ধারাবাহিক - পিনাকী চক্রবর্তী

নাড়ু রহস্য
পিনাকী চক্রবর্তী



অন্তিম পর্ব

উদয়পুর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দক্ষিণে খেরওয়াড়া গ্রাম, আহমেদাবাদ হাইওয়ের ওপর। কলকাতা থেকে দিল্লী, তারপর দিল্লী থেকে উদয়পুর ট্রেনে, সেখান থেকে খেরওয়াড়া বাসে। খেরওয়াড়ায় বাসের থেকে নেমে, ভাড়ার সাইকেলে চড়ে মাঠঘাট পাহাড় পর্ব্বত পেরিয়ে আরও আট কিলোমিটার দূরে মাসারোঁ-কি-ওবরি গ্রামে পৌঁছলাম। যাতায়াতের বন্দোবস্তটা ভালোই। খেরওয়াড়ায় দাড়িওয়ালা সাইকেল-বাবার দোকান থেকে সাইকেল ভাড়া করে ওবরিতে ফেরত দেওয়া যায়, ভাড়ার পয়সা আর চিরকুটটা জমা করে। শুধু ওবরিতেই না, আরও বিভিন্ন দিকের গ্রামেও এই ব্যবস্থা। রাস্তা যেখানে যেখানে খারাপ, সেখানেই একটা সাইকেল সারানোর দোকান। সাইকেলের টায়ার পাংচার হলে, চেন ছিঁড়ে গেলে বা সীট ভেঙ্গে গেলে সারানোর খরচা গ্রাহকের, সাইকেল-বাবার কোনোই খরচা নেই। পরে জেনেছিলাম এই সাইকেল সারানোর দোকানগুলোও ওই সাইকেল-বাবারই বেনামী সম্পত্তি! জিওলজি পড়ে আর কি মোক্ষলাভ হবে? তার থেকে, টাকাপয়সা থাকলে এইরকম একটা সাইকেল ভাড়া দেওয়ার ব্যবসার চেন যদি খোলা যেত সারা রাজস্থান জুড়ে, তিনপুরুষ ধরে পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দিতাম। যাকগে সে কথা...

গ্রামের ব্যাপারে রাজস্থানী ধারণাটা আমাদের থেকে একটু আলাদা। বাংলার গ্রামে বসতি সবারই এক জায়গায়, পাশাপাশি, কাছাকাছি। হতে পারে বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত, কিন্তু তাও একই সাথে লাগোয়া। চাষের জমিও একসাথে লাগা, শুধু মাত্র আল দিয়ে আলাদা করা। ওখানে কিন্তু যেখানে যার জমি, তার ঠিক মাঝখানে তার কুঠিয়া। জমিগুলো কোথাও কাঁটাগাছ, কোথাও আলগা পাথরের দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা। কিন্তু অনেকটা বিস্তৃত উবড়খাবড় পাথরিলা জমিনের মধ্যে হয়তো এক ফালিতে চাষ হয়। এর ফলে এক একটা গ্রামের সীমানার একপ্রান্ত থেকে অন্য-প্রান্ত মাইল খানেকও হতে পারে, মাইল তিনেকও হতে পারে। ম্যাপে যেখানে ওবরি দেখানো ছিলো সেইটা গ্রামের পাটোয়ারীর বাড়ী। সাইকেল জমা করে আমি সেইখানে গিয়ে হাজির হলাম গোধূলীলগ্নে, আশ্রয়ের খোঁজে।

আমার মতো সম্মানিত অতিথি পেয়ে তো পাটোয়ারী অভিভূত। তিনি এই গ্রামে সরকারের প্রধান প্রতিভূ, আবার গ্রামের বাণিয়াও বটে। আমাকে খাতির করে খাটিয়ায় বসালেন, আমার সব বৃত্তান্ত শুনলেন, ওঁদের নিজেদের পাহাড়ের কৃতিত্বে মুগ্ধ হলেন – কারণ সুদূর কলকাত্তা মুলুক থেকে এসে আমি জয়পুর, উদয়পুর ছেড়ে ওঁদের গ্রামকেই বেছে নিয়েছি আমার পড়হাই-এর জন্যে – এটা তো তাঁদের ওই আখাম্বা পাহাড়েরই সৌজন্যে। সেই আনন্দে সন্ধে না নামতেই বাজরার রুটি আর কলাইয়ের ডাল দিয়ে ডিনার খাওয়ালেন তিনি এবং রাত্তিরে তাঁর দোকানে শোয়ালেন। বাজরার রুটি যাঁরা কখনো খান নি, তাঁদের জানিয়ে দিই যে ওই রুটির অর্ধেকটার ওপর আসনের মতো বসে বাকি অর্ধেকটা খেতে হয়। একেই তো তিনদিন ধরে চলার শ্রান্তি, তার ওপর ওই বাজরার রুটি চিবানোর ক্লান্তি। তালেগোলে জল ছাঁকার কথাটা আর খেয়াল ছিল না।

সারারাত সেই দোকানের মশলাপাতি, গোয়ালের সাঁজালের ধোঁয়া আর উঠোনের উটের নাদির গন্ধে ঘুম এলো না। ওদেশে উটের গোবরে ঘুঁটে দেয়, বাড়ীর উঠোনে সেই বস্তু স্তূপ করে সাজিয়ে রাখা থাকে। গন্ধে সমস্ত রজনী ম’ম’ করছিলো। তার ওপর ঠিক আমার পাশের ঘরেই একপাল ছাগল ভেড়া, তারাও সারারাত ম্যা’ম্যা’ করছিলো...আর সবার ওপর পাথরের মতো চেপে ছিলো আমার পেটের মধ্যে সেই বারকোশ সাইজের বাজরার রুটি।

ঠিক করে ফেললাম যে করেই হোক, পরের দিনই অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

আমার অবশ্য অত না ভাবলেও চলতো। কারণ পরের দিন তাঁর দোকানে আর বাড়ীতে লোক ভেঙ্গে পড়লো এই পরদেশি চিড়িয়া দেখতে – শুধু ওবরির থেকেই নয়, দূর দূরান্তর থেকে, এমনকি সারেরা-কি-পাল থেকেও নাকি এসেছিলো লোকজন আমাকে দেখতে। আসলে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে এমন অনেক জায়গা আছে যা আমাদের কাছে যতটা না অজানা তার থেকে অনেকটাই বেশী আমরা ওখানকার লোকদের কাছে অচেনা। একমাত্র ইলেকশনের সময় ছাড়া সেখানে বাইরের লোক কেউ যায়না। তাই পড়াশোনা করতে সুদূর কলকাত্তা থেকে আসা কালেজ স্টুডেন দেখতে লোকের ভিড় উপচে পড়লো পাটোয়ারী-জীর আঙ্গিনায়। ব্যবসা-পত্তর উঠলো মাথায়, তাই পাটোয়ারী-জী ঠিক করলেন আমাকে অনতিবিলম্বে স্থানান্তরিত না করলেই নয়।

তিনি ডেকে পাঠালেন গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাইকে। এঁকে এখানকার ভাষায় মান্ডসাব বলে লোকে। স্কুলটি সরকারী, তাই মান্ডসাব পাটোয়ারীর অধীনস্থ কর্মচারী। কিন্তু তিনি পড়ি-লিখি লোক বলে পাটোয়ারীর থেকে অনেক বেশী সম্মানিত। নাম শ্রী লক্ষ্মণ সিং মীণা, ধাম বাঁসওয়াড়া, অধুনা ঋযভদেব (জৈনদের তীর্থস্থান, খেরওয়াড়ার কাছে) নিবাসী। ছোটখাটো, হাসিখুশি, অল্পবয়সী ভদ্রলোক, একটা টিলার ওপর একটা ছোট্ট দোচালা ঘরে একটা প্রাইমারী স্কুল চালান। দেখামাত্রই ভাব হয়ে গেলো আমাদের। মীণাজীকে বলে দেওয়া হলো তাঁর স্কুলে আমাকে জায়গা দিতে। তিনি ডাকলেন ‘আসুন’...

আমি যাচ্ছিলাম দোকানঘরের দিকে আমার বাক্স-পেঁটরা নিতে, সবাই মিলে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো। “আপনি এগোন, আপনার জিনিষপত্র পৌঁছে যাবে।” প্রাইমারী স্কুলের দুই মুশকো জোয়ান ছাত্র ঘাড়ে করে আমার বেডিং আর সুটকেস নিয়ে এলো আমাদের পেছন পেছন। আড়ে আর বহরে আমার সমান সাইজের এমন প্রাইমারী ছাত্র আমি আগে দেখিনি, তাই কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে তাদের দেখছিলাম। মীণাজী অন্তর্যামী, আমার মনের কথা বুঝে নিলেন বলার আগেই। জানালেন এখানে দুপুরবেলা সরকারী খরচে খাবার দেয় প্রাইমারী স্কুলে, তাই এরা পড়তে আসে। প্রাইমারীটা একবার পাশ করে গেলে ফ্রিতে লাঞ্চ বন্ধ, তাই এরা বছর বছর ফেল মারে। বুদ্ধিমান ছাত্র, সন্দেহ নেই! আর ছাত্রীরা? না:, তাদের এত বুদ্ধি নেই। তাদেরকে দশ বারো বছরের মধ্যে স্কুলের পড়া শেষ করে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়, এত সময়ও তাদের নেই...কিন্তু আপনি তো ভূবিজ্ঞান নিয়ে রিসার্চ করছেন, সমাজবিজ্ঞান জেনে আপনার কি হবে? আপনি বাঙ্গাল মুলুকের লোক, আপনারা মেয়েদের ছেলেদের একই নজরিয়াসে দেখেন, মেয়েরা শিক্ষা না পেলে দেশ কতটা পিছিয়ে থাকে আপনারা কি জানবেন?

কথা বলতে বলতে আমার নতুন বাসস্থানে পৌঁছান গেল। একটাই ঘর, তার একটা দরজা, দুটো জানলা, একটা বারান্দা। সমস্তটার ওপর খড়ের দোচালা। ঘরের ভেতরে চার কোণায় চারটে মাদুর পাতা, এক একটা মাদুর একটা ক্লাসের জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। তার ওপরে বসে চারটে ক্লাসের বাচ্চারা নিজের নিজের পড়া সমবেত ভাবে চিৎকার করে পড়ছে, কেউ তারস্বরে নামতা, কেউ চিল-চ্যাঁচানো হিন্দি, কেউ বা অন্য কিছু। আর চতুর্থ ক্লাস লেখ (রচনা) লিখছে। কেউ কিছুক্ষণ না চেঁচালে একজন দিদিমণি বকুনি দিচ্ছেন, “কাকষা তিইইইন (মানে ক্লাস থ্রি), পড়হোওওও!” কোলাহল বললে পুরোটা বোঝানো যায় না, ক্যাকোফোনির ধুম বলতে হয়। নিজের কথা নিজে শুনতেই অসুবিধে হয়। এরই মধ্যে হয়ে গেল টিফিন টাইম, একটা প্রবল রণ-হুঙ্কার তুলে বাচ্চারা দৌড়ালো বাইরে, যেখানে টিফিনের ডালিয়া রান্না করা হচ্ছে...আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

স্কুলের দায়িত্বে আছেন মীণাজীকে নিয়ে তিনজন। টিফিনের সময় আলাপ হল দিদিমণিটি আর স্কুলের চৌকিদার বুধিলালের সাথে। বিশেষ করে এই শেষ জনের কথা বলতে হয়, কারণ ওবরির নানা ঝড় ঝাপটা এড়িয়ে আমার নৌকো পারে লেগেছিল এনারই দৌলতে। সে সব অনেক কথা, সেই ঝাঁপি খুলে বসলে আস্ত একটা ইতিহাস হয়ে যাবে। আপাতত জানা গেলো যে বিকেলবেলা স্কুলের ছুটির পর দুজন টিচারই চলে যান, থেকে যান ওই বুধিলালজী–তিনি নিজের খাবারের সাথে আমার খাবারটাও বানিয়ে দেবেন। আমি আমার বিছানাপত্র মাদুরের ওপর বিছিয়ে রাত্তিরে ঘুমাতে পারি, শুধু সক্কাল সক্কাল উঠে ব্যাগ বন্ধ করে, বিছানা গুটিয়ে এক কোণায় রেখে দিতে হবে যাতে স্কুল স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারে। আমার জলের সমস্যাটাও দূর হোল একই সাথে। একটা নতুন কেনা মাটির হাঁড়িতে আমার কাপড় দিয়ে ছেঁকে জল ভরা থাকবে আমার জন্যে, সুতরাং রোজ সকালবেলায় জল ছাঁকার ফ্যাচাংটাও থাকলো না।

কিন্তু মাঠে ঘাটে? কাজের সময়? এক ওয়াটার বটল জল ওবরির দুপুর রোদে কতক্ষণ টেঁকে ? জল ফুরিয়ে গেলেই দৌড়ঝাঁপ করে হয় কুয়ো খুঁজতে হয়, নাহয় কারুর বাড়ী গিয়ে হাজির হতে হয়। আর তারপরেই প্রাণে লাগে ব্যথা! ‘আমি তাপিত পিপাসিত, আমায় জল দাও’ বলে তো প্রথমে একেবারে ভিক্ষু আনন্দের স্টাইলে হাঁটু গেড়ে বসা। কিন্তু চকচকে পিতলের ঘটীতে ঝকঝকে জল যেই এলো ওমনি শুরু হোল ওয়াটার বটল বাগিয়ে তার মাথায় শাড়ীর টুকরোর ফিল্টার চড়িয়ে সেই জলের শোধন-পর্ব। এতে প্রকৃতি বা তার মা, মাসী, পিসী, চাচীরা কেউই বিশেষ আপ্যায়িত বোধ করেন না। এক একজন তো বলেই বসেন ‘আমাদের জলে যদি এতই নোংরা তো সেই জল নেওয়ার কি দরকার?’ পরের দিকে অনেক বাড়ীর দুয়ারে কর হেনে বা পঞ্চমে স্বর তুলে হেঁকেডেকেও কোনরকম সাড়াশব্দ পেতাম না! স্বাভাবিক! আমি হলেও এই ব্যবহারই করতাম নিশ্চয়! কিন্তু, এ তুমি আমাকে কি পরীক্ষায় ফেললে প্রভু? নির্জলা উপোষ করা শুনেছি, নির্জলা থিসিস করা তো কক্ষনো শুনি নি...

কুয়ো নিয়ে তো আর এক বিপত্তি! স্যার বলেছিলেন খোলা কুয়োর কথা, সাধারণ পাতকুয়ো নিয়ে কোনও সাবধান-বাণী শুনিনি তাঁর কাছে। কিন্তু এই যন্তরগুলো তো আমার কাছে এখন পর্যন্ত না দেখা সেই স্যারকথিত বাউলীর থেকে ঢের বেশী বিপজ্জনক। কেন? শুনুন তাহলে আপনাদের বলি। এই পাতকুয়োগুলোর পাড় বেশ উঁচু করে বাঁধানো – প্রায় আমার নাক বরাবর উঁচু, কে জানে কেন! কিন্তু বালতি তোলা নামানোর জন্যে কোনও কপিকলের বালাই নেই। কোন পার্মানেন্ট বালতিও নেই দড়িও নেই, যেমনটি অন্যান্য জায়গায় থাকতে দেখেছি, বিশেষ করে পুরনো হিন্দি সিনেমায়। এখানে যে যার কলসি দড়ি সঙ্গে করে নিয়েই আসে। ডুবে মরতে নয় নিশ্চয়ই, কারণ অত জল এখানকার কুয়োতে থাকেইনা। সুতরাং জল ভরতে। কিন্তু সেই জল ভরার কায়দাটা কি?

পাতকুয়োর পাড়ের ব্যাস প্রায় পাঁচ ছয় ফুট। একটা গাছের গুঁড়িকে লম্বালম্বি দুই ভাগ করে কেটে দুদিকের পাড়ের মধ্যে দুটো ব্রিজের মত পাশাপাশি পাতা আছে। ব্রিজ-দুটোর মাঝে হাত খানেকের গ্যাপ। আর ওই গ্যাপটাই হোল আসল জিনিষ। ওটার দিকে নজর রাখবেন।

বীরাঙ্গনা ভীল-বালারা নাতিদীর্ঘ ঘাগরা চোলি পরে, মাথায় তিন চারটে হাঁড়ি কলসির কুতুব মিনার বানিয়ে, হাতে একটা বালতির মধ্যে নাইলনের মোটা দড়ি নিয়ে কুয়োর ধারে আসতেন। হাঁড়ি কলসিগুলোকে কায়দা করে কুয়োর ধারে সাজিয়ে রেখে, স্ট্র্যাটেজিক ভাবে রাখা এক উপলখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে দুই লাফে উঠে যেতেন কুয়োর ওপরের গাছের গুঁড়ির ব্রিজে। তারপর দুই পা দুই ব্রিজে রেখে মাঝখানের গ্যাপ দিয়ে দড়ি-বাঁধা বালতিটা সরসর করে নিচে নামিয়ে দিয়ে জল ভরে নিতেন, আর হুড়মুড় করে টেনে তুলতেন সেটাকে। অতঃপর, ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে বালতির জল অব্যর্থ টিপে ছুঁড়ে ছুঁড়ে সারিবদ্ধ হাঁড়ি কলসিগুলোর মধ্যে চালান করে দিতেন। আসল ব্যাপারটা হোল এই, যে ওই গ্যাপটা যদি না থাকত তবে ঝুঁকি নিয়ে তক্তার একপাশে ঝুঁকে পড়ে জল তুলতে হোতো, তাতে ব্যাল্যান্সের অভাব হবার প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু আবার অনভ্যস্ত লোকদের পক্ষে দুই তক্তায় পা রাখা সহজ ব্যাপার না। আমি একবার নিজে নিজে জল তোলার চেষ্টা করার সময় দুটো তক্তা দুইদিকে স্লিপ করায় কুয়োর ভেতরে পরতে পরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। তার পর থেকে সেই অপচেষ্টা আর করিনি। এই বীরবালারা অপত্য স্নেহে আমার বোতলে জল ভরে দিয়ে থাকেন, কিন্তু জল ছেঁকে নিতে গেলে এনারাও বিরূপ হন। এই ছাঁকাছাঁকির ব্যাপারটা নিয়ে তো বড় ল্যাঠা হোল দেখছি!

চণ্ডালিকার কথায় মনে পড়লো - কুয়ো-তলায় একদিন অন্যরকম বিপত্তিও ঘটেছিলো। আমার বাবা নিজের হাতে আমাদের তিন ভাইয়ের জন্যে পৈতে তৈরি করে দিতেন। আমরা কখনো পৈতে না পরলে মুখে কিছু বলতেন না বটে, কিন্তু মনে মনে খুবই দুঃখ পেতেন। বাবা যতদিন ছিলেন, আমরা তিনজন নিয়ম করে পৈতে ধারণ করতাম। এইবারও কলকাতা থেকে বেরোবার আগে বাবা একদম টাটকা তাজা পৈতে বানিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন এক ভীল-কন্যা কুয়োর ওপর থেকে আমার বোতলে জল ঢালার সময় দেখতে পেয়ে গেলেন আমার শার্টের ভেতরে আমার কাঁধের ওপর সেই পৈতে। ভীল মেয়েদের মুখ সব সময় বিশাল ওড়নার আড়ালে থাকে, তাই পৈতে দেখার পর এনার মুখের ভাবান্তর দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নি। কিন্তু গলায় এক আকাশ মেঘ নিয়ে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন তিনি আমার কি ক্ষতি করেছেন যে আমি তাঁকে স্বামীপুত্র-পরিবারসহ নরকস্থ করতে চাই? আমি যে ব্রাহ্মণ দেওতা – এই কথাটা আগে জানলে তিনি, এক অন্ত্যজ নীচ জাত কি অওরত, আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতেন না, আমাকে জলদান করা তো দূর কি বাত! আমার কি উচিত হয়েছে এইরকম একজন নিরীহ নিরপরাধিনীকে ঘোর নরকের পথে ঠেলে দেওয়া ...ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেশ আমাকে সেই পৈতেটি বের করে শাপ দেওয়ার অভিনয় করতে হয়েছিল এই বলে যে যদি আমি যদি জলের অভাবে শুকিয়ে মরি, তাহলে এই মহিলার ব্রাহ্মণ-হত্যার যে অনন্ত পাপ হবে তার থেকে স্বয়ং ভগবানও তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন না। এবং সেই ভগবানই জানেন যে সেই কথাটা কতটা দুঃখের সাথে বলতে হয়েছিল আমাকে! কিন্তু জলটা পেয়ে গেছিলাম সেদিন ওই পৈতেরই জোরে...কে বলে কলিকালে ব্রহ্মতেজ কাজ করে না!!!

এইসব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম ঠিকমত জনসংযোগ রক্ষা করতে হলে সবসময় জল ছেঁকে খাওয়া সম্ভব নয়, আর গিনি ওয়ার্মের ইনফেকশন হবার জন্যে মাত্র একবার খারাপ জল খাওয়াই যথেষ্ট। আর সেটা তো এক আধবার করে প্রথম দিন থেকেই খেয়ে চলেছি। সুতরাং এইইনফেকশন আজ নয়ত কাল আমার কপালে ঠিকই নাচছে, পালাবার পথ নাই। তাই যদি হয় তাহলে কি দরকার এত ফ্যাচাং করে? আবার ভাবলাম যদিই ইনফেকশনটা না হয়ে থাকে এখন পর্যন্ত, তবে চান্স নিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ি কেন? না:, এত টানাপোড়েনের মধ্যে থাকাটা বড় কষ্টকর, একটা নিরপেক্ষ সার্ভে করে দেখি এই অঞ্চলে গিনি ওয়ার্মের প্রভাব বা প্রাদুর্ভাবটা কেমন। সত্যিই কি তিনি আছেন, নাকি আগে ছিলেন, এখন নেই... না কি আদৌ ছিলেনই না এখানে, স্যার মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিলেন।

যাকেই জিগ্যেস করি, কেউই গিনি ওয়ার্মের নাম শোনে নি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, এরা ইংরিজী নামটা জানে না... দেখি বর্ণনা দিলে বোঝে নাকি! জলে থাকে একরকম কিড়া, যা নাকি হাত পা ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসে – না, না, ওইরকম কোনও কিড়া মাকোড়া এখানকার পানিতে নেই, এখানকার পানি বহত সাফ অর মিঠা। পাতকুয়ো-বিহারিণী এক দেবী তো হাতেনাতে প্রমাণই দিয়ে দিলেন।

দোষের মধ্যে আমি তাঁকেও জিগ্যেস করেছিলাম এখানকার জলে কোনোরকমের কিড়া আছে কিনা। তিনি আমাকে কুয়োর তক্তার ব্রিজের ওপর উঠতে বললেন, এবং আমার হাঁচোড় প্যাঁচর করে পাড়ের ওপরে ওঠা দেখে খিলখিলিয়ে হাসলেন, আমি হাসিটা শুধু শুনলাম, দেখার তো আর উপায় নেই। তারপর তিনি নিচে দেখতে বললেন। কি দেখবো? মেঁডক। ব্যাঙ? কই কোথায়? আমি তো শুধু সবুজ জল দেখছি। তিনি নিচের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে দেখালেন অনেক নীচে, জলের লেভেল-এ একটি কূপমণ্ডূক, একটি প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি আঁতকে উঠে প্রায় জলে পড়ে যাচ্ছিলাম, এই ব্যাঙ-ওয়ালা কুয়োর জল আমি খাই? মানে খেয়ে থাকি? এক মাস ধরে খাচ্ছি?

দেবী অভয় দিলেন, বললেন যে কুয়োতে ব্যাঙ বেঁচে থাকে, সেই কুয়ো বিষাক্ত নয়। আর তা ছাড়া, কুয়োতে ব্যাঙ থাকলে সব পোকামাকড় খেয়ে ফেলে জল পরিষ্কার রাখে। সুতরাং এই কুয়োতে কোনও কিড়া মাকোড়ানেই থাকতে পারে না। কিউ ই ডি।

সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারাহি কাফি হ্যায়, তাও বলে দি আপনারা যাঁরা জ্ঞানীগুণী তাঁদের... সাবধান, যে কুয়োতে মরা ব্যাঙ ভাসে সেই কুয়োর জল একদম খাবেন না !!!

ব্যাস, হয়ে গেল সব সমস্যার সমাধান। আমি অবশ্য সাবধানের মার নেই বলে মান্ডসাব, বুধিলাল, পাটওয়ারীজী – কাউকেই জিগ্যেস করতে বাকি রাখি নি, কিন্তু নেট ফল হলো শূন্য। কেউই এইরকম কোন পোকামাকড় কথা শোনেন নি, গিনি ওয়ার্মের তো কথাই নেই। আর কি চাই! পরিষ্কার বোঝা গেল স্যার এই অঞ্চলে আগে আসেন নি, আর তাই ওঁর এই ওবরির জলের পোকা মাকড়ের ব্যাপারে সম্যক ধারণা নেই। আমি শাড়ীর টুকরোগুলোকে ব্যাগের নীচের দিকে চালান করে দিয়ে কুয়োর আছাঁকা জল খেতে লাগলাম দুগগা দুগগা বলে।

এর দুই সপ্তাহের মধ্যে স্যার এলেন আমার ফিল্ডের কাজের প্রাথমিক পরীক্ষা নিতে। প্রথম দিন দুপুরবেলায় তাঁর পরিদর্শনের পয়লা চক্কর সেরে আমরা ক্যাম্পে ফিরছিলাম। কিন্তু তখনো মীণাজীর স্কুল ছুটি হয় নি, সুতরাং আমাদেরও যাবার জায়গা নেই। তাই পাটোয়ারী-জীর দোকানে একটা ঢুঁ মারতে গেলাম। পাটোয়ারী-জী জানতেন আমার গুরুজীর আসার কথা আছে, না দেখা করালে ক্ষুব্ধ হতেন। আমরা যেতেই দোকান ছেড়ে বাইরে এসে ‘পধারিয়ে, বিরাজিয়ে’ ইত্যাদি গুরুভার সম্ভাষণে আপ্যায়িত করে বসালেন তিনি আমাদের। আমি বিরাজিত হলাম আমার পছন্দের বারোয়ারী চারপাইটার এক কোণায়। স্যারের জন্যে এল পিঠ-উঁচু একটা হেলান দেওয়া মোড়া। সাথে সাথে এল অতিথি সৎকারের স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী আচমনীয় এবং পানীয়, দুইরকম জল। অমনি স্যার বের করলেন পকেট থেকে শাড়ীর টুকরো, ছাঁকনি লাগালেন ওয়াটার বটলে আর সাথে সাথে কুঁচকে উঠলো পাটোয়ারীর ভুরু। তাই না দেখে আমি সটান পিতলের ঘটী থেকে উঁচু করে সব জল চোঁচা মেরে দিলাম। এক নিশ্বাসে ঘটী খালি।

ঘটী থেকে উঁচু করে জল খাওয়ার সময় নজরটা ওপর দিকে থাকে। ঘটী নামিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি স্যার জল ছাঁকা ছেড়ে আমাকে দেখছেন, চোখের দৃষ্টিতে আতঙ্ক, বিস্ময়, বিভীষিকা, তিরস্কার – সব মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। আমি বিপদ বুঝে সাদা বাংলায়ে বললাম, “স্যার, আপনি আপনার মত জল ছেঁকেই খান। কিন্তু আমি জল ছাঁকা ছেড়ে দিয়েছি। খবর নিয়েছি – এদিকের ত্রিসীমানায় গিনি ওয়ার্ম নেই।”

“তাই বল,” আমার কথায় মুখে হাসি ফুটলো তাঁর। হৃষ্টচিত্তে শাড়ীর টুকরোটা ভাঁজ করে পকেটে গুঁজে রাখলেন আবার। তারপর মুখটুখ ধুয়ে নিয়ে পাটোয়ারী-জীর আস্ত এক কুঁজো ঠাণ্ডা জল আমারই মত মেরে দিলেন চোঁচা করে। “ঠিকমত খবর নিয়েছিলে তো?” মুখ মুছতে মুছতে পরম স্নেহভরে হাসিমুখে জিগ্যেস করলেন তিনি, উত্তরের অপেক্ষা না রেখেই । আসলে তিনি জানতেন যে আমি বেশ সাবধানী ছেলে, খবর নিশ্চয় ভালো করেই নিয়েছি। তাই ওটা একটা কথার কথা বলা হল, জিগ্যেস করতে হয় তাই করা...আমি ঘাড়টা কোনদিকে নাড়লাম সেটা তাকিয়েও দেখলেন না।

জলটল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে স্যার ঠেট মেওয়ারি বোলিতে আড্ডা জমালেন পাটোয়ারীর সাথে। ততক্ষণে উটের দুধের ফুটন্ত চা এসেছে কাঁচের গেলাসে। আমি গরম চা খেতে পারি না, গেলাস মাটীতে নামিয়ে রেখে হাঁ করে কথাবার্তা শুনছি আর রোমাঞ্চিত হচ্ছি আমার গুরুর জ্ঞানের গভীরতা দেখে। স্ট্রাকচারাল জিওলজি ছাড়াও কত কিছুই না জানেন এই ভদ্রলোক। তিনি ততক্ষণে বৃষ্টি, বাদলা, সুখা, গর্মী, জওয়ার, বাজরা, চাষ আবাদ পার হয়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। এমারজেন্সী ভালো না খারাপ, এই সরকারের নাশবন্দি আর গ্রামীণ প্রকল্প সম্বন্ধে পাটোয়ারীর কি মত ইত্যাদি কূট প্রশ্নে পাটোয়ারী নাজেহাল। এরই মধ্যে শুনি স্যার বলছেন, “তবে এই নাড়ুর প্রকোপ থেকে দক্ষিণ উদয়পুরকে বাঁচানো একটা বিরাট ব্যাপার, এই একটা ব্যাপারে মানতেই হবে যে অন্তত একটা ভালো কাজ এই সরকার করেছে।”

নাড়ুর প্রকোপ? নাড়ু কি একটা খারাপ জিনিষ? কোনও নেশার পদার্থ বা তার কোড নাম নাকি? নাড়ু তো আমি রাজস্থানে এসে থেকে অনেক খেয়েছি, যোধপুরের ক্ষীরের নাড়ু অতি উপাদেয় বস্তু, যদিও এদেশে ওটাকে লাড্ডু বলে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু ওদিকে পাটোয়ারীর ধরণ দেখে মনে হল তিনি এতক্ষণে একটা প্রশ্ন কমন পেয়েছেন। হাঁকপাঁক করে বলে উঠলেন, “লেকিন নাড়ু গিয়েছে কোথায়? দস্তুরমত মওজুদ আছে দক্ষিণ উদয়পুরে, আমাদের এই গ্রামেই আছে কত লোকের! আরে ও লাখন, তোর ইস্কুলের কত ছাত্র ছাত্রার আছে, গুরুজীকে দেখিয়ে দে তো! আপনিও যেমন লোক, গুরুজী, নাড়ু দূর করবে এই সরকার? মুরোদ জানা আছে...!

মনের গভীরে একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ মাথা চাড়া দিচ্ছিল। আমি ভয়ের চোটে স্যারের দিকে না তাকিয়ে নিচু হয়ে সন্তর্পণে চায়ের গেলাসের টেম্পারেচার মাপছি। হঠাৎ হিস্ হিস্ করে হুঙ্কার, (হ্যাঁ, হিস্ হিস্ করেও হুঙ্কার দেওয়া যায়)... “পিনাকীইইইইই...!” আমি আবার বিষম খেলাম, চায়ে চুমুক না দিয়েই। মাথা তুলে দেখি স্যারের রুদ্রমূর্তি। আমি আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম ‘এই নাড়ু জিনিষটা কি?’ – “নাড়ু কি, সেটাই তুমি জানো না? বা, বা, বাঃ!!! তবে তুমি কিসের খবর নিয়েছিলে হে?” “গিনি ওয়ার্মের, স্যার!” আমার সরল স্বীকারোক্তি। “সে কি? গিনি ওয়ার্মের নাম এরা জানবে কি করে? তোমাকে আমি বলে দিই নি গিনি ওয়ার্মের লোকাল নাম নাড়ু?” ‘না তো, স্যার!’ এবার স্যার একটু থমকালেন, “তা হলেও, তোমার তো উচিত ছিলো আমাকে জিগ্যেস করা!” কি কারবার রে বাবা, ইনি তো দেখি যত দোষ, সবই এই নন্দ ঘোষেরই ঘাড়ে চাপাতে চান, এইসব কি ভালো কথা? কিন্তু আরও কথা বাকি ছিলো, সেটা স্যার বললেন স্কুলের টিলায় চড়তে চড়তে।

“শোন পিনাকী, সামনের বছর পূজোর আগে পর্যন্ত যদি তোমার বা আমার গিনি ওয়ার্মের লক্ষণ দেখা না দেয় তবে ধরে নেব কপালজোরে বেঁচে গেছি। সে ক্ষেত্রে তোমার একবারে এমএসসি পাশ করে যাওয়ার খুব জোর একটা সম্ভাবনা আছে। না হলে আমার কপালে যতটা দুঃখ আছে, তোমার কপালেও ঠিক ততটাই দুঃখ নাচছে – হতে পারে অবশ্য তার থেকেও বেশী, অনেক বেশী।”

ইংরিজীতে এরে কয় ভেইলড থ্রেট!

খুব একটা “ভেইলড”-ও না!

এক সপ্তাহ পরে আমি স্যারকে ফিরতি পথের বাসে তুলে দিতে এসে ঋষভদেব জিউয়ের কাছে পূজো দিয়ে এলাম, কিন্তু শাকাহারী জৈন সাধু যদি ঘোরতর মাসা-হারী বাংগালী পাতকীর কথা না শোনেন, তাই সাবধানের মার নেই বলে উদয়পুরের আশপাশে যত দেব-দেউল আছে সব জায়গায় ঘুরেফিরে দেখা সাক্ষাত করে এলাম। একলিঙ্গ-জী থেকে শ্রীনাথ-জী, কারণিমাতা থেকে নীমাচমাতা, সব্বাইকে আর্জি জানালাম, আমাদেরকে, মানে আমাকে আর আমার স্যারকে যেন নাড়ুর হাত থেকে তাঁরা বাঁচান, আমি এমএসসিটা পাস করে নিই। ভুলেও আর গিনি ওয়ার্মের নাম নিই নি, পাছে আবার তেনাদের কোনোরকম ভুল বোঝাবুঝি হয়।

হয়নি সেরকম কোনও ভুল বোঝাবুঝি। পূজো এলো, ভালোয় ভালোয় কেটেও গেলো, নাড়ুর দেখা নাই রে নাড়ুর দেখা নাই। আর আমার এমএসসি পাশ করা ঠেকায় কেডা? কেউ ঠেকায় নি। থিসিস পেপারেও বেশ ভালই নম্বর পেয়েছিলাম, যদিও এক্সটারনাল এগজামিনার এসেছিলেন, স্যারের কোনও হাত ছিলো না এতে...তাও!


কিন্তু এর পর থেকে আমার সবরকমের নাড়ুর ওপর কেমন একটা বিতৃষ্ণা এসে গেলো। সে তিলের নাড়ুই হোক বা নারকোল নাড়ু, আমি নাড়ু দেখলেই ফুটপাথ বদল করে প্যালারামের ল্যাংচাদার মতো – “দীনবন্ধু কৃপাসিন্ধু কৃপাবিন্দু বিতরো” গানটা গাইতে গাইতে উলটো পথে হাঁটা লাগাতাম।


1 মতামত: