সম্পাদকীয় - নভেম্বর ২০১৪





উৎসবের মরশুম চলে গেল ভাবছেন না কি? মানছি দুর্গাপুজো-কালীপুজো-ভাইফোঁটা-জগদ্ধাত্রী
পুজো আবার আসছে বছর, কিন্তু রাসের মেলা শুরু হল যে! আপনি যেখানে থাকেন সেখানে না-ই বা হল, নবদ্বীপ বা উলুবেড়িয়ায় বেড়িয়ে আসুন, উপায় না থাকলে মানস ভ্রমণ।
কেউ নেই বাধা দেবার, তাই না? আর রাসের মেলা ফুরোতে ফুরোতেই বাঙালির ‘আহা শীতকাল’, কেন যে কবিগুরু তেমন চোখে দেখলেন না শীতকালকে, কে জানে!

কানাঘুষো খবর আসছিল, চিলেকোঠা ওয়েবজিন নাকি ঠিকভাবে হ্যাণ্ডল্‌ড হচ্ছে না, হতেও পারে। আরে বাপু, বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে কয়েকজন মিলে এই প্রচেষ্টা, ধুরন্ধর প্রফেশনালদের দ্বারা চালিত কিছু তো নয়। ভুলচুক কিছুমিছু তো হয়েই যায়, ইচ্ছাকৃত নয় সেসব মোটেও। আর আপনারা ভাববেন না যে কর্তৃপক্ষ গা-ছাড়া, এ নিয়ে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সব দেখা হচ্ছে, ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

অতএব, বন্ধুরা, কাকে কান নিয়ে গেছে শুনে কাকের পিছনে না দৌড়ে চোখ রাখুন চিলেকোঠা ওয়েবজিন-এর প্রতি সংখ্যায়। স্বাদ নিন সাহিত্য-সংস্কৃতির।

হৈম শুভেচ্ছা, শিশির-ধোয়া...   

বিশেষ রচনা - সৌমিত্র ব্যানার্জী




মা আমার ব্রহ্মময়ী
সৌমিত্র ব্যানার্জী

মা আমার একাধারে ব্রহ্মময়ী, ভুবনমোহিনী, বিশ্বপালিনী, বিশ্বপ্রসবিনী। মা আবার বিশ্বসংহারিণী, শ্মশানবাসিনী। কৃপাময়ী আর ধংসকারিণী। স্নেহময়ী ও আবার করালী, আনন্দময়ী কিন্তু অগ্নিজিহ্বা, লোলজিহ্বা, নরকর মেখলাধারিণী। সৃষ্টি ও ধ্বংস। একই মহাশক্তির ভিন্নরূপ কালীমূর্তিতে প্রকটিত। মা একাধারে ধূমহীন স্বর্ণবর্ণা অগ্নিশিখা। আবার সুরজ কিরণের অভাবাত্মিকা ধ্বংসর হেতু। অগ্নির ধূমপুঞ্জ মহামেঘ ও সুরজ কিরণের অভাবে মিশকালো। চিতাগ্নিরূপী শ্মশানচারী সমস্ত অশুভ শক্তিনাশ করে মুণ্ডমালিনী। ছিন্নমস্তা, দুই কষে রক্তধারা বিশ্বনাশিনী ধ্বংস শক্তির ভয়াবহ প্রকাশ। আবার শান্ত, সুন্দর, করুণাময়ী। একই শক্তির এই বৈপরীত্য নিয়ে কালীতত্ত্ব, কালীমহিমা।

মা কালী হিন্দু দেবী। কিন্তু তিনি বিশ্বমাতা। তাই নানা যুগে নানান জাতি, ধর্ম ও সভ্যতায় কালী-সদৃশ দেবীর দেখা পাই। তত্ত্বগত ভাবেও তাদের মধ্যে মিল খুঁজে পাই।
এমনই এক দেবী কোহাটলিকুয়েহ (COATALICUE) সম্পর্কে আমরা জানব। 

১৪ থেকে ১৬ শতাব্দীতে মেসোআমেরিকান সভ্যতা, প্রাচীন মেক্সিকোর নাহুয়াতল-ভাষী (Nahuatl) অ্যাজটেক (Aztec) সমাজের দেবী মা কোহাটলিকুয়েহ। ইনি একদিকে গর্ভধারণের দেবী। রজলার দেবী, শস্য-শ্যামলা ও চাষবাস সৃষ্টির প্রতীক। সৃষ্টিকারী উত্তাপশক্তি তারই মধ্যে। অপরদিকে তিনিই শিকার, ধ্বংস, যুদ্ধ, নরহত্যার দেবী। তিনি ভূমিতত্ত্বের দেবী অর্থাৎ ধরিত্রীমাতা হলেও সুর্য, চন্দ্র, তারা এবং দক্ষিণাকাশ (দক্ষিণাকালী?) তারই নিয়ন্ত্রণে। জন্ম-জন্মান্তর-মৃত্যুর নির্ধারণ তিনিই করেন। তিনি রেড-ইন্ডিয়ানদের রক্ষাকর্ত্রী এবং তাদের তিনি গর্ভ হতে কবরস্থান উভয়েরই অধিষ্ঠাত্রী।

কোহাটলিকুয়েহ সর্পেরও অধিষ্ঠাত্রী কারণ সাপ হল প্রতীকী রজলা। অজস্র সাপের সমাহার তার কটিবন্ধে। সর্পগুলি যেন রক্তের ধারা। কোহাটলিকুয়েহ দেবী তিনি মুণ্ডমালিনী। তার বুক বেয়ে নেমে এসেছে মানুষের (তারই সন্তানদের) হৃদযন্ত্রের মালা। বুকের উপর লকেটে অসংখ্য নরহস্ত দিয়ে ধরা মানুষের মাথার খুলি ও নরকপাল। আবার তার স্তন স্নেহময়ী মায়ের মতন ভারী, দুগ্ধপূর্ণ, উদ্ধত, পুষ্টিদায়ী।
কথিত আছে যে বর্তমান সৃষ্টির পূর্বে দেবীকে বলি দেওয়া হয়। তার নিজের মুন্ডছেদ হয়ে দু’টি ধারা নেমে আসে (ছিন্নমস্তা?)। মায়ের মাথার জায়গায় দুটি পরস্পর যুক্ত সাপের লোলজিহ্বা মুখ। তার হাতে বড় বড় নখ, তিনি রক্তলোলুপা এবং মনুষ্য মৃতদেহ সেই নখ দিয়ে চিরে ভক্ষণ করেন। নশ্বর দেহ তাই ভূমি বা প্রকৃতিতেই বিলীন হয়ে যায়। দেবীর মাথার পিছনে ১৩টি বেণী। অ্যাজটেক মতে ১৩টি স্বর্গ এবং বছরে ১৩টি মাস। দেবী একাধারে কুমারী ও অপরদিকে বিশ্বজননী। আমাদের মা কালী ও অ্যাজটেকদের কোহাটলিকুয়েহ-র মধ্যে কি আশ্চর্য সাদৃশ্য!

মা কালী সংক্রান্ত গল্প বা তথ্য ও তত্ত্বগুলি আমরা সবাই কমবেশি জানি। এবার জেনে নেব মাতা কোহাটলিকুয়েহ-র স্তুতি।

কোহাটলিকুয়েহ ছিলেন রাজকন্যা। কাল্পনিক সর্প পাহাড় কোহাটেপেকের (Coatepec) শিখরে অবস্থিত মন্দিরের দেখশোনা করার দায়িত্ব দেবীর উপর ন্যস্ত ছিল। একদিন তিনি যখন মন্দির প্রাঙ্গন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন, তখন আকাশ থেকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে একটি পালকের মণ্ড নেমে আসে। কোহাটলিকুয়েহ সেটি নিজের কাপড়ের কোঁচড়ে রেখে দেন। আশ্চর্যজনক ভাবে  সেই পালকের দ্বারা দেবী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। তার গর্ভে আসেন যুদ্ধ দেবতা হুইটজিলোহপোহোছটলিহ (Huitzilopochtli)। দেবী একাধারে মাতা, অপরদিকে কুমারী। কুমারী হলেও কী করে যে আগে থেকেই তার এক কন্যা আর ৪০০ পুত্রসন্তান ছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।  সন্তানদের মধ্যে ছিলেন ঘন্টার মালা পরিহিতা কন্যা কোয়োলক্সায়ুহকুই (Coyolxauhqui - চন্দ্রের দেবী) এবং ৪০০ পুত্রগণ অর্থাৎ সেনটন হুইতজনাহয়াহ (Centon Huitznahua তারা, যারা দক্ষিণাকাশে বিচরণ করত)। এরা দেবীর কুমারী মাতৃত্ব মেনে নিতে পারল না। তারা দেবীকে বধ করার সিদ্ধান্ত নিল।

মাতৃগর্ভে থাকা হুইটজিলোহপোহোছটলিহ সব টের পেলেন। তিনি দেবীর কণ্ঠনালী ছিন্ন করে গর্ভ থেকে বের হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন, নিজের মাতাকে রক্ষা করার জন্য।
তিনি জিউইহকোউয়াহটলহ নামক অস্ত্রে শোভিত (Xiuhcoatl) এই অস্ত্রটি অগ্নিসর্পের ন্যায়। মতান্তরে এটি আদপে সূর্যকিরণ। হুইটজিলোহপোহোছটলিহ তার দিদি ও দাদাদের অর্থাৎ (চন্দ্র এবং তারাদের) সংহার করে টুকরো টুকরো করে পাহাড়ের চুড়ো থেকে নীচে ফেলে দিলেন। সেই থেকে প্রতি কালো রাতের পর শুভ দিন আসে। 
এ যেন আলোকের জয় অন্ধকারের উপরে। শুভর জয় অশুভর উপরে। সূর্যের জয় চন্দ্র-তারাদের উপরে।

কোহাটলিকুয়েহ দেবী একাধারে মৃত্যু ধ্বংসের দেবী। অপরদিকে তিনি রজলা মাতা, মাতৃত্বের প্রতীক। প্রসবকালীন মৃত জননীর প্রতীক। তিনি আবার অবৈধ কুমারী মাতৃত্বেরও অধিষ্ঠাত্রী।

মা কালী সদৃশ এ দেবীর মূর্তি মেক্সিকোর জাদুঘরে রক্ষিত আছে।




বিশেষ রচনা - তাপস ব্যানার্জি



একটি বিখ্যাত আমন্ত্রণ পত্র 
তাপস ব্যানার্জি



১৭৭৮ সালের শেষের দিকে সমগ্র লকাতা চমকে উঠেছিল অদ্ভুত একটি আমন্ত্রণ পত্র পেয়েবাংলাদেশের ব্রাম্ভণ এবং পন্ডিতরা সেই পত্রখানি পেয়ে হতবাক
পত্রখানি এসেছিল ১২ নং সুকেশ স্ট্রীট থেকে (অধুনা সুকিয়া স্ট্রীট) এবং পত্রলেখক ছিলেন বিদ্যাসগর মহাশয়ডাকে এবং হাতের মাধ্যমে সেই বিস্ময়কর পত্র সারা বাংলাদেশে ৮০০জন পন্ডিতের কাছে পৌঁছেছিল লেখা হয়েছিল বাংলা গদ্যে সে এক চিরস্মরণীয় ঘটনা বাংলার নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল এই পত্রের মাধ্যমে
সেই পত্রে লেখা হয়েছিলঃ

শ্রী শ্রী লক্ষামণিদেব্যাঃবিনয়ং নিবেদনম২৩শে অগ্রহায় রবিবার বিধবা কন্যার শুভবিবাহ হইবেক, মহাশয়েরা অনুগ্রহপূর্ব্বক কলিকাতার  অন্তঃপাতী সিমুলিয়ার সুকেশ স্ট্রীটের ১২ সংখ্যক ভবনে শুভাগমন করিয়া শুভকর্ম করিবেনইতি তারিখ ২১শে অগ্রহায় শকাব্দঃ ১৭৭৮

এই পত্রখানি পেয়ে আনেক লোকের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় এইবার পাত্র-পাত্রী সমাচার

পাত্রঃ যশোরের খাটুয়া গ্রাম নিবাসী সুবিখ্যাত রামধন তর্কবাগীশের পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নপেশাঃ মুর্শিদাবাদের জজ পণ্ডি




পাত্রীঃ কালীমতি দেবীপিতার নাম ব্রম্ভানন্দ মুখোপাধ্যায়নিবাস বর্ধমানের পলাশডাঙ্গা গ্রামকালীমতির যখন ৬ বছর বয়স তখন  সে বিধবা হয়প্রখ্যাত পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালংকার মহাশয়ের উদ্যোগে শ্রীশ বিবাহ করতে রাজি

একটু বিয়ের খবর দেওয়া যাক......
বিয়ে ছিল গোধূলি লগ্নে পাত্র এসে উঠেছিল বিখ্যাত রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের বাড়িতেশ্রীশ একটি পালকিতে চললেন সঙ্গে চললেন তখনকার দিনের বিখ্যাত সব মানুষেরা বরযাত্রী হিসাবে যেমন রামগোপাল ঘোষ, দ্বারকানাথ মিত্র, শম্ভুনাথ পন্ডিত, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই সর্বাগ্রে পালকি ধরে হাঁটতে লাগলেন রাস্তা লোকে লোকারন্যসবাই এসেছে মজা লুটতেবিধবার বিয়ে দেখতে কোথাও পা ফেলার জায়গা নেইপালকি নিয়ে এগোবার জায়গা নেইকোথাও উৎসাহ কোথাও বা ব্যঙ্গকিন্তু বরযাত্রীরা দৃঢ় পায়ে  এগিয়ে চললেনগোলমালের ভয়ে পুলিশের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিলকিন্তু আর্শ্চয যে কোথাও কোনো গোলমাল হলো না

সব দেখেশুনে সন্তুষ্ট হয়ে বিদ্যাসাগর মশাই মাঝপথ থেকে বিদায় নিলেন
অতিকষ্টে বর বিবাহ আসরে এলেন... ঙ্গে এলেন সুপ্রসিদ্ধ সব পণ্ডিতেরা, যেমন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক জয়নারায় তর্কবাচস্পতি  ছাড়া এসেছিলেন ভরতচন্দ্র শিরোমণি, প্রেমচন্দ্র শিরোমণি, তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রমুখ অধ্যাপক এবং শাত্রজ্ঞ পণ্ডিতবর্গ

বিদ্যাসাগর মশাই নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলেন পাত্রীর সাজসজ্জা
অবশেষে নির্বিঘ্নে সমাধা হল বিধবা বিবাহবাংলার নবজাগরণের সূত্রপাত হল ১২৬৩ সালের ২৩শে অগ্রহায় রবিবারইংরাজি 7th December 1856
 
প্রসজ্ঞত জানাই এই বাড়িটির বর্তমান ঠিকানা 48A /48B Kailash Basu Street.

(সূত্রঃ কলকাতা, লেখক শ্রীপান্থ)