বিশেষ প্রতিবেদনঃ চিলেকোঠার বৈঠক















বিশেষ প্রতিবেদনঃ


চিলেকোঠার বৈঠক


বাংলা নববর্ষ, ১৪২১; ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪; চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের মুকুটে সংযোজিত হোল আরও একটি নতুন পালক। শুরু হোল মাসিক সাহিত্য আড্ডা, চিলেকোঠার বৈঠক। 

সেদিন কাশীপুর রোডে আমাদের এক অত্যন্ত প্রিয় সদস্য, কবিবন্ধু সুব্রত পালের বাড়িতে বসেছিলো বৈঠকের প্রথম আড্ডা। অনুষ্ঠানের আদ্য পুরোহিত ছিলেন বর্ষিয়ান সাহিত্যপ্রেমী, প্রথিতযশা স্বনামধন্য ব্লগার, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। প্রদীপ জ্বালিয়ে তিনি শুভ সূচনা করলেন বৈঠকের। সমবেত মাঙ্গলিক সঙ্গীতের পর বৈঠকের শুরুতেই সাবলীল ভঙ্গীতে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ততায় সঞ্চালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক শেখর রায়। 

আলোচনার সূচনায় শ্রী রায় একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সূত্র তুলে ধরেন। সভার কাছে প্রশ্ন রাখেন, আধুনিক কবি কে? রবীন্দ্রনাথকে কি আধুনিক বলা যায়? উত্তরে দেবাশিষ কাঞ্জিলাল সুন্দর ভাবে সংস্থাপন করেন তাঁর মত। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ কালোত্তীর্ণ, আর তাই তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং চরম আধুনিক; আসলে রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর সময়ের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। 

আলোচনাসূত্রে বৈজয়ন্ত রাহার সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই ‘না বলা কথার বাঁকে’ থেকে কবি পাঠ করলেন ‘হাত ঘোরালেই স্রোত’ । সুকন্ঠের অধিকারী বৈজয়ন্তর পাঠ গুনে কবিতাটি এক অন্য মাত্রা পেল। আর তখনই, প্রাসঙ্গিক ভাবেই সভার আলোচনার অভিমুখ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হোল; প্রশ্ন উঠলো, কবিতা পাঠ আর আবৃত্তি কি একই প্রক্রিয়ার ভিন্ন নাম? 

আসলে কবি নিজে যখন স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন, তখন কবিতার অন্তর্নিহিত মর্ম সপ্রকাশ হয় অবলীলায়; আর বাচিক শিল্পীর আবৃত্তিতে কবিতা হৃদয়গ্রাহীতা লাভ করে অন্য এক মাত্রায়, সেখানে মিশে থাকে আবৃত্তিকারের নিজস্ব অনুভূতিও - অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। আলোচনা হয় পাঠযোগ্য কবিতা ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতার সৃষ্টি এবং বৈষম্য নিয়েও। সভার আলোচনা স্বতঃস্ফূর্ততা পায়, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে দুরন্ত ঝর্ণার বেগে তরতরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে বৈঠক। 

রামমোহন থেকে শুরু রবীন্দ্রনাথে শেষ – তারপর ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’। ১৯৩০-এ বুদ্ধদেব বসুর আগে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য কুমার, বিষ্ণু দে; রবীন্দ্র-পরবর্তী ৪০-এর দশকের সাহিত্যে মানুষের কথা, মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা, তার দৈনন্দিন জীবন চর্যার কথা। তারপর যুদ্ধবিরোধী সাহিত্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ৭০/৮০-র দশকের সাহিত্যে বিশ্বায়ন। মাঝে হাংরি মুভমেন্ট, কৃত্তিবাস যুগ বাদ পড়ে গেলো কি!!! আসলে সময়কে ধারণ করেই আধুনিকতা। 

এক সময় কবিতা থেকে গান তৈরী হয়েছে। পরে গীতিকার গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে গান তৈরীর স্বার্থে। আবার সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্রের জন্য লেখা গল্প – এও এক প্রাসঙ্গিক আলোচনা। 

এরই মাঝে একাধারে কবি ও সুকন্ঠী গায়ক তন্ময় গুপ্তের গলায় ‘শুধু যাওয়া আসা’ আর ‘দিবস রজনী আমি যেন কার’ – পরিবেশে এক অন্য মাত্রা সংযোজন করে। এরপর আসরকে কমিক রিলিফ দিলেন নারায়ণ রায়। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র পটাই বাবু – স্ট্রং স্যাটায়ার; সমাজের সমস্ত বিচ্যুতির প্রতিই তাঁর আঘাত। লেখক কন্ঠে শোনা হলো অপ্রকাশিত, এমনকি অলিখিত এমনই এক পটাই বাবু কাহিনী। প্রসঙ্গত দেবাশিষ কাঞ্জিলাল শোনালেন তলস্তয়ের এক বিখ্যাত গল্প। সুলেখক ডঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য অবশ্য সোজাসাপটা। তাঁর মতে, যে সাহিত্য জীবন থেকে রস গ্রহণ করেই সৃষ্টি হয়, তা যেন সহজবোধ্য হয়। সাহিত্যিকের ভাবনা যেন অধিকতর পাঠককে একই সঙ্গে স্পর্শ করতে পারে, তবেই তা রসোত্তীর্ণতা লাভ করবে। 

এর পর বাচিক শিল্পী বন্ধু তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাত্ত গুরু গম্ভীর বাচন ভঙ্গীমায় শোনা হলো বাংলাদেশী কবি আবু জাফর অবায়দুল্লাহ রচিত কবিতা ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ । আহা, এতো শুধু আবৃত্তি নয়, এ এক পরম অনুভূতির উপলব্ধি !!

এরই রেশ টেনে জয়তি গুপ্তের আবৃত্তি – ‘মাগো, রাজার দুলাল যাবে আমার’ – শুভক্ষণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। - পরিবেশকে মায়াময় করে তোলে। সমানতালে চলতে থাকে কবিতা পাঠও। তন্ময় গুপ্তের ফেসবুকিও কবিতা – ‘সঙ্গীকলম’, সুব্রত পালের ‘বর্ষবরণ তোমাকে নিয়ে’। সুরেলা সুকন্ঠী মিসমি রায় বণিক ও শুভা ঘোষের সুমিষ্ট গান, সঙ্গে জলযোগ। এরই মধ্যে চিলেকোঠা ওয়েবজিনের বিষয়ে দু-চার কথা বলে নিলেন সুস্মিতা সিং। 

এর পরেই দেবাশিষ মিত্র পাঠ করে শোনালেন বনফুলের বিখ্যাত ছোটগল্প – ‘দর্জি’। দেবাশিষের বাচনভঙ্গী বড় মনোগ্রাহী। এখনও কিন্তু সভার সেরা আবিষ্কারটি বাকি ছিলো। সুহৃদ সুব্রত পালকে আমরা সবাই কবি বলেই চিনি, কিন্তু তিনি যে এমন অপূর্ব লোক সঙ্গীত গাইতে পারেন, তা জানা ছিল না। জয়তি গুপ্তের গানের পর আমরা শুনলাম তুসিমা ভট্টাচার্যের গলায় অসাধারণ দুটি গান। 

এবার আমরা প্রায় সভার শেষ পর্বে। সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে শেখর রায় শোনালেন অত্যন্ত কালানুগ একটি স্বরচিত কবিতা – ‘আন্তর্জাতিক ২৬শে ডিসেম্বর, বাগুইহাটি’। বিশ্বায়ন থেকে উৎসে ফেরা – অপূর্ব সাবলীল ভঙ্গীতে ও অনুভূতিতে তিনি ধরেছেন তাঁর মাত্র কয়েক ছত্রের ছোট্ট এই কবিতাটিতে। 

দেবাশিষের কাঞ্জিলালের দুটি কবিতা আর বৈঠকের শেষ সংযোজনা স্বনামধন্যা আবৃত্তিকার বৃষ্টি সাহার কণ্ঠে দুটি অপূর্ব কবিতা আবৃত্তি শোনার পর প্রথম বৈঠকের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করলেন চিলেকোঠা ফেসবুক পরিবারের অন্যতম এড্‌মিন অলোক চৌধুরী। অতিথিবৎসল কবিবন্ধু সুব্রত পাল ও কবিপত্নীর আন্তরিক আথিথেয়তা বৈঠককে পরিপূর্ণতা দান করল, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। 


কত অতৃপ্তি, কত না বলা কথা রয়ে গেল, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে ৭টা ৩০মি। স্বস্তির কথা, সমাপ্তি তো শুধুই সমাপ্তি নয়, আগামী সূচনার সুত্রপাত। তাই, পরের বৈঠকে আবার দেখা হবে – এই অঙ্গীকার নিয়ে সে দিনের মতো যে যার ঘরমুখী। সঙ্গী হোল এক অসাধারণ পয়লা বৈশাখী সন্ধ্যার স্মৃতি আর বন্ধুদের ক্যামেরায় ও মুঠোফোনে বন্দী কিছু ফটোমুহূর্ত। এখন শুধু চিলেকোঠার বৈঠক দিনে দিনে শ্রীমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ হোক – এই কামনা নিয়ে আগামী বৈঠকের প্রতীক্ষা ।।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন