সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা

সম্পাদকীয়



চারপাশ আলোঝলমল, রাস্তার দুধারে সব বাড়ির গা বেয়ে নেমে আসছে আলোর ঝর্ণা, বিকেল হলেই শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে জ্যাম, বাসের জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে ক্লান্ত যাত্রী তবুও দেখে নিচ্ছে, প্যান্ডেলের ভিতরের দেবীমূর্তি রোদের যেমন তাপ, হটাৎ বৃষ্টিতে তা একটুও কমার নাম নেই---জানান দিচ্ছে , শহরের বুকে পূজো এল। আর তার সাথে সাথে এল চিলেকোঠার পূজোসংখ্যা।

হ্যাঁ, বন্ধুরা,

পূজোর গন্ধ নিয়ে আবার আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনটি প্রকাশ পেল, অজস্র সদস্যদের লেখা, ফটো, রন্ধন-প্রণালী, প্রবন্ধ, ও সদস্যদের সন্তানের লেখা নিয়ে।

আমরা পূজোসংখ্যাটি সাজিয়েছি, প্রবন্ধ, বিশেষ রচনা, পুরাতত্ব মুলক লেখা, জীবনীমূলক সাহিত্য, গল্প, কবিতা, মহাভারতের কথা , ছোটদের পাতা ও রান্নাঘর দিয়ে, যা পড়ে আশা করব আপনারা প্রত্যেকবারের মতই তৃপ্ত হবেন।

আমরা জানি, আপনারা সাগ্রহে পড়বেন, ও নিজেদের মতামত দিয়ে আমাদের এই পত্রিকাটির চলার পথ আরও সুগম করে তুলবেন--

পূজো খুব ভাল কাটুক আপনাদের, আনন্দে কাটুক, সবাইকে ভাল রাখুন, ভাল থাকুন।



নমস্কারান্তে,
চিলেকোঠার সম্পাদক মন্ডলী


স্মৃতিচারন - নন্দিনী সেনগুপ্ত চক্রবর্তী

আমার বাবা রামানন্দ সেনগুপ্ত
নন্দিনী সেনগুপ্ত চক্রবর্তী



১৯১৬’র ৮ মে (২৫ বৈশাখ) ঢাকা শহরে বাবার জন্ম হয়। ছোটবেলা কেটেছিল মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই)। আমার ঠাকুরদা সতীশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, ছিলেন রেলের ইঞ্জিনীয়র। তাই চাকরি সুত্রে তাকে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হত। ছোট বয়স থেকেই মাদ্রাজে থেকে বেড়ে ওঠার জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই তামিল ও তেলেগু ভাষায় সাবলীল আমার বাবা, কিন্তু তার ছেলেবেলায় বাংলাতে কথা বলতে পারতেন না। ১৯২৬ সালে বাবাকে আমার ঠাকুরদা শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের শিশু বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন। এই বিদ্যালয়েই উনি বাংলা শেখেন, এবং গুরুদেবের স্নেহচ্ছায়ায় প্রতিপালিত হতে থাকেন। শান্তিনিকেতনের প্রভাবে তার মনে যে শিল্প ও সংস্কৃতি বোধ জন্ম নিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তা সম্পূর্ণতা পেয়েছিল, সেই বোধই ছিল তাঁর পরবর্তী কালের অনন্য শিল্পচেতনার, পরিশীলিত রুচিবোধের অন্যতম ভিত্তি। গুরুদেব তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন নৃত্যনাট্য গীতিনাট্যের মহড়া দিতেন। অন্যান্য বিভাগের মত শিশু বিভাগের ছাত্রছাত্রীদেরও সেই মহড়া দেখার ও তাতে অংশ নেবার পূর্ণ অধিকার ছিল। এই মহড়া গুলিতেই বাবার মনে ভারতীয় ও বঙ্গ সংস্কৃতির এক সুদৃঢ় ভিত রচিত হয়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল গুরুদেবকে খুব কাছে থেকে দেখার এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। ১৯২৮ সালে আমাদের পরিবারে নেমে আসে এক বিরাট দুর্যোগ। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে আমার ঠাকুরদা‘র মৃত্যু হয়। এই বিপদ সামলাতে, আমার ঠাকুরমা তাঁর তিন ছেলেকে নিয়ে ফিরে যান নিজের ভিটে ঢাকা শহরে। এখানে উল্লেখ্য, বাবার বড় ভাই, আমার বড় জেঠু, ডঃ জে সি সেনগুপ্ত ছিলেন এক নামকরা শিক্ষাবিদ, যিনি পরবর্তী কালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।

আমার বাবা রামানন্দ সেনগুপ্তের আজ ৯৭ বছর বয়স। আমার বাবা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম বয়ঃজ্যেষ্ঠ এবং স্বনামধন্য আলোকচিত্রী বা সিনেম্যাটোগ্রাফার। প্রকৃত অর্থেই বাবা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের একজন পথিকৃত। কারিগরী বহু বিষয় আছে যা নাকি বাবাই প্রথম এই শিল্পে শুরু করেছিলেন। এদেশে বাবাই প্রথম আলোকচিত্র শিল্পী যিনি ‘টেকনিকালার’ এ ছবি তুলেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর পেছনে আছে এক ইতিহাস। বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর অগুস্ত রেনোঁয়া’র সুপুত্র অসাধারণ চলচ্চিত্রকার জ্যাঁ রেনোঁয়া ১৯৪৯-৫০ সালে ভারতে আসেন, তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘দ্য রিভার’ পরিচালনা করবার জন্য লোকেশন দেখতে। সেই সময়ে তখনকার নবীন চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে এই আগমন ছিল এক বিশাল ব্যাপার। তাঁরা অনেকেই সে সময় জুটে যান রেনোঁয়া’র সাথে, এদেরই মধ্যে ছিলেন তরুণ সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত প্রমুখ বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বরা। এদের মধ্যে ছিলেন তরুণ সুপুরষ যুবা রামানন্দ সেনগুপ্ত। বাবা তাঁর মিশুকে সপ্রতিভ স্বভাবের জন্য সহজেই রেনোঁয়া’র নজরে পড়ে যান। ১৯৩৮ সালে, বাবা ‘ফিল্ম করপোরেশন’ এ যোগ দেন, এবং তখন থেকেই ওনার ফিল্মের ক্যারিয়ারের শুরু। রেনোঁয়া আধুনিক প্রযুক্তির কাজ শিখতে উৎসাহী যুবক রামানন্দ কে ইংলন্ডে পাঠান ‘টেকনিকালার’ প্রযুক্তি শিখে আসার জন্য। বিলেতে গিয়ে ওই আধুনিক চলচ্চিত্র প্রযুক্তি আয়ত্ত করে বাবা যখন দেশে ফিরে এলেন তখন, রেনোঁয়া সাহেব তাঁর ‘দ্য রিভার’ শ্যুটিং শুরু করতে চলেছেন। বাবা ওই ছবিতে ‘অপারেটিভ ক্যামেরাম্যান’ হিসেবে কাজ করেন।

অর্ধেন্দু মুখার্জি পরিচালিত ‘পূর্বরাগ’ বাবার প্রথম বাংলা ছবি। এই ছবিতে বাবার সহকারি ছিলেন পরর্বতী কালের বিখ্যাত পরিচালক অসিত সেন। চলচ্চিত্র জগতের আজকের দিনের ও অতীতের বহু বিখ্যাত কারিগরদের হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছেই। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন দীনেন গুপ্ত ও সৌমেন্দ্যু রায়। আজ এদের পরিচয় আপনাদের কাছে আর আলাদা করে দেবার কিছুই নেই। স্বনামধন্য আলোকচিত্রী সৌমেন্দ্যু পরবর্তিকালে সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হন এবং দীনেন গুপ্ত পরিচালক হিসেবে তাঁর পদচিহ্ন রেখে গেছেন বাংলা ছবির ইতিহাসে। নানা কারণে ‘পূর্বরাগ’ ছবিটি কিন্তু বাংলা ছবির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। রামানন্দ সেনগুপ্তের সাথে এই ছবিতে আরো কয়েকজন বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন চলচ্চিত্র জগতে, এদের মধ্যে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গীতিকার হিসেবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও অভিনেতা হিসেবে জহর রায়।

আলোকচিত্র শিল্পী হিসেবে রামানন্দের ছবির সংখ্যা ৬৪। এদের মধ্যে তারপর নিশীথে, কান্না, শিল্পী, হেড মাস্টার, ডাক হরকরা, নাগরিক, কঙ্কাবতীর ঘাট, বোবা সানাই, তিন ভুবনের পারে, জয় মা তারা, হংস মিথুন, চারণ কবি মুকুন্দদাস, অভিশপ্ত চম্বল, রূপসী ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ছাড়াও, ওড়িয়া, অসমীয়া, ইতালিয় (ডকুমেন্টারি), ভাষার নানা ছবিতে, রামানন্দ তাঁর শিল্প সত্বার উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন। তাঁর তোলা ছবি গুলি বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই অসামান্য আলোকচিত্রীর কাজের বৈশিষ্ঠ গুলো পরিস্কার হয়ে ওঠে। তাঁর কাজের ছিল এক নিজস্ব স্টাইল, যার অন্যতম মূল উপাদান ছিল ন্যাচারল লাইট, বা স্বাভাবিক আলো। এ ছাড়া ছবির বিভিন্ন দৃশ্যর মেজাজের সাথে খাপ খাইয়ে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, তাঁর ফ্রেম, আলোর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার করে এবং প্রয়োজন মত তাকে পরিবর্তন করে ছবিতে এক অদ্ভুত ‘মুড’ সৃষ্ঠি করে রামানন্দ এক অনন্য চলচ্চিত্র ভাষার সৃষ্ঠি করতেন। নাটকীয় আলো-আধাঁরির রাতের দৃশ্যের লাইট করতে উনি সবচেয়ে ভালবাসতেন, এবং তাঁর তোলা ছবিগুলি দেখলেই বোঝা যায় এ বিষয়ে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে রামানন্দ সেনগুপ্তের অবদান শুধু আলোকচিত্রী হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়। সামগ্রিক ভাবে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের যাতে উন্নতি সাধন হয়, যাতে আরো উন্নতমানের ছবি এখানে তৈরি হয়, সে বিষয়ে উনি সারা জীবন নিরলস ভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন। এই লক্ষেই বাবা এবং তাঁর কিছু বন্ধুরা মিলে কলকাতার টলিগঞ্জে বিখ্যাত টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োটি স্থাপন করেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর বিখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’ ছবির কিছু অংশ শ্যূট করেছিলেন এই স্টুডিয়ো তে। এই স্টুডিয়ো স্থাপনের জন্য, তাকে সুষ্ঠু ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, বাবাকে নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আজও যখন আমরা তাঁর সাথে কথা বলি, তখন বুঝতে পারি এই স্টুডিয়ো’র প্রতি এখনো তাঁর কি অপরিসীম ভালবাসা রয়ে গেছে।

ফিল্ম জগতের মানুষদের এক অন্য গ্ল্যামার হয়, সাধারণের চোখে স্বভাবিক ভাবেই তারা হয়ে ওঠেন এক অন্য জগতের মানুষ। তাই চলচ্চিত্রের সাথে জীবনভর জড়িয়ে থেকে রামানন্দ সেনগুপ্ত, আসল মানুষ হিসেবে কেমন, তাঁর কিছু কথা আপনাদের বলি। আমার বাবার যে দুটি গুণ আমাকে সবচেয়ে আকৃষ্ঠ করে, মুগ্ধ করে, তা হলো তাঁর রুচিবোধ ও জীবনযাত্রায়, পোশাকে, আচারে ব্যবহারে পরিমিতি বোধ। বরাবর মুগ্ধ হয়ে দেখেছি এক অসাধারণ সুপুরুষ চেহারার অধিকারী বাবার পোশাক নির্বাচন তাঁর যে অনন্য রুচির পরিচয় দিত, আজও ৯৭ বছরেও তা বর্তমান। আমাদের একটা কথা উনি সবসময় বলেন “এমন কোনও পোশাক পড়বে না, যাতে তুমি সামনে এলেই, তোমার আগে তোমার পোশাকটি চোখে পড়ে!”।

গুণী শিল্পী হিসেবে, একজন সৎ মানুষ হিসেবে, তাঁর নিজস্বতা বোধ, বিনীত স্বভাব ও নিয়মানুবর্তিতা’র জন্য ইন্ডাস্ট্রির সবার শ্রদ্ধার মানুষ, কাছের মানুষ, ‘রাম’দা’ তাঁর দীর্ঘ কর্ম জীবনে বরাবর সবারই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়ে এসেছেন। কাজের মানের ব্যপারে, তার উৎকর্ষের ব্যপারে কোনদিনও কারোর সাথে আপোষ করেননি শিল্পী রামানন্দ। সে হিসেবে তিনি এক ‘পারফেকশনিস্ট’। আর তাঁর এই গুণের জন্যই বিখ্যাত নায়িকারা চাইতেন, তাঁদের প্রিয়, ‘রাম’দা’ যেন তাঁদের ছবির ক্যামেরাম্যান থাকেন। কারণ তারা জানতেন ক্যামেরায় রামানন্দ সেনগুপ্ত থাকলে, ছবিতে একেবারে নিখুঁত লাইট করে, তাঁদের চেহারার এক নিখুঁত রুপ ফুটিয়ে তুলবেন রামানন্দ, সেই সব নায়িকাদের করে তুলবেন আরো বেশী সুন্দর।

খুব রসিক মানুষ আমার বাবা। ঠিক সময়ে মজাদার রসাল মন্তব্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এব্যপারে ছবির জগতের অনেকের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। একদিন, এক শ্যূটিং এর অবসরে সবাই মিলে গেছেন এক রেস্তোঁরায় খেতে, অনেকের সাথে অভিনেত্রী অপর্ণা সেনও আছেন সেদিন। যেখানে খেতে গেছেন, সেখানেই পাশের টেবিলে এক বিদেশী পরিবার খেতে বসেছেন। তাঁদের সাথে একটি শিশুও আছে। কোনো কারণে বাচ্চাটি খুব কান্নাকাটি করছিল। সেই হট্টগোলে সবাই যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন বাবা’র সরেস মন্তব্য “ওরে বাবা, সাহেবের বাচ্চাও কাঁদে নাকি?” সেই শুনে সবার সাথে রিনা’দিও (অপর্ণা সেন) হেসে লুটোপুটি। পরে অনেক বার রিনা’দি বাবার কথা উঠলেই, হাসতে হাসতে সেদিনের সেই মজার কথা বলতেন। এরকম আরো কত টুকরো স্মৃতি, কত গল্প... সে সব বলতে গেলে আজ এই লেখা শেষই হবে না।

আমার মতে, একজন শিল্পী হিসেবে বাবার সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হল তাঁর আধুনিক-মনস্কতা। নূতন কে বরাবর বাবা স্বাগত জানিয়েছেন। এমন একটা মাধ্যমে বাবা কাজ করতেন, যেখানে প্রতিনিয়ত নানা নূতন কারিগরি প্রযুক্তি, নানা ধরণের ক্যামেরা, লাইট সব এসেছে, বাবা সব আগ্রহের সাথে শিখেছেন, জেনেছেন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে নিজেকে এবং চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই জন্যেই। কি চেহারায়, কি মনে, তিনি এক ‘চির যুবক’। তাঁর জীবন শুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে, পরবর্তীকালে জ্যাঁ রেনোয়াঁ, সত্যজিৎ রায়, এবং আরো অনেক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের সাহচর্য লাভ করেও, বাবা কিন্তু তাঁর কাজে, মননে জীবনযাত্রায় ভীষণ ‘অরিজিন্যাল’ নিজস্ব। এই নিজস্বতাই তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ। এখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের শততম বর্ষে, ৯৭ বছরের আধুনিক যুবক, প্রবাদপ্রতিম আলোকচিত্রী রামানন্দ সেনগুপ্তের চলচ্চিত্র জগতে অনস্বীকার্য অবদানের কথা স্মরণ রেখেই, গত ১৬ তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন বাবাকে দিয়েই করানো হয়েছিল। সারা জীবনে তাঁর কাজের জন্য বহু সম্মান পুরস্কার বাবা পেয়েছেন, এর তাঁর সুনামের জন্য আজও পেয়ে আসছেন।

আমরা সবাই এই চিরনবীন যুবকের শততম জন্মদিনের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ। উনি সুস্থ থাকুন, ঈশ্বরের কাছে এই কামনা। চিলেকোঠার অনলাইন ম্যাগাজিনে পূজোসংখ্যা উপলক্ষে, এই ছোট্ট লেখাটি আমার বাবা’র প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং ভালবাসার উপহার।


রম্যরচনা - পিনাকি চক্রবর্তী

বোম্বে হাইওয়ে 
পিনাকি চক্রবর্তী



সাহাব, ই তো কারবুরেটর ওভারফালোট হ্যায়...

এক সপ্তাহ ধরে তিওয়ারীজীকে যতোটা চিনেছি, গাড়ীর আভ্যন্তরিক ব্যাপারে ইনি সাঙ্ঘাতিক রকম সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলে থাকেন। কিন্তু কারবুরেটার ওলোট পালোট মানে কি? ভেঙ্গেচুরে গেল নাকি ইঞ্জিনটা? জীপের বনেট খুললে সেটা এসে উইন্ডস্ক্রীনের ওপর চেপে বসে, ভেতরে বসে কিছুই বোঝা যায়না বাইরে কি হচ্ছে। তড়াক করে নেমে এসে তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আড়ে আর বহরে জীপের প্রায় সমমাপের তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে কিছু দেখা সহজ নয়। শুধু এইটুকু বুঝলাম যে তিনি অভিমানিনী প্রিয়ার মানভঞ্জন করার জন্য একটা স্প্যানারের উলটো দিকটা দিয়ে ইঞ্জিনের প্রত্যন্ত প্রদেশে কোথাও আলতো করে ঠোনা মেরে যাচ্ছেন একমনে। কোনো কথায় কান দিচ্ছেন না। হতাশ হয়ে বিকল জীপটার সঙ্গ ছেড়ে রাস্তার পাশের একটা মাইলস্টোনের ওপর চেপে বসে গত সপ্তাহের ঘটনাবলী মনে মনে রোমন্থন করতে লাগলাম।

একটা তেলের কম্পানিতে জিওলজিস্টের চাকরী করি, দেশের ঈশান কোণের পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই তেলের সন্ধানে, হাতে হাতুড়ি আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং তাম্বুমন্দিরে। হঠাৎ হেডকোয়ার্টারে তলব।

পিনাকী, তোমাকেই গাড়ীদুটো নিয়ে যেতে হবে ভাই কাঁঠালিয়া পর্যন্ত। বলবিন্দর সিং রানাওয়াত, আমার পার্টী চীফ এবং বন্ধু, অনুরোধের সুরে বলেছিলো আমাকে। হাবেভাবে মনে হচ্ছিল ‘সিধে রাস্তা, সোয়া ঘন্টার পথ, গেলেই হল’ – এইরকম কিছু একটা বোঝাচ্ছে আমাকে। পার্টীচীফ যখন বলছে, সেটা তো আর অনুরোধ নয়, হুকুম, সুতরাং যেতেই হবে। কিন্তু, সত্যি করে তো আর কিছু সোয়া ঘন্টার পথ নয়, কলকাতা থেকে ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্ত, হিসেব মত দু হাজার কিলমিটারের ওপর। দুই দুটো জীপ, পেছনে ট্রেলারে ভর্তি যন্ত্রপাতি, তাঁবু, খাটিয়া মায় বিছানা পর্যন্ত, মাক্সিমাম স্পীড উঠবে চল্লিশ। দিনে দুশো কিলোমিটার গেলে মোট লাগবে দশ এগারো দিন, তাও যদি গাড়ী ঠিকঠাক চলে। নাহলে খোদায় মালুম কবে পৌঁছাবো।

তাও নাহয় হলো, কিন্তু সঙ্গে যাবে কে? ড্রাইভার তিওয়ারীজী আর জোরা সিং এবং অ্যাটেন্ডেন্ট ভুট্টিপ্রসাদ। অন্য একজন অফিসার কই? আর কেউ নেই, তোমাকেই সামলাতে হবে দুটো গাড়ী। যাব্বাবা! রাস্তাঘাটে কিছু বিপদ আপদ হলে কি হবে? আপদ বিপদ কিছু হবে না, গাড়ী দুটো টনাট্টন সারানো আছে। প্লীস্ পিনাকী, আর কেউ নেই আমার হাতে!

মানে? আমি ওর হাতে আছি? আহ্লাদের ঘনঘটা আর কি! আমাকে পেয়েছে কি ও? আর, এই তো গাড়ী সারানোর নমুনা! প্রথম দিনে বারাসাত পৌঁছতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। তিওয়ারীজীর গাড়ী “মৌসম পাকড়তিহী নহী।” অনেক হাঁচোড়পাঁচোড় করে বুঝলাম মৌসম মানে মোশন, সাদা বাংলায় গাড়ী পিকআপ নিচ্ছে না। আমরা যতক্ষণ চাঁপাডালির মোড়ে পাইস হোটেলে ডালভাত খেলাম, তিওয়ারীজী গাড়ীর মৌসম ঠিক করলেন। তারপর সন্ধ্যেবেলা মধ্যাহ্নভোজন করলেন তিনি। বহু কষ্টে বহরমপুর পৌঁছলাম মাঝরাতে।

প্রথম দিনের ধাক্কায় পরের দিন দেরী হয়ে গেল বেরোতে বেরোতে। বহরমপুর থেকে লালগোলা, ফরাক্কা, মালদা হয়েরায়গঞ্জ এসে সব্বাই ক্লান্ত। থেকে গেলাম রায়গঞ্জ ডাকবাংলোতে। পরের দিন রায়গঞ্জ থেকে বেরিয়ে ইসলামপুর সবে পেরিয়েছি আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে, এমন সময়ে ঘটংঘট করে গাড়ী ফুলস্টপ। আশীর্বাদের ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নেবেন না। যাঁরা রাস্তাঘাটে যাতায়াত করেন তাঁরা বুঝবেন ইন্টারস্টেট বাউন্ডারি একবার এপার একবার ওপার করা কি যন্তর জিনিস! আর এই ঘটনাটা ঘটে ডালখোলা থেকে কিষাণগঞ্জ হয়ে ইসলামপুরের পথে দুই দুবার। সারা পৃথিবীর যত ট্রাক, টেম্পো, ঠেলাগাড়ী – সব দাঁড়িয়ে থাকে বর্ডার চেকপোস্টে – লাইন দিয়ে নয়, জট পাকিয়ে। সেই যানজট দুবার করে ঠেলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি সবে, এমন সময় “রেডিওয়াটার লীক হোগয়া।” এটা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য রোগ। রেডিয়েটর লিক করে জল সব বেরিয়ে গেছে। তা মাঝরাস্তায় রেডিয়েটর ঝালাইমিস্ত্রী কোথায় পাই? জোরা সিংএর জীপটাকে ট্রেলারমুক্ত করে মিস্ত্রী আনতে পাঠাবো নাকি? তিওয়ারীজী পরম আশ্বাসে বললেন, “হজৌর, ঘাবড়াইয়ে মত, অভী দুরুস্ত কর দেতে হেঁ।”

নিজের কালো রঙের একটা টয়লেট ব্যাগ থেকে ঝপ করে বের করলেন একটা কাপড় কাচার ৫০১ বার সাবান। ছুরি দিয়ে তার একটা টুকরো কেটে নিয়ে, অল্প জল দিয়ে টিপেটুপে সেটাকে একটা নরম পুট্টি বানিয়ে ফেলে যেখানে যেখানে লিক বলে সন্দেহ ছিল সেখানে নিপুণ হাতে তাপ্পি দিয়ে দিলেন। আমি তাজ্জব! তারপর একটা জেরিক্যানে এইরকম সম্ভাবনার কথা ভেবেই বোধহয় জমিয়ে রাখা জল দিয়ে “রেডিওয়াটার” আবার শূন্য হতে পূর্ণ হল, এবং অচল গাড়ী আবার সচল হোলো। কিন্তু দশ-বারো কিলোমিটার যেতে না যেতেই আবার লিক, আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই উপর্যূপরি যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি শিলিগুড়ি পৌঁছে, ফাটা রেডিওয়াটার ঝালাই করিয়ে।

শিলিগুড়ি থেকে গোঁসাইগাঁও তিওয়ারীজীর গাড়ী কোনোরকম বেগড়বাঁই করে নি। রাস্তায় গুচ্ছ গুচ্ছ নদী, আমি মনে মনে স্কুলের ভূগোল বইএর পাতায় ডুব দিয়ে মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক গুণতে গুণতে চলেছিলাম। কিন্তু তখনই এল জোরা সিংএর পালা। তার জীপের ট্রেলার টানার হূক-ব্লকটার “রিপিট” গেল কেটে, হাসিমারার কাছাকাছি। এটার আর কোন টোটকা দাবাই হয় না। ট্রেলার খুলে জোরা সিং ভুট্টিকে সাথে নিয়ে গিয়ে রিভেট করিয়ে আনল কোথার থেকে যেন, ঠিক মনে নেই। আমার যা মনে আছে তা হোলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে থেকে হঠাৎ হঠাৎ কানফাটা শব্দ তুলে জোড়ায় জোড়ায় যুদ্ধবিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো, আর আমি হাঁ করে তাদের ডেলটা উইং আর নোজকোন দেখে এরা মিগের কোন প্রজাতী বোঝার চেষ্টামাত্র করছিলাম।

রিভেট করে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেল, আর তাই আমরাও মেরেকেটে বড়পেটা ডাকবাংলো পর্যন্ত পৌঁছলাম রাত আটটায়। মাঝখানে গোঁসাইগাঁওএ আসামের সীমানা শুরু। সেখানে সব কাজও হয় লাহে লাহে (মানে আস্তে ধীরে)। জীপের সামনে “ভারত সরকার” লেখাটা আবার ওই মুল্লুকে ব্যাকফায়ার করতো সেই যুগে। সে যাইহোক, বড়পেটা জায়গাটা বড়ই মনোরম। একবার ভেবেছিলাম শেষজীবনে বড়পেটায় একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ি বানিয়ে থাকব। পাশে নদী, পেছনে ভুটানের হিমালয় পাহাড় আর নীল জঙ্গল, সামনে সবুজ মাঠ। ভাগ্যিস আজকাল আর ভাবি না!

পরদিন বড়পেটা ছেড়ে গৌহাটীর পথে রঙ্গিয়ায় দেখা হলো ব্রহ্মপুত্রের সাথে। আর জীপ তাই দেখে চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তিওয়ারীজীর কম্পাউন্ডারি বিদ্যেতে এবার আর কুলালো না। ভালো জীপটা প্রথমে খারাপটাকে টেনে নিয়ে গেলো গৌহাটীতে মাহিন্দ্রা ওয়ার্কশপএ, তারপর একে একে দুটো ট্রেলারকে টেনে নিয়ে এলো গৌহাটীর একটা হোটেলে। রাত কাটলো দুশ্চিন্তায় আর বদহজমে।

পরদিন সক্কালবেলা ভগ্নদূতের মতো তিওয়ারীজী এলেন হোটেলে, জানালেন যে জীপের “ইলিক্ট্রিক ফায়ার ফুঁক গয়া”... ইলেকট্রিকের আগুণ, মানে স্পার্ক প্লাগের কো্নো গন্ডগোল? আরে নহী সাহাব, তিওয়ারীজী আমাকে বোঝানোর আশা অনেক আগেই ত্যাগ করেছেন বোঝা গেল, পকেট থেকে একটা ছোট্ট তেঁতুলেবিছে টাইপের দাঁড়াওয়ালা কি যেন বের করে আমার হাতে দিলেন। তখন বয়েস কম, চোখের তেজ বেশী, দেখলাম ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে লেখা আছে লুকাস আরসিটি ১২ভি এসি। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে একটা প্রশ্ন এল, বললাম, এটা কি অলটারনেটারের রেক্টিফায়ার? এক প্রশ্নে আমার হৃত সম্মান পুনরূদ্ধার হয়ে গেলো। সসম্ভ্রমে তিওয়ারীজী বললেন, জী হজৌর!

সেই যে গাড়ী ঠিক হলো, তারপর গৌহাটী থেকে জোড়াবাট, উমস্নিং, শিলং, জোয়াই হয়ে বদরপুর টপকে নীলমবাজার থেকে ধর্মনগর যাবার পথে আর কোন ঝামেলা হয় নি। সেটা হতে হোল শেষমেশ এই উগ্রপন্থীদের আড্ডা বারোমূড়ায়? আগরতলা আর মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূর, জানাচ্ছে আমার নীচে থেকে এই মাইলস্টোনটা!

কি করে পার পেলাম সে যাত্রা? কিভাবে পৌঁছলাম কাঁঠালিয়া? আদৌ পৌঁছলাম কি? আর না পৌঁছালেই বা ক্ষতি কি? সে সব প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। অন্য কোনোদিন হবে, যদি আপনারা সত্যিই জানতে চান। কিন্তু একটা কথা আজ বলা দরকার, সেটা হোল এই গল্পের নামের সাথে গল্পটার সম্পর্কের কথা।

এই ঘটনার সাত বছর পরে আমি ফিরেছি তিওয়ারীজীর সাথে, মিজোরাম থেকে। ফিরেই হাতে পেলাম ট্রান্সফার অর্ডার। যেতে হবে বোম্বে উপকূলে, আরব সাগরের মাঝে তেলের সন্ধানে। সেই সময়ে বোম্বে হাই দৈত্যপ্রায় তেলের খনী, দেশবাসী মাত্রেই এর নাম জানেন। সেই অঞ্চলে কাজ করতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। সহকর্মীরা সবাই ব্যাজার, ফিল্ডপার্টীর কাজে সবাই এক পরিবারভুক্ত হয়ে কাজ করেন, তাই কারুর যাওয়াটাই সহজে মেনে নেন না। কিন্তু বোম্বে হাই বলে কথা!

বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সবাই একে একে ভাষণ দিলেন, আমার নিজের গুণপনার কথা নিজের কানে শুনতে শুনতে আমার মত নির্লজ্জেরও কান লাল হলো। আমাকে যিনি এতদিনে সবচেয়ে ভাল করে চিনেছেন, সেই তিওয়ারীজী বলতে উঠলেন সবার শেষে। পাত্থর থেকে ইঞ্জিন পর্যন্ত সব ব্যাপারে আমার জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি জানালেন যে আমি যেরকম আসাম থেকে ত্রিপুরা, সর্বত্র সুনাম অর্জন করেছি, তিনি আশা করছেন যে বোম্বে হাইওয়েতেও আমি ততটাই কর্মদক্ষতা দেখাতে পারব!

অভিজ্ঞ ড্রাইভার মানুষ, বোম্বে হাই কে বোম্বে হাইওয়ে করে নিয়েছিলেন নিজগুণে!

বয়োজ্যেষ্ঠ তিওয়ারীজীর আশীর্বাদে আর আপনাদের শুভেচ্ছায় আমি কিন্তু পেরেছি!ওই কর্মদক্ষতা দেখাতে, আর কি!

বিশেষ প্রতিবেদন - তিমিরকান্তি পতি

পুরাতাত্ত্বিকতার আলোকে বাঁকুড়ার গ্রাম - হাড়মাসড়া
তিমিরকান্তি পতি



জেলা শহর বাঁকুড়া থেকে ৩২ কিমি ও মহকুমা শহর খাতড়া থেকে ১৯ কিমি দূরে অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী জন পদ হাড়মাসড়া। গ্রামের এরূপ নাম নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই বলেন হাড়াম নামে কোন আদিবাসী সর্দারের নামানুসারে এরূপ নামকরণ। তাঁদের যুক্তি সাঁওতালী ভাষায় অড়া শব্দের অর্থ বাসস্থান । অর্থ্যাৎ হাড়াম > অড়া = হাড়ামের বাসস্থান বা বাড়ী। ক্রমে হাড়ামঅড়া থেকে আজকের হাড়মাসড়া। কয়েক ঘর আদিবাসী বসতি ছাড়া এর কোন প্রামান্য নেই।

বাঁকুড়ার তালডাংরা ব্লকের এই গ্রামটিতে কান পাতলে আজও শোনা যায় জৈন ও বৌদ্ধ যুগের ইতিহাসের পদধ্বনী। এখনো খোলাচোখে দেখতে পাওয়া যায় গ্রাম / এলাকার আনাচে কানাচে অযত্নে, অবহেলা আর অনাদরে নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য বাঁকুড়া – খাতড়া ভায়া হাড়মাসড়া বাস রাস্তায় গেলেই সবার নজর কাড়বে ৩০-৩২’ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মাকড়া পাথরে নির্মিত একটি জৈন মন্দির। স্থানীয় বয়োঃ জ্যেষ্ঠ মানুষজন ও পুরাতাত্তিকদের মতে, এরকম মন্দির এই গ্রাম ও এলাকায় আরো ছিল। তার উৎকৃষ্ট প্রমান ঐ মন্দির চত্বর ছাড়াও পার্শ্ববর্ত্তী কেশাতড়া ও ভীমাড়া গ্রামে এরূপ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, শিলাবতী নদী তীরবর্ত্তী অঞ্চলে ঐ সব জৈনমন্দির জৈনধর্মালম্বী উত্তর কলিঙ্গের রাজা ষোড়শ শতাব্দীতে এই সব তৈরি করেছিলেন। বিশিষ্ট্য প্রাবন্ধিক , লেখক ও কবি প্রয়াত শক্তি সেনগুপ্ত তাঁর ‘ দামুন্দা কপিসা শিলাবতী গ্রন্থে ( অক্টোঃ ১৯৯৬ ) উল্লেখ করেছেন , “ গ্রামের সানবাঁধা পুকুর খনন কালে ৬ ফুট উচ্চতার সপ্তনাগ ফনাবিশিষ্ট্ ক্লোরাইট পাথরের একটি পার্শ্বনাথ মূর্তি পাওয়া গেছে । ঐ পুকুর খননকালে আরও দুটি জৈন্ তীর্থঙ্কর মূর্ত্তি পাওয়া গেছে যার মধ্যে একটি সিংহলাঞ্ছিত মহাবীর ও অপরটি নেমিনাথ মূর্ত্তি। যা এখনও পাঁচঘরিয়া পাড়ার শিব মন্দিরে রক্ষিত আছে। ঐ গ্রন্থে তিনি আরো অভিমত প্রকাশ করেছেন , “ বর্তমান মন্দিরের সমগ্র পশ্চাদ ভূমি ও ভিত্তি অঞ্চল, কাছাকাছি সানবাঁধা ও পতির পুকুরের সূ উচ্চ ভূমি, পলাশ ডাঙার ঢিবি অঞ্চল দেখে আমার মনে হয়েছে, যে অর্ধমাইল পরিধি বিশিষ্ট এই উচ্চ ভূমি ভাগের সমস্তটাই একটি খননযোগ্য প্রত্নভূমি। এখানে অনেক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপে বহু প্রত্ন বিষয় উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে ।

এছাড়াও ঐ সানবাঁধা পুকুর পাড়েই গাছের তলায় সপ্তনাগ ফনাবিশিষ্ট্ একটি প্রাচীন মূর্ত্তি আছে। যা নাকি ঐ পুকুর খনন কালে পাওয়া যায়। স্থানীয় ‘ হাঁড়ি সম্প্রদায়ের মানুষজন এই মূর্ত্তিটি কে ভক্তি ভরে খাঁন্দারানী নামে পূজা করেন । পার্শ্ববর্তী ভীমাড়া – কেশাতড়া গ্রামের মানুষের অভিমত,এই মূর্ত্তিটি খাঁন্দাসিনী জঙ্গল থেকে রাতের অন্ধকারে তুলে আনা। তাই এর নাম খাঁন্দারানী।

শিলাবতী নদী তীরবর্ত্তী এই অঞ্চলটি যে অতি প্রাচীন ও এক কালে যথেষ্ঠ সমৃদ্ধশালী ছিল তার প্রমান মেলে। এই নদীর ঘাট গুলির নাম যেমন- ইটাঁপোড়া, শতীরডাঙা, শহরঘাটা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়াও এখানের সুলগী ও চুনালু মৌজাতে মাঠ খনন কালে আজও পোড়া মাটির পাত্র, ভাঙা অস্ত্র – শস্ত্র, লোহা গলাবার উনুন মেলে। এর থেকেই আন্দাজ করা যায় এলাকাটি শিল্প সমৃদ্ধ ছিল।

কিন্তু এই সব উদ্ধারে সরকারী স্তরে কোন পদক্ষেপ নেই। যদিও সম্প্রতি ‘ ওয়েষ্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন ; ১৬,৯৮,৩৪৮ টাকা ব্যায় করে প্রাচীন জৈন মন্দিরটি সংস্কার করেছেন। এখনই এই সব অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্জ না চালালে প্রকৃতি ও মানুষের আগ্রাসনে একদিন হারিয়ে যাবে এই প্রত্ন নির্দশন।


প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

সকলেই কবি
শ্রীশুভ্র



না কেউ কেউ কবি নয়! সকলেই কবি! বিশেষত যদি বাঙালি হন, আর লগইন করেন ফেসবুকে! তবে স্ট্যাটাসে কীপ্যাড ওপেন করলেই কাব্যসরস্বতী আপনার অধীনস্ত! অক্ষর জুড়ে অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, দলবৃত্ত তছনছ হতে পারে! ধর্ষিত হতে পারে ছন্দ অনুপ্রাস কাব্যমাত্রা! কিন্তু কবিতাদেবীর শরীরের বিভঙ্গে শব্দযোজনা করলেই আপনি কবি! সম্পাদকের কাঁচি নেই! প্রকাশের জন্য অপেক্ষা নেই! বন্ধুবৃত্ত যত জোরালো তত লাইক! কমেন্টের হুল্লোর আছড়ে পড়বে আপনার পোস্টের মার্চপাস্টে, ট্যাগের মিসাইলে অধিকৃত করতে পারবেন যত বেশি বন্ধু দেওয়াল! শেয়ার বাটনে সৌরভ ছড়াবে আপনার কবিখ্যাতির নতুন দিগন্তে! শুধু একটা লগইনেই বঙ্গলক্ষ্মীর কাব্যভাঁড়ারের চাবি আপনার হাতে!

সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু যুগ পূর্বেই বলে গিয়েছিলেন, বঙ্গসন্তান যৌবনে কাব্যচর্চা করবে না, এ হয় না! বঙ্গজীবনে বাঙালির কাব্যচর্চার ধারার বিবর্তন হয়েছে নানান ভাবে, যুগ পরিবর্তনের নানা পর্বে! কিন্তু পরাধীন জাতির- বৃটিশের স্কুলে প্রবেশ করে কাব্যচর্চায় ঘটে গিয়েছিল এক বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আর কবিকৃতী যেন সমান্তরাল পদধ্বনী করে এগিয়ে চলছিল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আধুনিক পর্বে! হয়ত সেই কারণেই কবি জীবনানন্দ দাশকে উচ্চারণ করতে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক সাবধানবাণী; "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি" কবি যশ প্রার্থী বাঙালি অবশ্য তাতে কান দেবার পাত্র নয়! দেয়ও নি তাই কোনোদিন!

ছাপাখানার চৌহদ্দীর সেই যুগে জীবনানন্দ কল্পনাও করে যেতে পারেন নি- আজকের লগইন অনলাইনের এই যুগের কাব্যসুনামীর প্রলয়ের বর্তমান চিত্রটি! ইনটারনেট পত্তনের আগে, পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষার সেই যুগেই কবি অস্থির হয়েছিলেন অকবির সংখ্যাধিক্যে! আর আজ তিনি জীবিত থাকলে হয়ত দমবন্ধ হয়েই মমি হয়ে যেতেন আমাদের দাপাদাপিতে! কিন্তু আমরা বাঙালিরা কাঁটাতারের কী এপাড়ে, কী ওপাড়ে সেকথা ভেবে দমার পাত্র নই! আমাদের অফুড়ন্ত দম! সেই দমেই দমদমাদম কবিতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে অনলাইনে!
কিন্তু কি লিখছি আমরা? কেন কবিতা! কবিতাই তো?
কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়, সেই সীমারেখাটা কি ধুয়ে যায় নি ইনটারনেটের পক্ষ বিস্তারে?

কবিতা আর অকবিতার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্যের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন কবি; ইনটারনেটে কাব্যচর্চার যুগে সে পার্থক্যের বিষয়ে আমরা কজনই বা আর খেয়াল রাখি? জীবনবোধের পরতে পরতে, অভিজ্ঞতা আর সজ্ঞান কালচেতনার যুগলবন্দীতে- সমাজ সভ্যতা ও ইতিহাস জ্ঞানের বিস্তারে; প্রাত্যহিক জীবনের পরিধিতে- শাশ্বত জীবনবোধের সুস্পষ্ট মায়াবী উদ্ভাসনের যে প্রবল সংঘটনের অন্যতম অভিমুখই হলো কবিতা; সে কথা আজকের এই লগইন সভ্যতায় কজনই বা আর অনুভব করি আমরা? কতগুলি মনের ভাবনা বা বক্তব্যের পরিস্ফূটনে আপাত অসংলগ্ন কিছু শব্দ বিন্যাসের মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক ছবির উদঘাটনকেই কবিতা বলে ভুল করে বসি অধিকাংশ সময়েই!

জীবনযাপনের চর্চার মধ্যে নান্দনিক প্রত্যয় এবং ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্বন্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা ও দেশ আর জাতীয়তার শিকড়ের সাথে নিবিড় সংযোগ না থাকলে, যে কবিতা লেখা সম্ভব নয়, ভুলে যাই আমরা সেই মূল সত্যটাকেই! অনেক সময়! তাই বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ করে অনলাইনে- মূলত শব্দ বিন্যাসের কারিকুরিকেই কাব্যচর্চা বলে ভেবে বসি! কারণ জীবনযাপনের পরিসরে আমরা সাধারণত ভাসমান কচুরীপানার মতোই জীবনের উপরিতলে ভেসে বেড়াই! ফলে কোনো গভীর জীবনবোধের সামনাসামনি হতে আগ্রহী হই না আমরা!সেখানেই আমাদের কাব্যচর্চার পরিসর জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে! আর জীবন বিচ্ছিন্ন লেখা কখনোই হয়ে ওঠে না কবিতা!

জীবনবোধের অগভীর তল থেকে এই যে আমাদের প্রাত্যহিকতা, এই কারণেই সমস্ত কিছুর সাথেই আমদের সংলগ্নতা বড়োই আলগা হয়ে পড়ছে ক্রমশ! ক্রমশই আমরা নিজেদের জীবন প্রক্রিয়ার চারপাশে কখনো তৃপ্তি কখনো বা অতৃপ্তির আত্মগত একটি সংকীর্ণ বলয় তৈরী করে ফেলছি! যার মধ্যে থেকে সমগ্র জীবনবোধের গভীরে পৌঁছাতে পারছি না আমরা কিছুতেই! হারিয়ে ফেলছি বৃহৎ মানবজীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিজীবনের মূল প্রেক্ষিতটাকেই! আর ঠিক সেই কারণেই বিস্তৃতভাবে বাংলা কাব্যচর্চা আজ আর ঠিক সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতে পারছে না! হয়ে উঠতে পারছে না আমাদের জীবনযাপনেরই মূল অনুষঙ্গ! এর সাথেই যোগ হয়েছে নেটদুনিয়ায় "আমরা সবাই কবি, আমাদের এই লগ-ইনের দৌলতে!"-মানসিকতা!

তাই তো আজ নেট দুনিয়ায় বাংলা কাব্যসাহিত্যে ঘটে গেছে কবিদের বিপুল বিস্ফোরণ! লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, যে পরিমাণে কবিতার সুনামি আছড়ে পড়ছে প্রতিদিন নেটের দেওয়ালে, তার সিকি ভাগও কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে না সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলিতে! একটু ভাবলেই কিন্তু কারণটা স্পষ্টতর হয়ে উঠবে আমাদের মানস পটে! গল্প প্রবন্ধ নাটক উপন্যাস লিখতে যে পরিমাণ সাহিত্যবোধ, পরিশ্রম, আর ধৈর্য্যের প্রয়োজন; আমাদের ধারণায়- কবিতা লিখতে গেলে সেই পরিমাণ সাধনার প্রয়োজন নেই! আমরা দেখেছি কবিতার আকারে কিছু বিশৃঙ্খল শব্দের সাময়িক বিন্যাসেই কবি বলে বাহবা পাওয়া যায় বেশ সহজেই! যে লেখা যত বেশি অবোদ্ধ, প্রিয় বন্ধুদের প্রীতিতে তাই তত বড়ো কবিতা!

আর এই ছবিটি দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জুকেরবার্গের ফেসবুকের দৌলতে! কী এক আশ্চর্য্য আলাদীনের প্রদীপ কবি যশ প্রার্থী বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছে কলেজ ড্রপআউট প্রতিভাধর এই ছেলেটি! হয়ত সে নিজেও সে বিষয়ে আদৌও অবহিত নয়! কবিতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে ব্যক্তিগত ওয়াল থেকে নোটের ভল্টে! না তাতেও রক্ষা নেই! ফেসবুক গ্রুপ আর পেজের সৃষ্টিতে বাঙালি যেন কাব্যসরস্বতীর বরপূত্র আজ! লক্ষ্য করার মত বিষয়, প্রায় প্রতি জনেরই এক বা একাধিক গ্রুপ রয়েছে আমাদের! যার বেশির ভাগটাই কবিতা কেন্দ্রিক! আর যার বন্ধুবৃত্ত যত প্রসারিত, এবং জনপ্রিয়তা যত বেশি, তার কবিতায় তত বেশি লাইক আর বাহবা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা!

ফেসবুকের এই বন্ধুত্বের অলীক জগতে বাঙালি বিনা কাব্যচর্চায় কবি হয়ে ওঠার এক চমৎকার সুষোগ হাতে পেয়ে গেল! বন্ধুদের বাহবা পেলেই তার কবি খ্যাতির প্রসারে সে তৃপ্ত! ট্যাঁকে বাজে খরচের রেস্ত থাকলে তো কথাই নেই! "আপন হাত জগন্নাথ!" নিজের বা স্বামীর পয়সায় প্রকাশক ধরে বই ছাপিয়ে বইমেলায় একবার পৌঁছে গেলেই হল! বিক্রী হোক বা না হোক আত্মীয় বন্ধুদেরকে নিজের নাম স্বাক্ষর করে বই উপহার পাঠাতে পারলেই "আমি কবি!" বিভিন্ন কাব্যপাঠের আসর থেকে কবিতা প্রতিযোগিতার অনলাইন বিচারকের আসনটি পাকা! আর এদিকে ফ্রীতে বই উপহার পেতে তথাকথিত কবির বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপানো স্ট্যাটাসে কমেন্টের লম্বা মিছিল! বাঙালির কাব্যপ্রীতির নমুনা ঐ অব্দিই!

ফেসের পার্সোনাল ওয়াল থেকে গ্রুপের ওয়ালগুলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে অধিকাংশ কবিতারই কোনো পাঠক নেই! ব্যক্তিগত ওয়ালে নিজের লেখা যারা বন্ধুদের ট্যাগ করেন নিয়মিত , সেখানেও অধিকাংশ সময়েই মাত্র তিরিশ শতাংশ মত বন্ধুরাই তাতে সাড়া দেন! এবং চুপি চুপি বলে রাখা ভালো তার মধ্যেও অধিকাংশই কবিতাটি না পড়েই লাইক ও কমেন্ট করে বন্ধুকৃত্য সারেন! সেটা তাদের কমেন্টের বহর দেখলেই অনুধাবন করা যায়! অসাধারন, অনবদ্য, অপূর্ব, চমৎকার, খুব ভালো লাগল, দরুণ লিখেছ- এর থেকে আর বেশি কিছু লিখে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার মত ভাষা খুঁজে পান না অধিকাংশ প্রিয় বন্ধুরাই! তাই কবিও জনে জনে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্টের কমেন্ট সংখ্যা বাড়িয়ে যান!

এবং বন্ধুর লেখা কবিতা পড়ে ভালো না লাগলেও কিংবা নিজের কাব্যবোধের অভাবজনিত কারণে মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে না পারলেও আমরা লেখা ও লেখককে অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিতেই ভালোবাসি! কিন্তু অপরিচিত লেখক- যিনি আমার বন্ধুবৃত্তে নেই; তাঁর লেখা ভালো না মন্দ তা পড়ে দেখতেও যাই না, যদি না গ্রুপ এডমিন হই! অন্যের লেখা পড়ার থেকে নিজের লেখা সবাইকে পড়ানোর জন্যেই আমাদের তৎপরতা অনেক বেশি! তাই ফেসের পাতায়, সত্যি কথা বলতে কি, কবিতার পাঠকের থেকে লেখকের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি! আর ঠিক এই কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো কবিতা নিয়েই যথার্থ সাহিত্য সমালোচনার কোনো পরিসরই গড়ে ওঠে না অনলাইনের এই আত্মপ্রচারের জগতে!

ফলে আত্মপ্রচারের এই নেট দুনিয়ায়, যেখানে সম্পাদকের নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাঁচি নেই, প্রকাশের সীমাবদ্ধতাও নেই, যেখানে আমিই আমার সম্পাদক ও প্রকাশক; সেখানে যা লিখব তাই কবিতা, যদি আমার বন্ধুবৃত্ত বেশ শক্তিশালী হয়! আর তখনই ভাষা ও ভাবের উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়! যে কোনো ভাষার কাব্যচর্চার প্রেক্ষিতে যা সত্যিই অশনিসংকেত! তবুও এর বাইরেও এই কাব্য তিমিরের বলয়েও কবি ও কবিতার জন্ম হবেই! বাংলার মাটির শিকড় থেকেই পুষ্ট হয়ে উঠবে আগামীদিনের কবি প্রতিভা! অকবিদের মিছিলের পদধ্বনি ছাপিয়েও শোনা যাবে কবিকন্ঠে জীবনের বাণী, শাশ্বত মানবকন্ঠের বাঁশিতে! সেদিনের অভিমুখেই এগোতে হবে আমাদের তলায় তলায়!


মহাভারতের কথা - সুস্মিতা সিং

তা সে যতই কালো হোক
সুস্মিতা সিং



মধ্য এশিয়া থেকে খাইবার পাস হয়ে আর্যরা এই ঔপনিবেশিক ভূখণ্ডে আসতে থাকেন খৃষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ – এই সময় সীমার মধ্যে। খৃষ্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ সালের কাছাকাছি সময়টাই হল আদি বৈদিক যুগ। এই সময়ই রচিত হয় ঋক্‌বেদ। এরই সমকালীন ইতিহাস হল মহাভারত।

ঋক্‌বৈদিক যুগের সামাজিক বিন্যাসটি বেশ আকর্ষনীয়। সমাজে জাতিগত ভাবে মূলতঃ দুটি ভাগ – আর্য এবং অনার্য; আর্যরা বহিরাগত, কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁরাই শাসক। আর অন্যদল উপমহাদেশের আদি আধিবাসী, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই অন্তরিত হয়েছেন বিন্ধ্যপর্বতের অপরপ্রান্তের নিরাপদ আশ্রয়ে। যে অনার্যরা উপনিবেশের মূলখণ্ডে অর্থাৎ বিন্ধ্যপর্বতের এই প্রান্তে আর্যদের সঙ্গে রয়ে গেলেন, তাঁরা হয়ে গেলেন দাস, দস্যু এবং শূদ্র। ক্রমশঃ আর্য উপজাতিও উপজিবীকার নিরিখে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য। প্রাথমিক ভাবে একে বলা হত বর্ণ, যার আভিধানিক সমার্থক শব্দ হল রঙ বা রং। অর্থাৎ, সেই সময় বর্ণ বিভেদ ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে কোনও সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না। আর্যরা ছিলেন দীর্ঘদেহী, উন্নতনাসা, গৌরবর্ণ; অন্যদিকে, অনার্যরা খর্বকায়, স্থূলাগ্রনাসা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।

মূলতঃ চার বর্ণে বিভক্ত সমাজ – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। সমাজে প্রথম তিন বর্ণের আধিপত্য সমাধিক। অনার্য শূদ্ররা অবদমিত , বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাঁধা নেই বটে, কিন্তু দৈনন্দিন সম্পৃক্ততায় প্রবল আপত্তি। তাই সূতপুত্র কর্ণকে দু-দুবার পরিপূর্ণ জনসভায় লাঞ্ছিত হতে হয়, এক বার রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন এবং পরবর্তীকালে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মনোজ্ঞ পাঠক,অনুধাবন করুন, মহাভারতের গতিপ্রবাহ। এ কাহিনীর সুবিশাল ইতিহাস আদ্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কয়েকজন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নারী-পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে। তাঁদের মধ্যে তিনজন প্রত্যক্ষভাবে শূদ্রবর্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা হলেন যথাক্রমে, সত্যবতী, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, কৃষ্ণ, আর্জুন এবং দ্রৌপদী।

এই পাঁচজনের মধ্যে সাত্যবতী, ব্যাসদেব এবং অর্জুন একই বংশলতাসূত্রে আবদ্ধ। বাসবরাজ উপরিচর বসুর সপ্তম পুত্র মৎস্য বা মৎস্যকাল; তাঁরই পুত্রী সত্যবতী। আর, তাই তিনি মৎস্যগন্ধা এবং বাসবী-ও। এঁরা ছিলেন মৎস্যদেশ অর্থাৎ রাজপুতানার অধিবাসী। সত্যবতীর মা ছিলেন আর্যজনবিগর্হিতা রমণী, তাই মৎস্যরাজের অন্তঃসত্ত্বা পত্নী বিসর্জিতা হয়েছিলেন ধীবর পল্লীতে। সেখানেই পালিতা হয়েছেন সত্যবতী, তাই তাঁর গায়ে আঁশটে গন্ধ, যা বহুদূর থেকে থেকে পাওয়া যায়; আর তাই তিনি যোজনগন্ধা। সেই সূত্রে সত্যবতী অনার্যা – শূদ্রাণী।

মর্যাদাময়ী সত্যবতী নিজেকে দাস রাজার কন্যা বলে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করেন। তিনি পিতার অনুপস্থিতিতে যমুনায় খেয়া পারাপার করেন। এমনই এক সায়াহ্নে ঋষিশ্রেষ্ঠ পরাশর খেয়া পারের জন্য যমুনার উপকূলে উপস্থিত হয়ে দেখলেন নৌকার প্রান্তদেশে এক নিষন্না কৃষ্ণবর্ণা রমনী চিত্রার্পিত মূর্তির মতো বসে । আসন্ন সন্ধ্যারাগে উদ্ভাসিত দিগন্তের অরুনাভাস এসে পড়েছে রমনীর চিক্কণ কৃষ্ণবর্ণ শরীরের উপর। ঘন কৃষ্ণ কেশরাশি মাথার উপর চূড়া করে বাঁধা। আতাম্র ওষ্ঠাধারে মুক্তাঝরা হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী সূত্রগ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ, অধমাঙ্গের পরিধান কিছু খাটো। প্রায় ঊরু পর্যন্ত অনাবৃত। এই অনাবরণ প্রকট লাবণ্য পরাশরের পৌরুষেয় দৃষ্টিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হল না।

ঋষিশ্রেষ্ঠ শরবিদ্ধ হলেন। মুগ্ধ মুনিবর এই উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীর আসঙ্গলিপ্সা করলেন মনে মনে। কোনও ভণিতা না করে সত্যবতীর কাছে পুত্রার্থে মিলন কামনা করলেন পরাশর। আপন জন্মশোকাভিতপ্তা কুমারী সত্যবতী এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিতা হয়েছেন। পরক্ষণেই ঋষিপ্রবরের পরম আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। এবং যমুনার মধ্যবর্তী এক দ্বীপে তাঁদের মিলন সাধিত হয়েছে। সেখানেই জন্ম হয়েছে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস-এর। তৃপ্ত পরাশরের আশীর্বাদে যোজনগন্ধার শরীর পদ্মসৌরভে সুগন্ধিত হয়ে উঠেছে।

এই শূদ্রাণী সত্যবতীকে পরবর্তী কালে বিবাহ করেছেন হস্তিনাপুররাজ শান্তনু। বিবাহের একমাত্র শর্তই ছিল সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রই হবেন হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ , বিবাহের পূর্ব থেকেই সত্যবতী হস্থিনাপুরের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রিত করতে শুরু করেছেন নিজহস্তে।

পরবর্তী কালে সত্যবতীপুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের নিঃসন্তান অবস্থায় অকালপ্রয়াণের পর সত্যবতীর কালীন পুত্র ব্যাসদেব কিভাবে মহারাজ শান্তনুর বংশলতায় পুনরায় প্রানপ্রবাহ সঞ্চালিত করেছেন, সে ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। সেই সূত্রে ধনঞ্জয় বীর সব্যসাচী অর্জুন হলেন ব্যাসদেবের পৌত্র এবং মাতা সত্যবতীর প্রপৌত্র।

সমগ্র মহাভারতের সুবিশাল পরিসরে মাতা সত্যবতী তাঁর সমকালীন সময়ের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন পেশাদারী নৈপুণ্যে ও দক্ষতায়। এই কাজে তাঁকে অনেকাংশে সাহায্য করেছেন তাঁর কালীন পুত্র ব্যাস। পরবর্তীকালে ধনঞ্জয় অর্জুনও একাধারে সামরিক রাজনীতির পরিকল্পক ও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন স্বইচ্ছায়, স্বমহিমায় ও স্বকীয়তায়। নিপুণ পরিকল্পকের মতোই বারো বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন কালে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিচরণ করেছেন এবং আর্য-অনার্য নির্বিশেষে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার আকাঙ্খায়; কুরুক্ষেত্রের মহাসমর কালেও তিনিই সৈনাপত্য গ্রহন করেছেন ধনঞ্জয়সখা বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কে তো দেখা যায় সমগ্র মহাভারত জুড়েই তাঁর অবাধ বিচরণ। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই তিনি নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এঁরা তিনজনই কিন্তু ছিলেন বর্ণসংকর শূদ্র সম্পর্কিত ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের নারী-পুরুষ।

মহাভারতের কথা অধিকাংশই অকথিত থেকে যায় যে পুরুষটির কথা না বললে, তিনি হলেন পুরাণ পুরুষোত্তম, কপট চূড়ামণি, বিশ্বমোহন বৃন্দাবনী লাম্পট্যে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল অথচ অত্যন্ত ধুরন্ধর , এক বিশাল মাপের রাজনৈতিক নেতা, পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ; অসম্ভব তাঁর আকর্ষণী শক্তি। মহাকাব্য মতে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্কন্যা দেবযানী ও নাহুষপুত্র যযাতির প্রথম পুত্র যদু থেকেই যদুবংশের সৃষ্টি। এই বংশেরই কুলতিলক কৃষ্ণকায় কৃষ্ণ। অর্থাৎ, এখানেও সেই বর্ণসংকর জন্মের ইতিহাস।

মহাভারতে বৃন্দাবনবিলাসী একনায়ক, মথুরা-দ্বারকার রাজাদের রাজা, কুরু-পাণ্ডবের ধর্মযুদ্ধের পুরোহিত, মহাভারতের মতো বিশাল জীবন-নাটকের সূত্রধার, কৃষ্ণকে প্রথম থেকেই আমরা দেখি এক কূটবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কর্মপ্রবাহ শুরু হয়েছে অত্যাচারী মাতুল কংসকে বধ করে এবং শেষ হয়েছে ভারতযুদ্ধ অন্তে সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। কৃষ্ণ যখন জন্মেছিলেন, সেই সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে ছিলনা। মগধরাজ জরাসন্ধ ছিলেন শ্রেষ্ঠতম পুরুষ; চেদিরাজ শিশুপাল, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব, জরাসন্ধের জামাতা ও কৃষ্ণের মাতুল কংস, সকলেই জরাসন্ধের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

এমত পরিস্থিতি থেকে সমগ্র রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অস্বাভাবিক দক্ষতায় নিজের অনুকূলে এনেছেন অত্যন্ত স্বল্প সময়ে। তার জন্য প্রয়োজনে কোথাও নিজে প্রত্যক্ষভাবে ছলনা ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, কোথাও বা অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। একসময়, কুরু-পাণ্ডবের পারিবারিক বিবাদ আর পরিবারের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। এমনকি, সমগ্র ভারতযুদ্ধের দায়ও বর্তেছে তাঁরই উপর। এবং তার জন্যই, অবশেষে গান্ধারীর কাছ থেকে অভিশাপও গ্রহন করেছেন তিনি মাথা নত করে।

মহাভারতের রাজনৈতিক নেতা, কৃষ্ণকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই পরিসর সত্যই বর স্বল্প। কিন্তু, যে কথাটি উল্ল্যেখ না করলে আখ্যানের বিষয়াভিলাষ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেটি হল – মহাভারতের এই নায়ক পুরুষটিও ছিলেন একজন কালো মানুষ; বর্ণ বৈষম্যের শিলাভার তাঁকে অবদমিত করে রাখতে পারেনি কিছুমাত্র।

এই প্রসঙ্গে আমরা প্রবন্ধের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে যে বিদগ্ধা রমণীর কথা শুনবো, তিনি হলেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা, কৃষ্ণসখী, যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী দ্রৌপদী। মহাভারতের এই চরমতমা নায়িকার জন্মও রহস্যাচ্ছন্ন। যজ্ঞবেদী থেকে উদ্ভূতা হয়েছেন কালো মেয়ে দ্রৌপদী। তাই তিনি কৃষ্ণা-ও। দ্রৌপদীর রূপের বর্ণনা করতে গিয়ে মহাকাব্যের কবি সচেতন হয়েছেন। “ সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোনীপয়োধরা “ - এই টুকুই মাত্র কৃষ্ণার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া যায় সমগ্র মহাভারতে। আসলে, কালো মেয়ে দ্রৌপদীর সৌন্দর্য তাঁর শরীরে নয়, সৌন্দর্য তাঁর বৈদগ্ধতায়; বৈদূর্যমণির মতো যা প্রতিভাত হয় স্বমহিমায়। আগুন তাঁর চরিত্রে, সে আগুনের সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, হয় তাঁরা পুড়ে খাঁটি হয়েছেন , নয়তো জ্বলে রাখ্‌হয়েছেন।

এহেন নায়িকার কোন শৈশবকাল নেই। জন্মলগ্নেই তিনি উদ্ভিন্নযৌবনা এক কুমারী নারী। অলৌকিকতার আবরণ ছিন্ন করলে, ধরে নেওয়া যায় , রাজা দ্রুপদ ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদী কে দত্তক নিয়েছিলেন যজ্ঞাগ্নিকে সাক্ষী রেখে। এবং এই দত্তক গ্রহণও একান্ত ভাবেই রাজনৈতিক কারণেই। দ্রোণহত্যা তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও, কন্যাকেও তিনি ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির স্বার্থেই। আর তাই, দত্তক নেওয়ার পরে পরেই তিনি দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছেন। এর পরবর্তী থেকে শেষ পর্যন্ত মহাভারত আবর্তিত হয়েছে এই একতমা নায়িকা, কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে অবলম্বন করেই। এখানেও বর্ণবৈষম্য পরাভূত হয়েছে সমূলে।

মহাভারতীয় রঙ্গভূমিতে এই ক’জন কালো মানুষ সমগ্র লোককাহিনীটিকে মাতিয়ে রেখেছেন আগাগোড়া । গৌরবর্ণ শাসক জাতির উপর কৃষ্ণকায় মানুষগুলির এই আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ বুঝিবা প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। আর্যদের আগমনের পূর্বে এই উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডে যে কৃষ্ণকায় মানুষগুলি একাধিপত্য করেছেন, তাঁদের যে এক মুহূর্তে অবদমিত ও নির্মূল করা যায়নি, মহাভারত তার সাক্ষ্য বহন করে।।

অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার

অনুবাদ কবিতা
ইন্দ্রানী সরকার


সন্ধ্যাতারার গান
(টমাস ক্যাম্পবেল )

যে তারা মৌমাছিকে ঘরে ফিরিয়ে আনে
ক্লান্ত শ্রমিককে কাজ থেকে মুক্তি দেয় ,
যদি কোনো তারা স্বর্গ থেকে শান্তি ঝরায় সে "তুমি |"
স্বর্গের নিঃশাস আর ভ্রূকুটি তখন সেই
আমাদের প্রিয় তারাটির মত সুমিষ্ট দেখায় |
যখন মাটির ঘ্রাণ আকাশ ছুয়ে নেয়,
যখন দূর থেকে গবাদি পশুদের আওয়াজ শোনা যায়,
কর্মশেষে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের কুটীর থেকে
কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া সূর্যের আলোয় হলুদ হয়ে যায়
ওগো তারকা, তুমি প্রেমিক অন্তরের মিলনক্ষণ,
পরস্পর থেকে বিছিন্ন প্রেমিকদের সান্ত্বনা,
তাদের চমত্কৃত শপথের স্মরণকারী
তোমাকে হৃদয় থেকে বিছিন্ন করা অসম্ভব!!

Song to the Evening Star
Thomas Campbell


Star that bringest home the bee,
And sett'st the weary labourer free!
If any star shed peace, 'tis thou,
That send'st it from above,
Appearing when Heaven's breath and brow
Are sweet as hers we love.
Come to the luxuriant skies
Whilst the landscape's odours rise,
Whilst far-off lowing herds are heard,
And songs, when toil is done,
From cottages whose smoke unstirred
Curls yellow in the sun.
Star of lover's soft interviews,
Parted lovers on thee muse;
Their remembrancer in heaven
Of thrilling vows thou art,
Too delicious to be riven
By absence from the heart.

কবিতা - ইন্দিরা দাশ

জীবন রঙ্গীন কাঁচ
ইন্দিরা দাশ



চলো ক্যালিডোস্কোপ‘টা ভরে জীবনটা দেখে নিই একবার

টুকরো টুকরো কাঁচে...কত ছবি ধরা আছে
সময়ের কত রং দেখবার!

কবে যেন স্কুল কেটে...বাবার পকেট ছেঁটে
মেট্রো গড়ের মাঠ ঘুরেছি যে খুব
কবে যেন কচি প্রেম...কোনও এক কালো মেম
মন নিয়ে ধোঁকা দিয়ে মারলো সে ডুব!
শৈশব-কৈশোর ...যৌবন হুল্লোর
লাল-নীল ভালবাসা ...হতাশার
টুকরো টুকরো কাঁচে...কত ছবি ধরা আছে
সময়ের কত রং দেখবার !

বেকারীর জারিজুরি ...বস এর বিকট ভুঁড়ি
ক্যারিয়ার মই বেয়ে ঝুলেছি বেদম
ছেলেপুলে ক্যাঁচম্যাচ ...বোর্ড এর কোন ব্যাচ
থ্রি-বেডরুম ফ্ল্যাট খুঁজেছি কি কম ?
গিন্নির নেকলেস ...জামাইয়ের ব্রিফকেস
প্রভিডেন্ট ...পেনশন ...সংসার
টুকরো টুকরো কাঁচে...কত ছবি ধরা আছে
সময়ের কত রং দেখবার !

ঘড়ি কাঁটা ধরে ধরে ...অল্প একটু করে
অদ্ভুত যন্ত্রটা যখনই নাড়াই
সবুজের কাঁচা মন...মেরুন প্রৌঢ় ক্ষণ
পরপর মিলেমিশে মজা হে মজাই !
তিনসিঁড়ি রোদ এলে ...হয়ত বা যাবো ফেলে
আজকের এতো কিছু 'দরকার' –


ততদিন

টুকরো টুকরো কাঁচে...কত ছবি ধরা আছে
সময়ের কত রং দেখবার !

চলো ক্যালিডোস্কোপ‘টা ভরে জীবনটা দেখে নিই একবার।

(কাব্যগ্রন্থ অন্ধকারে ঝিনুকের দল থেকে)

কবিতা - অলোক চৌধুরী

টাকা
অলোক চৌধুরী



টাকা চাই টাকা,
অনেক অনেক টাকা।
জুলুমের বন্যা ঢেলে,
কেড়ে নেবে টাকা।
এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবে,
হাতের চেটোয় রেখে।
তোলাবাজ উন্মাদ শিবিরে,
টাকা ওড়ে।
আমাকে আহত করে,
সন্মোহনী টাকার বুলেট।
চিৎকার করে উঠি,
এ আমি কোথায় এলাম।
রক্তে কলঙ্ক মেখে,
বেলোয়ারী বাণিজ্য নগরীর গোরস্থানে।
আর কত টাকা চাই?
তার থেকে এস হাতড়াই,
ভালবাসা, গেরুয়া নুড়িতে।
দেখবে সেখানে,
টাকা মাটি, মাটি টাকা।

কবিতা - দেবাশিস কাঞ্জিলাল

জ্যোৎস্না-সন্ধান
দেবাশিস কাঞ্জিলাল



দীপ্ত তারার পানে তাকিয়ে তাকিয়ে ক্লান্ত হলে চোখ
স্নিগ্ধ নরম কোন জ্যোৎস্নার খোঁজে থাকি।
সেই জ্যোৎস্নাও কি খুঁজে চলে কাকে ?
যদিও তো আমি জানি,তা' নয় আমাকে !

আশা তবু,পুঞ্জীভূত বেদনার নীল রঙ যত
একদিন ঠিক জ্যোৎস্নার সবুজ রঙের সাথে
আশাতীত মিলে,ময়ূর-কন্ঠী রঙে সঙ্গত হবে।


কবিতা - দেবাশিষ মিত্র

হারান মন
দেবাশিষ মিত্র



চলেছি অনন্তকাল ধরে।।
সময় কে না জানিয়ে...
না পাবার অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে...
হারিয়ে যাওয়া সৃষ্টিশীল মনটা নিয়ে...
চলে গেছ তুমি দুমড়িয়ে, মুচড়িয়ে...
মুড়ি খাওয়া ঠোঙার মত করে...
গোলাপের কাঁটার আঘাতে রক্ত ঝরিয়ে..।
ভেবোনা তুমি, আমি চলেছি তোমার সন্ধানে...
চলেছি আমি, আমার হারানো মনটা ফিরিয়ে আনতে...










কবিতা - দেবাশিষ সেন

গৃহবন্দী ইচ্ছে
দেবাশিষ সেন



ইচ্ছে যখন পথের ধূলো-
উড়ো মেঘে শিমুল তুলো
আলগোছে হয় এলোমেলো,

বেপরোয়া বেসামাল ঝড়ে
এদিক সেদিক ওড়ে,
মন তখন গৃহবন্দী
কড়িকাঠ গোনে, আঁটে ফন্দি,
একফালি রোদ জানালায় আসে
ঘরের মেঝেয় মুচকি হাসে।

ইচ্ছে যখন রঙের মেলা-
ইকিড়-মিকিড় খেলা
নিঝুম রাতের বেলা,

চাঁদ ডাকে ইশারায়
ছেলেবেলা গল্প শোনায়,
রূপকথার সেই রাজারকুমার
পক্ষীরাজে হত সওয়ার,
বাইরে তখন ঝিঁঝিঁর ডাক
ঢুলুঢুলু স্বপ্নেই চিচিং ফাঁক।

ইচ্ছে যখন স্বপ্নের গুঁড়ো-
আলতো সে যৌবন উড়ো
মন এক বাউন্ডুলে ছুঁড়ো,

পিরিতি জ্বালায় জ্বলিয়ে বুক
দিনে উন্মাদ, রাতে উন্মুখ,
ডাগর চোখের শ্যামলা মেয়ে
আড় চোখেই দেখেছি চেয়ে,
কালের যাঁতাকলে ভাঙ্গা কুলো
ইচ্ছে আজ পথের ধূলো ।।

কবিতা - জয় (শমীক) সেনগুপ্ত

যোজনগন্ধা তুমি
জয়(শমীক)সেনগুপ্ত


যোজনগন্ধা, তুমি নাকি সৌরভেতে রোজ
একরাশ লাজ বৃষ্টির ছাঁটে ঢেকে দিতে চাও।
তোমার এলানো চুলে বাঁধা শাপলার গিঁট
বারবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
তাল-তমালের ফাঁকে অদৃশ্য আকাশে-
বাঁকা চাঁদ সপ্তমী রাতে
চুপিচুপি গ্রহণ লাগাল।
যোজনগন্ধা, তুমি এখন অনুষ্টুপের তালে
মন্দাক্রান্তা ছন্দ জাগাও।
না, আজ আর অমিত্রাক্ষর নয়-
আজ জয়স্তু ছন্দ শেখাবো..
একবার চোখ বুজে তুমি অতলে তলাও;
যোজনের বিস্তৃতি আমাদের বাংলার ঘাট মাঠ
নদ-নদী জলে;
হারানো শ্যাওড়া, ভাঁটফুল কাশেদের ভিড়ে
পদ্মের আঁচলের তলায়-
কবিতারা জন্মাক শত সহস্রবার।
সাঁকো আর সেতুদের সংযোগ ঘিরে
হর্ম্য-প্রাসাদে আর ছেঁড়া রাজপথে
হেঁটে চল পয়দল! ভাসাও সোপান
অলক্তক-রঞ্জিতা কনের লালিমায়।
যোজনগন্ধা, আকাশের ডানাতেই ফিরুক কুলায়
শ্রান্ত ভাষারা নব বরষায়।
ব্যাস আর প্রস্থের হিসেব না করে
দেবতার ব্রত আর মানুষের ভরসার বুকে
যোজনগন্ধা তুমি আশা হয়ে ফুটে ওঠো আজ।
ভাষারা মুক্ত হক মনের ঘরেতে ।।


কবিতা - রাণী সিনহা

মেয়ে
রাণী সিনহা



উবু হয়ে বসে অনবরত
ফুঁ দিয়ে চলেছে মেয়ে ,
উনুনের জ্বলণ্ড আগুনের ফোঁকড়ে।
পিঠে কালসিটে দাগ…..
ভ্রক্ষেপ নেই যেন কোনও,
সারা দিন পেটে পড়েনি কিছু….
সারা শরীর ক্ষুধায় বিদ্রোহ জানায়।
কোনও দিকে হুঁশ নেই মেয়ের
মদ্য মাতাল বাবা আসবে তখন…..
চিৎকার করে বলবে ভাত হলোনা এখন।
কিছু না বলে দিয়ে গেল
সামনে ভাতের থালা…..
অন্ধকারে কেউ দেখলো না
হাহাকার করা ক্ষুধা নিয়ে
চোখে উপছে পড়া জলের ধারা।।



কবিতা - শ্রীমন্ত শিকদার


নির্জন আরোহী
শ্রীমন্ত শিকদার



আলোকসন্ধানী ভোর,
তোমাকে ছুঁয়ে আছি উদ্দীপনার শেষ প্রহরে!
জ্যোৎস্নামাখা গাছপালা
কুয়াশার চোখে ঘুম
শারীরের সঙ্গে পা টিপে টিপে আমিও বাগানে এসেছি
তোমার কপালে একটি লাল সূর্য্য আনবো বলে!
তুমি কি এখন সাজগোজ করছ?
কেনাকাটা ?
বর্ষা যাই যাই করে এখন তো যায়নি,
আসি আসি করে তো আর আসা হয় নি!
সামনে আলো ঝলমল দুর্গা পূজো, আগমনীর আগমন –
কি নাম দেবো তোমার , বোধন, না বিসর্জন?
পূর্ণতাই তো পূর্ণমুখ গো, আলোকিত আকাশ,
ফুল গন্ধে ভরে সমুদ্র বাতাস –
একটাই নদী হয়, একটাই নৌকা,
উজানে যেতে হলে চাই
আরো কিছু নিষ্ঠা !! 


কবিতা - সুব্রত পাল


পাগলা, ফাঁদে পা
সুব্রত পাল



পাগলা, সমুদ্দুর ! ভাসবি যদি চল্‌ -
মেঘ ভাবলে মেঘজল ভাবলে জল

জ্বলতে এত সুখ চোখ জ্বলছে আজ -
রূপ ভাবলে রূপসাজ ভাবলে সাজ
পাগলা, খালি গায় আছড়ে পড়ে চাঁদ -
যোগ ভাবলে যোগবাদ ভাবলে বাদ

খেলতে মানা নেই সাজিয়ে নিয়ে ছক -
চুপ ভাবলে চুপবক্‌ ভাবলে বক্‌

পাগলা, হট্টগোল ! শান্ত হয়ে বোস্‌ -
গুণ ভাবলে গুণদোষ ভাবলে দোষ

সকালে তাজা প্রাণ সন্ধ্যে বেলা লাশ -
দূর ভাবলে দূরপাশ ভাবলে পাশ

পাগলা, হাতের পাঁচ ধরবি যদি ধর -
প্রেম ভাবলে প্রেমঘর ভাবলে ঘর

আদর ছুঁয়ে মন শরীর পেতে চায় -
বুক ভাবলে বুকআয় ভাবলে আয়

পাগলা, ফাঁদে পা, এবার কিস্তিমা -
দিন ভাবলে দিনরাত ভাবলে রাত