ভ্রমণকাহিনী - তন্ময় গুপ্ত

সুন্দরী শিলং অসামান্য আসাম
তন্ময় গুপ্ত

(শেষ পর্ব)




এবার গন্তব্য শিলং পিক। আকাশ বেশ কালো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ফলা চিরে দিচ্ছে চারপাশ। শিলং পিক এর গেটের সামনে আমাদের বাস থামল। অনতিদূরে একটা ট্রান্সফরমার । এমন সময় একটা তীব্র আলোর ঝলকানি ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের ফুলঝুরি আর একটা বুক কাঁপান বজ্রপাতের নির্ঘোষ-ধ্বনি। দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলাম।


পিক এ উঠে অবশ্য ভুলে গেলাম এই ঘটনা। কনকনে ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া গোটা শহরটা কে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। বিষণ্ণ মনে ফিরে আসছি, পাহাড়ের গায়ে কিছু ২-৩ ইঞ্চি বাসন্তী বা লেবু-সবুজ রঙের গাছ দেখলাম যার প্রতিটি তে উজ্জ্বল বেগুনি বা রানি রঙের থোকা থোকা ফুল। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলাম দূরে পাহাড়ের পদতলে নানা রঙের অনেক ফুল ছড়ান, কাছে গিয়ে দেখলাম...... একটি স্তবক। একটি সদ্য-নির্মিত সমাধি। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গিরিরাজের কোলে শুয়ে আছে কোন এক মানব সন্তান। মনটা চারিপাশের প্রকৃতির মতই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।









১৭ই এপ্রিল,২০১৩

আমাদের গাড়িটা মেঘ ধরবে বলে উঁচু আরও উঁচুতে উঠছে। পাহাড়ি রাস্তা সরু হয়ে যাচ্ছে যখন তখন। আমি জানলার পাশে বসে অতলান্ত বিভাজিকা দেখে উদাস হয়ে যাচ্ছি কখনও আবার কখনো বা শিউরে উঠছি যখন গাড়ির চাকা আর রাস্তার কিনারার ব্যবধানটা চোখে পড়ছে । ঠিক এমন সময় গাড়ির টায়ার পাঞ্চচার হল। আমরা একে একে নেমে এলাম। হাত পা ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা ! মেঘের স্পর্শ পেলাম, উড়ে চলেছে। আনমনে দুজনে প্রায় এক সাথেই গেয়ে উঠলাম ‘ ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও, কোন ঠিকানায়’ ।

গন্তব্য মউলিনং । এশিয়ার পরিষ্কারতম গ্রাম। ১০০% শিক্ষিত। রাস্তার প্রথম দ্রষ্টব্য ‘লিভিং রুট ব্রিজ’। পাথর সাজিয়ে সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ৭০ ফুট নিচে নেমে দেখতে পেলাম সেই প্রাকৃতিক সেতু। বিস্মিত হওয়ার মতই ! বিশাল এক বটগাছ তার ঝুড়ি নামিয়েছে। গাছটার ঠিক নিচ দিয়েই বয়ে চলেছে ১৫ ফুট চওড়া এক খরস্রোতা ঝর্ণা। গাছের শাখাপ্রশাখা দীর্ঘ প্রসারিত হয়ে ঝর্ণাটিকে অতিক্রম করে অপর পাড়ে পৌঁছেছে। এই প্রসারিত শাখাপ্রশাখার থেকে অজস্র ঝুরি নেমে বানিয়েছে সেই সেতু। তাই পারাপার করার রাস্তা এই জীবন্ত সেতু, প্রকৃতির হাতে গাছের মূল দিয়ে গড়া । মুগ্ধ হলাম এই ঝুলন্ত সেতু দেখে।




চমকের বাকি ছিল। গাছ- বাড়ির নাম তো শুনেছিলাম, আজ তা চাক্ষুষ করলাম। বিশাল উঁচু এক গাছের ওপর বাঁশ ও খড় দিয়ে বানানো এক কুটির। বাঁশ দিয়ে মই বানানো হয়েছে। ওপরে উঠে বাংলাদেশ এর সিলেট জিলা দেখা গেল।

অবশেষে সেই পরিষ্কারতম গ্রাম মউলিনং। ছোট গ্রাম। ছবির মত ঘর। অনেক ফুলের গাছ। সবাই মিলে চেষ্টা করলে কি না হয় ! কাল শিলং ছেড়ে চলে যাব গুয়াহাটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও শিলং কে মনে রাখতে হবে এখানকার আবালবৃদ্ধবনিতার হাস্যজ্বল মুখগুলির জন্য। এখনো পর্যন্ত একটি মুখ ও দেখলাম না যে মুখে হাসি লেগে নেই...।







১৮ই এপ্রিল,২০১৩

সকাল থেকেই বৃষ্টি । একটানা। কালো আকাশ। ব্জ্রপাত। বিদ্যুৎ । আজ শিলং ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভিজে মন, ভিজে শিলং। এম.টি.ডি.সি.র বাসে চলেছি। কতকগুলো গাল-ফুলো পুতুলের মত বাচ্চা স্কুল ইউনিফর্ম এ। হাত নেড়ে বিদায় জানালো আমায়। পিছনে ফেলে এলাম গত ৪ দিনের মধুর স্মৃতি, আর আমার নতুন বান্ধবী – সেই আকাশী ফুলে ভরা গাছ কে।

ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে গৌহাটি শহর। সুন্দর রাস্তাঘাট । হোটেল এ লাগেজ রেখে বেরিয়ে পরলাম। চিড়িয়াখানা দেখলাম, কলাক্ষেত্র বা আর্ট মিউজিয়াম দেখলাম, আর গেলাম কামাখ্যা মন্দিরে। বন্ধুরা মাফ কোরো , কোনও মন্দির মসজিদ গির্জা তে আমার ঈশ্বর দর্শন হয়না।

কাল যাব কাজিরাঙ্গা। বুকিং সেরে ফিরে আসছি হোটেলে, ব্রহ্মপুত্র নদে হলুদ বিকেলের বিষণ্ণ প্রতিচ্ছবি, গাড়ির সাউন্ডসিস্টেম এ তাঁর কণ্ঠস্বর... “এক বস তু হি নহী, মুঝসে খফা হো বৈঠা...” বন্ধুরা, আমার ঈশ্বর দর্শন হোল।




১৯ শে এপ্রিল,২০১৩

একবার আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকানো, তারপর একটা তিড়িং করে লাফ এবং বিদ্যুৎগতিতে দৌড়। একটা, আর একটা, আরও একটা। বাদামী বড় শিং-ওয়ালা হরিণ। দূরে একটা সাদাটে পাথুরে পিঠ দেখা গেল। একমনে ঘাস খেয়ে চলেছে। একশৃঙ্গ গণ্ডার। কাজিরাঙ্গা ফরেস্ট এ ঢোকবার ঠিক মুখে। কাল এলিফ্যান্ট সাফারি।

কাজিরাঙ্গা ফরেস্ট গেস্ট হাউস এ আমরা সবাই সন্ধ্যাবেলায় আসাম চা এর পেয়ালা হাতে লম্বা বারান্দায় বসে আছি, সামনের লন এ আলো ছায়া মাখামাখি, এমন সময় ৮ টি বাচ্চা ছেলে মেয়ে এল। মুহূর্তেই শুরু হল বিহু নাচগান । অসমে এখন রঙ্গোলী বিহুর সময়। অপূর্ব নাচ ও গান এ মাতোয়ারা আমরা। চেনা সুর। গলা মিলিয়ে দিলাম।



২০ শে এপ্রিল,২০১৩


হাতিটা দুলকি চালে এগিয়ে চলল ঘন তৃণভূমির মাঝে পথ বানিয়ে। সঙ্গী হাতীগুলো এগিয়ে গেছে। আমরা সবার শেষে। হাতিটার পিঠের ওপর মাহুত, জন্টি, চৈতালি এবং একদম পিছনে আমি বসেছি। মানে আমি দলের সবার পিছনে, আমার পিছনে আর কেউ নেই ভাবতেই পিঠটা কেমন শিরশির করে উঠল। মাহুতকে চাপা গলায় বললাম ‘ভাই একটু এগিয়ে’। কাজিরাঙ্গা ফরেস্ট -এ ঢোকার মুখেই নোটিস বোর্ডে দেখেছি এই বনের বাসিন্দারা হলেন গণ্ডার, হরিণ, বুনো মহিষ, হাতি এবং... বাঘ। খানিক এগোতেই গণ্ডার দর্শন হোল। বেশ বড়সড় পুরুষ একটা। মাহুত দেখাল সঙ্গিনী দখলের লড়াইয়ে কিছুদিন আগেই জখম হয়েছে সে। এরপর হরিণ-এর ঝাঁক। দল হরিণ বলে এদের। অনেক দূরে দেখা গেল বুনো মহিষ এর পাল। মাহুত বলল ওদের কাছে যাওয়া বিপদজনক। কিছুটা এগিয়ে ভিজে মাটির কাছে আমাদের হাতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে পেলাম সে মাটির ওপর বাঘের পায়ের ছাপ। মাহুত জানাল এ ছাপ টাটকা। গা শিউরে উঠল। তাহলে বনবিবি কি এতক্ষণ আমাদের ওপর নজর রাখছিল ?




আরও এগোতে একটা অপূর্ব বন মুরগী। বেশ কয়েকটা শ্যামা, দোয়েল, ঘুঘু। একটা জলাশয়ের পাশে বেশ কিছু ক্রেন। দূরে জলের ফোয়ারা, একটু এগোলাম, বুনো হাতির দল। জলকেলি তে মত্ত। এরপর দুটো সরু পথ। গভীর অরণ্যের শুরু। বিনা অনুমতিতে এবং সশস্ত্র রক্ষী ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। সাফারি শেষ। ফিরে আসছি, দেখি একটা বড়সড় হাড়, বুনো মহিষের। পরে আছে একটা ঝোপ এর ধারে। বাঘের ভুক্তাবশেষ। ফিরে চলে এলাম বাংলো তে। সকালের সোনা রোদ বারান্দায় লুটিয়ে আছে। বেশ কয়েকটা সুন্দর দিন কাটল। দুপুর ১ টায় বিমান ছাড়বে, তাই একটু পরেই রওনা হব গৌহাটি বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে।


সমাপ্ত


1 মতামত:

  1. OPEKKHA KORCHHILAM SESH TUKU PORAR JONNO....DERI HOLO PORTE......CHHOBIR MOTO JHOKJHOKE LEKHA TORTOR KORE EGIYE JAY....KOKHON JE SESH HOYE GELO, BUJHTEI PARLAM NA.....AARO ONEK PORTE CHAI, DADA TOMAR LEKHA...:)

    উত্তরমুছুন