ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

পরিচয়
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



সাংঘাতিকভাবে আহত জজ সাহেবকে কাছাকাছি বেসরকারী নার্সিং হোম থেকে ট্রান্সফার করে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না । নার্সিং হোম বলল,ওঁর যা কন্ডিশন তাতে শিফট করতে গেলে বিপদ হবে । বাঁচার সম্ভাবনাও কমে যাবে । আমরা আমাদের মত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে ওঁর বিপদ কেটে যায় ।

জজসাহেবের বাড়ির লোক, আদালতের লোক সবাই কথাটি মানল, বাধ্য হয়েই। এই মুহূর্তে সত্যিইএতটা ধকল দেওয়া উচিত নয় । তাঁর মত নামী বিচারকের প্রাণের মূল্য অনেক ।

মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরছে বটে কিন্তু সে সামান্য । স্পেশাল কেয়ার ইউনিট থেকে তাকে এখন স্পেশাল কেবিনে দেওয়া হয়েছে । অবস্থা অনেকটা ভাল । চারিদিকটা দেখে আগেকার কথা কিছু ভাববার চেষ্টা করতে গিয়েও আর পারছেন না ।

আজ অনেকটা ভাল জজসাহেব । কাল ঘুম হয়েছে । আজ সকালে ব্রেক ফাস্টও করেছেন । মাঝে মাঝে যন্ত্রণাটা বেশ কষ্ট দিচ্ছে । ডাঃ বোস খুব যত্ন করে চিকিৎসা করছেন । নাহলে এমন সাংঘাতিক চোট এত তাড়াতাড়ি হীল হয় ? বলেছেন, আপনি নতুন জীবন পেয়েছেন স্যর । ছুরিটা আর আধ ইঞ্চি বাঁয়ে গেলেই হার্ট ফুটো হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে ।

চোখ খুলেছেন । আশপাশটা দেখছেন যেন নতুন কোনও জিনিসকে দেখছেন । সত্যিই নতুন এক জীবন ফিরে পেয়েছেন তিনি । নতুন এক অভিজ্ঞতা । বিচারক হিসেবে কত দুর্ঘটনা, খুন-জখম, খুনের চেষ্টা সব কিছুর বিচার করেছেন । সাক্ষী-সাবুদ, তথ্য-প্রমাণ সব কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে রায় দিয়েছেন । কিন্তু নিজের জীবন যে অনুরূপ এমন এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে তা কখনও কোনদিন ভাবতে পারেন নি ।

-- এই চল । পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষাল ঘরে ঢুকলেন । সঙ্গে হাতকড়া পরানো একটা ছেলে কনস্টেবলের সঙ্গে বাঁধা । বয়েস বড় জোর আঠারো কিংবা উনিশ । কালো রঙ । গায়ে-গতরে বেশ শক্তসমর্থ হলেও মুখ দেখে মনে হল প্রচণ্ড ভয়ে শুকনো ।

-- এই যে স্যর আপনার অফেন্ডার । আমরা একে অ্যাটেম্প টু মার্ডার চার্জ দিয়েছি । অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণও প্রচুর আছে । তবু আমার মনে হয় ছুরি মারার আগে এর মুখ আপনি নিশ্চয় দেখেছিলেন ?

ভুরু কোঁচকালেন জজসাহেব । এই ছেলেটা ? হবে হয়ত । এই বয়েসের ছেলেদের বেশীর ভাগ এসব দুষ্টুমি করার রিপোর্ট আছে । স্ট্যাটিস্টিকও তাই বলে । কিন্তু কোথায় যেন একটা খটকা – মাথার মধ্যে কি যেন একটা ঝাঁকিয়ে উঠল । স্মৃতির ঝাপসা ভাবটা একটুখানি কাটল ।

হঠাৎ একটা বিশ্রী কাণ্ড । ছেলেটা হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় কনস্টেবলকে টেনে হিঁচড়ে খাটের দিকে নিয়ে এল । মিঃ ঘোষাল তেড়েমেড়ে ছুটে এলেন । চকিতে ধরতে চাইলেন ছেলেটার চুলের ঝুঁটি ।

কিন্তু দেরি হয়ে গেল । আঠারো-উনিশ বছরের জোয়ান ছেলে । গায়ে জোর অসম্ভব । কনস্টেবল সমেত এসে পড়ল একেবারে জজসাহেবের পায়ে । চোখ থেকে বেরোতে লাগল জল । জজসাহেবের পায়ে ক ফোঁটা পড়তে চমকে তার দিকে তাকালেন তিনি । পুলিশ সাহেবের চোখের ইঙ্গিতে কনস্টেবল টেনে হিঁচড়ে আবার সোজা করে দিল । দূরে নিয়ে এল জজসাহেবের কাছ থেকে ।

-- অনেক কষ্টে ওর বাবার নাম জোগাড় করেছি স্যর । মিঃ ঘোষাল বললেন, কিছুতেই বলবে না পাজিটা । বেশ দু চার ঘা দিতে,... না না, স্যরি কিছু নয় !একটু রিগোরাস ইন্টারোগেট করতে তবে বলল ।

শুয়ে শুয়ে ছেলেটার শরীরের খোলা জায়গাগুলো দেখতে লাগলেন জজসাহেব । মারধোরের ছাপ বেশ স্পষ্ট । হয়ত আদালতে তোলার আগে এগুলো একটু সাফসুতরো করে নেবে । কিন্তু এখন সময় পায় নি । কিংবা প্রয়োজন বোধ করে নি । ভেবেছে তাঁর এজলাসে তো আর তোলা হবে না । তাকে ডাকা হবে সাক্ষী এবং ভিক্টিম হিসেবে ।

ছেলেটার চোখের দিকে তাকালেন জজসাহেব । ওর চোখে যেন অনেক কথা জমে থাকার চিহ্ন স্পষ্ট । তাকালেন মিঃ ঘোষালের দিকে । হাতকড়া খুলে দিয়ে ছেলেটাকে এখানে রেখে সবাইকে বাইরে যেতে নির্দেশ দিলেন ।

-- কি... কিন্তু স্যর, ঘোষাল প্রায় ঠিকরে গেলেন, ডেঞ্জেরাস ক্রিমিন্যাল স্যার –

-- সেটা আমি বুঝব । আর আপনারা সবাই দরজার মুখে পাহারা দিন । বেজার ঘোষাল কনস্টেবলকে নিয়ে চলে গেলেন ।

-- বোসো বাবা । অত্যন্ত স্নেহের সুরে ছেলেটাকে ডাকলেন জজ সাহেব, বোসো, ভয় নেই তোমার । এখানে আমি আছি কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না ।

ছেলেটা ভয়ে আর অনভ্যস্ত চিন্তার অনেকক্ষণ পরে বসল টুলের ওপর ।

পুলিশ সাহেবের ওপর হুকুম আছে যতক্ষণ না তিনি ডাকেন ততক্ষণ কেউ যেন ঘরে না ঢোকে । জজ সাহেব একভাবে তাকালেন ছেলেটার মুখের দিকে । পুলিশের কাছে ও নাকি কিছুই বলতে চায় নি । এমন কি বাবার নাম পর্যন্ত নয় । কেবিন থেকে বেরোবার আগে ঘোষাল সাবধান করেছিলেন, ওর বাবার নাম শুনলে আপনি এতটা নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না স্যার । তবে বাইরে আমরা বেশ কড়া পাহারাই রাখছি ।

এবার এই মুখটা মনে পড়ছে একটু একটু । খুব ঝাপসা । একটা লোম খাড়া কড়া গল্পের নায়ক যেন হয়েছিলেন কয়েক ঘন্টার জন্যে । মৃত্যুকে মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারে না । কারণ মৃত্যুর অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে মাত্র একবারই হয় । আর সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্যে সে তো ইহলোকে আর ফিরে আসে না ।

কিন্তু একটা সুনিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন জজ সাহেব । আর তিনি একাই । নার্সিং হোম বলেছে তার গাড়ীটা মেরামতির অযোগ্য হয়ে গেছে । সিকিউরিটি আর ড্রাইভার বাঁচে নি । একা জজ সাহেব যে বেঁচে ফিরেছেন সেটা শুধু ঈশ্বরের আশীর্বাদই নয়, এই নার্সিং হোমের সুনাম বৃদ্ধির পক্ষেও একটা মাইল ফলক বটে ।

ঘটনাটা এবার অনেকটা মনে পড়ছে । হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় পাশ দিয়ে একটা লরি খুব খারাপ ভাবে তার গাড়ীকে ধাক্কা মারে । বিকট শব্দ করে গাড়ীটা লাফাতে লাফাতে গিয়ে পড়ে একটা বিশাল গাছের গায়ে । মুহূর্তে চুরমার হয়ে যায় সেটা ।

ধাক্কাটা লাগার মুহূর্তেই বাঁ পাশের দরজার লকটা খুলে গিয়ে দরজাটাও খুলে যায় । আর তাতেই গাছের গায়ে ধাক্কা মারার আগেই জজ সাহেব গিয়ে পড়লেন রাস্তার অনেক নিচে গড়াতে গড়াতে । একটা ঝোপে গিয়ে আটকাল শরীরটা । আহত অবসন্ন । সারা শরীরে অবশ্য রক্তপাত বিশেষ হয় নি । কিন্তু স্নায়ুমণ্ডলী অকেজো হয়ে যাওয়ায় আর উঠে বসতে পারছেন না । ড্রাইভার আর সিকুরিটি গার্ড যে কোথায় কেমন আছে বোঝা যাচ্ছে না ।

অতিকষ্টে রাস্তার ওপর উঠে দাঁড়িয়েছেন । গাড়ী বিশেষ চলছে না । একটা মোটর সাইকেল ঘড়ঘড় করে আসছিল । দুই হাত ধরে সাহায্য প্রার্থনা করলেন । ওরা দাঁড়াল । ভগবানের অসীম কৃপা মনে করলেন জজ সাহেব ।

ওরা নেমে এগিয়ে এল । জজ সাহেব হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ।

-- মুরগীটা বেশ শাঁসাল মনে হচ্ছে না ? বেটা একটা গাড়ীর মালিক ।

একজন বলল আর একজনকে ।

হ্যাঁ, ওর গাড়িটা ওখানে খাবি খাচ্ছে । খুব খুশির সঙ্গে দ্বিতীয় জন বলল ।

-- নে নে, ঝাড়াই বাছাই করে সটকে পড় ।

ওরা এগোল । জজ সাহেবের দিকে নয় । তাঁর পকেটের দিকে । টাকাকড়ি মোবাইল সমস্ত এক এক করে কেড়ে নিল লোকগুলো । শুধু দেখা ছাড়া আর কিছু করার শক্তি ছিল না জজ সাহেবের ।

-- এটাকে রেখে আর কি লাভ ?

-- একদম না । আমাদের মুখ দেখে ফেলেছে । কোর্টে সাক্ষী দিয়ে দেবে ।

একটা মাত্র ছ’ ইঞ্চির ছুরি,তার যে এত শক্তি তা ভাবাই যায় না । জজ সাহেব অজ্ঞান হয়ে গেলেন । একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরল । সারা বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছে । সেই অবস্থায় দুই হাত তুলে চলতি গাড়ি গুলোকে দাঁড়াতে ইশারা করতে থাকলেন । কিন্তু কেউ দাঁড়াল না । অনেকে খানিক গতি কমিয়েই আবার বাড়াতে লাগল । কারণ জজ সাহেবকে দেখার আগেই তাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ছিল তাঁর বুকে বেঁধা ছুরির দিকে ।

বেশ খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন জজ সাহেব । আবার তাকালেন টুলে বসা ছেলেটার দিকে । পুলিশ সাহেব ঘোষালের ভাষায় যে একজন ডেঞ্জেরাস ক্রিমিন্যাল ।

স্মৃতি এবার খুব ভালভাবে সঙ্গ দিতে লাগল তাঁকে । সেই সন্ধ্যায় অন্ধকার থাকলেও মাঝে মাঝে দূর থেকে ছুটে আসা গাড়ির হেডলাইটে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ছেলেটার মুখটা । ছেলেটা সাইকেলে করে আসছিল । দাঁড়াল এবার । জজসাহেবকে দেখল । তারপর চলে গেল । তারপর আবার এল । একটা রিক্সা ভ্যান নিয়ে । সেটায় সে আর একটা লোক মিলে ধরাধরি করে তুলল । জজসাহেব কাতরভাবে ছেলেটাকে ইঙ্গিত করছেন তাঁর বুকের ছুরিটা খুলে ফেলতে । একবার খুলতে গিয়েই থমকে গেল ছেলেটা । বলল, এটা খুলে ফেললে খুব রক্ত বেরোবে আর আপনি তাড়াতাড়ি মারা যাবেন । আমরা কেউ তা চাই না ।

মুহূর্তের জন্য জজ সাহেবের মনে হল তাঁর পরিচয় হয়ত এই ছেলেটা জানে । আর সেই জন্যেই বাঁচাবার চেষ্টা করছে ।

অতি কষ্টে বললেন, তুমি কি আমাকে চেন ?

-তা তো জানি না । তবে -, ছেলেটা বলল, আপনি আর কথা বলবেন না । এখনও নার্সিং হোম অনেক দূরে । হাসপাতাল আরও দূরে । অনেকটা রাস্তা যেতে হবে । ওখানে ডাক্তারদের আপনার নাম ঠিকানা বলবেন । তখন বাড়ীর লোক আসবে। আমি আপনার নাম জেনে কি করব বলুন ?

কিন্তু নার্সিং হোমে যাওয়ার আগেই তিনি আবার অজ্ঞান হয়ে যান । ভেবেছিলেন ছেলেটিকে আর দেখতে পাবেন না । কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় আজ পেয়েছেন দেখা । কিন্তু এমনভাবে যে তিনি ভাবতে পারেন নি ।

-- তোমার নাম কি বাবা ?

ছেলেটা চুপ । দু’তিনবার বলার পর বলল, বুলি । বলাই ঘোষ ।

বাবার নাম ? বাবা কি করেন ?

একেবারে চুপ । কোনও কথা নয় ।

এবার বেশ একটু রুষ্ট হলেন জজ সাহেব, তুমি জান না বাবার নামেই আমাদের সকলের পরিচয় ? বাবার নাম বলাটা সকলের কর্তব্য ? বাবা আমাদের জন্ম দিয়েছেন, খেতে দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, বড় করেছেন ।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ছেলেটা বলল, সুনীল ঘোষ ।

পরিচয় পুরো হল ছেলেটার । সুনীলের বিচারটা জজ সাহেবের এজলাসেই হয়েছিল।সে বিচার শেষ হয়ে গেছে তিন মাস আগেই।সুনীল একজন সাংঘাতিক ভাড়াটে খুনি।একজনকে খুন করার অপরাধে তার যাবজ্জীবন শাস্তির রায় এই জজ সাহেবই শুনিয়েছিলেন তাকে ।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন