সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা

সম্পাদকীয়




শীতের বনে কোন্‌ সে কঠিন আসবে বলে – সবাই প্রস্তুত; তবুও, তেমন শীত আজকাল আর পড়ে কই!! শীত মানেই কন্‌কনে উত্তুরে হাওয়া, রোদ পোহানো দুপুর, মায়ের হাতে উল-কাঁটা, রোদে দেওয়া লেপ-কম্বল, নতুন গুড়ের মোয়া, কমলালেবু, পুলি-পিঠে, রসবড়া, আউনি-বাউনি, আরও কতো কি!! আমার মেয়েবেলার এই শীতের স্মৃতি আজ অনেকটাই ঝাপসা। এখনকার শীত অন্যরকম, তবে বৈচিত্রের অভাব নেই।

শীতের শুরু পৌষ মাস, বাংলা সনের নবম এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দশম মাস। পৌষ নামটি এসেছে পূষ্যা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে।

পৌষ মাস মেলা আর উৎসবের মাস। এ মাসে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিখ্যাত মেলা দুটি হলো শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা আর বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামের জয়দেব মেলা। পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই এই দিনটি মকর সংক্রান্তি নামেও বিশেষ বিখ্যাত। ঐ দিন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার সাগর দ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যস্নান ও বিরাট মেলার মধ্যে দিয়ে উদ্‌যাপিত হয় সাগর মেলা। আর এমাসের উল্লেখযোগ্য উৎসব বলতে নতুন শস্য তোলার উৎসব, নবান্ন আর পৌষ সংক্রান্তিতে পৌষপার্বণ, বাঙালী রসনার তৃপ্তি সাধনে পিঠেপুলির উৎসব।

বাংলাদেশের পুরানো ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন নামে বিখ্যাত। এই দিন এখানে পালিত হয় ঘুড়ি উৎসব নামে অতি প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। কথিত আছে, ১৭৪০ সালে নবাব নাজিম মহম্মদ খাঁ এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই ঘুড়ি উৎসব পশ্চিম ভারতের গুজরাটেও পালিত হয়। সেখানে মানুষ সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা ও আকুতি প্রেরণ করেন।

পৌষের এই উৎসব মুখরতার আমেজ নিয়ে প্রকাশিত হলো চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা। এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ বিখ্যাত প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার, মিহির বসু-র একেবারে অন্য ধরনের একটি সাক্ষাৎকার। আর থাকছে আমাদের বিশেষ বিভাগ, “কোলাঘাটে কোলাহল”; এতে পাবেন, গত ১লা ডিসেম্বর, ২০১৩-য় চিলেকোঠার সদস্যদের কোলাঘাট ভ্রমণের ছবি ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কিছু লেখা। সংযোজিত হোলো নতুন বিতর্ক বিভাগঃ “চিলেকোঠা সরগরম”। এছাড়া থাকছে প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, একটি একাঙ্ক নাটক, রম্য রচনা, অনুগল্প, ছোটগল্প, দুটি নতুন ধারাবাহিক, সম্পর্ক নিয়ে লেখা একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, ইত্যাদি। আর, ছোটোদের পাতা, ভ্রমন কাহিনী, রান্নাঘরের মতো নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে।

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আপনাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকাটির মানোন্নয়ণে সহায়তা করবে।

জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।।


নমস্কারান্তে,

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

সাক্ষাৎকার - শেখর রায়

বিশেষ সাক্ষাৎকারঃ
মিহির বসু-র মুখোমুখি শেখর রায়




“একদিন ধীরেন দে বলেছিলেন, ঘটীর ছেলে হয়ে ইস্ট বেঙ্গলে খেললে, যাও গঙ্গায় স্নান করে এসো, মোহনবাগানে সই করো ...”
- সেদিন সন্ধ্যায় স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার, মিহির বসু, উঁকি দিলেন শেখর রায় ।

বসিরহাটের গ্রামের ছেলে, দশ ভাই বোন, তবুও বাবার শাসন ছিল প্রচণ্ড। সারা দুপুর ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাঙত বাবার মার খেয়ে। আমি পড়াশুনো না করে ফুটবল খেলি, বাবা পছন্দ করতেন না। মার খেয়ে বলতাম, আজ খেলি নি। বাবা তখন দেশলাই কাঠিতে তুলো জড়িয়ে আমার দুই কানে ঢুকিয়ে দিতেন। যথারীতি, তুলোতে কাদা মাটি লেগে যেত, শুরু হতো আবার মার, মিথ্যে বলার জন্য। ফুটবল কিন্তু ছাড়ি নি।

১৯৭৩ সাল। কোলকাতায় এলাম পোর্ট ট্রাস্ট-এর হয়ে খেলতে। অভাবের সংসার, একটা চাকরী জরুরি। ১৯৭৪-এ বি এন আর -এ সই করলাম। ৩০০ টাকার চাকরী হোলো রেলে। বসিরহাট-কোলকাতা রেলে যাই আসি। কোলকাতার মাঠে খেলছি, অল্প অল্প নাম ডাক হচ্ছে। এক ছুটির দিনে গ্রামের মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলছি। ধুলো উড়িয়ে দুটো গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কারা যেনও আমার খোঁজ করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি ইস্টবেঙ্গলের জীবন, পল্টূ আরও অনেকে। আমাকে বাড়ি যেতে বলল। বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বাড়িতে এলাম, ওরাও এলো। বাবাকে বলল, মিহির কে কলকাতায় নিয়ে যাবো, ওকে ইস্ট বেঙ্গলে খেলতে হবে। আমি বললাম, তবেতো রেলের চাকরী যাবে, সংসার চলবে কি করে! ওরা ব্যাঙ্কের চাকরীর কথা বলে একরকম আমাকে তুলে নিয়ে গেল সেদিন। শিয়ালদার একটা হোটেলে ৫ দিন বন্দি ছিলাম। সাথে ভাস্কর গাঙ্গুলি আরও অনেকে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেললাম। জীবনের প্রথম ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ। ৭ জুলাই, ১৯৭৭। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গোল করলাম। সমর্থকদের মুখে মুখে আমার নাম। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা এক সুরে গাইতে লাগলো, হাবিব নাচে, উল্গা নাচে, পি কে বাজায় ঢোল / দেখবি যদি আয়রে তোরা মিহির বোসের গোল । চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি সেদিন। সেদিন বসিরহাটের বাড়িতে ঢুকতেই ছোট ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যে কটা দিন বাড়িতে ছিলাম, ভাই ঘরে ফেরেনি। আসলে আমার বাড়ির সবাই, এমনকি, আমিও ছিলাম মোহনবাগানের অন্ধ সমর্থক।

১৯৮০ তে মোহনবাগানে এলাম। ধীরেন দে বলেছিলেন, ঘটীর ছেলে হয়ে ইস্টবেঙ্গলে খেললে, যাও গঙ্গায় স্নান করে এসো, মোহনবাগানে সই করো। ১৯৮০-৮১, মাঝে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ ফিরেছিলাম ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৮৫ তে আবার মোহনবাগানে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ খেললাম মোহামেডানের হয়ে। এই আমার দীর্ঘ ১২ বছরের কোলকাতার মাঠে খেলা । জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল । দুবাই, রাশিয়া, নর্থ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে ভারতের হয়ে খেলেছি। খেলেছি সন্তোষ ট্রফি, ডুড়াণ্ড, ডি সি এম, আইএফএ শিল্ড, নেহেরু কাপ... । ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, কোলকাতায় সেদিন প্রথম জহরলাল নেহেরু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ম্যাচে চীনের কাছে আমরা প্রথমার্ধে ০-১ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আমরা পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি মাঠ ছেড়ে গিয়েছিলেন ব্রিগেডের এক সভা তে। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, গোলটা শোধ হলে তাঁকে যেন জানানো হয়। দ্বিতীয়ার্ধে আমি গোলটা শোধ করেছিলাম। ইডেনের গগনভেদী উল্লাস পৌঁছে ছিল ব্রিগেডে তাঁর কানে। সেই মুহূর্তে তিনিও উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেন নি। বলেছিলেন, আমরাও পারি। আমরা কারো থেকে পিছিয়ে নেই।

ফুটবল খেলোয়াড়রা চিরকালই মেয়েদের পছন্দের হয়। অনেক মেয়ে আমাকেও প্রেম নিবেদন করতে চাইতো। একদিন বিকেলে ইস্টবেঙ্গল মাঠের বাইরে গোখেলে পড়া একটি মেয়ে আমার সাথে আলাপ করলো। অফিসের ঠিকানা চাইল। দিলাম। সেই শুরু, প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে আমরা দেখা করতাম চিড়িয়াখানায়। সে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমার ঘাড়ে তখন সংসারের জোয়াল। ভাইদের দাঁড় করাতে হবে, বোনদের বিয়ে দিতে হবে। নিজের সংসার আজও আমার করা হল না।

বসিরহাটে আমার ফুটবল গুরু ছিলেন শ্রদ্ধেয় রবীন সেনগুপ্ত। ওনার প্রেরণা আর শিক্ষায় আমি আজকের মিহির বসু। পরবর্তীতে কোচ হিসেবে পেয়েছি অনেককে, তাদের মধ্যে প্রিয় অমল দত্ত, অরুন ঘোষ। ঘটী বাড়ীর ছেলে হয়েও আমার প্রিয় ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মধ্যে যে আবেগ আমি দেখেছি, অন্য ক্লাব-এর সমর্থকদের মধ্যে আমি তা খুঁজে পাই নি।

খেলার মাঠের সমর্থকরা খেলোয়াড়দের কাছে অনন্য অনুপ্রেরণা। ওঁদের উল্লাস, ওঁদের ভালবাসা, ওঁদের ধিক্কার খেলোয়াড়দের কাছে ভগবানের আশীর্বাদ। আমাদের সময় সমর্থকরা তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড়দের নিয়ে ছড়া বানাতেন, আজ যা বিরল। মোহনবাগানের হয়ে খেলার সময় আমি গোল করলেই মোহনবাগান সমর্থকরা চিৎকার করে মাঠ কাঁপাতেন, সুরে গাইতেন, ২১ নম্বর জার্সি তাকেই শোভা পায়, আমাদের মিহির দা যেন কোনোদিন মোহনবাগান ছেড়ে না যায় ।

ফুটবলের জন্যেই সব দিয়েছি, যা কিছু পেয়েছি তা ফুটবালের জন্যেই। আজ একটা কথাই বার বার মনে হয়, ভূমি পুত্র যদি না তৈরি হয়, ভারতবর্ষের ফুটবলে বাংলার আধিপত্য কায়েম হবে না।

বিতর্ক বিভাগ - চিলেকোঠা সরগরম

এই সংখ্যার বিষয়ঃ
সমকামিতা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী

(বিশেষ সূচনাঃ এই বিভাগে প্রকাশিত প্রতিটি মন্তব্য অংশগ্রহণকারীর একান্তই নিজস্ব মতামত, এ বিষয়ে চিলেকোঠা অয়েবজিন কোনোভাবে দায়ী নয়)



পক্ষেঃ


১) রূমনি সেন

সমকামিতা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ঘটনা-


সমকামিতা হল এক অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক,অনুচিত মানবাধিকার বিরোধী কাজ। দুঃখের বিষয় এটা উচিত কি অনুচিত এ নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন,এমনই এক সমাজে আমরা বাস করি যেখানে আকাশ নীল, গাছের পাতা সবুজ, জল তরল এবং নীচের দিকে যায় ইত্যাদি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়েও বহুপাক্ষিক আলোচনার প্রয়োজন হয়।

দুটি পুরুষ পরস্পরের সাথে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক করতে পারে না, প্রাকৃতিক কারনে। প্রকৃতির নিষেধ আছে বলে কোন পশুপাখি সমলিঙ্গের মধ্যে সেক্স করে না । সেক্স এর উদ্দেশ্যই হল রিপ্রোডাকশন, যেটা বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে সেক্স এর ফলেই সম্ভব।

সমকামী বিবাহিতরা অনেক সময় টেস্টটিউব বেবী বা দত্তক সন্তান পালনের কথা বলে। কিন্তু এই সন্তানেরা তাদের স্বাভাবিক মা বা বাবাকে পায় না,এবং একজনের সাথে তাদের রক্তের সম্পর্ক থাকে না কোন ।এই সব শিশুরা পরবর্তী কালে Identity Crises এর শিকার হয়, সমাজে নিজেদের স্থান খুঁজে পায় না ।

সমকামিতাপন্থীদের নানা অপযুক্তি আছে । এই সব তার্কিকদের বক্তব্য হল, সমকামিতা মানুষের একটা অধিকার, সুপ্রীম কোর্টের রায় এই অধিকার খর্ব করেছে।

বস্তুত সমকামিতা একটা অসম্ভব ব্যাপার। যখন দুজন পুরুষ সেক্স করে তখন একজন স্ত্রীলোকের ভূমিকা পালন করে, এবং সে তার শরীরটা ব্যবহৃত হতে দেয়, যাতে অপর পুরুষটি সেক্সের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। এটাই মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় উল্লঙ্ঘন।

সমকামিতার ফলে এডস রোগের মহামারী শুরু হবে,তা' বলাই যায়। শুধুমাত্র এডস মহামারী থেকে বাঁচতে সমকামিতা বর্জনীয়। বাৎস্যায়ন বলেছিলেন, যে ব্যক্তি অকাম নারীতে (যে আসলে পুরুষ ! ) অভিগমন করে সে অনন্ত নরকের অধিবাসী হয়।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে দুজন ব্যক্তি সেক্স করছে, অথচ একজন আনন্দ উপভোগ করছে আর একজন যন্ত্রণা, এটা ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। সুপ্রীম কোর্টের রায় বিশেষভাবে কেবল সমকামিতার বিরুদ্ধেই দেওয়া হয় নি, বরং সমস্ত আনন্যাচারাল সেক্স এর বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে। পশুর সঙ্গে মানুষের সেক্সও এই ক্যাটিগরিতে পড়ে।

সব শেষে বলি, যা' প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, তা' কখনো গ্রহনীয় হতে পারে না, নানা কারণে প্রকৃতি-বিরুদ্ধতায় মানুষের সভ্যতা বহুবার ধ্বংস হয়ে গেছে অতীতে।



২) শ্রীশুভ্র

একথা বলাই বাহুল্য সমকামিতা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না! বরং হতবাক হতে হয় এই বিষয়ে বিতর্ক উঠতে দেখেই! যারা বলবেন বহুবিচিত্র ভারতীয় সংস্কৃতিতে সবই খাপ খেয়ে যায়, তাদের সবিনয়ে বলি, তবে তো বর্তমান ভারতীয় আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিসরের ব্যপক দুর্নীতিকেও ভারতীয় সংস্কৃতি বলে গর্ববোধ করতে হয়!

না, কোনো ভারতীয়ই যেমন দুর্নীতি চলছে বলেই তাকে দেশীয় সংস্কৃতি বলে মেনে নেবেন না, তেমনি সামান্য কজন ব্যতিক্রমী প্রচলিত সুস্থ মানসিকতার বিপ্রতীপে অবস্থানরত মানুষের প্রবৃত্তিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে মেনে নিতে আপামর ভারতীয়র মতো আমরাও অপারগ! দুঃখিত !

এবার আসা যাক আমাদের ঘরগেরোস্থালীর পরিসরে !
কটি পরিবারে সমকামী সম্পর্কের চর্চা হয়? ভাবা যায়, আমাদের ছেলেমেয়েরা ঘরেঘরে সমকামের চর্চা শুরু করে দিয়ে আজীবন সুস্থ সুন্দর জীবনযাপন করছে? কজন চাইবে , তার মেয়েটি আর একটি মেয়ের সাথে ঘরসংসার করছে দেখতে? কজন, ছেলের বউয়ের বদলে ছেলের বরকে বরণ করবেন বড়ো মুখ করে? এবং সবচেয়ে বড়ো কথা আমাদের ভারতবর্ষীয় মানসিকতায় আমরা কজন চেতন অবচেতনের অতলে সমলিঙ্গের সঙ্গসুখ কামনা করি ? যারা তথাকথিত সমকামী বলে ঢাক পেটাতে পছন্দ করেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে হয়ত অনেকেই আজীবন সমলিঙ্গ সঙ্গসুখ ও সংসার যাপনের দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল নন ততটা! ক’দিনের মোহ ক’দিন টিকবে কে বলতে পারে ?

যারা সনাতন ভারতীয় বৈদিকসংস্কৃতির দৃষ্টান্তের কথা বলে সমকামিতার পক্ষে কোলাহল করেন তাঁরা ভুলে যান যে, সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই! একদিন তপোবনে গুরুগৃহে অধ্যয়ন থেকে বাণপ্রস্থ গমন সবই ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেই আজকের যুগে তার অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যদি বিতর্ক না ওঠে, তবে সেই পুরানো কাসুন্দী ঘেঁটে আর লাভ নেই! বুঝতে হবে পরিবর্তিত সহস্রাব্দের ভারতীয় সংস্কৃতিতে সমকামিতা অচল এবং অগৌরবের! যে প্রবণতা সমাজ সংসারে শতাংশের হারে অতি নগন্য তাকে আর যাই হোক দেশীয় সংস্কৃতির স্বরূপ বলে চালানোর প্রয়াস অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক! তাই সুস্থ বিবেচনার পরিধিতে একথা স্বীকার্য, যে ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গনে সমকামিতা অচল!

৩) অরুণ চট্টোপাধ্যায়

কাম শব্দের আভিধানিক বহুল প্রচলিত অর্থ হল একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে অপর একটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার প্রকৃতি-সম্মত যৌনাচারের অভিলাষ । বলা বাহুল্য প্রকৃতি তার সৃষ্ট জীব বা উদ্ভিদের জীবনধারাকে প্রবাহিত রাখতেই উন্মুখ। আমরা সকলেই জানি বিপরীতধর্মী যৌনমিলন ছাড়া জনন বা Reproduction সম্পন্ন হয় না আর তৈরি হয় না ভবিষ্যৎ প্রজন্ম । অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই প্রকৃতি নরনারীর মধ্যে কাম নামক ইচ্ছাটির সৃষ্টি করেছেন বলে ধরে নেয়া যেতে পারে ।

ভারতীয় সংস্কৃতির আবহমণ্ডলে সমকামিতা স্থান পায় না । কারণ এই সংস্কৃতি মনে করে প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর কামচর্চা সঠিক পথে পরিচালিত হয়ে উভয়ের দেহ ও মনকে পরিতৃপ্তি দিক। কিন্তু সমকামিতা কিছুকালের জন্য কিছু ব্যক্তিকে পরিতৃপ্ত করলেও দীর্ঘকালের জন্য একটি সমাজকে তা পরিতৃপ্ত করতে পারে না । মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণী হবার সুবাদে সমাজের প্রতি তার কিছু দায়িত্বকে অস্বীকার করা যায় না । কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে ঘাটতি থেকে যেতে পারে যদি সমকামিতা নামক আত্মকেন্দ্রিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় ।

“প্রকৃতি-বিরুদ্ধ্ব” এই কথাটা অনেকের কাছে হয়ত অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। অনেকে মনে করেন মানুষ বিজ্ঞান জানে তাই প্রকৃতি তার কিছুই করতে পারবে না । তাই তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে অনেক কিছু করবার চেষ্টা করে বা করে । তারা নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে তার স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে । পাহাড়ে কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে পাহাড়কে অনাবশ্যক ভারাক্রান্ত করে । বিস্তৃত সাগর চায় তার একটি খোলামেলা বালুতট । সেখানে নির্মিত হয় সুসজ্জিত বহুতল । প্রকৃতি কিছুকাল সহ্য করে কিন্তু চিরকাল নয় । আর প্রকৃতির প্রতিশোধ কত নির্মম হয় সেটাও কি খুব কম বার আমরা দেখেছি ?

প্রকৃতি চায় নরনারীর যৌনাচার – সুন্দর ও অনাবিল একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে । প্রকৃতির কথা থাক মানুষ কি চায় না ? কিন্তু সমকাম বা homosexuality কি সেই অভিলাষ পূরণ করতে পারবে ? সমকাম শুধু কিছু নারীপুরুষের অস্বাভাবিক পথে যৌন তৃপ্তির সহায়ক হতে পারে এর বেশী কিছু নয় । তাছাড়া যৌন সংক্রমণ ঘটিত রোগগুলি যা সারা পৃথিবীকে গ্রাস করছে ক্রমশ তার কি আরও প্রসার কি হবে না এর ফলে ?

৪) নারায়ণ রায়
“সমকামিতা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না”--, আমি এই যুক্তিকে সমর্থন করি। অনেকেই বলছেন একে অপরাধ বলার অর্থ মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা।

তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, মানুষের যৌন কামনার প্রকার ভেদের কি কোনও শেষ আছে ? অর্থাৎ ঠিক কোন যায়গায় আপনি লক্ষণ রেখাটি টানবেন? যার পর, আর এক পা এগোলেই সেটা অপরাধ কিম্বা বিকৃত রুচি বলে বিবেচিত হবে?

আজ যদি সমকামিতাকে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলে তো আগামীকাল দুজন প্রাপ্তরয়স্ক polygamist, incest বা এইরকম আরও অনেকে আছেন যারা তাদের সপক্ষেও নানান যুক্তি দেখিয়ে বলবেন যে তারাও অপরাধী নন । আর এদের সবাইকে ছাড় দিলে আমাদের সমাজটা কোথায় পৌছবে ভাবতেও আতঙ্ক হয়।

কথাটা হচ্ছে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র সঙ্গে খাপ খায় কি না? অনেকে এ ব্যাপারে আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রের উদাহরণ টানেন, তাঁদের সবিনয়ে বলি, এই শাস্ত্রগুলি ‘তৎকালীন’ সমাজ ব্যবস্থার অভিজ্ঞতায় আমার আপনার মত সাধারন মানুষেরই লেখা । সেযুগের সমাজে সামগ্রিক অনুশাসন ছিল খুবই দুর্বল। আসলে তৎকালীন সমাজের উচ্চস্তরের ব্যক্তি যথা রাজা, ব্রাহ্মণরাই ছিলেন আইনের প্রণেতা, নিজেদের ইচ্ছে মতন যৌন কামনা চরিতার্থ করার কথা ভেবেই তারা আইন প্রণয়ন করতেন, সেজন্য সমাজে অনেক স্বেচ্ছাচারিতাও ছিল। আচ্ছা, আজকের দিনে কি শুধু কূল রক্ষার তাগিদে আপনার অষ্টম বর্ষীয়া কন্যাকে একজন সত্তর বর্ষীয় বৃদ্ধের ত্রয়োদশ পত্নী হিসেবে বিবাহ দেবেন ?

তাই শাস্ত্রের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। এবার একটি আসল কথায় আসা যাক, সমকামিতায় সন্তান জন্মানো সম্ভব নয়, সমর্থকেরা বলবেন, “কোই বাত নেহি, সন্তান দত্তক লেগা,”। একবার ভাবুন তো-- একটি শিশু জ্ঞান হয়ে দেখছে তার কোন মা নেই, আছে দু-দুটো মূলোর মতো গোঁফ আর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা টেকো-মাথার বাবা, অথবা শাড়ি কিম্বা শালোয়ার-কামিজ পরা দু দুটো পটেশ্বরী মা যারা কেউই তার জন্মদাত্রী নন।

সেক্ষেত্রে সে কি আর পাঁচটি সাধারণ শিশুর মত স্বাভাবিক ভাবে মানুষ হবে ? অথচ পাশের বাড়িতেই তার বন্ধুর একটা টেকো বাবা আর একটা পটেশ্বরী মা দুই-ই আছে, শুধু তাই নয় একদিন সে দেখলো তার বন্ধুটি মায়ের কোলে বসে মায়ের বুকের দুগ্ধ পান করছে, তবে সে কেন বঞ্চিত ?

সব শেষে একটা কথা বলি, পৃথিবীতে যে কোন মতবাদেরই সমথর্করা মনে করেন যে, তাঁর মতবাদটাই শ্রেষ্ঠ এবং সবাই সেই মতবাদ অনুসরন করুক। যেমন একজন রাজা চান সারা পৃথিবীতে আবার রাজতন্ত্র ফিরে আসুক, একজন সাম্রাজ্যবাদী চান সারা পৃথিবী তার অধীনস্ত থাকুক, একজন কম্যুনিস্ট চান সারা পৃথিবী কম্যুনিজমের দীক্ষায় দীক্ষিত হোক।

সমকামের সমথর্করও নিশ্চই চাইবেন যে সবাই তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হোক এবং দিনে দিনে তাদের গোষ্টির সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। এবার আগামী সেই দিনগুলির কথা কল্পনা করুন যখন পৃথিবীর আটশো কোটি জনসংখ্যার অধিকাংশই সমকামী… পুরুষ নারীকে নিয়ে, কিম্বা নারী পুরুষকে নিয়ে আর কোন কবিতা রচনা করবে না….চলচ্চিত্রে ধুমশো চেহারার দুজন পুরুষ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নাচছে আর গাইছে…. “কানে কানে শুধু একবার বলো ওগো তুমি যে আমার…” একবার ভাবুনতো দৃশ্য -টা ?

৫) বেলাল হোসেন

সমকামিতা স্বাভাবিক মনের বিকাশ নয় -

সমকামিতা নিয়ে এত হৈ চৈ ! সমকামিতা স্বাভাবিক মনের বিকাশ নয়। মেডিক্যাল সায়েন্সে এই বিষয়টি ফোরেন্সিক মেডিসিনের অন্তর্গত। একটি ফ্রেশ কিশোর কিংবা কিশোরী সমকামিতার প্রথম সন্ধান কার কাছে পায়? তার এক বিকৃতকাম সিনিয়রের পাল্লায় পড়ে তার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়। এর পর সে যদি সুস্থ সঙ্গ না পেয়ে থাকে, সেও কালক্রমে ঐ পথের পথিক হয়ে পড়ে।

আমি জীবনে এরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দুবার পড়েছি। প্রথম অভিজ্ঞতা আই আই টি হোস্টেলে, র‍্যাগিং পিরিয়ডের সময়। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা, যখন মেডিক্যালে ফার্স্ট ইয়ারে যখন পড়ি । তখন একবার আমার হাত ভেঙে যায়, যে অর্থোপেডিক সার্জেন আমাকে দেখেছিলেন, তিনি কলকাতার একজন স্বনামধন্য ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও আমার সঙ্গে সমকামীদের মত ব্যবহার করেছিলেন; শুধু তাই নয়, জীবনে উন্নতির জন্য গোপনে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতে বলেছিলেন। আমার ভাগ্য ভাল, আমি খুব বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলতে ভালবাসি, জীবনের কোন অধ্যায়েই কোন গোপনীয়তা প্রায় কিছুই রাখিনি। তাই বেঁচে গিয়েছি। স্বাভাবিক জিনিসের আনন্দ স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার শিক্ষাটা মনের মধ্যে থেকে গিয়েছিল বলে ঐ গোপন জগৎটাকে ঘৃণা করতে পেরেছি।

কলেজ লাইফে শুনেছি, কলকাতার অনেক পার্কে নাকি অনেক অল্পবয়সি ছেলে এভাবে কিছু বিকৃতকাম মধ্যবয়সি পুরুষদের আনন্দ দিয়ে অর্থ উপার্জন করেছে। সেটা যে নিশ্চিন্তভাবে এবং নিশ্চয়ই নোংরা কাজ, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ফোরেন্সিক মেডিসিনে সমকামিতা, পশুর সংগে কামে লিপ্ত হওয়া ও সঙ্গীকে ব্যাপক নিপীড়নের মাধ্যমে নিজের কামাবেগ অর্জন করাকে একই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করে পড়ানো হয়, যার সোজাসুজি অর্থ হল, এগুলি অসুস্থ মনের বিকাশ যার চিকিৎসা প্রয়োজন।

আজ যাঁরা এই বিষয়টিকে আধুনিক প্রজন্মের দাবী বলে খুব সায় দিচ্ছেন, তাঁদের বাড়ীর ছেলেমেয়েদের এই রোগ ধরলে খুশি হব। এই নেতাগুলো বরং নিজের ছেলের বিয়ে আরেকজন ছেলের সঙ্গে কিংবা নিজের মেয়ের জীবনসঙ্গী হিসেবে আরেকজন মেয়েকে নির্বাচিত করে একটু পথ দেখাক না! তাদের তো অনেক ধনসম্পত্তি...সেই ব্যাপারটাও আইনানুযায়ী কী করে সামলায় একটু দেখাক ! এই নেতাদের কাজকারবার দেখে সেই পুরোনো গ্রাম্য প্রবাদটা মনে পড়ে যাচ্ছে ...পরের ছেলে পরমানন্দ, যত ভোগে যায়, তত আনন্দ।

অন্ধ পাশ্চাত্য অনুকরণের ফল যা হয় আর কি! তাদের ভাল জিনিসগুলো নেবোনা, বিকৃত জিনিসটা চাই!

সুপ্রীম কোর্ট ঠিক কাজটাই করেছে। বাঁচিয়েছে। ভয় হয়, আবার কোন নতুন বাবু এসে আইনটাকেই না আবার পাল্টে দেয়!!!



বিপক্ষেঃ



১) ঋত্বিক দাশ শর্মা


আমি দুটি মানুষের, একই লিঙ্গ বা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে। আমি মানুষের নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভালবাসার মানুষকে খুঁজে নেওয়ার পক্ষে। আমি দুটি মানুষ উভয়েই দুজনকে ভালবেসে, সুখে একসাথে ভাল থাকার পক্ষে। আমি মানুষের নিজস্ব রিপুর অবধারিত প্রকাশের পক্ষে । আমি প্রাকৃতিক নিয়মে, ভালবাসার হাত ধরে আসা শেষ পর্যায় পর্যন্ত শারীরিক সুখ ও তৃপ্তি অনুভুতির পক্ষে। আমি মানুষের কামজ স্বাধীনতার পক্ষে।

আমি শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্যই শারীরিক মিলনের বিপক্ষে। আমি দুটি মানুষের অনৈতিক ব্যভিচারের বিপক্ষে। আমি কামজ কুঅভ্যাসের বিপক্ষে। আমি মানুষের মানসিক অবসাদে বা আদিম রিপুর তাড়নায় কামনার বিকৃত রুচি প্রকাশের বিপক্ষে। আমি একটি মানুষের ভালবাসা ও ভাললাগার দোহাই দিয়ে অন্য প্রাণীর সহিত সহবাসের বিপক্ষে। আমি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নামে ভণ্ডামির বিপক্ষে।


২) বৃষ্টি ব্যানার্জী


মাননীয় বিচারক মণ্ডলী ও মোশনের পক্ষের বন্ধুরাঃ

সমকামী, সমকামিতা শব্দগুলি এতই নতুন যে বাংলা অভিধানে এখনও এদের স্থান হয়নি। কিন্তু এই নামের দ্বারা প্রকাশিত মানুষের যে সহজাত চিত্তবৃত্তি, সেটি আদৌ নতুন নয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাবেন, এদেশে সমকামিতার ইতিহাস বহু পুরানো, Indian culture-এ alredy তাঁরা accepted.

আর তাছাড়া, সমকামিদের সংখ্যা সমাজে অল্প বলেই তাদের অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করতে হবে, এটা কোনো সভ্য সমাজের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আমাদের সমাজে তো transgender-রাও আছেন, তাঁরাও সংখ্যায় লঘু, তাঁরা সমাজের কোন্‌ কাজে লাগেন? তাঁদের তো আমরা মেনে নিয়েছি!! শারীরিক বিশিষ্টতার কারণে যাঁরা লঘু সম্প্রদায় তাঁদের যদি মেনে নিতে পারি, তবে মানসিক বৈশিষ্টগত কারণে যাঁরা সংখ্যালঘু তাঁদের মানতে পারব না কেন?

সবচেয়ে বড় কথা, ‘কাম’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ যেমন যৌন সম্ভোগেচ্ছা, তেমনি, কামনা, অভিলাষ, অনুরাগও বটে। সুতরাং, একটি মানুষের প্রতি অপর একটি মানুষের গভীর অনুরাগও তো থাকতে পারে!! সেটি যদি সমজাতি বা সমলিঙ্গের প্রতি হয়, তাতে বাঁধা কোথায়?

যাঁরা reproduction-কেই যৌনমিলনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করেন, বন্ধুরা, বলতে বাধ্য হচ্ছি, কেবলমাত্র মনুষ্যতর প্রাণীরাই শুধু reproduction-এর জন্য মিলিত হয়। মানুষের কাছে it is a superlative stage of love making.

সবার আগে ব্যক্তি আমি, আমিই রাষ্ট্রের কারণ এবং উদ্দেশ্য। তাই আমার মৌলিক আধিকার আগে সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। নিজের যৌনসঙ্গী নির্বাচন করাও আমার মৌলিক অধিকার গুলির মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান শর্ত। সেখানে সমাজকে reproduction-জাত ফসল দিতে পারব না বলে, আমাকে আমার মৌলিক অধিকার বর্জন করে স্ব-ইচ্ছার গলা টিপে হত্যা করতে হবে, এটা ভারতবর্ষের মতো মহান, উদার, সহনশীল, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সিদ্ধান্ত হতে পারে না।

যাঁরা সমকামিতার ক্ষেত্রে এক পক্ষের আনন্দ এবং অন্য পক্ষের শারীরিক নির্যাতন-এই মতের সমর্থক, তাঁদের কাছে জানতে চাই, তাঁরা কি কখনও কোন সমকামীর কাছে জানতে চেয়েছেন, তাঁরা উপভোগ করেন, না কষ্ট পান? নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলে সিদ্ধান্ত টানা উচিত নয়।

Transgender এবং সমকামী- উভয় ক্ষেত্রেই শারীরিক বা মানসিক বিকৃতির আখ্যা দেওয়া যাবে না। বরঞ্চ শারীরিক ও মানসিক অস্বভাবিকতা বা অসুস্থতা তবু বলা যেতে পারে। কারুর অসুখ করলে সে কি দেশীয় সংস্কৃতির বহির্ভূত হয়ে যায় নাকি???

হাজার হাজার বছর পুরানো ভারতীয় সংস্কৃতিতে সমকামিতা, সহবাস, বিবাহ বিচ্ছেদ, বহুবিবাহ, সতীদাহ, ইত্যাদি সামাজিক প্রথাগুলি আগাগোড়াই ছিল, ইতিহাস ও সাহিত্য তার সাক্ষ্য বহন করে। প্রথাগুলির সামাজিক নামকরণ অপেক্ষাকৃতভাবে অনেকটাই নবীনকালের সংযোজন। বহুবিবাহ বা সতীদাহের মতো প্রথাগুলিকে আমরা সচেতন ভাবে বর্জন করেছি, তার কারণ, প্রথাগুলি সরাসরিভাবে সমাজের ক্ষতি করছিল। কিন্তু, সমকামিতা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যৌনসঙ্গী নির্বাচনের পৃষ্ঠপোষণ ছাড়া সমাজের আর কোন প্রত্যক্ষ্য উপকারে লাগে না বলেই তাকে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী আখ্যা দিতে হবে, এটা অযৌক্তিক। এমন অমানবিক সিদ্ধান্তই বরঞ্চ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে আমি বিশ্বাস করি।।


৩) স্বপন দেব

যাঁরা এর সপক্ষে বলছেন এবং মাননীয় বিচারক মহোদয়,

আপনারা কোন ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলছেন ? প্রায় ৫০০ বছর মুসলিম ও ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনে থাকা, বহু-বিবাহ, সতীদাহ, বাল্য-বিবাহ, বৃদ্ধ স্বামীর প্রয়াণে কিশোরীর কঠোর বৈধব্য পালন, জন্মভিত্তিক জাত-পাত সমণ্বিত ভারতীয় সংস্কৃতির কথা ? ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে আমি বুঝি, সভ্যতার শিখরে থাকা বৈদিক সংস্কৃতি। ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে বুঝি, “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবেনা ফিরে, এই ভারতের মহা-মিলনের সাগরতীরে।”সংস্কৃতি। এর বাইরে,যে সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধ, মানবিক অধিকার, দুটি মানুষের ভালোবাসার বিরোধী, সেটাই অপসংস্কৃতি।

যৌনতা বিষয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি বরাবরই খুব উদার। কোনারক বা খাজুরাহো তে যে মৈথুন মূর্তিগুলি আছে, তাতে সমকামে রত পুরুষ এবং সমকামে রত মহিলা মূর্তি আছে। বাৎস্যায়নের কাম-শাস্ত্রেও সমকামিতার উল্লেখ আছে। সমকামিতা কথা টা নতুন, প্রথাটা কিন্তু বহুদিন ধরেই চালু। বিধবা পুনর্বিবাহ, সমকামিতার থেকে অনেক বেশী আলোড়ন তুলেছিল তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে। ভারতীয় সংস্কৃতি কিন্তু সেটা মেনে নিয়েছে। লিভ-টুগেদার, ডিস্কো-থেক, বিবাহবিচ্ছেদ এ গুলি তো ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে দিব্যি খাপ খেয়ে গেছে!

আসলে আপনারা ভারতীয় সংস্কৃতিটাকেই খুব সংকীর্ণ ও ছোট করে দেখছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি এতোটাই উদার, এতোটাই সহনশীল যে, যীশুর জন্মদিনে কেক কাটা বা মুসলিম দের ঈদের মত, বিজয়ায় কোলাকুলি করাটা আমাদের সংস্কৃতিতেই ঢুকে গেছে! দুজন অভিন্ন হৃদয় বন্ধুকে দেখে আমরা বলি, “হরি-হর” আত্মা। তো, দুজন পুরুষ বা নারীর যদি আত্মার মিলনে বাধা না থাকে, তবে, যৌন মিলনে বাধা কোথায়...?

আর অধিকার এবং সংস্কৃতি দুটি কিন্তু ভিন্ন বিষয়। নিজের এবং দেশের স্বাধীনতা আমার অধিকার। আমার যৌন-সঙ্গী বেছে নেওয়াটাও আমার মানবাধিকার। আমি আগে মানুষ, পরে ভারতীয় । সংস্কৃতির সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই।

আর একটি কথা, মার্ক্সীয় দর্শনে, অর্থনীতি হোল স্ট্রাকচার আর সংস্কৃতি হোল সুপার-স্ট্রাকচার । একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। আপনি অর্থনৈতিক সুবিধার জন্যে গ্লোবালাইজেসন এর দরজা হাট করে খুলে দিয়ে বিদেশী পুঁজি কে স্বাগত জানাবেন আর তার পেছন পেছন আসা বিদেশী সংস্কৃতিকে ঢুকতে দেবেন না , এটা হয় না।


৪) অনুরাধা দাসগুপ্তা

আমি বিচারকের ভূমিকায় না। প্রথমে 377 ধারাটিকে দেখা যাক, 377 states that “whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, woman or animal shall be subject to a punishment up to life imprisonment”. এর সঙ্গে সমকামিতার যোগাযোগ দেখিনা, সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাক্তিগত। শুধু পুরুষ মহিলার যৌন মিলন সামাজিক, বাকি অসামাজিক এটা মানতে নারাজ। প্রতিটি মানুষের ব্যাক্তিগত স্বাধিনতাকে সন্মান করা উচিত। এটা mental distortion বলা যেতে পারে, তার জন্য medical science improve করার দরকার।



হিজরা যেমন প্রাকৃতিক নিয়মের বহির্ভূত নয়, সমকামিতাও প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে।

What really bugs me the most is that these religionists think they're such an authority on nature. Actually, they know nothing about nature and they are the ones who are completely clueless about nature. They are too brainwashed by their religions of male domination that they don't even try to analyse how and why gays are created.


৫) সুস্মিতা সিং

সভার সপক্ষের বন্ধুরা ও মাননীয় বিচারক মণ্ডলী-

সবার প্রথমে খুব ভাল করে বিতর্কের বিষয়টি কি, তা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, প্রশ্নটি ‘আমি মানি কিনা’ নয়, ‘ভারতীয় সংস্কৃতি মানে কিনা’। আসুন দেখে নেওয়া যাক, ভারতীয় সংস্কৃতিতে তথা ইতিহাস ও সাহিত্যে সমকামিতার স্থান কোথায়।।

ভারতীয় সংস্কৃতি সমকামিতার পরিপন্থী – এ কথা মেনে নিতে গেলে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল আধার বৈদিক পুরাণ সাহিত্য এবং সমকালীন ইতিহাসকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হতে হয়। অনেকানেক কাহিনীর মধ্যে বিতর্কের এই স্বল্প পরিসরে মাত্র কয়েকটি উদহরণ উপস্থাপিত করা গেল। পুরাণ মতে, দেবী পার্বতী ও গজাননা রাক্ষসী নামে দুই নারী গনেশের জন্ম দেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সূর্যবংশীয় রাজা দিলীপের অপুত্রক দুই বিধবা স্ত্রী মহাদেবের আদেশে সমকামে লিপ্ত হয়ে জন্ম দেন পুত্র ভগীরথের। ঋগ্বেদের বহু কাহিনীতেও নারী সমকামিতার চিত্র পাওয়া যায়। আবার মহাভারতে শিখণ্ডিনী প্রথম জীবনে ছিলেন নারী, তা সত্ত্বেও এক নারীর সঙ্গেই তাঁর বিবাহ হয়। এই মহাভারতেই দেখি, স্বাহার পতি অগ্নির সঙ্গে সোমদেবতার সমকামী সম্পর্ক ছিল। বৈদিক সাহিত্য ও মহাভারতের দুই দেবতা মিত্র ও বরুণ-এর মধ্যে গভীর সমকামের সম্পর্কের উল্লেখ পাই। ভাগবত পুরাণ মতে, এই মিত্র ও বরুণ অযোনিজ কামে লিপ্ত হয়ে বাল্মিকী ও অগ্যস্ত নামে দুই পুত্রের জন্ম দেন। সুশ্রুত সংহিতাতেও পুরুষ সমকামীদের কথা পাওয়া যায়। বাৎস্যায়নের কামসূত্রেও সমকামিতার উল্লেখ রয়েছে, পরবর্তীকালে যার প্রত্যক্ষ প্রক্ষেপণ আমরা লক্ষ্য করি খাজুরাহ ও কোণারকের মন্দির গাত্রে।

দক্ষিণ ভারতে একেবারে আদিকাল থেকে ‘জোগাপ্পা’ নামে এক সম্প্রদায় আছে, যাঁদের পেশা গণিকাবৃত্তি। এঁদের এবং দক্ষিণ ভারতীয় দেবদাসীদের একটা বড় অংশ সমকামী। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কিছুটা আগে কাশীর বিধবা মহিলাদের মধ্যে সমকামিতা ভারতীয় সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল, ইতিহাস যার নীরব সাক্ষী। সহনশীল ভারতীয় সংস্কৃতিতে মানুষের সহজাত প্রতিটি প্রবৃত্তিকেই সমান মর্যাদায় ইতিহাস ও সমকালীন সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে অকুণ্ঠিত ভাবে।

সুমহান ভারতের ‘সংস্কৃত’ ইতিবৃত্ত আমার আপনার সহমতের অপেক্ষা না রেখেই সমকামিতাকে নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি দিয়েছে একেবার আদি থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত। অতএব, বন্ধুরা, গর্বিত ভারতবাসী হিসাবে মানবিক ও মানসিক ঔদার্য্য খর্ব করার সংকীর্নতাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার মধ্যেই সার্বিক আত্মিক উত্তরণ প্রতিষ্ঠিত হয় বলেই আমি মত পোষণ করি।।

বিশেষ রচনা - কোলাঘাটে কোলাহল


ছবিঃ

১)
সৌভিক বিশ্বাস


২)
কৌশিক বিশ্বাস

৩)
দেবাশিস সেন



কোলাঘাটের কোলে –


১)
নস্টালজিয়া আর রোমান্টিকতার অন্বেষণে

অরুণ চট্টোপাধ্যায়





জীবন একটা প্রবাহ। এক স্রোতস্বিনী তটিনী। বরফ-শৃঙ্গে তার সৃষ্টি। পাহাড়ের কাঠিন্য ভেদ করে তার শৈশবের পথচলা। শৈশবের টালমাটাল অবস্থা কাটিয়ে সবে সমতলে এসে দুই পায়ে ভর করার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন দীর্ঘ চলার পথ তার। রয়েছে দীর্ঘ কাজের তালিকা। দীর্ঘ জনপদ সজীব করার পর সাগরের বুকে হারিয়ে যাওয়াই তার নিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

নদীর বুকে রয়েছে ঢেউ যা শুধু তার চঞ্চলতার প্রতীক মাত্র নয়। এই তরঙ্গবিভঙ্গ হল জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। জীবন কখনও নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখের আধার নয়। সুখের জীবন দুঃখের সাগরে কখনও হারিয়ে যায়। আবার দুঃখও কখনও মুখে করে সুখের ঠিকানা এনে হাজির করে।

আসলে আমরা জীবনকে শুধু দুঃখের একটা প্রবাহ বলে ভাবি, আর সুখকে যদি ভাবি সেই তরঙ্গ- বিক্ষুব্ধ জীবন-নদীতে হঠাৎ ভেসে আসা একটা কাঠের টুকরো- তাহলে মনে হয় সুখকে আরও বেশী করে উপলব্ধি ও উপভোগ করা সম্ভব ।

কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে আমরা কিছুদূর যেতে পারি। তাকাতে পারি আকাশের দিকে, স্পর্শ পেতে পারি সুশীতল বাতাসের, কর্ণগোচর হতে পারে পাখীর কুজন। কিন্তু তবু কাঠের গুঁড়ির টালমাটাল অবস্থা প্রতি পদে আমাদের জানান দিতে থাকে সুখকে পেলেও তাকে ধরে রাখা কতই না কঠিন কাজ।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ত পছন্দ হবে না কারও। কিন্তু শিবের গীত যখন ধান ভানার কষ্টকে খানিক লাঘব করে তখন সেই গীত হয়ত আমাদের খারাপ লাগে না। যেমন ধরুন আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে আনন্দের এক একটা ছোঁয়া আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু এই যাওয়া আসার সাক্ষ হিসেবে তারা রেখে যায় কিছু সুখানুভূতি। যেমন চিলেকোঠার এই “কোলাঘাট ভ্রমণ”।

অসুখ যদি সুখ হারানোর কাব্য হয় তো আমার মত অসুস্থ মানুষের পক্ষে কোলাঘাট ভ্রমণ নিতান্তই ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু তা হয় নি। আমার অসুস্থতা আমার শরীরকে যত পীড়িত করেছে, সুখ থেকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা করেছে, আমার মন ততই সজীব হয়ে তার প্রতিবাদ করে সুখের প্রতিটি ইঞ্চি পরিমাপ করে নিয়েছে। সুখের গ্রহণ আর আত্তীকরণের মধ্যে ফাঁকটাকে ন্যুনতম রাখার চেষ্টা করেছে।

১লা ডিসেম্বর দিনটির সকাল নটা ছিল এক আনন্দ-আহরণের সেই মুহূর্তের বর্তমান মাত্র। সাউথ ইস্টার্নের পনের নম্বর প্লাটফরমের গাড়ীটিতে সকলে হুড়মুড়িয়ে ওঠার পর সেই বর্তমান পিছিয়ে গিয়ে যতই তাকে অতীতের দিকে ঠেলে দিতে লাগল ততই একরাশ হুল্লোড় আর আনন্দ আর একটা ছন্দময় বর্তমানকে উপহার দিতে উদগ্রীব হল।

প্যাকেটের লুচি তরকারি আর দরবেশ খেতে না খেতেই একটা চমক এসে হাজির হল দুই বাউলের সুরের মধ্যে দিয়ে। সারা কম্পার্টমেন্টে অর্ধ-শতাধিক আমরা ছাড়া হাতে গোনা যারা ছিল তারা মহা আনন্দে নেচে নেচে উপভোগ করতে লাগল এই লাগাতার বাউল-সঙ্গীত।

গাড়িটি গ্যালপিং হওয়ায় আমাদের বাগনান স্টেশনেই যাত্রাপথের সাময়িক বিরতি দিতে হল। কারণ কোলাঘাট তুলনামূলক ছোট স্টেশন হওয়ায় এই গাড়ি ধরবে না। কিছুক্ষণের সেই অপেক্ষা আমাদের পীড়িত বা বিরক্ত করতে পারল না কারণ বাঁধভাঙ্গা আনন্দের একটা ভবিষ্যৎ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।

পেছনের গাড়ীটি এসে পড়তে আমরা উঠলাম আর অবাক হয়ে দেখলাম সেখানে আরও কিছু নতুন বন্ধু। যারা মাঝপথ থেকে উঠবেন তাদের সঙ্গত কারণেই আগেই গ্যালপিং গাড়ীটি নেয় নি।

কোলাঘাটের প্ল্যাটফরমে ব্যানারের পেছনে সকলের ছবি তোলা হল। এই ছবি শুধুমাত্র একটি আনন্দের উপকরণ নয় ভবিষ্যতের মূল্যবান একটি দলিল বলে অনেকেই মনে করে।

প্ল্যাটফরমে পা দেওয়া মাত্রই কোলাঘাটের সুন্দর প্রকৃতি যেন এগিয়ে এল হাসিমুখে। আমার সঙ্গে আরও অনেক ক্যামেরা-প্রেমী মানুষের ক্যামেরা সেই প্রকৃতির সঙ্গে হাসিমুখে কোলাকুলি করল।

লাইনের পাশ দিয়ে মেঠো পথে নেমে যেতে হবে একটা গড়ান বেয়ে। কিন্তু গড়ানের মুখেই চোখ গেল বেশ একটু দূরেই। যেখানে রয়েছে রূপনারায়ণের ওপরের সুদৃশ্য একটি সেতু যার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে। মনে হল কোনও ছবি দেখছি । আবার মনে হল সেই গানটার কথা। “ তুমি কি কেবলই ছবি – শুধু পটে লিখা ?”

সেই পটে লিখা ছবিকে “শুধু পটে লিখা” থাকতে দিল না আমার ছটফটে ক্যামেরাটা। তার ফ্ল্যাশের ঝলকানি দিয়ে দৃশ্যটাকে দিল একটি চুম্বন আর দিল আমার হৃদয়-কারাগারে যাবজ্জীবন কারাবাসের পুরস্কার। সেতুর ওপর দিয়ে একটা ট্রেন আসতে দেখে সবাই ব্যস্ত আর ব্যগ্র হয়ে পড়ল।

এরপর আবার সেই মেঠো পথ বেয়ে যাত্রা। একটু পরেই সেই মেঠো পথ বন্ধুত্ব করল এক পাকা পিচের রাস্তার সঙ্গে। আমরা সেই পথ ধরে চলতে শুরু করেছি। ইতিমধ্যে আমার ফুসফুস নামক যন্ত্রটি প্রচণ্ড বিদ্রোহ করতে শুরু করে আমার গতিপথে বাধা সৃষ্টি করার বাসনায় তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। মেকানিকস বলে গতিবেগ যত কমে পথের দূরত্ব তত বাড়ে।

যাই হোক এরপর রূপনারায়ণ এসে পড়ল আমাদের ঠিক পাশে। রূপনারায়ণ কিন্তু নদ, নদী নয়। আকারগত পার্থক্য (বিশালতায়্) তাকে নদ অভিধায় অবিহিত করেছে।

রূপনারায়ণের কথা বহু শুনেছি ছেলেবেলা থেকে। নদনদীকে আমি ভয় পেলেও ভালবাসি এটা ঠিক। আমার স্বপ্নের রূপনারায়ণ– আমার স্বপ্নের রূপনারায়ণ আজ আমার পাশে পাশে চলছে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে উষ্ণ বন্ধুত্বের। এই সুখের স্মৃতি আমি সারাজীবন সঙ্গে নিয়ে বেড়াব এই চিন্তা যেন আমায় পাগল করে দিল।

নদীর ঘাটে আরও অনেকে নেমে পড়েছে। কেউ ছবি তোলবার আবার কেউ বা ছবি তোলাবার জন্যে। সকলেই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নৌকোর কাছি ধরে নৌকোয় ওঠার ছবি তোলার জন্য আকুল। এ প্রসঙ্গে দেবাশিসদার (দেবাশিস কাঞ্জিলাল) উৎসাহের বর্ণনা না দিলে হয়ত বর্ণনায় কিছু ফাকি থেকে যাবে।

তিনি তো সটান নৌকোয় উঠে পড়লেন। তাঁর প্রারম্ভিক টালমাটাল অবস্থাটা আমার মনকে ক্ষণিকের জন্যে চিন্তিতও করে তুলেছিল কারণ রূপনারায়ণের রূপ আর গভীরতা দুইই আছে।

এরপর আমরা চললাম সেই রাস্তা ধরে। আমার ব্রঙ্কিয়াল কনজেশসন আমাকে সকলের থেকে পেছনে ফেলে দিলেও নৈকট্যের খাতিরে আমি পৌঁছে গেলাম একটু পরেই। নদীর ঠিক তীরে একটি সুন্দর লজ। সেখানে তখন চলছে ব্যানার টাঙ্গানোর পালা।

জায়গাটা আমাকে যেন দীঘা বলে মনে করিয়ে দিতে লাগল বারবার। রূপনারায়ণের বিশালতায় একটু ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস আর পাড়টি আর একটু চওড়া হলেই যেন একে আর এক দীঘা বলে মনে হত।

অপূর্ব সুন্দর এই লজটি আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করার জন্য চিলেকোঠা নিশ্চয় বন্ধু বেলাল হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। এই ব্যবস্থায় আমরা সকলেই বেশ খুশী আর সুখী।

হলের ভেতরে তখন অধিকাংশ বন্ধু আসন গ্রহণ করেছেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্ব চলছে। মাইক্রোফোন হাতে স্নেহের শ্রীরূপাকে হাসিমুখে দেখা গেল। এরপর অনেকেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন।

আবার এলেন বাউল দম্পতি। একের পর এক বাউল গান একতারার সুরের সঙ্গে নাচতে লাগল। আর সেই তরঙ্গ আমাদের চোখ আর কানের ওপর বোলাতে লাগল মধুর এক পরশ।

বাউলভাইরা (অধীরদাস বাউল ও কৃষ্ণা দাসী) প্রায় বেশীর ভাগ জুড়ে থাকলেও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বৈজয়ন্ত রাহার কবিতা আবৃত্তি, ইন্দ্রাণী মুখারজী আর পিলু ভট্টাচার্যের গান একটা উল্লেখযোগ্য উপহার ছিল।

দুপুরে খাওয়ার পর প্রচণ্ড অসুস্থতা নিয়েও ক্যামেরা হাতে আমি বেরোলাম। আমার লাগামছাড়া (আর হয়ত সৃষ্টিছাড়া ) মন আমাকে স্থির থাকতে দেয় না এতটুকু। সৃষ্টির কিম্বা সৃষ্টিকে ধরে রাখার চিন্তায় সে সদাব্যস্ত । আমার মন যখন তখন লিখে চলে অনেক কিছু । কিন্তু স্মৃতিশক্তি তার অক্ষমতার রবার ঘষে তুলে দেয় সব কিছু। তাই আমার ক্যামেরা আমাকে এ কাজে সহায়তা করে । সেই দ্বিপ্রহরে রূপনারায়ণের রূপ কি ভোলার? আমি ভুললেও ক্যামেরা ভুলতে দেয় নি।

এখানের একটি আকর্ষণ ছিল যাত্রাশিল্পী কুমার কৌশিকের মন-মাতান গান। ধরতে গেলে তিনি এই বিনোদন পরিবেশনার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অনুরাধা (অনুরাধা দাসগুপ্ত) দীর্ঘ সময় তার বিগত অভিজ্ঞতার কথা অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে বলেছিল,যা অবশ্য আমি আগেও শুনেছি।

সারা সময় জুড়ে আহুতির প্রাণোচ্ছ্বলতা ছিল লক্ষ করার মত। তার ব্যক্তিসত্বাকে সকলের আনন্দ মহাযজ্ঞে যেন সত্যিই সে আহুতি দিয়েছিল। আহুতি, তনিমা, মিমি এরা সকলেই নৃত্য আর সমবেত সঙ্গীতে ভরিয়ে রেখেছিল একটা দীর্ঘ সময়।

স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছে আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন তনুশ্রী চক্রবর্তী। আবৃত্তি করেছেন দেবাশিস কাঞ্জিলাল। এ ছাড়া প্রায় সকলেই এই মহামিলন যজ্ঞে নিজেদের সামিল করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।

বাউল এই ভ্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এটা আগেই জেনেছিলাম। আমার বাউলদের জীবনী নিয়ে একটি কবিতা “মনের কথক” ছাপা হয়েছিল কবিতা ক্লাবের এক বইতে। এটিকে প্রাসঙ্গিক ভেবে আমি ভেবেছিলাম এটি পাঠ করব। কিন্তু যখন আমার ডাক এক তখন গুরুতরভাবেই অসুস্থ আমি। যাহোক অতি কষ্টে তা আমি পড়লাম। এই উপস্থাপনা এই দিনের সবচেয়ে খারাপ এক উপস্থাপনা এ আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।

অনুষ্ঠান সম্পর্কে আর একটা কথা না বললে হয়ত বলাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি হলেন আমাদের শেখরদা অর্থাৎ শেখর রায়ের কথা। সারাক্ষণ সব সময় এই অনুষ্ঠানকে মাতিয়ে রেখেছেন কখনও নেচে, কখনও গেয়ে কখনও কিছু বলে। আবার কখনও কিছু না বলেই। তার ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিই উপস্থিত করেছে অনেক কিছু।

সকলের কথা হয়ত বলা হল না। হয়ত উচারণ করা গেল না সকলের নামও। কারণ তাহলে এই প্রবন্ধ আর প্রবন্ধ থাকত না হয়ে উঠত একটি নামাবলী বিশেষ।

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অন্ধকার এসে বাসা বাঁধল রূপ নারায়ণকে ঘিরে। রূপনারায়ণ তার রূপ পাল্টাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কিন্তু আপসোস এই রূপ বদলের সাক্ষী আমার ক্যামেরা হতে পারল না। কারণ বহু পূর্বেই সে তার বৈদ্যুতিক প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।

আমরা এবার ফিরে চলেছি কোলাঘাট স্টেশনের দিকে। ফেরার পথে কি কি নিয়ে গেলাম এখান থেকে আর কি কি দিয়ে গেলাম এখানে তার হিসেব কষছি। নিয়ে গেলাম যত জিনিস তার হিসেব করা দুরূহ। কিন্তু রেখে গেলাম মাত্র একটা জিনিস যা হল আমার মনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে।

কোলাঘাট আজ অতীত। অতীত স্মৃতি হয় কিন্তু সব অতীত ইতিহাস হয় না। ইতিহাস হয় সেই অতীতগুলিই যে গুলির গায়ে স্বীকৃতির একটা তকমা পড়ে। কবরে শায়িত মানুষ অতীত বটে কিন্তু তারা ইতিহাস নয়। কিন্তু ইতিহাস হল ফারাওরা যারা পিরামিডের স্বীকৃতির নীচে আজও উজ্জ্বল।


চিলেকোঠার কোলাঘাট ভ্রমণ তাই আজ একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।



২)
আনন্দ ঝর্ণা


‘ চিলেকোঠা ’ শব্দটা শুনলেই যেন মনে হয় স্বতন্ত্র কোন স্থান। কিন্তু এই পরিবারের সদস্য / সদস্যারা একেবারেই চিলেকোঠায় বসবাসকারী কোন প্রাণীর মত নন ; তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই স্বতন্ত্র। ফেসবুকের স্বল্প পরিচিতির মাধ্যমে আমি বুঝতে পারলাম এখনও কিছু মানুষের মধ্যে মানবিক গুণ যথেষ্ট পরিমাণেই বিদ্যমান। এতটা যত্ন , আন্তরিকতা , স্নেহ , বন্ধুপ্রীতি বোধহয় আজ খুব প্রয়োজন।

তবে আজ আমি এই আনন্দের অংশীদার হতে পারতাম না যদি দাদাই (শ্রী অলোক চৌধুরী মহাশয়) আমায় চিলেকোঠাকে না চেনাতেন। প্রথম যখন আমি এই পরিবারে পদার্পণ করলাম তার কয়েকদিন পরেই আমাদের কোলাঘাট যাবার আয়োজন শুরু হল। সেই প্রস্তুতিকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে গত ১লা ডিসেম্বর ২০১৩ সকাল ৯টায় আমরা সকলে হাওড়া স্টেশনে মায়াজালের বাইরে নতুন করে একে অপরের সাথে পরিচিত হলাম।

প্রথমে কথা ছিল আমরা সরাসরি কোলাঘাটে পৌঁছবো কিন্তু ঘটনাচক্রে আমাদের বাগনান স্টেশনে সাময়িক বিরতির একটি সুযোগ ঘটে গেলো। তারপর? আবার কু... ঝিক ...ঝিক তালে তাল দেওয়া ; এবারের ট্রেনটি নিজেই সুসজ্জিতা– হলে কি হবে? চাঁদেও যে কলঙ্ক থাকে ... !

কোথা থেকে এক সুযোগসন্ধানী ছদ্মবেশীর প্রতারণার শিকার হলেন আমাদের প্রিয় দেবাশিস কাঞ্জিলাল কাকু এবং মহুয়া দি । অমন সাহসী অনুরাধা আন্টিও পরিত্রাণ পাননি !

মা লক্ষ্মীর কৃপা ভেবে সে মহানন্দে তাঁর (অনুরাধা আন্টির) পানের বটুয়া এবং চশমার খাপটি চক্ষুদান করেন । দেবাশিস কাকু ও মহুয়াদির টাকায় বনভোজন সেরে অবশেষে পান না চিবোলে যে যথার্থই বাঙালী বলে মনে হয়না এ বিষয়ে তস্করের দূরদর্শিতা সত্যিই প্রশংসনীয় । সবাইকে ঠকাতে এসে স্বয়ং তিনি যে নিজেই ঠকবেন এ বোধহয় তাঁর কল্পনার অতীত ছিল।

কোলাঘাটে নেমে এবড়ো খেবড়ো ছোট ছোট পাথরের ওপর পা দিয়ে রেললাইন পেরোনোর সঙ্গে দাদার (শেখর দা) কড়া নজরদারী দারুণ উপভোগ্য ; তারপর পায়ে পায়ে ইঁটের চওড়া সিঁড়ি দিয়ে খুশীর লহরী তুলে নামা – সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

এবার এলাম সমতলে। রূপনারায়ণ তো সেজেগুজে তৈরী অভ্যর্থনা জানাতে ; আহুতি হৈ হৈ করে ছুটে চলে তার সঙ্গে আলাপ করতে , সঙ্গে কিছু বন্ধু বান্ধবী । রূপসী স্রোতস্বিনী জানতো যে ‘ আমরা নূতন যৌবনেরই দূত ’ তাই সে ঘাটে বেশ কয়েকটি নৌকা বেঁধে রেখেছে কিন্তু মাঝি রাখেনি (ভাগ্যিস রাখেনি নাহলে কি যে হতো)। আমাদের উৎসাহে ভাটা পড়বে তাবলে ? না না অকুতোভয় দেবাশিস কাকু নৌকায় উঠে পড়লেন এবং এমনভাবে ক্যামেরাবন্দী হলেন যেন তাঁর তরণী নিয়ে তিনি অতিথি আপ্যায়নের জন্য সদ্য আগত ।

এবার আমরা এলাম নীহার গেস্ট হাউসে । সারা ট্রেনে লোকগান শুনেছি অধীর দাস বাউল এবং কৃষ্ণা দাসী এই বাউল দম্পতির কণ্ঠে - কিন্তু সে গান অনেকসময়েই অস্পষ্ট ছিল ট্রেনের যান্ত্রিক কোলাহলের কারণে । এবার ইন্দ্রানী দিদি মুক্তকণ্ঠে সেই গানটি ধরলেন ;

‘তোমায় হৃদমাঝারে রাখিবো , ছেড়ে দেবো না ...’ –

ইন্দ্রাণীদির কণ্ঠজাদুতে আমরা মুগ্ধ । সেই ছন্দে মন তো দুললোই আর মন দুলে উঠলে তার প্রকাশ ঘটে নৃত্যে । বান্ধবীদের নৃত্য শুধু দেখা নয়, সঙ্গে সঞ্চালনা ও মাঝে মাঝে তাল দিয়ে সুন্দরভাবে সময়টাকে এগিয়ে নিয়ে গেল শ্রীরূপা । মৈত্রেয়ীদির কাছ থেকে প্রায় কেউই ‘উঠোন বাঁকা’ – এই অজুহাতে রেহাই পেলোনা । অমন সদাহাস্যময়ী দিদিকে কেই বা না বলতে পারে ? সুস্মিতা দি , তনিমা দি (সকলের নাম জানিনা বলে উল্লেখ করতে পারলাম না , ক্ষমা করবেন) এঁদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মত। আমার মত একজন অতি সাধারণ মানবীকে সুস্মিতাদি, শেখরদা এবং অন্যান্য বন্ধুরা যেভাবে অনুপ্রাণিত করলেন তাঁর জন্য আমি কৃতজ্ঞ ।

মঞ্চ জুড়ে কখনও গান , কখনও নাচ , কখনও মজার কথা , কখনও কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা আবার কখনও আবৃত্তি – সবকিছু মিলিয়ে সে যেন এক স্বপ্নের বাতাবরণ ! এই সুন্দর মুহূর্তগুলোকে অমলিন রাখার প্রয়াস সর্বদাই জারী রেখে গেলেন দেবাশীষ চক্রবর্তীদা, দাদাই, শমিতা দি এবং আরও অনেকে ।

সবচেয়ে অবাক লাগলো যখন দেখলাম , ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায় কিভাবে নিজের শারীরিক কষ্টকে উপেক্ষা করে নিরলস ভাবে এই আনন্দকে উপভোগ করার চেষ্টা করে চলেছেন। যেখানে শারীরিক অসুস্থতা পরম প্রিয় মানুষের একটি ভালো কথাও বিরক্তির উদ্রেক করে সেখানে তাঁর চোখে মুখে সামান্যতম বিরক্তির আভাসটুকুও পরিলক্ষিত হয়নি।

পিয়ালী মজুমদার, যাকে চিনতাম না, সে কেমন মুহূর্তের মধ্যে বন্ধুত্বের বাঁধনে বেঁধে ফেললো তার ব্যবহারিক মাধুর্যে। ডাঃ বেলাল হোসেন দম্পতি তাঁদের স্থান তো মনের মণিকোঠায়। ওঁদের আন্তরিকতায় শত্রুও বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। অনেকের নাম হয়তো এই স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব হলো না, তবে এই চিলেকোঠা পরিবার হলো এমন একটি পরিবার যেখানে না এলে কেউ বুঝবে না বৃহত্তর পরিবার কাকে বলে। এ পরিবার জানে নতুনকে স্থান দিতে, ভালবাসতে ও আপন করতে। শুধু তাই নয় এখানে এসে আমি এটাও উপলব্ধি করলাম যে, স্বার্থপরতার নাগপাশ এখনও দুর্বল।

সর্বোপরি যাঁর কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন আমাদের কোলাঘাট স্টেশনে ফেরার পথে পথপ্রদর্শনকারী এক অজানা তরুণ। তিনি নিজে পথ চেনাতে এগিয়ে এলেন এবং শুধু যে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন শুধু তাই নয়, তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।

চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোয় আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, কি হলো ভাই? সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে যা বললেন তা শুনে আমি অভিভূত – ‘দেখে নিচ্ছি একটু সবাই আসছে কিনা, কেউ যদি না আসে সে তো পথ চিনতে পারবেনা। আপনাদের সবাইকে আমি যদি ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে না পারি , তবে যে আমাদের গ্রামের বদনাম হয়ে যাবে’।

অনতিবিলম্বে আমরা ট্রেনের সাময়িক অতিথি হয়ে কোলাঘাটকে হাসিমুখে বিদায় জানালাম। কিন্তু আমরা যে একটু সময়কেও খুশীর মোড়কে মুড়ে দেবার এক অদৃশ্য অঙ্গীকারে আবদ্ধ। সুর, তাল, ছন্দে ভাসতে, ভাসতে কখন যে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পেরিয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। তখনও কিন্তু আমরা অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর; মনে হচ্ছিল যেন আমরা আবার নবউদ্যমে যাত্রা শুরু করতে চলেছি।


ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করতে করতে কখন যে হাওড়া স্টেশনের বাইরে চলে এলাম বুঝতেই পারলাম না। ৬৩ জনের দলের নিবিড় বন্ধন যেন বলতে চাইছিল, ‘নয় থাকলে আরও কিছু ক্ষণ...’ কিন্তু সময় যে অবাধ্য; তাই বাধ্য হয়ে ‘আবার হবে তো দেখা, এই আশাটুকু সম্বল করে চিলেকোঠার কাছে আবার এমন একটি স্বপ্নরঙিন দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম আমরা সবাই।





৩)
“এবার কথা কানে কানে”

নারায়ণ রায়


জীবনে প্রথম কবে পিকনিক করেছি আজ আর সেটা মনে নেই, কিন্তু তখন তো ‘পিকনিক’ শব্দটাই জানা ছিলনা, হয় চড়ুইভাতি কিম্বা বনভোজন বলা হ'ত। তবে বনভোজন শব্দটার মধ্যে একটা সুন্দর ব্যঞ্জনা আছে -- বনের মধ্যে অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশে ভোজন।

সেই সময়ে বনভোজন করার জন্য আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা সাধারণত নিজের নিজের বাড়ি থেকে সাধ্যমত আলু-পিঁয়াজ, কেউ চাল-ডাল, কেউ তেল বা মশলা এসব নিয়ে যেতাম।কখনো সখনো গামছা দিয়ে ছেঁকে কোন পুকুর কিম্বা আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাঁদরে কুচো মাছ ধরা হ'ত। তারপর গ্রামের পাশের কোন শাল পিয়ালের বনের ভিতরে একটা পুকুরের পাড়ে, মাটির ঢেলার তৈরী উনুনে গাছের শুকনো ডালপালার জ্বালে সেগুলো রান্না করা হ'ত।

অবশ্যই রান্নার দায়িত্বে থাকতো পাড়ার চতুর্দশী, ষোড়ষীরা । সেই রান্না যতই মুখে দেবার অযোগ্য হোক না কেন, আমাদের তা কাছে ছিল এক পরম প্রাপ্তি। কারণ বাঃ, দারুন হয়েছে বলে পরিবেশনের সময়ে ‘আমাকে আর একটু দে’ বলে অনিতার হাত স্পর্শ করার সুযোগ কি সহজে ছাড়া যায় ? অথবা মিনতিকে সোমেন ঠিক কতটা ভালোবাসে সেই কথাটা তার কানে কানে বলার নামে দুটি ঠোঁট দিয়ে তার কান স্পর্শ করার সেই সুবর্ণ সুযোগ একমাত্র এই বনভোজনের দিনেই পাওয়া যেত।

আবার আমাদের ছেলেদের জীবনেও প্রথম লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া, একবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে কল্যানী অজয়ের হাত থেকে টুক করে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে ফুক ফুক করে দুটো টান দিতেই সে কি কাশি ? আর সেই সুযোগে কল্যানীর মাথায় হাত রেখে ষাট ষাট বলার জন্য ছেলেদের মধ্যে কি হুড়োহুড়ি !

আর একটা জিনিস ছিল, খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে ঐ বাগানে গাছের আড়ালে আড়লে সবাই মিলে চোর পুলিশ খেলা। স্বাভাবিক কারনেই নানা ছুতোয় নাতায় সবাই চেষ্টা করত যাতে সব সময় মেয়েরাই চোর হয়, কারণ চোর-রূপী মিনতি দৌড়বে আর পিছন থেকে পুলিশ-রূপী সোমেন দৌড়িয়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরবে এই সুযোগ কি আর সহজে পাওয়া যায় ?

“Age is nothing but a number” এই কথাটা কে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন জানিনা, কিন্তু কথাটা যে কি ভীষন ভাবে সত্য তা আবার মর্মে মর্মে উপলব্ধি ক’রলাম। আজ পাঁচ দশক পরেও চিলেকোঠার ব্যবস্থাপনায় সদলবলে কোলাঘাট ভ্রমণে গিয়ে সেই ছোটবেলার বনভোজনের দিনগুলোই যেন ফিরে পেলাম।

না এখানে আমাদেরকে বাড়ি থেকে চাল ডাল তরকারী নিয়ে যেতে হয়নি, জঙ্গলে কাঠ কাটতে হয়নি, মাটির উনুন তৈরী করতে হয়নি, আমাদের অনিতা, মিনতি বা কল্যানীদের রান্না করতে হয়নি কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুনতো, বাউল অধীর দাস আর কৃষ্ণা দাসী যখন চলন্ত ট্রেনে …. “যেমন চিটে গুড়ে পিঁপড়ে পড়লে…….” বলে গেয়ে উঠলেন তখন পিঁপড়ে লড়তে চড়তে পারুক বা না পারুক, আপনার হৃদয়টা কি একটু নড়ে চড়ে ওঠে নি? আর বাউল বাবাজি, কুমার কৌশিক এবং পিলুর গান যে আবাল বৃদ্ধ বনিতার হৃদয়কে কতটা আন্দোলিত করেছিল সেটা তাদের সমবেত নৃত্যের প্রকাশ ভঙ্গিমার মাধ্যমেই সবাই জানতে পেরেছে।

তাই সেদিনের অষ্টাদশ কিম্বা পঞ্চদশীর সঙ্গে আজকের পক্ককেশ কিম্মা পক্ককেশীদের কোন তফাৎ খুজে পেলাম না। গোলাপ দেওয়া কিম্বা নেওয়ার নাম করে একটুকু ছোঁয়া লাগে, কিম্বা পাশাপাশি দুটি চেয়ারে দুজন বসে, একজনের কানের কাছে মুখটা নিয়ে একটুকু কথা শুনি…. কি করবে দুই বেচারা আর বেচারী, যা জোরে মিউজিক চলছে জরুরী কথাটা বলার জন্য মুখটা তো কানে ঠেকাতেই হবে! হোক না হেমন্ত, চলো না কিছুটা পলাশের নেশায় মেতে একটু ঘুরে আসি, যদিও দল বেধে, তবুও ঐ ভীড়ের মধ্যেও ঠিক পছন্দের লোকের হাতেই হাত রেখে রূপনারায়ণর তীরে কাঁচা আলকাতরার গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যায় ক্ষনিকের তরে।

হটাৎ কোন এক বেরসিক ঘড়ি দেখে বলে ওঠে “এই চলো চলো … সাড়ে পাঁচটা বাজলো ট্রেন ধরতে হবে।” দুসসস্ এই পড়ন্ত হেমন্ত কালটা বড্ড বেরসিক, কে তোমাকে দিব্বি দিয়েছিলো এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হওয়ার ? আবার …. ফেরার সময়েও কারও এনার্জীর কমতি কিছু দেখা গেল না….ট্রেনে যথারীতি কে কার পাশে বসবে তারি লাগি হুড়োহুড়ি ।

কিন্তু হাওড়ায় নামার পর অনেকরই মুখটি বেশ ভারাক্রান্ত। সবার শুকনো মুখে একটাই কথা ---“আবার কবে ?” হটাৎ দেখি সেই হাতে হাত, কানে মুখ রাখার গলায় উৎকন্ঠিত প্রশ্ন “আরে তোমার ফোন নম্বরটাই তো নেওয়া হ’ল না”...।।

৪)
আবার এসো

বেলাল হোসেন

প্রথম যখন শুনলাম, চিলেকোঠা , কোলাঘাটে আসছে , মনটা নেচে উঠেছিল । তারিখটা আমার কাছে সমস্যা হয়ে যায়। আমার অনুরোধে যখন ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়, দয়াবান হৃদয়বান অ্যাডমিন ১লা ডিসেম্বর রাজি হয়ে যায়, তখনও বুঝিনি, কোলাঘাটের পিকনিক প্রোগ্রাম মানুষকে এত এত আনন্দ দেবে ! এই আনন্দের শুরু কুশলের pinned post থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল।

সুপার হিট আড্ডা পিকনিকের Tune তৈরি করে দিয়েছিল।সকাল সকাল উঠে, professional কাজগুলো দ্রুত সেরে নিয়ে অধীর অপেক্ষা , কখন দল বলের দেখা পাবো। স্টেশনে দাঁড়ানো ছেলেটি এক একটা ট্রেন দেখছে আর ফোন করছে "এখনও আসেনি .." আর আমি কেবলই শেখরকে ফোন করে চলেছি , আর কত দূর, কত দূর...। শেষমেশ ভিনি- ভিডি ভিসি..আপনার প্রত্যেকে যে এত উচ্ছসিত হয়েছেন আমি ভাবতেও পারছিনা..উচ্ছাস যে এত দীর্ঘস্থায়ী হবে, তাও আমার কল্পনার বাইরে ছিল। কোলাঘাটে এর আগেও আমি অনেকবার এরকম পিকনিকের আয়োজন করেছি..আমার ডাক্তার বন্ধুরা বেশ কয়েকবার এসেছেন, তবে চিলেকোঠার মত এত eventful হয়নি সেগুলো ।
এবারে একটা বিশেষ জিনিস চোখে পড়েছে, তুলনামূলক ভাবে বয়স্ক সদস্যরা বেশি সংখ্যায় যোগ দিয়েছেন , এবং তাঁদের ভীষণ প্রানবন্ত participation আমাকে খুব উজ্জীবিত করেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আপনারা এসে এখানে কাউকে বুঝতে দেননি কার কি status .ভীষণ Appealing. মাননীয়াদের অফুরন্ত এনার্জি দেখে কিছু আর বলার ছিলনা। ওনারা অক্লান্ত নেচে গেয়ে আমাদের অফুরন্ত আনন্দ দিয়ে গেলেন।
আর ফটো সেশন ! এখনও চলছে !
যারা আসেননি, তারা জীবনের একটা আনন্দময় মাইলস্টোন মিস করলেন।
বিশেষ প্রাপ্তি অর্থাৎ "উপরি" হিসেবে বন্ধু ও বাড়লো বেশ কিছু।
শুধু একটা আক্ষেপ রয়ে গেল। খাবারটা তেমন যুৎসই হয়নি। মেনুটা আরও একটু "ঘ্যাম" হলে জমতো ভালো।
চিলেকোঠার সকল সদস্যকে আমার অনেক অনেক অভিনন্দন।

আবার এসো ।

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

অদ্বিতীয়া দ্বিতীয় লিঙ্গ
শ্রীশুভ্র



"....... আজ সখী, বুঝিলাম আমি সুন্দর আমাতে আছে থামি- তোমাতে সে হল ভালোবাসা।" - রবীন্দ্রনাথ (পুষ্প: বিচিত্রিতা)



পুরুষতন্ত্রের হাতে যে সমাজ সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ, সেই পুরুষতন্ত্রই নারীকে আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের বেশি পরিসর দিতে পারেনি ! আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে কখনো সখনো নারীর পদচারণা ঘটলেও সেটি ঐ পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের সীমারেখার বাইরে নয় কখনোই ! নারীবাদী আন্দোলনগুলিও ঐ একই সীমারেখার মধ্যেই ওঠা নামা করে ! সবচেয়ে বড়ো কথা প্রগতিশীল নারী চেতনাও পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপের বাইরে পা রাখলেই সমাজে গেল গেল রব ওঠে ! নারীকে ঘরে বাইরে সর্বত্র তার নিজস্ব স্বাধিকারবোধকে খর্ব করে নিতে হয় পরিবেশেরই মাপে !



ঘরসংসার থেকেই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের চর্চা শুরু হয়ে যায় ! শৈশব থেকে আমরা ভাবতে শিখে যাই নারী অবলা ! পুত্ররূপে মাতাকে, ভ্রাতারূপে ভগ্নিকে, স্বামীরূপে স্ত্রীকে, পিতারূপে কন্যাকে রক্ষা করা পুরুষেরই কর্তব্য ! আর এই বোধ থেকেই নারীর প্রতি করুণামিশ্রিত প্রচ্ছন্ন একটি অবহেলা আমাদের অবচেতনে জায়মান হয়ে ওঠে ! এই অবহেলার স্বরূপটি আমাদের সচেতন মনস্তরে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় না প্রাথমিক ভাবে ! কিন্তু সেটির প্রতিফলন ঘটে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ছোট বড়ো নানান মত প্রতিষ্ঠায় পুং অহমিকাবোধের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মাধ্যমে,বিভিন্ন ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের পরতে পরতে ! আর তখনই অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে জন্ম হয় দ্বিতীয়-লিঙ্গ ভাবনার !



আমাদের সমাজ সংসারের প্রতিটি স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে পরিকল্পনা রূপায়নে সর্বত্রই আমরা নারীকে অবলা বলেই পাশে বসিয়ে রাখি, অগ্রভাগে পৌরহিত্যের সুযোগ দিতে চাই না ! দিতে হলেও বাইরে বলি, আমরা নারী স্বাধীনতার পরিসর তৈরী করছি, ( যেন তা’ করছি দয়া করে !) আর ভেতরে ভেতরে মনের গহনে নিজের প্রভুত্ব বজায় রাখার সবরকম বুদ্ধিতে শান দিতে থাকি ! শান দেওয়ার যন্ত্র ভোঁতা হয়ে গেলে মানসিক অবসাদে ভুগি ! সেই অবসাদ থেকেই নারী বিদ্বেষী হয়ে পড়তে থাকি নিজের অজান্তেই! যখন জানতে পারি, তখন আর কিছু করার থাকে না, ভাঙতে থাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের সৌধটি! ব্যক্তিগত স্তরে কখন-সখন তার তলায় চাপা দিয়ে বিধ্বস্ত করতে চাই দ্বিতীয় লিঙ্গকেই!



প্রথম সর্বনাশের সূত্রই হচ্ছে মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন ধর্মগুলি! আর ধর্মের ভিত্তিই হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতি! যে ক্ষমতার বিন্যাসকরণ শুরুই হয়েছে নারীর উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে! তাই পৃথিবীর সব ধর্মেই নারীর অবস্থান দ্বিতীয় লিঙ্গে ! সেখান থেকেই লড়াইটা শুরু করতে হয় নারীবাদী আন্দোলনগুলিকে ! ধর্মের এই নাগপাশ, সময়ের অগ্রগতির সাথে কতটা মুক্ত হচ্ছে সেটা বিতর্কের বিষয়! কিন্তু দেখার বিষয়, যুগ পরিবর্ত্তনের সাথে সাথে ধর্মের বাঁধন একটু একটু করে আলগা হলেও প্রভুত্বের অনুষঙ্গগুলি নতুন নতুন রূপে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে থাকে সমাজ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার অলিতে গলিতে ! যার ধাক্কা খেতে হয় নারীকে আধুনিক জীবনের পরতে পরতে!



ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র নারীর উপর প্রভুত্ব করার এই যে মানসিকতা আমাদের রক্তের ভিতরে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের পুরুষত্বকে,এর থেকে মুক্ত হওয়ার মতো শিক্ষা আমাদের পরিবেশে আজও অপ্রতুল! তাই শুরু করতে হলে শুরু করতে হবে ঐ শিক্ষার বনিয়াদ থেকেই! সেখান থেকেই বিষবৃক্ষের শিকড় কাটার প্রস্তুতি নিতে হবে! আর এ’ দায়িত্ব নিতে হবে সেই নারীকেই! এই কাজে নারীকে নির্ভর করতে হবে নিজের আত্মপ্রত্যয়ের উপর ! পুরুষতন্ত্রের শিক্ষায় সাধন হবে না এই কাজ ! পুরুষতন্ত্রের বিপ্রতীপে নারীবাদের প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে পুরুষতন্ত্রের শিকড় কাটার শিক্ষার ভিত তৈরী কিন্তু অসম্ভব ! তাই অবাস্তব ! দুঃখের বিষয় নারীবাদী আন্দোলনগুলি এইখানে এসেই দিশা হারাচ্ছে !



নারীর জীবনবোধের পরিসরে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সভাসমিতির মঞ্চে কিংবা গবেষণা গ্রন্থের সূচীতে নারীবাদের ঘোষণা কোনোদিনও সত্য হয়ে উঠবে না! কার্যকর হবে না সমাজ জীবনের কোনো স্তরেই! নারীবাদের মূলে যে দুটি বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন, সে দুটি হল, নারীর নিজের উপর আত্মনির্ভরতার দৃঢ়তা ! এবং পুরুষের প্রভুত্ব অস্বীকার করার প্রতিজ্ঞা ! পুরুষতন্ত্র এই ব্যাপারে বাধা দেবেই! কারণ পুরুষতন্ত্রের চরকায়, নারীর পুংনির্ভরতা ও পুংপ্রভুত্ব স্বীকারের তেল নিয়মিত যোগান বন্ধ করতে পারলেই পুরুষতন্ত্র বিকল হয়ে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য ! তাই বাধা যখন প্রবল, প্রতিরোধের যুদ্ধও তখন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলা দরকার !



আত্মনির্ভরতার পথে প্রথমেই অর্জন করতে হবে আত্মপ্রত্যয় ! আত্মপ্রত্যয় গড়ে ওঠে আত্মসমীক্ষা এবং চলমান অভিজ্ঞতার যুগলবন্দীতে ! সেইখানেই বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রকে ধরে রাখলে দেখা যায় ঘরে বাইরে সর্বত্র নারীই কয়েক ধাপ এগিয়ে পাশের পুরুষটির থেকে! এই কয়েক ধাপের হিসেবটি, পুরুষের স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী না থেকে নারী যদি নিজের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবেই প্রাথমিক কাজটি শুরু করে দেওয়া যায় সার্বিক যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ ! মনে রাখা দরকার যুদ্ধ পুরুষের বিরুদ্ধে নয় ! পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ! এবং এটাও স্মরণে রাখতে হবে ব্যক্তি পুরুষ এই পুরুষতন্ত্রেরই ফসল! তাই সেই পুরুষকেই বিচ্ছিন্ন করতে হবে পুরুষতন্ত্র থেকে!



পুরুষতন্ত্র যেদিন থেকে নারীর মাতৃত্বের মহিমা প্রচার করে, সেই মোহে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে নারীর চেতনার পরিসর, সেইদিন থেকেই কপাল পুড়েছে নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের এই আত্মনির্ভর অস্তিত্বের ! মাতৃত্বের এই মহিমায় নারীকে বশীভুত করে রেখে পুরুষের যৌন কামনা চরিতার্থ করার উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি পুরুষতন্ত্রের প্রধানতম কৌশল! সেই কৌশলের আর এক দিক নারীর উপর প্রভুত্ব বিস্তারের ক্ষমতা চর্চা!



ঘর সংসারের পরিধিতেই এইভাবে নারীকে পুরুষের কামনার লক্ষ্য ও ভোগের বস্তু করে রাখে পুরুষতন্ত্র ! সেইখান থেকেই মন-মানসিকতা-মনস্তত্বের গণ্ডী কেটে বেরোতে পারে না নারী ! নারীবাদকে আঘাত হানতে হবে এইখানেই !



বংশানুক্রমে পুরুষতন্ত্রের চালিকাশক্তির আর একটি স্তম্ভ হল এই বংশানুক্রম! এতবড়ো একটি অন্যায় ব্যবস্থা চলে আসছে আবহমান কালব্যাপী ! প্রশ্ন জাগে, আমাদের জন্মদাত্রী গর্ভধারিণী যিনি আমাদের এই পৃথিবীতে আনলেন বংশের সূত্রপাত তার থেকেই নয় কি ? বংশতালিকায় তাঁর ভূমিকা কি গৌন ? এইভাবেই পুরুষতন্ত্র নারীকে খর্ব করে বনসাই করে সাজিয়ে রেখেছে নিজের ইচ্ছাধীন করে! নারীবাদকে রুখে দাঁড়াতে হবে এই অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে! প্রকৃতির সাথে মানব সভ্যতার মূল সংযোগটা এইখানেই বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে আছে! সভ্যতার মঙ্গলের স্বার্থেই এই সংযোগটি উদ্ধার করা একান্ত প্রয়োজন! সেই আত্মউদ্ধারের কাজে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষতন্ত্রের পরিভাষায় সেই দ্বিতীয় লিঙ্গকেই!



দ্বিতীয় লিঙ্গের এই যে ধারণা পুরুষতন্ত্রের অধীনে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের চেতনায় বদ্ধমূল হয়ে বসে আছে, এর থেকে মুক্তির পথটা কাটতে হবে নিজেদের সংসার থেকেই! মুক্তি পেতে হবে নারী পুরুষ দুজনকেই! সেই মুক্তির আলোটিকে নিয়ে আসতে হবে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃত পরিসরে! ঘরে এবং বাইরে স্বামীস্ত্রী নিজেদের মধ্যে অর্জিত এই আলোর দীপ্তিটুকু যে দিন সন্তানদের চেতনায় অন্তর্দীপ্ত করে তুলতে পারবে, সেইদিনই নারীবাদ প্রকৃত সাফল্যের প্রথম আলোটুকু দেখতে পাবে ! হয়ত সে কাজ সম্পন্ন করতে বহু মনীষীর অনেক শতাব্দী লেগে যাবে, তবু সে কাজ এই মূহূর্ত থেকেই শুরু করতে হবে আমার আপনারই আপন ঘর থেকে,আর তা’ অদ্বিতীয়াদের নেতৃত্বে রেখেই !

ধারাবাহিক কবিতা - অলোক চৌধুরী

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোট গল্প “ফাঁসুড়ে ডাকাত” অবলম্বনে ধারাবাহিক কবিতাঃ


ফাঁসুড়ে ডাকাত
অলোক চৌধুরী



তখন আমার বাইশ বছর বোধ হয়,
আমি তখন মাদুলির ফেরিওয়ালা।
কবিরাজের কাছে চাকরি করে,
ঘুচিয়েছিলাম সংসারেরই জ্বালা।
সাত্ত্বিক বামুন সাজতে হতো আমায়,
গেরিমাটিতে ছোপানো কাপড় পরে।
পায়ে থাকতো ক্যাম্বিসেরই জুতো,
রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করে।

বছর তিনেক সেই চাকরি করি,
ছেড়ে দিলাম ধকল সইল না।
ছাড়ার আগে গিয়েছিলাম এক গ্রামে,
আদায় করতে না দেওয়া পাওনা।
বর্ধমানের মাখনপুরে যেতে,
মেমারী থেকে হাঁটার রাস্তা ধরি।
রাস্তায় কিছু উদরপূর্তি করে,
যেতে হবে সেথায় তাড়াতাড়ি।

শুনে সবাই ভয় দেখিয়ে বলে,
ঠাকুরমশাই যাবেন না গো হোথা।
ফাঁসুড়ে ডাকাত ঘাপটি মেরে থাকে,
শরীর থেকে কেটে নেবে মাথা।
তবু আমায় যেতেই হবে সেথা,
বারণ আমি তাদের নাহি শুনি।
সন্ধ্যেবেলায় এক দিঘির কাছে এসে,

একা আমি মনে প্রমাদ গুনি।

--ক্রমশঃ

ধারাবাহিক - সৈয়দা মকসুদা হালিম

আমার মুক্তি যুদ্ধ
সৈয়দা মকসুদা হালিম (বাংলাদেশ)

পর্ব -১
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ---দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি

আমরা তখন থাকতাম তোপখানা রোডের ভাড়া বাসায়। আমাদের সাথে আমার এক ভাই থাকতো। তখন সারা দেশ জুড়ে উত্তেজনা। শেখ মুজিবর রহমান বঙ্গ ভবনে সমানে আলোচনা করছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর সাথে । ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রতিনিধি, সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৭০ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী শেখ মুজিবর রহমানের হাতে দেশের শাসন ভার তুলে দেয়ার কথা নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু কুচক্রী পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক কিছুতেই বাঙালির হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিতে নারাজ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তারা বাঙালীদেরকে অতি হীন চোখে দেখতো। সেনা বাহিনী, সামরিক বাহিনী বা কোন সরকারী উচ্চপদে বাঙালীকে নিয়োগ দেওয়া হতো না। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবকে বন্দী করে অতঃপর ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের প্রচণ্ড চাপের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমরা যারা ভাসানীর সমর্থক ছিলাম, ভাসানীর গরুর গাড়ি নৌকায় চড়ে বসার ফলে আমরাও নৌকার সওয়ারী হই।

যাহোক, দীর্ঘ আলোচনা চলছে, আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নাই যে এই দীর্ঘ আলোচনার ফাঁকে সমুদ্রপথে, সড়কপথে, আকাশপথে পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমান গোলা বারুদ, অস্ত্র-শস্ত্র কড়া সামরিক নিরাপত্তায় গোপনে এ দেশে আনা হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে আসছে অসংখ্য আর্মি। যখন তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়, তখন ইয়াহিয়া আর ভুট্টো আলোচনা অমীমাংসিত রেখে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পগার পার হয়। আমরা ২৫শে মার্চের রাতেও নিজেরা নিজেরা আলাপ করেছি যে, শেখ মুজিব একটা কিছু কম্প্রোমাইজে আসবেন। আমাদের বাঙালীদের কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিলো না। ৭ই মার্চে রেসকোর্সের ময়দানে কোটি কোটি জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব বলেছিলেন,’তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মুকাবেলা করো। কিন্তু আমাদেরতো লাঠি আর দা-বঁটি ছাড়া আর কোন অস্ত্রই ছিলো না। আমার স্বামী আর ভাই সন্ধ্যে থেকেই রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের বাড়ি আমাদের বাড়ির একদম কাছে ছিল। ঐ বাড়ির সামনে বড় বড় পানির পাইপ ছিল, ওরা ঐ পাইপগুলো গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তোপখানা রোড ব্লক করে দিচ্ছিল। রাত ১১ টায় ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে খাওয়া দাওয়া করলো, তারপর শোয়ার পালা। রাত ঠিক ১২টায় ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বিমান আকাশে উড়াল দিলো, এ দেশের আকাশ সীমা পার হওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো –ফটফটিয়ে খৈ ভাজা ! অর্থাৎ গোলাগুলির শুরু। মসীলেপা অন্ধকারে গুলির শব্দ আর মানুষের প্রাণফাটা আর্তনাদ মিলেমিশে কী বীভৎস জান্তব আওয়াজ ! রাতের অন্ধকারের বুক চিরে ক্ষণে ক্ষণে মর্টারের অগ্নি ঝিলিক! সারারাত বসে কাটিয়ে সকালে দেখা গেলো চারিদিক থমথমে। অবিরাম গোলাগুলির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। যে রেডিওতে সারাক্ষণ দেশাত্মবোধক গান বাজতো এখন রেডিও বন্ধ। আমরা উৎসাহের সাথে বাড়ির ছাদে কালো পতাকা আর বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উঠিয়েছিলাম, এখন এগুলো নামানো দরকার। কোন প্রস্তুতি বা হাতিয়ার ছাড়াতো যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু কে ছাদে উঠে নামাবে ? কাজী সাহেব আমার ভাইকে বলেন-‘তুই নামা’, আমার ভাই বলে, ‘না, আপনি নামান’। শেষে আমাদের কাজের ছেলেটাকে ধমক দিয়ে ছাদে তোলা হলো, বেচারা প্রতিবাদের কোন সুযোগ পেলো না। সে কাঁপতে কাঁপতে ছাদে উঠে কোনমতে টেনে টেনে পতাকা গুলো নামিয়ে আনলো। আমাদের ভাড়া বাড়িতে একটুখানি উঠোন মতো ছিলো। উঠোনে একটা গুলির খোসা পাওয়ায় আমরা আরো ভয় পেয়েছিলাম। এরপর হঠাৎ করে রেডিও চালু হয়ে জানান দিলো সারা দেশে কারফিউ বলবৎ থাকবে, কেবলমাত্র বেলা ২টা থেকে ৪ টা এই দুই ঘন্টা শিথিল করা হবে। তারপর কাউকে বাইরে দেখা মাত্রই গুলী করা হবে। কাজী সাহেব আমার ভাইকে বললেন, ‘চল, চল আমরা বাইরে থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসি। তখনো তাদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ে নাই। দুজনে বীর বিক্রমে বাড়ি থেকে বের হলেন। কিন্তু একঘন্টাও গেলো না- দুজনেই মুখ কালো করে ফিরে এলেন। আমি অবাক হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম—‘কি হয়েছে ? বাইরের অবস্থা কি ?’ কেউ উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেব বললেন, ’কি বলবো ? বাইরে রাস্তায় শুধু মানুষের লাশ! লাশ ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে খানিক দূর গেলাম। রাস্তার দুপাশের দোকান গুলোর মধ্যে প্রাণ ভয়ে ভীত মানুষেরা লুকিয়েছিলো, দোকান পুড়ে যাওয়ায় মানুষেরা পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে আছে ! এমন বীভৎস দৃশ্য কোন সিনেমাতেও দেখা যায় না। শুনলাম, রাজারবাগ আর পিলখানার সমস্ত পুলিশ আর ই.পি.আর বাহিনীকে মেশিন গান দিয়ে গুলী করে মেরে শেষ করে ফেলেছে !’

দুপুরে খুব সংক্ষেপে খাওয়া দাওয়া হলো। আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি। কে যাবে রান্নাঘরে রাঁধতে! আমরা তিনজন গুটিসুটি হয়ে একসাথে বসে থাকলাম। বিকালের দিকে কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো আকাশ। কেমন বুকফাটা আর্তনাদ গুলির শব্দ ভেদ করে কানে এসে লাগলো। চারিদিকে হায় হায় হাহাকার! আমরা উঠোনে বের হয়ে দক্ষিণের আকাশের দিকে তাকালাম। সারা আকাশ কালোধোঁয়ায় ঢাকা। ওদিকে শাঁখারিবাজার—হিন্দুদের বসতি। যেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঝলকে ঝলকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, ক্রমেই সেটা বাড়ছে, স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে, অবশেষে আগুনের লেলিহান জিহ্বা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো! শাঁখারিবাজার তোপখানা থেকে বেশ অনেক দূর। কী পরিমাণ আগুন হলে সেটা এতোদূর থেকেও দেখা যাবে!

আজ এতো বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু ১৯৭১ সালের সেই কাল রাতের স্মৃতি এখনো চোখের সামনে যেন জীবন্ত ছবি হয়ে আছে !

বিশেষ রচনা - হাবিব খান

জারবেরা কন্যা
হাবিব খান (বাংলাদেশ)




‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।’ ফুলের প্রতি প্রচণ্ড ভালবাসা ও ভাললাগা থেকেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই লাইন কটি রচনা করেছিলেন। সেই ফুলের প্রতি অগাধ ভালবাসা থেকে ফুলের চাষ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কান্দিলা গ্রামের গৃহবধু খন্দকার পারভীন সুলতানা। তিনি জারবেরা ফুলের চাষ করছেন। তার ফুলের প্রতি ভালবাসায় বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে স্বামীর স্মৃতি। তার স্বামীই বাড়িতে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছিলেন গোলাপের বাগান। পরবর্তীতে তিনিই জারবেরা ফুলের বাণিজ্যিক চাষও শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ স্বামী মারা যাওয়ার পর হাল ধরেন পারভীন সুলতানা।



বুধবার সকালে কান্দিলা গ্রামে তার বাগানে গিয়ে দেখা যায়, লাল, হলুদ ও সাদা রঙের হাজার হাজার জারবেরী ফুল ফুটে আছে বাগানজুড়ে। তিনটি আলাদা আলাদ জায়গায় বাগান। সারি সারি গাছের উপরে লম্বা ‘ডাট’ (ফুলের গোড়ার অংশ) উঠে মাথায় ফুলগুলো দুলছে বাতাসে।



কথা হয় খন্দকার পারভীন সুলতানার সঙ্গে। তিনি জানান জারবেরা ফুল চাষের শুরুর কথা। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর তার স্বামী মাহবুবুর রহমান খান ছানু ফুলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। কয়েকটি গোলাপ ফুলের চারা দিয়ে বাড়ির সামনে বাগান করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি প্রায় দুইশ’ প্রকারের গোলাপ ফুল দিয়ে বাগানের পরিধি বাড়ান। সৌখিনভাবেই তিনি শুরুটা করেন। টাঙ্গাইলে গোলাপ সমিতিও গঠন করেন। তিনি ছিলেন সে সমিতির সাধারণ সম্পাদক। টাঙ্গাইলে কয়েকবার পুস্পমেলারও আয়োজন করা হয় তার উদ্যোগে।



২০০৪ সালে চিকিৎসার জন্য মাহবুবুর রহমান খান ভারতের মাদ্রাজ যান। চিকিৎসার ফাঁকে তিনি বেড়াতে গিয়ে জারবেরা ফুলের সন্ধান পান। শখের বসেই ৩০-৪০টি সাধারণ জারবেরা ফুলের চারা কিনে আসেন। লাগান তার বাগানে। প্রথম বছরই সেই বাগানে চমৎকার ফুল ফোটে। সেখান থেকে নতুন চারা উৎপাদন করেন। পরের বছরই তার বাগানে প্রথম দফায় তিনশ’ টি ফুল আসে। সেগুলো ঢাকায় নিয়ে যান বিক্রির জন্য। প্রতিটি ফুল বিক্রি করেন চার টাকা করে। তখন তার পরিকল্পনা হয় বাণিজ্যিকভাবে জারবেরা চাষের। তিন বছর পর আবার ভারত যান চারা কেনার জন্য। ৫০০ টি হাইব্রিড চারা নিয়ে আসেন। আস্তে আস্তে জারবেরা ফুলের জন্য বাগানের পরিধি বাড়াতে থাকেন। সেই সঙ্গে চারাও উৎপাদন করতে থাকেন। ফুলের চাহিদা বাড়ে। বিক্রি হয় ভাল। লাভও হয় আশানুরূপ। কয়েক বছরের মধ্যে বাড়ির আশপাশে একশ’ শতাংশের বেশি জমিতে চাষ শুরু করেন জারবেরা’র। এ ফুলের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়তে থাকে।



হঠাৎ করে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে স্ট্রোক হয়ে মারা যান মাহবুবুর রহমান খান। প্রেমিককে হারিয়ে বাগানের ফুলগুলোও যেন ফ্যাকাসে হতে থাকে। যত্ন আর খাদ্যের (পানি, সার, ওষুধ) অভাবে মরে যেতে থাকে অনেক চারা। বেশ কিছুদিন পর সেদিকে নজর পরে খন্দকার পারভীন সুলতানার। কিন্তু তিনি কিভাবে প্রায় মরতে বসা বাগানে ফুল ফোটাবেন? সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। পরে স্বামীর ডাইরি ঘেঁটে অনেকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে শিখতে থাকেন ফুলের যত্ন নেয়া। পাশাপাশি আগের শ্রমিকদের ডেকে আনেন। পরামর্শ করেন তাদের সঙ্গেও। শুরু করেন জারবেরা ফুল ফোটানোর কাজ। প্রায় ছয় মাস লাগে সব আয়ত্তে আনতে। এখন তিনি সব শিখে নিয়েছেন। গাছ তার পোষ মেনেছে। তার হাতের পরশে ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছেন তিনি।



পারভীন সুলতানা জানান, তিনজন শ্রমিক প্রতিদিন তার বাগানে কাজ করে। ফুলের মৌসুম শুরু হলে অতিরিক্ত শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস হলো জারবেরা ফুলের মৌসুম। এ সময় সপ্তাহে তিনদিন ফুল সংগ্রহ করা যায়। একদিনে প্রায় পাঁচ হাজার ফুল সংগ্রহ হয়। ঢাকায় পাইকারী বিক্রি করা হয় এগুলো। সব খরচ বাদে প্রতিটিতে প্রায় দুই টাকা লাভ থাকে। বছরের অন্য সময় ফুলের উৎপাদন অনেক কমে যায়। তখন চাহিদা বাড়ে। দামও বাড়ে। ফুল বিক্রির লাভ দিয়ে দুই ছেলের লেখাপড়া ও সংসার খরচ চলছে তার। বাগান করা ছাড়াও তিনি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ভোরে উঠে বাগান ঘুরে সব দেখে নেই। তারপর শ্রমিকদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে স্কুলে চলে যাই। স্কুল থেকে ফিরে আবার কাজের তদারকি করি। নিড়ানী, ওষুধ দেয়া, নতুন চারা লাগানো, পানি দেয়া, ফুল তোলাসহ বাগানের সব কাজ নিয়ম করে করায় কোন সমস্যা হচ্ছে না।



জারবেরা’র পাশাপাশি তিনি অর্কিডও চাষ করছেন। তার বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় এক হাজার টি অর্কিড ফুল রয়েছে। জায়গা সমস্যা ও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বাগানের ব্যাপ্তি বাড়াতে পারছেন না। পারভীন সুলতানা বলেন, ফুল সবাই ভালবাসে। আমারও ফুলের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। তাই ফুল ফুটিয়ে আনন্দ পাই। তাছাড়া এরমধ্যে স্বামীর স্মৃতিও খুঁজে পাই। তিনি বলেন, এটা সৎ ব্যবসা। নিজের মতো করে সৎভাবে ফুলের বাগান করলে ভাল লাগার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবানও হওয়া যায়।

কবিতা - শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

তোমাকে
শমীক (জয়) সেনগুপ্ত



তোমাকে দিয়েছিলাম প্রথম ভোরের চায়ে ধোঁয়া ওঠা উষ্ণতা;
তোমাকে দিতে চাওয়া চুমুর মধ্যে মিলেমিশে ঘুম দেয় বিপ্লব।
তুমি কি ক্লান্ত হও !! তুমি কি সন্দেহে তাকিয়েছো শহুরে সড়কে-
এখনো রাত নেমে আসেনি ও শরীর জুড়ে সরোবরে শ্যাওলার ভিড়ে।
শিয়ালদা চত্বরে গুড়িশুঁড়ি ন্যাকড়া কাঁথায় পার হল কত রাত,
আর সোহাগী সকালে এখনো বেহালায় আধ ঠেলা জলের লাইনে
সুখী আর কাঁচা মিঠে বচসায় ঘুম ভাঙে তোমার আমার।
লবনহ্রদের জল কতখানি নোনা, হয়নি যে জানা-
আর মন্দ আমার আমি হুগলীতে প্রত্যুষ মেঘ।
সে আবেগ দিয়েছি তোমায়, দুপুরবেলায়।
তোমাকে দিতে চাওয়া প্রথম স্লোগান সে ত' ক্যান্টিনে সাতবুড়ি প্রেম-
খুচরো পয়সা ভেবে দিতে গিয়ে দেখি.. না বুঝেই মন হারালেম।
এ ছিল আমার দেওয়া, যা নিলাম তার কথা থাক-
হিসেব করিনি বলে রাত -তারা -চাঁদ -ফুল, মিছিলে দেওয়ালে
চাকরী খোঁজা হাতে আজ শুধু শুদ্ধতা পাক ।
তুমিও দিয়েছিলে প্রথম সন্ধ্যায় সমকামী স্পর্শ প্রবল;
আমারো স্বপ্নে এক অধরা অবয়বে এসেছিলে- বেঁধেছিলে চিরকূটে গান...
ভাসা ভাসা সুর তার তোমায় দিলাম ।
বিবরে তমসায়, তুমিও কি এক মনে বয়ে চলা নদী, চুপচাপ ছুঁয়ে যাও প্রাণ ?
আমার কোলকাতা আমি অবেলায় রাখবো না কোন অভিমান
তোমার খাতায়।
যা হারাবে, যা হারালো তার দায় সে আমার থাক...
এক ঝাঁক পরযায়ী পাখি, তোমার নন্দনে বসে আমায় ভাসাক হিংসাতে।
আমি যত ভাগ হব, গুণে তত বেড়ে যাবে অভিযান একা-
তারপর হবে দেখা কাল মধুবারে, কাল তাকে টেনে নেবে অসীম ক্ষমায়।
ট্রাম ট্রেন বাস ধুলো আর কিছু কোলাহল বুকে...আমিও ফিরে যাব
কালান্তরেতে... যদি তুমি দাও নীরবতা আমারই বুকেতে এঁকে কোমল পেলবতায়।

কবিতা - মৌ দাশগুপ্তা

সন্ধ্যার মেঘমালা
মৌ দাশগুপ্তা



সন্ধ্যার মেঘমালা আমার, কি পরেছ কপালে?
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
ভাবছ নজরে পড়বে না আমার?
গোধূলীর রাঙা সূর্য নাকি রক্তের ফোঁটা?
আমি কবি নই কিনা, উপমা খুঁজে পাই না,
চোখে ধাঁধা লাগে, মনে হয়
তোমার চোখের মত শুষ্ক ধুধু বালুচর
কেমন আলো আঁধারী ভরা ;
একফোঁটা আলোর আভাষও যে নেই।
আভাষ নেই ও ডাগর চোখে প্রেমের বাণেরও।
তবু অষ্টপ্রহর দিনের কানে তোমার স্মৃতির উস্কানি ,
এখনই বিদায় নয় সুকন্যা, তবু কেন যাও,
মিলিয়ে যাও কেন, কেন যাও দূরে সরে,
মাটির অশ্রুভরা উপত্যকা ছেড়ে,
নিশার গহন রহস্যভরা বনানীর পথ ধরে,
সময়কে ভালোবেসে
সাদা আর কালো স্মৃতির কোলাজগুলো আঁচলে ঢেকে,
কেন যাও ? মনকে নিঃসঙ্গ করে আলো থেকে আঁধারে ?
দূর থেকে দূরে, সুদূরে সুদূরে,
কেন হাত ধরে আমায় সঙ্গে নাও দিনের শেষযাত্রায় ?
আর তারও পরে, কিংবা অবশেষে,
যখন সূর্যের স্মৃতি মুছে যায় হৃদয় থেকে।
সন্ধ্যার মেঘমালা আমার, কেন নিশার এলোচুলে মুখ ঢাকো ?
এটা কি ? অন্ধকার ? নাকি সন্ধ্যার অবসান ?

কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

বর্ণচ্ছটা
ঊষসী ভট্টাচার্য



তোমার দেওয়া কালো পেনের ডগায়
আমি এঁকেছি স্বপ্নের নাকছাবি,
এক যাদু স্পর্শে হাতে এসেছে
রোজের গুচ্ছ গুচ্ছ তাজা
লাল গোলাপ।
চিবুকে কান পেতে শুনেছি
দাঁতে দাঁতে ঘষা লাগা
প্রেমময় অগ্ন্যুৎপাত!

তোমার দাঁতের যন্ত্রণায়
ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে ,
আমার নেলপালিশের রঙ,
নখের প্রতিটি খাঁজে
তোমার কামড় রেখে যাচ্ছে
এন্টিবায়োটিক এফেক্ট!

কালো পেনের ডগা আমার গোলাপে
কাঁটা জন্ম দিচ্ছে বারবার,
সেও অস্ফুটে বলে যাচ্ছে আমায়–
আমার প্রেমের রঙ কালো’ ।

কবিতা - সৌভিক দে (শুভ)

আমায় মুক্তি দেবে, বাবু?
সৌভিক দে (শুভ)


সকাল থেকে ঝাঁটা হাতে,
ঝাঁট দিয়ে যাই তোমার ঘর,
ছুটে যেতে চাই সবুজ মাঠে,
আমায় মুক্তি দেবে,
বাবু?

ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে,
মুছে চলি সারা ঘর,
বিনিময়ে মায়ের ঔষধ,
আমায় মুক্তি দেবে,
বাবু?

জানো আমি ছবি আঁকি,
প্রজাপতির ছবি আঁকতেও
ভালবাসি,
চোখের সামনেই ভেসে ওঠে
এসব,
আমায় মুক্তি দেবে,
বাবু?

এঠো বাসনগুলি মাজার ফাঁকেই,
ইচ্ছে জেগে ওঠে স্কুলের পথে,
মিশে যাওয়া সাদা-নীল রঙে,
আমায় মুক্তি দেবে,
বাবু?

নোংরা কাপড়গুলি কাচতে কাচতে,
সাবান জলের ভেতর হাতগুলি ছুঁতে চায়,
ছোটবেলার সকল ইচ্ছে গুলোকেই,
আমায় মুক্তি দেবে,
বাবু?

পড়তে চাই আমি, জানার ইচ্ছায়,
সকলের মতোই যেতে চাই স্কুলে,
শিক্ষার আলোয় খুঁজে নিতে চাই নিজেকে,
আমায় মুক্তি দেবে,
বাবু?

তোমরা যদি আমায় কাজে না
রাখতে,
কত ছবি এঁকে ফেলতাম
এতদিনে,
কত কিছু জানতে পারতাম বই
পড়ে,
আমায় মুক্তি দেবে, বাবু? 

কবিতা - সুবীর বোস

ঋতুর ঢালে
সুবীর বোস



সেই যেখানে প্রতিধ্বনির পথিক বীণায়
তোর আসলই বৃষ্টি আনে - তোর ছবি না
এই ঋতুদি, চল সেখানে – দিঘির ঢালে
সামর্থ্যে যা পাইনি খুঁজে – তার নাগালে
কী বললি তুই – আমি দস্যি – ছন্নছাড়া –
উল্টো-পাল্টা বকেই অসুখ করছি আড়াল?
তুই ঋতুদি, দুপুর-ছাদের পাগলামি মুখ
তাই বুঝলি না ভোরের গদ্য - দেখলি অসুখ
শোন ঋতুদি, শরীরী সুখ – সেই তো দস্যু
সেই জটিলে – মনে পড়ছে - এই তো পরশু
তোর প্রেমিকের দূরত্বে তুই উদাস ছিলি –
সে অস্পষ্টে – অমনস্ক... আগুন দিলি
এই শরীরে - আর নিবিড়ে প্রশ্ন যত
ভাঙলি-গড়লি একইসাথে - ইচ্ছেমতো
সত্যি বলছি, সেই থেকে এক টালমাটালে
জটিল যা সব - হাসছে যেন ঋতুর ঢালে।

কবিতা - বাবুই

অপরাজিতা
বাবুই



কই তোর জন্য কান্না...
লক্ষ্য মানুষের ভিড়...
কই সেই জ্বলন্ত প্রতিবাদী শিখা-সমূহ...?
দেখ, আজ নুতনের চাদরে ঢাকা পড়েছে
                           কালিমায় লিপ্ত ললাট...
চারিদিকে রব-রব, হৈ-চৈ,
কিন্তু এই সুর তোর বেদনার আর্ত্মনাদ নয়,
এই সুর যে ভিন্ন...
ফিরে আয় আর একবার...
স্ম্লান শিখার ক্ষীণ তেজ প্রখর করতে,
এভাবে যাস না হারিয়ে,
দিস না হারতে,
চাই না তোকে আবার হারাতে...।।

কবিতা - ঋত্বিক দাশ শর্মা

আসলে তুমি বন্ধু ছিলে না
ঋত্বিক দাশ শর্মা



নরম ব্যথায় স্পর্শও করতে ইচ্ছে করে না তোমার ?!
কোন করুণ সন্ধ্যায় কিছু কথা বোনা হয়ে থাকে
দগদগে ঘা এর মত, তোমার হাতে লেখা কিছু শব্দ !
কিন্তু বিশ্বাস করো,আকাশকুসুম চাওয়া ছিল না আমার !
ফেলে আসা দিনের গল্প বলে
অতীতকে ফিরে চাওয়া কি খুব অপরাধ ??
ভুল ছিল, পাগলামো ছিল...
এ সব সরাসরি বলে দিলেই তো পারতে!!?
লিখে বলার কোন দরকার ছিল না!
অথচ দেখো, তুমিও শুরু করেছিলে আমার সাথে চলা
চাওয়া ছিল কি খুব বেশি??
আজ আমার দীর্ঘ নিশ্বাস উত্তর দিচ্ছে,
হয়তো তোমার চাওয়া ছিল কিছু!
যা আমি বুঝতে পারি নি তোমার মনের গভীর সেই কথা !
মেলেনি... পাওনি... হতাশ হয়েছ... অথচ বলতে পারনি!
তাই সেদিন সন্ধ্যার বাসরে সমস্ত রাগ উগরে দিলে আমাকে!
একবারের জন্য ভাবলে না পরবর্তী প্রতিক্রিয়া,
বা... এই ক্রিয়ার ক্ষত ... কি, কি ভাবে, কতোটা, ছড়াতে পারে ?
এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে,কত দিন সময় লেগে গেল জানতে আমার...
যে,
আমি তোমার কেউ নই!! কেউ ছিলাম না!!

কবিতা - এনাক্ষী রায়

গন্ডীর ভেতরে আলো
এনাক্ষী রায়



এখন প্রত্যেকটা বিকেলই বিপুল সান্নিধ্য চায়,
এখন প্রত্যেকটা সকাল প্রত্যাশাময়
চেক সার্টের খোপ জুড়ে ঘামের মতো আটকে থাকে বিষাদ...
তুমিই শেখাও কি দারুন বর্ণময় এ বেঁচে থাকা,
তুমিই শেখাও কবর খুঁড়ে জাগাতে নেই মৃত্যু চিন্তা
অথচ প্রতিটা সন্ধ্যায় তুমি আমার শরীরে মৃত্যু ঢুকিয়ে দাও,
অথচ প্রতিটা যাত্রায় ঘাম গন্ধর ঝোপে বুনো ফুল,
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে রোজ আমার প্রবেশ পথে পড়ে থাকে বিদ্রূপ,
রোজ প্রেম এসে ওৎ পেতে থাকে
আর
তাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে
আমি অন্ধ গাছ হয়ে যাই।



কবিতা - বিদিশা সরকার

ব্যক্তিগত গদ্য
বিদিশা সরকার



নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেতেই পারে। কারণ পাবলিক বিষয়টা খুব খায়। দিবাস্বপ্নের সুবিধা একটা যে, কাঁচালঙ্কা ও পান্তাভাতের পাশে শুঁটকি মাছ বা পেঁয়াজি কল্পনা করে নেওয়া যায়। আত্মতৃপ্তির কোনো বিকল্প নেই।
বোঝাবার একটা রাজনৈতিক পদ্ধতি আছে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পন্থা। প্রথম পর্যায়ের প্রথম শর্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠা । অতুল মিস্ত্রির স্ত্রী স্বামীর দেওয়া বিষ মেশানো ভাতে যে আন্তরিকতা দেখেছিল, ও'র দ্বিতীয় পক্ষও তাই। বিষ প্রয়োগের কৌশল তাহলে প্রথমে বিশ্বাস উৎপাদন করা। বস্তি'র উন্নয়ন হয়নি, বস্তি'র উন্নয়ন হয়না। ওদের ভোটাধিকার কার পক্ষে যাবে, সেটা নির্ভর করছে অটো'র পারমিটে, ড্রাইভিং লাইসেন্সে, সর্বসাকুল্যে চারটি শৌচাগারে। অথচ জানলাহীন যক্ষ্মারোগের উপযুক্ত পরিবেশে বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র অকূলের কূল ! স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রয়োজনে রোগ আর রোগের প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আমার পিঠ চুলকালে, অন্যে চুলকে দেবে।
আনুগত্যের দারিদ্র্য নিরাপত্তার আশ্রয় খোঁজে কারো না কারো ছত্রছায়ায়। প্রাকৃতিক বৈচিত্রের ভাবালুতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই চির-বাস্তব হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় ঠিকে মাসি বর্ষার বিকেলে কাজে না এলে !

কবিতা - তন্ময় গুপ্ত

অর্থ-বদল
তন্ময় গুপ্ত



ভাগ্নে :

কপাল পোড়ার গন্ধ কি পাও ?
ফুল টা ফোটার শব্দ ?
বড় বড় চোখ, দাঁতে কাটো নখ
এবার কেমন জব্দ ?
মামু ধিন তাক
মামু ধিন তাক
মামু ধিধিনা ধিধিনা ধিন তাক ।

মামা :

বল দেখি তুই হিংসা জ্বলনে
কোন সে মলম লাগে ?
কতকাল পরে ঘুমন্ত প্রেম
সহসা মনেতে জাগে ?
তেরে কেটে ধিনা
তেরে কেটে ধিনা
বল দেখি তুই ভাগিনা।

ভাগ্নে :

ধারে গাছ কাটে, ভারে কথা কাটে
কেমনে যে কাটে বল দিন
লেবু ছানা কাটে, দাম জেব কাটে
সেন্সর কাটে বাজে সিন।
ধা ধিন কত
ধা ধিন কত
ধাধিনা নাতিনা ধিন ধিন।

মামা :

অংকের মাথা, কাতলার মাথা
শুনেছি খারাপও হয় মাথা
দলের যা মাথা, দৈয়েরও তা মাথা ?
শুনেই তো করে মাথা ব্যথা
তেরে কেটে তাক
তেরে কেটে তাক
ধিধিনা ধিধিনা ধা ।।

কবিতা - অনুপম দাশশর্মা

তবু কোথাও কেউ হয়ত
অনুপম দাশশর্মা



ভাললাগার বুদবুদ কি রঙ্গিন, না কী উদাসীনের খাতার সাদা পাতা
পলকের তীব্রতায় কায়াহীন কস্তুরী কত সহজেই মুছে দেয়
পাওয়া না পাওয়ার রোজকার আর্দ্রতা।
যদি প্রিজম ভেঙ্গে রং বসাও ভাললাগার উজ্জ্বল শরীরে
পেতেই পারো সফলতার এক চিলতে রোদ্দুর,
কিংবা ধরো ভাসিয়ে দিলে ডানা, তখনি....
নাচের মুদ্রাগুলো রাঙ্গিয়ে দিল
ইচ্ছেপূরণের অতিথিনিবাস।

ভাললাগার পায়ে পড়াও কুহূধ্বনির বেড়ি
রং ছড়াবে চোখের অনামিকায়!

এমন যদি হয়, সন্ধ্যামণি জুঁইকে ডেকে
নেভায় সংশয়....
উজ্জ্বলতার ভীড়ে কুঁকড়ে থাকা বেলফুলে চাঁদ উঁকি দেয়
দ্বিধার মেহেন্দিতেও।
তখন যায় না পাওয়া ভাললাগার ঋদ্ধ দাগ!

চল যাই ভেজা জোৎস্নায় চেতনাকে স্নান করাতে
শ্বেতপদ্মের বিমোহিত সরোবরে।

কবিতা - দেবাশিষ মিত্র

আজ রাতে
দেবাশিষ মিত্র



আজ রাতে আমি একটু ভালবাসতে চাই,
কিভাবে বাসবো ভালো বলো না।
আমার সব অহংকার আজ ভেঙে ফেলতে চাই,
আসবে কি আজ রাতে বলো না।
হৃদয়ের সব যত ব্যথা আজ উপড়ে ফেলতে চাই,
একটু আদর করবে কিনা বলো না।
আমি যে আজ নিজেকে শেষ করে দিতে চাই,
একটু তুমি কাঁদবে কিনা বলো না।