সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়



কনকনে উত্তুরে হাওয়ার হিমেল পরশে পৌষ পার্ব্বণকে পিছনে ফেলে এসে উপস্থিত শীত ঋতুর দ্বিতীয় অধ্যায়, মাঘ; বাংলা সনের দশম এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের একাদশ মাস। বাংলা ‘মাঘ’ এবং শকাব্দের ‘মাঘা’ নামটি এসেছে ‘মঘা’ নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। প্রবাদে আছে, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়ে’!! ঘন কুয়াশা আর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডাই পড়ার কথা এ মাসে। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কাল ও তাপমাত্রার এমনই তারতম্য ঘটেছে যে, সত্যি সত্যি এখনো মাঘ মাসে বাঘের শীত করে কিনা, সে খবর অবশ্য নেওয়া হয় নি!!

এরই মাঝে ঘটে গেল বাংলা তথা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র জগতের মহানক্ষত্রপতন। কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের (৬ই এপ্রিল, ১৯৩১ – ১৭ই জানুয়ারী, ২০১৪) জীবনাবসান। বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্রামের এক অখ্যাত স্কুলের হেডমাস্টার করুণাময় দাসগুপ্ত ও ইন্দিরাদেবীর পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা রমা দাসগুপ্তর ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের চিরনবীন কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠার কাহিনী নিঃসন্দেহে ঘটনাবহুল। ১৯৭৪ সালে বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন রমা। তারপর ১৯৫২ সালে প্রথম ছবি ‘শেষ অধ্যায়’ অবশ্য মুক্তি পায়নি। ওই বছরই আরো দুটি সিনেমা করেন তিনি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ তাঁর আত্মপ্রকাশ বাংলা সিনেমা জগতে সাড়া ফেলে দেয়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৯, দীর্ঘ ২৬ বছর – অগ্নিপরীক্ষা, দেবদাস, শাপমোচন, সবার উপরে, সাগরিকা, শিল্পী, হারানো সুর, পথে হোল দেরী, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, চাওয়া পাওয়া, হসপিটাল, সাত পাকে বাঁধা, উত্তর ফাল্গুনী, দেবী চৌধুরানী, মুসাফির, বোম্বাই কা বাবু, মমতা, আঁধি, প্রভৃতি একের পর এক প্রায় ৬৭টি বাংলা ও হিন্দী হিট ফিল্ম। তাঁর আভিনয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৬৩ সালে; ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভাল-এ। ১৯৭২-এ পান পদ্মশ্রী, আর ২০১২ সালে বঙ্গ বিভূষণ ‘লাইফ টাইম এচিভ্‌মেন্ট ইন ফিল্ম এক্টিং’-এর জন্য। ১৯৭৯ সালে অবসর গ্রহনের পর দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি নিয়ে ছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহানায়িকার জীবনাবসান হোল ১৭ই জানিয়ারী, ২০১৪।

তবুও মৃত্যু শুধু একটি অধ্যায়েরই ছেদ টানতে পারে; পৃথিবী চলে নিজের গতিতে, কোনও পরিবর্তন হয় না। তাই মাঘমাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ঝমঝমিয়ে এসে উপস্থিত হয় বাঙ্গালীর প্রেমদিবস – সরস্বতী পূজো আর ১১ই মাঘ ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসব। খনা বলেন, যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ – তবুও মাঘের প্রকৃতি নীরস। তাই বাংলা সাহিত্যে মাঘের প্রসঙ্গ দুর্লভ। কিন্তু, আমের কুশি তো এই মাসেই বোলে পরিণতি পায়!! তাই রিক্ত মাঘ, নিঃস্ব মাঘ উল্লেখযোগ্য স্বাতন্ত্রে ইঙ্গিত বহন করে চির নতুন, চির সবুজের প্রতীক বসন্তের নৈকট্য বার্তার পূর্বাভাসে!!

এ মাসের বিশ্ব বিখ্যাত বঙ্গীয় উৎসবটি হোল নিঃসন্দেহে কলকাতা পুস্তক মেলা। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত এই বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। এশিয়ার সর্ব বৃহৎ এবং ফ্রাঙ্কফূর্ট ও লন্ডন বইমেলার পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ এই মেলা পুস্তকপ্রেমী মানুষের এক আশ্চর্য মিলনতীর্থ। কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অবাণিজ্যিক বইমেলা। এ বছর মেলার ৩৮তম বছর। ফ্রাঙ্কফূর্ট বইমেলার আদলে প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণকারী একটি বিদেশী রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ ও ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। এবারের ‘ফোকাল থিম’ ও ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ রহস্যময় ‘ইন্‌কা’ সভ্যতার মায়াবী দেশ দক্ষিণ আমেরিকার পেরু। এখন কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই মেলা একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বিভিন্ন দেশী বিদেশী বই ছাড়াও নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, পদযাত্রা, প্রতিযোগিতা, গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান, লিটল ম্যাগাজিন স্টল, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, গান, আর কত কি এ মেলার বিশেষ আকর্ষণ। পরিসংখ্যান বলে, প্রতি বছর জানুয়ারী মাসের শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় রবিবার পর্যন্ত – ১২ দিন ব্যাপী এই মেলায় প্রায় ২ কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এ এক অভাবনীয় মিলনোৎসব।

এই সর্বব্যাপী উৎসবের বার্তা বহন করে প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা। এই সংখ্যায় সংযোজিত হোলো দুটি নতুন বিভাগঃ আনন্দলোক এবং হাস্যকৌতুক। এছাড়া থাকছে প্রচ্ছদ নিবন্ধ, বিশেষ প্রতিবেদন, কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের স্মৃতিতর্পণ, তিনটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, কবিতা, ছোটগল্প, ধারাবাহিক, নাটক, ইত্যাদি। আর, চিলেকোঠা সরগরম, ছোটোদের পাতা, রান্নাঘরের মতো নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে।

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আপনাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকাটির মানোন্নয়ণে সহায়তা করবে।

জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।।



নমস্কারান্তে,

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

স্মৃতিতর্পণ - অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়





ভালোবাসার মতোই শ্রদ্ধা মানুষের মনের সম্পদ। হোক না তার বাস মন – সিন্দুকে। খামোকা তাকে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে, ফুলেতে, মালাতে কিংবা ধূপের গন্ধতে আটকানো কেন বাপু ? তার চেয়ে বরং চোখ রাখা যাক টেঁপির বাড়ির দিকে।

সকাল দশটাও বাজেনি। দোতলার সিঁড়ি থেকে চকিতা হরিণীর মতো লাফাতে লাফাতে টেঁপি নামলেন। পরনে সিফন শাড়ি। চোখে ‘আলো আমার আলো’ সানগ্লাস। বাগদা চিংড়ির মতো ঠোঁট দুটোতে জ্বলজ্বল করছে লিপিস্টিক। যেই না সদর দরজার ছিটকিনি খুলে ‘মা বেরোলাম’ মুখ ফসকে বেরিয়েছে টেঁপির অমনি ক্যাচ কট কট। গুছিয়ে করা বিনুনি শুদ্ধু মাথাখানা তার ঝজ্ঝরিয়ে নড়ে উঠল। মা তার ওত পেতেই বসেছিল আজ। সঙ্গে সঙ্গে মাতৃপ্রলাপ... ‘ বলি বাড় এতো হল কোত্থেকে শুনি? হারামজাদি... কলেজের লেখাপড়া শিকেয় তুলে সাতসকালে মোচ্ছব কত্তে বেরোচ্চ?

- আঃ মা! লাগছে তো ছাড়।

- ঠোঁটে আবার টকটকে লিপস্টিক? নিজেকে কী সুচিত্রা সেন ভেবেছিস?

কাণ্ড বুঝুন। ছিল টেঁপি, হল সুচিত্রা...

সেই বাংলাদেশের পাবনা শহরের নিতান্ত সাধারণ ঘরের এক মেয়ে। করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের মেয়ে কৃষ্ণা। জন্ম যার ৬ এপ্রিল ১৯৩১ এ। সে কিনা হুশ করে সত্তরের কলকেতার এক বাড়িতে ঢুকে পড়ল। সত্যি বাবা! এ মেয়ে নিঘ্ঘাত জাদু জানে। নইলে কি না মেয়ে, ছেলে কাউকেই ছাড়ে না?

ওই যে দেখুন, অমল, বিট্টু, গোলাই আর সন্তোষ, নব্বই দশকের ইশকুল পাড়ার মাঠে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার তোড়জোড় করছে। অমলের ডান হাত সকলের বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর মুখে আওড়ে চলেছে সুচিত্রা নামতা, ‘ প্লেন প্লেন প্লেন, প্লেন থেকে নেমে এলো সুচিত্রা সেন। সুচিত্রাদি সুচিত্রাদি উত্তমদার জন্য কী এনেছ?’ এরপরেই হুল্লোড়। বিট্টুর বুকে অমলের শেষ কিস্তির হাতটা পড়েছে। অর্থাৎ বিট্টুই সবাইকে ধরবে।

ছোটো থেকে মা – কাকিমার মুখে শুনেছি কারও নাম করলে না কি সে বিষম খায়। কী সব্বোনাশ ভাবুন একবার। সারাজীবন তাহলে সুচিত্রা ম্যাডাম ঠিক কত কোটিবার বিষম খেয়েছেন!

আসলে এগুলো মানুষের মনে নস্ট্যালজিয়ার সিঁড়ি। টুকরো ঘটনাগুলোই এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের স্মৃতির মিলন ঘটায়। ছোটোবেলায় অভিনয়ের কতটুকুই বা বুঝতাম? তবু কোথাও থেকে ‘এ শুধু গানের দিন’ এর মিউজিক ভেসে এলেই বুকটা নেচে উঠত। উপায় থাকলে ছুট্টে যেতাম টিভির সামনে। ব্যস, তার পরেই মন্ত্রমুগ্ধার সেই মোহিনী চাউনি, সঙ্গে চন্দ্রকলাহাসি। প্রেম শব্দটা তখন বড়োদের কথা। কিন্তু মন যে উন্মুক্ত পাখি। তাকে বাঁধে কোন সেনসর? সেজো কাকিমা গল্প করেছিল, ‘পথে হল দেরী’ ছবিটা না কি সে যুগে প্রথম রঙিন ছবি। সুচিত্রা সেন এই ছবিটিতে ২১ টা না ২২ টা শাড়ি পালটে পালটে পরেছিলেন। কিন্তু তখন একেবারেই হালকা কালার ছিল। তাই সকল অভিনেতাকেই খুব চড়া মেকআপ দিতে হয়েছিল। নইলে ফিল্মে রং ধরা দুষ্কর ছিল। সে রং টিঁকল না। সময়ের গোঁজামিলে রঙিন ছবি আজ সাদাকালো হয়ে গেছে। এখন সিনেমাটা

দেখলেই বোঝা যায় যে কী পরিমাণ চড়া মেকআপে সেজেছিলেন সুচিত্রা, উত্তম, অনুপকুমার এমনকী অমন রাসভারী ছবি বিশ্বাসও।




ছিল কৃষ্ণা, হল রমা। রুপোলি দুনিয়ায় যাত্রা শুরু ‘শেষ কোথায়’ ছবি দিয়ে। কিন্তু ছবিটি তখন মুক্তি পেল না। অনেক পরে ১৯৭৪ – এ দীনেন গুপ্ত এই ছবিটির কিছু অংশ ব্যবহার করেন চিত্রসারথী পরিচালিত ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ ছবিতে। ততদিনে ‘সাত নম্বর কয়েদি’-র রমা সেন সুচিত্রা সেন হয়ে উঠেছেন। পেরিয়ে এসেছেন সাড়ে চুয়াত্তর(১৯৫৩), কাজরী (১৯৫৩), ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য (১৯৫৩), অ্যাটম বোম (১৯৫৪), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), সদানন্দের মেলা (১৯৫৪), অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৪), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহপ্রবেশ (১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), শুভরাত্রি (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭), জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রাণী (১৯৫৮), সুর্যতোরণ (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯), হাসপাতাল (১৯৬০), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২)...

চলতেই থাকল মিসেস সেন – এর জয়যাত্রা। এরই মাঝে সুচিত্রার বম্বে পাড়ি। দিলীপকুমারের সাথে ১৯৫৫ সালে হিন্দিভাষায় তৈরি হল ‘দেবদাস’। সুচিত্রা সেন পার্বতী। এরপর মুসাফির, শেখর, চম্পাকলি, বোম্বাইকা বাবু, শরহদ, মমতা, আঁধি। হিন্দি এবং বাংলায় সব ছবিই যে সাফল্যের মুখ দেখল তেমনটা নয়। তবু শিল্পীর শিল্প কখনও খাটো হল না। সম্মান, পুরস্কারে ছায়াছবির শিখরে নিজের বিজয়পতাকা দৃঢ় করে গেঁথে দিলেন সারাজীবনের জন্য।

বড়ো যত হতে থাকলাম, টালিগঞ্জে উত্তমকুমারের মূর্তির মতো মনের চৌরাস্তায় সুচিত্রা দেবীর মূর্তি গড়ে উঠল, অজান্তেই। অভিনয়টাও খানিক খানিক বুঝতে শুরু করলাম। এককথায় সিনেমার দুয়ারটা উন্মোচিত হতে থাকল। তখন তাঁর সব ছবিতে অভিনয় যে মন কাড়ল তা একেবারেই নয়। অনেক ছবিতেই অন্যান্য অনেক নায়িকার অভিনয় মন কেড়েছে বেশি। কিন্তু একান্তে নিজের মনের নায়িকা সংবাদে কেবল তাঁরই নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে। কেন? হয়তো আজকের যুগের ভাষায় সেটাই এক্স ফ্যাক্টর। এক অমোঘ সম্মোহনী।

আপামর বাঙালি প্রেম করতে শিখেছিল সুচিত্রা – উত্তম জুটিকে দেখে। ছুটন্ত হরিণী যেমন হঠাৎ করে মেঘের ডাকে কিংবা হরিণের আহ্বানে সাড়া দিতে ঈষৎ বঙ্কিমগ্রীবায় চায়। ঠিক তেমনই সাদাকালো পর্দাজুড়ে সুচিত্রার দৃপ্ত চাউনি কত পুরুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য নিয়েছিলই বা বলি কেন? আজও কী নেয় না? ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিটা আজও আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। অনেক ছোটোবেলায় দূরদর্শনের একটি গানের অনুষ্ঠানে এই ছবিরই একখানি গান দেখেছিলাম। দূর থেকে ভেসে আসছে হেমন্ত কন্ঠে চৈতন্য সংগীত। আর তাঁর স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরের দাওয়ায় মাথায় ঘোমটা টেনে ঢুলুঢুলু চোখে মাথাটিকে হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রোম্যান্টিক মুখাবয়বে কী করে ভক্তি ঝরাতে হয় সেদিন বুঝেছিলাম। আমার অপূর্ণ চিত্ত সেদিন জেনেছিল প্রেম আর ভক্তি একই অঙ্গের দুই ভূষণ। প্রণয় পাশা-র পর বাকি জীবনটা তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া হয়েই তো কাটালেন। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলিতে যখনই পড়েছি ‘কী মোহিনী জান বঁধু কী মোহিনী জান, অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন’ ... তখন শ্রীমতী রাধিকাকেই দেখেছি চোখের সম্মুখে। আসলে তিনিই সুচিত্রা সেন। আমাদের আজন্মের চৈতন্যচারিণী বিষ্ণুপ্রিয়া। লাখ লাখ যুগ হাম রূপ নেহারলুঁ নয়ন না তিরপিত ভেল...





১৭ জানুয়ারি, ২০১৪... কফিনে চেপে আগুনে ভেসে গেল কেবলমাত্র একটা সময়ের ইতিকথা। তিনি আমাদের সুচিত্রিত সুচিত্রা নন। যাঁরা বললেন, ‘চলে গেলেন মহানায়িকা’ তাঁরা ভুল বললেন। জানলেনও না আজও হৃদয়ের গোপন অলিন্দে তাঁর সন্ধ্যা-কন্ঠ থেকে ভেসে আসছে সেই লাস্যময়ী আহ্বান... ‘ কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে... আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে’...

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

সেকালের থিয়েটার ও নটী বিনোদিনী
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে সমাজ প্রগতির প্রক্রিয়ায় নারীর অবদানকে যোগ্য স্বীকৃতি কোনদিনই দেয় না । বাংলা থিয়েটারে আদিপর্বে এক বারাঙ্গনা কন্যা তাঁর তন্ময় সাধনায় ও মেধায় সেকালের অভিনয় জগতের সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছিলেন ও বাংলা থিয়েটারের নির্মাণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতিও এই সমাজ দেয় নি । তিনি বিনোদিনী দাসী বা নটী বিনোদিনী ।

অন্যরকম ভাবে বাঁচার তাগিদে পিতৃ-পরিচয়হীনা বিনোদিনী থিয়েটারকেই তাঁর মুক্তিতীর্থ ভেবেছিলেন, প্রবল বঞ্চনা ও ছলনার শিকার হয়ে খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও মাত্র ২৩ বছর বয়সে চিরতরে মঞ্চত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । আশার কথা, তাঁর জন্মের সার্ধশত বর্ষে এই মহীয়সী রমণীকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাঁর জীবনকাহিনী আমরা জানতে চাইছি ।

১৮৭৪এর শেষের দিক, তখন বাংলা থিয়েটারের নিতান্ত শৈশবকাল । ঠিক দু’বছর আগে, ১৮৭২এর ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীল দর্পন’ নাটক দিয়ে । তার আগে কলকাতার ধনাঢ্য বাবুদের বদান্যতায় জমিদার বাবুদের আঙ্গিনায় সখের থিয়েটার হত মাঝে মধ্যে । কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তখন কলকাতার নতুন বিনোদন থিয়েটার দেখার সুযোগ ছিল না ।

ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাধারণের জন্য থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু নাটকের নারী চরিত্র রূপায়ণ করতেন পুরুষ অভিনেতারাই । ১৮৭৩এ বেঙ্গল থিয়েটার চারজন বারাঙ্গনা কন্যাকে অভিনেত্রী নিয়োগ করেছিলেন। মেয়েদের কাছে নাট্যাভিনয়ের দরজা খুলে গেলো সেই প্রথম, যে কাজের অক্লান্ত সৈনিক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।

মধুসূদনের বেঙ্গল থিয়েটারে নাটক দেওয়ার শর্তই ছিল নারীচরিত্রে অভিনয় মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে । ১৮৭৩ সালের ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি দিয়ে বাংলা নাট্যাভিনয়ে অভিনেত্রী নিয়োগের ধারাবাহিকতার সূচনা হয় । এই যুগান্তকারী ঘটনাটি অবশ্য দেখে যেতে পারেননি মধুসূদন, তার আগেই মৃত্যু হয় বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের পক্ষে অক্লান্ত সৈনিক মাইকেল মধুসূদন দত্তর (২৯জুন ১৮৭৩) ।

মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্য্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন । তাদের একটা তাগিদ ছিল – মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন ।

এই পথ ধরে বিনোদিনীও এলেন থিয়েটারকে ভালোবাসতে । বারো বছরের বালিকা বিনোদিনী দশটাকা মাস-মাইনেতে ভর্তি হয়ে গেলেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে, নাট্যশিক্ষক অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি ।

১৮৭৫এর শুরুতে অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির পরিচালনায় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার লক্ষ্ণৌ, লাহোর, দিল্লী প্রভৃতি স্থানে অভিনয় করে নীলদর্পণ, সুরেন্দ্রবিনোদিনী, সতী কি কলঙ্কিনী, গজানন্দ ও যুবরাজ প্রমু্খ ইংরাজ বিরোধী নাটক । বিনোদিনীও সেই দলে ছিলেন ।

তাঁদের নাটকেই ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরাজ-শাসন জারি করে কুখ্যাত নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন । গ্রেট ন্যাশনাল বন্ধ হয়ে যায়, বিনোদিনী যোগ দেন বেঙ্গল থিয়েটারে । এখানে বিনোদিনী অভিনয় করলেন ‘মেঘনাদ বধ’ নাটকে প্রমীলা, ‘দুর্গেশ নন্দিনী’’তে আয়েষা, ‘কপাল কুণ্ডলা’ প্রমুখ দুরূহ চরিত্রে । বেঙ্গল থিয়েটারে বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন মাত্র উনিশ মাস আর এই অল্প সময়েই সেকালের সব প্রধান নাট্যকারের নাটকের মুখ্য ভুমিকায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন বিনোদিনী ।

নজরে পড়েন গিরীশচন্দ্র ঘোষের । গিরীশচন্দ্র ঘোষ তাঁকে নিয়ে আসেন নিজ মালিকানাধীন ন্যাশনাল থিয়েটারে । চারবছর পরেই গিরীশচন্দ্রের ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিকানা বদল হয় । হীরা জহরতের ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি যুবক প্রতাপ চাঁদ জহুরী থিয়েটার ব্যবসায়ে নামেন ও ন্যাশনাল থিয়েটার কিনে নেন ।

গিরীশচন্দ্র চাকুরী ছেড়ে পেশাদার বেতনভোগী ম্যানেজার হন । গিরীশচন্দ্রকে সামনে রেখেই প্রতাপ জহুরীর থিয়েটার ব্যবসায়ে নামা । প্রতাপ জানতেন গিরীশচন্দ্র থাকা মানেই বিনোদিনীর থাকা । কেননা ইতিমধ্যেই বিনোদিনীর অভিনয়ই তখনকার নাট্যজগতের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল ।

বস্তুত, এই সময় থেকে বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল । বিনোদিনীর বারো বছরের অভিনয় জীবনের নয় বছরই কেটেছে গিরীশচন্দ্রের সঙ্গে, অভিনয় করেছেন ৯৬টি নাটকে ।

বিনোদিনীর নিজের কথায় - “তাঁহার শিক্ষায় আমার যৌবনের প্রথম হইতে জীবনের সারভাগ অতিবাহিত হইয়াছে” । অর্থাৎ বাংলা থিয়েটারের উদ্ভব পর্বের শৈশব অবস্থা থেকে পেশাদারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বিনোদিনীর যোগদান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল । বিনোদিনীকে বাদ দিয়ে ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই একযুগের বাংলা থিয়েটারের কোন আলোচনা করা যায় না ।

বিনোদিনীর সামনে অভিনয়ের কোন অনুসরণযোগ্য আদর্শ ছিল না । তাকে শুরু করতে হয়েছে শূণ্য থেকে । দ্বিতীয়ত, সেকালের অভিনেত্রীরা বারাঙ্গনা হওয়ার কারণে পত্র-পত্রিকাগুলিতে তাদের অভিনয়ের আলোচনা কদাচই থাকতো । বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় ১৯৭৪এর ১২ই ডিসেম্বর, গিরীশচন্দ্রের ‘শত্রু সংহার’ নাটকে একটি অপ্রধান চরিত্র দ্রৌপদীর সখীর ভূমিকায় । মাত্র চার পাঁচটি সংলাপ । মাত্র তিনমাস পরেই ১৮৭৫এর ৬ই মার্চ ‘হেমলতা’ নাটকের নামভূমিকায় এবং তারপর অভিনয় করেন নীলদর্পণ, লীলাবতী, নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, সরোজিনীর মত গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের মঞ্চসফল নাটকগুলিতে ১৮৭৬এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে ।

অতএব আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, অভিনয় দক্ষতার জন্যই মাত্র একবছরের মধ্যে নাটকের ক্ষেত্রে বিনোদিনী কত অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন ।

বিনোদিনী তাঁর ১২বছরের নাট্যজীবনে চারটি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন – গ্রেট ন্যাশনাল’ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’, ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ ও ‘স্টার থিয়েটার’। নাট্য শিক্ষক পেয়েছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি(গ্রেট ন্যাশানাল), শরৎচন্দ্র ঘোষ (বেঙ্গল) এবং গিরীশচন্দ্র ঘোষ (ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটার) । বেঙ্গল থিয়েটারে দু’বছর থাকা কালীন বিনোদিনী যথার্থ পরিণত হয়ে উঠেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনীতে ‘মনোরমা’, ‘কপাল কুন্ডলা’, দূর্গেশ নন্দিনীর ‘আয়েষা’ ও ‘তিলোত্তমা’, মেঘনাদ বধ’এ ‘প্রমীলা’র মত জটিল চরিত্রের অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন । মৃণালিনীতে ‘মনোরমা’র জটিল চরিত্রটিকে বিনোদিনী কেমন বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেকথা আত্মকথায় লিখে গেছেন, “একসঙ্গে বালিকা, প্রেমময়ী যুবতী, পরামর্শদাতা, মন্ত্রী, অবশেষে পরম পবিত্র চিত্তে স্বামী সহ-মরণ অভিলাষিণী দৃঢ়চেতা এক রমণী”। বিনোদিনী তখন ১৪বছরের বালিকা । এমন বিশ্লেষণই বলে দেয় তাঁর অভিনয় প্রতিভার গভীরতা ।

স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র মৃণালিনীর অভিনয় দেখে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ করিব এমন আশা করি নাই । আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল”।

এহেন বাংলা থিয়েটার বিনোদিনীকে মনে রাখেনি । বিনোদিনীকে পাওয়ার লোভে গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি নামে এক মাড়োয়ারি যুবক থিয়েটারের ব্যবসায়ে নামেন । তিনি একটি থিয়েটার বাড়ি নির্মাণ করে দেবেন, কিন্তু গিরীশচন্দ্রদের শর্ত দিলেন বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকার জন্য রাজি করাতে হবে, আর থিয়েটার হবে বিনোদিনীর নামে । নিজেদের থিয়েটার হবে, শিল্পীদের থিয়েটার হবে তাঁর নামে, এই প্রতিশ্রুতিতে বিনোদিনী সম্মত হয়েছিলেন গিরীশচন্দ্রদের প্রস্তাবে । নানা গন্ডগোলের কারণে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বাড়ির বদলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন বিনোদিনীকে ।

বিনোদিনী নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন । বলেছিলেন থিয়েটার বাড়ি না হলে তিনি গুর্মুখের সঙ্গিনী হবেন না । দেড়শ’ বছর আগে পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন যিনি, তাঁকে প্রতারিত হতে হ’ল তাঁর সহ অভিনেতা নাট্যরথীদের কাছ থেকে । বাংলা পেশাদারী থিয়েটারের উদ্ভব কালের সে এক ক্লেদাক্ত ঘটনা ।

বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন, “শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তুতের জন্য রাত্র পর্যন্ত কার্য হইত । সকলে চলিয়া যাইতেন । আমি, গুর্মুখ বাবু আর দু’একজন রাত্রি জাগিয়া কার্য করাইয়া লইতাম” । থিয়েটার বাড়ি হল, কিন্তু গুর্মুখ রায় বা বিনোদিনীর অজান্তে গিরীশবাবুরা সেই থিয়েটারের রেজিস্ট্রী করে নিলেন বিনোদিনী থিয়েটার নয়, ‘স্টার থিয়েটার’ নামে ।

বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন, “আমি তখন একেবারে উহাদের হাতের ভিতর! আর আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, উহারা ছলনা দ্বারা আমার সহিত এমনভাবে অসৎ ব্যবহার করিবেন” ।

এই প্রবঞ্চনা সত্বেও থিয়েটারের প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্য বিনোদিনী স্টার থিয়েটারেই থেকে গিয়েছিলেন । ১৮৮৩র ২১শে জুলাই স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয় গিরীশচন্দ্রের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে, সতীর ভুমিকায় বিনোদিনী ।

মাত্র ছয়মাস পরেই অসুস্থতা ও পারিবারিক চাপে গুর্মুখ থিয়েটার ব্যবসা ত্যাগ করেন । গুর্মুখ চেয়েছিলেন যার জন্য তিনি থিয়েটার বানিয়েছিলেন সেই বিনোদিনীকে থিয়েটারের স্বত্ব দিয়ে যেতে । এবারেও গিরীশ বাবুরা বাধা দিলেন । সরলমতী থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণা বিনোদিনী আবারও বঞ্চিত হলেন ।

মাত্র এগারো হাজার টাকায় স্টার থিয়েটার কিনে নিয়েছিলেন অমৃতলাল মিত্র, দাশুচরণ নিয়োগীরা ।

কেন এই প্রতারণা ? সেকালের নাট্যরথীরা বলেছিলেন, এক বারাঙ্গনা কন্যার নামে থিয়েটার সে যুগের সমাজ মেনে নিত না, থিয়েটার চলতো না ।

অথচ এই বারাঙ্গনা কন্যার অভিনয়ই সেদিন বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদামন্ডিত করেছিল । ১৮৮৪’র ২রা অগস্ট গিরীশচন্দ্রের ‘চৈতন্য লীলা’য় নিমাই চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয় দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ভাববিহ্বল হয়ে পড়েন, বিনোদিনীর মস্তক স্পর্শ করে আশির্বাদ করেন । থিয়েটারে অশুচিতার বেড়া ভেঙ্গে যায় । ১৮৮৬র ১৬ই অগস্ট রামকৃষ্ণ দেবের মৃত্যু, আর তার চারমাস পরেই একরাশ ক্ষোভ ও যন্ত্রণা নিয়ে অভিনয় খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও ১৮৮৭র ১লা জানুয়ারী থিয়েটার ত্যাগ করেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে । আর ফিরে আসেন নি ।

মঞ্চ ত্যাগের পর আরো পঞ্চান্ন বছর বেঁচে ছিলেন বিনোদিনী । বৃদ্ধ বয়সেও স্টারে থিয়েটার দেখতে আসতেন । গিরীশবাবুরা তাকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি ।

সেকালের সব অভিনেত্রীই আসতেন বারাঙ্গনা পল্লী থেকে, যাঁরা সকলেই বাংলা থিয়েটারের নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন, বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদামন্ডিত করেছেন, তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও এই সমাজ দেয় নি । গিরীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহে মালা দেবার অধিকারটুকুও তাদের দেওয়া হয়নি । বিনোদিনীর কন্যা সন্তানকেও সমাজপতিরা বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে বাধা দিয়েছিলেন, বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে । থিয়েটারের প্রথম অভিনেত্রী গোলাপ সুন্দরী বা স্বনামে সুকুমারী দত্ত দেশের প্রথম মহিলা নাট্যকারের সম্মান অর্জন করেছিলেন, গিরীশ-যুগের অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী তাঁর অর্জিত সম্পত্তি দান করেছিলেন শিক্ষা বিস্তারের কাজে । আবার গিরীশ-যুগ থেকে শিশির-যুগের অভিনেত্রী কুসুম কুমারী বৃদ্ধা বয়সে রংমহল থিয়েটারের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতেন ।

৭৯ বছর বয়সে ১৯৪১এর ১২ই ফেব্রুয়ারি জন্মস্থান ১৪৫নম্বর কর্নওয়ালিশ ষ্ট্রীটের বাসায় নিভৃতে তাঁর মৃত্যুকালে বাঙ্গালির সমাজ অনেক উদার, তবুও কিন্তু অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা , আমাদের থিয়েটারের নির্মাণে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া এক নটীর মৃত্যুতে কোন শোকসভা হয়নি ।

কোন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল কি না জানা নেই । তাঁর একটি কবিতার পংক্তিতে “স্মৃতি হ’তে বিস্মৃতিতেই অধিক সন্তোষ” মনে করেছিলেন বিনোদিনী । দেড়শ বছর পর আমরা কিন্তু ইতিহাসের সেই ছিন্নপত্র সন্ধান করে বেদনাহত হয়ে যাই ।

বিশেষ প্রতিবেদন - ইন্দ্রাণী ঘোষ

আমার সরস্বতী পূজো
ইন্দ্রাণী ঘোষ



জানুয়ারীর শেষে, ফেব্রুয়ারীর শুরুতে শীত যখন যাই যাই করেও যায় না, কৃষ্ণচূড়া, রুদ্রপলাশে, চারিদিক হলুদ হয়ে থাকে, একটা কোকিল মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে, ঠিক তখনি হুড়মুড়, দুদ্দাড় করে আগল ভেঙে বেরিয়ে আসে আমার ছেলেবেলা। আর ছেলেবেলা মানেই সরস্বতী পূজো ।

এক মাস আগে থেকে চলত নাটকের মহড়া - কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখলো সুকুমার রায়, কখনো ঋতু রঙ্গ নিয়ে একেবারে বাসন্তী সাজে সেজে চলে আসত দিনগুলো আমার সামনে। ভাবতাম কি করে থাকব সারাটা বছর এত আনন্দ ছাড়া। তখন তো আর বুঝতে শিখি নি, না থাকাটাকেই মেনে নিতে হয়, আনন্দ আসলে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা!

সরস্বতী পূজোর আগের রাত্রে আমরা কেউ ঘুমোতাম না। সেই রাতের নেশা এখন যে কোনো নেশা কে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে। রক্তচক্ষু এড়িয়ে সেই আনন্দের চোরাস্রোতে গা ভাসানোর এক মুক্তির আশ্বাস ছিল আমাদের কাছে। পাশের তৈরি হওয়া বাড়ির থেকে ইঁট চুরি করা দিয়ে শুরু হতো আমাদের সৃষ্টিশীলতা। সারা রাত বাজে বকে ভোর হতে যখন একটু বাকি থাকত, আমরা যেতাম ময়দা গুলে আঠা তৈরি করতে । সেই আঠা, মারবেল পেপার, চুমকি, অভ্র, সমস্ত নিয়ে সেদিন আমরা একেবারে সৃষ্টিশীলতার তুঙ্গে থাকতাম।

ঐ কয়েক ঘন্টা আমরা হয়ে পড়তাম’ চূড়ান্ত সৃষ্টিশীল। সব শেষ করে যে যার বাড়ি গিয়ে চাপ চাপ হলুদ মেখে স্নান করে নতুন পরতে শেখা শাড়ী নিয়ে লতপত করে ঠাকুরের সামনে। শুরু হত আমাদের সরস্বতী পূজো ।

আমরা সেদিন সব এক এক জন নায়িকা। সবই তো আপেক্ষিক, ভেবে নিলেই হল। সকালের অনিদ্রার চোখ জ্বালা, হলদে শাড়ীর ঝলকানী আর কাঁচা হলুদের গন্ধ নিয়ে সে কি মহা সমারোহ !

এতদিন পর হয়তো অনেক কারনেই চোখ জ্বালা করে, সেই সরস্বতী পূজোর চোখ জ্বলুনীর সাথে তার কোন তুলনা নেই। কি মুক্তির আস্বাদ থাকতো হলদে শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে। আজ প্রায় মধ্য বয়েসে এসে দাঁড়িয়ে সেই নতুন বাটা হলুদের গন্ধ ঝাপটা মারে ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে, ফিরে যেতে পারি শুধু স্মৃতিতে, যেখানে ছবিতে বাঁধাই হয়ে আছে আমার সরস্বতী পূজো।

আর সেই দিন ফিরবে না জানি, কারণ সেই চমক লাগা মনটাই তো ঘুমিয়ে পড়েছে এজ অভিজ্ঞতার লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে !

চিলেকোঠা সরগরম

এই সংখ্যার বিষয়ঃ
VIRTUAL RELATION-এ আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই


[ এই বিতর্ক বিভাগের সমস্ত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণকারীদের নিজস্ব, তা চিলেকোঠা ওয়েবজিনের মতামত নয় ]


পক্ষেঃ

১. শ্রীরূপা চ্যাটার্জী

VIRTUAL RELATION এ আবেগ আছে স্থায়িত্ব নেই ' আমি সম্পূর্ণ ভাবে এই মতটির পক্ষে। VIRTUALজগতে আমরা যখন এক জনের সাথে আলাপ করি, তখন আমরা জানতেই পারিনা সেই মানুষটা আসলে কেমন, কী করে, এমনকি সে নারী না পুরুষ এবং তাঁর সঠিক বয়স, সঠিক পরিচয়ও আমরা জানতে পারিনা, শুধুমাত্র তাঁর কথার উপর বিশ্বাস করে আবেগে ভেসে গিয়ে আমরা একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করি, অনেক সময়ই দেখা যায় একটা মিথ্যার উপর নির্ভর করে একটা নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করতে গিয়ে আমরা আমাদের জগত সংসার ভুলে, এমনকি পাশের বাড়ির বন্ধুকে ভুলে, সেই virtual জগতের বন্ধুর কথাই ভাবতে থাকি। তারপর যখন কোনভাবে আসল সত্যিটা সামনে চলে আসে, তখন শুধুই কষ্ট পেতে হয়। আবেগে ভেসে গিয়ে আমরা তার বিনিময়ে শুধু চোখের জলই পেয়ে থাকি। তাই এই বন্ধুত্বে স্থায়িত্ব থাকেনা। যতক্ষণ না আমারা তার সামনে মুখোমুখি হচ্ছি, তার সাথে নিজের মত বিনিময় করছি, ততক্ষণ আমরা জানতেই পারিনা আসল মানুষটাকে। তাই বন্ধুত্বে স্থায়িত্ব পেতে গেলে মানুষটার সাথে সামনাসামনি পরিচয়টা খুব জরুরি। আর সেই জন্যই বোধহয় আমরা virtual বন্ধুদের সাথেও বাস্তবে দেখা করি, তাদের সাথে নিজেদের সুখ দুঃখও আদান প্রদান করি, সম্পর্কটাকে একটা স্থায়িত্ব দিতে চাই।





২. বৃষ্টি ব্যানার্জী

মাননীয় বিচারকমণ্ডলী ও বিপক্ষের বন্ধুরা,

Virtual Relation-এ আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই, এই মত আমি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি। Motion-এর দুটি ভাগ – Virtual Relation-এ আবেগ ও স্থায়িত্ব। প্রথমে আবেগের কথা ধরা যাক। প্রকাশ যেমনই হোক, মানুষ মাত্রেই আবেগ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটা মানুষ আজ সামনের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে। নিজের সঙ্গে কথা বলার সময়ও এখন অপ্রতুল। ছুট্‌-ছুট্‌-ছুট্‌ -- সঙ্গী শুধু নিজের passion আর খানিকটা আবেগ, এক মুহূর্তও দাঁড়াবার সময় নেই। আর ঠিক এখানেই আসে স্থায়িত্বের প্রসঙ্গ।

চলমান এই শতাব্দীতে এসে তো স্বায়িত্ব শব্দটার Definition-ই বদলে গেছে। স্থায়িত্ব বলতে আমাদের আগের Generation-এর মানুষজন যা বোঝেন, আমাদের কাছে তার অন্য মানে। কারুর সঙ্গে ছ’মাস Relation থাকলেই মনে হয় সে অনেক দিনের চেনা। আসলে কোনো কিছু নিয়ে অনেকক্ষণ বা অনেকদিন ধরে ভাবার সময়ই আমাদের আর নেই।

ভারতে Virtual Relation সংক্রান্ত সমস্যার ইতিহাস বড়োজোর ৪/৫ বছরের পুরনো। তাই বিষয়টি যদি আমাদের আগের Generation-এর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে তো মাত্র ৪/৫ বছরের Relation Finally Stability পাবে কিনা, সেটা বিচারেরই সময় এখনও আসে নি, তাই না?

Virtual World আমাদের রুদ্ধশ্বাস দৈনন্দিন জীবনে মুক্তির জানালা। মুহূর্তে পৃথিবী আমার ১৫ ইঞ্চি screenবন্দী। নিভৃত অবসরে আবেগ তাড়িত হয়ে বিভিন্ন রকম Relation-এ জড়িয়ে পড়ি আমরা। বেশীরভাগ সময়ই মোহভঙ্গ হয়, কষ্ট পাই। কিন্তু তবুও সত্যটাকে মর্মে মর্মে জানি বলেই মেনে নিই অত্যন্ত সহজে। দুদিনের মনখারাপ, কিন্তু সেটা নিয়ে বসে থাকার সময় কোথায়? তাই আবার এগিয়ে চলা, চলতে চলতে আবার কারোর সঙ্গে দেখা হওয়া, কিছু ভালো মুহূর্ত তার সঙ্গে share করা। মনে মনে কিন্তু তৈরী থাকা, স্বীকার করি বা না করি। আসলে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে, আমরা মেনে নিয়েছি।

Virtual Relation আমাদের Practical Life-এ Secondary Choice। Virtual World-এ শুরু হওয়া Relation তখনই Stability পায়, যখন সেটা Real Life-এ Introduced হয়। আর তখন Relationটা আর Virtual থাকেই না। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, But exception proves the rule only, তাই না? So, Virtual Relation আর Stability একসঙ্গে যায়ই না, এই নিয়ে কোনও তর্কই নেই।



৩. শ্রীশুভ্র


ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কে আবেগ তো থাকবেই! কারণ আবেগের সূত্রেই আমরা অপরিচয়ের গণ্ডী পেরিয়ে পরস্পরের কাছে এসে পৌঁছোই! সে কাছে আসা শারীরীক নৈকট্যের প্রচলিত ধারণার দূরবর্তী হলেও মন মানসিকতা মমতায় হৃদয়বৃত্তির নিকটবর্তী হতে তো বাধা নেই কোনো! কিন্তু তাই বলে ভারচ্যুয়াল সম্পর্ক থেকে স্থায়িত্ব আশা করাটা অনেকটাই সোনার পাথরবাটির মতোই কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কি হতে পারে? সবচেয়ে বড়ো কথা যে সামাজিক অন্তর্জাল ব্যবস্থাকে মাধ্যম করে এই ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের গ্রন্থনা, সেটি কিন্তু বিজ্ঞানের নবীনতম আবিষ্কার! যার বয়স এক দশকের বেশী নয়! তাহলেই বোঝা যায়, এই ব্যবস্থার দৌলতে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলির এখনও শৈশব দশাই ঘোচেনি! তাই না!

তাহলেই দেখা যাচ্ছে মাত্র দশ বছরের সময়সীমায় গড়ে ওঠা এই যে ভার্চ্যুয়াল জগতের সম্পর্কের বিন্যাস, তাতেই স্থায়ীত্বের সীমানা নির্ধারণ করা অনেকটাই গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল গোছের! এদিকে ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের আবেগ নিয়ে যারা স্থায়ীত্বের সুখস্বপ্নে বিভোর, অচিরেই জীবন বাস্তবতার কঠিন ভূমিতে আছাড় খেয়ে তাদের স্বপ্নভগ্নের অভিজ্ঞতায়, ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের আবেগের ক্ষণস্থায়ীত্ব তাঁদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে! এটাই ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের বৈশিষ্ট! আবেগ আসে ঢেউয়ের মতো! যত দ্রুত তার উত্থান ততধিক দ্রুতই তার পতন! এটাই স্বাভাবিক! একটা সম্পর্কের স্থায়ীত্ব নির্ভর করে যে যে বিষয়গুলির উপর, ভার্চুয়্যাল জগতের অলিন্দে সেগুলি কোথায়?

যে কোনো সম্পর্কের স্থায়ীত্বে পারস্পরিক দায়িত্ব কর্তব্য মায়া মমতার যে ভূমিকা থাকে, ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের আলগা পরিসরে সেইগুলির অভাবই এই সম্পর্কের স্থায়ীত্বের পক্ষে প্রধানতম অন্তরায়! যে সম্পর্ক মাউসের একটা দুটো ক্লিকেই আনফ্রণ্ড থেকে ব্লকের সলিল সমাধিতে সমাধিস্ত করা যায়, সে সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে আর যাই হোক স্থায়ীত্বের গর্ব করা যায় না! তাই আবেগের আতিশয্যকেই যারা স্থায়ীত্বের নিশ্চয়তা বলে পরামানন্দে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তাদের প্রজ্ঞা সম্বন্ধে যথেষ্ঠই সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়! তাই বন্ধু, আবেগের ছোঁয়ায় ভার্চ্যুয়াল সম্পর্ক উপভোগ করুন; কিন্তু স্থায়ীত্বের কুহক মায়ায় নিজেকে প্রলোভিত করে ঠকাবেন না!


৪. নারায়ণ রায়

সেদিন পটাইবাবুর সাথে দেখা, মুখ দেখে মনে হ’ল বেশ দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। পটাইবাবুর মুখখানি এমন রোদে পোড়া আমসির মত কেন, একথা শুধাতেই পটাইবাবু বললেন, “আর বলবেন না, ক’দিন ধরে মাঝে মধ্যেই মনটা কেমন যেন উচাটন হয়ে উঠছে।” কিন্তু এর কারণটা কি? একথা জিগ্যেস করতেই তিনি বললেন, “এই মধুমাধবে থেকে থেকেই আমার এক বাল্যবন্ধুর কথা মনে পড়ছে।” আমি বললাম, “এ তো খুবই স্বাভাবিক, আমারও এমন হয়, তখন আমরা যেকোন একজন আরেকজনের বাড়ি চলে যাই আর সারাদিন ধরে গল্প গুজব হাসি মশকরা করে মনকে শান্ত করি, আমাদের দুজনের ঘরনীরাও পরস্পরের সঙ্গে বেশ ঘনিস্ঠ হয়ে উঠেছেন, আমরা এখন পরস্পরের খুব ভালো ফ্যামিলি ফ্রেন্ড যাকে বলে তাই, আপনিও তাই করুন।” এ কথা শুনে আমি যেন অবিবেচকের মত কিছু একটা বলে ফেলেছি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে দুর মশাই! সে কি করে সম্ভব? তিনি একজন দক্ষিন ভারতীয় মহিলা নাম ‘মধুজা’ কেরলে থাকেন, একসময়ে আমার পত্রবন্ধু ছিলেন, সম্প্রতি অনেক চেষ্টা করে এটুকু খবর যোগাড় করেছি যে বর্তমানে স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে দিল্লিতে সুখে সংসার করছেন, আর তাঁর স্বামীতো ব্যাপারটা জানেনই না।” আমি বললাম, “তাহলে তো এই সম্পর্ক আপনার ভূলে যাওয়াই উচিৎ,” একথা শুনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পটাইবাবু বললেন, “সেটাইতো পারছি না, এমন আবেগ-তাড়িত সস্পর্ক যে যতই ভূলে থাকার চেষ্টা করি ততই মনে পড়ে যায়, সেই সুগন্ধী রঙ্গীন খামে ভরা কত মিষ্টি মিষ্টি কথা, কত রঙ্গীন ছবি! আমরা তখন ‘শয়নে স্বপনে কিবা জাগরনে’ একজন অপরের জন্য নিবেদিত।” আমি বললাম “সত্যি আপনাদের প্রেম ধন্য, আপনার কথা শুনে আমার লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট এদের কথা মনে পড়ে যায়,” একথা বলার পর আমি আবার একটি অবিবেচকর মত কথা বলে ফেলি, “আচ্ছা পটাইবাবু, আপনি বরং আপনার ঐ মধুজাকে ভোলার জন্য বর্তমানে আবার কোন সোস্যাল মিডিয়াতে আপনার মনের মত একজনের সঙ্গে বন্ধু্ত্ব করুন।” এবার একটু মুচকি হেসে পটাইবাবু বললেন, “আপনাকে চুপি চুপি বলছি যে, সেটাও আমি করেছি এবং এক নয় একাধিক। সম্প্রতি তো একজনকে সঙ্গে নিয়ে পুরী পর্যন্ত ঘুরে এলাম।” একথা শুনে আমি বলি “তাহলে আর চিন্তা নেই, যাকে সঙ্গে নিয়ে পুরী পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন বাকী জীবনটাও তাকে নিশ্চই স্থায়ি ভাবেই সঙ্গে পাবেন।” এরপর পটাই বাবু বড়ই বিষন্ন বদনে বললেন, “না না ঘন্টুরানী এখন তার সংসার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পরেছেন যে তাকে আর অন লাইনে পাওয়াই যায় না।” এরপর হটাৎ পটাইবাবু কেমন যেন দার্শনিক হয়ে গেলেন, বললেন “জানেন রায়বাবু, জীবনে এসব অনেক করলাম, পত্রবন্ধু, টেলিফোনে বন্ধু কিম্বা সোস্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব…. একটা কথা সার বুঝেছি যে এইসব মিডিয়ার মাধ্যমে দুজনের যোগাযোগ হতেই পারে, এমন কি ঘনিষ্ঠতাও হতে পারে আর তখন যদি দুজনেই Single হয় এবং বিয়ে করা সম্ভব হয় তাহলে বিয়ে করে বাকী জীবনটা সুখী হতেই পারে, কিন্তু শুধু এই ধরনের virtual relation এর জীবন কখনো স্থায়ী হতে পারে না।” একথা বলতে বলতে পটাইবাবু এতটাই ভেঙ্গে পরলেন যে তাঁকে আর বেশী ঘাটাতে ইচ্ছা করল না এবং আমি বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ফেরা ইস্তক আমার সামনে পটাইবাবুর বিষন্ন মুখটা ভেসে উঠতে থাকলো। হটাৎ কি ইচ্ছা হ’ল ডিকশনারীটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইলাম virtual শব্দটির অর্থ কি? দেখলাম Oxford Dictionary দুটো অর্থ দিয়েছে (1) Almost or nearly the thing described, but not completely (2) ‘Computing’ not existing in reality but made by software to appear to do so. আমার মনে হয় এই দ্বিতীয় অর্থটাই আমাদের বিতর্কের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে যথেষ্ঠ অর্থাৎ যা real বা বাস্তবই নয় তা স্থায়ী হবে কি করে?



৫. রুমনি সেন


-চিত্রলেখা?
-বলো সুইট হার্ট
-আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আই লাভ ইউ
-মি টু, সোনা
-যখন তোমার ছবিগুলো দেখি তখন আমার ইচ্ছে করে (আর লেখা সম্ভব নয়)
-যাঃ আমার লজ্জা করছে। তবে আমারও ওই সব ইচ্ছে করে।
-তোমার সাথে কিভাবে দেখা করা যাবে
-দেখা করার দরকার কি?
-দরকার কি মানে? ডোন্ট ইউ লাভ মি?
-লাভ ইউ, সুইট হার্ট
-তাহলে আমাকে এড়িয়ে চলো কেন? তোমার ঠিকানা ফোন নাম্বার কিছু দাও না কেন?
-তুমি জান না আমাদের বাড়ি খুব কনজারভেটিভ। বাবা খুব রাগী। জানতে পারলে কেটে ফেলবে।
-আর এই যে রাত দুটোর সময় চ্যাট করছ তাতে বাবা কিছু বলবে না? আসলে তুমি আমায় এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না।
-প্লিজ ও কথা বোলো না।
-তাহলে কেন এমন করছ?
-আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ। গুড নাইট... সুইট ড্রিম
-চিত্রলেখা শোনো।

এইভাবেই চলছিল সৌম্য আর চিত্রলেখার প্রেম। প্রায় দুমাস হল ফেসবুকে তাদের
প্রেম চলছে কিন্তু এই মেয়ে এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে সৌম্যর প্রেমের
কথা, কামনা বাসনার কথা শোনে ও উপভোগ করে, কিন্তু যখনই ঠিকানা বা ফোন
নাম্বার চাওয়া হয় তখনই অফ লাইন হয়ে যায়। সৌম্য দিনে দিনে হতাশ এমন কি
ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে চিত্রলেখার পরিচয় জানতে পারে।

ট্রেনের কামরায় এক মহিলা সৌম্যর ঠিক মুখোমুখি বসল। বয়স্ক, চুলে ঈষৎ পাক
ধরেছে। তার চোখ, মুখের হাসি সব কিছু সৌম্যর খুব চেনা চেনা লাগল। ভীষণ
চেনা। মহিলার সঙ্গে তারই সমবয়সী আর একজন মহিলা ছিল। দুজনে নিজেদের মধ্যে নানা সাংসারিক গল্প করছিল। সেই চেনা চেনা মহিলাকে দেখতে দেখতে সৌম্য মনে মনে বলল, পেয়েছি, এ তো হুবহু চিত্রলেখা। মুখটা একেবারে কেটে বসানো। নিশ্চয় ওর মা হবে। মহিলা হঠাৎ বলল,
-আমার ছেলের কথা আর বোলো না। রাতদিন কাজে ব্যস্ত, নাওয়া খাওয়ার সময় পায় না। কোম্পানি ওকে দিন রাত খাটিয়ে নিচ্ছে কিন্তু মাইনে দেয় সামান্য। ওর
খাটুনি চোখে দেখা যায় না। রাত জেগেও ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে।
-কি করা যাবে লেগে থাকুক, একসময় নিশ্চয়ই উন্নতি হবে।
-সেই আশাতেই তো আছি। জানো আমার ছেলে কম্পিউটারে ভীষণ এক্সপার্ট। ফটোশপ টপ... সবকিছু খুব ভালো পারে। এই তো সেদিন আমার পুরনো দিনের একগাদা ফটো চাইল, বলল ফেক আইডি বানাতে হবে। অফিসের কাজে দরকার। তাই নিয়ে সারাদিন পড়ে রইল, নাওয়া খাওয়া ভুলে, এমন কাজ পাগল ছেলে।
সৌম্যর কান মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। সে বলল,
-কাকিমা আপনার ছেলের নাম কি সুজয়? মানে কিছু মনে করবেন না। আমি সুজয় নামে একজনকে জানি, কম্পিউটার খুব ভালো জানে আর ফটোশপ ফেকাইডিতে তো একেবারে মাস্টার। লিলুয়া থাকে। ওখানে সবাই ওকে চেনে।
ছেলের বিষয়ে প্রশ্ন করায় মহিলা খুব খুশী হল।
-না আমার ছেলের নাম শুভ্রদীপ। আমরা মানকুন্ডু থাকি। আমার ছেলেও খুব ফেমাস। তুমি ইন্টারনেট পারো? আমার ছেলে পারে। ইন্টারনেটে শুভ্রদীপ ভট্টাচার্য লিখলেই ওকে দেখতে পাবে।
-আপনার কোন মেয়ে আছে?
-না আমার একই ছেলে।
সেদিন রাত্রে চিত্রলেখা চ্যাটে এল
-কি করছ সোনা?
-আমি কি করছি তাতে তোর কি মা****র শুভ্রদীপ। শুওরের বাচ্চা, মাকে বেচে
খাচ্ছিস? ভালো ভালো। কাল রাতে পাঠিয়ে দিস। দশটা টাকা দেব।
চিত্রলেখা (বা শুভ্রদীপ) দমার পাত্র নয়
-চোপ। তোর তো শালা মেয়েছেলে দেখলে ***এ লাল পড়তে থাকে। এতদিন তো দিব্যি প্রেম চালাচ্ছিলি। দাঁড়া সালা, চ্যাটিং এর স্ক্রিন শট নিয়ে সব পোস্ট করব।
-যা যা করিস, আমার *** ছিঁড়বি। হ্যাঁ আমার মেয়েছেলে দেখলে লাল পড়ে আর তোর তো শালা ব্যাটাছেলে দেখলে লাল পড়ে। মুখে লিপস্টিক মেখে রাস্তায় দাঁড়া।
তাতেও দুটো পয়সা আসবে।
রাগে গরগর করতে করতে সৌম্য চিত্রলেখার প্রোফাইলে গেল। একসাথে রিপোর্ট ও
ব্লক করবে। কিন্তু দেখল চিত্রলেখা তাকে আগেই ব্লক করে দিয়েছে।









বিপক্ষেঃ




১. রানী সিনহা

ভারচুয়াল সম্পর্কে স্থায়িত্ব অবশ্যই আছে, আমি এর পক্ষেই কিছু কথা বলতে চাই...আমি কিছুতেই স্বীকার করবো না ভারচুয়াল এই সম্পর্কের কোনও স্থায়িত্ব নেই ।

কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাদের আমরা চিনি না, কিছু জানিনা তারা কেমন মানুষ, কোথায় থাকে, কি তার পেশা ।

ফেসবুক এ আসতে হলে তাদের একটা ছবি দিতে হয়, তাই সেই সুবাদে ওরা আমার কাছে পরিচিত। আমি একে Face book বা মুখ-বই বলতে পারবো না।

আমার কাছে এটা একটা সোসাইটি। একটা পরিবারের মত, পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া, খুনসুটি, সবকিছু আছে এখানে, আবার আবেগ আছে পুরো মাত্রায় ।

শোক, শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা, সন্মান, ভালোবাসা, মেলামেশা, আন্তরিকতা সব কিছু আছে এখানে। নিজেদের জানা অজানা অনেক কিছুই আদান প্রদান হয়, আর এই ভাবেই দিনের দিন কেটে যায়। কিন্তু একবারও মনে আসে না, এরা আমাদের কেউ নয়। সকলের অজান্তেই আপন হয়ে যায় সবাই কখন আমরা বুঝতেও পারি না। এই ভাবেই কখন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আর এই সম্পর্ক গুলোর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে আস্তে আস্তে কেমন স্থায়িত্বও এসে যায়। তখন মনে হয় ওরা আমার পরিবারের কেউ। সুখে-দুঃখে খোঁজখবর নেওয়া, শরীর ঠিক আছে কিনা, তার জন্য আবার সাবধান করে দেওয়া, এই ভাবেই আস্তে আস্তে স্থায়িত্ব এসে যায় এবং সেটা চিরস্থায়ী হয় । বাস্তবিক জীবনে স্কুল কলেজ বা সংসারে আমরা অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করি কিন্তু সকলের সঙ্গে কি স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে ?

তেমনি এই ভারচুয়াল জগতেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগ থাকে আর আমাদের এই আদান প্রদান, লেখালিখির মাধ্যমে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।



২. স্বপন দেব

সভার মোশন এর সপক্ষের বন্ধুগণ এবং শ্রদ্ধেয় পাঠক-পাঠিকা মণ্ডলী,

এটা যে একটা বিতর্কের বিষয় হতে পারে, আমি ভাবতেই পারিনা ! সপক্ষের বন্ধুরা যে কি-বোর্ড এ টাইপ করে আপনারা বক্তব্য পেশ করছেন, সেটাও কিন্তু একটা ভার্চুয়াল কি বোর্ড ! সভা এবং সপক্ষের বন্ধুরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ভার্চুয়াল সম্পর্কে আবেগ আছে ! আমার যৌবনকালে বিতর্ক বা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয় থাকতো, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ ! আর আমার বার্দ্ধক্যে এসে শুনছি, এক ধরণের সম্পর্ক দিয়েছে আবেগ কিন্তু, অনিশ্চিত করেছে তার বেগ বা স্থায়িত্ব ! যাই হোক, সপক্ষের বন্ধুরা এবং সভা যে এটাকে আবেগ বলে মেনে নিয়েছেন, আমি তাতেই খুশি ! একটা সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ভর করে দুটো বিষয়ের ওপর। একটি আবেগ বা ভালোবাসা এবং আর একটি পারস্পরিক বিশ্বাস এর ওপর। আপনাদের স্বীকারোক্তিতেই পরিষ্কার যে আবেগ বা ভালোবাসা এখানে বিদ্যমান। বাকি থাকে, পারস্পরিক বিশ্বাস। সেটা কিন্তু, ভারচুয়াল বা রিয়ালিটির ওপর নির্ভরশীল নয়।

পুরুষ মাত্রেই By nature, polygamist. এটা মেয়েরা তো জানেই, সারা বিশ্বই জানে। সব রকম সম্পর্কেই মেয়েরা এটা মেনে নিয়েই সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখে ! রাখতে বাধ্য হয়। এর সঙ্গে ভার্চুয়াল বা রিয়ালিটির কোন সম্পর্ক নেই।

এবার বলুন তো আমার সপক্ষের বন্ধুগণ , রাধাকৃষ্ণ বা কৃষ্ণ-দ্রৌপদীর সম্পর্ক কি ভার্চুয়াল ছিল, না রিয়েলিটি ছিলো ? মহাভারতীয় যুগ থেকে আজ অবধি কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের আবেগ এবং স্থায়িত্ব দুটোই বর্তমান ! আচ্ছা বলুন তো, রোমিও-জুলিয়েট বা ওথেলো-ডেসডিমোনার সম্পর্ক ঠিক কি ছিলো ? নাগ-রাজ কন্যা উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের মাত্র একরাত সহবাস হয়েছিলো। তার পরিণতিতে উলূপী-অর্জুনের সন্তান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে যোগদান করে বীরের মৃত্যু বরণ করেন। এটাকে কি বলবেন আমার সপক্ষের বন্ধুগণ ? আসলে ভার্চুয়াল শব্দটিই নতুন প্রজন্ম, যাকে G নামে অভিহিত করা হয় তাঁদের জন্যে। এই G নামক প্রজন্ম টি কিন্তু সদা এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। 2G থেকে 4G তে আসতে এদের বেশী সময় লাগেনা। স্থায়িত্ব কথাটাই আপেক্ষিক। বিশ্ব-চরাচরে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আর প্রেম-হীন, বিশ্বাস-হীন নিরুপায় অভ্যস্ত দাম্পত্যের থেকে যে সম্পর্ক আবেগময়, ভালবাসায় প্রাণবন্ত তার মূল্য অনেক বেশী।



৩. অনুপম দাশশর্মা

প্রথমতঃ স্থায়িত্বের কোন বাঁধাধরা সংজ্ঞা নেই। আপেক্ষিক তত্ত্বের তত্ত্বতালাশ ঘাঁটলে দেখা যাবে সময়ের আশির্বাদপুষ্ট বাছাই ভাগ্যধর লিঙ্গ নির্বিশেষে কোথাও কোথাও দীর্ঘ সম্মতিতে স্থায়িত্বের সুবিধা পায়। মূল ব্যাপারটা যেখানে সম্পর্কের ভূমিকায় জড়িয়ে আছে তখন যে কথাটি চলে আসে তা হলো আবেগ। আবেগ সম্পর্কের প্রথম বর্ণমালা।

আবার ব্যক্তিকে সবসময় ছাপিয়ে যায় সমষ্টির দাপট। তাই ভার্চুয়াল রিলেশনে ব্যক্তির ইচ্ছা-ঘূর্ণিতে বিপাকে পড়ে কেউ নিছক আবেগকে মুকুট পড়ালে বোধহয় সম্পর্ক'র প্রতি অবিচার করা হবে।

কেউ একজন বা দুজন, দশজন উদাহরণ হয়ে দাঁড়াতে পারে না বেশীর ভাগ শুভবুদ্ধি ধারকদের। প্রতিদিন যাঁরা ছায়ার আড়ালে মনের যাবতীয় সুখ আহ্লাদ অকাট্য উপস্থিতিতে এই ভার্চুয়াল জগতে হাজির করেন, রিয়েল স্টেজে তাঁদের কজন'কে এই বেগবান কঠিন জীবনে আমরা সেভাবে পাই?

সব জায়গায় কিছু বেয়াদব কৃষ্টি(?) রিপুতাড়িত হয়ে আঁচড় কাটে সৌহার্দে, ভার্চুয়ালি সে মুখগুলো সক্রিয়, ক্ষিপ্রও ততোধিক। কিছু করার নেই। কিন্তু বাকী সংস্কৃতিমুখর সুজনদের অভাব কি অস্বস্তি বাড়ায় না কোনসময় অন্তর্জালের যান্ত্রিক বিভ্রাটে?

হয়। হতেই হয়। আর তখনি স্থায়িত্বের আস্থাভোট হই হই করে জয়ী হয়ে ওঠে।



৪.অরুণ চট্টোপাধ্যায়


দিন যত যাচ্ছে পৃথিবী তত ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু মানুষের কাজের গতি ততই বেড়ে চলেছে। ইঁদুর দৌড়ের এই যুগে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তার জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দ। মানুষের মনের ওপর চাপ বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। নানা সমস্যার চাপে মানুষের প্রতি মুহূর্তেই উঠছে যেন নাভিশ্বাস। মন চায় একটু বিশ্রাম কিন্তু পায় না। আপন জনেরাও যে যার নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত। তাছাড়া আজকের দিনে পরিবারগুলি হয়ে পড়েছে পরমাণু-সদৃশ। পড়াশোনা আর রুজি রোজগারের টানে পরিবারের অন্যান্যরা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে।

একাকীত্ব মানুষের কাছে একটি অভিশাপ। মানুষের মনে গভীর আর সুদূরপ্রসারী এক বিষবৃক্ষের শেকড় গেড়ে দিতে পারে এটি। হতাশা আর অবসাদ তার জীবনে আনতে পারে এক চরম দুর্দিন। তাই এই অবস্থায় মানুষ চেয়েছে তার প্রতি মুহূর্তের একটি মনের মত সঙ্গী। সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটগুলি বিশেষভাবে ফেসবুক সেই সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষদের সঙ্গে তার যোগাযোগের দরজা খুলে দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সম্পর্ক বন্ধু নামে অভিহিত হলেও মানুষ পরবর্তী পর্যায়ে অন্য নানা নিকট সম্পর্ক পাতিয়ে বসে।

ভার্চুয়াল কথাটার মানে হল যার অস্তিত্ব আছে কিন্তু তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণতঃ সোশাল নেট ওয়ার্কিং সাইটগুলোর সম্পর্কেই এই ভার্চুয়াল সম্পর্কের প্রশ্ন ওঠে। এই সম্পর্কগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত কেউ আমরা বিশেষ জানতে পারি না বলেই হয়ত এ প্রশ্ন ওঠে।

মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। সে জানে শুধুমাত্র আবেগ সর্বস্ব হয়ে বাচা যায় না। তাই সমস্ত “অলীকত্ব” ঘুচিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তবসম্মত সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী ও উদ্যোগী হয়।

এটা ঠিক যে এই ভার্চুয়াল সম্পর্কের মোহে পড়ে বহু প্রেমের পরিণতি হতাশাগ্রস্ত ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু আবার এটাও ঠিক যে বহু প্রেমের ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলি বিবাহ নামক স্থায়িত্বের ছোঁয়া পেয়ে সুখে ঘরসংসারও করছে।

ইদানীং ফেসবুক তার ভার্চুয়াল খোলসখানা ছেড়ে ফেলতে উদগ্রীব। ফেসবুকের বন্ধুদের মধ্যে বাস্তবসম্মত দেখাসাক্ষাৎ, নানা অনুষ্ঠান, বনভোজন, সমাজসেবা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বন্ধুত্বের টানে দূর প্রবাস এমন কি বিদেশ থেকেও ছুটে আসছেন এরা নানা অনুষ্ঠানে। এ বিষয়ে চিলেকোঠা গ্রুপটি বেশ কিছুটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও পালন করছে তার সাম্প্রতিক কাজকর্ম এমনি ইঙ্গিত দেয়। শুধুমাত্র আবেগতাড়িত হয়ে কি এরা এত কিছু করতে পারতেন? একটা স্থায়িত্বের নির্দিষ্ট লক্ষের দিকেই হয়ত এগিয়ে চলেছে আজকের ফেসবুক-জগত।



৫. বেলাল হোসেন

ভার্চুয়াল রিলেশনশিপে আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই ? তাই কি ? ক্ষেত্র বিশেষে তা সত্য হতে পারে, কিন্তু, ইংরেজিতে যাকে বলে, জেনেরালাইজড, তা কিন্তু নয়। বেশ কিছু ঘটনার আমি সাক্ষী যেখানে, সোশ্যাল মিডিয়াতে পরিচয় হয়ে, পরে তা বৈবাহিক সম্পর্কে পরিণতি লাভ করেছে। কিছুদিন আগে একটি অপরিণত মেয়ে আমার চেম্বারে দেখাতে আসে, সে ছিল গর্ভবতী। আমি যখন তার মাকে বলি ‘এত বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দিলেন, তাও ঠিকমত শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেননা ! আপনাদের মত বাবা মাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিৎ ! সরকার থেকে এত চেঁচামেচি, এত প্রচার, সব জলাঞ্জলি যাচ্ছে !’ তার মায়ের উত্তর ছিল, ‘আমরা কি দিয়েছি ! ..দেখছেন না, আমরা হলাম ঘোষ, আর মেয়ে হল কিসকু’। বললাম, ‘তাতে কি হয়েছে, সে তো হতেই পারে’। আসল কথা হল মেয়েটি ক্লাস টেন-এ পড়াকালীন চ্যাট করে বন্ধু যোগাড় করে পালিয়েছিল। চেন্নাইয়ে। ছেলেটি নেহাত ভালো , মেয়েটি গর্ভবতী হওয়ায় বেশ ভয় পেয়ে যায়। তার সেখানকার বন্ধুদের পরামর্শে ফিরে আসে।

আমরা নিজেরাও কি কিছু ভার্চুয়াল সম্পর্ককে আন্তরিকতার স্পর্শে জড়িয়ে নিইনি ? হ্যাঁ, পাঁচশো বন্ধুর মধ্যে হয়তো অন্ততঃ পনেরটা সম্পর্ক সামাজিকতার বন্ধনে বাঁধা হয়েছে। বেনোজল নিশ্চয় বেশি।

মিসড কল শেষ পর্যন্ত মিসেস কল এ পরিনত হওয়ার উদাহরণও আছে । প্রফেসনাল কারণে, আমার পক্ষে এসব ঘটনা জানার সুযোগ বেশি।

আমার ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থাকে, হোস্টেলে। গত বছর, হঠাৎ, এক সন্ধ্যায় ওর বিব্রত ফোন পেয়ে বিপদে পড়ে গেছলাম, ওর পাশের রুমে একটি ছেলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে, সেই পরিস্থিতিতে পড়ে আমার ছেলে ভয় পেয়ে বমি টমি করে ভীষণ প্রবলেমে পড়ে যায়, আমি আমার ডক্টর’স গ্রুপের ওয়ালে এ নিয়ে একটা লেখা পোষ্ট করি, ব্যাঙ্গালোরে মিলিটারিতে কর্মরতা এক ডাক্তার, যে আমাদেরই কলেজ থেকে পাশ করেছে, আমি পাশ করবার অন্ততঃ পনের বছর পরে, যাকে আমি কোনোদিনই দেখিনি, সে ব্যাপারটা জানা মাত্র আমার ছেলের ফোন নম্বর চায়, এবং তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং করে দেয়।

বন্ধুপুত্র, আই আই টি তে পড়ত। নেট এ বন্ধুত্বের সূত্রে অস্ট্রেলিয়াতে ইণ্টার্ণশিপ যোগাড় করেছে, থাকার জায়গা পেতে সুবিধা হয়েছে, আবার পাশ করবার পরে চাকরিও জুটিয়েছে। হয়তো সুবিধাবাদিতা, কিন্তু যিনি উপকার করেছেন, তিনি তো হৃদয় দিয়ে করেছেন।

আসলে ব্যাপারটা নির্ভর করে মানুষের মানসিক কাঠামোর উপর। একজন স্বার্থপর মানুষ , তার চোখের সামনে যতই ভালোমানুষ থাকুক, যারা উপকার করতে পিছপা নয়, সেরকম লোকেরও প্রয়োজনের সময়, সেই স্বার্থপর মানুষের দেখা পাওয়া যাবেনা। সে কিছুনা কিছু অজুহাত খাড়া করবেই। আর সে যদি একটু বেশি বিদ্যে বুদ্ধি ধরে, তাহলে তো আর কথাই নেই। সোস্যাল মিডিয়াতে সে জ্ঞান দিয়ে ফাটিয়ে দেবে। আবেগের অস্থিরতায় অস্থির হয়ে পড়বে। বাস্তবে, কাজের লোকেরা চিরদিনই নীরবে কাজ করে গেছে, তারা প্রচারের আলো থেকে একটু দূরে থাকতেই ভালবাসে; সে মানুষের মাঝেই হোক, কি ভার্চুয়াল জগতেই হোক। কিন্তু, ভার্চুয়াল জগৎটা যেহেতু নিজের ঢ্যাঁঢরা পিটবার জায়গা, তাই সেখানে ঢক্কানিনাদের লোকজনই বেশি। তবে, তার জন্য সিস্টেমকে দোষ দেওয়া যায়না।

বাস্তব জগতের একটা ‘আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই’ এর মজার উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করি। একজন বেশ গরীব এক রোগী ক্লিনিকে ভর্তি হল, ভর্তির সময়েই সে জানিয়ে দিয়েছে, তার কতদূর কী ক্ষমতা; সেই অনুযায়ী একটা বাজেট করে তার চিকিৎসা চলছে। মাঝপথে একদিন, তার কোন ধনী আত্মীয় (যে আমারও হয়তো অচেনা নয়) হাজির হল। সে তো এসেই, আবিষ্কার করবে, ‘আরে কী চিকিৎসা হচ্ছে তোর এটা ! এই হচ্ছেনা, সেই হচ্ছে না ..চলতো দেখি, আমি নিজে ডাক্তারবাবুকে চিনি, তাঁর সঙ্গে আমি নিজে কথা বলবো....’ । যথাসময়ে সেই মক্কেল এবারে আমার রুমে হাজির হবে, আমি তার বাক্যবাণ শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, তারপর বলবো , ‘আসলে আপনার আত্মীয় বেশ গরীব মানুষতো, তার পক্ষে হয়তো অসম্ভব, আপনি যদি এই দামী ওষুধগুলি কিনে দেন..’ এই বলে তাঁর হাতে একটি ওষুধের লিস্টি ধরিয়ে দেব। এর পর আর সেই ভদ্রলোকের টিকিটির সন্ধান পাওয়া যাবেনা । তিনি তো সেই গরীব মানুষটির হাতে ততক্ষণে সেই মেডিসিন স্লিপটি ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন। কী সমাজে, আর কি ভার্চুয়াল জগতে, সর্বত্রই এই ধরনের সিউডো ( Pseudo ) পরোপকারী লোক সংখ্যায় বেড়ে গেছে, তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ‘আবেগ আছে, স্থায়িত্ব নেই’ । এতে তর্কের কী আছে। এই নিয়েই চলব।

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র


চন্দ্রবোস, দ্য আনটোল্ড স্টোরি
শ্রীশুভ্র



"A true revolutionary is one who never acknowledges defeat, ..... A true revolutionary believes in the justice of his cause and is confident that his cause is bound to prevail in the long run."

( Netaji )

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস! একটি নাম! এক কিংবদন্তী! এক ইতিহাস! এবং এক বিস্মৃত অধ্যায়! ১৯৪৫, ১৮ই আগস্ট! তাইহোকু বিমানবন্দর! বিমান দুর্ঘটনার কথিত কাহিনী! এবং এক কিংবদন্তীর অন্তর্ধান! তারপর কেটে গেছে প্রায় সাত দশকেরও বেশী সময়!আজও কিনারা হয়নি সেই রহস্যের! আজও লেখা হয়নি পুরো ইতিহাস! আজও ধামাচাপা পড়ে আছে ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের নেপথ্য কাহিনী! আজও সারা ভারত জুড়ে একঘরে করে রাখা হয়েছে নেতাজীর অবদান!

তাইহোকু বিমানবন্দরের ঘটনার পর জল অনেকদূর গড়িয়েছে! ঘটনার দুই বছরের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে মুখ রক্ষা করতে হয়েছে বৃটিশকে! ভারতবর্ষের রাষ্ট্রিক কাঠামোয় ব্রাত্য করা হয়েছে সুভাষ বোসকে! তথাকথিত স্বাধীনতার ইতিহাসে সুকৌশলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে নেতাজীর ভূমিকাকে! আর একদিকে ইঙ্গ-মার্কিণ শক্তি পঁয়তাল্লিশের আগস্ট থেকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িছে নেতাজীকে! এই একমাত্র একজন, যিনি বৃটিশকে বৃটিশের ভাষাতেই পাল্টা জবাব দিতে পেরেছিলেন! আর সেখানেই বৃটিশের অহং এ চোট লেগেছিল মারাত্মক! তাই নেতাজীকে ধরতে না পারার আক্ষেপে বিমান দুর্ঘটনার কথিত কাহিনীর পর থেকেই তাদের প্রধান টার্গেট হয়ে ওঠেন চন্দ্রবোস! প্রধান আতঙ্কও বটে!

"He has again escaped; if Subhas Chandra Bose comes again we will lose whole of Asia"
বক্তা বিখ্যাত মার্কিণ সেনাপতি ম্যাক আর্থার!

হ্যাঁ, সেদিন ইঙ্গ-মার্কিণ শক্তি এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল নেতাজী সম্বন্ধে! আর সেই আতঙ্ক থেকেই সেই ১৮ই আগস্টের তাইহোকু বিমান বন্দরের বিমান দুর্ঘটনার মাত্র দুই বছরের মধ্যে তড়িঘড়ি ভারতীয় বৃটিশভক্তদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে বাধ্য হল প্রবল পরাক্রান্ত সেই বৃটিশ! নয়ত কোনো ভাবে নেতাজী দেশে ফিরে এলে তাদের যে আম ও বস্তা দুইই যাবে, এ বিষয়ে বৃটিশের কোনো সন্দেহ ছিল না! আর এই সত্যই স্পষ্ট করে নেতাজী মারা যাননি সেই দিন! স্পষ্ট করে তথাকথিত ভারতীয় স্বাধীনতা এসেছিল ঠিক কোন পথে!

ম্যাক আর্থারের এই বক্তব্যটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম! মনে রাখতে হবে এই বক্তব্যের আগে ইউরোপে জার্মানী বিধ্বস্ত! হিটলার আত্মহত্যা করেছেন! জাপান হিরোশিম-নাগাসাকির ক্ষত নিয়ে, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছে মার্কিণদের শক্তির কাছে! তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ অক্ষশক্তি! এই রকম নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও নতুন আবিষ্কৃত পারমানবিক শক্তিতে বলিয়ান মদমত্ত প্রবল শক্তিধর মার্কিণরা কিনা আতঙ্কিত বঙ্গসন্তান চন্দ্রবোসকে নিয়ে?

হ্যাঁ ঠিক তাই! নেতাজীকে নিয়ে ইঙ্গমার্কিণ শক্তির এই আতঙ্কের মূল কারণ দুটি! তারা নেতাজীকে চিনতে একটুকুও ভুল করেনি! আর তাইহোকুর বিমানদুর্ঘটনাকে বিশ্বাস করার মতো নির্বোধও তারা ছিল না! এটাই ইতিহাস!

এই প্রসঙ্গে দেখা যাক "The Last Years of British India" গ্রন্থে লেখক Michael Edwards ঠিক কি বলছেন ; "....British had not feared Gandhi; the reducer of violence; they no longer feared Nehru; who was rapidly assuming the lineaments of civilized statesmanship....The British however; still feared Subhas Bose...."

তাই স্বভাবতঃই ইঙ্গ-মার্কিণ শক্তি সেদিন আতঙ্কে ভুগছিল শুধুমাত্র নেতাজীর ফিরে আসার সম্ভাবনায়! তাই একদিকে পাগলের মতো তারা খুঁজে গেছে চন্দ্রবোসকে! আর একদিকে কংগ্রেস ও লীগ নেতৃত্বকে নিজেদের সমস্ত শর্তে রাজী করিয়ে, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনায় এগোতে হল অকল্পনীয় দ্রুততায়!



তাইহোকু বিমানকাণ্ডের পর নেতাজীর অন্তর্ধানের সাথেই শেষ হল আজাদ হিন্দ ফৌজের স্বাধীনতা যুদ্ধ ! কিন্তু সেখানেই শেষ হল না আইএনএর প্রভাব! সেই প্রভাবের স্বরূপ বোঝা গেল, লালকেল্লায় শুরু হওয়া আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার পর্বে! সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দীদের মুক্তির দাবিতে সরব সমস্ত রাজনৈতিক পক্ষ! তাই দেশের জনমত অনুধাবন করে বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়োর পর প্রায় নেতিয়ে পরা জাতীয় কংগ্রেস এগিয়ে এল বন্দীমুক্তির দাবিতে! বৃটিশ মুখপাত্র হিউ টয়ের ভাষায়, "....As a political weapon the I.N.A. had been of the greatest use to the Congress in India." এই সুযোগে দেশবাসীকে নিজের দিকে টেনে আনা সহজ হল কংগ্রেসের!

ঠিক এই কথাই শোনা গেল মাইকেল এডওয়ার্ডসের লাস্ট ইয়ার্স অফ বৃটিশ রাজ গ্রন্থে, "The I.N.A. trials were used by Congress propagandists to glorify the right to rebel against foreign rule."

সেদিনের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দীদের মুক্তির দাবীর স্বপক্ষে না দাঁড়ালে জনগণের কাছে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাবে! তাই জওহরলাল নেহরু, ভুলাভাই দেশাই প্রমুখ ছয়জনকে নিয়ে গঠন করা হল আই.এন.এ ডিফেন্স কমিটি! নেতাজীর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে রাজনীতির প্রেক্ষাপটে! বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লীমেন্ট এটলীর কথায়, "We were sitting on the top of the volcano!"

কিন্তু কোন ভলক্যানোর কথা বলছেন এটলী ? প্রবল পরাক্রান্ত বৃটিশের ভয়টা ঠিক কোনখানে ? পট্টভি সীতারামাইয়া তাঁর ‘দ্য হিস্ট্রী অফ দ্য ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেস’ গ্রন্থে লিখছেন, "It looked as though the I.N.A. itself eclipsed the Indian National Congress and the exploits of war and violence abroad threw into obscurity the victories of non-violence at home." (Vol-2: p-784)

কি সাংঘাতিক কথা! কংগ্রেসের নিয়ম-তান্ত্রিক আন্দোলন কি তবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে? ওদিকে বৃটিশ সমর বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, "The I.N.A. affair was threatening to tumble down the whole edifice of the Indian army."


এটলীর অবস্থা সত্যই সঙ্গীন!

আই.এন.এ.র বিচার পর্বে সত্যিই বৃটিশের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছিল ! কারণ যে দুইটি স্তম্ভ ভারতে বৃটিশের সাম্রাজ্যকে ধরে রাখতে বরাবর সাহায্য করে এসেছে, সেই জাতীয় কংগ্রেস এবং বৃটিশ সেনাবাহিনীর প্রভুভক্ত ভারতীয় সেনাদের উপর নেতাজী ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রভাব দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল! পরিস্থিতির এই পরিবর্তনে বৃটিশের সামনে একটাই পথ খোলা ছিল, নেতাজীর পুনরাবির্ভাবের পূর্বেই মানে মানে বৃটিশভক্ত কংগ্রেস ও লীগ নেতৃত্বের কাছে শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেওয়া! আর সেই লক্ষ্যেই সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারা করে দেশভাগের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নেতাজীর প্রভাব সম্পূর্ণ ধুয়ে দেওয়া! আর ঠিক সেটাই তারা করল!

জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব, আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি সারা দেশের অনুরাগকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সেই আবেগকে ইন্ধন করে দেশবাসীর আনুগত্য নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা অনেকটাই বাড়িয়ে নিল! যার ফল পাওয়া গেল হাতে হাতে, ১৯৪৬এর ৪ঠা জানুয়ারী লালকেল্লা থেকে আই.এন.এ-র জেনারেল শাহনওয়াজ খান, কর্নেল সেইগল এবং ধীলন এর ঐতিহাসিক মুক্তির পর নির্বাচনে কংগ্রেসের জয়-জয়াকারে! বৃটিশ মুখপাত্র হিউ টয়ের মতে, এই বিচার পর্বেই বোঝা যায়, নেতাজীর এই অপরিসীম প্রভাব কংগ্রেসের রাজনৈতিক অগ্রগতির পক্ষে কতটা সুবিধে করে দিল! আর স্বভাবতঃই কংগ্রেসের এই অগ্রগতি বৃটিশের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল!

আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রামের দেশজোড়া আবেগের পিঠে সওয়ার হয়ে জাতীয় কংগ্রেসের এ হেন সাফল্যে বৃটিশের একটি দুর্ভাবনা ঘুচল! দেশবাসীর মনকে এবার নেতাজীর দিক থেকে ঘুরিয়ে আবার অহিংস আন্দোলনের সাফল্যের রূপকথায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা সহজ হবে! হলোও ঠিক তাই! আর এবিষয়ে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মতো বৃটিশের এমন সৃহৃদ আর কে আছে! অবশ্য মুসলীম লীগ নেতৃত্বও এই বিষয়ে জাতীয় কংগ্রেসের থেকে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিল না! আর এই দুই পক্ষের নাকের ডগায় সাম্প্রদায়িক বিভেদের উস্কানীমূলক ক্ষমতার ভাগ বাঁটোয়ারার টোপ ঝুলিয়ে দেশভাগের সুনিপুন ষড়যন্ত্রের খাল কেটে নেতাজীর আদর্শের চিরতরে সলিল সমাধি ঘটিয়ে তবেই দেশ ছাড়ল বৃটিশ! নিজের শর্তে!

১৯৪৬এ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে সেদিনের পরিস্থিতি সম্বন্ধে সাবধান করে বলা হল, "Although the Indian National Army has been disbanded following the futile attempt to 'liberate' India with Japanese support; it is still an explosive political issue and more emotionally surcharged than any to be found here.... "

নেতাজী ও তার আই.এন.এ-র প্রভাব নিয়ে এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল ইঙ্গমার্কিণ শক্তি ! এবং আশঙ্কা যে মোটেই অমূলক ছিল না সেই সত্য প্রমাণ হল ১৮ই ফেব্রুয়ারী! শুরু হলো বিখ্যাত নৌবিদ্রোহ! বিদ্রোহের প্রথম সূত্রপাত বোম্বাইতে! তারপর ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ল করাচী, মাদ্রাজ, বিশাখাপত্তম প্রভৃতি বন্দরে!

আবারও বৃটিশ মুখপাত্র হিউ টয়ের ভাষ্যে, "There can be little doubt that the serious naval mutinies and the unrest in the other two services early in 1946; owed something to its (I.N.A.) influence."

এবার দেখা যাক কি ছিল নৌবিদ্রোহীদের দাবীর মধ্যে! একটি প্রধান দাবী ছিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের সমস্ত বন্দীদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে! সরাসরি আবারও নেতাজীর আই.এন.এ-র প্রভাব! আটাত্তরটি জাহাজের নৌসেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন একে একে! বৃটিশের পক্ষে মাত্র দশটি জাহাজ! সমস্ত জাহাজ থেকে বৃটিশের পতাকা নামিয়ে তোলা হল কংগ্রেস, লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির পতাকা! নৌবাহিনীর নাম পরিবর্ত্তন করে রাখা হল, ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল নেভি!

তরুণ নৌসেনাদের এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে আহ্বান জানানো হলো বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদেরকে! বিদ্রোহী নৌসেনাদের নিয়ে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এম এস খান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন! কেউ তাদের ডাকে সাড়া দিতে রাজী নয়! সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেলেন লৌহমানব, জাতীয় কংগ্রেসের নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের কাছ থেকে! নেহরু রুষ্ট হয়ে উঠলেন নৌবিদ্রোহের সমর্থনে হরতাল ডাকায় ! গান্ধী বললেন, "Why should they continue to serve; if service is humiliating for them or India."
প্যাটেল বললেন, "...Bunch of young hotheads messing with things they had no business in.."

টাইমস অফ ইণ্ডিয়ায় লেখা হল, "As a result of the extravagant glorification of the I.N.A. following the trials in Delhi; there was released throughout India a flood of comment which had inevitable sequel in mutinies and alarming outbreaks of civil violence..."

নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, "....Stimulated by the propaganda of CHANDRA BOSE; the pro-Japanese leader who had won followers among Moslems and Hindus alikes...."

বৃটিশ মন্ত্রীসভায় বড়লাট লর্ড ওয়াভেল প্রেরিত রিপোর্টে পরিস্কার জানানো হলো, পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ! সর্বস্তরের মানুষের কাছেই বৃটিশ সরকার অপ্রিয় হয়ে উঠছে!

আবুল কালাম আজাদের মতে, "A most remarkable change had in the meantime come about in all the public services..all the three branches of the Armed Forces -the Navy; the Army; and the Air Force -were inspired by a new spirit of patriotism...these sentiments were wide-spread; not only among officers but also among the ranks."

এই রকম অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার বদলে সেদিন বৃটিশের প্রধান সহায় হয়ে দাঁড়ালো জাতীয় কংগ্রস ও মুসলীম লীগের নেতৃবৃন্দ! এটাই ভারতবর্ষের ইতিহাস !
নেতাজীর ভাবাদর্শের ছোঁয়ায় গোটা দেশ যখন দেশপ্রেমে সংগ্রাম মুখর, তখনই আঘাত এল ঠিক পেছন দিক থেকে!

নৌবিদ্রোহীদের নেতাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল! লৌহ মানব! তিনি তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তাদের সব দাবী-দাওয়া পূরণের জন্যে বৃটিশের সাথে তারা কথা বলবেন! নৌবিদ্রোহীদের যাতে কোনো শাস্তি পেতে না হয়, সেই বিষয়ে কংগ্রেস তাদের পাশে থাকতে অঙ্গীকারাবদ্ধ ! বাদ গেল না মুসলীম লীগও ! মহম্মদ আলী জিন্না তাদের জানালেন, তাদের প্রতি যাতে ন্যায় বিচার হয়, তিনি ও লীগ সর্বতোভাবে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন এবং তাদের অভিযোগ পুরণের জন্যেও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন! ২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৬! বিদ্রোহীরা সেই প্রতিশ্রুতি মত সমস্ত সেন্টারে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন ! হাঁফ ছাড়ল বৃটিশ! এবার ডাইরেক্ট একশন!

জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের নেতৃবৃন্দের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বিদ্রোহী নৌসেনারা যখন যুদ্ধ বন্ধ করে, প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণের আনন্দে মাতোয়ারা, ঠিক তখনই বৃটিশ সৈন্য বোঝাই যুদ্ধ জাহাজগুলি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কামানের গোলা ছুটে এল তাদের দিকে তাক করে! প্রথমে শান্তির পতাকা লাগানো বৃটিশের যুদ্ধ জাহাজগুলি এগিয়ে আসতে দেখে তারা ভেবেছিল, তাদেরই সমসাথীরা প্রীতিবিনিময় করতে এগিয়ে আসছে জাতীয় নেতাদের প্রতিশ্রুতি পেয়ে! কিন্তু শান্তির পতাকার আড়াল থেকে ছুটে এল বৃটিশের লক্ষ্যভেদী গোলা!
জাতীয় নেতারা বৃটিশের কথা মতো কাজ করেছেন! এবার বৃটিশের পালা তাদের হাতে নিরাপদে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যাওয়া! পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার চুক্তি!

ফণিভূষণ ভট্টাচার্য তার নৌবিদ্রোহের ইতিকথায় সেদিনের এই চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে জানান অতর্কিত এই হানায় বিদ্রোহীদের দেড়শর ওপর সৈন্য অকুস্থলেই শহীদ হন! কিন্তু তাতেও দমবার পাত্র ছিলেন না কেউ কেউ! বীর সৈনিক মদন সিং "খাইবার" জাহাজের বেতারে আবার যুদ্ধ ঘোষণা করলেন! অল আউট যুদ্ধের ডাক দিয়ে শুরু করলেন গোলাবর্ষণ! দেশের জনগণের উদ্দেশে বললেন, " See our national leaders. They are nothing but traitors of our motherland..." ফলে লড়াই করেও বিনা শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য হতে হল তাদের! কিন্তু আজও বিশেষ জানা যায়নি, কত হাজার জন গ্রেফ্তার হয়েছিল, বা কার কি শাস্তি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত!

পেছন দরজা দিয়ে কুটকৌশলে নৌবিদ্রোহ দমন করলেও বৃটিশ প্রশাসন বুঝে গেল ভারতীয় সৈন্য দিয়ে আর আগের মত ভারতবর্ষকে পদানত রাখা যাবে না! কারণ, এই সৈন্যদের মধ্যে আজাদ হিন্দ বাহিনী ও নেতাজীর প্রভাবে স্বাধীনতার আকাঙ্খা জেগে উঠছে! এখন আর তারা শুধুমাত্র বেতনভুক্‌ কর্মী নয়, স্বাধীনদেশের সৈন্যরূপেই নিজেদের ভাবতে চাইছে! ফিল্ড-মার্শাল অকিনলেক রিপোর্ট পাঠালেন; সেই সময়ে ৬,৭০৪ জন অফিসার সহ প্রায় ২২ লক্ষ ভারতীয় সৈন্যের মধ্যে প্রায় ৭০% সৈন্যই আই.এন.এ-র প্রতি সহানুভূতিশীল এবং স্বাধীনতার পক্ষে! বৃটিশ দেখল এই অবস্থায় নেতাজী একবার ভারতে ফিরে এলে, একজন বৃটিশও হয়ত জ্যান্ত ফিরতে পারবে না বৃটেনে! সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল তারা!


১৯৪৫-এর ১৮ই আগস্টের তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুকে ইঙ্গমার্কিণ শক্তি আদৌ বিশ্বাস করেনি বলেই তারা ভেবেছিল ১৯৪৬-এর মতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে নেতাজী একবার ফিরে এলে গোটা ভারতবর্ষে গণবিপ্লব ঘটে যাবে! খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের মতো বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়ক দলগুলি! ফলে চিরকালের মতোই ভারতবর্ষ হাতছাড়া হয়ে যাবে তাদের! লণ্ডন অবজারভারে লেখা হল, "India today is a vast powder magazine with exclusive potentialities exceeding those at any period of Indo-British history since Mutiny."

ঠিক, না আর ঝুঁকি নেওয়া যায় না! এই ঝুঁকি এড়াতে গেলে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরিত করে যাওয়াই ভালো!

এই সময় বৃটিশ দুটি কাজ করল একসাথে! প্রথমেই জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের নেতৃবৃন্দকে সতর্ক করে দেওয়া হল, ভারতীয় রাজনীতি যেভাবে নেতাজীর বৈপ্লবিক ভাবাদর্শ ও আই.এন.এ-র প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ছে, তাতে ভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র গান্ধী-জিন্নার সমর্থকদের হাত থেকে চন্দ্রবোসের অনুগামীদের হাতে চলে যেতে পারে! ফল মিলল হাতে হাতে! রাজনীতির সমস্ত স্তর থেকেই মুছে ফেলা শুরু হল নেতাজী ও আই.এন.এ-র প্রভাব! ইতিহাসের পাতায় নির্বাসিত করা হল, উপমহাদেশের ভাগ্য পরিবর্ত্তনের এই নির্ণায়ক অধ্যায়! আর এই সূত্রেই উপমহাদেশের তিন অংশেই নেতাজীকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়েছে গত সাত দশকে! সত্য বড়ো কঠিন! বলেছিলেন বিশ্বকবি!

দ্বিতীয়ত, বৃটিশ ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল! এ বিষয়েও সহযোগী রূপে কাছে টেনে নিল কংগ্রেস ও লীগ নেতৃত্বের প্রধান অংশকে! এই কাজে বাংলা, বিহার, পাঞ্জাবে গোপনে অস্ত্র ও গুণ্ডাবাহিনী সরবরাহ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়ে, দেশভাগের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, নেতাজী ও আই.এন.এ-র প্রভাবিত অসাম্প্রদায়িক ঐক্যবোধের স্বদেশচেতনাকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হল সহজেই! আর এই পথেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে উভয় পক্ষের টিকিই ইঙ্গমার্কিণ শক্তির হাতে শতাব্দীব্যাপী বাঁধা রাখা নিশ্চিত করল বৃটিশ প্রশাসন! আজ যা কঠোর বাস্তব!

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা! দেশভাগ! একদিকে চৌদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি, সহায় সম্পদ, জীবিকা ত্যাগ করে সীমানা পেরিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়! নতুন জায়গায় নতুন করে শূন্য থেকে জীবন শুরু করার কঠোর সংগ্রাম! আর একদিকে স্বাধীন দেশের ক্ষমতাতন্ত্রের চাকভাঙ্গা মধু খেতে দলতন্ত্রের রাজনীতিতে বুদ্ধির শান দেওয়া! এসবের মাঝে কত সহজেই তলিয়ে গেলেন নেতাজী তার অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমের দুর্ম্মর ভাবাদর্শ নিয়ে! বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেল আই.এন.এ! নৌবিদ্রোহের অকথিত কাহিনী, বিশ্বাসঘাতকতার নির্লজ্জ ইতিহাস সব- সবই ধামা চাপা পড়ে গেল বৃটিশ ও তার ভারতীয় সহযোগীদের সুনিপুণ কৌশলে! এটাই সেদিনের ইতিহাস! ইঙ্গমার্কিণ শক্তির দুরন্ত সাফল্য!

রাজনৈতিক ইতিহাসের এটাই এক সাধারণ ধর্ম! ক্ষমতার কেন্দ্রে বিজয়ী শক্তির অঙ্গুলি হেলনে অর্দ্ধসত্যের সাথে অসত্যের জাল বুনে প্রচারিত হয় জনসাধারণকে পরিচালিত করার জনপ্রিয় ইতিহাস! রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকে শুরু করে এটাই মানব সভ্যতার চরম সত্য! উপমহাদেশের স্বাধীনতার নামে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাসে আজ তাই ব্রাত্য নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ও তাঁর বৈপ্লবিক ভাবাদর্শ! স্বাধীন ভারতের সৈন্যবাহিনীতে ঠাঁই হয়না আজাদ হিন্দ ফৌজ ও নৌবিদ্রোহের দেশপ্রেমী বীর সেনানীদের! ইতিহাসের পাতায় তাদের ত্যাগ, বীরত্ব ও কৃতিত্বকে ধামাচাপা দেওয়া হয় নিপুণ কৌশলে! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অস্পষ্ট হতে থাকে প্রকৃত ইতিহাসের অকথিত কাহিনী!

অথচ সেদিন ইঙ্গমার্কিণ শক্তি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে নেতাজীকে! কোথায় অন্তর্ধান করল চন্দ্রবোস! ভারতে ঢোকার সমস্ত পথে অতন্দ্র প্রহরা! কোনো ভাবেই যেন ভারতে ঢুকতে না পারে নেতাজী! কিন্তু বিশ্বাস নেই লোকটাকে! নিশ্ছিদ্র প্রহরার জাল কেটে বেড়িয়ে গিয়েছিল লোকটা! বারবার চেষ্টা করেও তারপর আর তার নাগাল পায়নি, প্রবল পরাক্রান্ত ইঙ্গমার্কিণ শক্তি! তাই আর ঝুঁকি নিয়ে বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারেনি বৃটিশ মন্ত্রীসভা! ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে ১৯৪৮ সালকে স্থির করলেও একবছর আগেই এদেশে তাদের সহযোগীদের হাতে তড়িঘড়ি ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে হল তাদের! এতটাই প্রবল ছিল সেদিন নেতাজী ছায়া বৃটিশের আতঙ্কসরূপ হয়ে!

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ছায়া কতটা প্রবল ছিল সেদিনের বৃটিশ প্রশাসনে, সেকথা লেখা আছে মাইকেল এডওয়ার্ডসের ‘দ্য লাস্ট ইয়ার্স অফ বৃটিশ ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে! লেখকের মতে, "The ghost of Subhas Bose; like Hamlet's father; walked the battlements of the Red Fort; and his suddenly amplified figure over-awed the conferences that were to lead to independence."
এখানেই শেষ নয়! বৃটিশ মুখপাত্র হিউ টয়ের মতে, "There can be little doubt that the Indian National Army; not in its unhappy career on the battlefield; but in its thunderous disintegration; hastened the end of British rule in India."

ইতিহাসের কি করুণ পরিণতি! যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে নেতাজীর এতবড়ো সংগ্রাম, যে সংগ্রামে তাঁর ডাকে হাজার হাজার ভারতীয় সামিল হয়েছিলেন, যে সংগ্রামে শতশত আজাদী-সৈন্য শহীদ হল, যে সংগ্রামের প্রভাব পড়ল বৃটিশ সেনাবাহিনীর সকল বিভাগে কর্মরত ভারতীয় সৈন্যদের ওপর; সেই স্বাধীনতা এল না! অথচ তার বদলে তথাকথিত ভারতীয় স্বাধীনতার নামে ক্ষমতার হস্তান্তর হল পেছনের দরজা দিয়ে সেই নেতাজীরই পুনরাবির্ভাবের আতঙ্কে! আজ এসত্য স্পষ্ট, ১৯৪৫এর ১৮ই আগস্ট সত্যি সত্যিই তাঁর মৃত্যু হলে বৃটিশ অত তড়িঘড়ি পাততাড়ি গোটাতো না! কিন্তু একথাও সত্য, পাততাড়ি গোটালেও তারা নেতাজীর স্বপ্নের স্বাধীনতাকে চিরতরে ব্যর্থ করে যেতে সফল হয়েছিল সেদিন!



====উপসংহার====
দেশবিভাগের লজ্জার মধ্যে দিয়ে এল ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্ট! সম্পূর্ণ বৃথা গেল নেতাজীর আকুল আবেদন! "I have no doubt that if India is divided; she will be ruined. I vehemently oppose the Pakistan scheme for the vivisection of our motherland; our divine motherland shall not be cut up."

অথচ ক্ষমতার মধুলোভী রাজনীতিবিদরা সেদিন দেশভাগের জন্যে বৃটিশের ষড়যন্ত্রে সামিল হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি! তারাই স্বাধীন ভারতে নেতাজী, তাঁর ভাবাদর্শ ও আই.এন.এ-র বীর সেনানীদের সবরকম ভাবে একঘরে করে রাখার সুবন্দোবস্ত করেছিলেন অনমনীয় দৃঢ়তায়!

স্বাধীন ভারতে আই.এন.এর সৈন্যরা কি পুরস্কার পেয়েছিল দেখা যাক!

লৌহমানব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল

"Sardar Patel; India's first Home-Minister; explained to me in 1950 that he had been very careful indeed not to reinstate any of the officers who had gone over to Subhas Bose's I.N.A. He also saw to it that they did not thrive in politics."
[Reporting India: Taya Zinkin]

এবার জাতির জনক নেহরু!

"He (Nehru) wanted them to be kept out of politics and made no hint of any possibility of their being reinstated in the Indian army before or after the transfer of power."
[The Indian National Army: K.K.GHOSE.]


আর মহাত্মা গান্ধী? তিনি আজাদী সৈনিকদের চাষ-আবাদ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন নিজের নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে!
ইতিহাসের পাতায় আজও তাই একঘরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়!

"There is no power on earth that can keep India enslaved. India shall be free and before long." [Netaji]

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

মাইকেল এডওয়ার্ডস!
হিউ টয়!
পট্টভি সীতারামাইয়া!
ফণিভূষণ আচার্য!
শৈলেশ দে!
লণ্ডন অবজারভার!
টাইমস অফ ইণ্ডিয়া!
নিউইয়র্ক টাইমস!
ডঃ কে.কে ঘোষ!
প্রমুখ!

প্রবন্ধ - স্বপন দেব

EUTHANESIA বা স্বেচ্ছা-মৃত্যু
স্বপন দেব



(২০১১ সালে ইউ এস এ তে বসে এই লেখাটি এখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি বলেই এটা আপনাদের জ্ঞ্যাতার্থে আবার পেশ করলাম।)
বিতর্ক ছিলোই, চলেই আসছিলো, সম্প্রতি এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করলো অরুণা শানবাগ এর কেস টি। অরুণা ছিল মুম্বাইয়ের King Edward Memorial ( KEM ) হসপিটালের একজন দক্ষ, তরুণী , প্রাণচঞ্চল জুনিয়র নার্স। ২৭শে নভেম্বর, ১৯৭৩ এর রাতে যখন অরুণা তার পোশাক বদল করছিল, ঐ হসপিটালের একজন ওয়ার্ডবয়, যার নাম সোহনলাল বাল্মিকি, অরুণার গলায় কুকুরের চেন দিয়ে বেঁধে তার শ্বাসরোধ করে ধর্ষণ করে। গলায় চেন দিয়ে বাঁধার ফলে অরুণার মস্তিষ্কে অক্সিজেন এর যোগান বন্ধ হয়ে যায় এবং সেই থেকে কোমাতে আচ্ছন্ন অবস্থায় ঐ হসপিটালের বেড এ শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকে অরুণা......কিন্তু তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়না। অন্ধ, কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় ঐ ভাবেই অরুণা কাটিয়ে দিল দীর্ঘ ৩৭ টা বছর।

২০১০ সালে, অরুণার বন্ধু, পিঙ্কি ভিরানি নামে এক জার্নালিষ্ট অরুণা কে ইউথানেসিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেবার জন্যে সুপ্রিম কোর্ট এ আবেদন করেন। অরুণা বা ইউথানেসিয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এর রায় জানার আগে আসুন আমরা পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে নেই, এই ইউথানেসিয়া বা মার্সি-কিলিং নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আইন কি বলছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে অনেকদিন আগে থেকেই “Passive mercy killing” আইনসম্মত। ২০০৫ এ আমেরিকাতেও টেরীর নিষ্কৃতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য এর জন্যে টেরীর পরিবার কে দীর্ঘদিন আইনী লড়াই চালাতে হয়েছিলো। আদালত ও আইনসভার অঙ্গনে বার বার আলোচিত হয়ে অবশেষে টেরীর আবেদনে বৈধতার সীলমোহর পড়ে। আমেরিকাতে শর্তসাপেক্ষে Passive mercy killing আইনসম্মত রূপে পরিগণিত হয়। কিন্তু ভারতে, এই কয়েকবছর আগেও প্রশাসন ও বিচারবিভাগীয় স্তরে মধ্যযুগীয় মানসিকতা বিরাজমান ছিল এই কৃপামৃত্যুর ক্ষেত্রে।

হায়দ্রাবাদের ২৫ বছর বয়েসি ভেঙ্কটেশ “muscular dystrophy” রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ বছর বয়েস থেকেই জীবনদায়ী যন্ত্রের সাহায্যে বেঁচেছিলেন। দীর্ঘ ১৫ বছর কেটেছিল বিছানায় শুয়ে, মস্তিষ্ক ছাড়া সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অচল। ভেঙ্কটেশের শেষ ইচ্ছে ছিল যে, তার শরীরে লাগানো জীবনদায়ী যন্ত্রগুলি খুলে দিয়ে তাকে শান্তিতে মরতে দেওয়া হোক। ভেঙ্কটেশের এই শেষ ইচ্ছায় সম্মতি জানিয়েছিলেন তার মা সুজাতাও, যিনি ছিলেন অসুস্থ পুত্রের আ-মৃত্যু সঙ্গী। কিন্তু, ভেঙ্কটেশ ও সুজাতার আর্জি অন্ধ্র হাইকোর্ট খারিজ করে দেয় এই যুক্তিতে যে নিষ্কৃতি মৃত্যু এ দেশে আইনসম্মত নয়। এটা ২০০৬ এর ঘটনা।

৫ বছর ধরে কোমায় আচ্ছন্ন বিহারের হত-দরিদ্র দলিত পরিবারের গৃহবধু কাঞ্চন দেবী। তার পিতার ভাষায়, “জীবন্ত লাশ” ! কাঞ্চনের চিকিৎসার জন্যে এই পরিবারটির সবকিছু গেছে। পাটনা হাইকোর্ট এবং বিহারের রাজ্যপালের কাছে কাঞ্চনের পরিবারের আবেদন ছিল তার নিষ্কৃতি মৃত্যুর অধিকার প্রদান। না, সম্মতি মেলেনি। কারণ আইনি বাধা। এটা এপ্রিল ২০০৭ এর ঘটনা।

নিষ্কৃতি মৃত্যুর বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করলো ২০০৮ এর শেষের দিকে রাজস্থানের ৩ জন জৈন ধর্মাবলম্বীর “ সান্থারা” পালনের মাধ্যমে স্বেচ্ছা-মৃত্যু বরণ। জৈন ধর্মাচারে সান্থারার নিয়ম মেনে অন্ন জল পরিত্যাগ করে তিনজন ই মৃত্যু-বরণ করেন। এঁরা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন রোগভোগ করছিলেন। তিনজনের বয়েস ছিলো যথাক্রমে ৬৪, ৭৮, ৮৪। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে খুব বেশীদিন আগে নয়, বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যেও “গঙ্গা যাত্রা” নামক ধর্মাচারের মাধ্যমে স্বেচ্ছা-মৃত্যু বরণের রেওয়াজ ছিলো। আমি তখন বেশ বড়। মাত্র ১৯৬২ সালে আমার ঠাকুমা ৮৪ বছর বয়সে গঙ্গা-যাত্রা করেন। গঙ্গার ঘাটের পাশেই গঙ্গাযাত্রার জন্যে আমাদের পরিবারের কয়েকটি ঘর ছিল। উনি তার একটি ঘরে থেকে এবং কেবলমাত্র ঐ দুষিত গঙ্গাজল পান করে ১১ দিন পর দেহত্যাগ করেন। প্রসঙ্গতঃ, এঁরা কেউ ই কিন্তু স্বেচ্ছা বা নিষ্কৃতি মৃত্যুর জন্যে প্রশাসনের দ্বারস্থ হন নি, যা ভেঙ্কটেশ এবং কাঞ্চনের কাছে অপরিহার্য ছিল। মৃত্যু কামনা করা আর সেই মৃত্যুকে বাস্তবায়িত করা এক জিনিস নয়। ভেঙ্কটেশ ও মৃত্যু-কামনা করেছিলো কিন্তু সেই মৃত্যুকে বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা তার ছিলোনা। প্রয়োজন ছিল অন্য কোন ব্যক্তির বা ডাক্তারের সহায়তা, যিনি তার শরীরের সাথে যুক্ত জীবনদায়ী যন্ত্র গুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। কিন্তু সান্থারা বা গঙ্গাযাত্রার ক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তির সক্রিয় সহায়তা দরকার হয়না। এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটেছে এক নতুন বিতর্কের। প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মাচারের আড়ালে ইচ্ছা-মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলার দিক দিয়ে কতখানি যুক্তিযুক্ত ? সান্থারা বা গঙ্গাযাত্রার মধ্যে যে ধর্মীয় ভাবনাটুকু আছে, সেটুকু বাদ দিলে তা অবিকল স্বেচ্ছামৃত্যুর সমতুল্য। কৃপা-হত্যা নয়, স্থূল অর্থে আত্মহত্যাও নয়, এ হোল ইচ্ছা-মৃত্যু। রাজপুত রমণীদের জহর-ব্রত বা যতিন দাস এর কারাগারে আ-মৃত্যু অনশন, কোন কিছুর সঙ্গেই স্বেচ্ছা-মৃত্যুর তুলনা করা যায়না। এ কারণেই বলা যেতে পারে, এ এক স্বতন্ত্র ধরণের মৃত্যু।

স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমর্থন করা যেতে পারে। “জীবন স্বতঃ মূল্যবান” শুধুমাত্র এই যুক্তিতে জীবন্ত-লাশ বা উদ্ভিদের মত বেঁচে থাকাকে সমর্থন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। জীবনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ যদি থাকে তাহলে স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে সমর্থন করা উচিৎ , কারণ জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সন্মান বশতই ব্যক্তি স্বেচ্ছা-মৃত্যুর মাধ্যমে নিজের জীবনকে সন্মানীত করছে যে জীবন একদা তাঁর কাছে ছিল অতীব মূল্যবান।

ফিরে আসি অরুণা শানবাগ এর কথায়। ১৭ই ডিসেম্বর, ২০১০ এ সুপ্রিম কোর্ট অরুণার স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকার অর্জনের জন্যে করা পিঙ্কি ভিরানীর আবেদনটি গ্রহণ করেন এবং ২৪শে জানুয়ারী, ২০১১ এ কোর্ট একটি তিন সদস্যের মেডিকাল বোর্ড গঠন করে অরুণার মেডিক্যাল রিপোর্ট এক মাসের মধ্যে জমা দেবার নির্দেশ দেন। অরুণার মেডিক্যাল রিপোর্ট টি বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্ট তার মার্সি-কিলিং এর আবেদনটি খারিজ করে দেন বটে কিন্তু , ঐ ৭ই মার্চ, ২০১১ তে সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে এখন থেকে ভারতে শর্তাধীনে Passive Euthanasia চালু করার সপক্ষে অনুমতি দেন। উন্নত মানবিক চেতনা থেমে থাকেনা...... দাবী ওঠে... অধিকার অর্জনের দাবী, অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী... আর সমাজ কে একদিন না একদিন মেনে নিতে হয় সেই দাবী। সুপ্রিম কোর্ট এর রায় কে আমরা স্বাগত জানাই।

বাধা এখনো অনেক আছে... কিন্তু উদার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অনারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত যন্ত্রনা-কাতর মানুষের আইনি আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবার নিশ্চয় সময় এসেছে।

প্রবন্ধ - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার ও ভারতের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার কথাটা শুনে অনেকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হতে পারেন । ভাবতে পারেন যৌনাচার জিনিসটাই তো প্রকৃতির দেওয়া, তাহলে তা আবার প্রকৃতিবিরুদ্ধ হয় কি করে ? শুধু মানুষ কেন পশুপাখি, জীবজন্তু, এমন কি উদ্ভিদ পর্যন্ত যৌনক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করে বংশগতিকে রক্ষা করার তাগিদে । তাহলে যৌনক্রীড়া তো জীব বা উদ্ভিদের একটি প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যেই পড়ে ।

তবে আমরা জানি, মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ে এবং প্রকৃতির ওপরে উঠে দেখাতে চায় সে প্রকৃতির বশ নয় বরং প্রকৃতিই তার বশ । এজন্যে বিজ্ঞান অবশ্যই তার এক মূল্যবান হাতিয়ার ।

প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার বলতে গেলে প্রকৃতিসম্মত যৌনাচার সম্পর্কে কিছু বলতে হয় । আর তার আগে প্রকৃতি আর যৌনাচার এই দুটি কথাও একটু একটু করে ব্যাখ্যা করতে হয় ।

প্রকৃতি বলতে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন কথা জানেন । কেউ বলেন, প্রকৃতি হল লতা-পাতা, ফুল-ফল, গাছপালা, পাহাড়- পর্বত, নদীনালা এসব । উদাহরণ স্বরূপ তারা বলেন কবি, লেখক এঁরা হলেন প্রকৃতি- প্রেমিক । কারণ, এঁরা পাহাড়- পর্বত, ঝোপ- জঙ্গল এসব দেখলেই ভাবতে বসে যান । তক্ষুনি অথবা কিছু পরে তাঁদের কলমে থেকে ঝরতে থাকে কাব্য অথবা সাহিত্যরস ।

আবার কেউ জানেন প্রকৃতি মানে হল স্বভাব । যেমন, বাঘ সিংহের হিংস্র প্রকৃতি, গরু ভেড়া ছাগলের মৃদু প্রকৃতি, এইসব । মানুষেরও বিভিন্ন প্রকৃতি থাকে । নরম মেজাজের বা উগ্র মেজাজের । এমন কি প্রকৃতির নিজেরও থাকে রুদ্ররূপ ও কোমল রূপ বা প্রকৃতি । যেমন, বাতাসের রুদ্ররূপ হল ঝড়, সূর্যের রুদ্ররূপ হল ভয়ানক গরম এইসব । এই রকম বহু । উদাহরণের ডালা সাজাতে বসলে পুজো করার আর সময় থাকবে না ।

প্রকৃতি কথাটার বহু অর্থের একটি হল স্বাভাবিক । অর্থাৎ সঠিক । যদিও সঠিক শব্দটি নিজেই সঠিক অর্থে সঠিক নয় । কারণ, একশ ভাগ সঠিক জিনিসটা একমাত্র গণিত শাস্ত্র ছাড়া আর কোথাও নেই । তবু নব্বই ভাগ বা তার বেশী যদি আমাদের পৌঁছানোর লক্ষ্য মাত্রা নির্দিষ্ট থাকে, আর যদি বেশীর ভাগই তা মেনে নিই, তবে সেটাই হবে সঠিক অর্থাৎ তাই হল প্রকৃতি । যেমন ধরা যাক, প্রতিবছর জুলাই-আগস্ট মাস বর্ষাকাল । এখানে, এর অর্থ এই নয় যে, জুনের কিছু দিন বা সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের কটা দিন বৃষ্টি পড়বে না । তবে বেশীর ভাগ বৃষ্টিটাই পড়বে এই জুলাই-আগস্ট মাসে । এটাকেই প্রকৃতির নিয়ম কিম্বা বৃহৎ অর্থে প্রকৃতি বলে ধরে নিই । এবার যদি কোনও বছর আগস্ট পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টির দেখা না থাকে, তবে সেটা অবশ্যই হবে প্রকৃতির বিরোধিতা । অথবা ধরুন, ডিসেম্বর-জানুয়ারি প্রকৃতি নির্দিষ্ট শীতকাল হলেও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও যদি শীতের দেখা না মেলে তবে সেটা হবে বিরুদ্ধ প্রকৃতির চেহারা । কিংবা জানুয়ারি মাসটা যদি মাসভর অঝোরে বৃষ্টি ঝরতে থাকে তবে তাকেও প্রকৃতির বিরুদ্ধতাই বলব ।

আশা করি, প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি ।

এবার আসা যাক যৌনাচারের কথায় । কোনও প্রাপ্ত-বয়স্ক পুরুষ বা নারীকে এটি বিশদ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না । কারণ জন্মানোর পর থেকেই প্রকৃতি আমাদের মনে একটু একটু করে যৌন বিষয়ে ধারণা তৈরি করতে থাকে ।

বিষয়টি বুঝিয়ে বলা যাক । আমাদের মস্তিষ্ক হরমোন নামক এক প্রকারের রাসায়নিক পদার্থকে সৃষ্টি করে । মস্তিষ্কের Sphenoid Bone –এর ফাঁকে আটকে থাকা পিটুইটারি গ্ল্যান্ড সমস্ত রকম হরমোন ক্ষরণের জন্য দায়ী । আকারে মাত্র মটরের দানার মত এই গ্ল্যান্ডটি বহু প্রকারের হরমোন নিঃসৃত করে এবং শরীরযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে তারা বিভিন্ন ভাবে কাজ করে । কিন্তু সে তো প্রসঙ্গান্তর । আপাতত সে ব্যাপারে হেঁটে গেলে মূল বিষয়ে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে । তবে সামান্য একটু ধারণা দিতেই হয় । এই পিটুইটারি গ্ল্যান্ড যে হরমোন বা হরমোনগুলি নিঃসৃত করে, তারা আবার শরীরের অন্যান্য গ্ল্যান্ড, যেমন, থাইরয়েড, প্যারা থাইরয়েড, এড্রেনাল, ওভারি (ডিম্বাশয় - মেয়েদের ক্ষেত্রে), টেস্টিস (বীর্য থলি- পুরুষের ক্ষেত্রে) ইত্যাদির ওপর কাজ করে তাদের কাউকে অন্যান্য হরমোন নিঃসৃত করতে উৎসাহিত করে বা তাদের অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয় । সারা দেহে এরকম বহু গ্ল্যান্ড রয়েছে, কিন্তু সমস্ত গ্ল্যান্ডের নিয়ন্ত্রক পিটুইটারিকে বলে Master Gland.

পিটুইটারি মাস্টার গ্ল্যান্ড হলেও তার ওপরে কিন্তু আবার একটা হাইকম্যান্ড আছে সে হল ব্রেনের প্রধান একটি অংশ অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস । হাইপোথ্যালামাস তৈরি করে কতগুলি হরমোন উৎপাদক উত্তেজনা ( Hormone Releasing Factors) যারা পিটুইটারির ওপর কাজ করে । হাইপোথ্যালামাস আবার নিজেও স্বাধীন নয় । তাকেও কিন্তু খানিকটা নির্ভর করতে হয় পরিবেশের ওপর । পরিবেশের সঙ্গে ব্রেনের যোগাযোগ হল চোখ, কান, নাক , জিভ, চর্ম, আর মন বা চিন্তন । এদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু হাইপোথ্যালামসকেও চলতে হয় ।

হরমোনগুলি প্রোটিন জাতীয় পদার্থ আর এরা রক্ত দ্বারা সারা শরীরে প্রবাহিত হয় । মজার ব্যাপার হল এরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে Feedback Control পদ্ধতিতে। হরমোনগুলির অসংখ্য কাজের মধ্যে রয়েছে দেহ ও দেহের অঙ্গগঠন ও তাদের পুষ্টিসাধন, তাদের উত্তেজিত করণ । হরমোনগুলির আধিক্য বা ঘাটতি শরীরে নানা রোগের জন্ম দেয় । মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে এই হরমোনগুলি প্রবেশ করে প্রধানতঃ দুই ভাবে । এক, গর্ভস্থ অবস্থায় আর দুই, ভূমিষ্ঠ হবার পর স্তনদুগ্ধ পানের মাধ্যমে । মাতৃস্তন পানের অনেক উপকারিতার মধ্যে একটি কিন্তু এই মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে হরমোন প্রবেশ ।

আমরা হরমোন প্রসঙ্গে বেশী ঢুকলে ফেরার ট্রেন পাব না । তবু কয়েকটা স্টেশন তো সেদিকে যেতেই হবে না হলে সেক্স বা যৌনতা জিনিসটিকে সঠিকভাবে বোঝানো হয়ত যাবে না । তাই সেদিকেই একটু হাঁটা যাক । এই সমস্ত হরমোনগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সেক্স-হরমোন । যারা সেক্স-যন্ত্রগুলিকে (Sex Organs) জনন বা Reproduction এর উপযোগী করে তোলে । শরীরে যৌন-উত্তেজনা আনে । এবং অত্যন্ত সুন্দর ও মসৃণভাবে আর ধীরে ধীরে একটি মানুষকে (শিশু > কিশোর > তরুণ > যুবক ) যৌন- সচেতন করে তোলে । যৌন উন্মেষ ( Onset of Sex Feeling) কিন্তু একদিনে আসে না । যদিও মিডিয়া অর্থাৎ বাইরের যোগাযোগ যেমন দেখা, শোনা, ঘ্রাণ গ্রহণ, বই পড়া, ছবি বা ভিডিও দেখা ইত্যাদি যৌন উন্মেষের অনেকগুলি কারণ ও তারা যৌন উন্মেষ ঘটাতে পারে দ্রুত, তবু একথা মানতেই হবে বাইরের জগৎ থেকে মুক্ত বা গুহার অন্ধকারে আবদ্ধ প্রাণীরও যৌন উন্মেষ ঘটবে । কারণ প্রকৃতিই এই কাজটি সুসম্পন্ন করে থাকে ।

আগেই বলেছি, যৌন উন্মেষের একটি সুনির্দিষ্ট ও পূর্ব নির্দিষ্ট পথ আছে ।

কিন্তু পথটি যদি মসৃণ না হয় বা জটিল হয় তো মানুষের যৌনশিক্ষা (এক্ষেত্রে প্রকৃতির দ্বারা ) বিকৃত হতে পারে । জীবনের বিভিন্ন ভাগে মানুষ কিন্তু যৌন-বিকৃতির কোপে পড়তে পারে । প্রকৃতি আপ্রাণ চেষ্টা করে তাকে সঠিক পথে আনার । কিন্তু যদি ব্যর্থ হয় তখন মানুষ যৌন বিকারগ্রস্ত মানসিক রুগী (Sex Maniac বা Perverted Sex) হতে পারে বা হতে পারে বিভিন্ন যৌন কুকর্মের কর্তা অর্থাৎ যৌন অপরাধী (Sex Offender) । তখন প্রয়োজন হয় চিকিৎসার । চিকিৎসার ফলে কে কি ভাবে ভাল হয় বা না হয় সে কিন্তু অন্য প্রসঙ্গ । আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই । আমরা এখানে শুধু কারণ আর ফল নিয়েই আলোচনা করব প্রতিকার নিয়ে নয় ।

ওপরের প্যারাগ্রাফগুলি হয়ত পাঠকদের কিছুটা ধারণাও দিতে সমর্থ হয়েছে কিভাবে প্রকৃতি সেক্স বা যৌনতাকে মানুষের ( বা অন্যান্য জীবের) মধ্যে আনে, আর তাকে যৌন বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা, যাতে পরিণত একটি মানুষ ( বা জীব বা উদ্ভিদ ) উপহার দিতে পারে তার ভবিষ্যৎ সুন্দর এক প্রজন্মকে ।

জীব (এর মধ্যে উদ্ভিদকেও ধরতে হবে), জড় আর শক্তি এই তিনটিই প্রকৃতির তৈরি করা জিনিস বলে আমরা মনে করতে পারি । আর প্রকৃতি কিন্তু সব সময়ই চায় এই তিনটি জিনিস যেন বয়ে চলে নিজের নিজের খাত ধরে । সেজন্য প্রকৃতিই সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছে । বংশধারাকে নিজস্ব ধারায় প্রবাহিত করতে প্রকৃতি কিন্তু সদা-উন্মুখ ( ব্যতিক্রম কিন্তু ব্যতিক্রমই )।

তাহলে প্রকৃতি আর যৌনাচার দুটি বিষয় কিছু কিছু নিশ্চয় আমাদের বোধগম্য হয়ে থাকবে । যাদের না হবে তাদের অনুরোধ, একটু সময়ের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রথম থেকে আবার পড়ে নেবেন ।

এবার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচারগুলি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে । মনে রাখবেন আমরা এখানে শুধুমাত্র এই ধরণের আচারগুলি নিয়ে আলোচনা করব । তাদের পরিণতি বা সেগুলি আইনসম্মত কি আইনবিরোধী কিংবা হলে তাদের কি বা কতটা শাস্তি এসব নিয়ে আলোচনা এখানে হবে না । কারণ সেগুলি আইন বিষয়ের ব্যাপার এবং বর্তমানে আমাদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় । এই নিবন্ধটি সমাজের বা লোকাচারের সঙ্গে যুক্ত । আইনের সঙ্গে নয় ।

দুটি প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে মিলিত হয়ে যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে । এক্ষেত্রে তারা বা তাদের কেউ একজন বিবাহিত হতেও পারে বা নাও হতে পারে । উভয়েই বিবাহিত হতে পারে বা উভয়েই অবিবাহিত হতে পারে । তবে প্রত্যেককেই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে আর প্রত্যেকের সম্মতি (লোভ, ভয়, বলপ্রয়োগ বা নেশা দ্বারা আচ্ছন্নতা ব্যতিরেকে ) থাকা চাই । বহু দেশে অনেকে এইভাবে লিভ টুগেদার বা একত্র বসবাস করে থাকে । বা প্রাক-বিবাহ কালে যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে । এই মিলনে সাধারণতঃ কারোর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি না হবারই সম্ভাবনা । এটি একটি সাময়িক চুক্তি মাত্র । তবে এরও কিছু সমস্যা থাকে। যেমন, ১) অসতর্কতার জন্য অবাঞ্ছিত সন্তান উৎপাদনের ঝুঁকি, ২) এর মধ্যে দুই বা যে কোনও এক পক্ষ বিবাহিত হলে তাদের বা তার সংসারের অশান্তি ও তৎ সংক্রান্ত সামাজিক ও আইনগত জটিলতা, ৩) যৌনরোগগুলির সংক্রমণ (Spreading of Sex-contaminated diseases) । বহুপত্নী (Polygamy) বা বহুস্বামী (Polyandry) আইনত সম্ভব নয় । সেজন্য বহু লোকে ( পুরুষ বা স্ত্রী ) এ ধরণের যৌনাচারে লিপ্ত হয় বা হতে পারে । এই যৌনাচারের পথগুলি প্রকৃতিবিরুদ্ধ না হলেও নানান সামাজিক ও সাংসারিক জটিলতার জন্ম দিতে পারে । নীতির অবনমনও ঘটতে পারে । তাই এই বিষয়টি সম্পর্কে এই প্রবন্ধের স্পষ্ট কোনও মত নেই ।


ধর্ষণ বা বলাৎকার বা Rape:

উপরোক্ত ক্ষেত্রে যদি যে কোনও এক পক্ষের সম্মতির অভাব থাকে তবে তাকে এই অভিধায় অবিহিত করা হয় । একথা মনে রাখতে হবে যৌনাচার বিষয়টি কোনও এক পক্ষের সিদ্ধান্ত দ্বারা সীমায়িত নয় । বিবাহিত নারীপুরুষ যখন মিলিত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় যে পারস্পরিক ইচ্ছাতেই তারা এই কাজ করছে । একথা ঠিক যে অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কোনো একজনের সাময়িক অসম্মতি থাকতে পারে । যেমন, অফিস থেকে ফেরা ক্লান্ত স্বামী মিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারে বা গৃহকর্মে বা অন্যান্য মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত স্ত্রী মিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন । পরে হয়ত ভালবাসার খাতিরে তারা মিলিত হন । হয়ত পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ এই অনিচ্ছাকেও ধর্ষণের সমতুল হিসেবে দেখে। তবে আমাদের দেশের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি একে এখনও পর্যন্ত ধর্ষণ হিসেবে দেখে না । ধর্ষণে এক পক্ষ (ধরা যাক পুরুষ যারা নারীর তুলনায় শক্তিশালী ) ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে বা আঘাত করে বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে বা নেশা দ্বারা প্রতিপক্ষকে আচ্ছন্ন করে অন্য পক্ষকে যৌনাচারে বাধ্য করে থাকে । সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই যৌনাচার প্রথাসম্মত নয় ও নিষিদ্ধ ।


সমকামিতা (Homo-sexuality):

সম লিঙ্গ অর্থাৎ দুই পুরুষ বা দুই মহিলার মধ্যে পারস্পরিক যৌনাচার । এখানে দুই পক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক হলেও বা তাদের সম্মতি থাকলেও, উভয়ের মধ্যে বলপ্রয়োগ, লোভ, মৃত্যুভয়, নেশা দ্বারা আচ্ছন্নতা না থাকলেও তা কোনোভাবেই ধর্তব্য নয় । এইরূপ যৌনাচারকেও প্রকৃতিবিরুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় । কারণ, এখানে যৌনাচারের নিজস্ব নির্দিষ্ট যৌনাঙ্গগুলির পরিবর্তে বিকল্প অঙ্গগুলি ব্যবহৃত হয় । যৌনাচারের নিজস্ব পথ ও প্রথাটি বিলুপ্ত হয় । অনেক সময় এটি একটি বিকৃত মানসিকতারও (Perversion) জন্ম দিতে পারে । যেমন ধরা যাক, যারা এই ভাবে অভ্যস্ত তারা স্বাভাবিক যৌনাচারে বিমুখ হতে পারে । প্রকৃতি তার ওপর তার বংশধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে দায়িত্ব দিয়েছে, তাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে সে বিবাহ ও সংসার-জীবন থেকেই দূরে সরে থাকতে পারে । এবং এর দ্বারা বিভিন্ন যৌনরোগগুলির সৃষ্টি ও বিস্তার ঘটতে পারে ।


মেয়েদের মধ্যে সমকামিতা বা Tribalism or Lesbianism:

এই ক্ষেত্রে দুইটি নারী তাদের নিজ নিজ যৌনাঙ্গগুলি ব্যবহার করে থাকে যৌনাচারের জন্য । এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরুদ্ধ-যৌনসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করে তৃপ্তি পায় । বলাই বাহুল্য এইরূপ যৌনাচার প্রকৃতি ও সমাজ সমর্থন করে না ।


মানবেতর প্রাণীর সঙ্গে যৌনাচার বা Bestiality:

এটা অনেকের ক্ষেত্রে বিস্ময়ের হলেও সত্যি যে, কিছু কিছু মানুষ পশুপাখিকেও তাদের যৌনাচারের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারে । সাধারণতঃ গরু, বাছুর, ভেড়া ছাড়াও হাঁসমুরগি পর্যন্ত এই কাজে ব্যবহৃত হতে পারে । তবে এই যৌনাচার স্বাভাবিক মানসিকতার দ্বারা সংঘটিত হয় না । বিকৃত মানসিকতা আর পশু পাখীর দ্বারা সঙ্গমে যৌনরোগগুলির নিরাময় হতে পারে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস কিছু কিছু অস্বাভাবিক মানুষকে এই প্রকারের প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচারে লিপ্ত করতে বাধ্য করে । অনেকের পশুপাখি বেছে নেওয়ার অন্য অর্থ হল তাদের দ্বারা কোনও অনিষ্ট হবে না (তারা নিশ্চয় যৌনাচারী মানুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে যাবে না ) এই বিশ্বাস ও নির্ভয়তা-প্রাপ্তি । ভারতীয় সমাজ এই যৌনাচার সমর্থন করে না।


শিশুর সঙ্গে যৌনাচারঃ

মন ও শরীর দ্বারা প্রাপ্তবয়স্ক নয় এমন শিশু যৌনাচারের কোনও পক্ষ হতে পারে না । কারণ তাদের যৌনাঙ্গগুলি ও মস্তিষ্ক যৌনাচারের পক্ষে অপরিণত থাকে । এই প্রকার যৌনাচার শুধু তাদের শরীরেই নয় মনেও প্রভাব বিস্তার করে অত্যন্ত গভীরভাবে আর এই প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী এমন কি সারাজীবন ধরে তার মানসিক স্বাস্থ্যকে পঙ্গু করে দিতে পারে । সংগত কারণেই প্রকৃতি ও সমাজ এই ধরণের কাজ সমর্থন করে না ।


নিকট রক্ত-সম্পর্কের ব্যক্তির সঙ্গে যৌনাচার (Sexual act between two persons having very near blood relationship) বা Incest:

খুব নিকট সম্পর্কের ব্যক্তি যেমন বাবা/মেয়ে, মা/ছেলে, কাকা-কাকিমা/ ভাইঝি-ভাইপো, সৎ মা-বাবা/ সৎ ছেলে-মেয়ে, ভাই/বোন, সৎ ভাই/ সৎ বোন, ঠাকুরদা / নাতনি, ঠাকুমা/ নাতি ইত্যাদি । সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলি অস্বাভাবিক ।

ওপরে যে ধরণের যৌনাচারগুলির কথা বলা হল সেগুলি ছাড়াও আরও বহু প্রকার যৌনাচার আছে । মনে রাখতে হবে, এই আচারগুলির কিছু কিছু হয়ত কোনও কোনও দেশে আইনসিদ্ধ, আবার হয়ত কোনও কোনও দেশে আইনবিরুদ্ধ । এ সম্পর্কে এই প্রবন্ধকারের কোনও বক্তব্য নেই । আইনের কথা আইন বলবে । আমরা সমাজের লোক আমরা শুধু সমাজের কথা বলব ।

পাঠকরা লক্ষ করে দেখেছেন হয়ত, আমি প্রকৃতিসম্মত যৌনাচার সম্পর্কে কিছুই বলি নি । পাঠকরা আরও লক্ষ করে দেখেছেন যে, আমি না বলা সত্ত্বেও এই বিষয়টি কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁদের বোধগম্য হয়েছে । কারণ ইতিবাচক বিষয়টি পাবার একটি রাস্তা হচ্ছে নেতিবাচক বিষয়গুলিকে বাদ দেওয়া । যেমন চাল থেকে কাঁকর বাছা বা ছাঁকনি দিয়ে চায়ের পাতাগুলিকে চায়ের লিকার থেকে আলাদা করা । সেটা তাঁরা করেছেন আর আসল বিষয়টি নিজে নিজেই পেয়ে গিয়েছেন । এই কৃতিত্ব আসলে শুধু লেখকের নয়, সচেতন পাঠকেরও বটে ।

এটা সকলেই স্বীকার করবেন যে, যৌনতাকে বাদ দিয়ে জীবন হয় না । কারণ যৌনতার আবশ্যকতাই হল বংশধারাকে স্বখাতে প্রবাহিত-করণ । মানুষ অত্যন্ত উন্নত প্রজাতির প্রাণী । তাই সে শুধুমাত্র সুন্দর বর্তমান নিয়েই খুশি ও সুখী নয় । তার সুখ আর আনন্দ সুন্দর এক ভবিষ্যতকে খুঁজে নেওয়ার মধ্যেও । সুস্থ যৌনতা মানুষকে সেই সুযোগ দেয় । সুস্থ যৌনতা মানে সুন্দর জীবন । বৃহৎ অর্থে তা একটি সুন্দর সমাজ গড়তে সাহায্য করে । মানুষের মনের অসুস্থ ও বিকৃত কামনা সমাজের নানা অশান্তি ও অপরাধের সূচনা ঘটাতে পারে । সূচনা করতে পারে নানা মানসিক ব্যাধি ও তৎ সংক্রান্ত জটিলতা । দিনে দিনে দিকে দিকে যৌন বিকার আর যৌন অপরাধগুলি বেড়েই চলেছে । আজকের সমাজ তাই এক অদ্ভুত যৌন সংকটের ভারে ভারাক্রান্ত । তাই আসুন না, আজ থেকে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক সুস্থ যৌনতা – সুস্থ জীবন – সুস্থ সমাজ আর পরিশেষে সুন্দর ও উজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ ।

দীর্ঘ কবিতা - অলোক চৌধুরী

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোট গল্প ফাঁসুড়ে ডাকাতঅবলম্বনে।

ফাঁসুড়ে ডাকাত
অলোক চৌধুরী

তখন আমার বাইশ বছর বোধ হয়,
আমি তখন মাদুলির ফেরিওয়ালা।
কবিরাজের কাছে চাকরি করে,
ঘুচিয়ে ছিলাম সংসারেরই জ্বালা।।

সাত্ত্বিক বামুন সাজতে হতো আমায়,
গেরিমাটিতে ছোপানো কাপড় পরে।
পায়ে থাকতো ক্যাম্বিসেরই জুতো,
রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করে।।

বছর তিনেক সেই চাকরি করি,
ছেড়ে দিলাম ধকল সইল না।
ছাড়ার আগে গিয়েছিলাম এক গ্রামে,
আদায় করতে না দেওয়া পাওনা।।

বর্ধমানের মাখনপুরে যেতে,
মেমারী থেকে হাঁটার রাস্তা ধরি।
রাস্তায় কিছু উদর পূর্তি করে,
যেতে হবে সেথায় তাড়াতাড়ি।।

শুনে সবাই ভয় দেখিয়ে বলে,
ঠাকুরমশাই যাবেন না গো হোথা
ফাঁসুড়ে ডাকাত ঘাপটি মেরে থাকে,
শরীর থেকে কেটে নেবে মাথা।।

তবু আমায় যেতেই হবে সেথা,
বারণ আমি তাদের নাহি শুনি।
সন্ধ্যেবেলায় এক দিঘির কাছে এসে,
       একা আমি মনে প্রমাদ গুনি।।

খুব বড় সেকেলেএক দিঘি,
দুই পারেতেই তালগাছের সারি।
ডাকাত যদি আসে আমার কাছে,
উল্টো দিকেও দৌড় দিতে পারি।।

দূরে দেখি লিলি করছে গ্রাম,
ওই গ্রামটাই খুঁজছি আমি যাকে।
ওটা নিশ্চই সেই সঞ্জয়পুর,
কি ভয়টাই না দেখিয়েছিল লোকে।

তখন আমার এটাই মনে হল,
মানুষ কেন মিথ্যে দেখায় ভয়।
যেসব কথা বলেছিল ওরা,
এসে দেখি তেমন কিছুই নয়।।

হটাৎ দেখি এক বৃদ্ধ পিছন পানে,
আমার দিকেই আসছে মনে হয়।
হাত নেড়ে সে আমায় যেন ডাকে,
কাছে এসে বললে সে আমায়।।

সাঁঝেরবেলা যাবেন আপনি কোথা,
রাতের বেলায় একটু বিশ্রাম নিতে।
চলুন না তবে আমার বাড়ির পানে,
যেথায় যাবেন পৌঁছে দেব প্রাতে।।

অসুবিধা কিছুই রাখব না যে,
চাল ডাল সব মজুত ঘরেতেই।
একটু খানি পুণ্যি করার লোভে,
বামুন সেবা করে ধন্য হই।।

মনে হলো ভালোই হলো আমার,
ভগবান তো আছেই আমার সাথে।
বৃদ্ধের নাম নফর চন্দ্র দাশ
,
উঠলাম গিয়ে এক চণ্ডী মণ্ডপেতে।।

এক নাগাড়ে হটাৎ কুকুর ডাকে,
কেমন যেন অমঙ্গলময়।
মনে হলো এলাম শশ্মানভূমে,
এটা কোন গৃহস্থবাড়ি নয়।


পরে দেখি বেশ অবস্থাপন্ন তিনি,
বাড়ির মধ্যে তিনটে ধানের গোলা।
গোয়ালঘরে আছে কত গরু
,
বাড়ির মধ্যে চারটে আটচালা।।

সেইখানেতে একটা ছোট্টঘরে,
থাকতে দিল আমায় যতন করে
চাল, ডাল, জল এনে দিল সবই,
বলল, স্বপাক রান্না নেবেন করে।।

খানিক পরে সমুখ পানে দেখি,
       ঝাঁটা হাতে আসছে একটি মেয়ে।
মনে হলো বাড়িরই কোন বউ,
       সামনে এসে চকিতে তাকাল চেয়ে।।

অপলকে তাকিয়ে আমার পানে,
       ভাল লাগে না গণ্ডগ্রামে এসে।
ব্যাপারটা মোর লাগছে না তো ভালো,
       ঝামেলায় কি পড়ব অবশেষে।।

খানিকবাদে উঠান ঝাঁটা দিয়ে,
       চলে গেল ভিতর বাড়ির দিকে।
আমার পানে চায় যে ফিরে ফিরে,
      ভাবি আমি, বলবে যা তা লোকে।।

মিনিট পাঁচেক পরেই আবার এলো,
       মনে হল সে খুবই উত্তেজিত।
নীচুস্বরে বললে আমার পানে,
    আজ আপনার মৃত্যু নির্দ্ধারিত।।

এরা হল ফাঁসুড়ে ডাকাত সব,
       এখান থেকে পালান সুযোগ পেলে।
চকিতে সে চলে গেল কোথা,
      আচম্বিতে আমায় এ সব বলে।।

শুনে আমার হৃদকম্প শুরু,
       খুন্তি আমার রয়েই গেল হাতে।
ভাবি গৃহস্থরা ডাকাত অবশেষে,
       জীবন আমার শেষ হবে এই রাতে।।

কি করেই বা পালাব এখান থেকে,
      জানিনা তো গ্রামের কোন কিছু।
ছেলেদের নিয়ে বৃদ্ধ দাওয়ায় বসে,
পালাতে গেলেই করবে কেটে কচু।।

মিনিট পাঁচেক পরেই বউটি আসে,
       মনে ভাবি, দয়াময়ী ওগো তুমি।
দাওনা বলে পালাব কিভাবে যে,
       কি যে হবে জানেন অন্তর্যামী।।

বউটি বলে, দেখে এলাম সব,
       পালাবার তো কোন উপায় নাই।
ঘাঁটি আগলে বসে আছে ওরা,
       অন্য কিছু  ভাবতে হবে তাই।।

তবে একটা উপায় এখনও দেখি আছে,
যদি তাতে কিছুটা কাজ হয়।
ব্রহ্মহত্যা হয়েছে অনেক হেথা,
       বন্ধ এবার করবই তা নিশ্চয়।।

মনে রাখুন আমার ক’টা কথা,
       বাঁচার রাস্তা আছে ওই একটাই।
বলতে যদি পারেন ঠিক মতো,
       অভিনয়টাও করতে পারা চাই।।

আমার নাম বামা, বাড়ির মেজবউ,
        হরিদাস আমার বাবার নাম।
বাপের বাড়ি আমার কুসুমপুর।
        আপনারও বাস আমাদের সেই গ্রাম।।

আমরা হলাম দুটি মাত্র বোন,
       ক্ষান্তমণি আমার দিদির নাম

তার শ্বশুরের নাম দুর্লভ দাস,
       সামতাপুর, তেওটা বর্দ্ধমান।।

জাতে আমরা সবাই বারুই,
       আমার বাবা এখনও আছে বেঁচে।
মা মারা গেছেন আমার ছোটবেলায়,
       জ্যাঠামশাই এখনও সাথেই আছে।।

বলবেন আপনি তাদের গুরুবংশ,
       তখন যেন কাঁপে না এই গলা।
সন্দেহ যেন না হয় কোন মতে,
       তাহলে আপনার শেষ হবে ভবখেলা।।


ভয় পাবেন না গুরু ঠাকুরমশাই,
       রান্না খাওয়া এবারে সেরে নিন।
তারপরেতে শ্বশুরের কাছে গিয়ে,
       আপনার এই পরিচয়টা দিন।।

খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে আমি,
        নিজের মনে বারেক ঝালিয়ে যাই।
ভুলটি যদি কিছু বলে ফেলি,
        সাঙ্গ হবে সাধের জীবনটাই।।

হটাৎ দেখি সামনে গৃহস্বামী,
      দাঁড়ায় এসে দরজাখানি খুলে।
ঠাকুরমশাই নিন পানটা খান,
       গৃহস্বামী হেসে আমায় বলে।।

সামনে পেয়ে শুধাই আমি তারে,
একটা কথা আপনাকে আমি কই।
আমার এক মন্ত্রশিষ্য আছে,
       বাস তাহার এই সঞ্জয়পুরেতেই।।

হরিদাস নামটি তাহার,
      ছোট মেয়ের নাম বামা।
এখানে কোথাও হয়েছে তাহার বিয়ে,
      আছে নাকি আপনার তা জানা।।

বলে ছিল হেথায় আসার সময়,
ঘুরে আসতে তাদের বাড়ি থেকে।
কাল সকালে সেথায় যাব আমি,
       চেনে তাদের গ্রামের সর্বলোকে।।

আমার কথা শুনে গৃহস্বামী,
অবাক হয়ে আমার পানে চায়।
সত্যি করে আপনি তাদের চেনেন,
       দয়া করে বলুন তা সব আমায়।।

বামার কথা মনে স্মরণ করি,
       দৃঢ়স্বরে বলি তাদের আবার।
আমি হলেম তাদের গুরুবংশ,
       মন্ত্রশিষ্য তারা আমার বাবার।।

বৃদ্ধ বলেন, দাদাঠাকুর, একটু বসুন,
       ভিতর থেকে আসছি আমি ঘুরে।
ভয় তখনও যায়নি পুরো আমার,
       রেহাই পাবো আমি কি এরপরে।।

বেশ কিছুক্ষণ পরে গৃহস্বামী,
       আমার কাছে আবার ফিরে আসে।
পিছে আসে বাড়ির সব লোক,
       বামাও দেখি আসে সবার শেষে।।

পরিচয় দেয় এক এক করে সবার,
       সবাই এসে আমায় গড় করে

বামাও আসে ধীর পায়ে শেষে,
       চোখের জলে পা-টি আমার ভরে।।

আমারও চোখ অশ্রুজলে ভাসে,
       দয়াময়ী তুমি আমার বামা।
তুমি যদি থাকতে নাকো হেথা,
জীবন আমার যেত, তা তো জানা।।

সকাল হলে আমার যাবার কালে,
       সপরিবার গৃহস্বামী আসে।
পাঁচটি টাকা গুরুপ্রণামী দেয়,
       শান্ত মুখে আশীর্বাদের শেষে।।

********* সমাপ্ত *********