সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়


বাংলা সাহিত্যে হেমন্তকাল নিয়ে তেমন চর্চার কথা বিশেষ জানা নেই। সাহিত্য-সরস্বতীর সমস্ত কৃপাদৃষ্টিটুকু গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-শীত-বসন্তই ভাগ করে নিয়েছে। শরতের উৎসব যাত্রার শেষে শীতল অতিথির আগমন বার্তা নিয়ে আসে হেমন্ত।

কার্তিক-অগ্রহায়ণ, এই দুই মাস হেমন্তকাল। এক সময় পূর্ববাংলার ঘরে ঘরে প্রচলন ছিল আশ্বিন মাসের শেষদিনে রান্না করা অন্নে জল ঢেলে রেখে পরের দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের প্রথম দিন খাওয়া হতো; কেননা প্রবাদ ছিলঃ “আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খায়, যেই বর মাঙ্গে সেই বর পায়”......... এই সংস্কৃতি হয়তো আজ ইতিহাস।।

বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন বাদশাহ আকবরের নবরত্ন সভার প্রভাবশালী সদস্য ফতেহ্‌উল্লাহ্‌ সিরাজ। এক-একটি নক্ষত্রের নামানুসারে বাংলা মাসগুলির নামকরণ করা হয়। সেই অনুসারে কৃত্তিকা ও মৃগশিরা – এই দুই নক্ষত্র থেকে কার্তিক ও মার্গশীর্ষ – এই দুই মাসের নামকরণ হয়। এই সময় এই মার্গশীর্ষ মাসটি থেকে বছর শুরু হতো; অগ্র অর্থাৎ শুরু এবং হায়ন অর্থাৎ বৎসর – এই সূত্র ধরে পরবর্তী কালে মার্গশীর্ষ বদলে হয়ে গেল অগ্রহায়ণ।

হেমন্ত শরতের পরিনতি, শীতের প্রস্তুতি। হাল্কা কুয়াশার আচ্ছাদনে নরম সূর্যকে আরও নরম করে দিয়ে শিশিরের নিঃশব্দ চরণে আসে বাংলার এই চতুর্থ ঋতু, হেমন্ত; সেই হেমন্তে যেন আজ কোন্‌ বসন্তেরই বাণী –

আর হেমন্তের এই মায়াবী বাসন্তী আলো মেখে একেবারে ঝলমলে সাজে প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা। এই সংখ্যায় থাকছে রম্য রচনা, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, অনুগল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, ধারাবাহিক ‘নাড়ু রহস্য’, সম্পর্ক নিয়ে লেখা একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, ছোটোদের পাতা, ভ্রমন কাহিনী; এছাড়া, মহাভারতের কথা, রান্নাঘরের মতো নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে।

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা পত্রিকাটির মানোন্নয়ণে আমাদের সহায়তা করবে।

জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।।
নমষ্কারান্তে,

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

বিশেষ রচনা - অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

চণ্ডালিনী-রাধা : একটি আলেখ্য ...

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়




হম, সখি দারিদ নারী
জনম অবধি হম পীরিতি করনু,
মোচনু লোচনবারি।
রূপ নাহি মম, কছুই নাহি গুণ,
দুখিনী আহির জাতি-
নাহি জানি কছু বিলাস-ভঙ্গিম
যৌবনগরবে মাতি-

প্রকৃতির শরীরে তবুও বসন্ত আসে। পিক কুহু কুহু গায়। মৃদুমন্দ বাতাস বয়।
বসন্ত আওল রে!
মধুকর গুন গুন অমুয়ামঞ্জরী   কানন ছাওল রে

প্রকৃতির বুক ছুঁয়ে দখিনার দাক্ষিণ্যে রভসরসগান। প্রাণের পালে নতুন দোলা। এর অর্থ কী ও জানে না। শুধু ‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিলে তিলে আইসে যায়’উচাটন মন, নিশ্বাস সঘন। কানে ভেসে আসে গান। প্রকৃতি চণ্ডালিকা চমকে চায়। ওর চেনা সেই কুয়োতলার গণ্ডি ছাড়িয়ে পথের পাশে দাঁড়ায় চুপটি করে। চেয়ে দ্যাখে একদল ফুলওয়ালি নববসন্তের ডালি সাজিয়ে দ্বারে দ্বারে ফিরছে আর গাইছে-

বনমাধুরী করিবি চুরি
আপন নবীন মাধুরীতে
সোহিনী রাগিনী জাগাবে যে তোদের
দেহের বীণার তারে তারে
                                    আয় আয় আয়।।

আজন্ম অস্পৃশ্য চণ্ডালিকা বন্ধুহীনা। ফুলপসারিনীদের এমন সুরেলা আহ্বানে ওর মুহূর্তে মনে হল এতদিনে বুঝি ভগবান একদল সখিকে পাঠিয়েছেন তার জন্য। আর সে বন্ধুহীনা নয়কিন্তু না, ক্ষণিকের ফোটা ফুলের মতোই ঝরে পড়ল চণ্ডালিকার ভুল। ফুল চাইতেই ঘৃণা জুটল কপালে। ফুল ছোঁবার অধিকারও তার নেই। কিন্তু কেন কে জানে, মন বলছে, তার ফুলের আজ বড়ো প্রয়োজন। কিছু নিবেদন আছে তার। কাকে? ‘কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি, শ্যামচন্দ্র নাহি রে’একে একে দইওয়ালা, চুড়িওয়ালা সকলের কাছ থেকেই প্রত্যাখ্যাত হল চণ্ডালিনীর ঝি। এটাই কি ওর প্রাপ্য ছিল? এর জন্যেই কি সে প্রতিদিন দেবতার পায়ে ফুল দেয়? পূজাদীপ জ্বালে মন্দিরদ্বারে? কেন দেবে ফুল? যে তাকে সারাজীবন রেখে দিল অপমানের ধিক্কারে! কেবল নিচু জাতের দোহাই দিয়ে এ জগতের সকল কিছু ভালোর থেকে সে বঞ্চিতা। তাকে মানতে হবে সে শুধুমাত্র এক চণ্ডালিনী রমণী। কোনও চণ্ডালেরই সেবায় লাগতে পারে সে। তা ভিন্নে নয়।

শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর!
বিরহ সাথি করি দুঃখিনী রাধা         রজনী করত হি ভোর।

চণ্ডালিকার মতো রাধিকাও নিযুক্ত ছিল তার স্বামী আইহনের সেবায়। সঙ্গে সমগ্র শ্বশুরকুলেরও একমাত্র সেবাইত সে-ই। জগতের আর কোনও আকর্ষণেই তাকে মন দিতে নেই। তবুও শ্যামের জন্য অনন্ত আকুল প্রতীক্ষা ঘোচেনি তার। যৌবনজ্বালার উর্ধ্বে উঠেছিল হৃদয়জ্বালা। মুক্তি চাইছিল চণ্ডালিকা, মুক্তি খুঁজছিল রাধা...অন্তরে অন্তরে। এমন সময়...


যো সন্নিসিন্নো বরবোধিমূলে
মারসম্ সেনং মহতিং বিজেত্বা...

পথ বেয়ে চলে গেল বৌদ্ধভিক্ষুগণ, চণ্ডালিকার জীবনে। ওদিকে যমুনার তীরে কদম্বতরুমূলে বাঁশি উঠল বেজে। ‘শুন সখি বাজই বাঁশি... শশীকর বিহ্বল নিখিল শূন্যতল এক হরষ রসরাশি’আরও চঞ্চলতায় ব্যাকুল হয়ে উঠল দুটি দিকের দুটি হৃদয়।
                           একমনে কী যেন ভাবছে প্রকৃতি। পথ বেয়ে বাতাসের মতো বয়ে যাওয়া বৌদ্ধমন্ত্রের সুর বেলা বাড়ার খবরটুকুও পৌঁছোতে দেয়নি প্রকৃতির প্রাণে। রাজবাড়ির ঘণ্টা বেজে গেছে ঢং ঢং করে। তীক্ষ্ণ রোদে শুকনো উঠোন পিপাসায় হা হা করছে
বিরহ বিষে দহি বহি গেল রয়নী, নহি নহি আওল কালা

রাধিকার এই অভিব্যাক্তির ছায়াতেই খুঁজে পাই চণ্ডালিকা বা প্রকৃতিকে। সেও বলছে, ‘আঁধার অঙ্গনে প্রদীপ জ্বালিনি, দগ্ধ কাননে আমি যে মালিনী,/ শূন্য হাতে আমি কাঙালিনী করি নিশিদিনযাপনা’ প্রকৃতির মা মায়া তাড়া দিয়েও মেয়েকে কোনও কাজ করাতে পারে না। বিরক্ত হয়ে চলে যায়। চণ্ডালিকাও ভীষণ আলস্যে ছলছল চোখে ওর চেনা কুয়োতলাতে স্নান করাতে থাকে মা মরা বাছুরটিকে।
 হঠাৎ এক সুর। অনেকটা করুণ বাঁশির মন ভাসানিয়া ডাকের মতো। ‘জল দাও আমায় জল দাও। তাপিত পিপাসিত আমায় জল দাও’ কৃষ্ণও পিপাসার্ত ছিল রাধিকার তৃষ্ণায়। তাই সে বাঁশির সুরে রাধাকে রোজ ডাক পাঠাত। রাধিকা ভয় পেয়েছিল শ্বশুরঘরে নিন্দা হবে বলে। সে যে একজনের অর্ধাঙ্গিনী, সহধর্মিণী। সমাজ তাকে একপুরুষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রকৃতিও ভয় পেলসেও যে চণ্ডালকন্যা। তাপিত শ্রান্ত বুদ্ধশিষ্য আনন্দকে একপুট জলদানের পুণ্য থেকে সমাজ যে তাকে বঞ্চিত করে রেখেছে। ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের আড়ালে। ‘ক্ষমা করো প্রভু’, ‘মোর কূপের বারি অশুচি’
হলেই বা! স্বয়ং কৃষ্ণ দেবতার অবতার হয়েও রাধিকাকে বুঝিয়েছিলেন, প্রেমে কোনও পাপ নেই। প্রেম সর্বদা নির্মল সুন্দর। প্রেমিকের আহ্বানে প্রেমিকার সাড়া দেওয়া সর্বোপরি প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেওয়া, সে তো পরোক্ষে প্রেমেরই পুজো করা। রাধিকা তখন আর কেবলমাত্র রাধা নয়, সে এক মানবী। যার মন আছে, প্রাণ আছে, ইচ্ছে আছে। সমাজ কেন? ব্রহ্মাণ্ডের কোনও নিষেধাজ্ঞাই মানুষের মনের ওপর চলে নামান আর হুঁশ নিয়েই মানুষ। সে সমাজবদ্ধ হতে পারে, তা বলে সমাজের সম্পত্তি নয়। চণ্ডালিকাকে বলা আনন্দের কথাতেও এই মতেরই আভাস মেলে, ‘যে মানব আমি সেই মানব তুমি, কন্যা’শুধু এই একটি কথাই সকল জীবনের সার। দুই নারীই মেনেছিল সেই বচন। একটা কথাই চণ্ডালিকার অন্তরমহলের অস্পৃশ্য পর্দাটিকে মুহূর্তে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। জন্ম নেয় এক মানবী প্রকৃতি। উত্তরণ ঘটে তার। আনন্দকে জলদান করে পরমমুক্তির লগ্নে গেয়ে ওঠে - ‘এ নতুন জন্ম নতুন জন্ম নতুন জন্ম আমার’ তরঙ্গ নেচেছিল হৃদয়ে, মনে, শরীরে। প্রকৃতির অভিসার শুরু হয়েছিল সেই মুহূর্তে, চুপিসারে। আশঙ্কায় চণ্ডালিকার মায়ের বুক কেঁপে উঠেছিল। বারংবার বলেছিল, ‘বেছে নিস মনের মতো বর- রয়েছে তো অনেক আপনজন। আকাশের চাঁদের পানে হাত বাড়াস নে’তবু কন্যা তার সে কথা শোনে না। যে ফুল তার কানন আলো করে গেছে, যে তার চক্ষের তৃষ্ণা, বক্ষের পিপাসা সেই দীপ্ত সমুজ্জ্বল শুভ্র সুনির্মল, সুদূর স্বর্গের আলোকে তার চাই-ই। মনমোহনের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে এমনি দশা হয়েছিল বৃন্দাবিপিনের শ্রীমতীর
হেন রূপ কবহুঁ না দেখি।
যে অঙ্গে নয়ন থুই        সেই অঙ্গ হৈতে মুঞি
ফিরাইয়ে লইতে নারি আঁখি।।

অনুরাগিনী প্রকৃতি ঠিক এমনই। শুধু তার চরিত্রে যোগ হয়েছিল প্রকৃত মানুষের সম্মান পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্খার হাত ধরেই প্রেম এসেছিল তার জীবনে নিঃশব্দ চরণে। পূর্বরাগ, অনুরাগ তারপর অভিসার। ভানুঠাকুরের রাধা বলছে-- 

একলি যাওব তুঝ অভিসারে
তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে-
ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি
                  পন্থ দেখায়ব মোর।


রবিঠাকুরের চণ্ডালিকা বা প্রকৃতির কথায়—
আমি ভয় করিনে মা, ভয় করিনে।।

প্রেম নির্ভয়। রাধা আর চণ্ডালিকার অভিসারে যেন তারই প্রমাণ। একজনের সামনে ভয় দাড়িয়েছে অভয় মূর্তি ধরে। ‘মন্দির বাহির কঠিন কপাট’ ঠেলে সে একাই যেতে পারে মানস-সুরধুনীর ওপারে। আর অন্যজন ভয়কে জয় করেছে আনন্দকে পেতে। কিন্তু কথা হল, রাধার অভিসারের কথা আমরা সকলেই জানি। বলা ভালো, দেখতে পাই। কিন্তু প্রকৃতিতো অভিসারে যায়নি। সত্যি কি তাই? অভিসারের অর্থ, প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেতস্থানে গমন। পদাবলীতে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই রাধা অভিসারিকার সাজে ঝড়-বাদল তুচ্ছ করে ঘন আঁধিয়ারে পথ চলেছেআর প্রকৃতি...আনন্দকে পাওয়ার জন্য সমাজের সকল বন্ধনকে তুচ্ছ করেছে (রাধিকার ঝড়-বাদলকে তুচ্ছ করার সাথে তুলনীয়) বলেছে, ‘ শ্রাবণের কালো যে মেঘ তারে যদি নাম দাও চণ্ডাল/ তা ব’লে কী জাত ঘুচিবে তার, অশুচি হবে কী তার জল’অথবা ‘ রাজার বংশে দাসী জন্মায় অসংখ্য, আমি সে দাসী নই। দ্বিজের বংশে চণ্ডাল কত আছে, আমি নই চণ্ডালী।।’ রাধা বলছে, ‘ঘর কৈলুঁ বাহির, বাহির কৈলুঁ ঘর। পর কৈলুঁ আপন, আপন কৈলুঁ পর।।’ একজন নিজেকে খুঁজে পেয়েছে বৌদ্ধভিক্ষু আনন্দের স্পর্শে। আর অন্যজন পরমাত্মা কৃষ্ণের সুরস্পর্শে মূর্ছিত ও প্রণয়াসক্ত হয়ে আপনজন, ঘর সব ত্যাগ করেছে। দুজনেই উপেক্ষা করেছে আজন্ম লালিত হওয়া পরিচয়ের। খুঁজে নিয়েছে আপন আপন পরিচয়। এক মানবীর পূর্ণ অধিকারে।
তবু আপাত দেখায় চণ্ডালিকার জীবনে রাধিকার মতো ঝড়ের রাত আসেনি। বিপদসংকুল কণ্টকাকীর্ণ মেঘমন্দ্রিত পথ অতিক্রম করতে হয়নি। কিন্তু গভীরে দেখলে এ সকল কিছুই ধরা পরে প্রকৃতি মানে চণ্ডালিকার জীবনে। স্বয়ং আনন্দই অশুচির দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে ঝড়ের বার্তা। যার প্রবল দাপটে প্রকৃতির জীবন থেকে খসে গেছে নকল পরিচয়ের মুখোশ। তীব্র বাসনায় মা মায়াকে কালনাগিনীর মন্ত্র পড়তে বাধ্য করেছে প্রকৃতি। কারণ মনে মনে আনন্দের অভিসারী হয়েছে প্রকৃতি। প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যেই মায়াদর্পণে দেখতে চেয়েছে প্রিয়তম আনন্দের দিব্যমূরতি। একটা মানুষ যখন ঘর ছেড়ে হেঁটে চলে যায়,  তখন আমরা তার চলে যাওয়াটা দেখতে পাই। কিন্তু যে মানুষটা ঘরের কোণে আনমনে বসে থাকে বা কোনও একটা মানুষের প্রতীক্ষার বেদনা ভুলতে নিজগৃহকাজে মন সঁপে দেয়, ডাকলে সহজে সাড়া মেলে না, তার মনও যে হারায় লোকচক্ষুর আড়ালে শতেক যোজন দূরে। সেও এক যাওয়া। শরীরের গণ্ডী ছাড়িয়ে মনপবনের নাওয়ে ভেসে প্রিয়মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেতস্থানে গমনসেখানে শরীর নয়, ঘটে মনের অভিসার। চণ্ডালিকা তার কাজে, চঞ্চলতায়, আকুতিতে, হাহাকারে সেই পথেরই আভিসারিকা। পার্থক্য শুধু একটাই। রাধা জানত তার কৃষ্ণের মানস-সুরধুনির খোঁজ, তাই সে নিজেই ছুটে গিয়েছিল রমণীমোহনের কাছে। কিন্তু আনন্দ যে বৌদ্ধভিক্ষু। কোন পথে তার চলা তা কেউ জানে না। তাই চণ্ডালিকা মন্ত্রবলে টেনে এনেছিল আনন্দকে তার নিজের কাছে। মোদ্দাকথা সেই ভালোবাসা। সে পথও খুব সহজ নয়। ‘ কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝঞ্ঝা— মহান বনস্পতি ধূলায় কি লুটাবে, ভাঙবে কি অভ্রভেদী তার গৌরব’মায়ামন্ত্রবলে আনন্দ যন্ত্রণাদীর্ণ। দর্পণে ফুটে ওঠে আনন্দর সেই বেদনার্ত পাংশু প্রতিমূর্তি। সহ্য করতে পারে না চণ্ডালকন্যা। আনন্দের যন্ত্রণা যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে তাকেই বেত্রাঘাত করছে। ‘আমি দেখব না, আমি দেখব না, আমি দেখব না তোর দর্পণ’এও যে এক ঝড়। বাইরের ঝড় আর অন্তরের ঝড় দুই দুরকম। কিন্তু কষ্টের সত্ত্বাটি যে একই। যে দুঃখ সইছে যে দুঃখ দিচ্ছে দুজনেরই বুক ফাটে। তাইতো প্রকৃতি বলে, ‘ বুক ফেটে যায়, যায় গো, বুক ফেটে যায়।’
 বাকি রইল বিপদসংকুল কণ্টকাকীর্ণ মেঘমন্দ্রিত পথ। আখ্যানে দেখতে পাই, মা মায়া প্রকৃতিকে বলছে, ‘বল দেখি, বাছা, কী তুই দেখছিস আয়নায়।।’ উত্তরে প্রকৃতি বলছে –
ঘন কালো মেঘ তাঁর পিছনে
চারিদিকে বিদ্যুৎ চমকে,
অঙ্গ ঘিরে ঘিরে তাঁর অগ্নির আবেষ্টন—
যেন শিবের ক্রোধানলদীপ্তি!

এই পথ আনন্দ পেরোলেও মনে মনে ঠিক এমনই প্রলয়ংকর মরু পেরোচ্ছে প্রকৃতি। তাই সেও এই একই কষ্টে জর্জরিত। আনন্দকে সেই সর্বনাশের মধ্যে দেখে তারও বুক কাঁপছে। শিউরে উঠছে তাঁর সর্বাঙ্গ। তাই কিছুটা ক্রুরবাক্যেই মাকে সে বিঁধছে—

তোর মন্ত্রবাণী ধরি কালীনাগিনীমূর্তি
গর্জিছে বিষনিশ্বাসে,
                                কলুষিত করে তাঁর পুণ্যশিখা।।



তবু প্রকৃতির নিষ্ঠুর পণ। হার সে কিছুতেই মানবে না। অলক্ষে সে ভয় পায়, পাছে আনন্দকে চিরতরে সে হারিয়ে ফেলে। পরক্ষণেই তাই মাকে বলে—‘দুর্বল হোস নে, হোস নে। এইবার পড় তোর শেষনাগমন্ত্র- নাগপাশবন্ধনমন্ত্র।।’ রাধাও হাতের কঙ্কণ পণ রেখে নাগবশীকরণ মন্ত্র শিখেছিল, ‘ কর কঙ্কণ পণ ফণীমুখবন্ধন শিখই ভূজগগুরু পাশে’রাধা নাগমন্ত্র শিখে প্রিয়তমের কাছে গিয়েছিল, চণ্ডালিকা নাগমন্ত্রের বলে আনন্দকে নিজের কাছে টেনে এনেছিল।

হিয়ে হিয়ে অব রাখত মাধব    সো দিন আসব সখি রে—

আনন্দ এসেছে। ‘আহা, কী ম্লান, কী ক্লান্ত- আত্মপরাভব কী গভীর’এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট, এত ঝড়ের পরে এবার দর্শন, মিলন।

প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,
দিলে তার এত মূল্য,
                           নিলে তার এত দুঃখ।
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো—

প্রকৃতির রাধা-হৃদয় অনুতাপে, আনন্দে, ভালোবাসায়, মিলনে অবনত। আরেক জীবাত্মা খুঁজে পেল তার পরমাত্মাকে। পদাবলির রাধা ঝড়ের রাতে সেই যে ঘর ছেড়েছিল পরমাত্মা কৃষ্ণের জন্য, তারপর পৌঁছোতে কি পেরেছিল? হয়েছিল কি মিলন? সে উত্তর দৈবের মতোই ধোঁয়াশা, মূর্তির মতোই কাল্পনিক, ভক্তের মতোই আস্তিক। ভানুঠাকুর তার অস্পৃশ্য নায়িকাকে হতাশার ধোঁয়াশায় রাখেননি। নিচ হয়েও উচ্চকে টেনে নামিয়ে আনার ক্ষমতা দিয়েছেন। প্রমাণ করিয়েছেন, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে/ আমায় নইলে ত্রিভূবনেশ্বর/ তোমার প্রেম হত যে মিছে’অবশ্য তার জন্য প্রকৃতি চণ্ডালিকা ক্ষমাপ্রার্থিনী ছিল। বলেছিল, ‘ ধূলি হতে তুলি নাও আমায় তব পূণ্যলোকে।’ এইখানেই প্রকৃতি কোনও কবির ভাবাবেগে সৃষ্ট বঞ্চিতা নায়িকা বা দয়িতের দয়িতা নয়, সে এক সাধারণ নারী। যার চাওয়া আছে, প্রার্থনা আছে আবার মান-হুঁশের মিশ্রনে মাথা নোয়ানোর ক্ষমতাও আছে। সে তার সমগ্র জীবন দিয়ে দেবী নয়, মানবী হতে চায়। রাধিকা যেমন ছিল। সেও মানবী সত্তার জোরেই বারবার কৃষ্ণের বংশিধ্বনি শুনে নিলাজ যামিনীতে লাজহারা হয়ে ঘর ছেড়েছে। প্রকৃতিও লজ্জা ভুলে মাকে প্রতিনিয়ত অনুরোধ করেছে মন্ত্রবলে তার মনের মানুষটিকে এনে দেওয়ার জন্য। প্রেম নির্লজ্জ। প্রেম রাঙা পলাশের মতো নরম পাপড়ির আদরে ঢেকে রাখে সদ্য ফোটা ভালোবাসার কুসুমটিকে।
                            রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের দুটো সত্ত্বা। প্রকৃতি, অর্থাৎ চণ্ডালিকার হৃদয়ে রাধা বসেছিল। আনন্দ ছিল সেই রাধারই কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ছিল কালো, রাধা গৌরবর্ণা। কিন্তু আনন্দ ছিল দীপ্ত সমুজ্জ্বল স্বর্গের গৌর আলো। আর চণ্ডালিকা কৃষ্ণবর্ণা। পদাবলিতে আলো ছুটেছে কালোর অভিসারে। ভানুঠাকুরের আখ্যানে কালো সেজেছে আলোর অভিসারিকা হয়ে। যুগে যুগে কালে কালে পদকর্তারা প্রেমকে শিখণ্ডি করে আলো-আঁধারের এমনই লীলার ক্ষেত্র রচিত করে চলেছেন... তাঁদের দেওয়া নামেই আমরা প্রেমকে চিনি নতুন করে... দৃশ্যপট পালটায়, পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে... পথ কিন্তু সেই একটাই... পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন...

রম্যরচনা - নারায়ণ রায়

পটাই-বাবুর নিরুদ্দেশ যাত্রা
নারায়ণ রায়



পটাই-বাবু গত কদিন ধরে নিখোঁজ, কিম্বা নিরুদ্দেশ বলা যেতে পারে। সাতদিন অপেক্ষার পর অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও, নিতান্তই বন্ধুদের পরামর্শে তাঁর পুত্র, অনাদীচরণ স্থানীয় কোতোয়ালিতে গিয়ে একটা নিখোঁজ ডায়েরী করে এলেন। আসলে সবাই তাকে বোঝালো যে, ডেথ সার্টিফিকেটের ন্যায় নিখোঁজ ডায়েরীর কপিও ভবিষ্যতে অনেক সময়ে, বিভিন্ন বৈষয়িক কাজে ভীষণভাবে প্রয়োজনে লাগতে পারে। তবে এতকিছু ঘটার পরেও পাড়ার লোকজন কিন্তু কেউই সেভাবে জানতে পারলো না যে, তাঁর বাড়িতে এত-বড় একটা অঘটন ঘটে গেছে। সেদিন পটাই-বাবুর সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু লাটাই-বাবু, অনাদীচরণকে তার পিতৃদেবের এই আকস্মিক অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাওয়ায় উত্তর পেলেন, পটাই-বাবু তীর্থ দর্শনে গেছেন। এ কথা শ্রবণ করে লাটাই-বাবু যার পর নাই বিস্মিত হলেন, যে পটাই-বাবু পাড়ার মন্দিরে কদাপি পঞ্চাশ পয়সাও প্রণামী দেননা, তার এহেন ঈশ্বর ভক্তির কারণ কি, সেটি অনেক চেষ্টা করেও লাটাই-বাবুর বোধগম্য হ’ল না । এদিকে অনাদীচরণ যথারীতি তার ঘরে, মিউজিক সিস্টেমে ‘ধানী-পটকা’ ব্যান্ডের ‘শ্মশানে অশান্তি’ অ্যালবামটি তারস্বরে চালিয়ে দিয়ে দুবাহু এবং পদযুগল আন্দোলিত করে অবিরাম নৃত্য করে চলেছেন। পটাই-বাবুর একমাত্র কন্যা রটন্তীও যথারীতি জিনস আর টপ পরিধান করে, অধর এবং মুখমণ্ডল রঞ্জিত করে, নিয়ম মত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন তার বয়-ফ্রেন্ডের সঙ্গে সিটি সেন্টার, আইনক্স কিম্বা সাউথ সিটিতে হাজিরা দানের কর্তব্য পালন করে চলেছেন। পটাই-বাবুর স্ত্রী পুটিরানী মনে মনে ভাবছেন, যাক ক’দিনের জন্য অনন্ত কিপটে বুড়োটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে, দুবেলা কাঁচা পেঁপের তরকারি খেয়ে খেয়ে মুখটা একেবারে হেদিয়ে গেছে, এবং মনের আনন্দে রসুই কক্ষে দুইবেলা পাঁঠার মাংস, লুচি ও পলান্ন রন্ধনে ব্যস্ত রয়েছেন। এমতাবস্থায় নিরুদ্দেশের নবম দিবস সকাল ন’টা নাগাদ পটাই-বাবু, বড়ই প্রফুল্ল চিত্তে ঘন্টুরানীকে সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে অবতরণ ক’রলেন। এমন আনন্দদায়ক সকাল তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পূর্বে কখনো দেখেছেন বলে স্মরণ করতে পারলেন না। স্বল্প বয়সে শরীর এবং মনে বারংবার পুলক জাগলেও, প্রেম নামক বস্তুটির সঙ্গে কদাপি পরিচিত হ’বার সুযোগ পান নি। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে একজন পরনারীর সঙ্গে স্ত্রীর চক্ষু ফাঁকি দিয়ে সমুদ্র দর্শনের যে এইরূপ আনন্দ, তাহা আবিষ্কার ক’রে যুদ্ধ জয়ের আনন্দে ঘন্টুরানীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে ঘন্টুরানীর কাঁধে হাত রেখে সকালের কলকাতা দর্শন করতে করতে গৃহ অভিমুখে রওনা দিলেন। অবশেষে রাসবিহারীর মোড়ে পৌঁছে যথারীতি ট্যাক্সিটি ছেড়ে দিলেন, অবাঙ্গালী ট্যাক্সি চালক যখন বললেন, “বাবু আপ পচাস রূপাইয়া য্যাদা দে দিয়া”, চিরকালের কিপটে বলে পরিচিত পটাই-বাবু তার উত্তরে বললেন, “ইয়ে তুমহারা বকশিস হায়।” ঘন্টুরানীর বাড়ি এসে গেছে, তাঁকে বিদায় দেবার কালে পটাই-বাবুর সম্প্রতি ইংরাজি সিনেমাতে দেখা দৃশ্যের ন্যায় ঘন্টুরানীকে দুহাত বাড়িয়ে হাগ করবেন ভেবে, দুহাত বাড়াতেই ঘন্টুরানী টা টা বাই বাই বলে সুরুৎ ক’রে ছিটকে গিয়ে গলির মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। অগত্যা পটাই-বাবু তার গৃহের উদ্দেশ্যে একটি বেহালা গামী বাসে উঠে বসলেন। পাড়ায় পৌঁছতেই একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন যে, নয়দিন আগে এই পাড়াকে যে অবস্থায় তিনি দেখে গিয়েছিলেন, বর্তমানে তার বিশেষ কোন উনিশ বিশ হয়নি। তাঁর গৃহের নিকট পৌঁছতেই বুঝতে পারলেন যে তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কলত্র বেশ আনন্দেই আছেন। বাইরে থেকেই একতলার ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন যে তাঁর কন্যা রটন্তী, মুখে আপেলের খোসা এবং শসা বাটার প্রলেপ লাগিয়ে চক্ষু বুজে ত্বক চর্চায় ব্যস্ত। পুত্রের ঘর থেকে নির্গত ‘ধানী পটকা’ ব্যান্ডের ‘শ্মশানে অশান্তি’ অ্যালবামের উচ্চ নাদ শ্রবণ করে তিনি যার পর নাই পুলকিত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, যাক--তাহলে তিনি যে এই কদিন ঘন্টুরানীকে সঙ্গে নিয়ে পুরী ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেটা তাহলে বাড়ীর লোকেরা কেউ টেরটি পায় নি। তখন পটাই-বাবু মনের আনন্দে গুন গুন করে “মন চলো নিজ নিকেতনে..” গানটি গাইতে গাইতে আস্তে আস্তে পিছনের দরজা দিয়ে এক পা এক পা করে গৃহে প্রবেশ করলেন এবং দেখে অবাক হয়ে গেলেন যে … সমগ্র গৃহে একমাত্র তাঁর অর্ধাঙ্গিনী পুটিবালাই অধোবদনে ফোঁস ফোঁস করে চোখর জল ফেলে ক্রন্দনরত অবস্থায় কাজ করে চলেছেন। এই দৃশ্য দর্শন করে পটাই-বাবুর নিজেকে বড়ই অপরাধী বলে মনে হ’ল। তাঁর এইরূপ সতী লক্ষ্মী স্ত্রীর প্রতি তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তাঁর নরকেও স্থান হওয়া উচিৎ নয়। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম তিনি আবিষ্কার করলেন পুটিরানী তাকে কতোটা ভালোবাসেন, আর এতদিন তার এই সতী লক্ষ্মী অর্ধাঙ্গিনীকে ভুল বোঝার জন্য মনে মনে তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। হঠাৎ পুত্রের ঘরে অ্যালবাম থেমে গেল, চারিদিক নিস্তব্ধ, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’, সেই মুহূর্তে সমগ্র গৃহে এক শোকের পরিবেশ, পুটিরানী তখনও নীরবে অশ্রুবর্ষণ করে চলেছেন। ঠিক সেই সময়ে তাঁর পুত্র অনাদীচরণ তার জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য রসুই কক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন, এমন সময়ে তার পিতৃদেবকে অঙ্গনে দণ্ডায়মান দেখে ভূত দর্শনের ন্যায় চমকিত হলেন এবং সোচ্চারে বলে উঠলেন “বাবা তুমি….. ?” পুটিবালার কর্ণে এই কথা যাইবা মাত্র, গৃহে যেন একটি তিনশো ডেসিবলের বোমা বিস্ফোরিত হ’ল। -- “ওরে, মুখ পোড়া মিনসে….তুই ফিরে এসেছিস?” সজোরে এই কথা বলে হাতের নিকটে থাকা রুটি বেলার বেলনটাকে ধাইইইই করে ছুঁড়ে মারলেন পটাই-বাবুকে লক্ষ্য করে। পটাই-বাবু কোনক্রমে নিজের মাথাটি সরিয়ে নিয়ে সে যাত্রায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে ভাবলেন, আহা স্বামীর বিরহে বেচারি পুটিরানীর মাথাটাই বুঝি গেছে, আর মুখে বললেন, “এ কি করো গিন্নী? এখনই তো তুমি বিধবা হয়ে যাচ্ছিলে ?” পুটিরানী ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আমি তো সেটাই চাই রে মুখপোড়া, আমি ভাবলাম তুই ঘন্টুকে নিয়ে পুরীতেই ঘর বেঁধে থেকে যাবি, আর আমারও হাড়ে বাতাস লাগবে। নেহাত পাঁঠার মাংস রান্নার জন্য পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখদুটো জলে ঝাপসা হয়ে গেছিল, তাই বেলনটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ল, তা না হলে আজ তোকে আমি খুনই করে ফেলতাম।”

প্রবন্ধ - সৈয়দা মকসুদা হালিম

রসসিক্ত কাব্য কথা
সৈয়দা মকসুদা হালিম



অভিনয়াদির দ্বারা অন্তরহৃদয়গত রসকে যা প্রকাশ করে, তাকে ভাব বলে। রস উৎপন্ন না হলে ভাবেরও কোন পৃথকসত্তা নেই। ভাবের দ্বারা যেমন রস প্রকটিত হয়, তেমনি রসের দ্বারাও ভাব প্রকটিত হয়।
কোন কবি যখন তার কাব্যশিল্প রচনা করেন, তখন তার লৌকিক যে সব ভাব বাস্তব ঘটনার সাথে জড়িত থাকে, তাকে অবলম্বন করে তিনি সেই কাব্যশিল্প রচনা করতে পারেন না। লৌকিকভাবে বাস্তব ঘটনার সাথে অনুভূত ভাবগুলো যখন হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বাসনারূপে অবস্থিত হয় এবং সেই বাসনাগুলি বাস্তবকে অবলম্বন না করে তার হৃদয়ের মধ্যে উদ্বুদ্ধ হয়, তখনই তিনি দেশকালাদি রহিত ভাবে সাধারণীকৃতরূপে কাব্যারথের বিভাবণ করতে পারেন। এবং তাদৃশ বিভাবন ব্যাপারের ফলেই যে কাব্য রচিত হয়, তা লোকের আস্বাদ যোগ্য হতে পারে। নিজের ব্যক্তিগত বাস্তব ঘটনার বা তৎসহ রচিত অনুভবের বর্ণনায় কখনও কাব্য হতে পারে না, তা জীবন চরিত হতে পারে; তা দিয়ে লোকের চিত্তে অনেক অনুভব উৎপন্ন হতে পারে, কিন্তু তা কাব্যরসজণিত অনুভব নয়।

ভারত বলেন, চার প্রকার রস—মূল রস। শৃঙ্গার, রৌদ্র, বীর ও বীভৎস।
শৃঙ্গার থেকে হাস্য, রৌদ্র থেকে করুণ, বীর থেকে অদ্ভুত এবং বীভৎস থেকে ভয়ানক রস উৎপন্ন হয়।
অভিনব গুপ্ত, একমাত্র রসকেই কাব্যের তাৎপর্য বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু অনেকেই তা সমর্থন করেন নি।
ভামহ, শব্দার্থের সাহিত্যকে কাব্য বলেছেন। এ ছাড়া রুদ্রট, শব্দ ও অর্থকে।
মন্মট বলেছেন, সগুণ ও দোষ বর্জিত শব্দার্থই কাব্য।
বামন বলেন, রীতি কাব্যের আত্মা।
দন্ডী, কাব্যের শরীরভূত শব্দের উপরেই জোর দিয়েছেন।


কিন্তু বিশ্বনাথ ও কেশব মিশ্র- অভিনবকেই অনুসরণ করেছেন। বিশ্বনাথ, ‘রসাত্মক বাক্যকেই কাব্য বলেছেন। আর কেশব মিশ্র বলেন, রসই কাব্যের আত্মা।

আগে ধ্বনিই কাব্যের আত্মা স্বরূপ—এমন একটা মতও প্রচলিত ছিলো, তবে অনেকেই তা স্বীকার করতেন না। ধ্বনিকার এই মতকে সুন্দররূপে সমর্থন করেন।

আনন্দবর্ধন তার বৃত্তিতে এবং অভিনব তার লোচনটীকায় এই মত এমন করে সমর্থন করেছেন যে মন্মট, প্রভৃতি পরবর্তী অনেক আলংকারিকই এর অনুসরণ করে গেছেন। কাব্যতত্ত্বজ্ঞেরা অনেকেই যারা ধ্বনি স্বীকার করেন না, তারা বলেন যে শব্দ, অর্থ এবং অলঙ্কার ছাড়া নিরতিশয় শোভাবর্ধনকারী কাব্যের অন্য কোন গুণ নাই, কাব্যের শোভাকারী বলে মনে হয়। তার যে নাম দেওয়াই হোক না কেন তা গুণ বা অলঙ্কারের মধ্যে পড়বে। শব্দার্থ কাব্যের শরীর, কিন্তু এরা কেউই ধ্বনি নয়, শব্দার্থের চারুতাকে ধ্বনি বলা যায় না। কাব্যের আলোচনা করলে সহজেই ধ্বনি বলে এমন কিছু পাওয়া যায় না---শব্দার্থের গুণালঙ্কার ছাড়া যার অন্য কোন স্বাতন্ত্র্য আছে। গীত, নৃত্য হাস্যাদির সহৃদয় হৃদয়াহ্লাদী শব্দার্থময়ত্ত্বই কাব্যতত্ত্বের লক্ষণ।

ধ্বনিবাদীরা বলেন যে, ধ্বনিই কাব্যের বিষয়ীভূত, অথচ পূর্ববর্তী প্রসিদ্ধ আলঙ্কারিকেরা তার কোনও উল্লেখ করেন নি। যদি কাব্যের এতাদৃশ্য প্রাণস্বরূপ কিছু থাকতো, তবে তারা তার উল্লেখ করতেন এবং এ সম্বন্ধে বিচারও চলতে পারতো।
কেউ কেউ বলেন, লক্ষণার দ্বারা যে অর্থ পাওয়া যায়, তাই ধ্বনি। উদ্ভট, বামন, প্রভৃতিরা এই মত পোষণ করতেন। কেউ কেউ বলেন যে, ধ্বনিবস্তুর কোন লক্ষণ দেওয়া যায় না, তা বাক্যের অগোচর। কেবল হৃদয় দিয়ে সহৃদয় ব্যক্তিরাই তার আস্বাদ পেয়ে থাকেন। শরীরের লাবণ্য যেমন শরীরের অবয়ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অথচ তা অবয়ব দ্বারাই প্রকাশিত হয় এবং কোন অলংকারাদির অপেক্ষা রাখে না, ধ্বনিও তেমনি কাব্যশরীরের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয় অথচ কাব্যশরীর থেকে একান্ত স্বতন্ত্র। এই ধ্বনিগম্য অর্থটি তিন প্রকার---বস্তুমাত্র, অলঙ্কার এবং রসাদি, যা কাব্যঅর্থ দ্বারা আক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু বাচ্যঅর্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অভিনব বলেছেন---এই তিন প্রকার ধ্বনির মধ্যে রসধ্বনিই সর্বশ্রেষ্ঠ!

ধারাবাহিক - পিনাকী চক্রবর্তী

নাড়ু রহস্য
পিনাকী চক্রবর্তী



অন্তিম পর্ব

উদয়পুর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দক্ষিণে খেরওয়াড়া গ্রাম, আহমেদাবাদ হাইওয়ের ওপর। কলকাতা থেকে দিল্লী, তারপর দিল্লী থেকে উদয়পুর ট্রেনে, সেখান থেকে খেরওয়াড়া বাসে। খেরওয়াড়ায় বাসের থেকে নেমে, ভাড়ার সাইকেলে চড়ে মাঠঘাট পাহাড় পর্ব্বত পেরিয়ে আরও আট কিলোমিটার দূরে মাসারোঁ-কি-ওবরি গ্রামে পৌঁছলাম। যাতায়াতের বন্দোবস্তটা ভালোই। খেরওয়াড়ায় দাড়িওয়ালা সাইকেল-বাবার দোকান থেকে সাইকেল ভাড়া করে ওবরিতে ফেরত দেওয়া যায়, ভাড়ার পয়সা আর চিরকুটটা জমা করে। শুধু ওবরিতেই না, আরও বিভিন্ন দিকের গ্রামেও এই ব্যবস্থা। রাস্তা যেখানে যেখানে খারাপ, সেখানেই একটা সাইকেল সারানোর দোকান। সাইকেলের টায়ার পাংচার হলে, চেন ছিঁড়ে গেলে বা সীট ভেঙ্গে গেলে সারানোর খরচা গ্রাহকের, সাইকেল-বাবার কোনোই খরচা নেই। পরে জেনেছিলাম এই সাইকেল সারানোর দোকানগুলোও ওই সাইকেল-বাবারই বেনামী সম্পত্তি! জিওলজি পড়ে আর কি মোক্ষলাভ হবে? তার থেকে, টাকাপয়সা থাকলে এইরকম একটা সাইকেল ভাড়া দেওয়ার ব্যবসার চেন যদি খোলা যেত সারা রাজস্থান জুড়ে, তিনপুরুষ ধরে পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দিতাম। যাকগে সে কথা...

গ্রামের ব্যাপারে রাজস্থানী ধারণাটা আমাদের থেকে একটু আলাদা। বাংলার গ্রামে বসতি সবারই এক জায়গায়, পাশাপাশি, কাছাকাছি। হতে পারে বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত, কিন্তু তাও একই সাথে লাগোয়া। চাষের জমিও একসাথে লাগা, শুধু মাত্র আল দিয়ে আলাদা করা। ওখানে কিন্তু যেখানে যার জমি, তার ঠিক মাঝখানে তার কুঠিয়া। জমিগুলো কোথাও কাঁটাগাছ, কোথাও আলগা পাথরের দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা। কিন্তু অনেকটা বিস্তৃত উবড়খাবড় পাথরিলা জমিনের মধ্যে হয়তো এক ফালিতে চাষ হয়। এর ফলে এক একটা গ্রামের সীমানার একপ্রান্ত থেকে অন্য-প্রান্ত মাইল খানেকও হতে পারে, মাইল তিনেকও হতে পারে। ম্যাপে যেখানে ওবরি দেখানো ছিলো সেইটা গ্রামের পাটোয়ারীর বাড়ী। সাইকেল জমা করে আমি সেইখানে গিয়ে হাজির হলাম গোধূলীলগ্নে, আশ্রয়ের খোঁজে।

আমার মতো সম্মানিত অতিথি পেয়ে তো পাটোয়ারী অভিভূত। তিনি এই গ্রামে সরকারের প্রধান প্রতিভূ, আবার গ্রামের বাণিয়াও বটে। আমাকে খাতির করে খাটিয়ায় বসালেন, আমার সব বৃত্তান্ত শুনলেন, ওঁদের নিজেদের পাহাড়ের কৃতিত্বে মুগ্ধ হলেন – কারণ সুদূর কলকাত্তা মুলুক থেকে এসে আমি জয়পুর, উদয়পুর ছেড়ে ওঁদের গ্রামকেই বেছে নিয়েছি আমার পড়হাই-এর জন্যে – এটা তো তাঁদের ওই আখাম্বা পাহাড়েরই সৌজন্যে। সেই আনন্দে সন্ধে না নামতেই বাজরার রুটি আর কলাইয়ের ডাল দিয়ে ডিনার খাওয়ালেন তিনি এবং রাত্তিরে তাঁর দোকানে শোয়ালেন। বাজরার রুটি যাঁরা কখনো খান নি, তাঁদের জানিয়ে দিই যে ওই রুটির অর্ধেকটার ওপর আসনের মতো বসে বাকি অর্ধেকটা খেতে হয়। একেই তো তিনদিন ধরে চলার শ্রান্তি, তার ওপর ওই বাজরার রুটি চিবানোর ক্লান্তি। তালেগোলে জল ছাঁকার কথাটা আর খেয়াল ছিল না।

সারারাত সেই দোকানের মশলাপাতি, গোয়ালের সাঁজালের ধোঁয়া আর উঠোনের উটের নাদির গন্ধে ঘুম এলো না। ওদেশে উটের গোবরে ঘুঁটে দেয়, বাড়ীর উঠোনে সেই বস্তু স্তূপ করে সাজিয়ে রাখা থাকে। গন্ধে সমস্ত রজনী ম’ম’ করছিলো। তার ওপর ঠিক আমার পাশের ঘরেই একপাল ছাগল ভেড়া, তারাও সারারাত ম্যা’ম্যা’ করছিলো...আর সবার ওপর পাথরের মতো চেপে ছিলো আমার পেটের মধ্যে সেই বারকোশ সাইজের বাজরার রুটি।

ঠিক করে ফেললাম যে করেই হোক, পরের দিনই অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

আমার অবশ্য অত না ভাবলেও চলতো। কারণ পরের দিন তাঁর দোকানে আর বাড়ীতে লোক ভেঙ্গে পড়লো এই পরদেশি চিড়িয়া দেখতে – শুধু ওবরির থেকেই নয়, দূর দূরান্তর থেকে, এমনকি সারেরা-কি-পাল থেকেও নাকি এসেছিলো লোকজন আমাকে দেখতে। আসলে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে এমন অনেক জায়গা আছে যা আমাদের কাছে যতটা না অজানা তার থেকে অনেকটাই বেশী আমরা ওখানকার লোকদের কাছে অচেনা। একমাত্র ইলেকশনের সময় ছাড়া সেখানে বাইরের লোক কেউ যায়না। তাই পড়াশোনা করতে সুদূর কলকাত্তা থেকে আসা কালেজ স্টুডেন দেখতে লোকের ভিড় উপচে পড়লো পাটোয়ারী-জীর আঙ্গিনায়। ব্যবসা-পত্তর উঠলো মাথায়, তাই পাটোয়ারী-জী ঠিক করলেন আমাকে অনতিবিলম্বে স্থানান্তরিত না করলেই নয়।

তিনি ডেকে পাঠালেন গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাইকে। এঁকে এখানকার ভাষায় মান্ডসাব বলে লোকে। স্কুলটি সরকারী, তাই মান্ডসাব পাটোয়ারীর অধীনস্থ কর্মচারী। কিন্তু তিনি পড়ি-লিখি লোক বলে পাটোয়ারীর থেকে অনেক বেশী সম্মানিত। নাম শ্রী লক্ষ্মণ সিং মীণা, ধাম বাঁসওয়াড়া, অধুনা ঋযভদেব (জৈনদের তীর্থস্থান, খেরওয়াড়ার কাছে) নিবাসী। ছোটখাটো, হাসিখুশি, অল্পবয়সী ভদ্রলোক, একটা টিলার ওপর একটা ছোট্ট দোচালা ঘরে একটা প্রাইমারী স্কুল চালান। দেখামাত্রই ভাব হয়ে গেলো আমাদের। মীণাজীকে বলে দেওয়া হলো তাঁর স্কুলে আমাকে জায়গা দিতে। তিনি ডাকলেন ‘আসুন’...

আমি যাচ্ছিলাম দোকানঘরের দিকে আমার বাক্স-পেঁটরা নিতে, সবাই মিলে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো। “আপনি এগোন, আপনার জিনিষপত্র পৌঁছে যাবে।” প্রাইমারী স্কুলের দুই মুশকো জোয়ান ছাত্র ঘাড়ে করে আমার বেডিং আর সুটকেস নিয়ে এলো আমাদের পেছন পেছন। আড়ে আর বহরে আমার সমান সাইজের এমন প্রাইমারী ছাত্র আমি আগে দেখিনি, তাই কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে তাদের দেখছিলাম। মীণাজী অন্তর্যামী, আমার মনের কথা বুঝে নিলেন বলার আগেই। জানালেন এখানে দুপুরবেলা সরকারী খরচে খাবার দেয় প্রাইমারী স্কুলে, তাই এরা পড়তে আসে। প্রাইমারীটা একবার পাশ করে গেলে ফ্রিতে লাঞ্চ বন্ধ, তাই এরা বছর বছর ফেল মারে। বুদ্ধিমান ছাত্র, সন্দেহ নেই! আর ছাত্রীরা? না:, তাদের এত বুদ্ধি নেই। তাদেরকে দশ বারো বছরের মধ্যে স্কুলের পড়া শেষ করে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়, এত সময়ও তাদের নেই...কিন্তু আপনি তো ভূবিজ্ঞান নিয়ে রিসার্চ করছেন, সমাজবিজ্ঞান জেনে আপনার কি হবে? আপনি বাঙ্গাল মুলুকের লোক, আপনারা মেয়েদের ছেলেদের একই নজরিয়াসে দেখেন, মেয়েরা শিক্ষা না পেলে দেশ কতটা পিছিয়ে থাকে আপনারা কি জানবেন?

কথা বলতে বলতে আমার নতুন বাসস্থানে পৌঁছান গেল। একটাই ঘর, তার একটা দরজা, দুটো জানলা, একটা বারান্দা। সমস্তটার ওপর খড়ের দোচালা। ঘরের ভেতরে চার কোণায় চারটে মাদুর পাতা, এক একটা মাদুর একটা ক্লাসের জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। তার ওপরে বসে চারটে ক্লাসের বাচ্চারা নিজের নিজের পড়া সমবেত ভাবে চিৎকার করে পড়ছে, কেউ তারস্বরে নামতা, কেউ চিল-চ্যাঁচানো হিন্দি, কেউ বা অন্য কিছু। আর চতুর্থ ক্লাস লেখ (রচনা) লিখছে। কেউ কিছুক্ষণ না চেঁচালে একজন দিদিমণি বকুনি দিচ্ছেন, “কাকষা তিইইইন (মানে ক্লাস থ্রি), পড়হোওওও!” কোলাহল বললে পুরোটা বোঝানো যায় না, ক্যাকোফোনির ধুম বলতে হয়। নিজের কথা নিজে শুনতেই অসুবিধে হয়। এরই মধ্যে হয়ে গেল টিফিন টাইম, একটা প্রবল রণ-হুঙ্কার তুলে বাচ্চারা দৌড়ালো বাইরে, যেখানে টিফিনের ডালিয়া রান্না করা হচ্ছে...আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

স্কুলের দায়িত্বে আছেন মীণাজীকে নিয়ে তিনজন। টিফিনের সময় আলাপ হল দিদিমণিটি আর স্কুলের চৌকিদার বুধিলালের সাথে। বিশেষ করে এই শেষ জনের কথা বলতে হয়, কারণ ওবরির নানা ঝড় ঝাপটা এড়িয়ে আমার নৌকো পারে লেগেছিল এনারই দৌলতে। সে সব অনেক কথা, সেই ঝাঁপি খুলে বসলে আস্ত একটা ইতিহাস হয়ে যাবে। আপাতত জানা গেলো যে বিকেলবেলা স্কুলের ছুটির পর দুজন টিচারই চলে যান, থেকে যান ওই বুধিলালজী–তিনি নিজের খাবারের সাথে আমার খাবারটাও বানিয়ে দেবেন। আমি আমার বিছানাপত্র মাদুরের ওপর বিছিয়ে রাত্তিরে ঘুমাতে পারি, শুধু সক্কাল সক্কাল উঠে ব্যাগ বন্ধ করে, বিছানা গুটিয়ে এক কোণায় রেখে দিতে হবে যাতে স্কুল স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারে। আমার জলের সমস্যাটাও দূর হোল একই সাথে। একটা নতুন কেনা মাটির হাঁড়িতে আমার কাপড় দিয়ে ছেঁকে জল ভরা থাকবে আমার জন্যে, সুতরাং রোজ সকালবেলায় জল ছাঁকার ফ্যাচাংটাও থাকলো না।

কিন্তু মাঠে ঘাটে? কাজের সময়? এক ওয়াটার বটল জল ওবরির দুপুর রোদে কতক্ষণ টেঁকে ? জল ফুরিয়ে গেলেই দৌড়ঝাঁপ করে হয় কুয়ো খুঁজতে হয়, নাহয় কারুর বাড়ী গিয়ে হাজির হতে হয়। আর তারপরেই প্রাণে লাগে ব্যথা! ‘আমি তাপিত পিপাসিত, আমায় জল দাও’ বলে তো প্রথমে একেবারে ভিক্ষু আনন্দের স্টাইলে হাঁটু গেড়ে বসা। কিন্তু চকচকে পিতলের ঘটীতে ঝকঝকে জল যেই এলো ওমনি শুরু হোল ওয়াটার বটল বাগিয়ে তার মাথায় শাড়ীর টুকরোর ফিল্টার চড়িয়ে সেই জলের শোধন-পর্ব। এতে প্রকৃতি বা তার মা, মাসী, পিসী, চাচীরা কেউই বিশেষ আপ্যায়িত বোধ করেন না। এক একজন তো বলেই বসেন ‘আমাদের জলে যদি এতই নোংরা তো সেই জল নেওয়ার কি দরকার?’ পরের দিকে অনেক বাড়ীর দুয়ারে কর হেনে বা পঞ্চমে স্বর তুলে হেঁকেডেকেও কোনরকম সাড়াশব্দ পেতাম না! স্বাভাবিক! আমি হলেও এই ব্যবহারই করতাম নিশ্চয়! কিন্তু, এ তুমি আমাকে কি পরীক্ষায় ফেললে প্রভু? নির্জলা উপোষ করা শুনেছি, নির্জলা থিসিস করা তো কক্ষনো শুনি নি...

কুয়ো নিয়ে তো আর এক বিপত্তি! স্যার বলেছিলেন খোলা কুয়োর কথা, সাধারণ পাতকুয়ো নিয়ে কোনও সাবধান-বাণী শুনিনি তাঁর কাছে। কিন্তু এই যন্তরগুলো তো আমার কাছে এখন পর্যন্ত না দেখা সেই স্যারকথিত বাউলীর থেকে ঢের বেশী বিপজ্জনক। কেন? শুনুন তাহলে আপনাদের বলি। এই পাতকুয়োগুলোর পাড় বেশ উঁচু করে বাঁধানো – প্রায় আমার নাক বরাবর উঁচু, কে জানে কেন! কিন্তু বালতি তোলা নামানোর জন্যে কোনও কপিকলের বালাই নেই। কোন পার্মানেন্ট বালতিও নেই দড়িও নেই, যেমনটি অন্যান্য জায়গায় থাকতে দেখেছি, বিশেষ করে পুরনো হিন্দি সিনেমায়। এখানে যে যার কলসি দড়ি সঙ্গে করে নিয়েই আসে। ডুবে মরতে নয় নিশ্চয়ই, কারণ অত জল এখানকার কুয়োতে থাকেইনা। সুতরাং জল ভরতে। কিন্তু সেই জল ভরার কায়দাটা কি?

পাতকুয়োর পাড়ের ব্যাস প্রায় পাঁচ ছয় ফুট। একটা গাছের গুঁড়িকে লম্বালম্বি দুই ভাগ করে কেটে দুদিকের পাড়ের মধ্যে দুটো ব্রিজের মত পাশাপাশি পাতা আছে। ব্রিজ-দুটোর মাঝে হাত খানেকের গ্যাপ। আর ওই গ্যাপটাই হোল আসল জিনিষ। ওটার দিকে নজর রাখবেন।

বীরাঙ্গনা ভীল-বালারা নাতিদীর্ঘ ঘাগরা চোলি পরে, মাথায় তিন চারটে হাঁড়ি কলসির কুতুব মিনার বানিয়ে, হাতে একটা বালতির মধ্যে নাইলনের মোটা দড়ি নিয়ে কুয়োর ধারে আসতেন। হাঁড়ি কলসিগুলোকে কায়দা করে কুয়োর ধারে সাজিয়ে রেখে, স্ট্র্যাটেজিক ভাবে রাখা এক উপলখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে দুই লাফে উঠে যেতেন কুয়োর ওপরের গাছের গুঁড়ির ব্রিজে। তারপর দুই পা দুই ব্রিজে রেখে মাঝখানের গ্যাপ দিয়ে দড়ি-বাঁধা বালতিটা সরসর করে নিচে নামিয়ে দিয়ে জল ভরে নিতেন, আর হুড়মুড় করে টেনে তুলতেন সেটাকে। অতঃপর, ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে বালতির জল অব্যর্থ টিপে ছুঁড়ে ছুঁড়ে সারিবদ্ধ হাঁড়ি কলসিগুলোর মধ্যে চালান করে দিতেন। আসল ব্যাপারটা হোল এই, যে ওই গ্যাপটা যদি না থাকত তবে ঝুঁকি নিয়ে তক্তার একপাশে ঝুঁকে পড়ে জল তুলতে হোতো, তাতে ব্যাল্যান্সের অভাব হবার প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু আবার অনভ্যস্ত লোকদের পক্ষে দুই তক্তায় পা রাখা সহজ ব্যাপার না। আমি একবার নিজে নিজে জল তোলার চেষ্টা করার সময় দুটো তক্তা দুইদিকে স্লিপ করায় কুয়োর ভেতরে পরতে পরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। তার পর থেকে সেই অপচেষ্টা আর করিনি। এই বীরবালারা অপত্য স্নেহে আমার বোতলে জল ভরে দিয়ে থাকেন, কিন্তু জল ছেঁকে নিতে গেলে এনারাও বিরূপ হন। এই ছাঁকাছাঁকির ব্যাপারটা নিয়ে তো বড় ল্যাঠা হোল দেখছি!

চণ্ডালিকার কথায় মনে পড়লো - কুয়ো-তলায় একদিন অন্যরকম বিপত্তিও ঘটেছিলো। আমার বাবা নিজের হাতে আমাদের তিন ভাইয়ের জন্যে পৈতে তৈরি করে দিতেন। আমরা কখনো পৈতে না পরলে মুখে কিছু বলতেন না বটে, কিন্তু মনে মনে খুবই দুঃখ পেতেন। বাবা যতদিন ছিলেন, আমরা তিনজন নিয়ম করে পৈতে ধারণ করতাম। এইবারও কলকাতা থেকে বেরোবার আগে বাবা একদম টাটকা তাজা পৈতে বানিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন এক ভীল-কন্যা কুয়োর ওপর থেকে আমার বোতলে জল ঢালার সময় দেখতে পেয়ে গেলেন আমার শার্টের ভেতরে আমার কাঁধের ওপর সেই পৈতে। ভীল মেয়েদের মুখ সব সময় বিশাল ওড়নার আড়ালে থাকে, তাই পৈতে দেখার পর এনার মুখের ভাবান্তর দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নি। কিন্তু গলায় এক আকাশ মেঘ নিয়ে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন তিনি আমার কি ক্ষতি করেছেন যে আমি তাঁকে স্বামীপুত্র-পরিবারসহ নরকস্থ করতে চাই? আমি যে ব্রাহ্মণ দেওতা – এই কথাটা আগে জানলে তিনি, এক অন্ত্যজ নীচ জাত কি অওরত, আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতেন না, আমাকে জলদান করা তো দূর কি বাত! আমার কি উচিত হয়েছে এইরকম একজন নিরীহ নিরপরাধিনীকে ঘোর নরকের পথে ঠেলে দেওয়া ...ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেশ আমাকে সেই পৈতেটি বের করে শাপ দেওয়ার অভিনয় করতে হয়েছিল এই বলে যে যদি আমি যদি জলের অভাবে শুকিয়ে মরি, তাহলে এই মহিলার ব্রাহ্মণ-হত্যার যে অনন্ত পাপ হবে তার থেকে স্বয়ং ভগবানও তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন না। এবং সেই ভগবানই জানেন যে সেই কথাটা কতটা দুঃখের সাথে বলতে হয়েছিল আমাকে! কিন্তু জলটা পেয়ে গেছিলাম সেদিন ওই পৈতেরই জোরে...কে বলে কলিকালে ব্রহ্মতেজ কাজ করে না!!!

এইসব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম ঠিকমত জনসংযোগ রক্ষা করতে হলে সবসময় জল ছেঁকে খাওয়া সম্ভব নয়, আর গিনি ওয়ার্মের ইনফেকশন হবার জন্যে মাত্র একবার খারাপ জল খাওয়াই যথেষ্ট। আর সেটা তো এক আধবার করে প্রথম দিন থেকেই খেয়ে চলেছি। সুতরাং এইইনফেকশন আজ নয়ত কাল আমার কপালে ঠিকই নাচছে, পালাবার পথ নাই। তাই যদি হয় তাহলে কি দরকার এত ফ্যাচাং করে? আবার ভাবলাম যদিই ইনফেকশনটা না হয়ে থাকে এখন পর্যন্ত, তবে চান্স নিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ি কেন? না:, এত টানাপোড়েনের মধ্যে থাকাটা বড় কষ্টকর, একটা নিরপেক্ষ সার্ভে করে দেখি এই অঞ্চলে গিনি ওয়ার্মের প্রভাব বা প্রাদুর্ভাবটা কেমন। সত্যিই কি তিনি আছেন, নাকি আগে ছিলেন, এখন নেই... না কি আদৌ ছিলেনই না এখানে, স্যার মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিলেন।

যাকেই জিগ্যেস করি, কেউই গিনি ওয়ার্মের নাম শোনে নি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, এরা ইংরিজী নামটা জানে না... দেখি বর্ণনা দিলে বোঝে নাকি! জলে থাকে একরকম কিড়া, যা নাকি হাত পা ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসে – না, না, ওইরকম কোনও কিড়া মাকোড়া এখানকার পানিতে নেই, এখানকার পানি বহত সাফ অর মিঠা। পাতকুয়ো-বিহারিণী এক দেবী তো হাতেনাতে প্রমাণই দিয়ে দিলেন।

দোষের মধ্যে আমি তাঁকেও জিগ্যেস করেছিলাম এখানকার জলে কোনোরকমের কিড়া আছে কিনা। তিনি আমাকে কুয়োর তক্তার ব্রিজের ওপর উঠতে বললেন, এবং আমার হাঁচোড় প্যাঁচর করে পাড়ের ওপরে ওঠা দেখে খিলখিলিয়ে হাসলেন, আমি হাসিটা শুধু শুনলাম, দেখার তো আর উপায় নেই। তারপর তিনি নিচে দেখতে বললেন। কি দেখবো? মেঁডক। ব্যাঙ? কই কোথায়? আমি তো শুধু সবুজ জল দেখছি। তিনি নিচের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে দেখালেন অনেক নীচে, জলের লেভেল-এ একটি কূপমণ্ডূক, একটি প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি আঁতকে উঠে প্রায় জলে পড়ে যাচ্ছিলাম, এই ব্যাঙ-ওয়ালা কুয়োর জল আমি খাই? মানে খেয়ে থাকি? এক মাস ধরে খাচ্ছি?

দেবী অভয় দিলেন, বললেন যে কুয়োতে ব্যাঙ বেঁচে থাকে, সেই কুয়ো বিষাক্ত নয়। আর তা ছাড়া, কুয়োতে ব্যাঙ থাকলে সব পোকামাকড় খেয়ে ফেলে জল পরিষ্কার রাখে। সুতরাং এই কুয়োতে কোনও কিড়া মাকোড়ানেই থাকতে পারে না। কিউ ই ডি।

সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারাহি কাফি হ্যায়, তাও বলে দি আপনারা যাঁরা জ্ঞানীগুণী তাঁদের... সাবধান, যে কুয়োতে মরা ব্যাঙ ভাসে সেই কুয়োর জল একদম খাবেন না !!!

ব্যাস, হয়ে গেল সব সমস্যার সমাধান। আমি অবশ্য সাবধানের মার নেই বলে মান্ডসাব, বুধিলাল, পাটওয়ারীজী – কাউকেই জিগ্যেস করতে বাকি রাখি নি, কিন্তু নেট ফল হলো শূন্য। কেউই এইরকম কোন পোকামাকড় কথা শোনেন নি, গিনি ওয়ার্মের তো কথাই নেই। আর কি চাই! পরিষ্কার বোঝা গেল স্যার এই অঞ্চলে আগে আসেন নি, আর তাই ওঁর এই ওবরির জলের পোকা মাকড়ের ব্যাপারে সম্যক ধারণা নেই। আমি শাড়ীর টুকরোগুলোকে ব্যাগের নীচের দিকে চালান করে দিয়ে কুয়োর আছাঁকা জল খেতে লাগলাম দুগগা দুগগা বলে।

এর দুই সপ্তাহের মধ্যে স্যার এলেন আমার ফিল্ডের কাজের প্রাথমিক পরীক্ষা নিতে। প্রথম দিন দুপুরবেলায় তাঁর পরিদর্শনের পয়লা চক্কর সেরে আমরা ক্যাম্পে ফিরছিলাম। কিন্তু তখনো মীণাজীর স্কুল ছুটি হয় নি, সুতরাং আমাদেরও যাবার জায়গা নেই। তাই পাটোয়ারী-জীর দোকানে একটা ঢুঁ মারতে গেলাম। পাটোয়ারী-জী জানতেন আমার গুরুজীর আসার কথা আছে, না দেখা করালে ক্ষুব্ধ হতেন। আমরা যেতেই দোকান ছেড়ে বাইরে এসে ‘পধারিয়ে, বিরাজিয়ে’ ইত্যাদি গুরুভার সম্ভাষণে আপ্যায়িত করে বসালেন তিনি আমাদের। আমি বিরাজিত হলাম আমার পছন্দের বারোয়ারী চারপাইটার এক কোণায়। স্যারের জন্যে এল পিঠ-উঁচু একটা হেলান দেওয়া মোড়া। সাথে সাথে এল অতিথি সৎকারের স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী আচমনীয় এবং পানীয়, দুইরকম জল। অমনি স্যার বের করলেন পকেট থেকে শাড়ীর টুকরো, ছাঁকনি লাগালেন ওয়াটার বটলে আর সাথে সাথে কুঁচকে উঠলো পাটোয়ারীর ভুরু। তাই না দেখে আমি সটান পিতলের ঘটী থেকে উঁচু করে সব জল চোঁচা মেরে দিলাম। এক নিশ্বাসে ঘটী খালি।

ঘটী থেকে উঁচু করে জল খাওয়ার সময় নজরটা ওপর দিকে থাকে। ঘটী নামিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি স্যার জল ছাঁকা ছেড়ে আমাকে দেখছেন, চোখের দৃষ্টিতে আতঙ্ক, বিস্ময়, বিভীষিকা, তিরস্কার – সব মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। আমি বিপদ বুঝে সাদা বাংলায়ে বললাম, “স্যার, আপনি আপনার মত জল ছেঁকেই খান। কিন্তু আমি জল ছাঁকা ছেড়ে দিয়েছি। খবর নিয়েছি – এদিকের ত্রিসীমানায় গিনি ওয়ার্ম নেই।”

“তাই বল,” আমার কথায় মুখে হাসি ফুটলো তাঁর। হৃষ্টচিত্তে শাড়ীর টুকরোটা ভাঁজ করে পকেটে গুঁজে রাখলেন আবার। তারপর মুখটুখ ধুয়ে নিয়ে পাটোয়ারী-জীর আস্ত এক কুঁজো ঠাণ্ডা জল আমারই মত মেরে দিলেন চোঁচা করে। “ঠিকমত খবর নিয়েছিলে তো?” মুখ মুছতে মুছতে পরম স্নেহভরে হাসিমুখে জিগ্যেস করলেন তিনি, উত্তরের অপেক্ষা না রেখেই । আসলে তিনি জানতেন যে আমি বেশ সাবধানী ছেলে, খবর নিশ্চয় ভালো করেই নিয়েছি। তাই ওটা একটা কথার কথা বলা হল, জিগ্যেস করতে হয় তাই করা...আমি ঘাড়টা কোনদিকে নাড়লাম সেটা তাকিয়েও দেখলেন না।

জলটল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে স্যার ঠেট মেওয়ারি বোলিতে আড্ডা জমালেন পাটোয়ারীর সাথে। ততক্ষণে উটের দুধের ফুটন্ত চা এসেছে কাঁচের গেলাসে। আমি গরম চা খেতে পারি না, গেলাস মাটীতে নামিয়ে রেখে হাঁ করে কথাবার্তা শুনছি আর রোমাঞ্চিত হচ্ছি আমার গুরুর জ্ঞানের গভীরতা দেখে। স্ট্রাকচারাল জিওলজি ছাড়াও কত কিছুই না জানেন এই ভদ্রলোক। তিনি ততক্ষণে বৃষ্টি, বাদলা, সুখা, গর্মী, জওয়ার, বাজরা, চাষ আবাদ পার হয়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। এমারজেন্সী ভালো না খারাপ, এই সরকারের নাশবন্দি আর গ্রামীণ প্রকল্প সম্বন্ধে পাটোয়ারীর কি মত ইত্যাদি কূট প্রশ্নে পাটোয়ারী নাজেহাল। এরই মধ্যে শুনি স্যার বলছেন, “তবে এই নাড়ুর প্রকোপ থেকে দক্ষিণ উদয়পুরকে বাঁচানো একটা বিরাট ব্যাপার, এই একটা ব্যাপারে মানতেই হবে যে অন্তত একটা ভালো কাজ এই সরকার করেছে।”

নাড়ুর প্রকোপ? নাড়ু কি একটা খারাপ জিনিষ? কোনও নেশার পদার্থ বা তার কোড নাম নাকি? নাড়ু তো আমি রাজস্থানে এসে থেকে অনেক খেয়েছি, যোধপুরের ক্ষীরের নাড়ু অতি উপাদেয় বস্তু, যদিও এদেশে ওটাকে লাড্ডু বলে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু ওদিকে পাটোয়ারীর ধরণ দেখে মনে হল তিনি এতক্ষণে একটা প্রশ্ন কমন পেয়েছেন। হাঁকপাঁক করে বলে উঠলেন, “লেকিন নাড়ু গিয়েছে কোথায়? দস্তুরমত মওজুদ আছে দক্ষিণ উদয়পুরে, আমাদের এই গ্রামেই আছে কত লোকের! আরে ও লাখন, তোর ইস্কুলের কত ছাত্র ছাত্রার আছে, গুরুজীকে দেখিয়ে দে তো! আপনিও যেমন লোক, গুরুজী, নাড়ু দূর করবে এই সরকার? মুরোদ জানা আছে...!

মনের গভীরে একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ মাথা চাড়া দিচ্ছিল। আমি ভয়ের চোটে স্যারের দিকে না তাকিয়ে নিচু হয়ে সন্তর্পণে চায়ের গেলাসের টেম্পারেচার মাপছি। হঠাৎ হিস্ হিস্ করে হুঙ্কার, (হ্যাঁ, হিস্ হিস্ করেও হুঙ্কার দেওয়া যায়)... “পিনাকীইইইইই...!” আমি আবার বিষম খেলাম, চায়ে চুমুক না দিয়েই। মাথা তুলে দেখি স্যারের রুদ্রমূর্তি। আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম ‘এই নাড়ু জিনিষটা কি?’ – “নাড়ু কি, সেটাই তুমি জানো না? বা, বা, বাঃ!!! তবে তুমি কিসের খবর নিয়েছিলে হে?” “গিনি ওয়ার্মের, স্যার!” আমার সরল স্বীকারোক্তি। “সে কি? গিনি ওয়ার্মের নাম এরা জানবে কি করে? তোমাকে আমি বলে দিই নি গিনি ওয়ার্মের লোকাল নাম নাড়ু?” ‘না তো, স্যার!’ এবার স্যার একটু থমকালেন, “তা হলেও, তোমার তো উচিত ছিলো আমাকে জিগ্যেস করা!” কি কারবার রে বাবা, ইনি তো দেখি যত দোষ, সবই এই নন্দ ঘোষেরই ঘাড়ে চাপাতে চান, এইসব কি ভালো কথা? কিন্তু আরও কথা বাকি ছিলো, সেটা স্যার বললেন স্কুলের টিলায় চড়তে চড়তে।

“শোন পিনাকী, সামনের বছর পূজোর আগে পর্যন্ত যদি তোমার বা আমার গিনি ওয়ার্মের লক্ষণ দেখা না দেয় তবে ধরে নেব কপালজোরে বেঁচে গেছি। সে ক্ষেত্রে তোমার একবারে এমএসসি পাশ করে যাওয়ার খুব জোর একটা সম্ভাবনা আছে। না হলে আমার কপালে যতটা দুঃখ আছে, তোমার কপালেও ঠিক ততটাই দুঃখ নাচছে – হতে পারে অবশ্য তার থেকেও বেশী, অনেক বেশী।”

ইংরিজীতে এরে কয় ভেইলড থ্রেট!

খুব একটা “ভেইলড”-ও না!

এক সপ্তাহ পরে আমি স্যারকে ফিরতি পথের বাসে তুলে দিতে এসে ঋষভদেব জিউয়ের কাছে পূজো দিয়ে এলাম, কিন্তু শাকাহারী জৈন সাধু যদি ঘোরতর মাসা-হারী বাংগালী পাতকীর কথা না শোনেন, তাই সাবধানের মার নেই বলে উদয়পুরের আশপাশে যত দেব-দেউল আছে সব জায়গায় ঘুরেফিরে দেখা সাক্ষাত করে এলাম। একলিঙ্গ-জী থেকে শ্রীনাথ-জী, কারণিমাতা থেকে নীমাচমাতা, সব্বাইকে আর্জি জানালাম, আমাদেরকে, মানে আমাকে আর আমার স্যারকে যেন নাড়ুর হাত থেকে তাঁরা বাঁচান, আমি এমএসসিটা পাস করে নিই। ভুলেও আর গিনি ওয়ার্মের নাম নিই নি, পাছে আবার তেনাদের কোনোরকম ভুল বোঝাবুঝি হয়।

হয়নি সেরকম কোনও ভুল বোঝাবুঝি। পূজো এলো, ভালোয় ভালোয় কেটেও গেলো, নাড়ুর দেখা নাই রে নাড়ুর দেখা নাই। আর আমার এমএসসি পাশ করা ঠেকায় কেডা? কেউ ঠেকায় নি। থিসিস পেপারেও বেশ ভালই নম্বর পেয়েছিলাম, যদিও এক্সটারনাল এগজামিনার এসেছিলেন, স্যারের কোনও হাত ছিলো না এতে...তাও!


কিন্তু এর পর থেকে আমার সবরকমের নাড়ুর ওপর কেমন একটা বিতৃষ্ণা এসে গেলো। সে তিলের নাড়ুই হোক বা নারকোল নাড়ু, আমি নাড়ু দেখলেই ফুটপাথ বদল করে প্যালারামের ল্যাংচাদার মতো – “দীনবন্ধু কৃপাসিন্ধু কৃপাবিন্দু বিতরো” গানটা গাইতে গাইতে উলটো পথে হাঁটা লাগাতাম।

মহাভারতের কথা - সুস্মিতা সিং

নহ সামান্যা নারী, তুমি অকুণ্ঠিতা
সুস্মিতা সিং



মহাভারতের ভীষ্মপর্বে কুরু-পাণ্ডব মহারণকালে যুদ্ধক্ষেত্রে অকস্মাৎ প্রবেশ করলেন সুন্দর, সুবেশ, বীরশোভার আধার অশ্বারূঢ় এক যুবক যোদ্ধা; সঞ্জয় তাঁর পরিচয় দিলেনঃ এ হোল নাগরাজ-পুত্রবধূ উলূপীর গর্ভে জাত অর্জুনের পুত্র ইরাবান!!

পাঠক, আজ, পত্রিকার এই স্বল্প পরিসরে এই নাগরাজ-পুত্রবধূ, ইরাবান-জননী, সর্বোপরি, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের নির্জনচারিণী অনার্যা পত্নী, উলূপীকে চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করব আমরা; বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব বহিশ্চরা অনার্যা এই নাগনন্দিনী আজও এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক প্রেক্ষাপটে কতোটা প্রাসঙ্গিক বা আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা...

‘নাগ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ একাধারে সর্প এবং হস্তী। লৌকিক বিচারে, মহাভারতীয় জনগোষ্ঠীর বহু পূর্বগামী এই নাগজনজাতি মূলতঃ উপরোক্ত দুইটি শাখায় বিভক্ত ছিলেন। এই হস্তী বংশীয় নৃপতি ঐরাবত কৌরব্য-এর সুন্দরী কন্যা উলূপী। রাজা যথা সময়ে কন্যার বিবাহ দেন স্বজাতীয় এক নাগ-পুরুষ, সর্প বংশীয়

প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, সুপর্ন নাগের সঙ্গে। বংশগত কারণে আবার এই সর্পশাখার চিরশত্রু ছিলেন বৈমাত্রেয় ভাতৃ সম্প্রদায় গরুড় বৈনতেয়রা। পরস্পর বিরোধী এই দুই জনগোষ্ঠীর জনজাতীয় সাংকেতিক প্রতীক চিহ্ন ছিল যথাক্রমে সর্প এবং পক্ষী।



মহাভারত-পুরান বিখ্যাত বহুচর্চিত এই দুই গোষ্ঠীর চিরন্তন কলহ-বিবাদের ফল স্বরূপ উলূপীর স্বামী সুপর্ন নাগ গরুড় গোষ্ঠীয় কোন এক পুরুষের হাতে নিহত হন বিবাহের সামান্য কয়েকদিনের মধ্যেই। সদ্য বিগতধবা, উদ্ভিন্ন যৌবনা, অনিন্দ্য সুন্দরী, নিঃসন্তান, দীনচেতন উলূপী তথাপি রয়ে যান তাঁর শ্বশ্রূগৃহেই; কিন্তু, মহাভারতের অভিনিবিষ্ট পাঠক মাত্রেই জানবেন, পরম ব্যক্তিত্বময়ী এই রমণীর দীনচেতনাবিষ্ট মনোভাব খুব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। নিজের ভাবাবেশের এই অন্তর্জাল ছিন্ন করে অসম্ভব বাস্তববাদী এই নারী সরল স্বভাবিক জীবনযাত্রায় প্রত্যাবর্তন করেছেন খুব অল্পদিনের মধ্যেই। সাবলীল গতি, সর্বত্রগামী অনার্যা এই রমণী ঠিক এই সময়ই গঙ্গা উপকূলে প্রত্যক্ষ করেছেন তৃতীয় পাণ্ডব, গাণ্ডীবধন্বা, ধনঞ্জয়, অর্জুনকে।



অর্জুন তখন গঙ্গাবক্ষে পিতৃলোকের তর্পন অন্তে বেদবিহিত অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করার কথা ভাবছেন মাত্র। এমনই সময় ঘটে গেল এক অলৌকিক ঘটনা!! নাগরাজকন্যা উলূপী বীরপুঙ্গব কনিষ্ঠ কৌন্তেয়কে টেনে নিয়ে চললেন গহন জলরাশির গভীর অন্তরালে। উলূপী অর্জুনকে সরাসরি এনে ফেললেন আপন পিত্রালয়, নাগরাজ ভবনের অগ্নিশরণ গৃহের সম্মুখে; সেখানে অগ্নিহোত্র কর্মের যাবতীয় প্রস্তুতি সুসম্পন্ন।।



পাঠক, লক্ষ্য করবেন, দুর্গমপ্রবেশ অনার্য নাগরাজ্যের এই আর্যজনোচিত অগ্নি উপাসনা আর্য-অনার্য উভয় সম্প্রদায়ের আত্মিক তন্ময়ীভবনের দ্যোতক; যার পরবর্তী ফলস্বরূপ হয়তোবা বাসুকি বা শেষনাগও আর্য সংস্কৃতিতে আত্মস্মৃত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য, ‘গভীর জলরাশির অন্তরালে নাগরাজ্য’ – এই প্রক্ষেপণের লোকায়ত বিচার হয়তবা এমন হতে পারে, অনার্য নাগ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আর্য-অধ্যুষিত ভূখণ্ড থেকে অনেকটা দূরে কোনো নির্জন এবং গভীর জলাভূমিতে বসবাস করতেন; হয়তো, নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই।



এবং এক্ষেত্রে আরও লক্ষ্যনীয়, ইদানিং শ্বশ্রূকুলে বসবাসকারী উলূপী কিন্তু অর্জুনকে নিয়ে এসে তুলেছেন আপন পিত্রালয়ের নিরাপদ আশ্রয়ে। সে যুগে নিঃসন্তান বিধবা রমনীর পুনরায় বিবাহে কোনোরূপ সামাজিক বাঁধা নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও, উলূপীর এরূপ কার্যকরণ হয়তবা তাঁর পূর্বতন শ্বশ্রূকুলের সম্ভাব্য বিরুদ্ধাচরণ আশঙ্কার ফলপ্রসূ। আর তাছাড়া, উলূপী হয়তো এবিষয়ে আপন পিতার সমর্থন প্রাপ্তি সম্বন্ধে অধিক সুনিশ্চিত ছিলেন। আসলে, প্রখর বাস্তবদৃষ্টিসম্পন্না এই নারী বুঝেছিলেন, পিতার সাহায্য নিয়ে তাঁর নিজের ব্যবস্থা তাঁকে নিজেকেই করতে হবে।



যাই হোক, অগ্নিহোত্র সুসমাপন অন্তে অর্জুনের অপার কৌতূহল নিরসনপূর্বক নাগ সুন্দরী নিজের পরিচয় দিয়েছেন সবিস্তারে, এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য, এই সময় নিজের অভিপ্রায় বিন্দুমাত্র অপ্রকাশ রাখেননি অর্জুনের কাছে। তিনি স্পষ্টতঃই জানিয়েছেন, অর্জুনকে তিনি কামনা করেন। সে যুগে নিঃসন্তান সকামা রমণীর পুত্রার্থে সক্ষম পুরুষের কাছে রতি প্রার্থনা অধর্ম ছিলনা। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয়, উলূপী নিজের আন্তরিক বাসনাকে ধর্ম বা রীতির প্রচ্ছন্ন পুলিন্দায় পরিবেশন করেননি। মহাভারতীয় অনার্যা নারীর এই চরম আধুনিকতা আমাদের শিহরিত করে, সন্দেহ নেই।



অন্যদিকে, মহাবীর অর্জুন, গাণ্ডীবধন্বা অর্জুন, আপন জয়লব্ধ পুরষ্কারের এক পঞ্চমাংশ অধিকার থেকেও আপাতত বঞ্চিত। উপরন্তু, স্বয়মাগতা প্রগলভা নাগ সুন্দরীর এই অকুণ্ঠ উচ্ছ্বাস তাঁকে আকর্ষিত করেছে। আর তাই বোধহয় তিনি

গঙ্গাপোকূল থেকে গহন নাগরাজ্যে উলূপীকে অনুসরণ করেছেন বিনা প্রতিবাদে; নয়তো, চাইলে, তাঁর মতো বীর এক নারীর কোমল বাহুপাশ ছিন্ন করে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননা, একথা নিতান্তই হাস্যকর।



একদিকে আত্মনিবেদিতা যৌবনবতী সুন্দরী রমণী, অন্যদিকে ব্রহ্মচর্য ব্রতের স্খলন – পরিস্থিতির জটিলতা উপলব্ধি করে সপ্রতিভ উলূপী অকাট্য যুক্তিতে পরম কাঙ্ক্ষিতের এই মানসিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছেন। অর্জুনও আর বিশেষ কালক্ষেপ করেননি, এই নিঃসঙ্কোচ কল্যানীর প্রিয় আচরণ সাধনে উদ্যোগ নিয়েছেন।



এরপর, নাগরাজ ঐরাবত কৌরব্য-এর সম্মতিক্রমে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গে উলূপীর বিধিসম্মত শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছে এবং অর্জুন মাত্র একরাত্রের জন্য উলূপীর সহবাসে নিযুক্ত হয়েছেন। লক্ষ্যনীয়, মহাভারতের অন্যতম প্রধান এই নায়ক চরিত্র বিধবা বিবাহ করেছেন; এই ঘটনার ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিঃসন্দেহে অপরিসীম, একথা অনস্বীকার্য।



নিজের তীব্র আসঙ্গ-লিপ্সা চরতার্থ হওয়ার পর উলূপী আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেননি। আপনার স্নিগ্ধ অঞ্চল ছায়ায় বিশ্ব বন্দিত বীর স্বামীকে আচ্ছাদিত করে রাখতে চেষ্টা করেননি। বৃহত্তর জাগতিক স্বার্থে সদ্য বিবাহিত প্রিয়তমকে তিনি পরের দিনই আপন বাহুপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। নিজে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন গঙ্গা উপকূলে, ঠিক যেখান থেকে অর্জুনকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন। দৃঢ়চেতা এই রমণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পলে পলে পাঠককে মুগ্ধ করে তুলেছে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের অনুষঙ্গেও।



স্বামীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহে শ্বশ্রূকুলের বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু উলূপী পিতার সম্মতিক্রমে নাগবংশ ত্যাগ করায় তিক্ততার সৃষ্টি হয় ওই তরফে, এবং এই তিক্ততা বিরাটাকার ধারণ করে ইরাবানের জন্মের পর। তদানীন্তন প্রথানুসারে নিঃসন্তান উলূপীর উপর তাঁর পূর্বস্বামী সুপর্নর মৃত্যুর পর সর্বাধিক অধিকার জন্মায় পূর্বস্বামীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা অশ্বসেনের। অর্জুনের সঙ্গে বিবাহ এবং ইরাবানের জন্মে অশ্বসেনের এই আশা ফলপ্রসূ না হওয়ায় তিনি এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন যে, উলূপীর পক্ষে আর পূর্বতন শ্বশ্রূগৃহে বসবাস করা সম্ভব হয় না। ইরাবানকে নিয়ে তিনি পিত্রালয়ে চলে আসেন চিরতরে। সেখানেই মাতার তত্ত্বাবধানে পালিত হতে থাকেন ইরাবান।



উলূপী ও তাঁর পুত্রের জীবনের এইসমস্ত ঘটনাপ্রবাহের কোনো খবর উলূপী অর্জুনকে দেননি। সাবলীল দৃঢ়তায় একক মাতা পুত্রকে বীরশ্রেষ্ঠ পিতার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন; এবং পরবর্তীকালে মহাভারতীয় ভারতযুদ্ধের মহারণকালে পুত্রকে পিতার সাহায্যার্থে হস্তিনাপুরে প্রেরণ করেছেন। সেখানে ইরাবান তাঁর সাধ্যমত যুদ্ধ করে পিতাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন এবং অবশেষে বীরোচিত সদ্‌গতি লাভ করেছেন।



পুত্রের মৃত্যুতে নাগিনীমাতার বিলাপের কোনো বিষাদ-বিবরণ মহাভারতকার আমাদের দেননি। বরঞ্চ, এরপর বহুদিন আমরা উলূপীর কোনো সংবাদ পাইনা। আবার উলূপীকে আমরা দেখি অশ্বমেধ পর্বে; সেখানে আবারও এক সংকট মুহূর্তে তিনি ছুটে গেছেন অর্জুনকে রক্ষা করতে......



কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম যখন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেননা বলে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন, তখন পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণের সঞ্চালনায় এবং শিখণ্ডীর সহায়তায় এই অষ্টমবসু কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে সহস্র শরে জর্জরিত করে তাঁকে ভূমিসাৎ করেন অর্জুন। আর এই অন্যায় কার্য সাধনের কারণে অবশিষ্ট বসুগণ গঙ্গার সম্মতিক্রমে অর্জুনকে নরক দর্শনের আভিশাপ দেন। গঙ্গা উপকন্ঠ নিবাসী উলূপী একথা জানতে পেরে বহুতর অনুনয় পূর্বক অর্জুনের শাপমুক্তির উপায় জ্ঞাত হন এবং অর্জুনকে রক্ষা করতে ছুটে যান। অর্জুন তখন অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব পরিক্রমণ কালপর্যায়ে মণিপুর রাজ্যে অবস্থান করছিলেন।



সেখানে বহুকাল পর অর্জুন আবার মিলিত হয়েছেন তাঁর প্রথম যৌবনে বিবাহকৃতা এই অনার্যা নাগিনী ভার্যার সঙ্গে। দীর্ঘকাল পূর্বে ছেড়ে আসা নাগনন্দিনীর ‘পৃথুলশ্রোণি’ ‘চপলাপাঙ্গি’ শরীরের আকুল ইশারা আজও টের পান পার্থ। তাই তাঁর আজীবন প্রীতিকামী এই রমণীকে ‘দেবী’ সম্ভাষণে প্রীত করার চেষ্টা করেন ধনঞ্জয়।



পরবর্তী ইতিহাস সংক্ষিপ্ততর। অর্জুনের আহ্বানে তাঁর বহিশ্চরা নাগিনী ভার্যা উলূপী চৈত্রমাসের ফাল্গুনী পূর্ণিমার পুণ্য লগ্নে হস্তিনাপুরের রাজঅন্তঃপুরে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন এবং এইভাবেই মহাভারতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্রের বিধিসম্মত বিবাহিতা অনার্যা পত্নী অশ্বমেধ যজ্ঞ উপলক্ষে আর্য-সামাজিক চিত্রপটে বহু পূর্বপ্রাপ্তব্য সম্মান, স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন; কুন্তী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা ধন-রত্ন-বসন-অলঙ্কার ইত্যাদি বহুতর মহার্ঘ উপাচারে বধূকে আত্মিকরণ করেও নিয়েছেন রাজকুলে। আর উলূপীও অন্যান্য সপত্নীদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শ্বশ্রূমাতা কুন্তীর সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন। এ এক আশ্চর্য মহাকাব্যিক উদারতার প্রতিচ্ছবি।



মহাকাব্যের একেবারে শেষ পর্যায়ে অর্জুন যখন পট্টমহিষী দ্রৌপদী এবং অন্যান্য ভ্রাতাদের সঙ্গে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করেছেন, উলূপী কিন্তু আর হস্তিনাপুরে থাকেননি, আপন পিত্রালয়েও আর ফিরে যাননি প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এই নারী। তিনি স্বেচ্ছায় পুণ্যসলিলা গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ করে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। আর এই ভাবেই পরম প্রিয়তমের বিরহে আত্মবিসর্গের মাহাত্ম্যে এক রমণীয় স্বতন্ত্রতায় উলূপী সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন।



উলূপীর জীবনে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ছিলেন মুহূর্তের অতিথি, ক্ষণিকের উৎসব; মাত্র এক রাত্রের অঙ্কশায়িনী সোহাগিনী তিনি। তবুও সারা জীবন অর্জুনের এবং শুধু মাত্র অর্জুনেরই শুভ চিন্তা করে গেছেন উলূপী। প্রথম যৌবনে বিরহবিধুর বনবাসক্লিষ্ট বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনকে নিজের স্নিগ্ধ অঞ্চলছায়ায় আশ্রয় দিয়েছেন। নির্দ্বিধায় নিজের বাসনা চরিতার্থ করে নিজে সমৃদ্ধ হয়েছেন, বীরশ্রেষ্ঠকেও সুখাবেশে আবিষ্ট করেছেন। সর্বোপরি, ব্রহ্মচর্য ব্রতের নাগপাশ থেকে মুক্তির যুক্তি দিয়েছেন পরমবীর পার্থকে, বনবাসের অবশিষ্ট কালপর্যায়ে যার সাহায্যে অর্জুন অনেকটাই স্বভাবিক জীবনে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন।



নারীসুলভ সংকোচ-হীনা, স্বচ্ছদৃষ্টিভঙ্গী-সম্পন্না ও প্রখর বাস্তববাদী এই রমণীর বাসনা ছিল, কিন্তু লালসা ছিলনা। তাই আপন বাসনার চরিতার্থতায় তিনি নিজে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছেন প্রেমাস্পদকে। পূর্বতন স্বামীকুলের বৈরীতায় ভেঙ্গে পরেননি দৃঢ়চেতা এই নারী। নির্দ্বিধায় শ্বশ্রূকুল ত্যাগ করে পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছেন পিতৃগৃহে। সেখানে একক মাতা হিসাবে পুত্রকে পালন করেছেন বীর পিতার যথাসাধ্য উপযুক্ত করে। পরবর্তীকালে, পিতার প্রয়োজনে জীবনের একতম অবলম্বন সেই পুত্রকেও পিতার সাহায্যার্থে নিযুক্ত করতে এবং বিসর্জন দিতে দ্বিধান্বিতা হননি। আবারও অর্জুনের জীবনের আরও একটি সংকটকালে তাঁকে রক্ষা করতে সুদূর মণিপুর রাজ্যে ছুটে গেছেন এই রমণী।



লক্ষ্যনীয়, প্রথমবারের পর আর কখনই নিজের প্রীতিসাধন উদ্দেশ্যে অর্জুনকে বিচলিত করেননি তিনি। তাঁর এই অসম্ভব চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং অর্জুনের প্রতি দ্ব্যর্থহীন ফলাকাঙ্ক্ষারোহিত আত্মনিবেদন তাঁকে এক সমুজ্জ্বল বিশিষ্টতা দান করেছে, যা তাঁকে মহাকাব্যের সহস্র পার্শ্বচরিত্রের মিছিলে হারিয়ে যেতে দেয়নি।



উলূপী অল্পেই সন্তুষ্ট। অর্জুনের স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেই তিনি পরম তৃপ্তিতে সারাজীবন অতিবাহিত করে দিয়েছেন। উলূপী এতোটাই বন্ধনমুক্ত যে মাত্র একবার মিলন কামনা করেই ক্ষান্ত হয়েছেন । পরবর্তীকালে তাঁর অন্তরচেতনা অর্জুনের অপেক্ষায়, হিতকামনায় ও অন্তরসাম্যের ভাবনায় স্বর্গের পরিণতি লাভ করেছে।




প্রবন্ধের শুরুতেই যে বিষয়াভিলাষের প্রস্তাবনা, তার যথার্থ মূল্যায়ন করা গেল কিনা, পাঠকই তা বিচার করবেন। কিন্তু অন্তিমপর্বে এসে একথা অবশ্যই বলা যায়, মহাভারতের সুবিশাল পরিসরে সহস্র চরিত্রের সমাবেশে উলূপী এক অদ্ভুত দৃঢ় চরিত্র। মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান নায়ক অর্জুনের বহিশ্চরা অনার্যা নাগিনী ভার্যার এই চারিত্রিক দৃঢ়তাই পাঠকের চেতনায় আলোড়ন তোলে, নিশ্চিত। অসম্ভব বাস্তববাদী, প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী, মহিমান্বিতা এই রমণীর যুগাতিক্রমী প্রাসঙ্গিকতা পাঠককে একাধারে প্রভাবিত ও আশ্চর্যান্বিত করে, সন্দেহ নেই।

অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার

অনুবাদ কবিতা
ইন্দ্রানী সরকার


বসন্তকালে এক প্রার্থনা
রবার্ট ফ্রস্ট


আজ ফুলে ফুলে আমাদের আনন্দ দাও;
আর আগত ফসলের আগমনকে অনিশ্চিত করে রেখো না;
বসন্তের সমাবেশে আমাদেরও স্থান দাও |
আমাদের শুভ্র ফলের বাগানের সৌরভে আমোদিত করো,
সুখী মৌমাছিদের সাথে তাদের ঘুর্ণাবর্তে সামিল করো |
উড়ন্ত পাখিদের কলতানে আনন্দ দাও,
ধুমকেতুর তীক্ষ্ন সূচের মত পতনের
ও বাতাসে একাকী ফুলের সাথে সখ্যতা করে দাও |
কারণ এটাই ভালোবাসা, অন্য কিছুই ভালোবাসা নয়,
যা কি না ঈশ্বরের জন্য সংরক্ষিত, যা আমাদের অনুভবে জড়িয়ে নেয় |



A Prayer in Spring
Robert Frost (1915)


Oh, give us pleasure in the flowers to-day;
And give us not to think so far away
As the uncertain harvest; keep us here
All simply in the springing of the year.

Oh, give us pleasure in the orchard white,
Like nothing else by day, like ghosts by night;
And make us happy in the happy bees,
The swarm dilating round the perfect trees.

And make us happy in the darting bird
That suddenly above the bees is heard,
The meteor that thrusts in with needle bill,
And off a blossom in mid air stands still.

For this is love and nothing else is love,
The which it is reserved for God above
To sanctify to what far ends He will,
But which it only needs that we fulfill.