ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ভূস্বর্গে হনিমুন
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



ডাঃ অবিনাশ সেন । মেডিক্যাল কলেজের সত্তর দশকের কোনও এক সময়ের ব্যাচ । কৃতি ছাত্র । টপ স্কোরার না হলেও দশজনের মধ্যে একজন ছিল । এম-বি-বি-এসের পরে আরও গোটা পাঁচ ছয় দেশী বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে সরকারী চাকরিতে ঢুকেছিল । কিন্তু অন্যের তাঁবেতে থেকে চাকরি বেশী দিন ভাল লাগে নি । ছেড়ে দিয়ে ফ্রি প্র্যাকটিস শুরু করেছিল ।

মাস্টারমশাইরা সব হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, নিজের ফিউচারটা এমনভাবে ফুটুরডুম করে দিয়ো না অবিনাশ । পস্তাতে সময় বেশী লাগবে না ।

চল্লিশ বছরের ওপর প্র্যাকটিস করে গেল । কিন্তু পস্তাবার সময় এখনও পেল না সে ।

কি করেই বা পাবে ? তার হাতে অত সময় কোথায় ? দিনরাত রুগী রুগী আর রুগী । সারা জগতের সব রুগী কি এসে পড়ল তার চেম্বারে ? হায় রে । দেশে এত রুগী ? কিন্তু হায় কথাগুলো ভাবার সময় পর্যন্ত নেই তার ।

জামাই একবার নমস্কার করতে এসেছিল শ্বশুরকে । বিয়ের পর প্রথম জোড়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছে । তা তাকে সটান তুলে দিয়েছে রুগী দেখার বেডে । জামাই তো হতবাক । স্টেথো হাতে শ্বশুরকে দেখে তার তো খুব ভয় হচ্ছিল । এই রে এই শ্বশুর-ডাক্তার না তার দুটো কিডনিই কেটে নেয় ।

শেষে শাশুড়ি এসে রক্ষা করল । অবিনাশ চিনতে পারে নি জামাইকে । চিনবেই বা কি করে ? মেয়ের বিয়ের সব কাজ তো ধরতে গেলে একা ময়ূরাক্ষীই করেছে । অবিনাশের অত সময় কোথা ? এর মধ্যে একটা ফাঁক ফোকর খুঁজে নিয়ে হবু জামাইকে দেখে এসেছিল । তাও মিনিট পাঁচেকের বেশী নয় । একটা নার্সিং হোম থেকে ফোন এল । এক রুগীর অবস্থা খুব খারাপ । এখুনি অপারেশন করা চাই ।

আর বিয়ের দিন কোনমতে সম্প্রদানটুকু করেই ছুটতে হয়েছে নার্সিং হোমে । কারণ আর কি – ঐ জরুরি ফোন । অবিনাশ অনেক টাকা মানে ফিসের ডাক্তার । কিন্তু ফাঁকিবাজ নয়। বলে রুগীরা আমায় যা দেবে আমি যেন তাদের তেমনটাই ফিরিয়ে দিতে পারি ।

- আনসোশাল গো আনসোশাল । আত্মীয়রা অভিযোগ করে, লোকটা একেবারেই আন সোশাল । রুগী রুগী করে লোকটা না পাগল হয়ে যায় ।

- আনসোশাল নয়, অ্যান্টিসোশাল । দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে গজরায় ময়ূরাক্ষী । অবিনাশের বড় সাধের “ময়ূর” ।

একবার একটা বাচ্চা ছেলের খুব অসুখ । কেউ সারাতে পারছে না । ডাক পড়েছে অবিনাশের । রুগী দেখার পর সে ভরসা দিল, কেসটা একটু ক্রিটিক্যাল বটে তবে সেরে যাবে ।

এরপর আবার একটা নার্সিং হোমে যাবার তাড়া । মোটরে উঠে দেখল ময়ূরাক্ষী ছুটতে ছুটতে আসছে । বলল, তুমি ? তারপর ভাবল তার একটু বাতিক আছে । অসুস্থ মানুষের জন্যে তার প্রাণ কাঁদে । তাই হয়ত এসেছে ।

স্ত্রী উঠে বসে বলল, আমি আজ যাই । জয়ার শাশুড়ি খুব একটিভ মানুষ । উনিই সামলে নেবেন ।

হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে গেছে এমনই ভেবে অবিনাশ বলল, এই দেখ ওরাই ভুলে গেছে কিম্বা হয়ত দিয়েছিল আমিই কোথায় হারিয়েছি ।

- কি দিয়েছিল ? কি হারিয়েছ ?

- আর বল কেন ? মনে হচ্ছে ফিসের হাজার টাকার কটা নোট যেন দিল । কিন্তু কোথায় যে রাখলুম না ওরাই ভুলে গেল কে জানে –

ময়ূরাক্ষীর তো তখন ধিৎকারে চুল ছেঁড়ার মত অবস্থা, হায় ভগবান ! কে ফিস দেবে তোমায় ?

- ঐ তো ওরা পেসেন্ট পার্টী ?

- তুমি যে কি একটা না ? জান না বাচ্চাটা কে ?

অবিনাশ ভ্রু কুঁচকে বলল, কে ?

দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল ময়ূরাক্ষী, নিজের নাতিটাকেও চিনতে পারলে না ? নিজের একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে ?

ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল অবিনাশ । কিন্তু কিছু দিনের জন্যে । তারপর ভুলে গিয়েছিল । আবার ডুবে গিয়েছিল রুগী দেখার কাজকর্মে । কিন্তু আর তো পারা যায় । দিনে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম পেলে কি শরীর টেকে ? ময়ূরাক্ষী বলল, আমি আর থাকব না এখানে । আর আমার ভাল লাগছে না ।

এবার একটু খেয়াল হল বটে অবিনাশের । সেও তো চায় রুগী কমাতে । কিন্তু কি উপায়ে যে কমে তা বুঝতে পারছে না । একজন বলল, ফিস ডবল করে দাও । রুগীর পকেটে টান পড়লে আর সকলে আসবে না ।

তাই করা হল । কিন্তু হিতে বিপত্তি । প্রথমটায় একটু রুগীরা হতচকিত হলেও অচিরে অবস্থা আরও ভয়ংকর দাঁড়াল । রুগীর সংখ্যাও ডবল হয়ে গেল । কথায় বলে রেস্টুরেন্ট চেনা যায় ডিসে আর ডাক্তার চেনা যায় “ফিসে” । যার যত বেশী ফিস তার কদর তত বেশী । এরপর চান করা আর খাওয়ার সময়গুলো কাটছাঁট করতে হল ।

ছেলে চাকরি পেয়ে বিদেশে চলে গেছে । আর সবাইকে হলেও বাবাকে ফোন করে না । যদি ব্যস্ত বলে না ধরে । মেয়েজামাই নাতি আর কখনও আসেই না । ময়ূরাক্ষী আর থাকবে না । সে জামাকাপড় গোছাচ্ছে ।

রুগী আরও কমান দরকার । কিন্তু কেমন ভাবে ? একজন কানে কানে পরামর্শ দিল ।

পরের দিন থেকে ফিস অর্ধেক করে দিল অবিনাশ । গরীবরা সবাই থেকে গেল । বড়লোকেরা হাওয়া । কিন্তু তবু রুগীর চাপ অসহ্য । কমাতে কমাতে ফিস নিয়ে এল মাত্র পঞ্চাশ টাকায় ।

বড়লোক রুগী তো গেছেই । গরীবরাও মুখ ফেরাল ।

- এ ডাক্তার যেন কেমন ধারা হয়ে গেছে গো । সস্তার ফি আবার সস্তার ওষুধ । এত বড় বড় রোগ কি সস্তার ওষুধে সারে ?

তিনমাস পরের কথা । অবিনাশ হাঁক পাড়ল, আজ কজন ?

কম্পাউন্ডার রাখাল বলল, আজ তিনটে ডাক্তারবাবু ?

দিন পনের আরও গড়াল । অবিনাশের এখন ফিস হচ্ছে মাত্র কুড়ি টাকা ।

ময়ূরাক্ষীকে বলল, পনের আগস্ট আমাদের অ্যানিভারসারি নয় ?

- মনে আছে দেখছি ? ঠোঁট বাঁকাল ময়ূরাক্ষী ।

- কোথায় যেতে চাও ? কাশ্মীর ? ওকে ! আমাদের এই বাষট্টি আর সাতান্নর আবার মধুচন্দ্রিমা হবে সেখানেই । রাখাল একটা নোটিশ দিয়ে দাও পনের দিন আমরা থাকব না ।

রাখাল বলল, দরকার হবে না স্যর । আগের পনের দিনে একটাও রুগী হয় নি ।

যাবার আগের দিন ফাঁকা চেম্বারে বসে আছে অবিনাশ । একজন এল লুঙ্গি পরে । অবিনাশের খুব চেনা গরীব এক রুগী ।

অবিনাশের নামে রটে গেছে সে কোনও এম-বি-বি-এস ডাক্তারই নয় । তার সব ডিগ্রী জাল । ও একটা হাতুড়ে ডাক্তার ছাড়া আর কিছু নয় । নিশাপদ ওর বন্ধু । উকিল সে । বলল, আমাকে বললেই আমি একটা ডি-ফেমেশনের মামলা ঠুকে দেব । যারা বলছে তারা আর বলার সাহস পাবে না । অবিনাশ হাসতে হাসতে বলল, তাহলে মামলাটা কর আমার নামেই । আমিই তো ফিস কমিয়ে আমার ডি-ফেমেশনের সুযোগ করে দিয়েছি ।

ইতিমধ্যে নিজের আকাউন্ট দেখার সময় হয়েছে অবিনাশের । সব মিলিয়ে তার ব্যালেন্স কোটী লাখ এসব কি যেন শুনেছে ময়ূরাক্ষী । মনে রাখতে পারে নি । শুধু জিজ্ঞেস করেছে, আর লাগবে ?

অবিনাশ লাফিয়ে উঠেছে, একদম না । শুধু স্বস্তি চাই । আর চাই কাশ্মীরে হনিমুন করা ।

লুঙ্গি পরা লোকটির নাম আব্বাস । তাকে বলল, যাও ডাঃ নোটন ঘোষের কাছে ।

- আপনি থাকতে নোটন ঘোষ ?

শুনছ না লোকেরা আমার কথা কি বলে ? আমার ডিগ্রীগুলো নাকি ভুয়ো ।

- ডাক্তারবাবু আমি অশিক্ষিত মানুষ । আমি আপনার ডিগ্রী কি পড়তে পারি ? তাছাড়া – তাছাড়া কি ?

- ডিগ্রী কারোর চিকিৎসা করে না ডাক্তারবাবু ।

অবিনাশ অবাক হয়ে বলল, তবে কি করে ?

- চিকিৎসা তো ডাক্তারের ভেতরের মানুষটা করে গো । তার শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞান বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, মানবিকতা এইসব । ওষুধের দোকানগুলো সব কি বলে জানেন ?

- কি বলে ?

- বলে অবিনাশ ডাক্তার এত অল্প দামের ওষুধে এত বড় বড় রোগ সারাতে পারে যে আর কেউ পারে না । আমি তো জানি ডাক্তারবাবু আমার ছেলেটাকে কেমন করে কত অল্প পয়সায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ।

অবিনাশ চুপ করে ছিল । আব্বাস আবার বলল, সব গরীব এক নয় বাবু । এখানকার গরীব রুগীরা বেশী ফিসের ডাক্তার ছাড়া আর সব অবিশ্বাস করে । কিন্তু এমন অনেক গরীব আছে যারা খেতেই পায় না তো ফিস দেবে কোথা থেকে ? তাদের কাছে ভিক্ষের চাল কাঁড়া আর না কাঁড়া দুইই সমান ।

অনেক অনুনয় করেছে আব্বাস । তাই কাশ্মীর যাবার আগে আব্বাসদের গ্রামে একদিনের জন্যে এসেছে অবিনাশ । সুন্দর আকাশ, ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস আর মনোরম প্রকৃতির পাশে দারিদ্র সার বেঁধে দাঁড়িয়ে । স্বর্গ আর নরকের সুন্দর সহাবস্থান ।

ক্যামেরার ছবি তুলে ইমেল করে ময়ূরাক্ষীকে পাঠিয়ে দিয়ে জানতে চাইল, এই স্বর্গটা কি তোমার পছন্দ হয় ময়ূর ? যদি হয় তবে তুমি আমার ডাক্তারি ব্যাগ সমেত তোমার সব কিছু নিয়ে চলে এস । হনিমুনটা আমরা এখানেই সারব ভাবছি ।

নিজের আকাউন্টের টাকা দিয়ে এই গ্রামে একটা হেলথ সেন্টার খুলেছে অবিনাশ । নাম দিয়েছে, ভূস্বর্গ স্বাস্থ্য -নিবাস ।


ময়ূরাক্ষী নিয়েছে নার্সিং ট্রেনিং । বুড়ো বয়েসে আর কোথায় শিখতে যাবে ? স্বামী আছে না? অবিনাশ – মনে যার ক্ষয় নেই ।


1 মতামত: