ছোটগল্প - শাশ্বতী নন্দী

মেঘ মল্লার
শাশ্বতী নন্দী



মেঘ ভালোবাসতে শিখিয়েছিল আমায় মল্লার। বলত, ভালবেসে মেঘের দিকে তাকাবি, দেখবি পৃথিবীটা কত সুন্দর।

আমরা দুজনেই তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির বাংলা সেকেন্ড ইয়ার। আমি চিরকালই টপার। কী স্কুলে, কী ইউনিভার্সিটিতে। মল্লার অ্যাভারেজ। বড্ড বেশি আয়েশী ছিল ও। মন মেজাজ একেবারে সম্রাটের মতো। সারাদিন মেঘের প্রেমে পড়ে আছে।

তবে ছোঁয়াচে রোগের মত আমার মধ্যেও আজকাল অদ্ভুত এক বিলাসিতা তৈরী হয়েছে। মন খারাপের বিলাসিতা। ইউনিভার্সিটি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে অন্য কোনো এলোমেলো পথে হাঁটি। লোকাল ট্রেনে চেপে চলে যাই সবুজ মাঠ, সোনালী ধানক্ষেত, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দেখতে।

একদিন অমন খামখেয়ালির বেড়ানো সেরে ফিরছি, দেখি গলির মোড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে মল্লার। বেশ রাগী স্বরে বলল, কী রে, কোথা থেকে ক্লাস করে ফিরলি ?

- কেন ? মুচকি হাসলাম আমি। খুব মিস্‌ করছিলি?

- বয়েই গেছে তোকে মিস্‌ করতে। - মল্লার নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল। - আমার নোটসগুলো ফেরত দে। ওগুলোর জন্যই ...

- সত্যি? নোটস নিতে! আমার চোখ নাচছে। ঠোঁটের কোণায় অনেকখানি দুষ্টুমি ।

মল্লার নিজের দৃষ্টি লুকিয়ে বলে, ভ্যানতারা ছাড়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠ্যাং ব্যথা হয়ে গেছে। ফাইন দে। ওই দোকান থেকে দুটো ডবল হাফ স্পেশাল চা আর ওমলেট অর্ডার কর।

- চল হাঁট। আমার বলে পকেটমানি খতম। ভুপেনদার কেবিনের চালু চা খেয়ে কেটে পড়।

- চালু চা! ছাড় ভাই। খাওয়াতে হবে না। হাড় কিপটে একটা। যার ঘর করবি, তাকে একেবারে রাজা বানিয়ে দিবি।

- তাহলে তো তোর সব চাইতে খুশি হওয়ার কথা রে।

মল্লার গম্ভীরভাবে একবার তাকাল আমার দিকে। তারপরেই হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বলে, যত ইচ্ছে স্বপ্ন দেখ, বাঁধতে আমায় পারবি না কোনোদিনও। আমি শুধু মেঘে মেঘে ঘুরে বেড়াব।

- বয়েই গেছে তোকে বাঁধতে। যা না তোর মেঘেদের কাছে। যা। কী যেন সব নামধাম তাদের। সকালে আলতা মেঘ, দুপুরে রুদ্রপলাশ, বিকেলে ... হুঁ!! যত আদিখ্যেতা।

মল্লার হাসছে দাঁত বার করে, এখন তোর মুখটা জাস্ট লাইক মাই আলতা মেঘ।

রাগতে গিয়েও হেসে ফেলি। আস্ত পাগল কোথাকার।

মল্লার হঠাৎ সিরিয়াস। কাছে এসে আমার হাত ধরে, আমি তোকে একজন উইনার দেখতে চাই। তুই তো জয়িতা। হারবি কেন? আমার মত হেরো ভূতদের সঙ্গে জীবন জুড়লে হেরে একদম ভূত হয়ে যাবি।

- ওরে আমার জ্যাঠামশাই রে। রাখ তোর ভাষণ। আমি গটগট করে হাঁটা লাগাই।

শুনি পেছন থেকে মল্লার চেঁচাচ্ছে, কীরে আমার নোটসগুলো দিবি না?

- না। মেঘের কাছে গিয়ে চা।

মল্লার আবার হো হো হাসছে, এখন তোকে দেখতে ঠিক আমার কৃষ্ণকলি মেঘটার মতো হয়ে গেল। শরীরটা কালো, কিন্তু ভেতরে তিরতিরে জলের আলপনা।

টসটসে অভিমান নিয়ে ঘরে ফিরলাম। হঠাৎ মোবাইলে ফোন, জয়ী তুই আমার একটা জিনিস নিয়ে চলে গেছিস। এখুনি ফেরত পাঠা।

- কাল কলেজে গেলে নোটস পাবি। এখন ডিস্টার্ব করবি না।

- ধুর। নোটস ফোটস গুলি মার। আমার কৃষ্ণকলি মেঘটা এখন তোর কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করছে। ওকে এক্ষুনি পাঠা আমার কাছে। ওদের ছাড়া আমি থাকতে পারি না এক মুহূর্ত।

রেগে মেগে ফোন কেটে দিলাম।

একটু পরেই শুরু হল ঝোড়ো বাতাস। বারান্দায় গিয়ে দেখি একখণ্ড কালো মেঘ স্থির দাঁড়িয়ে আমার ঘরের ওপর। ওটাই কি তবে মল্লারের কৃষ্ণকলি? আমায় যেন দেখছে অহংকারী মুখ নিয়ে। অহংকার তো হবেই। মল্লারের ভালবাসা পেয়েছে যে।



(দুই)

রৌদ্র সেনগুপ্ত, মল্লারের পিসতুত দাদা। আমার এক বছরের সিনিয়র। ফিজিক্স থার্ড ইয়ার। একদিন কলেজ ফেস্টে আলাপ হয়েছিল। বুদ্ধিদীপ্ত, ঝকঝকে ছেলে। যথেষ্ট কেরিয়ার সচেতন। ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াতের সময় টুকটাক কথাবার্তা হয় আমাদের।

এদিকে মল্লারের মেঘ বিলাস বাড়াবাড়ি পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। রোজ ছুটির পরে আমায় নিয়ে সুকান্ত সেতুর ওপর যাওয়া চাই। না গেলেই গোঁসা। সেতুর মাথায় দাঁড়িয়ে ও আমায় আঙুল তুলে শঙ্খচূড়া মেঘ, আলতা মেঘ, আরও কী সব নামের মেঘেদের চেনায়। প্রথম প্রথম রাগ ধরত। এখন কিন্তু আমিও মগ্ন ওই মেঘ বিলাসে।



(তিন)

গোটা এক সপ্তাহ ধরে কলেজ ডুব মেরে বসে আছে মল্লার। না বলে ক’য়েই একদিন হানা দিলাম। মেসবাড়ি যেমন হয়। ছন্নছাড়া টাইপ। হাট করে খোলা ঘরের দরজা। কিন্তু ঘরে নেই তো বাবু। তরতর করে ছাদে উঠে যাই। দেখি দক্ষিণমুখো হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পাগল মল্লারটা।

আমায় দেখল তবে চোখে অচেনা দৃষ্টি। সামনে গিয়ে কনুই ঝাঁকিয়ে বলি, ওই, ছাদে উঠে কার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছিস রে ? কলেজের খাতায় তো এবার নাম কাটা পড়বে। । পরীক্ষা দিবি না

ও অন্যমনস্ক। বলে, আর বলিস না। দু দিন আগে আকাশে এক টুকরো মেঘের উদয় হয়েছে। শিশু মেঘ । বড্ড ছটফটে। নজরে নজরে না রাখলে পথ হারিয়ে ফেলবে।

বোঝো কারবার! আমি ফেড আপ। মল্লারের এই বাড়াবাড়ি রকমের মেঘ প্রীতি আর ভাল লাগছে না। এমন ছেলেকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখা যায় ?

ইদানিং রৌদ্রের সঙ্গে আমার মেলামেশা বেড়েছে। এত গুছনো ছেলে। নিজের ফিউচার নিয়ে নিখুঁত একটা প্রোগ্রামিং করে ফেলেছে। আমাকেও স্বপ্ন দেখায়। বুঝতে পারি ধীরে ধীরে আমি সেই স্বপ্নের জালে আটকা পড়ছি।



(চার)

রৌদ্রকেই জীবন সঙ্গী করে ফেললাম। উচ্চ পদস্থ, সুপুরুষ, বিত্তবান। আর কী চাই একটি মেয়ের? তাছাড়া আমিও তো টপার। নীচের দিকে তাকাতে ভালো লাগে না। শুধু মেঘ বৃষ্টির খেলা দেখে কি জীবনে চলা যায় ?

মল্লারটা সত্যি জ্যাঠামশাই টাইপ। হাসি মুখে মেনে নিল ব্যাপারটা। বলে, চল আকাশে একশো বেলুন ওড়াই। রৌদ্র এত ভাল ছেলে! তোর সঠিক সিলেকশন। খুব সুখী হবি তুই। দেখবি।

কিন্তু সুখের সব উপকরণ সাজিয়েও সুখের ঘরের চাবিটা ঈশ্বর আমায় দিলেন না। রৌদ্র বড় বেশি রৌদ্রজ্জ্বল। বড্ড উচ্চাকাঙ্খী। রাতদিন শুধু ‘টার্গেটের’ গল্প করে। শুধু ওপরে ওঠার নেশা। একদিন এগুলো আমায় টেনেছিল ঠিকই। কিন্তু এখন মনে হয় রৌদ্রের মধ্যে যদি একটু ছায়া থাকত তাহলে বেশ হত। একটু জিরোতে পারতাম। আমার নরম স্বপ্নগুলো এভাবে ঝলসে যেত না।

এখন আকাশের দিকে চোখ পড়লেই আমি থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ি। আঁতিপাতি করে খুঁজি মল্লারের মেঘগুলোকে। কিন্তু না, কারোকে চিনতে পারি না। সব কি হারিয়ে গেল ওরা ?

রৌদ্র একদিন অফিস থেকে থমথমে মুখে ফিরে এল। বলে, খুব খারাপ একটা খবর আছে। মল্লার খুব অসুস্থ। হসপিটালে অ্যাডমিটেড। সর্দি জ্বর, খুকখুকে কাশিতে ভুগছিল অনেকদিন। পকেটে পয়সা নেই। তাই হাতুড়ে ডাক্তার ধরেছিল। কাল বাড়াবাড়ি হয়েছে। তাই বাড়িওলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ... চল একবার দেখে আসি।

সমস্ত পৃথিবীটা দুলে উঠল চোখের সামনে। চিরটা কাল মল্লার আমার সঙ্গে শত্রুতা করে গেল। একটা খেলাঘর বেঁধেছিলাম। সেটাও কি ভেঙে দিয়ে চলে যেতে চাইছে ?

আমাকে পাশে বসিয়ে সাঁই সাঁই গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে রৌদ্র। সুকান্ত সেতুর ওপর দিয়ে গাড়িটা যেতেই সেই নীল বিকেলের ছবি আমায় চারি দিক থেকে ঘিরে ধরল। ওই তো, ওখানে দাঁড়িয়েই তো মল্লার আমায় মেঘ চেনাতো। ওখানে দাঁড়িয়ে ও বলত ...

আমি রৌদ্রের হাত চেপে ধরলাম, তুমি গাড়ি থামাও। আমি এখানে একটু দাঁড়াব !

- সে কী ! মল্লারকে দেখতে যাবে না ?

- যাব। একটু পরে। এই আকাশ জুড়ে তো মল্লারের মেঘ বন্ধুরা আগে দাঁড়িয়ে থাকত। একটু খুঁজে দেখি ওদের পাই কি না। ওদের খবর নিয়ে গেলে মল্লার খুব খুশি হবে।

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে, কী যে বল তুমি, বুঝি না, বাবা। এনিওয়ে। দেরী কোর না।

আমি আকাশের দিকে আবার চোখ ফেরাই। হঠাৎ দেখি সাদা, গোলাপি, কমলা, সব মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। আর একটা বক মহানন্দে সেই মেঘের ভেতর শরীর ডুবিয়ে সাঁতরে বেরাচ্ছে। আমাকে দেখেই বকটা ডানা ঝাপটে কাছে চলে এল। তারপর একটু ছুঁয়ে আবার উড়ান দিল আকাশে।

আমি অবাক। এটা কী হল ? ও কি কিছু দিয়ে গেল আমায় ? হ্যাঁ, বোধহয়। বকটা মল্লারের সব মেঘ বন্ধুদের স্পর্শ আমায় দিয়ে গেছে। সঙ্গে আকাশের খানিকটা নীল। এগুলো পেলেই বোধহয় মল্লার সুস্থ হয়ে উঠবে।

আমি রৌদ্রর কাছে ছুটে ছুটে আসি, বলি, তাড়াতাড়ি চল। হাতে একদম সময় নেই। কটা জরুরি জিনিস মল্লারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। দেখবে তাহলেই ও সুস্থ হয়ে উঠেছে। - বলতে বলতে আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম। - অনেক যত্ন করে খেলাঘরটা সাজিয়েছি আমি। এত তাড়াতাড়ি কি ভেঙে ফেলা যায় ?


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন