ছোটোগল্প - সুমন মণ্ডল

তৎকালীন
সুমন মণ্ডল



"তেরেকো বিলকুল চিন্তা নেহি হ্যায়, মেরে বাচ্চে লোগ সাম কো চার বাজে সে উধার ব্যাইঠেলা হ্যায়।"

ভোডাফোনের বিজ্ঞাপন দেওয়া একটা খুঁটির নিচে গুটখার একদলা লাল থুতু ফেলে দিয়ে এজেন্ট মহাশয় গর্বের সাথে বললো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে কিছু বলার বিন্দুমাত্র অবকাশ না দিয়ে, বাঁ হাতের মুঠোয় রিং হতে থাকা মোবাইলটা কানে ধরলো।

অন্য হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে ধরা আমার দেওয়া দু দুটো কড়কড়ে হাজার টাকার নোট তখন প্রথম হেমন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় উড়ছে। সদ্য এটিএম থেকে বেরোনোর স্টেটাস আপডেট আর কি। আমার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনটা তখন আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সামনে একটা আয়নার দরকার ছিল।

ঘটনাস্থল হলো পুনে স্টেশন চত্তর। সন্ধ্যা ঠিক নামার মুখে। আগাপাশতলা পুরো শহরটা তখন ছোট, বড়, মাঝারি-পুচকে, রং-বেরঙের আলোতে সেজে উঠেছে আগত দেওয়ালির খুশিতে।

আমার মনে খুশির লেশমাত্র নেই। গত পাঁচটা দিনের হয়রানির চ্যাপ্টারটা তে শেষ রেখা টানার জন্য আমার স্টেশন-এ আসা। বন্ধুদের কাছে হালে তৈরি হওয়া একটি প্রবাদ বাক্য শুনলাম, দেওয়ালির সময় তৎকাল টিকিট পাওয়া নাকি লটারি জেতার সমান। ব্যস, সেটা যে ভুল তা প্রমাণ করার একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল। জোশের বশে লেগে পড়েছিলাম, যথারীতি পাঁচটা দিনের চেষ্টা বিফলে যাবার পর, শেষমেশ দারস্থ হলাম গুটখাওয়ালে ভাইসাবের।

যাই হোক, প্লটে ফিরে যাই।

আমি এজেন্ট মহাশয়-এর চোখের দিকে এতক্ষণ করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, যদি ফোনটা কাটার পর তাঁর কৃপা হয়, তাহলে টাকাটা একটু কম করবেন হয় তো। কিন্তু, সেটা আর হলোনা। ফোনটা রাখতেই দ্বিতীয় ফোন সাথে সাথে। সেও বোধহয় আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারছিল। ফোনে কথা বলতে বলতে আমার পিঠে হাত রেখে, আশ্বাস দেওয়ার জন্য পিঠটা চাপড়ে, হালকা করে একটা ঠেলা দিলো, যাতে আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করি।

রাগে আর দুঃখে, আমার তখন জামার পিঠের অংশটা দেখতেও ইচ্ছা হলো না যে, তার হাত থেকে গুটখার লাল রং আমার জামাতে লেগে গেলো কিনা।

নাটকটা শুরু হয়েছিল দিন পাঁচেক আগে। কলকাতায় বদলির ছাড়পত্র পেয়ে যাবার পর, কিছুদিনের জন্য পুনে যেতে হলো কয়েকটা অসমাপ্ত কাজ মেটাতে। সেই কাজ মিটিয়ে ফেরার কথা চিন্তা করতেই বিপত্তিটা এলো। দেওয়ালির সময় তৎকালের টিকিট পেতে গেলে, এজেন্ট কে বেশি পয়সা দিয়ে টিকিট করাতে হয় শুনে ভাবলাম, শুধু শুধু কিছু মোটা টাকা গচ্চা দেওয়ার থেকে একদিনের জন্য সকালের আরামের ঘুমটা পরিত্যাগ করাই ভালো হবে। সেই মতো ভোর তিনটেতে অ্যালার্ম দিলাম। যদিও দেওয়ার দরকার খুব একটা ছিল না। দু-দু বার ইনস্টলমেন্টে ঘুম ভাঙ্গার পর তৃতীয় দফায় পৌনে তিনটের সময় জেগে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন অ্যালার্ম টা বাজে।


চারটে পনেরো-কুড়ি নাগাদ যেখানে পৌঁছালাম, সেটা স্টেশন থেকে ২ কিলোমিটার দূরে রেলের একটা অফিস কাম টিকিট কাউন্টার। আনন্দ আর গর্ব দুটোই ছিলো মনের মধ্যে। সকাল সকাল মন এমনিতেই ভালো থাকে। আর সকালের আলসেমি ছেড়ে যে উঠতে পেরেছি সেটা ভেবে বুক চওড়া হয়ে গেছে। এখানে আসার পিছনে ভাবনাটা এমন ছিল যে, ছোটো কাউন্টার যখন, বেশি লাইন পড়বেনা, পেলেও পেয়ে যেতে পারি। যাই হোক ,গিয়ে দেখলাম সামনের একফালি ফুটপাথে জনা সাতেক মানুষ ঘুমিয়ে আছেন। পোশাক আর ঘুমিয়ে থাকার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিল না, এরা তৎকালের টিকিট কেটে কোথাও যাবে। ঘুমন্ত বা নিশ্চিন্ডদের লাইনটা শেষ হবার পর, আমার মতো উৎকন্ঠা মাখানো ৪-৫ জন মানুষ কেউ দাঁড়িয়ে আছেন,আর কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোর হয়ে গিয়ে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা সরু ৫ ইঞ্চির মতো জায়গায় নিজেদের আসন করে নিয়েছেন। আমার ব্যাপারটা দেখে একটু চিন্তা হলো, ভাবলাম লাইনটা একটু ঠিকঠাক করে নিলে ভালো হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।

খানিকটা পাকামি করেই পিঠের ব্যাগটা থেকে এক চিলতে কাগজ আর একটা পেন বের করে, বলে ফেললাম,

"ভাইয়া, লাইন মে কৌন কৌন হ্যায়, জারা আপনা আপনা নাম লিখ দিজিয়ে, নেহি তো কোই দুসরা আকে লাইন মে ঘুঁশ যায়েগা।"

কথা টা খুব একটা অযৌক্তিক ছিলো না যদিও, কিন্তু গরম তেলে জল ঢাললাম যেন।

"তু কৌনসা হিরো আরেলা বে, রেলওয়ে মে নৌকরি কবসে জয়েন কর লিয়া। টিকিট লেনা হ্যায় তো, চুপচাপ উধার খাড়া হো যা ।"

ঘুমন্ত মানুষগুলোর মধ্য থেকে, মাথাটা তুলে একটা ৩০-৩৫ বছরের লোক কর্কশ গলায় বললো। চেহারা টা অনেকটা সঞ্জয় দত্ত আর আমজাদ খান মেশানো আছে যেন। পাশ থেকে আরেকজন মাথা তুলে আমাকে দেখে নিয়ে তিন অক্ষরের একটি বহু প্রচলিত হিন্দি গালি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। তারপর হালকা হাসি-ঠাট্টা চলল কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে। বুঝে নিলাম হাসির কারণটা। ভাবছিলাম শান্তশিষ্ট বাঙালিরা এ কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা কোথা থেকে জোগাড় করবে।

অগত্যা সকাল হওয়ার অপেক্ষা।

পাখি ডাকার আগেই ঘুমন্তরা জেগে উঠে নিজের নিজের জায়গা করে বসে পড়ল, সবকটি মানুষ একে অপরের সাথে ইয়ার্কি করছিল এমনভাবে, দেখে যা বোঝার বুঝে নিলাম। ততক্ষণে বেশ কিছু মানুষ আমাদের পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আর সামনের ওই দলটির পাশে কয়েকজন ভালো পোশাক পরা মানুষের ভিড়।

নাটক চলতে থাকলো এভাবেই। কয়েকজন এজেন্ট এলো, কিছু ফর্ম ফিল-আপ চললো নাকের উপর চশমা তুলে দিয়ে। টাকা-পয়সার লেনদেন মিটে গেলে সেই লাইন থেকে আগের লোকগুলি সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো ভালো ভালো পোশাক পরিহিত বাড়ি থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আসা বাবুদের।

সব ঠিকই ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু মাথা ঘুরে গেল তখন, যখন দেখলাম লাইন-এর জনা সাতেক ঘুমন্ত মানুষের রিপ্লেসমেন্ট এখন ২২ টা হয়ে দাড়িয়েছে। মানে আমার নাম্বার ১৩ থেকে ২৮ হয়েছে।

অর্থাৎ এজেন্টদের চ্যালা চামুন্ডারা, থুড়ি এ পাড়ার ছোটখাটো দাদারা একাই ৩-৪ জনের জন্য লাইন দিয়ে বসে আছেন। বুঝলাম, এ যাত্রায় আর হলো না। দুরন্ত-র তৎকাল, ওয়েটিং ৪৫ আর আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস-এর তৃতীয় এসি তো ততক্ষণে অবাধ প্রবেশের সুবিধা বিশিষ্ট চ্যারিটি শো হয়ে গেছে। যেটা কনফার্ম হওয়া অসম্ভব।

"চলো পানসি বেলঘরিয়া" তো আর বলতে পারলাম না। মনে মনে বললাম, "চলো ভদ্রলোক এম জি রোড "

এরপরে তো নটেগাছ মুড়িয়ে যাবার পালা। পরের ৩টে দিন আমি বেশ কয়েকটা ট্রাভেল এজেন্সী-র দোরগোড়ায়। কোনো লাভ হলো না,পরের এমন একটি দিনের অপেক্ষায় সবাই বসে আছে যেদিন পুনে থেকে হাওড়া যাবার জন্য, আজাদ হিন্দের সাথে সাথে দুরন্ত এক্সপ্রেসটাও পাওয়া যাবে।

২রা নভেম্বর, গুটখাওয়ালে এজেন্ট-এর সৌজন্যে পাওয়া গেল সেই দিন। ২ টি ট্রেন, সম্ভাবনাটা স্বভাবতই বেশি। বন্ধুরা টিকিট পাওয়ার জন্য এতবার করে উইশ করতে লাগলো, আমি আমার জন্মদিনটা গুলিয়ে ফেলতে বসেছিলাম। তবে নটেগাছটা মুড়ানোর আগে সব থেকে বড় অবাক হবার ঘটনাটা ঘটা বাকি ছিলো। সকাল বেলা আমিও স্টেশন-এর বাইরে চায়ের দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে বাবু হয়ে টিকিট নিতে চললাম। তারপর তৎকালীয় ব্যাপারটা যে এমন কাকতালীয় হয়ে যাবে তা কে ভেবেছিলো ?

চোখ ছানাবড়া করে দেখলাম, এজেন্ট আমার জন্য যাকে লাইন-এ বসিয়ে রেখেছে, সেই মহান পুরুষটি আর কেউ না, প্রথম দিন ছোট কাউন্টার-এর সামনে শুয়ে যে আমাকে হুমকি দিয়েছিল সে। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল,

" আবে, তেরেকো আভিতক নেহি মিলা কিয়া ?"

ব্যাঙ্গাত্মক হাসির সাথে যে দাঁত গুলো দেখতে পেলাম, সেগুলোতেও গুটখার নোংরা ছোপ। রাগ আর ঘৃনা তে আমার মুখ দিয়ে আর কিছু বেরলোনা। টিকিট পাওয়ার পর অবশ্য এটা খুশিতে বদলে গিয়েছিল। পাঁচটা দিনের নাটক শেষে যেন যুদ্ধজয় করে ফিরলাম। বাড়ি যাওয়ার খুশিটা তো ছিলই।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন