বিশেষ প্রতিবেদনঃ
চিলেকোঠার বৈঠক – ২-এ চিলেকোঠা জলসাঘর :~ একটি প্রতিবেদন
সুস্মিতা সিং
গত ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪২১ বঙ্গাব্দ (ইং – ১৮ই মে, ২০১৪) সন্ধ্যায় চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের বর্ষিয়ান সদস্য ও আমাদের অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু, স্বপন দেবের আতিথেয়তায় শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে বসেছিল দ্বিতীয় চিলেকোঠার বৈঠক। চিলেকোঠা সম্মানিত।
চিলেকোঠার ইতিহাসে এ এক বিচিত্র ব্যঞ্জনাময় বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় একটি সন্ধ্যা। সেদিন ছিল চিলেকোঠার বৈঠকের পক্ষে চিলেকোঠা জলসাঘরের কবিপ্রণাম। নাচে, গানে, পাঠে, কবিকে স্মরণ করার সন্ধ্যা। এই কবিপ্রণাম আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে স্থান মাহাত্মে। শিহরিত হতে হয় এ কথা ভেবে যে, এমনি এক ঠাকুর দালানে আমরা কবিকে স্মরণ করার সুযোগ পেলাম, যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার গান গেয়ে গেছেন। ধন্য হোল চিলেকোঠা।
জ্যৈষ্ঠের এই মায়াবী সন্ধ্যা চিলেকোঠাকে দিয়ে গেছে আরো একটি মাইল ফলক। কবিপ্রণাম ছিলো চিলেকোঠার ২৫তম অর্থাৎ রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠান; সন্ধ্যার চিরস্মরণীয়তার আরো একটি অবশ্যম্ভাবী কারণ।
বলা হয় নি আরো একটি কথা। সেদিন ছিলো শোভাবাজার রাজবাড়ির গৃহদেবতা গোপীনাথ-রাধারানীর প্রতিষ্ঠা দিবসও। ঠিক বিকেল পাঁচটায় শুরু হোল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের সূচনায় চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের পক্ষে অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ও সংঞ্চালক শেখর রায় গৃহদেবতার প্রতিষ্ঠা দিবসের কথা মাথায় রেখেই একটি ভক্তিমূলক গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে ডেকে নিলেন সুগায়ক সদস্য বন্ধু তন্ময় গুপ্তকে। পরে আমরা তন্ময়ের কণ্ঠে শুনলাম – ‘ভালোবাসে সখি নিভৃতে যতনে......’
শুরু হোল এক মনোহরণ সম্মোহনী সন্ধ্যা। একে একে গানে বিভোর করলেন মিশমি রায় বণিক, শুভা ঘোষ, পীতম ঘোষ, নন্দিনী সেনগুপ্ত, রুমনি সেন, দেবযানী ব্যানার্জী, অনুরাধা বিশ্বাস। মাঝে মাঝে চলতে থাকল আবৃতি ও পাঠ – শামিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজাতা ঘোষ, তনুশ্রী মিত্র, তাপস ব্যানার্জী, মণিমালা চক্রবর্তী, স্বপন দেব, শাশ্বতী চন্দ – সত্যিই অনবদ্য !
আর দেখলাম ছোট্ট মেয়ে মধুরিমা মুখার্জীর নাচ – ‘জোনাকী, কী সুখে ওই ডানাদুটি...’ – জোনাকীর মতোই নিজের আলোয় আলোকিত মধুরিমা; বড়ো ভালো নেচেছিস রে, মেয়ে – ! নাচ দেখলাম নন্দিনী লাহারও।
সেদিন চিলেকোঠার আমন্ত্রণে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে নিয়ে বৈঠকে এসেছিলেন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত অসাধারণ ছবি ‘শুধুই অনুভব’-এর প্রযোজক ইন্দ্রজিৎ রায় সরকার, অন্যতম পরিচালক রাজেশ দত্ত, ছবির ছোট্ট নায়ক শ্রীমান আকাশ মুখোপাধ্যায়। শুনলাম ছবি তৈরীর গল্প। রবীন্দ্রজয়ন্তীর অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারেন নি সুদূর অষ্ট্রেলিয়ার মেলবর্ন থেকে আসা বিদেশী বন্ধু সিগফ্রেড অ্যাঙ্গেরার। বিশ্বকবিকে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন, ‘আমি চিনি গো, চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী....’ আবৃত্তি করে। আমরা অভিভূত।
মাঝে ‘রূপে তোমায় ভোলাব না’ – সাড়ে ১২ মিনিটের একটি নৃত্য আলেখ্য; বিষয় রবীন্দ্র নৃত্য-গীতিনাট্যের চার বিবর্তিতা নারী। অংশ নিলেন তুষিমা ভট্টাচার্য্য, মিতা নন্দন, অনন্যা ভট্টাচার্য্য, বুলা রায়, শ্রীরূপা চ্যাটার্জী, সুস্মিতা সিং ও দেবাশিস মিত্র। মুগ্ধতার রেশ যেন কাটতে চায় না।
এরই মধ্যে কখন শত্রু সময় নিঃশব্দ চরণে এসে দাঁড়ায় মন্দির প্রাঙ্গণে, হাতে তার সমাপনী যবনিকা। কিন্তু ‘শেষ হয়েও’ যে ‘হইল না শেষ’!! – তবুও শেষ তো করতেই হয় – ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যে ৮.৩০মিঃ। তাই তুষিমার একটি ভক্তিমূলক গান দিয়ে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হোল এই মায়া সন্ধ্যার।
এর পর গৃহদেবতার ভোগ প্রসাদ গ্রহণ। সে এক রাজকীয় ভোজের সুব্যবস্থা। কি নেই তাতে – পলান্ন থেকে পরমান্ন – এক নিখুঁত মেইনু! স্বপ্নের মতো কেটে গেল সারাটা সন্ধ্যা! কি বলে যে মনের তৃপ্তি প্রকাশ করি, বুঝতে পারছি না। কবি বন্ধু কিংশুক চক্রবর্তী যথার্থই লিখেছেন সেদিনের কথা -
রাজবাড়ির ঠাকুর দালান ? জলসাঘর ?
নাকি চিলেকোঠা ?
বলো, কি নামে তোমায় ডাকবো ?
কবিপ্রণাম ? রজত জয়ন্তী ? .........
নাকি কুলদেবের প্রতিষ্ঠা দিবস ?
কি বলে দিনটিকে মনে রাখবো ?
বলো, কি বলে দিনটিকে মনে রাখবো ?
স্বয়ং রাজামশাই জানালেন, আমার কাছে দিনটি ছিলো চিলেকোঠার রজত জয়ন্তী ও কবিপ্রণাম। কারণ, বিগত ২৫০ বছর ধরেই আমাদের গৃহদেবতার প্রতিষ্ঠা দিবস পালন হচ্ছে। কিন্তু, এই প্রথম গানে, নাচে, আবৃত্তিতে, পাঠে......এতো বর্ণাঢ্যতা, এতো গুনীজনের সমাবেশ, এতো স্বতঃস্ফূর্ততা – এর আগে আমি কোনও দিন দেখিনি। এমন কি, আমাদের পরিবারের সবাই চিলেকোঠার এই সাংস্কৃতিক বাতাবরণে এবং ভদ্র সভ্য ব্যবহারে উচ্ছ্বসিত। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, বা ইন্ডিয়াতে থাকবো, আমাদের বাড়ি চিলেকোঠার জন্য অবারিত দ্বার।।
-চিলেকোঠা আপ্লুত!
আসল কথাটা তো এখনো বলাই হল না। পরিবারের ৭৫ জন সদস্যের এমন এক পারফেক্ট পারিবারিক মিলন সন্ধ্যা জলবৎ তরলং নির্বিঘ্নতায় অতিক্রান্ত করতে পারলাম কেবলমাত্র দুটি মাত্র মানুষের আন্তরিক সাহায্যে। সমস্ত ব্যবস্থাকে নিখুঁত করতে যাঁদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য, তাঁরা হলেন চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের অন্যতম এডমিন অলোক চৌধুরী ও গৃহস্বামী রাজা স্বপন দেব। সেদিনের উপরি পাওনা রানী কৃষ্ণা দেব কে আমাদের মধ্যে পাওয়া। অতিথিবৎসল রাজ দম্পতির কাছে চিলেকোঠা কৃতজ্ঞ।
রাত ন’টা নাগাদ সেদিনের মতো ভাঙল মিলনমেলা। মন জুড়ে তখনো মায়া সন্ধ্যার জ্বলজ্বলে স্মৃতি; যে স্মৃতি রোমন্থন এখনো চলছে। ধন্যবাদ, সেই ফটোগ্রাফার বন্ধুদের যাঁরা এখনো অসংখ্য ছবি পোষ্ট করে চলেছেন চিলেকোঠার দেওয়াল জুড়ে। সেদিনের সন্ধ্যার স্মৃতিকে চট্ করে তাঁরা মলিন হতে দেবেন না, জানি নিশ্চিত।।
চিলেকোঠা পরিবারের ৭৫ জন নক্ষত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে রাজ পরিবারের প্রায় তিন’শ সদস্য সাক্ষী রইলেন কবিস্মরণের মধ্যে দিয়ে রজত জয়ন্তী উৎসবের এই স্মরণীয় সন্ধ্যার। এও এক পরম পাওয়া !! সব শেষে, সকলকে ধন্যবাদ জানাই, আসুন সকলে একসঙ্গে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার করে কামনা করি, আমাদের হাত ধরে চিলেকোঠার আগামীর চলার পথ এমনই স্বপ্নীল রজতশুভ্র হয়ে উঠুক !!
- ছবি সৌজন্যে -
চিলেকোঠার বন্ধুরা
চিলেকোঠার বন্ধুরা
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন