সম্পাদকীয়





সম্পাদকীয়



‘তুমি এলে মনে হয় যেতে চাই সেইখানে, সেই প্রিয় উপত্যকা, প্রজাপতি আর পর্বতের কাছে, যেখানে অচিন্তনীয় ঊষার শরীর আর স্বর্ণরঙ চন্দ্রিমার ছায়া আজো বেঁচে আছে। মানুষের সব প্রেম যেইখানে গোধূলির কাছে একটি সূর্যাস্ত হয়ে চিরকালে সমর্পিত হয় - তুমি এলে জন্ম নেয় সেই প্রেম, সেই চিরকাল, সেই পরম বিস্ময়।’ - কবি ফজল শাহাবুদ্দীন ।

বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। গ্রীষ্মের শুরু। নামটি এসেছে বিশাখা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। রিক্ত চৈত্রের জীর্ণতাকে পরাভূত করে বৈশাখে বৃক্ষগুল্মলতা সুজলা, সুফলা, পূর্ণ যৌবনবতী। নতুন বৃষ্টির জলে সবুজ হয়ে ওঠে ধরিত্রী, ঘর বাঁধে পাখী।

বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র বাংলায়। নববর্ষে উৎসব উদযাপনের এই প্রথার প্রচলন করেছিলেন সম্রাট আকবর। সেই সময় চৈত্র সংক্রান্তির দিন বছরের সমস্ত খাজনা মিটিয়ে দিতে হতো – আর খাজনা মিটিয়ে দেওয়ার খুশীতে পরের দিন বর্ষবরণ উৎসব উদযাপিত হতো। চৈত্র সংক্রান্তিতে খাজনা এখন মেটাতে হয় না বটে, কিন্তু উৎসব প্রিয় বাঙালি বর্ষবরণ উৎসবের হাজার বছরের এই কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে আজও বহন করে চলেছে সমান উদ্দীপনায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন উৎসব।

চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। মনে আছে, আমার মেয়েবেলায় এই খোদ কলকাতাতেও এই দিন থেকে শুরু হতো চড়ক সংক্রান্তির মেলা......পয়লা বৈশাখের দিন বিকেলবেলা নতুন জামা পরে বাবার হাত ধরে আমরা যেতাম সেই মেলায়। হরেক রকম মাটির ঘর সাজানোর মূর্তি - রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী, বিবেকানন্দ, গাউন পরা মেমের সঙ্গে টুপি মাথায় সাহেব; পাখী, গাছ, খেলনাবাটি, মাদুর, তালপাতার পাখা, তোলা উনুন, হাতা-খুন্তি-সংসারের হরেক খুটিনাটি, জিলিপি, বোঁদে, জিবে গজা, আরও কত কি যে... সব কেমন স্বপ্ন মনে হয়। সে উৎসব বড় স্নিগ্ধ ছিলো। আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে তো এসব ‘বিগত শতাব্দীর রূপকথা’। 

এবছর নববর্ষে (পয়লা বৈশাখ, ১৪২১; ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪) চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের মুকুটে সংযোজিত হোল আরও একটি নতুন পালক। শুরু হোল মাসিক সাহিত্য আড্ডা, চিলেকোঠার বৈঠক।

এ মাসেই বিশ্বের আপামর বাঙালির প্রাণের উৎসব ২৫শে বৈশাখ......এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকার, সুরকার, গীতিকার, দার্শনিক আরো কত কি যে, এক কথায় বাঙালির প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতে তাঁর জন্মদিন উদযাপিত হয়েছে তাঁর সেই পঁচিশ বছর বয়স থেকেই। দেশে থাকাকালীন জোড়াসাঁকোতে, শান্তিনিকেতনে, শিলাইদহে, আলমোড়ায়, দেশের বাইরে সুদূর আমেরিকার আরাবানায়, রেঙ্গুনে, চীনের পিকিং-এ, জাপান যাত্রার সময় প্রশান্ত মহাসাগর বক্ষে নলদেরা নামক জাপানী জাহাজে, প্যারিসে, পারস্যে, কোথায় নয়!! আজ তাঁর নিজের কথাতেই তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই - তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শত বার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার। 

আজ তাঁকে স্মরণ করেই প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, দশম সংখ্যা। এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর-এর একটি একান্ত সাক্ষাৎকার ও প্রথম চিলেকোঠার বৈঠকের একটি বিশেষ প্রতিবেদন। 

আর থাকছে, রবীন্দ্র-বিষয়ক একটি মনোজ্ঞ প্রচ্ছদ নিবন্ধ ও একটি প্রবন্ধ, অনুবাদ কবিতা সহ আরো কবিতা, ছড়া, মুক্ত গদ্য, বিশেষ রচনা, অনুগল্প, ছোটগল্প, ধারাবাহিক, স্মৃতিচারণ, ইত্যাদি। এছাড়া, ছোটদের পাতা, রঙ ও তুলি, ফটোগ্রাফি, রান্নাঘর, হাস্যকৌতুক, জানেন কি, প্রভৃতি নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে। 

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আপনাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকাটির মানোন্নয়ণে সহায়তা করবে। 

জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।। 



নমস্কারান্তে, 

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ শ্রীশুভ্র













প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ


আমাদের রবীন্দ্রনাথ
শ্রীশুভ্র



আমরা যারা দুতিন পাতা লেখাপড়া শিখে বেশ চৌকশ হয়ে উঠেছি, তারা না পারলাম বিশ্বকবিকে অতিক্রম করে যেতে, না পারলাম তাকে অন্তর থেকে বরণ করে নিতে; কিন্তু কি আশ্চর্য্য তাকে ব্যবহার করে অনেকেই পেশাগত সিঁড়িগুলি পরপর দ্রুত পেরিয়ে সমাজে বেশ আখের গুছিয়ে আসীন হতে পেরেছি। বাকিরা যাদের পেশাগত কারণে তাকে বিশেষ কোনো কাজে লাগে না, তারাও সামাজিক পরিসরে কল্কে পেতে তাঁকে যত্রতত্র ব্যবহার করে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকি। এবং আরও আশ্চর্য্যের বিষয় হল এই একটা মানুষ, যাকে দুবেলা স্মরণ না করলেও কোনো না কোনো ভাবে তিনি ঠিকই উঁকি দিয়ে যান আমাদের মগ্নচৈতন্যে, কারণে অকারণে। ফলে সম্বচ্ছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর আনুষ্ঠানিক ঢক্কানিনাদের বাইরেও তিনি প্রবল ভাবেই আমাদের মত আধাশিক্ষিত মানুষদের ঘাড়ে চেপে বসেই থাকেন। নামার কোনো লক্ষ্মণই নেই আজ দীর্ঘ এক শতাব্দী হয়ে গেল। গোদের ওপর বিষফোঁড়ের মত আমাদের রাজ্যে পরিবর্তনের নতুন সরকারী ফরমান অনুযায়ী প্রত্যেকটি বড়ো রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাধ্যতামূলক করে বাজানোর ফলে আমাদের অজান্তেই তিনি আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন প্রতিদিন, আমরা চাই আর না চাই। কিন্তু সত্যি করে এই মানুষটির কাছ থেকে আমরা ঠিক কি চাই? 

কিম্বা আদৌ কি কিছু চাই? 

হয়ত আমরা নিজেরাই নিশ্চিত নই সেই ব্যাপারে। কিংবা নিশ্চিত হলেও মুখ ফুটে প্রকাশ করতে লজ্জা পাই। কারণ এটা তো খুবই সত্য কথা যে আমরা জানি দুছত্র রবীন্দ্রনাথ আউড়ালেই পাচঁজনের কাছে বেশ এলেম দেখানো যায়। যদিও যে বাংলা ভাষাটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ কোনো কাজেই লাগে না, সেই একই বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখস্ত ঝেড়ে দিলেই পন্ডিত বলে পাঁচজনে বেশ মান্যিগণ্যি করে। এমনই তাঁর মহিমা। কিন্তু কি আছে এই মহিমার পেছনে? কোন সে প্রতিভা যাকে মানুষ এত মূল্য দেয়? একটু তলিয়ে দেখলেই দেখতে পাই দুটি বিষয় খুবই ক্রিয়াশীল তাঁর এই মহিমার পেছনে। এক তো তাঁর নোবেল জয়। কারণ আমরা জানি আবিশ্ব এই পুরস্কারের গুরুত্ব। আর আমরা বাঙালিরা চিরকালই পুরস্কারলোলুপ প্রজাতি। ফলে প্রথম নোবেলবিজয়ী বাঙালি হিসেবে আমরা তাঁকে আজও মাথায় করে রেখেছি, এবং রাখবো। অন্তত যতদিন এই পুরস্কারটি আবিশ্ব সমাদৃত থাকবে। এবং দ্বিতীয়টি হল তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই একটি বিষয়ে তিনি খুবই শোচনীয় ভাবেই আমাদের জব্দ করে দিয়েই গিয়েছেন। এবং নিজেও এই বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলেন। আর সেকথা বলেও গিয়েছিলেন নিজের বন্ধুমহলেই। বলেছিলেন, বাঙালি যতদিন থাকবে ততদিন তাঁর অন্য সব সৃষ্টি ভুলে গেলেও, এই গান বাদ দিতে পারবে না কিছুতেই। অর্থাৎ একটু সহজ কথায় বললে বলা যায় বাঙালিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক একটি বাঁশ দিয়ে গেলেন বিশ্বকবি। কিন্তু কেন কবির মনে হয়েছিল যে বাঙালি তাঁর অন্য সৃষ্টির প্রতি অবহেলা প্রদর্শণ করলেও তাঁর গানকে কিছুতেই ভুলতে পারবে না। কেন বাঙালিকে এমন একটি জিনিস দিয়ে যেতে হল তাকে এই বলে যে, এর থেকে তোমাদের কোনোদিন নিস্তার নেই?

কারণ সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনের সূত্রে। যে আন্দোলনে প্রবল ভবেই সামিল হয়েছিলেন কবি। যে আন্দোলনকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোতে না দেখে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখার ডাক দিয়েছিলেন কবি নিজে। আর দুঃখের বিষয় হলেও সেই তখনই সঠিক ভাবে পরিচয় পেয়েছিলেন নিজেরই স্বজাতির। বিচ্ছেদই আমাদের ধর্ম, বিভেদই আমাদের লক্ষ্য, বিদ্বেষই আমাদের অস্ত্র। আর সেই গুণে গুণান্বিত হয়ে সেইদিনই আমরা তাঁকে সেই আন্দোলনের মধ্যেই কোণঠাসা করে বাধ্য করেছিলাম ঘরে ফিরে যেতে। তার উত্তরও নিজের মতো করে দিয়ে গেলেন “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে” খুব বড়ো ধরণেরই এক শিক্ষা পেয়েছিলেন কবি তাঁর নোবেলজয়ের প্রাক্কালেই, তাঁরই স্বদেশবাসীর কাছে। এরই একটি প্রত্যক্ষ নমুনা দেখতে পাই আমরা নোবেলজয়ের পর কলিকাতার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ট্রেনে করে বোলপুরে তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে গেলে কবির প্রতিক্রিয়ায়। কেননা কবি সেদিন খুব সঠিক ভাবেই বুঝেছিলেন যে বিদেশী নোবেলের মাহাত্মেই নাগরিক সমাজের এই প্রীতির প্রদর্শনী। এর পিছনে তাঁর কর্ম ও চিন্তার প্রতি এদের কোনো ভালবাসা নেই, তাই এই মেকী প্রীতি প্রদর্শনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছিলেন বিশ্বকবির মত সহনশীল মানুষও। বললেন, “ –যাই হোক, যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন।

তার যদি কোনো মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে, আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোনো আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নোবেল প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বা রস বৃদ্ধি করতে পারা যায় না। অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? এ সম্মান আমি কতদিনই বা রক্ষা করব? আমার আজকের এদিন তো চিরদিন থাকবে না, আবার ভাঁটার বেলা আসবে তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে। 

তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি, -যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব, কিন্তু যা সাময়িক উত্তেজনার মায়া, তা আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম। কোনো কোনো দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছ পর্য্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমার চিত্তকে দূরে রাখতে চাই। আমার রচনার দ্বারা আপনাদের যাঁদের কাছ থেকে আমি প্রীতিলাভ করেছি তাঁরা আমাকে অনেক দিন পূর্বেই দূর্লভ ধনে পুরস্কৃত করেছেন, কিন্তু সাধারণের কাছ থেকে নূতন সম্মানলাভের কোনো যোগ্যতা আমি নূতন রূপে প্রকাশ করেছি একথা বলা অসঙ্গত হবে।”

কি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই না কবি স্পষ্ট করে দিলে যে, নোবেল প্রাইজ বিদেশীদের প্রীতির উপহার। স্বদেশবাসীর সাথে তার কোনো সম্বন্ধ নেই। নোবেলজয়ের আগে যাঁরা তার কাব্যের গুণগ্রাহী ছিলেন তাঁদের প্রীতিতে তিনি পূর্বেই অভিষিক্ত। নতুন করে নোবেলের মাহাত্মে তাঁর কাব্যে নতুন কোনো রসোত্তীর্ণতা ঘটতে পারে না। ফলে সেদিনের সেই মেকী সম্মর্ধনা প্রত্যাখ্যান করতে হয়ে ছিল তাঁকে। এভবেই জীবনের নানা পর্ব থেকে পর্বান্তরে কবি চিনেছিলেন তাঁর স্বদেশবাসীকে বাস্তবতার পরতে পরতে। 

শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় গড়ে তোলার পর্বেও সে আর এক কাহিনী। কবির স্কুলে যাতে ঘরের ছেলেমেয়েদের কেউ না পাঠায় সেই জন্যে একদল মানুষ নিজের খরচে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের ভয় দেখিয়ে আসতেন, সেকথাই বলেছেন কবি নিজমুখে পরবর্তীতে। তাঁর মংপুবাস কালে একদিন গভীর দুঃখের সাথেই মৈয়েত্রী দেবীকে বলছিলেন কবি, “চারিদিকে ঋণ বেড়ে চলেছে, ঘর থেকে খাইয়ে পরিয়ে ছেলে যোগাড় করেছি, কেউ ছেলে তো দেবেই না, গাড়ী ভাড়া করে অন্যকে বারণ করে আসবে। এইরকম সাহায্যই স্বদেশবাসীর কাছ থেকে পেয়েছি।” শান্তিনিকেতন থেকে পঁচিশে এপ্রিল ১৯৩৪এ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, “এদেশের মানুষ পদে পদে আমাকে কঠিন আঘাতে জর্জরিত করেছে, নির্মমভাবে আমাকে অপমানিত করেছে, অসহ্য হয়েছে কতবার। নিঃশব্দে আমি তা সহ্য করে এসেছি”। দুই বছর পর সেই অমিয় চক্রবর্তীকেই ৬ই এপ্রিল ১৯৩৬ এর একটি পত্রে লিখলেন, “বাংলাদেশের কাছ থেকে মিথ্যে নিন্দা ও গালি দেশের লোকের বিনা আপত্তিতে আমি যেমন সহ্য করেছি এমন আর কেউ করেনি। এদেশে আমার শেষ বয়স পর্য্যন্ত আমি চিরনির্বাসনদশা ভোগ করেছি”। 

স্বদেশবাসীর কাছে এইভাবেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন বিশ্বকবি আজীবন। তাই তাঁর শেষ জীবনে সাহিত্যিক যাযাবরের একটি প্রশ্নের উত্তরে সখেদে বলেছিলেন কবি, তাঁর ‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানটি পরবর্তীতে লিখলে “স্বার্থক” কথাটি কেটে দিতেন। এমনই গভীর অভিমান নিয়ে চলে গেছেন এই বিশ্বপথিক আমাদেরকে তাঁর যথাসর্বস্ব নিঃশেষে দিয়ে। 

কিন্তু আমরা কি সত্যিই পেরেছি তাঁর সেই দান গ্রহণ করতে? কিম্বা করতে পেরেছি কি, সেই দান গ্রহণের জন্য নিজেদের প্রকৃতই যোগ্য করে তুলতে? না, দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে আমরা তা পারিনি। কিম্বা আরও একটু তলিয়ে দেখলে দেখব, আমরা সত্যি গ্রহণ করতেই চাইনি তাঁকে, তাঁর নিঃশেষে দিয়ে যাওয়া মনিমুক্তকে, তাঁর অভিপ্রায়কে। আমরা চেয়েছি তাঁর খ্যাতির মহিমাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে। আমরা চেয়েছি তাঁর পোশাকে হাত বুলিয়ে নিজেদেরকে সংস্কৃতিসম্পন্ন প্রতিপন্ন করতে। আর করেওছি ঠিক তাই। পরস্পরের পিঠ চাপড়িয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি নিজেদেরকে রবীন্দ্রমনস্ক তকমায় ভূষিত করে। অথচ আমরাই আজীবন নিজেদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে স্বেচ্ছায় থেকে গিয়েছি রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরবর্তী সুদূরে। আর সেটা যে ঘটবে অনুধাবন করেই গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বলে গিয়েছিলেন তাঁর অভিপ্রায়কে গ্রহণ না করলেও তাঁর গানকে আজীবন বহন করতে হবে আমাদেরকেই। যত দূরেই সরে যাই না কেন সমগ্র রবীন্দ্রনাথ থেকেই, জীবনের পরতে পরতে তাঁর গানকে আশ্রয় করেই আমদেরকে অনুধাবন করতে হবে কিভাবে দূরে রেখে দিয়েছি সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে। কিভাবে তাঁকে শুধুই ব্যবহার করে চলেছি, একাত্ম হইনি তাঁর সমগ্রতার সাথে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাই রবীন্দ্রনাথ থেকেই আজও অনেক দূরবর্তী। প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্র, জীবনসাথী নন।

প্রবন্ধঃ অমলেন্দু চন্দ












প্রবন্ধঃ


রম্যতা রমণীয়তা ও রবীন্দ্রনাথের জীবনের রমণীরা
অমলেন্দু চন্দ


দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অশিক্ষিতা ভবতারিনীর ১৮৮৩ সালে যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি দস্তুরমত লিখিয়ে পড়িয়ে বিলেতফেরত যুবক ও কবি । কথিত, তিনি তার বিয়ের বাসরে নিজেই নতুন পত্নী (বোধহয় তার বয়েস তখন নয়) কে উদ্দেশ্য করে গান গেয়েছিলেন। তাকে গান গাইতে প্রবুদ্ধ করেছিল নাকি তাঁর মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর মন্তব্য - তুমি থাকতে আর কে গান গাইবে। জ্ঞানদানন্দিনী উল্লিখিত এই ‘আর কে’ টা কার উপস্থিতির প্রতি আঙুল? কথিত যে, কাদম্বরী ভাল গায়িকা ছিলেন।

ভবতারিণী একদিন মৃণালিনী হয়ে গেলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর তত্ত্বাবধানে লোরেটো হাউসে পড়াশুনা করলেন, আদব কায়েদা শিখলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ হিসেবে নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে। উঠেছিলেন যে, তাতে কোনই সন্দেহই নেই। ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের মতই অভিনয় করেছেন, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রূপকথা সংগ্রহ করেছেন, অংশবিশেষ নিজেও লিখেছেন, রামায়ণ অনুবাদ করেছেন, আর তাঁর রান্না করার গল্প তো প্রবাদপ্রতিম, শোনা যায় এই রান্না প্রসঙ্গে যখন রবীন্দ্রনাথ তাকে খোঁচাতেন যে, দেখ তোমার রান্না আমি তোমাকে শিখতে বাধ্য করেছি বহুবার, তখন তিনি তার সহজ ভাষায় পাল্টা খোঁচা মেরেছেন যার সারমর্ম ছিল যে, তুমি তো জিতেই আছ, আমি আর জিতলাম কবে। 

মৃণালিনীর মৃত্যুর পর তার খাতা যেটুকু রথীন্দ্রনাথের কাছে পাওয়া গিয়েছিল, সেই খাতার রূপকথার গল্পের থেকেই নাকি অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল জন্ম নেয়। চিঠিপত্রের সূত্রে যা খুবই অল্প, বিশেষ যেখানে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বোধহয় শ’ তিনেক চিঠি লিখেছেন সেই তুলনায়; জানা যায় এই মৃণালিনী কে রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই সম্বোধন করেছেন ‘ভাই ছুটি’ বলে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত “ভাই ছুটি” থেকেছেন রবীন্দ্রনাথের পাশে। শান্তিনিকেতনে। উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সহধর্মিণীর ধর্ম পালন সাঙ্গ করতে করতে একদিন ফুরিয়ে গেলেন। সেটা ১৯০২ সাল। মৃণালিনী’র মৃত্যু’র এক বছর আগে তিনি শান্তিনিকেতনে তাঁর ব্রাহ্ম-মন্দির শুরু করেন, যেখানে মৃণালিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই তাদের মেয়ে রেনুকা মারা যায়। তারপর দেবেন্দ্রনাথ ১৯০৫, আদরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সাল। সেই মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই যেন সারা জীবন এক মৃত্যুর কার্নিভাল রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে অতিবাহিত হয়েছে। 

জীবনের দীর্ঘ প্রায় ষাঠ বা ততোধিক বছর ধরে শিল্পচর্চার মধ্যে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ কখনও শুধু শিল্পচর্চার জগতে বুঁদ হয়ে থাকেন নি। যে কোন অঙ্গীকারকেই মমতার সঙ্গে গ্রহন করেছেন, সে অঙ্গীকার প্রাতিষ্ঠানিক হোক বা নিজের কাছে হোক। পনের কি ষোল বছর বয়েসে জীবনানন্দ প্রথম কবিতা লিখে পাঠান রবীন্দ্রনাথের কাছে, কয়েকটি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ তখন বিশ্ববন্দিত কবি, নোবেল পেয়েছেন, নাইটহুড পেয়েছেন; তবু অচ্ছেদ্দা করেন নি এক তরুণের লেখার; পড়েছেন, তার পর তাকে একটা চিঠি লেখেন যেটা বহু জায়েগাতেই উল্লিখিত, এমন কি ক্লিন্টন সিলি’র বইতেও, যেটার কিছু বয়ান আজ বহুল পরিচিত –

“কল্যানীয়েষু,
তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাহাতে সন্দেহমাত্র নাই, কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন, বুঝতে পারি না। বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে। যেখানে তার ব্যঘাত দেখি, তাঁর সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে”। 

যেটা সবচাইতে লক্ষণীয় বিষয়, সেটা হল বিশ্ববরেণ্য কবি কিন্তু একটি তরুণের লেখাকে অবজ্ঞা করেন নি, পড়েছেন এবং পত্রালাপ করেছেন। এবং যা অনুভব করেছেন তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে কথা বলেছেন। এ সেই শিল্পের প্রতি - যে শিল্প তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত প্রেমের অঙ্গীকার - তাঁর নিজের অঙ্গীকার। সময়ানুগ ব্যখ্যা এবং চিঠিপত্র পড়লে জানা যায়, দ্বিতীয় চিঠি লেখেন এর প্রায় সাত বছর পরে, তখন ধুসর পাণ্ডুলিপি মুদ্রিত হয়েছে। এ চিঠির, না কি দু তিন লাইনের পত্র বলাই ভাল, ভাষায় ছিল স্বীকৃতির আর এক অভিব্যক্তি “তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে, তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে”। 

জীবনানন্দের কবিতায় মৃত্যুবোধ একটা দর্শনের মত ব্যপ্ত হয়ে আছে যা আমাদের কাছে পৌঁছয় এক অনবদ্য নিজস্ব রহস্যের মোড়কে। লক্ষণীয় হল রবীন্দ্রনাথের লেখায় মৃত্যুবোধের ভাব প্রকাশ আমরা আর এক ভিন্ন রূপের দর্শনে পাই। এ রূপের পেছনে তাঁর ভিক্টোরিয়ান মেজাজের কালচারের মধ্যে বড় হওয়া, পাশাপাশি ব্রাহ্ম মতের প্রভাব যে প্রভাবের মধ্যে বেদ ও উপনিষদের আত্মস্থ উত্তরাধিকার রয়েছে, আর তাঁর জীবনবোধ যেখানে প্রেম আর পূজা একাকার, তাঁর অ্যারিস্টোক্র্যাটিক লাইফ স্টাইল, সেই সব কিছুর প্রভাব রয়েছে ইন্ডিভিজুয়ালি সেই সব কিছুকেই ছাপিয়ে। আর এই অসীম কে ছুঁতে চাওয়ার ভাবাদর্শই রবীন্দ্রসঙ্গীতের মুল সুর। একটা আত্মনিবেদন।

মৃত্যু শোক সম্বন্ধে তার চিন্তা চেতনার শুরু বোধহয় তেইশ বছর বয়েসে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর। যদিও তার মা মারা যান তেরো বছর বয়েসে, কিন্তু বড় বৌঠান সর্বদাসুন্দরীর স্নেহ আর সে সময়ে কাদম্বরীর সখ্যতার আবহে তিনি টের পান নি মায়ের বিয়োগের কষ্ট। অনুভূতিতে বড় জোর একটা সেন্স অফ লস ছিল যে মা আর কোনদিন পূজোর ঘরের চেনা আসনটায় এসে বসবেন না। অন্যান্যদের, যেমন জ্যেষ্ঠা বউ ঠাকুরানির মৃত্যু, যে সর্বদাসুন্দরীর কাছে তিনি থাকতেন তাঁর মা মারা যাওয়ার পর, সেই সর্বদাসুন্দরীর মৃত্যুও তাকে সেভাবে নাড়া দেয়নি। কিন্তু কাদম্বরীর (নতুন বৌ) মৃত্যু, তাঁর নিজের বিয়ের কয়েক মাস পরেই, তাঁর বহুমাত্রিক দেখার দুনিয়াকে তাঁর তেইশ বছরের মন আর মনন কে মৃত্যু চেনায় স্থায়ী ভাবে। যে ভাব একটা পর্যায়ের পর একটা দর্শন হয়ে যায়। এর মধ্যে অবশ্যই আরও অনেক মৃত্যুর মিছিল তাকে নাড়িয়েছে।

কাদম্বরী দেবীর ঠাকুর বাড়িতে আসার আগের নাম ছিল মাতঙ্গিনি, তখন তাঁর বয়েস ন’ বছর, আর রবির সাত। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় হি ওয়াজ হার প্লেমেট অ্যান্ড কম্প্যানিয়ন এভার সিন্স হার ম্যারেজ। কাদম্বরীর আত্মহত্যা - মৃত্যু কে নতুন ভাবে দেখতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কবি অমিয় চক্রবর্তীর বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাকে যে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার থেকে বোঝা যায় তিনি কাদম্বরীর মৃত্যুতে কতটা বিয়োগ ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। হয়ত এই বিচ্ছেদ ব্যথার থেকেই উঠে এসেছিল সেই গান – তবু মনে রেখ।

তিনি লেখেন “এক সময়ে যখন আমার বয়েস তোমার মতই ছিল আমি যে নিদারুণ শোক পেয়েছিলাম সেও ঠিক তোমারই মত। আমার যে পরমাত্মীয় আত্মহত্যা করে মরেন, তাঁর আকস্মিক মৃত্যু তে আমার জগত শূণ্য হয়ে গিয়েছিল...সে প্রচন্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করেছিল” -অবশ্য এই চিঠি লেখার সময় আর কাদম্বরীর মৃত্যুর মধ্যে তিরিশ বছরেরও বেশী ব্যবধান রয়েছে।

কাদম্বরী দেবী এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মধ্যের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনামূলক কথা রয়েছে, সেগুলকে বাদ দিয়েই এটা মেনে নিতে হয় যে, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌ ঠাকুরবাড়িতে বিশেষ, সম্ভবত মহিলা মহলে খুব সম্মান পান নি, মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন বিলেত ফেরত, সে যুগের অতি আধুনিকা এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন এই আধুনিকার ভক্ত কিছুটা হয়ত মোহগ্রস্ত। এছাড়া অনেক পরে কথিত যে নাটক করতে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র বিনোদিনীর মধ্যে – সেসময়ের খ্যাতনামা নটী বিনোদিনী – একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। এর সাথে হয়ত নিঃসন্তান হওয়ার দায়ভাগ সে সময়ের নিয়মে সবটুকুই কাদম্বরীর কপালে জুটেছিল, আজও হয়। 

যে চিত্রটা জলরঙের স্বচ্ছতোয়া অনুভব কে স্পষ্ট করে তা হল এই রকম আবহাওয়ার পরিসরে দুটি সমবয়েসী প্রাণী আস্তে আস্তে সমমনস্ক তারুণ্য পেরিয়ে যুবক যুবতী হয়ে যায়। কোন আনুষ্ঠানিক মাপকাঠি ছাড়াই কাদম্বরী হয়ে ওঠেন কিশোর আর তরুণ রবির সাহিত্য-সঙ্গিনী। 

এই সময়েই যখন রবিকে বিলেত পাঠানোর বন্দোবস্ত হল, তখন রবির বোধহয় সতের আঠেরো বছর বয়েস। দেবেন্দ্রনাথ চাইলেন তাকে খানিকটা ইংরেজ করে তুলতে। সে সময়ে কিছুদিন মুম্বাইতে এক পরিবারে অতিথি হয়ে থাকেন রবি। আত্মারাম পান্ডুরঙের তিন কন্যা ছিল। জীবনে সম্ভবত এই প্রথম রবি বাবু পরিবারের বাইরে এবং কাদম্বরীকে ছাড়া কোন মেয়েদের সম্পর্কে আসেন এক জায়গায় থাকার এবং মেশার সুবাদে। 

পান্ডুরঙ সাহেবের কন্যারা বিলেত ফেরত সুশিক্ষিতা অ্যাকমপ্লিসড মেয়ে। এদের একজনের সঙ্গে তাঁর সখ্যতার সুবাদে পরে আমরা তাঁর লেখার নলিনী কে পাই। এ নিয়ে বহু বছর পরে আলাপচারিতায় অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে তিনি অনেক কথা বলেন, ততদিনে হয়ত আরও বছর পঁয়েতাল্লিশ কি আরও বেশী সময় চলে গেছে। সেই আলাপচারিতায় একটা জিনিষ স্পষ্ট হয়, সেই উঠতি যুবক বয়েসের দেখা আর মেলামেশার আনার সঙ্গ কে তিনি চিরকাল কোথাও তাঁর অন্তরে লালন করে গেছেন। এই ক্ষমতাটার মূলে কি কোন অংশেই কাদম্বরীর কাছ থেকে পাওয়া সখ্যতার দানে লালিত জীবনবোধের ঋণ ছিল না – কে বলবে। 

অবদানের প্রসঙ্গেই আরও একটা কথা এসে পড়ে। লন্ডনে তিনি থাকতেন এক ডাক্তার, জন স্কটের বাড়িতে। সেই জন স্কটের দুই কন্যার একজন ছিলেন লুসি। যা হওয়া স্বাভাবিক, সুদর্শন চেহারায় পুরোপুরি অ্যারিয়ান রবির প্রতি আকর্ষণ এবং ফলশ্রুতি লুসি’র সঙ্গে একধরনের সখ্যতার সুবাদে তিনি তাকে বাংলা ভাষা শেখাতে শুরু করেন। আর এই পর্বেই বোধহয় তাঁর নজরে আসে যে, শব্দবোধ আর উচ্চারণ সব সময়ে সোজা পথে হাঁটেনা। ভাষাতত্ত্বের ব্যপারে এই সমস্ত চিন্তার থেকেই তিনি প্রথম বোধহয় ভাবতে আরম্ভ করেন বর্ণনামুলক ব্যাকরণের কথা। নিশ্চিভাবে এইখানে রোপিত হয়েছিল “শব্দতত্ত্বের” বীজ। তাহলে কি এটা দাঁড়ায় যে, বিদেশিনীর প্রতি এক সখ্যতার অঙ্গীকার থেকে তিনি উঠে আসেন এমন এক চিন্তা চেতনার বিচরণক্ষেত্রে, যার সুবাদে ভাষা সম্পদশালী হয়ে ওঠে তাঁর সেই চিন্তা ভাবনার ফসলে। তাহলে বাংলা ভাষার ব্যাকরণবোধের জ্ঞান কি ঋণী নয় কিশোরী লুসির প্রেমের কাছে – কি বলেন।

জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। পরে যখন ইংল্যান্ডে আবার যান পরিণত বয়েসে, তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন সেই স্কট পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের। পারেন নি, কারণ স্কট পরিবার সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। একটা সেন্স অফ লস তখন কাজ করেছিল যার, রিফ্লেক্সান কিছু লেখায় পাওয়া যায়।

রবি ফিরে এলেন দেশে, ১৮৮০ সালে এবং সেই প্রচলিত বিশ্বাসের অনুষঙ্গে আমরা যেমন ভাবতে চাই – তাঁর বৌঠান কাদম্বরীর সখ্যতার কাছে, কিন্তু কাদম্বরী কি অনুভব করেছিলেন রবির দিগন্তে আরও কয়েকজন ঘুরে ফিরে গিয়েছেন। ভাবতে ভাল লাগে যে, এই রকম অবস্থা আর অনুভবের দুনিয়ায় হয়ত তিনি গেঁথেছেন সেই অনবদ্য কথার মালা – দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী আকাশে জল ঝরে অনিবার, জগতে কেহ যেন নাহি আর। সেই ১৮৮০ তেই তিনি ফিরে এসেই লিখলেন “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” – আমার ধারণা যদিও প্রচলিত বিশ্বাস যে এটি কাদম্বরী দেবীকে উদ্দিষ্ট করে লেখা – আমার ধারণা এই প্রেমের প্রকাশ হয়ত কাদম্বরী কে আরও ভাবিয়ে ছিল যে, বিলেতফেরত রবি ঠিক আগের রবি নেই। প্রেমের অনুষঙ্গে সে রমনীকে ছাপিয়ে প্রেম কে অনুভবে পেতে শিখেছে। হয়ত সেই রম্যতার রমণীয়তা রবিকে আরও মোহন করে তুলেছিল।

রবিঠাকুরের রেখে যাওয়া যে রিচ হেরিটেজের কথায় আমরা আজও অভিভূত হয়ে পড়ি, যেখানে সেই প্রেম আর পূজার কোন ভেদ নেই, প্রেমই পূজায় নিঃস্বণ, আবার পূজাই প্রেম হয়ে ধরা দেয় যে আবহে, সেই আবহের সম্পাদনে এদের ঋণ কতটা, তার কোন মূল্যায়ন সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় সারা জীবন ধরে তাঁর জীবনে আসা যাওয়া করা – স্বীকৃত পরিচিত ভাবানুষঙ্গের বিনিময়ের বাইরে অর্থাৎ ইন্দিরা দেবী, রানু বা সেই বিদেশিনী এনাদের ছাড়াও - রমণীয়তার আদান প্রদানে অসংখ্য নারীর ভুমিকার মূল্যায়ণ। হয়ত এই ঋণ স্বীকারের ভাষা হয়ে উঠেছিল সেই গানঃ
শুধায়োনা কবে কোন গান কাহারে করিয়াছিনু দান

কাদম্বরী তাঁর অনুভূতির জগতে কতটা ছিলেন, তাঁর অংশবিশেষ ভারতীতে ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত একটি লেখা সেই স্বাক্ষর বহন করে – 

“সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি, সেই অশ্রুসিক্ত আমার প্রানের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে। সে যে আমার খাতায় আমার 
কবিতার পার্শ্বে হিজ বিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটি দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সেই অর্থপূর্ণ হিজি বিজি ছাপা হইল না, আমার রচিত কতগুলি অর্থহীন হিজি বিজি ছাপা হইয়া গেল...”

কথিত এই সময়ে তারা দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে রবি’র জ্যোতি দাদাও ছিলেন। এটা কি খুব কো ইন্সিডেন্ট্যাল যে এই ১৮৮৩ সালেই কয়েক মাস পরেই ভবতারিণীর সঙ্গে রবির বিয়ে হয়। ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন।

এবং বিচিত্র কিছু তত্ত্ব প্রচলিত যে, ভবতারিণী কে পছন্দ করার ব্যপারে নাকি জ্ঞানদানন্দিনীর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সেটাও কি মহিলা মহলের সেই অন্তঃপুর ঘটিত কিছু বিসম্বাদের ফসল – কে বলবে। বিলেতফেরত মেজ বৌঠান স্বল্পশিক্ষিতা শ্যামলা মাতঙ্গিনীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন হয়ত – জ্যোতি তাঁর ভক্ত ছিলেন, রবি নয়। অথচ ঠাকুর পরিবারের অন্যতম রত্ন যার সখ্যতার কাছে হার মেনে বসে ছিল সে ছিল মাতঙ্গিনী, হয়ত এটা জ্ঞানদানন্দিনী কে ক্ষুব্ধ করেই রেখেছে আজীবন – আর তাই হয়ত অদ্ভূত কোন শোধ নেওয়ার জন্যেই কি তিনি ভবতারিণীকে পছন্দ করেছিলেন – কে বলবে। 

যে কথা বলে শুরুর একটি মন্তব্য, যে শুধু শিল্পচর্চার মধ্যেই তিনি বুঁদ হয়ে থাকেন নি, নিজের বোধ বিশ্বাসের জমিনে তৈরি হওয়া অনেক কিছুর মধ্যেই দেশের কথা, পল্লীর উন্নয়ণের কথা তিনি দায়িত্বের সঙ্গে লালন করেছেন, একটা ধর্ম হিসেবে তাকে পালন করেছেন; রথীন্দ্রনাথ কে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যাশিক্ষার জন্য, শুরু করেন “পল্লী সংগঠন কেন্দ্র”, গ্রহণ করেন এল্মহারস্টের সাহায্যের বাড়িয়ে দেওয়া হাত, যে সংগঠনের নাম পড়ে বদলে গিয়ে হয় শ্রীনিকেতন, এবং পাশাপাশি বোধহয় এগিয়ে চলে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম শৈল্পিক অধ্যায় – যেমন সম্ভবত তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা ও চিত্রাঙ্গদা এই পর্যায়ের রচনা, তাঁর দেশাত্মবোধের রচনা চার অধ্যায় এই পর্যায়ের সৃষ্টি। তাঁর শ্রেষ্ঠতম গদ্যকাব্য পুনশ্চ শ্যামলী ও শেষ সপ্তক এই পর্যায়ে সঙ্কলিত ও প্রকাশিত হয়। শেষের কবিতা এই পর্যায়ের রচনা। বয়েস তখন তাঁর আটষট্টি। 

প্রেমের কবি প্রেমিক কবির জীবনবোধের শুদ্ধতম রস হয়ত অমিতের বাচালতার সূত্রে সংলাপিত – মানুষের মৃত্যুর পর তার জীবনী লেখা হয়, তার কারণ একদিকে সে সংসারে মরে, আর আরেকদিকে সে বেঁচে ওঠে নিবিড় ভাবে মানুষের মনে। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে – মাইকেল, বিহারীলালদের শিল্প সাহিত্য চেতনার বোধের অনুষঙ্গে পথ শুরু করা রবি মাইকেলের কথা কে মিথ্যে করে দিয়ে গেছেন – তাঁর অমরতার সুত্রে আর শেষের কবিতার অমিতের বাখানে – নিবিড় ভাবে বেঁচে থেকে, মানুষের মনে।

রবি যেন সারা জীবন তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের ভাষায় সব রহস্যসন্ধানীদের বলে গেলেন এরকম কিছু (স্বরচিত) – শুধায়োনা এত সুখ কোথা পেলে, কোথা থেকে পেলে – তিনি নিজেই হয়ত সবটুকু ঠিক করে উঠতে পারেন নি। ১৯৪১ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি যে লেখাটি লেখেন তাতে যেন এক সংশয়ের ছোঁয়া পাওয়া যায় –


তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী,
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাদ ফেঁদেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে,
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত
তাঁর তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।


তিনি কি সংশয়ী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অন্তরের অদ্ভূত নিঃসঙ্গতা নিয়ে। জানি না, জানতে চাই না – তাই বলি শুধায়োনা – আর শুধায়োনা।

মুখোমুখিঃ ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর






মুখোমুখিঃ

চিত্রশিল্পী ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর


চিলেকোঠা জলসাঘরের ব্যবস্থাপনায় গত সরস্বতী বন্দনায় আমরা সম্বর্ধনা দিয়েছিলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ওয়াসিম রিয়াজ কাপুর মহাশয়কে। চিলেকোঠার তরফ থেকে তাঁর সাথে আলাপচারিতায় কিছুক্ষণ।

চিলেকোঠা-- ওয়াসিম, চিলেকোঠায় আপনাকে স্বাগতঃ । আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা সবাই গর্বিত।

ওয়াসিম-- আপনাদের চিলেকোঠার এই সুন্দর পরিবেশ আমারও খুব ভালো লাগছে। আপনাদের কথা আমি আগেই শুনেছিলাম অলোকের মুখে। আর তাই আপনাদের সাথে আলাপ করতে আমারও খুব আগ্রহ ছিল।

চিলেকোঠা-- যেহেতু আপনি একজন চিত্রশিল্পী, তাই আপনার ছবি আঁকা নিয়েই কিছু কথা বলতে চাই।

ওয়াসিম-- বলুন। 

চিলেকোঠা-- শুনেছি আপনি নাকি রাত্রে ছবি আঁকেন ? রাতের পর রাত এইভাবে ছবি আঁকতে কোন অসুবিধা হয়না।

ওয়াসিম-- হাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমার ছবি আঁকার সময়টাই হল রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে। বিষয়বস্তু ভাবনা চলে সারাদিন ধরেই। কিছু কিছু খাতায় স্কেচ করে রাখি। কিন্তু তার আসল প্রকাশ ঘটে ক্যানভাসে, সেটা রাত্রে। তখন কোলাহল মুক্ত পৃথিবী আমার চিন্তাধারায় কোন ব্যাঘাত ঘটায় না। আর তারপর তো বেলা এগারটা পর্যন্ত ঘুম...। হা...হা...হা...। আর এখন তো অভ্যাস হয়ে গেছে।

চিলেকোঠা-- আপনি কি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতেন ?

ওয়াসিম-- আমার ছেলেবেলা আর দশজন বাচ্ছার মত কাটেনি। আমি আমার ছ’মাস বয়সে খাট থেকে পড়ে যাই। আর তারপর জীবনের প্রথম বারোটা বছর কেটেছে বিছানায় প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায় হাসপাতাল আর বাড়িতে। দুবার অপারেশনও হয়েছে। ডাক্তার আরও একবার অপারেশন করার কথা বলেছিল, করাইনি। বাড়িতেই শুয়ে থাকতাম বিছানায়। আর জানলা দিয়ে দেখতাম, লোকজন, গাড়িঘোড়া। আর ইচ্ছা করতো খাতার পাতায় ওইসব ধরে রাখতে। তাই আমার বাবার কাছে আবদার করেছিলাম ছবি আঁকব বলে। বাবা আমায় কাগজ, পেন্সিল, রবার আর ক্রেয়ন রঙ এনে দিয়েছিলেন। আমি শুয়ে শুয়ে ছবি আঁকতাম। 

চিলেকোঠা-- শুয়ে কেন ?

ওয়াসিম-- আহা, আগেই তো বলেছি, আমার অসুস্থতার কারণে বেশীরভাগ সময়ই আমার পায়ে প্লাস্টার থাকতো। 
যাই হোক, সেইসময় আমার আঁকার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার বাবা অমর নন্দন নামে একজনকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন। তিনিই হলেন আমার প্রথম শিল্পগুরু। আমি জীবনে বহু বিখ্যাত শিল্পীর সান্নিধ্যে এসেছি। তাঁদের কাছে শিক্ষালাভ করেছি। যেমন, দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী, অতুল বসু, যামিনী রায়, হুসেন, পরিতোষ সেন, বিকাশ রায়, গোপাল সান্যাল, চিত্ত দাস, আরও অনেক অনেক। কিন্তু অমর নন্দন স্যার-এর সান্নিধ্য ভোলার নয়।

চিলেকোঠা-- তারপর...

ওয়াসিম-- তারপর আর কি... মাষ্টারমশাই অমর নন্দের সহযোগিতায় আমি পনের বছর বয়সে ভর্তি হলাম আর্ট কলেজে। সেই প্রথম আমার বাইরের জগতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ। বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম প্রথম দিন। এক অপরিচিত পরিবেশ, কত ছেলেমেয়ে, কোলাহল। আমার দাদা শামীম আমাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। আমার দু-বগলে ক্রাচ। তার সাথেই ধরা ছিল একটা ছোট্ট চামড়ার বাক্স ভর্তি রঙ। ক্লাসের মধ্যে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিলাম। অলোকই প্রথম আমার হাত ধরে আমাকে তার পাশে বসায়। সেই থেকে এখনও আমরা একসাথে। আমার অসুস্থতার জন্য অলোক আমায় প্রতিদিন কলেজ ছুটির পর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যেত। তার জন্যে অনেক বিরূপ মন্তব্যও ওকে শুনতে হয়েছে। আমিও ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মাও নিশ্চিন্তে থাকতেন অলোক সাথে থাকলে। ও এখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছে।

চিলেকোঠা-- আপনি প্রথম কবে ছবির প্রদর্শনী করেছেন ? আর এখনও কি ছবির প্রদর্শনী করে চলেছেন। তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।

ওয়াসিম-- আমার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শন বললে বলতে পারি আমার কলেজের প্রথম বছরের বার্ষিক প্রদর্শনী। সেইখানেই আমার ছবি প্রথম সর্বসমক্ষে আসে। তারপর প্রতি বছরই আমি সেই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। কলেজ থেকে পাশ করার পর কোলকাতার বিভিন্ন আর্ট গ্যালারীতে আমি প্রদর্শনী করেছি, কখনও একা, আবার কখনও কয়েকজন বন্ধু মিলে। তারপর ভারতের প্রতিটা বড় শহরেই আমার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। তাছাড়া পৃথিবীর বহুদেশে আমার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে বা এখনও হয়ে চলেছে।

চিলেকোঠা-- ব্যক্তিগত স্তরে বা বহু গ্যালারীতে তো শুনেছি আপনার আঁকা ছবির সংগ্রহ করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে যদি কিছু আলোকপাত করেন।

ওয়াসিম-- হাঁ তা আছে। আন্তর্জাতিক স্তরে কিছু দেশে আমার আঁকা ছবির সংগ্রহ আছে। আর আমাদের দেশেও কোলকাতার বিধানসভায়, উর্দু এ্যাকাডেমী, দিল্লী পার্লামেন্ট হাউস, ললিতকলা এ্যাকাডেমী, মুম্বাই, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানে আমার আঁকা ছবির সংগ্রহ আছে।

চিলেকোঠা-- আপনি ব্যস্ত মানুষ, আর বেশী সময় নেব না। শুধু শেষকালে একটা কথা বলি, বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে আপনি কি কোন বার্তা রেখে যাবেন।

ওয়াসিম-- দেখুন, কিছু বলার মত জায়গায় আমি এখনও পৌঁছতে পারিনি। তার জন্যে অনেক সাধনার প্রয়োজন। তাছাড়া আমি নিজেই এখনও শিক্ষার্থী। প্রতিনিয়তই আমি কিছু না কিছু শিখে চলেছি।
তবে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে দেখেছি, কোন শিল্পীর যেটা সব থেকে বেশী দরকার, তা হল তার মন, চোখ আর অধ্যবসায়। এই তিনের মিলন ঘটলে, সে একদিন ঠিক ভালো শিল্পী হতে পারবে। তাই বলি ভাল ভাল ছবির প্রদর্শনী দেখুন, দেখুন ওল্ড মাষ্টারদের ছবি। তাদের ভাবনা, উপস্থাপনা, রঙের ব্যবহার। আর তারপর তা প্রয়োগ করুন নিজের ভাবনার সাথে, নিজস্ব সত্ত্বার সাথে। কিন্তু কখনই নকল করবেন না। নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রকাশ করুন। আপনার অধ্যবসায়ই আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

চিলেকোঠা-- অনেক ধন্যবাদ ওয়াসিম। ভালো লাগল চিলেকোঠাকে এতটা সময় দেবার জন্যে। ভালো থাকুন।

ওয়াসিম-- আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনারাও সবাই ভালো থাকুন, চিলেকোঠা ভালো থাকুক। নমস্কার।

চিলেকোঠা-- চিলেকোঠার সবার তরফ থেকে আপনাকেও নমস্কার জানাই।

বিশেষ প্রতিবেদনঃ চিলেকোঠার বৈঠক















বিশেষ প্রতিবেদনঃ


চিলেকোঠার বৈঠক


বাংলা নববর্ষ, ১৪২১; ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪; চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের মুকুটে সংযোজিত হোল আরও একটি নতুন পালক। শুরু হোল মাসিক সাহিত্য আড্ডা, চিলেকোঠার বৈঠক। 

সেদিন কাশীপুর রোডে আমাদের এক অত্যন্ত প্রিয় সদস্য, কবিবন্ধু সুব্রত পালের বাড়িতে বসেছিলো বৈঠকের প্রথম আড্ডা। অনুষ্ঠানের আদ্য পুরোহিত ছিলেন বর্ষিয়ান সাহিত্যপ্রেমী, প্রথিতযশা স্বনামধন্য ব্লগার, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। প্রদীপ জ্বালিয়ে তিনি শুভ সূচনা করলেন বৈঠকের। সমবেত মাঙ্গলিক সঙ্গীতের পর বৈঠকের শুরুতেই সাবলীল ভঙ্গীতে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ততায় সঞ্চালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক শেখর রায়। 

আলোচনার সূচনায় শ্রী রায় একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সূত্র তুলে ধরেন। সভার কাছে প্রশ্ন রাখেন, আধুনিক কবি কে? রবীন্দ্রনাথকে কি আধুনিক বলা যায়? উত্তরে দেবাশিষ কাঞ্জিলাল সুন্দর ভাবে সংস্থাপন করেন তাঁর মত। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ কালোত্তীর্ণ, আর তাই তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং চরম আধুনিক; আসলে রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর সময়ের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। 

আলোচনাসূত্রে বৈজয়ন্ত রাহার সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই ‘না বলা কথার বাঁকে’ থেকে কবি পাঠ করলেন ‘হাত ঘোরালেই স্রোত’ । সুকন্ঠের অধিকারী বৈজয়ন্তর পাঠ গুনে কবিতাটি এক অন্য মাত্রা পেল। আর তখনই, প্রাসঙ্গিক ভাবেই সভার আলোচনার অভিমুখ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হোল; প্রশ্ন উঠলো, কবিতা পাঠ আর আবৃত্তি কি একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন নাম? 

আসলে কবি নিজে যখন স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন, তখন কবিতার অন্তর্নিহিত মর্ম সপ্রকাশ হয় অবলীলায়; আর বাচিক শিল্পীর আবৃত্তিতে কবিতা হৃদয়গ্রাহীতা লাভ করে অন্য এক মাত্রায়, সেখানে মিশে থাকে আবৃত্তিকারের নিজস্ব অনুভূতিও - অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। আলোচনা হয় পাঠযোগ্য কবিতা ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতার সৃষ্টি এবং বৈষম্য নিয়েও। সভার আলোচনা স্বতঃস্ফূর্ততা পায়, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে দুরন্ত ঝর্ণার বেগে তরতরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে বৈঠক। 

রামমোহন থেকে শুরু রবীন্দ্রনাথে শেষ – তারপর ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’। ১৯৩০-এ বুদ্ধদেব বসুর আগে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য কুমার, বিষ্ণু দে; রবীন্দ্র-পরবর্তী ৪০-এর দশকের সাহিত্যে মানুষের কথা, মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা, তার দৈনন্দিন জীবন চর্যার কথা। তারপর যুদ্ধবিরোধী সাহিত্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ৭০/৮০-র দশকের সাহিত্যে বিশ্বায়ন। মাঝে হাংরি মুভমেন্ট, কৃত্তিবাস যুগ বাদ পড়ে গেলো কি!!! আসলে সময়কে ধারণ করেই আধুনিকতা। 

এক সময় কবিতা থেকে গান তৈরী হয়েছে। পরে গীতিকার গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে গান তৈরীর স্বার্থে। আবার সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্রের জন্য লেখা গল্প – এও এক প্রাসঙ্গিক আলোচনা। 

এরই মাঝে একাধারে কবি ও সুকন্ঠী গায়ক তন্ময় গুপ্তের গলায় ‘শুধু যাওয়া আসা’ আর ‘দিবস রজনী আমি যেন কার’ – পরিবেশে এক অন্য মাত্রা সংযোজন করে। এরপর আসরকে কমিক রিলিফ দিলেন নারায়ণ রায়। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র পটাই বাবু – স্ট্রং স্যাটায়ার; সমাজের সমস্ত বিচ্যুতির প্রতিই তাঁর আঘাত। লেখক কন্ঠে শোনা হলো অপ্রকাশিত, এমনকি অলিখিত এমনই এক পটাই বাবু কাহিনী। প্রসঙ্গত দেবাশিষ কাঞ্জিলাল শোনালেন তলস্তয়ের এক বিখ্যাত গল্প। সুলেখক ডঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য অবশ্য সোজাসাপটা। তাঁর মতে, যে সাহিত্য জীবন থেকে রস গ্রহণ করেই সৃষ্টি হয়, তা যেন সহজবোধ্য হয়। সাহিত্যিকের ভাবনা যেন অধিকতর পাঠককে একই সঙ্গে স্পর্শ করতে পারে, তবেই তা রসোত্তীর্ণতা লাভ করবে। 

এর পর বাচিক শিল্পী বন্ধু তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাত্ত গুরু গম্ভীর বাচন ভঙ্গীমায় শোনা হলো বাংলাদেশী কবি আবু জাফর অবায়দুল্লাহ রচিত কবিতা ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ । আহা, এতো শুধু আবৃত্তি নয়, এ এক পরম অনুভূতির উপলব্ধি !!

এরই রেশ টেনে জয়তি গুপ্তের আবৃত্তি – ‘মাগো, রাজার দুলাল যাবে আমার’ – শুভক্ষণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। - পরিবেশকে মায়াময় করে তোলে। সমানতালে চলতে থাকে কবিতা পাঠও। তন্ময় গুপ্তের ফেসবুকিও কবিতা – ‘সঙ্গীকলম’, সুব্রত পালের ‘বর্ষবরণ তোমাকে নিয়ে’। সুরেলা সুকন্ঠী মিসমি রায় বণিক ও শুভা ঘোষের সুমিষ্ট গান, সঙ্গে জলযোগ। এরই মধ্যে চিলেকোঠা ওয়েবজিনের বিষয়ে দু-চার কথা বলে নিলেন সুস্মিতা সিং। 

এর পরেই দেবাশিষ মিত্র পাঠ করে শোনালেন বনফুলের বিখ্যাত ছোটগল্প – ‘দর্জি’। দেবাশিষের বাচনভঙ্গী বড় মনোগ্রাহী। এখনও কিন্তু সভার সেরা আবিষ্কারটি বাকি ছিলো। সুহৃদ সুব্রত পালকে আমরা সবাই কবি বলেই চিনি, কিন্তু তিনি যে এমন অপূর্ব লোক সঙ্গীত গাইতে পারেন, তা জানা ছিল না। জয়তি গুপ্তের গানের পর আমরা শুনলাম তুসিমা ভট্টাচার্যের গলায় অসাধারণ দুটি গান। 

এবার আমরা প্রায় সভার শেষ পর্বে। সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে শেখর রায় শোনালেন অত্যন্ত কালানুগ একটি স্বরচিত কবিতা – ‘আন্তর্জাতিক ২৬শে ডিসেম্বর, বাগুইহাটি’। বিশ্বায়ন থেকে উৎসে ফেরা – অপূর্ব সাবলীল ভঙ্গীতে ও অনুভূতিতে তিনি ধরেছেন তাঁর মাত্র কয়েক ছত্রের ছোট্ট এই কবিতাটিতে। 

দেবাশিষের কাঞ্জিলালের দুটি কবিতা আর বৈঠকের শেষ সংযোজনা স্বনামধন্যা আবৃত্তিকার বৃষ্টি সাহার কণ্ঠে দুটি অপূর্ব কবিতা আবৃত্তি শোনার পর প্রথম বৈঠকের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করলেন চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের অন্যতম এড্‌মিন অলোক চৌধুরী। অতিথিবৎসল কবিবন্ধু সুব্রত পাল ও কবিপত্নীর আন্তরিক আথিথেয়তা বৈঠককে পরিপূর্ণতা দান করল, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। 


কত অতৃপ্তি, কত না বলা কথা রয়ে গেল, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে ৭টা ৩০মি। স্বস্তির কথা, সমাপ্তি তো শুধুই সমাপ্তি নয়, আগামী সূচনার সুত্রপাত। তাই, পরের বৈঠকে আবার দেখা হবে – এই অঙ্গীকার নিয়ে সে দিনের মতো যে যার ঘরমুখী। সঙ্গী হোল এক অসাধারণ পয়লা বৈশাখী সন্ধ্যার স্মৃতি আর বন্ধুদের ক্যামেরায় ও মুঠোফোনে বন্দী কিছু ফটোমুহূর্ত। এখন শুধু চিলেকোঠার বৈঠক দিনে দিনে শ্রীমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ হোক – এই কামনা নিয়ে আগামী বৈঠকের প্রতীক্ষা ।।

বিশেষ রচনাঃ ইন্দ্রানী ঘোষ















বিশেষ রচনাঃ


নতুন দেখা
ইন্দ্রানী ঘোষ


আরেকটা বছর ঝরে পড়ল কালের সমুদ্রে। চৈত্রের শুরুতেই Macbeth এর tomorrow and tomorrow speech টা বড্ড মনে পড়ে, যা বলে Macbeth এর চরম উপলব্ধির কথা, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।একটা করে দিন চলে যায় কালের গর্ভে। ম্যাকবেথ কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল তাঁর আকাঙ্খা। তাঁর প্রচণ্ড ambition এর, পলতেয় আগুন ধরিয়েছিলেন স্বয়ং “লেডি ম্যাকবেথ’। শতাব্দী ধরে যাকে বলা হয় খলনায়িকা। আমাদের জন্য ভাগ করা নিজস্ব দুনিয়া। জয়ের সাথে পুরুষের যোগাযোগ। নারী প্রেরণার রূপ। জয়ের সাথে আছে আগ্রাসন, আছে পুরুষের অলঙ্কার অহং। ম্যাকবেথ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুদ্ধে রত হন। যদিও তাঁর অন্তর তখন ক্ষতবিক্ষত। ওদিকে পাগলিনী লেডী ম্যাকবেথ প্রলাপ বকেন। বলেন, নেপচুনের সমুদ্রের সমস্ত জল তার হাতের রক্ত মুছতে পারবে না। ম্যাকবেথ পড়েন বিজয়টিকা। লেডী ম্যাকবেথের জন্য কিন্তু বিজয়শ্রী নেই, তাঁর জন্য আছে বিস্মৃতির অতল কালো নেপচুনের সমুদ্র । 

দিন গেছে রেনেসাঁর বয়েস হয়ে গেল প্রায় চার শতক। চারশোটা “নববর্ষ” পেরিয়ে গেল। দেখাটা একটু হলেও বদলেছে বৈ কি। আমরা অন্তরীক্ষে যাই, প্লেন চালাই,গবেষণা করি, ছবি আঁকি, সিনেমা বানাই, লিখি, সৃষ্টির আদি কাজও করি। খলনায়িকা একটু আধটু হই আজও, তবে সমঝে চলে মানসিক শিক্ষায় উজ্জ্বল পুরুষেরা। বাকীদের মানুষ বলেই গন্য করি না আমরা। কিছুদিন আগে একটা মনস্তাত্ত্বিক কর্মশালায় গিয়েছিলাম কর্মসূত্রে। আজকের পুরুষদের দাঁত নখ এভাবে বেড়িয়ে পড়ার কারণ খতিয়ে দেখালেন Dr Manjula Padmanabhan. বললেন Gender sensitization বা লিঙ্গ ভিত্তিক সচেতনতা বাড়ান বেশি দরকার। Dr padmanabhan একটি সুন্দর নাটক পড়লেন। নাটকের বিষয় অবশ্যই মেয়েদের যৌনতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে করে মেয়েদের যৌনতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার দরকার নেই। Rapist রা মনে করে মেয়েদের “না” বলা মানেই “হ্যাঁ” বলা। তারা মনে করে যে “লজ্জা” মেয়েদের অলঙ্কার। সেই লজ্জাকে সজোরে সরিয়ে দেবার অধিকার তারাই রাখে। নাটকের শেষে গানের একটি কলি শেষ কথা বলে গেল,”I’m more than my lady parts”. নারী চিহ্ন ছাড়াও আমাদের কিছু অস্তিত্ব আছে।একেবারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গোঁড়ায় আঘাত হেনেছেন তিনি। এই সাহসী পদক্ষেপের সমর্থন দেখলাম অনেক পুরুষরা করলেন। দেখে বেশ ভালো লাগলো। 

এ প্রসঙ্গে আমাদের স্কুলের ছেলে বন্ধুদের কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। আমরা ছেলেদের সাথে সেই অবুঝ বয়েস থেকেই পড়াশোনা করেছি, খেলেছি। প্রকৃতিগত কিছু ‘ফারাক’ সেদিনও ছিল আজও আছে। রাগ, অনুরাগ, হেলাশ্রদ্ধা, স্পর্শকাতরতা সব মিলিয়ে এক অম্লমধুর সম্পর্ক আমাদের। কোন বান্ধবী হয়ত ফুটবল বা ক্রিকেট বিষয় কোন মন্তব্য করে ফেলেছে ,অমনি মন্তব্য উড়ে এসেছে “আঃ কি হয়েছে? তোরা আবার কি বলছিস?” মনে হত যেন তাঁর পেটে কামড় পরেছে। আমাদের একজন বান্ধবীর ক্রিকেট খেলার খুব সখ হয়েছিল ছেলে বন্ধুদের সাথে,তা তারা নেবে কেন? সেই সে বোঝে নি যে “We are from Venus ,they are from Mars”. football, cricket এসব ওদের কাজ। আমাদের কাজ দেখে যাওয়া। তবে হ্যাঁ, একটা কথা না বলে পারছি না আগের প্রজন্মের পুরুষদের সাথে আমাদের ছেলেদের অনেক তফাৎ তো নিশ্চয়ই আছে। আমাদের ছেলে বন্ধুরা টুনটুনি পাখীর

মতো তাদের ছানাদের খাইয়ে দেয়। মায়েরা আসতে পারেন না সবসময় ,বিদেশ থেকেও কেমন সুন্দর বাচ্চাদের ডানার নীচে নিয়ে উড়ে আসে বাবারা। প্রয়োজনে রান্না করে, চা ত করেই। বউ এর প্রশংসা করতে দ্বিধা করে না। এক বন্ধুর তিন বছরের মেয়ে তাঁর মায়ের গলা ধরে বায়না করলে আমাদের বন্ধু বলে “আমি ত আর সবার সামনে পারব না বায়না করতে”। সবার আড়ালে তাঁর বায়নাক্কার কি যে সামাল দিতে হয় তা না আলোচনা করাই ভালো। দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী আমাদের এক ডাক্তার বন্ধু বলে “আমি দুই খাণ্ডারনীর সঙ্গে থাকি, এক আমার ব্‌ দুই আমার মেয়ে” এই বন্ধুকে আমাদের আনটিরা পর্যন্ত কম নম্বর দিতে ভয় পেতেন। দুই নারী শক্তি এঁকে যে কি বাঁধনে বেধেছে, দেখে বড় আনন্দ পাই। এক বন্ধুর বউ আমাদের সাথে বেশ মিশে যায়, তাতে আমাদের বন্ধু বলে “আরে আমার বান্ধবীদের সাথে আমি স্পেস না পেলে আমি যাই কথায়?” বেশির ভাগ বন্ধু দেখি বউ এর রূপমুগ্ধ। অনেকে সঙ্গে করে আনে আড্ডাতে, অনেকে নয়, পাছে নজর লাগে। আবার যারা আনে তাঁরা একটা চোখের মনি এক কোণায় ঠেলে দিয়ে দেখে, কতজন তাঁর আদরের বউটিকে মাপছে। আরেকটি চোখের কোণ থাকে সুন্দরী বান্ধবীর দিকে। আর একজন বান্ধবী যে তাঁর দুটো চোখেরই খবর রাখছে তা সে বুঝতে পারে না । ‘men will be men after all’. আমরা বোকা থাকার অভিনয় শতাব্দী ধরে করে চলেছি আর মজা পাচ্ছি। আমাদের বন্ধুরা আমাদের কৈশোর কালের দুই বান্ধবীকে নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করে থাকে বৌদের সামনেই। তাদের ছোট স্কার্ট,চুলে ঢেকে যাওয়া চোখ ,গোলাপি ঠোঁট, মসৃণ ত্বক ইত্যাদি নিয়ে। অন্য বান্ধবীদের মন রাখতে তারা বলে “আমরা তোদেরও দেখি”। ওরা না দেখলে যেন আমরা দুঃখে আকুল হচ্ছি। আমাদের বরেরা আমাদের আড্ডাতে আসে না তারা আমাদের ছেড়ে দেয়। এটাও একটা নতুন পাওয়া বটে। আমাদের স্বাধীনতা বেশ উপভোগ করি আমরা। তবে আমরা আমাদের স্কুলের এই বন্ধুদের কাছে সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করি। ছোট বেলায় বেশ ফিরতে পারি। এমন বন্ধু যেন আফগানিস্তান,পাকিস্তান,উত্তর ভারতে মেয়েরাও পায়। 

আমাদের শৈশব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ওদের থেকে যায়। আমরা খলনায়িকা হয়ে থাকি বেশির ভাগ সময়, ওরা নিষ্পাপ শিশু। তবে দেখছি এতে ওরা একটু লজ্জা পাচ্ছে আজকাল। এই লজ্জাবোধ থাকলে আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত। আগামী নববর্ষের দিনগুলিতে যদিও জীবনের মোমবাতি একটু একটু করে গলবে। তবুও খানিকটা ভালবাসার আলো জ্বলবে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস এর মত। লেডি ম্যাকবেথদের এর মাথাতেও একটু ভালবাসার ছোঁয়া লাগবে আশা করি।

চিলেকোঠা সরগরম

















চিলেকোঠা সরগরমঃ


এই সংখ্যার বিষয়ঃ 


প্রতিদিন ঘটে যাওয়া পথদূর্ঘটনার সংখ্যা কমাতে আইন সম্মত ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা উচিত

(বিশেষ সূচনাঃ এই বিভাগে প্রকাশিত প্রতিটি মন্তব্য অংশগ্রহণকারীর একান্তই নিজস্ব মতামত, এ বিষয়ে চিলেকোঠা ওয়েবজিন কোনোভাবে দায়ী নয়)


কোনও পক্ষেই কোনও লেখা আসেনি :(


অনুবাদ কবিতাঃ ইন্দ্রানী সরকার





অনুবাদ কবিতাঃ


বিবর্ণ পাতা
ইন্দ্রানী সরকার




The Ragged Wood by William Butler Yeats

O hurry where by water among the trees
The delicate-stepping stag and his lady sigh,
When they have but looked upon their images -
Would none had ever loved but you and I!

Or have you heard that sliding silver-shoed
Pale silver-proud queen-woman of the sky,
When the sun looked out of his golden hood? -
O that none ever loved but you and I!

O hurty to the ragged wood, for there
I will drive all those lovers out and cry -
O my share of the world, O yellow hair!
No one has ever loved but you and I.





বিবর্ণ পাতা
উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস


নদীর ধারে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যাবার সময়
সাবধানী পায়ে হেঁটে যাওয়া যুবকটি আর তার সাথী
মেয়েটি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল যে
তাদের মত আর কেউ কখনো কাউকে ভালোবাসে নি |

রূপালী জুতো পায়ে এই যে মেয়েটি আকাশের রাণী
সৌন্দর্য্যের পসরা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়,
সূর্য্য তার সোনালী ঘোমটা খুলে তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
তাদের মত আর কেউ কখনো কাউকে ভালোবাসে নি |

খোলা বাগানের মাঝে হেঁটে আসা ওই যুবকটি
অন্য যে সব যুবকরা ওই মেয়েটিকে চায় তাদের
পরাজিত করে সুন্দর সোনালী চুলের ওই মেয়েটিকে
নিয়ে একসাথে এই পৃথিবী উপভোগ করবে কারণ
তার মত ওই মেয়েটিকে আজো কেউ এত ভালোবাসে নি

আর মেয়েটির মতও কেউ তাকে এত ভালোবাসে নি |

কবিতাঃ সৈয়দ হাসমত জালাল















কবিতাঃ


মায়া
সৈয়দ হাসমত জালাল



দিনান্তের অন্ধকার, ভাঙা ডিম আর সাপেদের চলাচল থেকে স্বল্প দূরেই
আমাদের অগোচরে যে বিভাময় অঙ্কুর উদ্‌গত হোল 
তারই নাম প্রেম?
তখন শুক্লপক্ষের আকাশে উঁকি দিচ্ছিল 
                    একটা রুপোর বর্ণ চাঁদ

অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একদিন
আমরা ঘুরেছি কতো দিক ও দিগন্তে
উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্বে ও পশ্চিমে
সম্পূর্ণ করেছি সেই চিহ্নহীন অন্তহীন একটি বৃত্ত
                  যার পরিধি বুঝি নিরবধিকাল...
আমরা বলেছি কথা অবিরল জলের কলস্বরে

তারও গভীরে যে নৈঃশব্দ্য দুলছিল
                অপরূপ মুক্তোমালার মতো
সেইখান থেকে এক মধুর বিষন্ন আলো 
বেজে উঠছিল দিনান্তের আবিশ্ব অন্ধকারে

তাকে যদি প্রেম বলি
তুমি তবে সেই উদ্গত মায়া, যাকে ছাড়া অপূর্ণ থেকে যায় আমার স্বদেশ

কবিতাঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত












কবিতাঃ


ঘট সরা
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


আধেক জীবন কিছু ওঠাপড়া,
সাজিয়ে দিলাম ঘটের উপর সরা,
আমার মত আমায় ভাবতে চাও ?
বাকি আধেক তোমার হল, তাও !

আধেক জীবন কিছু চিত্রপট,
সাজিয়ে দিলাম সরার উপর ঘট।
ভাবনারেখার বাইরে যদি রাখো,
সে আধেকও তোমারি হল,দ্যাখো ।

আধেক জীবন অনেক কলরব
ঘট সরাতে আমেরই পল্লব । 
একলা শালিক দুপুর স্বরলিপি,
আধেক ঘুমের স্বপ্নে তোমার দাবি ?

আধেক জীবন পদ্মপাতার জল,
পূর্ণ ঘটে লক্ষ্মী অচঞ্চল।
নাইরে বেলা, দীর্ঘতর ছায়া।
আধেক আলো মিশেছে কোন মায়া।

আধেক জীবন ছড়িয়ে ইতস্তত, 
কুড়িয়ে ভরা ঘট সরাটি যত।
উপবাসের ফুরায় কবে ক্ষণ,
আধেক রূপের মুহূর্ত মোক্ষণ। 


কবিতাঃ ব্রতী মুখোপাধ্যায়












কবিতাঃ


রাত্রিপাঠ 
ব্রতী মুখোপাধ্যায় 


দ্বিচিন্তার চিহ্ন নেই, ছায়াটি বলল
বলল, কোন বালিকা চাইল সরণির নাম
বলল, ঠিকানা, একের ভেতরে তের, গণহত্যাপাড়া 
সামলে যাবেন, ছেঁড়াপালক, বাচ্চাদের, রক্ত লেগে আছে 
তা বাদে, দুধারে কাতার দিয়ে সোনাসোনা আকাশপ্রাসাদ,
কান্নাপাথরে গড়া, পাকাপোক্ত, অসাধারণ আলোঝলমল

এই নগরীর নাম আনন্দের গুহা
ওই দেখুন আসছেন 
আগে ডুম বাগে ডুম ঘোড়াডুম সাজে 
নাচউঠানে মোচ্ছব
দাক্ষিণ্য
দান 

বলেই ছায়াটি 
দোমড়ানো মোচড়ানো দৈনিকের টুকরো হয়ে গেল

কবিতাঃ সৌমিত্র চক্রবর্তী
















কবিতাঃ

অপেক্ষায় মানুষ হওয়ার
সৌমিত্র চক্রবর্তী 


দেখতে দেখতে দুপাশের জুলপি রঙ হারাচ্ছে, 
রাস্তার ধারের আগাছার দল
নিজেদের স্বাধীন সত্বা হারিয়ে
ঢেকেছে আজব ক্যামোফ্লেজড খোলসে,
দুদিকেই ঘাড় হেলিয়ে রেখে মেরুদণ্ড
বেঁকে ভাঙতে ভাঙতে সাপের হাড়
হয়ে গেছে এই ছেষট্টি বছরে,
তবুও হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে
নিশ্চিত দৃঢ়তায় বলতে পারিনা
আমিই এ প্ল্যানেটের শ্রেষ্ঠ জীব।
নিজেকেই বিভ্রান্ত করতে দুলে দুলে
লন্ঠনের ঘষা কালি পড়া আলোয়
নিবিড় আন্দাজে কেবল মুখস্থ করেছি
অন্ধকার যুগ শেষ হওয়ার মিথ্যে গালগল্প,
সুবিধেমত লালসার লম্বা জিভ
বার করে চেটেপুটে খেয়েছি রসালো
ঘটিগরম কেচ্ছাকাহিনী তৃপ্ত আবেগে,
ধুকপুক তখনো চলতে থাকা রক্তমাখা
অবয়ব সযত্নে দূর থেকে দেখে নিয়ে
সেদিনের এডভেঞ্চারাস গল্পমালা
দুহাতের তালুতে জড়ো করে নির্লিপ্ত
চলে গেছি, অস্থির হৃদয়পিন্ডকে জাহান্নামে
যেতে দিয়ে ধোপদুরস্ত পোষাক আড়ালে ;
দিন চলে গেছে বিকেলের হাত ধরে
রাত স্থায়ী হয়ে গেড়েছে মৌরসিপাট্টা,
বুক ফুলিয়ে বলতে পারিনা আর
কোনোদিনও মানুষ হব কি না!

কবিতাঃ রণদেব দাশগুপ্ত














কবিতাঃ


নীলকন্ঠ দুপুরের ব্যালাড 
রণদেব দাশগুপ্ত


অমৃতের বিপরীতে কূটকথা ছিল ;
এত তীব্র, এত তার ঝাঁঝ__
বুক পুড়ে গেছে, তবু
তার জন্য সকল আসন ।

অংশু তার সব অকরুণ
আমাকেই দিয়েছিল,
পাকে পাকে বেঁধেছিল
দেবতার ঘোর অবিশ্বাস ।

আজও সেই পিঠে বেঁধা ছুরি
অত্যন্ত গোপনীয় দেরাজে রেখেছি ।
যদি চাও, অনন্য জ্যোৎস্নায়
রক্তের পুরোনো দাগ
অশ্রুমতী জলে ধুয়ে দেবো ।

দুপুর আমাকে চেনে,
আমি চিনি অধরের রৌদ্রমাখা বিষ ;
নীলকন্ঠ ফুটে আছে__
প্রেম, তুই আমাকে চিনিস্ ?

কবিতাঃ সুজাতা ঘোষ





কবিতাঃ


আশা
সুজাতা ঘোষ


কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে চাও ভালোবাসার দাম? 
বোঝোনি তবে কি হতে পারে প্রেমের সংগ্রাম!
আমার মনের জানালার ধারে
চিল শকুনে ঝগড়া করে...
প্রতিদিন সেথা নতুন করে বেঁধে যেতে হয় বাসা
আর তুমি বল কি না ভুলে যেতে হবে বিদ্রোহ হতাশা?

রাতের আঁধারে রোজই যেখানে মরা পোড়ানোর ভিড় 
জানালার ধারে সেই শ্মশানে প্রেম কেন অস্থির? 
কবর দিয়েছি... পেতেছি সেখানে ভীষ্মের শরশয্যা
আজ বাজারে বিক্রী করছি নারী প্রজাতির লজ্জা! 
অনেক ক্রেতা বিক্রেতার দল করে আছে সেথা ভীড়।

তবু কেন আশা ঘুরে মরে আজও প্রেমে হয়ে অস্থির?

কবিতাঃ প্রিয়দীপ














কবিতাঃ


সমীপে ,পরমাধ্য !
প্রিয়দীপ


তন্ময়ে –
গণ্ডায় পাণ্ডায়, যত্র তত্র - আজ ছেয়ে যাওয়া শুয়োরের খামার 
হে’ তেত্রিশ কোটি দেবতা – হে’ ছেষট্টি কোটি কবি,
আর কতো সঙ হবে, কতো মুখে রঙ শেষ হবে 
দুর্বৃত্ত মানুষে, দুর্ভাগা দেশে - শুধু’ ই ওজনপ্রীতি’র ছবি।

বিস্ময়ে – 
সহিষ্ণুতা মানেই কি মৌনতা, অর্থ মানেই বুঝি শ্রম ধর্ষণ
যদি থাকতে ! হে পরমাধ্য - হে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, 
আমি নিশ্চিত – তুমি বুঝতে, মুদ্রাস্ফীতি থেকে মানবিক দংশন 
এবং গাইতে - টাকা’ই খাঁটি, মাটি’ই ঘাঁটি - জয় মীরজাফর জয় ঔরঙ্গজেব।

অকতুভয়ে -
মানুষে ! অনেক কিছুই আড়াল ঢাকি
সে সব ভালোবাসি অ গো চ রে - 
মানুষে ! হরেক বিষয় বহাল থাকি 
সে সব সর্বনাশি স হ চ রে। 

সমন্বয়ে -
মুখেই শুধু সাম্য – কপচানো সমান্তরাল মনুষ্যত্ব 
অথচ কি দিন, কি রাত - পুড়তে থাকি বিভেদ রেখায়, মৌলবাদে আধিপত্য ।
অতীত মানেই বুঝি প্রাচীন, বাণিজ্য করণে শুধুই ইতিহাস 
বর্তমান মানেই বুঝি নবীন, ভুলের সপ্তর্ষি মণ্ডল নির্ণয়ে বারো মাস । 

বিনয়ে - 
হে ঈশ্বর , হে বিশ্ব নবী, হে চর্চিত মানস কবি
নিছক’ই শব্দার্থে নয়, বরং বাণী প্রেরিত করো মর্মার্থে – 
যেখানে কটাক্ষ – যেখানে বিদ্রূপ, যেন মানুষে ত্যাগ বিনয়ের ভাবার্থ লিখি 
দুর্যোগে গাও, বইয়ে দাও - অনিন্দ্য ঊষাময়, নিঃসৃত সুধাময়, অভয় সান্নিধ্যে।

সবিনয়ে -
নিছক’ই জাতে ওঠা নয়, তাই লিঙ্গ মোহে তোয়াজ তো নয়’ই 
সমূহ নারী - প্রভুত পুরুষ, হোক মানুষ – অবজ্ঞা জ্বালাক বিবেক বোধে ,
বাড়ন্ত উপসর্গ নয় , এমন কি নয় জৈবিক জ্ঞাতার্থে - 
এ অস্তিত্ব, এ পেলব বন্ধন, হে পরমাধ্য কূল! করো দীক্ষিত মনুষ্যত্বে।