প্রবন্ধঃ অমলেন্দু চন্দ












প্রবন্ধঃ


রম্যতা রমণীয়তা ও রবীন্দ্রনাথের জীবনের রমণীরা
অমলেন্দু চন্দ


দেবেন্দ্রনাথ ও সারদা দেবীর চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অশিক্ষিতা ভবতারিনীর ১৮৮৩ সালে যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি দস্তুরমত লিখিয়ে পড়িয়ে বিলেতফেরত যুবক ও কবি । কথিত, তিনি তার বিয়ের বাসরে নিজেই নতুন পত্নী (বোধহয় তার বয়েস তখন নয়) কে উদ্দেশ্য করে গান গেয়েছিলেন। তাকে গান গাইতে প্রবুদ্ধ করেছিল নাকি তাঁর মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর মন্তব্য - তুমি থাকতে আর কে গান গাইবে। জ্ঞানদানন্দিনী উল্লিখিত এই ‘আর কে’ টা কার উপস্থিতির প্রতি আঙুল? কথিত যে, কাদম্বরী ভাল গায়িকা ছিলেন।

ভবতারিণী একদিন মৃণালিনী হয়ে গেলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর তত্ত্বাবধানে লোরেটো হাউসে পড়াশুনা করলেন, আদব কায়েদা শিখলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ হিসেবে নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে। উঠেছিলেন যে, তাতে কোনই সন্দেহই নেই। ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের মতই অভিনয় করেছেন, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রূপকথা সংগ্রহ করেছেন, অংশবিশেষ নিজেও লিখেছেন, রামায়ণ অনুবাদ করেছেন, আর তাঁর রান্না করার গল্প তো প্রবাদপ্রতিম, শোনা যায় এই রান্না প্রসঙ্গে যখন রবীন্দ্রনাথ তাকে খোঁচাতেন যে, দেখ তোমার রান্না আমি তোমাকে শিখতে বাধ্য করেছি বহুবার, তখন তিনি তার সহজ ভাষায় পাল্টা খোঁচা মেরেছেন যার সারমর্ম ছিল যে, তুমি তো জিতেই আছ, আমি আর জিতলাম কবে। 

মৃণালিনীর মৃত্যুর পর তার খাতা যেটুকু রথীন্দ্রনাথের কাছে পাওয়া গিয়েছিল, সেই খাতার রূপকথার গল্পের থেকেই নাকি অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল জন্ম নেয়। চিঠিপত্রের সূত্রে যা খুবই অল্প, বিশেষ যেখানে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বোধহয় শ’ তিনেক চিঠি লিখেছেন সেই তুলনায়; জানা যায় এই মৃণালিনী কে রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝেই সম্বোধন করেছেন ‘ভাই ছুটি’ বলে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত “ভাই ছুটি” থেকেছেন রবীন্দ্রনাথের পাশে। শান্তিনিকেতনে। উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সহধর্মিণীর ধর্ম পালন সাঙ্গ করতে করতে একদিন ফুরিয়ে গেলেন। সেটা ১৯০২ সাল। মৃণালিনী’র মৃত্যু’র এক বছর আগে তিনি শান্তিনিকেতনে তাঁর ব্রাহ্ম-মন্দির শুরু করেন, যেখানে মৃণালিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই তাদের মেয়ে রেনুকা মারা যায়। তারপর দেবেন্দ্রনাথ ১৯০৫, আদরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সাল। সেই মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই যেন সারা জীবন এক মৃত্যুর কার্নিভাল রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে অতিবাহিত হয়েছে। 

জীবনের দীর্ঘ প্রায় ষাঠ বা ততোধিক বছর ধরে শিল্পচর্চার মধ্যে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ কখনও শুধু শিল্পচর্চার জগতে বুঁদ হয়ে থাকেন নি। যে কোন অঙ্গীকারকেই মমতার সঙ্গে গ্রহন করেছেন, সে অঙ্গীকার প্রাতিষ্ঠানিক হোক বা নিজের কাছে হোক। পনের কি ষোল বছর বয়েসে জীবনানন্দ প্রথম কবিতা লিখে পাঠান রবীন্দ্রনাথের কাছে, কয়েকটি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ তখন বিশ্ববন্দিত কবি, নোবেল পেয়েছেন, নাইটহুড পেয়েছেন; তবু অচ্ছেদ্দা করেন নি এক তরুণের লেখার; পড়েছেন, তার পর তাকে একটা চিঠি লেখেন যেটা বহু জায়েগাতেই উল্লিখিত, এমন কি ক্লিন্টন সিলি’র বইতেও, যেটার কিছু বয়ান আজ বহুল পরিচিত –

“কল্যানীয়েষু,
তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাহাতে সন্দেহমাত্র নাই, কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন, বুঝতে পারি না। বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে। যেখানে তার ব্যঘাত দেখি, তাঁর সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে”। 

যেটা সবচাইতে লক্ষণীয় বিষয়, সেটা হল বিশ্ববরেণ্য কবি কিন্তু একটি তরুণের লেখাকে অবজ্ঞা করেন নি, পড়েছেন এবং পত্রালাপ করেছেন। এবং যা অনুভব করেছেন তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে কথা বলেছেন। এ সেই শিল্পের প্রতি - যে শিল্প তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত প্রেমের অঙ্গীকার - তাঁর নিজের অঙ্গীকার। সময়ানুগ ব্যখ্যা এবং চিঠিপত্র পড়লে জানা যায়, দ্বিতীয় চিঠি লেখেন এর প্রায় সাত বছর পরে, তখন ধুসর পাণ্ডুলিপি মুদ্রিত হয়েছে। এ চিঠির, না কি দু তিন লাইনের পত্র বলাই ভাল, ভাষায় ছিল স্বীকৃতির আর এক অভিব্যক্তি “তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে, তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে”। 

জীবনানন্দের কবিতায় মৃত্যুবোধ একটা দর্শনের মত ব্যপ্ত হয়ে আছে যা আমাদের কাছে পৌঁছয় এক অনবদ্য নিজস্ব রহস্যের মোড়কে। লক্ষণীয় হল রবীন্দ্রনাথের লেখায় মৃত্যুবোধের ভাব প্রকাশ আমরা আর এক ভিন্ন রূপের দর্শনে পাই। এ রূপের পেছনে তাঁর ভিক্টোরিয়ান মেজাজের কালচারের মধ্যে বড় হওয়া, পাশাপাশি ব্রাহ্ম মতের প্রভাব যে প্রভাবের মধ্যে বেদ ও উপনিষদের আত্মস্থ উত্তরাধিকার রয়েছে, আর তাঁর জীবনবোধ যেখানে প্রেম আর পূজা একাকার, তাঁর অ্যারিস্টোক্র্যাটিক লাইফ স্টাইল, সেই সব কিছুর প্রভাব রয়েছে ইন্ডিভিজুয়ালি সেই সব কিছুকেই ছাপিয়ে। আর এই অসীম কে ছুঁতে চাওয়ার ভাবাদর্শই রবীন্দ্রসঙ্গীতের মুল সুর। একটা আত্মনিবেদন।

মৃত্যু শোক সম্বন্ধে তার চিন্তা চেতনার শুরু বোধহয় তেইশ বছর বয়েসে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর। যদিও তার মা মারা যান তেরো বছর বয়েসে, কিন্তু বড় বৌঠান সর্বদাসুন্দরীর স্নেহ আর সে সময়ে কাদম্বরীর সখ্যতার আবহে তিনি টের পান নি মায়ের বিয়োগের কষ্ট। অনুভূতিতে বড় জোর একটা সেন্স অফ লস ছিল যে মা আর কোনদিন পূজোর ঘরের চেনা আসনটায় এসে বসবেন না। অন্যান্যদের, যেমন জ্যেষ্ঠা বউ ঠাকুরানির মৃত্যু, যে সর্বদাসুন্দরীর কাছে তিনি থাকতেন তাঁর মা মারা যাওয়ার পর, সেই সর্বদাসুন্দরীর মৃত্যুও তাকে সেভাবে নাড়া দেয়নি। কিন্তু কাদম্বরীর (নতুন বৌ) মৃত্যু, তাঁর নিজের বিয়ের কয়েক মাস পরেই, তাঁর বহুমাত্রিক দেখার দুনিয়াকে তাঁর তেইশ বছরের মন আর মনন কে মৃত্যু চেনায় স্থায়ী ভাবে। যে ভাব একটা পর্যায়ের পর একটা দর্শন হয়ে যায়। এর মধ্যে অবশ্যই আরও অনেক মৃত্যুর মিছিল তাকে নাড়িয়েছে।

কাদম্বরী দেবীর ঠাকুর বাড়িতে আসার আগের নাম ছিল মাতঙ্গিনি, তখন তাঁর বয়েস ন’ বছর, আর রবির সাত। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় হি ওয়াজ হার প্লেমেট অ্যান্ড কম্প্যানিয়ন এভার সিন্স হার ম্যারেজ। কাদম্বরীর আত্মহত্যা - মৃত্যু কে নতুন ভাবে দেখতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কবি অমিয় চক্রবর্তীর বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাকে যে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার থেকে বোঝা যায় তিনি কাদম্বরীর মৃত্যুতে কতটা বিয়োগ ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। হয়ত এই বিচ্ছেদ ব্যথার থেকেই উঠে এসেছিল সেই গান – তবু মনে রেখ।

তিনি লেখেন “এক সময়ে যখন আমার বয়েস তোমার মতই ছিল আমি যে নিদারুণ শোক পেয়েছিলাম সেও ঠিক তোমারই মত। আমার যে পরমাত্মীয় আত্মহত্যা করে মরেন, তাঁর আকস্মিক মৃত্যু তে আমার জগত শূণ্য হয়ে গিয়েছিল...সে প্রচন্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করেছিল” -অবশ্য এই চিঠি লেখার সময় আর কাদম্বরীর মৃত্যুর মধ্যে তিরিশ বছরেরও বেশী ব্যবধান রয়েছে।

কাদম্বরী দেবী এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মধ্যের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনামূলক কথা রয়েছে, সেগুলকে বাদ দিয়েই এটা মেনে নিতে হয় যে, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌ ঠাকুরবাড়িতে বিশেষ, সম্ভবত মহিলা মহলে খুব সম্মান পান নি, মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন বিলেত ফেরত, সে যুগের অতি আধুনিকা এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন এই আধুনিকার ভক্ত কিছুটা হয়ত মোহগ্রস্ত। এছাড়া অনেক পরে কথিত যে নাটক করতে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র বিনোদিনীর মধ্যে – সেসময়ের খ্যাতনামা নটী বিনোদিনী – একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। এর সাথে হয়ত নিঃসন্তান হওয়ার দায়ভাগ সে সময়ের নিয়মে সবটুকুই কাদম্বরীর কপালে জুটেছিল, আজও হয়। 

যে চিত্রটা জলরঙের স্বচ্ছতোয়া অনুভব কে স্পষ্ট করে তা হল এই রকম আবহাওয়ার পরিসরে দুটি সমবয়েসী প্রাণী আস্তে আস্তে সমমনস্ক তারুণ্য পেরিয়ে যুবক যুবতী হয়ে যায়। কোন আনুষ্ঠানিক মাপকাঠি ছাড়াই কাদম্বরী হয়ে ওঠেন কিশোর আর তরুণ রবির সাহিত্য-সঙ্গিনী। 

এই সময়েই যখন রবিকে বিলেত পাঠানোর বন্দোবস্ত হল, তখন রবির বোধহয় সতের আঠেরো বছর বয়েস। দেবেন্দ্রনাথ চাইলেন তাকে খানিকটা ইংরেজ করে তুলতে। সে সময়ে কিছুদিন মুম্বাইতে এক পরিবারে অতিথি হয়ে থাকেন রবি। আত্মারাম পান্ডুরঙের তিন কন্যা ছিল। জীবনে সম্ভবত এই প্রথম রবি বাবু পরিবারের বাইরে এবং কাদম্বরীকে ছাড়া কোন মেয়েদের সম্পর্কে আসেন এক জায়গায় থাকার এবং মেশার সুবাদে। 

পান্ডুরঙ সাহেবের কন্যারা বিলেত ফেরত সুশিক্ষিতা অ্যাকমপ্লিসড মেয়ে। এদের একজনের সঙ্গে তাঁর সখ্যতার সুবাদে পরে আমরা তাঁর লেখার নলিনী কে পাই। এ নিয়ে বহু বছর পরে আলাপচারিতায় অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে তিনি অনেক কথা বলেন, ততদিনে হয়ত আরও বছর পঁয়েতাল্লিশ কি আরও বেশী সময় চলে গেছে। সেই আলাপচারিতায় একটা জিনিষ স্পষ্ট হয়, সেই উঠতি যুবক বয়েসের দেখা আর মেলামেশার আনার সঙ্গ কে তিনি চিরকাল কোথাও তাঁর অন্তরে লালন করে গেছেন। এই ক্ষমতাটার মূলে কি কোন অংশেই কাদম্বরীর কাছ থেকে পাওয়া সখ্যতার দানে লালিত জীবনবোধের ঋণ ছিল না – কে বলবে। 

অবদানের প্রসঙ্গেই আরও একটা কথা এসে পড়ে। লন্ডনে তিনি থাকতেন এক ডাক্তার, জন স্কটের বাড়িতে। সেই জন স্কটের দুই কন্যার একজন ছিলেন লুসি। যা হওয়া স্বাভাবিক, সুদর্শন চেহারায় পুরোপুরি অ্যারিয়ান রবির প্রতি আকর্ষণ এবং ফলশ্রুতি লুসি’র সঙ্গে একধরনের সখ্যতার সুবাদে তিনি তাকে বাংলা ভাষা শেখাতে শুরু করেন। আর এই পর্বেই বোধহয় তাঁর নজরে আসে যে, শব্দবোধ আর উচ্চারণ সব সময়ে সোজা পথে হাঁটেনা। ভাষাতত্ত্বের ব্যপারে এই সমস্ত চিন্তার থেকেই তিনি প্রথম বোধহয় ভাবতে আরম্ভ করেন বর্ণনামুলক ব্যাকরণের কথা। নিশ্চিভাবে এইখানে রোপিত হয়েছিল “শব্দতত্ত্বের” বীজ। তাহলে কি এটা দাঁড়ায় যে, বিদেশিনীর প্রতি এক সখ্যতার অঙ্গীকার থেকে তিনি উঠে আসেন এমন এক চিন্তা চেতনার বিচরণক্ষেত্রে, যার সুবাদে ভাষা সম্পদশালী হয়ে ওঠে তাঁর সেই চিন্তা ভাবনার ফসলে। তাহলে বাংলা ভাষার ব্যাকরণবোধের জ্ঞান কি ঋণী নয় কিশোরী লুসির প্রেমের কাছে – কি বলেন।

জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। পরে যখন ইংল্যান্ডে আবার যান পরিণত বয়েসে, তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন সেই স্কট পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের। পারেন নি, কারণ স্কট পরিবার সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। একটা সেন্স অফ লস তখন কাজ করেছিল যার, রিফ্লেক্সান কিছু লেখায় পাওয়া যায়।

রবি ফিরে এলেন দেশে, ১৮৮০ সালে এবং সেই প্রচলিত বিশ্বাসের অনুষঙ্গে আমরা যেমন ভাবতে চাই – তাঁর বৌঠান কাদম্বরীর সখ্যতার কাছে, কিন্তু কাদম্বরী কি অনুভব করেছিলেন রবির দিগন্তে আরও কয়েকজন ঘুরে ফিরে গিয়েছেন। ভাবতে ভাল লাগে যে, এই রকম অবস্থা আর অনুভবের দুনিয়ায় হয়ত তিনি গেঁথেছেন সেই অনবদ্য কথার মালা – দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী আকাশে জল ঝরে অনিবার, জগতে কেহ যেন নাহি আর। সেই ১৮৮০ তেই তিনি ফিরে এসেই লিখলেন “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” – আমার ধারণা যদিও প্রচলিত বিশ্বাস যে এটি কাদম্বরী দেবীকে উদ্দিষ্ট করে লেখা – আমার ধারণা এই প্রেমের প্রকাশ হয়ত কাদম্বরী কে আরও ভাবিয়ে ছিল যে, বিলেতফেরত রবি ঠিক আগের রবি নেই। প্রেমের অনুষঙ্গে সে রমনীকে ছাপিয়ে প্রেম কে অনুভবে পেতে শিখেছে। হয়ত সেই রম্যতার রমণীয়তা রবিকে আরও মোহন করে তুলেছিল।

রবিঠাকুরের রেখে যাওয়া যে রিচ হেরিটেজের কথায় আমরা আজও অভিভূত হয়ে পড়ি, যেখানে সেই প্রেম আর পূজার কোন ভেদ নেই, প্রেমই পূজায় নিঃস্বণ, আবার পূজাই প্রেম হয়ে ধরা দেয় যে আবহে, সেই আবহের সম্পাদনে এদের ঋণ কতটা, তার কোন মূল্যায়ন সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় সারা জীবন ধরে তাঁর জীবনে আসা যাওয়া করা – স্বীকৃত পরিচিত ভাবানুষঙ্গের বিনিময়ের বাইরে অর্থাৎ ইন্দিরা দেবী, রানু বা সেই বিদেশিনী এনাদের ছাড়াও - রমণীয়তার আদান প্রদানে অসংখ্য নারীর ভুমিকার মূল্যায়ণ। হয়ত এই ঋণ স্বীকারের ভাষা হয়ে উঠেছিল সেই গানঃ
শুধায়োনা কবে কোন গান কাহারে করিয়াছিনু দান

কাদম্বরী তাঁর অনুভূতির জগতে কতটা ছিলেন, তাঁর অংশবিশেষ ভারতীতে ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত একটি লেখা সেই স্বাক্ষর বহন করে – 

“সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি, সেই অশ্রুসিক্ত আমার প্রানের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে। সে যে আমার খাতায় আমার 
কবিতার পার্শ্বে হিজ বিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটি দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সেই অর্থপূর্ণ হিজি বিজি ছাপা হইল না, আমার রচিত কতগুলি অর্থহীন হিজি বিজি ছাপা হইয়া গেল...”

কথিত এই সময়ে তারা দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে রবি’র জ্যোতি দাদাও ছিলেন। এটা কি খুব কো ইন্সিডেন্ট্যাল যে এই ১৮৮৩ সালেই কয়েক মাস পরেই ভবতারিণীর সঙ্গে রবির বিয়ে হয়। ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন।

এবং বিচিত্র কিছু তত্ত্ব প্রচলিত যে, ভবতারিণী কে পছন্দ করার ব্যপারে নাকি জ্ঞানদানন্দিনীর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সেটাও কি মহিলা মহলের সেই অন্তঃপুর ঘটিত কিছু বিসম্বাদের ফসল – কে বলবে। বিলেতফেরত মেজ বৌঠান স্বল্পশিক্ষিতা শ্যামলা মাতঙ্গিনীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন হয়ত – জ্যোতি তাঁর ভক্ত ছিলেন, রবি নয়। অথচ ঠাকুর পরিবারের অন্যতম রত্ন যার সখ্যতার কাছে হার মেনে বসে ছিল সে ছিল মাতঙ্গিনী, হয়ত এটা জ্ঞানদানন্দিনী কে ক্ষুব্ধ করেই রেখেছে আজীবন – আর তাই হয়ত অদ্ভূত কোন শোধ নেওয়ার জন্যেই কি তিনি ভবতারিণীকে পছন্দ করেছিলেন – কে বলবে। 

যে কথা বলে শুরুর একটি মন্তব্য, যে শুধু শিল্পচর্চার মধ্যেই তিনি বুঁদ হয়ে থাকেন নি, নিজের বোধ বিশ্বাসের জমিনে তৈরি হওয়া অনেক কিছুর মধ্যেই দেশের কথা, পল্লীর উন্নয়ণের কথা তিনি দায়িত্বের সঙ্গে লালন করেছেন, একটা ধর্ম হিসেবে তাকে পালন করেছেন; রথীন্দ্রনাথ কে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যাশিক্ষার জন্য, শুরু করেন “পল্লী সংগঠন কেন্দ্র”, গ্রহণ করেন এল্মহারস্টের সাহায্যের বাড়িয়ে দেওয়া হাত, যে সংগঠনের নাম পড়ে বদলে গিয়ে হয় শ্রীনিকেতন, এবং পাশাপাশি বোধহয় এগিয়ে চলে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম শৈল্পিক অধ্যায় – যেমন সম্ভবত তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা ও চিত্রাঙ্গদা এই পর্যায়ের রচনা, তাঁর দেশাত্মবোধের রচনা চার অধ্যায় এই পর্যায়ের সৃষ্টি। তাঁর শ্রেষ্ঠতম গদ্যকাব্য পুনশ্চ শ্যামলী ও শেষ সপ্তক এই পর্যায়ে সঙ্কলিত ও প্রকাশিত হয়। শেষের কবিতা এই পর্যায়ের রচনা। বয়েস তখন তাঁর আটষট্টি। 

প্রেমের কবি প্রেমিক কবির জীবনবোধের শুদ্ধতম রস হয়ত অমিতের বাচালতার সূত্রে সংলাপিত – মানুষের মৃত্যুর পর তার জীবনী লেখা হয়, তার কারণ একদিকে সে সংসারে মরে, আর আরেকদিকে সে বেঁচে ওঠে নিবিড় ভাবে মানুষের মনে। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে – মাইকেল, বিহারীলালদের শিল্প সাহিত্য চেতনার বোধের অনুষঙ্গে পথ শুরু করা রবি মাইকেলের কথা কে মিথ্যে করে দিয়ে গেছেন – তাঁর অমরতার সুত্রে আর শেষের কবিতার অমিতের বাখানে – নিবিড় ভাবে বেঁচে থেকে, মানুষের মনে।

রবি যেন সারা জীবন তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের ভাষায় সব রহস্যসন্ধানীদের বলে গেলেন এরকম কিছু (স্বরচিত) – শুধায়োনা এত সুখ কোথা পেলে, কোথা থেকে পেলে – তিনি নিজেই হয়ত সবটুকু ঠিক করে উঠতে পারেন নি। ১৯৪১ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি যে লেখাটি লেখেন তাতে যেন এক সংশয়ের ছোঁয়া পাওয়া যায় –


তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী,
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাদ ফেঁদেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে,
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত
তাঁর তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।


তিনি কি সংশয়ী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অন্তরের অদ্ভূত নিঃসঙ্গতা নিয়ে। জানি না, জানতে চাই না – তাই বলি শুধায়োনা – আর শুধায়োনা।


1 মতামত: