অনুগল্প - জয় ভট্টাচার্য

সুহৃদ সমীপেষু
জয় ভট্টাচার্য



অগ্নিঃ- জানো বহ্নিশিখা, আজ আমার কোনো কাজ করতে ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, আমি হারিয়ে যাচ্ছি। কখনো চোরাবালি দেখি নি, তবুও... মনে হচ্ছে ডুবে যাচ্ছি।

বহ্নিশিখাঃ- তাই না কি, অগ্নি? এটা কি তোমার নেক্সট স্টেটাস?

অগ্নিঃ- হতে পারে। বহ্নি, হারিয়ে যাবার আগে, মানুষটা কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে গেল চোরাবালির ভেতর ! হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে একটা গোঙ্গানির শব্দ!

বহ্নিশিখাঃ- মানুষটা কিছু বলতে চেয়েছিলো? তাহলে বলছে না কেন, অগ্নি?

অগ্নিঃ- বলতে চাওয়া সব কথা, একটা জীবনের পরিধিতে দাঁড়িয়ে, বলে শেষ করা যায় না বোধ হয়। কিছু কথা লেখা থাকে, কিছু কথা বাতাসে মিলিয়ে যায়, কিছু কথা তলিয়ে যায় জীবনের অতলে। তবু বলতে চাওয়ারও একটা মূল্য রয়েছে, বহ্নি। সময়ের কাছে ; আগামী পৃথিবীর কাছে ; অলিখিত ইতিহাসের পাতায়। আপ্রাণ যুদ্ধ চলে যুযুধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সত্তায়! বলে দাও, অথবা, বললেই বিপদ! টানটান উত্তেজনা ! এক দিকে বিষম ঝোড়ো হাওয়া, অন্য দিকে মসৃণ চোরাবালি ! মাঝে সেই কথার পাহাড়... ভুল বললাম, বহ্নি?

বহ্নিশিখাঃ- এত সুন্দর করে কি ভাবে লেখো কে জানে। জানো তো অগ্নি, তোমার লেখাগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা আবেশ থাকে! অনেকক্ষণ থাকে। তুমি সত্যি খুব ভালো লেখো আজকাল। দিন দিন ইম্প্রুভ করছে তোমার লেখা।

অগ্নিঃ- না, না বহ্নি, না... কোনো সান্ত্বনা বাক্য শোনার জন্য বলি নি, অথবা লিখিও নি। এ যে আমার বলতে চাওয়ার যন্ত্রণা, না পারার হাহাকার, আড়ষ্ট জিহ্বার জান্তব ক্রন্দন!

আমি শুধু এক পাত্র পানীয় হাতে নিয়ে অতিক্রম করতে চেয়েছিলাম কথার পাহাড়। গ্রীষ্ম গেল, বর্ষা গেল, শীত এলো... আগামী বসন্তে পানীয়-র আকাল হবে বুঝতে পেরে খুঁজতে থাকি আঙুরের খেত। গোলাপের বাগান, শস্য খেত, পশুচারণভূমি পেরিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে... তবুও আমার শূন্য পানীয়-র পাত্রে সেই মুখ, সেই চোখ, সেই অব্যক্ত চাহনি!

বহ্নি, আরও দুটো কথা বেশী হলে, জীবনে কি অনেক ক্ষতি হয়ে যেত?

বহ্নিশিখাঃ- হুম... বলে যাও অগ্নি। আরও বলো।

অগ্নিঃ- কি বলবো ?

বহ্নিশিখাঃ- যা বলছিলে।

অগ্নিঃ- আমাকে দিয়ে তুমি কেন এত কথা বলাও, বলো তো? যে কথার কোনো মানে হয় না, যে কথা শোনার কেউ নেই, যে প্রস্তরীভূত কথা ভূমিকম্পেও কাঁপে না- কেন সেই কথা খুঁড়ে বের করে আনতে চাইছো বহ্নি? তাকে শান্তিতে ঘুমোতে দাও। তুমি তো জানো বহ্নি, কথা যখন পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে, তখন সেই কথার রেশ টুকুই শুধু ফিরে আসে অন্ত হয়ে। মিলিয়ে যায় শব্দের আদি। আমরাও যে আদি হারিয়ে ফেলেছি বহ্নি, এখন যে শুধু অন্ত নিয়ে বেঁচে থাকা! আর প্রতিধ্বনির রেশ টুকু আঁকড়ে ধরে ইতিহাস হাতড়ে বেড়ানো। বহ্নি, তোমার সেই ছবিটার কথা মনে পড়ে ? সেই যে আদিম গুহাচিত্রে আঁকা! কোনো অক্ষর নেই, কোনো শব্দ নেই, আছে শুধু কয়েকটা সংকেত; আর উজ্জ্বল রং দিয়ে আঁকা অসংখ্য ছবি... সেও তো না বলা কথা, তাই না বহ্নি? কয়েক লক্ষ বছর ধরে ঐ ভাবেই তো কত না বলা কথা জমে রয়েছে! আমাদের এই সামান্য একটা জীবনে, সামান্য কয়েকটা না বলা কথা, তার তুলনায় কিছুই তো নয়, বহ্নি!

এসো না, আমরাও কিছু গুহাচিত্র এঁকে রাখি!

বহ্নিশিখাঃ- অগ্নি, বলতে থাকো, আমি আরো শুনবো।

অগ্নিঃ- জানি তো। বহ্নি, তুমি যেমন শুনতে চাইছো, তেমনি দেয়াল-ও কান খাড়া করে রয়েছে- কখন সেই অসভ্য ইতিহাস কথা বলে ওঠে ! যদি একবারের জন্যেও সেই মহামন্ত্র ধ্বনিত হয়, লুফে নেবে পরম স্নেহে, যত্নে ; সুরভিত কোমল বক্ষে। না বহ্নি, আমার ভালোবাসার গল্প শোনাবো বলে আজ আসি নি। এসেছিলাম, আমার প্রিয় বান্ধবীর কাছে। তাকে জানিয়ে যাই- কোনো এক অস্ফুট সকালে আমি এসেছিলাম 'না বলা কথামালার দেশ' থেকে। অনেক মধ্যাহ্নের রুক্ষতা, সন্ধ্যার দীপমালা, স্বপ্নাচ্ছন্ন যামিনী পেরিয়ে, এখনো সেই দুই চিরহরিৎ নিস্পাপ মন কথার পাহাড় গড়ে; দুর্যোগের দিনে প্রয়োজনে বাঁধ হয়ে যায় কিছু কথা; খরার দিনেই ঝরে পড়ে অবিরাম 'কথাণু' বর্ষণে!


আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। বন্ধুত্বের পূর্ণ আভিজাত্যে!


1 মতামত: