প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

অদ্বিতীয়া দ্বিতীয় লিঙ্গ
শ্রীশুভ্র



"....... আজ সখী, বুঝিলাম আমি সুন্দর আমাতে আছে থামি- তোমাতে সে হল ভালোবাসা।" - রবীন্দ্রনাথ (পুষ্প: বিচিত্রিতা)



পুরুষতন্ত্রের হাতে যে সমাজ সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ, সেই পুরুষতন্ত্রই নারীকে আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের বেশি পরিসর দিতে পারেনি ! আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে কখনো সখনো নারীর পদচারণা ঘটলেও সেটি ঐ পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের সীমারেখার বাইরে নয় কখনোই ! নারীবাদী আন্দোলনগুলিও ঐ একই সীমারেখার মধ্যেই ওঠা নামা করে ! সবচেয়ে বড়ো কথা প্রগতিশীল নারী চেতনাও পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপের বাইরে পা রাখলেই সমাজে গেল গেল রব ওঠে ! নারীকে ঘরে বাইরে সর্বত্র তার নিজস্ব স্বাধিকারবোধকে খর্ব করে নিতে হয় পরিবেশেরই মাপে !



ঘরসংসার থেকেই পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের চর্চা শুরু হয়ে যায় ! শৈশব থেকে আমরা ভাবতে শিখে যাই নারী অবলা ! পুত্ররূপে মাতাকে, ভ্রাতারূপে ভগ্নিকে, স্বামীরূপে স্ত্রীকে, পিতারূপে কন্যাকে রক্ষা করা পুরুষেরই কর্তব্য ! আর এই বোধ থেকেই নারীর প্রতি করুণামিশ্রিত প্রচ্ছন্ন একটি অবহেলা আমাদের অবচেতনে জায়মান হয়ে ওঠে ! এই অবহেলার স্বরূপটি আমাদের সচেতন মনস্তরে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় না প্রাথমিক ভাবে ! কিন্তু সেটির প্রতিফলন ঘটে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ছোট বড়ো নানান মত প্রতিষ্ঠায় পুং অহমিকাবোধের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মাধ্যমে,বিভিন্ন ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের পরতে পরতে ! আর তখনই অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে জন্ম হয় দ্বিতীয়-লিঙ্গ ভাবনার !



আমাদের সমাজ সংসারের প্রতিটি স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে পরিকল্পনা রূপায়নে সর্বত্রই আমরা নারীকে অবলা বলেই পাশে বসিয়ে রাখি, অগ্রভাগে পৌরহিত্যের সুযোগ দিতে চাই না ! দিতে হলেও বাইরে বলি, আমরা নারী স্বাধীনতার পরিসর তৈরী করছি, ( যেন তা’ করছি দয়া করে !) আর ভেতরে ভেতরে মনের গহনে নিজের প্রভুত্ব বজায় রাখার সবরকম বুদ্ধিতে শান দিতে থাকি ! শান দেওয়ার যন্ত্র ভোঁতা হয়ে গেলে মানসিক অবসাদে ভুগি ! সেই অবসাদ থেকেই নারী বিদ্বেষী হয়ে পড়তে থাকি নিজের অজান্তেই! যখন জানতে পারি, তখন আর কিছু করার থাকে না, ভাঙতে থাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের সৌধটি! ব্যক্তিগত স্তরে কখন-সখন তার তলায় চাপা দিয়ে বিধ্বস্ত করতে চাই দ্বিতীয় লিঙ্গকেই!



প্রথম সর্বনাশের সূত্রই হচ্ছে মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন ধর্মগুলি! আর ধর্মের ভিত্তিই হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতি! যে ক্ষমতার বিন্যাসকরণ শুরুই হয়েছে নারীর উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে! তাই পৃথিবীর সব ধর্মেই নারীর অবস্থান দ্বিতীয় লিঙ্গে ! সেখান থেকেই লড়াইটা শুরু করতে হয় নারীবাদী আন্দোলনগুলিকে ! ধর্মের এই নাগপাশ, সময়ের অগ্রগতির সাথে কতটা মুক্ত হচ্ছে সেটা বিতর্কের বিষয়! কিন্তু দেখার বিষয়, যুগ পরিবর্ত্তনের সাথে সাথে ধর্মের বাঁধন একটু একটু করে আলগা হলেও প্রভুত্বের অনুষঙ্গগুলি নতুন নতুন রূপে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে থাকে সমাজ থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার অলিতে গলিতে ! যার ধাক্কা খেতে হয় নারীকে আধুনিক জীবনের পরতে পরতে!



ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র নারীর উপর প্রভুত্ব করার এই যে মানসিকতা আমাদের রক্তের ভিতরে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের পুরুষত্বকে,এর থেকে মুক্ত হওয়ার মতো শিক্ষা আমাদের পরিবেশে আজও অপ্রতুল! তাই শুরু করতে হলে শুরু করতে হবে ঐ শিক্ষার বনিয়াদ থেকেই! সেখান থেকেই বিষবৃক্ষের শিকড় কাটার প্রস্তুতি নিতে হবে! আর এ’ দায়িত্ব নিতে হবে সেই নারীকেই! এই কাজে নারীকে নির্ভর করতে হবে নিজের আত্মপ্রত্যয়ের উপর ! পুরুষতন্ত্রের শিক্ষায় সাধন হবে না এই কাজ ! পুরুষতন্ত্রের বিপ্রতীপে নারীবাদের প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে পুরুষতন্ত্রের শিকড় কাটার শিক্ষার ভিত তৈরী কিন্তু অসম্ভব ! তাই অবাস্তব ! দুঃখের বিষয় নারীবাদী আন্দোলনগুলি এইখানে এসেই দিশা হারাচ্ছে !



নারীর জীবনবোধের পরিসরে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সভাসমিতির মঞ্চে কিংবা গবেষণা গ্রন্থের সূচীতে নারীবাদের ঘোষণা কোনোদিনও সত্য হয়ে উঠবে না! কার্যকর হবে না সমাজ জীবনের কোনো স্তরেই! নারীবাদের মূলে যে দুটি বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন, সে দুটি হল, নারীর নিজের উপর আত্মনির্ভরতার দৃঢ়তা ! এবং পুরুষের প্রভুত্ব অস্বীকার করার প্রতিজ্ঞা ! পুরুষতন্ত্র এই ব্যাপারে বাধা দেবেই! কারণ পুরুষতন্ত্রের চরকায়, নারীর পুংনির্ভরতা ও পুংপ্রভুত্ব স্বীকারের তেল নিয়মিত যোগান বন্ধ করতে পারলেই পুরুষতন্ত্র বিকল হয়ে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য ! তাই বাধা যখন প্রবল, প্রতিরোধের যুদ্ধও তখন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলা দরকার !



আত্মনির্ভরতার পথে প্রথমেই অর্জন করতে হবে আত্মপ্রত্যয় ! আত্মপ্রত্যয় গড়ে ওঠে আত্মসমীক্ষা এবং চলমান অভিজ্ঞতার যুগলবন্দীতে ! সেইখানেই বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রকে ধরে রাখলে দেখা যায় ঘরে বাইরে সর্বত্র নারীই কয়েক ধাপ এগিয়ে পাশের পুরুষটির থেকে! এই কয়েক ধাপের হিসেবটি, পুরুষের স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী না থেকে নারী যদি নিজের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবেই প্রাথমিক কাজটি শুরু করে দেওয়া যায় সার্বিক যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ ! মনে রাখা দরকার যুদ্ধ পুরুষের বিরুদ্ধে নয় ! পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ! এবং এটাও স্মরণে রাখতে হবে ব্যক্তি পুরুষ এই পুরুষতন্ত্রেরই ফসল! তাই সেই পুরুষকেই বিচ্ছিন্ন করতে হবে পুরুষতন্ত্র থেকে!



পুরুষতন্ত্র যেদিন থেকে নারীর মাতৃত্বের মহিমা প্রচার করে, সেই মোহে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে নারীর চেতনার পরিসর, সেইদিন থেকেই কপাল পুড়েছে নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের এই আত্মনির্ভর অস্তিত্বের ! মাতৃত্বের এই মহিমায় নারীকে বশীভুত করে রেখে পুরুষের যৌন কামনা চরিতার্থ করার উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি পুরুষতন্ত্রের প্রধানতম কৌশল! সেই কৌশলের আর এক দিক নারীর উপর প্রভুত্ব বিস্তারের ক্ষমতা চর্চা!



ঘর সংসারের পরিধিতেই এইভাবে নারীকে পুরুষের কামনার লক্ষ্য ও ভোগের বস্তু করে রাখে পুরুষতন্ত্র ! সেইখান থেকেই মন-মানসিকতা-মনস্তত্বের গণ্ডী কেটে বেরোতে পারে না নারী ! নারীবাদকে আঘাত হানতে হবে এইখানেই !



বংশানুক্রমে পুরুষতন্ত্রের চালিকাশক্তির আর একটি স্তম্ভ হল এই বংশানুক্রম! এতবড়ো একটি অন্যায় ব্যবস্থা চলে আসছে আবহমান কালব্যাপী ! প্রশ্ন জাগে, আমাদের জন্মদাত্রী গর্ভধারিণী যিনি আমাদের এই পৃথিবীতে আনলেন বংশের সূত্রপাত তার থেকেই নয় কি ? বংশতালিকায় তাঁর ভূমিকা কি গৌন ? এইভাবেই পুরুষতন্ত্র নারীকে খর্ব করে বনসাই করে সাজিয়ে রেখেছে নিজের ইচ্ছাধীন করে! নারীবাদকে রুখে দাঁড়াতে হবে এই অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে! প্রকৃতির সাথে মানব সভ্যতার মূল সংযোগটা এইখানেই বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে আছে! সভ্যতার মঙ্গলের স্বার্থেই এই সংযোগটি উদ্ধার করা একান্ত প্রয়োজন! সেই আত্মউদ্ধারের কাজে এগিয়ে আসতে হবে পুরুষতন্ত্রের পরিভাষায় সেই দ্বিতীয় লিঙ্গকেই!



দ্বিতীয় লিঙ্গের এই যে ধারণা পুরুষতন্ত্রের অধীনে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের চেতনায় বদ্ধমূল হয়ে বসে আছে, এর থেকে মুক্তির পথটা কাটতে হবে নিজেদের সংসার থেকেই! মুক্তি পেতে হবে নারী পুরুষ দুজনকেই! সেই মুক্তির আলোটিকে নিয়ে আসতে হবে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃত পরিসরে! ঘরে এবং বাইরে স্বামীস্ত্রী নিজেদের মধ্যে অর্জিত এই আলোর দীপ্তিটুকু যে দিন সন্তানদের চেতনায় অন্তর্দীপ্ত করে তুলতে পারবে, সেইদিনই নারীবাদ প্রকৃত সাফল্যের প্রথম আলোটুকু দেখতে পাবে ! হয়ত সে কাজ সম্পন্ন করতে বহু মনীষীর অনেক শতাব্দী লেগে যাবে, তবু সে কাজ এই মূহূর্ত থেকেই শুরু করতে হবে আমার আপনারই আপন ঘর থেকে,আর তা’ অদ্বিতীয়াদের নেতৃত্বে রেখেই !


1 মতামত:

  1. কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।“

    কিন্তু নারী যে মানব সভ্যতার অর্ধেক অংশীদার তা মানতে নারাজ পুরুষশাসিত সমাজ।যে শিশুটি মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করে, জন্মের পর থেকে তাকে কপালে টিপ দিয়ে, কানে দুল পরিয়ে, হাতে একটি পুতুল দিয়ে বলা হয় সে মেয়ে। তার পোশাকে, চলনে, বলনে প্রমাণ করা হয় সে নারী। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষেরা ভাবে নারী মানেই পুরুষের ভোগের বস্তু, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, সংসারের দাস। পুরুষতন্ত্রের পরিভাষায় নারী তাই সেই দ্বিতীয় লিঙ্গ !
    একটু আগে কবি কাজী নজরুল ইসলামের উদাহরন দিলাম। তাই অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও আরেকটু লিখি? রবীন্দ্রনাথের মানসী’ কবিতার নারীকে দিয়েই লিখতে শুরু করি।
    “শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
    পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী
    আপন অন্তর হতে। বসি কবি গন
    সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
    …………………………
    …………………………
    লজ্জা দিয়ে সজ্জা দিয়ে দিয়ে আবরণ
    তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন
    পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা
    অর্ধেক মানবি তুমি অর্ধেক কল্পনা।।”
    এ কবিতায় পুরুষ নারীর ২য় বিধাতা। যে পুরুষ অনেক বেশি শক্তিশালী প্রথম বিধাতা থেকে। ১ম টি নারী সৃষ্টির কারণ, ২য় টি নারীর বন্দিত্বের কারণ। কবিতায় পুরুষ সক্রিয় নারী নিষ্ক্রিয়, নারী পুরুষের তৈরি মূর্তি সম্ভোগ সামগ্রী! শেষে নারীর পূর্ণ অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হলো ‘অর্ধেক মানবি তুমি অর্ধেক কল্পনা’ য়।
    বাংলা সাহিত্যের নারী জাগরণমূলক প্রবন্ধ ‘জাগো গো ভগিনী’ তে লেখিকা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী জাগরণের মূলমন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন নারীর প্রকৃত শিক্ষাকে। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষাই একজন নারীর অনগ্রসরতা দূর করে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে।শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর প্রভাব সম্বন্ধে নেপোলিয়ান বলেছেন- ‘‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’’ একথায় নারীবাদের উদ্দেশ্য হলো নারীকে শিক্ষা অর্জন করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হতে হবে, তা হলে আপনাতেই সমাজে নারী তার জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে।আর এটা প্রতিটা নারীকেই সম্যকভাবে উপলব্দি করতে হবে।

    উত্তরমুছুন