স্মৃতিতর্পণ - অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়





ভালোবাসার মতোই শ্রদ্ধা মানুষের মনের সম্পদ। হোক না তার বাস মন – সিন্দুকে। খামোকা তাকে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে, ফুলেতে, মালাতে কিংবা ধূপের গন্ধতে আটকানো কেন বাপু ? তার চেয়ে বরং চোখ রাখা যাক টেঁপির বাড়ির দিকে।

সকাল দশটাও বাজেনি। দোতলার সিঁড়ি থেকে চকিতা হরিণীর মতো লাফাতে লাফাতে টেঁপি নামলেন। পরনে সিফন শাড়ি। চোখে ‘আলো আমার আলো’ সানগ্লাস। বাগদা চিংড়ির মতো ঠোঁট দুটোতে জ্বলজ্বল করছে লিপিস্টিক। যেই না সদর দরজার ছিটকিনি খুলে ‘মা বেরোলাম’ মুখ ফসকে বেরিয়েছে টেঁপির অমনি ক্যাচ কট কট। গুছিয়ে করা বিনুনি শুদ্ধু মাথাখানা তার ঝজ্ঝরিয়ে নড়ে উঠল। মা তার ওত পেতেই বসেছিল আজ। সঙ্গে সঙ্গে মাতৃপ্রলাপ... ‘ বলি বাড় এতো হল কোত্থেকে শুনি? হারামজাদি... কলেজের লেখাপড়া শিকেয় তুলে সাতসকালে মোচ্ছব কত্তে বেরোচ্চ?

- আঃ মা! লাগছে তো ছাড়।

- ঠোঁটে আবার টকটকে লিপস্টিক? নিজেকে কী সুচিত্রা সেন ভেবেছিস?

কাণ্ড বুঝুন। ছিল টেঁপি, হল সুচিত্রা...

সেই বাংলাদেশের পাবনা শহরের নিতান্ত সাধারণ ঘরের এক মেয়ে। করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের মেয়ে কৃষ্ণা। জন্ম যার ৬ এপ্রিল ১৯৩১ এ। সে কিনা হুশ করে সত্তরের কলকেতার এক বাড়িতে ঢুকে পড়ল। সত্যি বাবা! এ মেয়ে নিঘ্ঘাত জাদু জানে। নইলে কি না মেয়ে, ছেলে কাউকেই ছাড়ে না?

ওই যে দেখুন, অমল, বিট্টু, গোলাই আর সন্তোষ, নব্বই দশকের ইশকুল পাড়ার মাঠে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার তোড়জোড় করছে। অমলের ডান হাত সকলের বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর মুখে আওড়ে চলেছে সুচিত্রা নামতা, ‘ প্লেন প্লেন প্লেন, প্লেন থেকে নেমে এলো সুচিত্রা সেন। সুচিত্রাদি সুচিত্রাদি উত্তমদার জন্য কী এনেছ?’ এরপরেই হুল্লোড়। বিট্টুর বুকে অমলের শেষ কিস্তির হাতটা পড়েছে। অর্থাৎ বিট্টুই সবাইকে ধরবে।

ছোটো থেকে মা – কাকিমার মুখে শুনেছি কারও নাম করলে না কি সে বিষম খায়। কী সব্বোনাশ ভাবুন একবার। সারাজীবন তাহলে সুচিত্রা ম্যাডাম ঠিক কত কোটিবার বিষম খেয়েছেন!

আসলে এগুলো মানুষের মনে নস্ট্যালজিয়ার সিঁড়ি। টুকরো ঘটনাগুলোই এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের স্মৃতির মিলন ঘটায়। ছোটোবেলায় অভিনয়ের কতটুকুই বা বুঝতাম? তবু কোথাও থেকে ‘এ শুধু গানের দিন’ এর মিউজিক ভেসে এলেই বুকটা নেচে উঠত। উপায় থাকলে ছুট্টে যেতাম টিভির সামনে। ব্যস, তার পরেই মন্ত্রমুগ্ধার সেই মোহিনী চাউনি, সঙ্গে চন্দ্রকলাহাসি। প্রেম শব্দটা তখন বড়োদের কথা। কিন্তু মন যে উন্মুক্ত পাখি। তাকে বাঁধে কোন সেনসর? সেজো কাকিমা গল্প করেছিল, ‘পথে হল দেরী’ ছবিটা না কি সে যুগে প্রথম রঙিন ছবি। সুচিত্রা সেন এই ছবিটিতে ২১ টা না ২২ টা শাড়ি পালটে পালটে পরেছিলেন। কিন্তু তখন একেবারেই হালকা কালার ছিল। তাই সকল অভিনেতাকেই খুব চড়া মেকআপ দিতে হয়েছিল। নইলে ফিল্মে রং ধরা দুষ্কর ছিল। সে রং টিঁকল না। সময়ের গোঁজামিলে রঙিন ছবি আজ সাদাকালো হয়ে গেছে। এখন সিনেমাটা

দেখলেই বোঝা যায় যে কী পরিমাণ চড়া মেকআপে সেজেছিলেন সুচিত্রা, উত্তম, অনুপকুমার এমনকী অমন রাসভারী ছবি বিশ্বাসও।




ছিল কৃষ্ণা, হল রমা। রুপোলি দুনিয়ায় যাত্রা শুরু ‘শেষ কোথায়’ ছবি দিয়ে। কিন্তু ছবিটি তখন মুক্তি পেল না। অনেক পরে ১৯৭৪ – এ দীনেন গুপ্ত এই ছবিটির কিছু অংশ ব্যবহার করেন চিত্রসারথী পরিচালিত ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ ছবিতে। ততদিনে ‘সাত নম্বর কয়েদি’-র রমা সেন সুচিত্রা সেন হয়ে উঠেছেন। পেরিয়ে এসেছেন সাড়ে চুয়াত্তর(১৯৫৩), কাজরী (১৯৫৩), ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য (১৯৫৩), অ্যাটম বোম (১৯৫৪), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), সদানন্দের মেলা (১৯৫৪), অন্নপূর্ণার মন্দির (১৯৫৪), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহপ্রবেশ (১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), শুভরাত্রি (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭), জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রাণী (১৯৫৮), সুর্যতোরণ (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯), হাসপাতাল (১৯৬০), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২)...

চলতেই থাকল মিসেস সেন – এর জয়যাত্রা। এরই মাঝে সুচিত্রার বম্বে পাড়ি। দিলীপকুমারের সাথে ১৯৫৫ সালে হিন্দিভাষায় তৈরি হল ‘দেবদাস’। সুচিত্রা সেন পার্বতী। এরপর মুসাফির, শেখর, চম্পাকলি, বোম্বাইকা বাবু, শরহদ, মমতা, আঁধি। হিন্দি এবং বাংলায় সব ছবিই যে সাফল্যের মুখ দেখল তেমনটা নয়। তবু শিল্পীর শিল্প কখনও খাটো হল না। সম্মান, পুরস্কারে ছায়াছবির শিখরে নিজের বিজয়পতাকা দৃঢ় করে গেঁথে দিলেন সারাজীবনের জন্য।

বড়ো যত হতে থাকলাম, টালিগঞ্জে উত্তমকুমারের মূর্তির মতো মনের চৌরাস্তায় সুচিত্রা দেবীর মূর্তি গড়ে উঠল, অজান্তেই। অভিনয়টাও খানিক খানিক বুঝতে শুরু করলাম। এককথায় সিনেমার দুয়ারটা উন্মোচিত হতে থাকল। তখন তাঁর সব ছবিতে অভিনয় যে মন কাড়ল তা একেবারেই নয়। অনেক ছবিতেই অন্যান্য অনেক নায়িকার অভিনয় মন কেড়েছে বেশি। কিন্তু একান্তে নিজের মনের নায়িকা সংবাদে কেবল তাঁরই নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে। কেন? হয়তো আজকের যুগের ভাষায় সেটাই এক্স ফ্যাক্টর। এক অমোঘ সম্মোহনী।

আপামর বাঙালি প্রেম করতে শিখেছিল সুচিত্রা – উত্তম জুটিকে দেখে। ছুটন্ত হরিণী যেমন হঠাৎ করে মেঘের ডাকে কিংবা হরিণের আহ্বানে সাড়া দিতে ঈষৎ বঙ্কিমগ্রীবায় চায়। ঠিক তেমনই সাদাকালো পর্দাজুড়ে সুচিত্রার দৃপ্ত চাউনি কত পুরুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য নিয়েছিলই বা বলি কেন? আজও কী নেয় না? ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিটা আজও আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। অনেক ছোটোবেলায় দূরদর্শনের একটি গানের অনুষ্ঠানে এই ছবিরই একখানি গান দেখেছিলাম। দূর থেকে ভেসে আসছে হেমন্ত কন্ঠে চৈতন্য সংগীত। আর তাঁর স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরের দাওয়ায় মাথায় ঘোমটা টেনে ঢুলুঢুলু চোখে মাথাটিকে হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রোম্যান্টিক মুখাবয়বে কী করে ভক্তি ঝরাতে হয় সেদিন বুঝেছিলাম। আমার অপূর্ণ চিত্ত সেদিন জেনেছিল প্রেম আর ভক্তি একই অঙ্গের দুই ভূষণ। প্রণয় পাশা-র পর বাকি জীবনটা তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া হয়েই তো কাটালেন। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলিতে যখনই পড়েছি ‘কী মোহিনী জান বঁধু কী মোহিনী জান, অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন’ ... তখন শ্রীমতী রাধিকাকেই দেখেছি চোখের সম্মুখে। আসলে তিনিই সুচিত্রা সেন। আমাদের আজন্মের চৈতন্যচারিণী বিষ্ণুপ্রিয়া। লাখ লাখ যুগ হাম রূপ নেহারলুঁ নয়ন না তিরপিত ভেল...





১৭ জানুয়ারি, ২০১৪... কফিনে চেপে আগুনে ভেসে গেল কেবলমাত্র একটা সময়ের ইতিকথা। তিনি আমাদের সুচিত্রিত সুচিত্রা নন। যাঁরা বললেন, ‘চলে গেলেন মহানায়িকা’ তাঁরা ভুল বললেন। জানলেনও না আজও হৃদয়ের গোপন অলিন্দে তাঁর সন্ধ্যা-কন্ঠ থেকে ভেসে আসছে সেই লাস্যময়ী আহ্বান... ‘ কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে... আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে’...


4 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ এ ২:১৭ PM

    সুচিত্রা সেনকে নিয়ে অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের এই স্মৃতিচারণ সবার কাছেই বড় মনোগ্রাহী হবে,তা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব ভাল লাগলো অভিষেক। সেকশান ৩ তা না থাকলে আরও ভাল লাগত ... কিন্তু মহাকাল মনে হয় সেকশান ৩ জুড়েই দেয়।

    উত্তরমুছুন
  4. অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন নিঃসন্দেহে বাঙ্গালীর মন-প্রাণ জয় করেছিলেন। কিন্তু, আমি সুচিত্রা দেবী কে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই তাঁর ব্যতিক্রমী বলিষ্ঠ মানবিক দৃঢ়তার জন্য। অসামান্য জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করে, তাঁর এই অন্তরালে চলে যাওয়া, কোন প্রলোভন, এমন কি দাদা সাহেব ফালকের মত ভারতের চলচিত্র জগতের সর্বোচ্চ সন্মানকেও তিনি হেলায় উপেক্ষা করেছিলেন।

    ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ ৭:১৪ pm

    উত্তরমুছুন