সম্পাদকীয় : মার্চ-এপ্রিল ২০১৬

সম্পাদকীয় : মার্চ-এপ্রিল ২০১৬


‘বসন্ত এসে গ্যাছে’-র মতো নেকুপুষু এন্ট্রি নিল না এবার এই চির-রোম্যান্টিক ঋতুরাজ। যাকে বলে এক্কেবারে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ! কিন্তু যদি এমন হত, ধরুন যেমন শীত এবার নিরাশ করল আপামর বাঙালিকে, যদি গ্রীষ্মও করে, নিরাশ।

খুশি হবেন অনেকেই। তবে ফলের কথা চিন্তা না করে, মা ফলেষু কদাচন। কারণ পাকা আম, কাঁঠাল, লিচু এহেন ফলগুলির কথা ভাবলেই মন আনচান না করে যায় কোথা!

এবারের ওয়েবজিন বের হতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সত্যি বলতে, আমরা একটা সংখ্যা লাফদড়ি খেলে একসঙ্গে দুটি সংখ্যা নিয়ে হাজির হলাম সোজা এপ্রিলে। আসলে কী জানেন, ফুরসৎ পাওয়াই যাচ্ছিল না মোটে, যতক্ষণ না সেই ভোর এল, ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’ বলে ঝাঁপিয়ে এল হাজারো রঙের খোয়াইশ, বাসন্তী আর নীলাভ-গোলাপী রাঙানো ঈষৎ শুষ্ক-শীতল বাতাস ঝাপটা মারল এসে চোখেমুখে... মন কুহুতান করে উঠল আনমনে, চিলেকোঠায়, ওয়েবজিনে।   

অন্য বছরের মতো এবারও চিলেকোঠায় বসন্ত উৎসব জমিয়ে পালিত হল, হাওড়া ডোমজুড়ে, এক অসামান্য বিনোদন পার্কে। রঙ, খুশি আর আনন্দগান ভরিয়ে রেখেছিল সকলকে। ছিল ছন্দোময় ভোজনপর্ব। চিলেকোঠা পরিবারের প্রাণপুরুষ, আমাদের সবার প্রিয় শ্রীশেখর রায়, যখন স্বপ্নে দেখেছিলেন এই গ্রুপটিকে, যখনও এটি ভূমিষ্ঠ হয়নি আন্তর্জালে, তখন তাঁর কর্মস্থলও ছিল এই ডোমজুড়। সুখ-স্মৃতিতাড়িত আমাদের এই মধ্যযুবা... 
 
খুশির রঙ ছড়িয়ে থাকুক, জড়িয়ে থাকুক আপনাকে, সব সময়।

প্রতিবেদন - গৌতম সেন

মন জুড়ে ডোমজুড় -- নীলাঞ্জনা 
গৌতম সেন

অনুরোধ এল লিখতে হবে, চিলেকোঠা আয়োজিত মনোরম সেই বসন্ত মিলনোৎসব কে ঘিরে আমার আন্তরিক অনুভুতির কিছু কথা। আন্তরিক কথাটা একটু জোরের সাথেই বলি কারণ জনা ষাটেক সদস্য-সদস্যা, কেউ নিজে একা, আবার কেউ কেউ সপরিবারে জমায়েত হয়েছিলেন নেহেরু শিশু মিউজিয়ামের সামনে অন্তরের অবাধ খুশির জোয়ারে ভেসেউপলক্ষ ডোমজুড়ে, ‘নীলাঞ্জনা’ কুঞ্জবীথিতে সেদিনের বসন্তোৎসব। বিশে মার্চ সকাল সাড়ে নটা নাগাদ যাত্রা শুরু হ’ল এক বিশাল কলেবরের ডিলাক্স ভলভো চড়ে। যাত্রাকাল খুব বেশি নয়, সওয়া ঘন্টা কি দেড় ঘন্টা খানেক লেগেছিল গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে। সারাটা পথ ছিল খুশির হাওয়ায় হাসি কলরোলমুখর। খিদে-তেষ্টার জৈবিক অনুভুতিগুলো উধাও হয়েছিল মনের এক উৎসবমুখর প্রাণচাঞ্চল্যে সেদিন।
অবশেষে ডোমজুড়ে এসে নির্ধারিত উৎসব প্রাঙ্গন ‘নীলাঞ্জনা’ কুঞ্জবীথিতে নামলাম দলের সবাই। সেখানে তন্ময় সমাদ্দার, চিলেকোঠার অন্যতম আর এক প্রাণচঞ্চল সদস্য আগে থেকেই উপস্থিত। যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও শ্রমের বিনিময়ে সেদিনের সেই খুশির প্রাঙ্গন সেজে উঠেছিল বসন্তবাহার সাজে।
সকলের উপস্থিতি আর সকালের উৎসব আমেজের সংমিশ্রনে জন্ম নিয়েছিল এক আনন্দঘন মিলনক্ষণ, বসন্তের ডাকে, বসন্তোৎসবের নামে। জলখাবার বা প্রাতঃরাশ তৈরিই ছিল এক সুস্বাদু অভ্যর্থনা জানাতে। ফুলকো লুচির উষ্ণতা, কষা আলুর দমের রসনাসিক্ত মহিমা আর গোলাপজামের অন্তরের রসমাধুর্য সুপ্ত ক্ষুধাকে তৃপ্ত করল অচিরেই। এরপর গরম গরম কফি উৎসবের মেজাজকে চাগিয়ে তুলল আরও।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল এক চমক। আর.জে. রয় (এই নামেই সে অধিক পরিচিত) ও তার সহকর্মীরা পরিবেশন করল এক চমকপ্রদ মজাদার খেলা –‘শব্দবাজি’। নিয়মকানুনের সাথে স্বল্প পরিচিতি পর্ব সাঙ্গ হতেই জমে উঠল সে খেলা রয়ের সুনিপুন পরিচালনায়। প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচনের সুবাদে মূল খেলায় ছটি দলকে বেছে নেওয়া হ’ল। খেলা জমে উঠল যতটা না প্রতিযোগিতার পরিমণ্ডলে তারও চেয়ে অনেক বেশি দেদার খুশির ঔজ্জ্বল্যে। প্রায় ঘন্টা খানেক ব্যপী এই খেলা শেষে ফলাফলের নিরিখে অমিত, মুনিয়া; নারায়ণদা, নন্দিনী; ও অনন্যা, নূপুর – এঁদেরকে সুন্দর কিছু বই পুরস্কার স্বরূপ উপহার দিল ‘শব্দবাজি’ পরিচালক দল। এমন এক সুন্দর শিক্ষামূলক বিনোদনের আয়োজন করার জন্য অলোকদা, ইন্দ্রানী ও সৌমিত্র কে সবিশেষ তারিফ জানাই সকলের পক্ষ থেকে। এই অনুষ্ঠান যে আমাদের সবাই কে ঋদ্ধ করেছিল, সে কথা অনস্বীকার্য
পরবর্তী পর্যায়ে শুরু হল চিলেকোঠার মূল অনুষ্ঠান প্রধানতঃ সদস্য-সদস্যাবৃন্দের মনোজ্ঞ পরিবেশনায়, যার সুচনা হ’ল দলের থিম্‌ সঙ দিয়ে। এর পর বসন্তকে বন্দনা করে এক নাতিদীর্ঘ সঙ্গীত-নৃ্ত্য-পাঠ সম্বলিত আলেখ্য পরিবেশিত হ’ল, উপস্থিত আমরা যারা উপবিষ্ট ছিলাম তাদের মনোযোগে কোন চিড় ধরে নি কেবলমাত্র তাঁদের এই সুললিত পরিবশনার গুণে। এঁরা হলেন সুভাস, শিবু,, মধুমিতা,  দোলনচাপা, চৈতালী, সুমন, নন্দিনী, নূপুর, ইন্দ্রানী ও আরও অনেকে। সুমন ও অনন্যা এদের দুই কন্যার নৃ্ত্যশৈলী বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। এছাড়াও সারাদিন ব্যাপি আবৃত্তি (তাপস দা, দেবাশিস, শিবু), গান (মধুমিতা,হানি, টুসিমা) ও নৃত্য (সুমন,  নন্দিনী, অনন্যা) এসবের মধ্যে দিয়ে বিকাল সাড়ে চারটে পর্যন্ত চলল এই অনুষ্ঠান। এর মাঝে ছিল দুপুরের আহারাদি পর্ব। সে আয়োজনও ছিল মনকাড়ানিয়া। সুবাসিত চালের ভাত সাথে অন্যান্য উপাদেয় ভোজসামগ্রী দ্বিপ্রাহরিক ভোজনকে এক অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। মজা করে বলি, শেষপাতে আইসক্রীমের দৌলতে অনেককেই এক পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে সাহায্য করেছিল সামান্য উষ্ণ সে মধ্যাহ্নে। এর পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে অপরাহ্নবেলায় কবির ভাষায় ‘বসন্তে এই ধরার চিত্ত হ’ল উতলা’ এমন এক রঙের বর্ণালীতে মেতে উঠল সবাই – লাল, সুবুজ, হলুদ আরও বিচিত্র সব ফাগে রেঙে উঠল সকলের কলেবরসে এক নির্ভেজাল মনের নান্দনিক আবির বন্দনা।
এরপর কফি খেয়ে নীলাঞ্জনার অমন ছায়া সুনিবিড় শান্তির বাতাবরণকে ঈষৎ ভারি মনে বিদায় জানানো। দিনযাপনের এই আনন্দঘন স্মৃতিমুখর দিনটিকে বুকের মাঝে নিয়ে সবাই ফিরে এলাম বাসে ঘরে ফেরার ডাকে। এ উৎসবের রেশটুকু মনে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ফের হয়ে উঠেছিল সঙ্গীতমুখর এক অতি জনপ্রিয় খেলা – ‘অন্তাক্ষরী’ ঘরে ফেরার ক্ষণকে করে তুলল মনোরমদিনান্তের গোধুলিতে কারও মাঝে কোনও ক্লান্তির ছাপ লক্ষ্য করা গেল না। বসন্তোৎসব স্থায়ী এক জায়গা করে নিল উপস্থিত চিলেকোঠা নিবাসীদের মনের আঙ্গিনায়। বাস চলতে থাকল কলকাতার দিকে, এ আনন্দের কিছুটা হলেও সাক্ষী হয়ে রইল দিগন্তে বিলীয়মান আবিরমাখা টকটকে লাল সূর্য।

কবিতা - অনুপম দাশ শর্মা

লগন আসেনি...
অনুপম দাশ শর্মা
.
সে আছড়ে পড়ে খোলা দরজার সামনে, তবুও উচ্ছ্বসিত
শব্দের ভাষ্যপাঠে স্বাক্ষর যখন মেধা-লিপি
এধারে ওধারে ছড়িয়ে পড়ছে
নিজস্ব দ্যুতি.....তখনই
বিজ্ঞাপিত এক তোরণ পেরোবার আগেই
সজোরে সরিয়ে দেওয়া তাঁকে
অথচ ঈর্ষার বান্দা হতে রাজী
ছিলনা কোনমতেই
তাই রেখা টেনে টেনে যাওয়া সমস্ত বারান্দায়
তাঁর শাব্দিক পরিক্রমণ
অভ্যাসের স্বাধীকার বজায় রেখেই
.
বারবার সে দেখে বন্ধ দরজার ভেতরে
ছক বাঁধা নির্বাচনের উল্লাস
দূর্গম পাথুরে জমি কবেই পেরিয়েছে
স্বপ্নের ভেতর লাজুক খুশি
চোখের কোলে ভিজিয়ে ছিল
আদুরে সম্ভাবনাকে
ভেসে ওঠে চোখে কালিদাসের রূপকথা
বিড়বিড় ঠোঁট একই কথা বলে ওঠে
দশদিক থেকে আলো পড়লে
নৈঋত কোণও কী জোটেনা আমার..
সপ্রতিভ চেহারায় বেদনার রং লাগে
চলকে ওঠে বন্ধুবৃত্তের দেওয়া শুভনাম
তাও কেমন ধূসর চেহারা নিচ্ছে..
.
হে দেবগণ!  আমায় না হয় দাও শাম্বের অভিশাপ
শেষ প্রান্তে কুড়িয়ে নেব
সূর্যমন্দিরের তৃপ্ত শিখা
নাহ্ সরল হয় না ভাগ্যের জট
অবাধ্য টানে শব্দের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে
অবশ্যই বেহাল প্রাপ্তির ফাঁকা ঘট না দেখেও
তবুও সে প্রতিদিন অনিয়মের পরিখায় নামে
দূরে সানাইয়ের ধূনে চোখ ভেজায়
উপোসী শব্দেরা অভিযোগহীন চোখে
আশায় থাকে ইজাজত পাবার মেহফিল-
শুধু বাচিক শিল্পী জানতে পারেন না
-লক্ষীর বরপুত্র হাঁটছে সাদা হাঁসের পাশে পাশে
লগ্নহীন মগ্নতায়

কবিতা - নন্দিনী সেনগুপ্ত

জলপ্রপাত
নন্দিনী সেনগুপ্ত

হঠাৎ পাহাড় উৎরাই ঢাল,
নদী নেই তো। জলপ্রপাত।
অমনি হঠাৎ বৃষ্টি নামে, 
ভিজুক শহর। কি বা তফাত?

জলপ্রপাত একলা আমার,  
লালন করি বুকের মধ্যে।
নগর- ভিড়ে, কাজ-অকাজে,
স্বপ্ন দেখায়, সাধ্যাসাধ্যে।

এগিয়ে আসে জলের প্রাচীর,
স্নান সেরে নিই অবগাহন।  
জলের বৃত্ত শেষের আগে,
গভীর হয়ে নামলো দহন। 

শহর-প্রান্তে সেই নদীটি,  
শুকায় বুঝি প্রত্যাখ্যানে।
তবুও হঠাৎ একলা ধারা
পেরোয় পাহাড় প্রপাত-গানে।  

কবিতা - শমীক জয় সেনগুপ্ত

মধুপুর
শমীক জয় সেনগুপ্ত
অসমাপ্ত ট্রেন লাইন
জীবনের আঁক কষে চলে,
 ভ্যানিশিং পয়েন্টে হাত রাখে
ক্লান্ত দুপুর।
 এখনো ত' ট্রেন এসে
 আমাদের নিয়ে যে গেলনা!
 আভূমি আবদ্ধ পা-
 আমাকে আঁকড়ে রাখে
রুখা মাটি আর মধুপুর।
প্লাটফর্ম থেকে দূরে
 কে তুই দাঁড়িয়ে ছেলে?
 তোর নাম শাল হতে পারে!
 দেওতার থান থেকে
মানুষের প্রেম নিয়ে এলি...
 মনেতে কুয়াশা থাক
তুই এলি ফাগুনকে নিয়ে।
 আমার শীতের পরে
 বসন্ত অসংলগ্ন আজ,
তবু তার রেশ রেখে
হুইসেলও বাজিয়েছে সুর।
আমাকে ত' কোলকাতা ফিরে যেতে হবে
স্মৃতির বুকেতে রেখে এই মধুপুর।

কবিতা - রমা চোঙদার

ছিন্নবীণা
রমা চোঙদার

মাঘী পূর্ণিমার রাত চেয়ে দেখছে চুপচাপ
প্রেম জোছনায় তৃষিত কাতর চাতক নিরুত্তাপ!
অভিমানে দূরে সরে যাওয়া মন
প্রদীপের শিখার নিচে অন্ধকারের মতন,
হয় তো সে আলোর কাছে করতে চায় না আত্মসমর্পণ!
প্রেমিক হৃদয় ঝিনুকমালা গাঁথে কখন,
ছিঁড়ে ফেলতেই বাঁধভাঙা প্লাবন,
ঝরাপাতাদের মর্মরধ্বনি বলে গেল
প্রেমের আর একনাম অকালবর্ষণ!

কবিতা - জয়ন্ত মন্ডল

উবে যায় সুগন্ধ
জয়ন্ত মন্ডল

আর যা কিছু ভাবো ওকে ধরে রেখো,
আর যা কিছু ঘটুক-ওকে বলতে দিও |
ফুল-মিষ্টি-ধুপ-দেবার্ঘ নাই বা দিলে,
প্রাণ ভরে ওকে ভালবাসতে দিও |
মেঠো পথ দিও-আকন্দের সুগন্ধ,
ধানের ফুল দিও –বুকে আগলাক ও|
চোখের এপারে থাক কাজলের আল,
জানি আজ আছ, থাকবে কি কাল ?
জোনাকি আলোয় চেনা পথ যাবে ভুলে,
শিশির ভিজিয়ে পা আর নেবেনা ধুয়ে !
শহরে তোমার নাম রাত জাগা হোর্ডিং এ,
যাকে নিয়ে এত কথা-তার কথা জানে কে?













কবিতা - পারমিতা চ্যাটার্জী

কবে কোথায়
পারমিতা চ্যাটার্জী

কবে যেন হয়েছিল দেখা কোন বসন্তে,
কি জানি কেন ধরেছিলাম হাত,
কি গান শুনিয়েছিলাম পরম লগনে,
কি কথা বলেছিলাম কানে,
আজ আর মনে পড়েনা।
তোমার আকাশে ছিল উদাস মেঘের ভার,
আমিও ছিলাম ক্লান্ত শ্রান্ত মনে,
জীবনের উপবনে,
আকণ্ঠ তৃষিত হৃদয়
চেয়েছিল ভালোবাসা,
এসেছিলাম কাছে সেদিন
ধরেছিলাম হাত।
কে জানত সবই ছিল মিথ্যা প্রবঞ্চনায় ভরা
এক জ্বলন্ত ইতিহাস,
শুকনো তপ্ত বালুকা রাশিতে
পড়লনা ঝরে ঘন শ্রাবনের ধারা,
বসন্ত পূর্ণিমার চাঁদ
অদৃশ্য হল অমাবস্যার আঁধারে,
আমি একা চলেছি হেঁটে
এক বসন্ত থেকে
আর এক বসন্তের পারাপারে।