সম্পাদকীয়





সম্পাদকীয় 




দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ–
নব-অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ–
ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর..... 
                                                              -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কোথা হতে এল আষাঢ়, এলো বর্ষা। আষাঢ় - বাংলা সনের তৃতীয় এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের চতুর্থ মাস। নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রউত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। 

এ বছর জ্যৈষ্ঠের অস্বাভাবিক তাপদাহের পরে ঠিক সময় মতো বর্ষা না এলে জনজীবনের বিপর্যয় সহনশীলতার সীমা লঙ্ঘন করত, সন্দেহ নেই। তবে বর্ষা এবার নিরাশ করেনি। 


সাহিত্য-সরস্বতীর সমস্ত স্নেহ সুধার অর্ধেকই বুঝি বর্ষিত হয়েছে এই বর্ষা ঋতুর উপর। সেই ঋতুর সূচনা, এই আষাঢ়ের নব ঘন জল-ভারাক্রান্ত কালো মেঘ কবিচিত্তকেও বুঝিবা আচ্ছন্ন করে ফেলে বিরহী যক্ষের ব্যথাতুর হৃদয়ের মতো। এমনই এক মনভারীকরা আষাঢ়ের দিনে চলে গেলেন একাধারে ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক শক্তিপদ রাজগুরু (১ ফেব্রুয়ারী, ১৯২২ - ১২ জুন, ২০১৪) । তাঁর লেখালেখির সূচনা ১৯৪৫ সাল থেকে। তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ ও প্রায় এক’শরও বেশী উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা যেন তৎকালীন সমাজের একটি জীবন্ত দলিল। তাঁর বহু উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা, মনি বেগম, অন্তরে অন্তরে, জীবন কাহিনী, অনুসন্ধান, অমানুষ, বাঘিনী, কুয়াশা যখন, বরসাত্‌ কি এক রাত, প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জীবৎকালে তিনি বিভূতিভূষণ পুরষ্কার, সর্বভারতীয় লায়ন্স পুরষ্কার, বঙ্গ বিভূষণ ও হল অফ ফেম সাহিত্যব্রহ্ম শিরোপায় ভূষিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের অসম্ভব বাস্তবধর্মী এই সাহিত্যিককে বাঙালী পাঠক বহুদিন মনে রাখবে নিঃসন্দেহে। সদ্য প্রয়াতঃ এই বর্ষীয়ান সাহিত্যব্রতীকে চিলেকোঠা ওয়েবজিনের বিনম্র প্রণাম।


বন্ধুরা, অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, চিলেকোঠা ওয়েবজিনের এটি দ্বাদশতম সংখ্যা। দেখতে দেখতে একটা গোটা বছর অতিক্রম করে এলাম। সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য হিসাবে বলতে পারি, এই গত এক বছরের পথ চলা সব সময় মসৃণ, বাঁধা-বন্ধহীন, কণ্টক-রোহিত ছিলো না। অনেক ঝড় ঝাপটা এসেছে, তবুও আপনাদের ঐকান্তিক শুভকামনা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নিরন্তর। আপনাদের পাশে পেয়ে আমরা ধন্য। 


আর আপনাদের এই আন্তরিক শুভেচ্ছা পাথেয় করেই প্রকাশিত হল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা। এতে থাকছে ৪ঠা জুলাই স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণদিবসকে স্মরণে রেখে একটি মনোজ্ঞ প্রচ্ছদ নিবন্ধ। আর থাকছে প্রবন্ধ সহ বিশেষ রচনা, রম্যরচনা, কবিতা, মুক্তগদ্য, অনুগল্প, ছোটগল্প, ধারাবাহিক এবং নিয়মিত বিভাগগুলির মধ্যে ছোটদের পাতা, ফটোগ্রাফি, রঙ ও তুলি, রান্নাঘর, হাস্যকৌতুক, জানেন কি। নিশ্চিত জানি, ভালো লাগবে।


আসুন, সকলে মিলে চিলেকোঠা ওয়েবজিনকে আরও জনপ্রিয় করে তুলি। 
সঙ্গে থাকুন, ভালো থাকুন। 



শুভেচ্ছান্তে

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে

সুস্মিতা সিং




































প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

















প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ


ভারতের রাজপুত্র স্বামী বিবেকানন্দ
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায় , গার্লল্যান্ড , টেক্সাস 



“পথ হতে গেঁথে এনেছি সিক্তযূথীর মালা, সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা-” 

আমরা অনেক কিছু জানি বা অনেক কিছু জানি না -এই দুই মতের বিরুদ্ধে গেলে একশত ভাগের দশ ভাগ হয়ত আমরা তাঁর সম্বন্ধে জানতে পেরেছি, বা জানবার চেষ্টা করেছি তাই না? 

তিনিই একজন ভারতীয় যিনি শুধু ধর্মই প্রচার করেন নি, তিনি আমাদের রীতি নীতি আচার ব্যাবহারের বৈশিষ্ঠ ও ঐতিহ্য তুলে ধরেছিলেন প্রাশ্চাত্যের বিভিন্ন মানুষের সামনে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তিনি কি খাদ্যও প্রচার করেছিলেন? অথবা তিনি কি খাদ্যরসিক ছিলেন? 

আমার স্বল্প জ্ঞানে তা হলোঃ তিনি প্রাশ্চাত্যে বেদান্ত এবং বিরিয়ানী তার সাথে চা-এর প্রচার করেছিলেন। চা যে শরীরের পক্ষে উপকারী তা তিনি স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ভালবাসতেন জিঘেবাগাস, সুইটমিট এবং খিচুড়ি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, শুক্তো, মোচার ডালনা, ইলিশ মাছ, চকলেট আইসক্রিম, ভারতীয় পালং শাক ও পুঁইশাকের চচ্চড়ি, ছোলার ডালের সাথে গরম লুচি, চানাচুর, জীবে গজা, ঝাল করে রান্না ঝিনুক। তাঁর কথায় আমরা জানতে পারিঃ 

“তোমরা অন্যদের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রচার করে বেড়াও, কিন্তু তাদের সুখাদ্য দিতে পারো না। গত চার বছর ধরে আমি এই সমস্যাটি নিয়ে ভাবছি। গম থেকে এক ধরণের মোটা চাল তৈরিই করা যায় কিনা সে বিষয়ে নিরীক্ষা করার ইচ্ছে আছে। পানীয় জলের ক্ষেত্রে, আমাদের দেশে লাগে- এমন একটি বিশোষক যন্ত্রের খোঁজ করেছি। আমি একটি বাটির মত চীনামাটির পাত্র দেখেছিলাম আর তার মধ্য দিয়ে জল নিষ্কাশন করা হচ্ছে ও জীবাণুগুলি সেই বাটিতে রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রমে ঐ জল -বিশোষক বাটিটিই সমস্ত জীবাণুর কেন্দ্রস্থল হয়ে যাবে। সকল বিশোষক যন্ত্রের ক্ষেত্রেই একই বিপদ। অনেক অনুসন্ধানের পর আমি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করি জল পরিশোধনের পর অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতির প্রয়োগে জল এত বিশুদ্ধ হচ্ছে যে নিঃসন্দেহে সেই জলের ব্যবহারে স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব।” 

খেতরি বাসকালে একটি সভায় ব্যবহারিক ভারতীয় জীবনে হিন্দুধর্মের শোচনীয় অবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত হন। এই প্রসংগে তিনি বলেন- “ আমরা হিন্দু নই, আমরা বৈ্দান্তিক ও নই-আমরা ছুঁৎমার্গীর দল। রান্না ঘর হল আমাদের মন্দির, ভাতের হাঁড়ি উপাস্য দেবতা আর দুখানা মন্ত্র'- সমাজের এই অন্ধ কুসংস্কার সত্বর দূর করা প্রয়োজন।”

মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠার আগে কম বয়সী নরেনের সাংঘঠনিক শক্তির প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছে এই রান্নার ক্ষেত্রেই। নরনারায়নের সেবার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে এক অভাবনীয় প্রতিষ্ঠান 'গ্রিডি ক্লাব' সংগঠন, যার বাংলা মহেন্দ্রনাথ করেছেন “পেটুক সঙ্ঘ'। উদ্দেশ্য ছিল- কেবল ভোজ়ন নয়, সেই সঙ্গে রান্না নিয়ে রীতিমত রিসার্চ। প্রতিষ্ঠার দৃষ্টি সারা বিশ্বের দিকে প্রসারিত। ভবিষ্যতের বিশ্ববিবেক এই সময় পুরনো বইওয়ালার কাছ থেকে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত ফেঞ্চ রান্নার বই কিনতে আরম্ভ করেছেন। যে ফরাসী জাত অর্ধসভ্য ইউরোপকে ভদ্রভাবে রান্না বান্না করে খেতেদেতে শিখিয়েছে, যে ফরাসীজাত ও সভ্যতার গুণগানে সন্নাসী বিবেকানন্দ একদিন মুখর হয়েছিলেন, তার আদিতে কমবয়সের -ফ্রেঞ্চকুকিং- এর সাধনা। 

~ আবিষ্কার ~ হাঁসের ডিম খুব ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে কড়াইশুঁটি ও আলু দিয়ে ভুনি-খিচুড়ি। পলোয়ার চেয়ে এই রান্না যে অনেক উপাদেয় বহু বছর পরেও বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন। বাবা রাঁধতেন কালিয়া এবং পলোয়া, আর সুযোগ্যপুত্র আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে নতুন ডিশের মাধ্যমে পূর্বপশ্চিমকে একাকার করে দিলেন। প্যারিস রাজধানীর একটি বিখ্যাত স্যুপ-এর রেসিপি তিনি দিয়েছিলেনঃ “কচি কলাইশুটি খুব সিদ্ধ করে, তারপর তাকে পিষে জলের সাথে মিশিয়ে ফেল। একটা দুধ ছাঁকনির মতো তারের ছাঁকনিতে ছাঁকলেই খোসাগুলো বেরিয়ে আসবে। এখন হলুদ, ধনে, জি্রে, মরিচ, লঙ্কা, যা দেবার দিয়ে সাঁতলে নাও-উত্তম সুস্বাদু সুপাচ্য ডাল হল। যদি পাঁঠার মুড়ি বা মাছের মুড়ি তার সংগে থাকে তো উপাদেয় হয়।” তাঁর সব কথার মধ্যেই দেখতে পাই সব কিছুর তুলনা করা হয়েছে কিছু না কিছু খাদ্য জাতীয় শব্দের মাধ্যমে। এইভাবে কি সুন্দর ভাবে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন আপামর বিদেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে, আর আমাদের হিন্দুধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

তাঁর সমস্ত চিঠিপত্র খুঁটিয়ে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় -

(মিঃ ই.টি.শটার্ডিকে লেখা)- 
“আমার প্রতি খুবই দয়াপরবশ হয়ে জাহাজের পার্সার আমাকে একলা একটি কেবিন ছেড়ে দিয়েছেন। খাবার নিয়েই যা একমাত্র অসুবিধা- মাংস আর মাংস। কেবল মাংস। আজ অবশ্য কিছু সবজী দেবে কথা দিয়েছে।” 

(মিস মেরী হ্যালেকে লেখা)-
“আমি একটা আলপিন নই যে শস্যের বোঝার নীচে হারিয়ে যাব। কাল রাত্রিবেলা আমি একটি খাবার তৈ্রী করেছিলাম। জাফরান, ল্যাভেন্ডার, জৈত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারুচিনি, লবং, এলাচ, ক্রীম, লাইমজুস। পিঁয়াজ, মনাক্কা, বাদাম, মরিচ এবং চাল- সব মিলিয়ে কী উপাদেয় পাঁচমিশালী, নিজেও একটু খেতে পারি নি। হিঙ্গ অবশ্য ছিল না, থাকলে গিলবার পক্ষে সুবিধা হত যদিও”।

এর থেকে বোঝা যায় তিনি গরম মশলাও কিভাবে করে-বিদেশীদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। 


২ 

তাঁর এই অসাধারণ বক্তব্যে আমরা কিছুটা আঁচ করি যে আমরা যে লোভী তার সমাধানের পথ ও তিনি বলে দিয়ে গেছেন- 
“একটি দম্পতির কথা জানি, স্বামী স্ত্রীরূপে পরিণত হবার পক্ষে তদের সব কিছুই অনুকূল ছিল, শুধু কনের বাবা এই বলে হেঁকে বসলেন, যে পাত্র অন্ততঃ দশলাখপতি না হবে তাকে তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন না। ছেলেটি আর মেয়েটি নৈরাশ্যে ভেঙে পড়ে, এমন সময় দেখা দিল এক চতুর ঘটক। সে বরকে গিয়ে বল্লে দশ লাখের বদলে সে তার নাকটি দিতে প্রস্তুত কিনা। বর বললে, না। কনের বাবার কাছে গিয়ে তখন ঘটক বললে, এমন সব জিনিসের মজুত আছে তার মূল্য কয়েক কোটি; বিবাহ পাকা হয়ে গেল! তুমি যেন এরকম 'কোটি' গ্রহণ কোরো না। 

তাহলেই দেখো, তুমিও লাখপতি জোগাড় করতে পারলে না, আমিও টাকা পেলুম না। অতএব আমার দুশ্চিন্তা হল প্রচুর। বহু পরিশ্রম করতে হল বৃথাই; তাই রোগে ধরল। আমার মতো মগজ চাই আসল কারণ খুঁজে বার করতে -নিজের প্রতি নিজেই মোহিত হয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা ঘটেছে এই দক্ষিণ ভারতেই; লন্ডন থেকে ফিরবার পর এখানকার লোকেরা আমাকে প্রচুর খাওয়াতে লাগল, ভোজ দিতে লাগল আর আমার কাছ থেকে যত পারে কাজ আদায় করে নিতে লাগল। আমরা সাত সমুদ্রে বিশ্বাস করি-এক দুধের সাগর, এক মধুর, এক দধির, এক সুরায়, এক আখের রসের, এক লবণের, আর একটা যেন কী ভুলে গেছি।” 

(স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা)-
“দেখতেই পাচ্ছো এখন আমি যাত্রাপথে। কলকাতায় কমলালেবু পাওয়া গেলে শ'খানেক মাদ্রাজে আলাসিঙ্গার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ো, যাতে মাদ্রাজে পৌঁছে আমি তা পাই। তুমি সমালোচনা বন্ধ করেছো; তা নইলে এর মধ্যে আরো ঠান্ডা কোনো যায়গায় চলে যেতাম-আর কিছু না হলেও মজা করার জন্য। তুমি কি সত্যি ওসব মূর্খের কথা শুনে চলো? এ যেন আমাকে তোমার কলাই ডাল খেতে না দেওয়া-ওতে শ্বেতসার আছে বলে! আরো কত -ভাত বা রুটি সেঁকে নিয়ে খেলে নাকি শ্বে্তসার থাকবে না! কি অসাধারণ জ্ঞান বৎস। রাত্রির খাবার টা খুব হালকা করে নেব ভাবছি । সকালে দুপুরে পেট বোঝাই করে খাব। রাতে শুধু দুধ , ফল ইত্যাদি। তাই তো এই ফল বাগিচায় আছি “ফলের আশায়”! বুঝতে পারো না?”
-কি অদ্ভুত তুলনা। 

তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে আমরা জানতে পারি এত ব্যস্ততা সত্বেও তিনি কিভাবে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে অন্য কাজকর্মের সাথেও খাদ্য-এর প্রয়োজনীয়তা আমাদের শরীরে ও মনে। 

(মারী হালবয়স্টারকে লেখা)- 
“ইউরোপে যাওয়া মানেই ত কাজ, তাই নয়? না কাজ, না রুটি। এখানে হলদে কাপড় যথেষ্ট, খাদ্যও পাব পর্য্যপ্ত। যেভাবেই হোক বহু আকাঙ্খিত বিশ্রামটি পাচ্ছি, আশা করি তা আমার শরীরের পক্ষে ভালো হবে। বেশ কয়েকটা বছরের জন্য ভালো রকমের বিশ্রাম, কোনো কাজ নয়-এরকমটা ইচ্ছে করে না তোমার? ঘুম আর খাওয়া আর ব্যায়াম; ব্যায়াম, খাওয়া আর ঘুম-আরো কয়েকমাস আমার এই রকমই চলবে। 

খুব ঘোড়ায় চাপা এবং ব্যায়াম চালিয়েছি , কিন্তু ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপ্সন অনুসারে প্রচুর মাখন তোলা দুধ খেতে হয়েছে, ফলে পিঠের চেয়ে পেট মোটা হয়েছে বেশী। সামনের দিকটা আমার বরাবরই কিছু বেশী কিন্তু এক্ষুনি আর তা বাড়াতে চাই না-তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তোমার আহারে রুচি এসেছে জেনে খুব খুশী হলাম। হ্যাঁ ভালো কথা, আমি দারুণ খুশী -অতি তাড়াতাড়ি বুড়ো হচ্ছি, চুল পাকতে লেগেছে। “সোনালীর মধ্যে রুপোলী সূত্র”- মানে কালোর মধ্যে আর কি- দ্রুত বাড়ছে। ধর্ম্প্রচারকদের পক্ষে যুবাপুরুষ হওয়া ভালো নয় , তাই না? আমার তো তাই মনে হয়, সর্বদাই মনে হয়েছে। বৃ্দ্ধদের ওপর লোকের বিশ্বাস বেশি হয়, আর অনেক বেশী শ্রদ্ধাস্পদ লাগে। তথাপি বুড়ো বদমায়েসরাই দুনিয়ায় সব চেয়ে বড় বজ্জাত, তাই নয়?”



অসাধারণ মজার মানুষ ছিলেন আমাদের রাজপুত্র বিবেক ও আনন্দ। বিদেশে তাঁকে অনেক নামে ডাকা হতো তার মধ্যে বিবেক ও আনন্দ নামটাই বেশি পরিচিত ছিল সবার কাছে। 

(সিস্টার নিবেদিতাকে লেখা)- 
“আমি দুর্বিক্ষের মোকাবিলায় খুব ব্যস্ত; আগামী দিনের কাজের জন্য কয়েকটি ছেলেকে শিক্ষাদান ছাড়া ট্রেনিং-এর কাজে আর বেশি পরিশ্রম দিতে পারছি না। “খাওয়ানোর কাজটাতেই” আমার সব শক্তি এবং সম্বল শুষে নিচ্ছে।” 

(মিসেস ওলি বুলকে লেখা)- 
“জো একজন মহিলা চিকিৎসক খুঁজে বার করেছে, তিনি সম্মোহনী চিকিৎসা করে থাকেন। আমরা দুজনেই তাঁর চিকিৎসাধীন। জো-র ধারণা-তিনি আমাকে বেশ চাঙ্গা করে তুলেছেন। আর বলছে, তার নিজের ওপর অলৌ্কিক ফল ফলছে। সম্মোহনী চিকিৎসার ফলে হোক, ক্যালিফোর্নীয়ার ওজনের গুণে হোক, কিংবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার দরুনই হোক, আমি সেরে উঠছি। রাতে পেটভরা খাবার পরেও তিন মাইল হাঁটতে পারা একটা মস্ত ব্যাপার।”

- তিনি বোঝাতে চেয়েছেন শুধু কাজ করলেই হবে না, শরীরে রক্ত চলাচল সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। - 

“আমাদের অন্যান্য জাতের কাছে অনেক শেখবার আছে। বলি- খাওয়া তো সব দেশেই এক; তবে আমরা পা গুটিয়ে বসে খাই, বিলাতিরা পা ঝুলিয়ে বসে খায়। এখন মনে কর যে, আমি এদের রকমের রান্না খাওয়া খাচ্ছি, তা বলে কি এদের মতো ঠ্যাং ঝুলিয়ে থাকতে হবে? আমার ঠ্যাং যে যমের বাড়ী যাবার দাখিলে পড়ে-টনটনানিতে যে প্রাণ যায়, তার কি? কাজেই পা গুটিয়ে, এদের খাওয়া খাব বইকি। ঐ রকম বিদেশী যা কিছু শিখতে হবে, সেটা আমাদের মতো করে -পা গুটিয়ে আসল জাতীয় চরিত্রটি বজায় রেখে। বলি কাপড়ে কি মানুষ হয়, না মানুষে কাপড় পরে? শক্তিমান পুরুষ যে পোশাকই পরুক না কেন, লোকে মানে; আর আমার মতো আহাম্মক ধোপার বস্তা ঘাড়ে করে বেড়ালেও লোকে গ্রাহ্য করে না। 

তবে দু-দেশ তুলনা করা সোজা হবে, এই ভণিতার পর। এরাও ভাল, আমরাও ভাল। ‘কাকো নিন্দো, কাকো বন্দো, দুয়ো পাল্লা ভারি।' তবে ভালোর রকমারি আছে, এইমাত্র।” 

“প্রিন্স ইন্ডিয়ান” কি ভাবে সরলরেখায় দু-দেশ কে এক জায়গায় এনেছেন তা আমাদের চোখে সত্যি ই অভাবনীয়। আবার রাঁধুনী-কেও কিন্তু বাদ দেন নি। এমনই মজাদার ছিলেন তিনি। আমরা অন্য দেশের খারাপগুলো আগে অনুকরণ করার চেষ্টা করি, কিন্তু নিজেদের দেশের ভালোগুলো বয়কট করি। কারণ , আমরা ভীষণ অনুকরণপ্রিয়। 

“বারে ফিরে ফিরে তোমার পানে দিবারাতি ঢেউয়ের মতো চিত্ত বাহু হানে...।” 

-তিনি আবার বলেছেন, 
“আমাদের রান্নার মতো পরিষ্কার কোথাও নেই। বিলেতি খাওয়ার শৃঙখ্লার মতো পরিষ্কার পদ্ধতি আমাদের নেই। আমাদের রাঁধুনি স্নান করেছে, কাপড় বদলেছে; হাঁড়িপত্র, উনুন-সব ধুয়ে মেজে সাফ করেছে; নাকে মুখে গায়ে হাত ঠেকলে তখনি হাত ধুয়ে তবে আবার খাদ্যদ্রব্যে হাত দিচ্ছে। বিলাতি রাঁধুনির চৌদ্দপুরুষে কেউ স্নান করেনি; রাঁধতে রাঁধতে চাখছে, আবার সেই চামচ হাঁড়িতে ডোবাচ্ছে। 

-রুমাল বার করে ফোঁৎ করে নাক ঝাড়লে, আর সেই হাতে ময়দা মাখলে। শৌচ থেকে এল-কাগজ ব্যবহার করে, সে হাত ধোবার নামটিও নেই-সেই হাতে রাঁধতে লাগলো। কিন্তু ধপধপে কাপড় আর টুপি পরেছে। হয়ত একটা মস্ত কাঠের টবের মধ্যে দুটো মানুষ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রাশীকৃত ময়দার উপর নাচছে-কি না ময়দা মাখা হচ্ছে। গরমি কাল-দরবিগলিত ঘাম পা বেয়ে সেই ময়দায় সেঁধুচ্ছে। তার পর তার রুটি তৈয়ার যখন হল, তখন দুগ্ধফেননিভ তোয়ালের উপর চীনের বাসনে সজ্জিত হয়ে পরিষ্কার চাদর বিছানো টেবিলের উপর, পরিষ্কার কাপড় পরা কনুই পর্যন্ত সাদা দস্তানা পরা চাকর এনে সামনে ধরলে! 

কোনও জিনিস হাত দিয়ে পাছে ছুঁতে হয়, তাই কনুই পর্যন্ত দস্তানা। 

আমাদের স্নান করা বামুন, পরিষ্কার হাঁড়িতে, শুদ্ধ হয়ে রেঁধে গোময়সিক্ত মাটির উপর থালশুদ্ধ অন্নব্যঞ্জন ঝাড়লে; বামুনের কাপড়ে খামছে ময়লা উঠছে। হয়তো মাটি ময়লা গোবর আর ঝোল কলাপাতা ছেঁড়ার দরুণ একাকার হয়ে এক অপূর্ব আস্বাদ উপস্থিত করলে !! চাই কি? --- পরিষ্কার শরীরে পরিষ্কার কাপড় পরা। মুখ ধোয়া দাঁতমাজা-সব চাই, কিন্তু গোপনে। পরিষ্কার রাঁধুনি, পরিষ্কার হাতের রান্না চাই। আবার পরিষ্কার মনোরম স্থানে পরিষ্কার পাত্রে খাওয়া চাই--'আচারঃ প্রথমো ধর্মঃ' । এত ওলাউঠা, এত মহামারী, ম্যালেরিয়া-কার দোষ? আমাদের দোষ। আমরা মহা অনাচারী!!!!” 


৪ 

স্বামীজী আমিষ খাওয়া বেশি পছন্দ করতেন- নানা উদাহরণ সহ আমরা জানতে পারি । তিনি একজন খ্যাতনামা রাঁধুনী ও ছিলেন। নানা অকেশনে তিনি মাটন পুলাও রান্না করতেন তাঁর শিষ্যদের বাড়িতে। বেলুড় মঠে একদিন এক ভক্ত আসেন মাংস নিয়ে নিজের গুরুদেবের জন্য। সব চেয়ে বেশী মজার কথা হলো তিনি যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমনি রান্না করতেও ভালবাসতেন। এবং তাঁর প্যাশন ছিল নানা রকম চা এর। তিনি ভেজিটেরিয়ান ছিলেন না মোটেই, শুধু মাছ না- মাংস-এ মধ্যে গরুর মাংস ও বাদ দিতেন না। 

তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে কোলকাতায় গুরুভাইদের লিখেছিলেন যে, 

“এখন তোমরা অনেক ইলিশ খাচ্ছো তোমাদের ইচ্ছামত-এখানে অনেকরকমের শাক যেগুলো খেতে nate এর মত আর তারা বলে -'এ্যস্প্যারাগাস' অনেকটা ঠিক ছোট কচি dengo-এর মত খেতে”। 

তাঁর কথায়ঃ 

“খাদ্য শুধু পেট ভরানোর জন্যই নয় শারীরিক শক্তি যোগানোর পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শক্তির সম্পূরকই হলো সু-খাদ্য”।

তিনি গরম খাবার পছন্দ করতেন, তা বেলুড় মঠে গেলে এখনও বোঝা যায় যে, ইন্সটিটিউশন-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমাদের প্রবাদপুরুষ স্বামীজী। 

খেতে খুব ভালবাসতেন, কিন্তু জীবনের শেষ দিকে ২১ দিন ভালো খাওয়া তো দূরের কথা, জল পর্যন্ত না খেয়ে কাটাতে হয়েছে, কবিরাজের অনুরোধে। 

নরেন তাদের পাড়ায় স্থাপন করেছিলেন greedy club, যাদের মূল motto ছিল ভোজন ও নানা দেশের রান্না নিয়ে রিসার্চ, ফ্রেঞ্চ রান্না করেছিলেন নরেন থাকাকালিন-হাঁসের ডিম ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে করাইশুঁটি আর আলু দিয়ে ভুনি খিচুড়ি মত। ভালবাসতেন জীবে গজা, কারণ তার একটা ঘটনা আছে, একবার এক যায়গায় জীবে গজা এসেছে, তিনি একটা তুলে নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে গোটা হাঁড়িটায় সেই এঁটো গজা টা ফেলে দিলেন, তাতে করে সবটা এঁটো হল, কেউ খেতে পারলো না, তিনি একাই খেয়ে ফেললেন, এটা নরেন থাকাকালিন। এ-থেকেই বুঝতে পারা যায় তিনি কতখানি চঞ্চল ছিলেন কিশোর বয়সে। 

নরেন একদিন পুলিন মিত্র নামে সেই সময়ের তৎকালীন গায়কের বাড়ি গেছেন, কচুরী ভেজে দেওয়া হয়েছে তাঁকে, খুব খুশী, হয়ে বলছেন, “বেশ চমৎকার”। যদিও বিবেকানন্দ রূপে লেখাতে কচুরীর তীব্র সমালোচনা করেছেন, বলেছেন কচুরী জিলিপি খানায় ফেলে দিতে। 

আবার সেই ঠাকুরের অসুখের সময় হোটেলে গিয়ে মহানন্দে মুরগীর ফাউল কারী খেয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এই সময়েই তীব্র অভাব বাড়িতে, টানা উপবাসে কাটাতে হয়েছে। 

বরানগরে থাকার সময় কিছুই জুটতো না, ভিক্ষার চাল সিদ্ধ করে তা কাপড়ের ওপর ঢেলে সকলে মিলে খেতেন এবং সঙ্গে ছিল নুন আর লংকার একটা ঝোল। তাতে সকলে মিলে হাত ডোবাতেন, অনেকটা টাকনার মত, আর ভাত খেতেন।- আসলে তিনি দেখিয়ে গেছেন আমাদের যে, যে কোন খাদ্য-ই হোক না কেন- তৃপ্তি সহকারে তা গ্রহণযোগ্য। 

এরপর দেশভ্রমণ কালে আবার অনাহার, এক সময় প্রায় মৃত্যুমুখে, শেষে এক ফকিরের দেয়া শসা খেয়ে প্রাণরক্ষা। বিদেশে পৌঁছে সব টাকা শেষ, আলসিঙ্গাকে টেলিগ্রাম করলেন টাকা পাঠাও। তবে এরপর বিদেশে কিছুদিন-এর পরে খাবার সমস্যা আর হয় নি, জানতেন খাবার আদব কায়দা, সারদানন্দকে শিখিয়েছিলেন কি ভাবে knife ডান হাতে ধরতে হয়, কিভাবে স্যুপ খেতে হ্য়, কিভাবে চামচ ধরতে হয়। সত্যি কি অসাধারন জীবনীশক্তি না থাকলে সব কিছু একধারে সুষ্ঠুভাবে পালন করা যে কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। একদিন ভাই মহেন্দ্রনাথ এক বিদেশীনির বাড়ি খেয়ে এলেন, চাপাটি রুটি মাংসের একটা তরকারী,আরো দুটো তরকারী। শুনে স্বামীজীও ওই রকম খাবার সেই বিদেশীনির বাড়ি গিয়ে খেতে ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন, যদিও তা আর হয়ে ওঠে নি। তাঁর অত্যধিক বালকসুলভ ব্যবহার এর থেকে আমরা পাই। 


৫ 

ঝাল খেতে খুব ভালবাসতেন, পরিব্রাজকরূপে একবার রাখাল মহারাজ খিচুড়ি রান্নার সময় এক ডেলা মিছরী দিয়ে দেন, তাতে তিনি খুব রেগে যান, তাতে মনে হয় মিষ্টি পছন্দ নয়, যদিও লুচি পায়েস পছন্দের খাবার, তা খেয়ে যেতেন সুগার হবার পরেও। কাঁচালংকার প্রতি খুব টান, বিদেশে গিয়ে খুঁজেছেন। কিনে নিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাচ্ছেন একের পর এক, একবার কোন শিষ্যের সাথে বাজী ধরে ৫০টা শুকনো লঙ্গা খেয়ে ফেলেছিলেন। 

তাঁর রান্নায় থাকত প্রচুর মশলার সমাগম, লোকে খেয়ে বলত, elaborate and alarming for health! 

শ্যামবাজারের ঢাকাই পরোটা, ছোলার ডাল আর জিলিপি খুব ভালবাসতেন। আবার ভালোবাসতেন ঝিনুক রান্না করে বেশ ঝাল করে খেতে। 

আরেকটা সূত্র জানাচ্ছে, একই বাড়িতে থাকতো, সুপ, মাছ বা মাংস, সবজি এবং আমেরিকান পাই। তবে ডিনারে ও দেশে কফির চল থাকলেও তিনি খেতেন না। বরং চাপাটি আর কারি চেয়ে নিতেন। 

ফল হিসাবে পছন্দ আঙ্গুর, লিচু, আম। আম ভালবাসতেন বরফ দিয়ে ভিজিয়ে , লিচু ভক্তদের কাছে দীক্ষাদানের সময় চেয়ে নিতেন গুরু দক্ষিণা হিসাবে। সম্ভবত ভালোবাসতেন বলেই। আর আঙ্গুর সম্বন্ধে বলেছেন খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়, খাওয়া খুব ভাল। ভাই মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন- একাবার ম্যাকলাউডের বাড়িতে আনারস কেটে গুঁড়ো চিনি দিয়ে খাবার কথা ও অন্যান্যদের দেবার কথা। 

পেঁয়াজ সম্বন্ধে বলেছেন আধ্যাত্ম পথের লোকের জন্য পেঁয়াজ সেরা খাদ্য নয়। যদিও নিজে ছেলে বেলায় খেতেন খুব, এবং বলেছেন, 

“ছোটো বেলায় আমি কি ভীষণ ভালোবাসতাম, পিঁয়াজ খেয়ে মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে খোলা হাওয়ায় অনেকক্ষণ হাঁটা চলা করতাম।” 

ডাল ভালবাসতেন, বিশেষ করে কড়াইয়ের ডাল, অনেকের কাছে খেতে চেয়েছেন। আর ভীষণ প্রিয় আইস্ক্রিম, ডিনার টেবিল ছেড়ে চলে যেতে চাইলেই মিসেস লেগেট ঘোষণা করতেন আইস্ক্রিম-এর কথা। অমনি বাচ্ছাদের মতো বসে থাকতেন। বিশেষ করে আইসক্রীমের ক্রীমটা খুব পছন্দ করতেন। খেয়ে বলেছেনঃ “food for Gods! Really divine.” 

আরেকবারের বর্ণনা, ২য় বার বিদেশে গিয়ে california তে থাকার সময় প্যাসাদোনায় স্বামীজীর ব্রেকফাস্টের পছন্দ ফল, ডবল ডিমের পোচ, দুটি টোস্ট, চিনি ও ক্রিম সহ কফি। আর দুপুরে মাটন আর নানারকমের শাকসব্জি ওনার জন্য রাখা হতো। ডেসার্ট হিসাবে ফল বিশেষত আঙ্গুর। একবার বিদেশ (ভারতবর্ষের বাইরে) সফর শেষে, স্বামীজী কোলকাতায় ফিরলেন মাদ্রাজ হয়ে। ট্রেণ শিয়ালদহ পৌঁছালো তখন প্রায় সকাল ৯টা । বহু কষ্টে ঘোড়ার গাড়ীতে করে বেলুড় পৌঁছালেন তখন প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজে। পৌঁছে দেখলেন মঠের গেট বন্ধ হয়ে গেছে। তখন কোনো চেঁচামিচি ডাকাডাকি তে গেট খুললো না, এদিকে খিদেয় প্রাণ যায় যায়। ভিতর থেকে কিছু খাবার এর গন্ধ ও আসছে। তাই আর দেরি না করে পাঁচিল টপকালেন। 

পৌঁছে গেলেন সোজা খাবার ঘরে। সবাই তো দেখে অবাক-

“তুমি কি করে ভিতরে এলে? আমরা তো জানি না তুমি আসছো” 

স্বামীজী বললেনঃ 

“শালা! তোমরা বসে খিচুড়ি আর পাঁপড় খাবে, আর আমি শালা বাইরে খালি পেটে ভজন কোরবো? তাতো চলবে না।” 

স্বামীজীর খিচুরী অত্যন্ত প্রিয় খাবার ছিল। তিনি নিজে খুব ভাল খিচুড়ী রান্না করতেন, নানা রকম মশলা , ডাল চাল দিয়ে খিচুড়ি নিজে হাতে রান্না করতে। পরিবেশন করতে ভালবাসতেন। বহুবার সিস্টার নিবেদিতাকেও উনি নিজ হাতে খিচুড়ী রান্না করে পরিবেশন করে সম্পূর্ণ মঠ সহ সবাইকে খাইয়েছেন। এমনি ছিলেন খাদ্যরসিক। 

তিনি সব দেশ ঘুরে বলেছিলেনঃ 

“হিঁদুরাই ঠিক অর্থাৎ হিঁদুদের ঐ যে ব্যবস্থা যে জন্ম -কর্ম-ভেদে আহারাদি অবশ্যি পৃ্থক, এইটিই সিদ্ধান্ত। নানান দেশ দেখেছি, নানান রকমের খাওয়াও দেখেছি। তবে আমাদের ভাত-ডাল-ঝোল-চচ্চড়ি-সুক্তো-মোচার ঘন্টের জন্য পুনর্জন্ম নেওয়াও বড় বেশী কথা মনে হয় না। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝছ না, এইটাই আপসোস।”

“কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো...” 

এক আউন্স পরিমাণ আনন্দ আর এক পাউন্ড পরিমাণ যন্ত্রণার কারণ। একটি শক্তি এক এক সময় আনন্দরূপে, আবার অন্য সময় বেদনার আকারে প্রতীয়মাণ হয়। যে মুহূর্ত্তে একদল চেতনা স্তব্ধ হয়। আর এক দলের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। 



তথ্য সংগ্রহঃ
বিবেকানন্দের রচনা সংগ্রহ, শ্রী শ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, Western Women in the footsteps of Swami Vivekananda, and Internet Wikipedia.

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


















প্রবন্ধঃ


পঞ্চকবির তিনজন
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



[ আগামী ২৬শে জুলাই কান্তকবি রজনীকান্ত সেন’এর ১৫০তম জন্মবর্ষ পূর্ণ হবে (জন্ম ২৬জুলাই ১৮৬৫), আর গতবছর আমরা পেরিয়ে এসেছি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সার্ধশত জন্মবর্ষ । এই দুজনের কথা বললেই এসে যায় আর একজনের নাম – অতুলপ্রসাদ সেন । রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক তিন সংগীত ব্যক্তিত্বের জীবন ও সৃষ্টিকে ফিরে দেখার প্রয়াস এই নিবন্ধে ] 



বাঙালির সংগীতভুবনে রবীন্দ্রগানের সমুদ্রপ্রমাণ পরিসরের বাইরে যে চারজনের গানের কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাঁরা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুল প্রসাদ সেন । নজরুল এসেছিলেন বাংলা গান বিপণন যোগ্য হয়ে ওঠার সময়কালে । অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে গ্রামফোন আসার পর আধুনিক বাংলা গানে যখন ব্যাপক বৈচিত্র এলো । বাংলা গানকে বিপণনযোগ্য করে তোলার পেছনে নজরুলের অসামান্য অবদান রয়েছে । নিজের সংগীত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন যে বাঙালিকে সুখে দুঃখে তাঁর গান গাইতেই হবে। ঠিক তেমনই নজরুল ইসলামও প্রত্যয় জ্ঞাপন করেছিলেন এই বলে “সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি । সংগীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা নাহলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে”(১৯৩৯এ জন সাহিত্য সংসদে ভাষণ) । নজরুল আমার এই আলোচনায় থাকছেন না । দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদের গানের সঙ্গে নজরুলের গানকে একত্র মিশিয়ে ফেলাও যায়না । তাঁর সংগীত ভাবনা ও গানের কথা পৃথক ভাবেই আলোচনা হওয়া সঙ্গত ।

দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমসাময়িক । অতুলপ্রসাদ কিছুটা কনিষ্ঠ । দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে এলাম গত বছর আর এ বছর জুলাইএ রজনীকান্ত পা দেবেন সার্ধশতবর্ষে, তারও ছবছর পরে অতুলপ্রসাদ পূর্ণ করবেন জন্মের দেড়শো বছর । দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতযাত্রার পথ ও রজনীকান্ত অপেক্ষা একটু ভিন্ন । রজনীকান্ত তাঁর কাব্যগীতিতে আশ্রয় করেছিলেন ভক্তির পথ, তাঁর গান আত্মনিবেদনের গান । অতু্লপ্রসাদের আশ্রয় ব্রহ্মসংগীত, গজল ও ঠুমরি আঙ্গিক । কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে শাস্ত্রীয় সংগীতের ধ্রুপদ ও খেয়াল আঙ্গিকের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন । পাশ্চাত্য সুরের সার্থক মিশ্রণও পাওয়া যায় তাঁর গানে । অতুলপ্রসাদকে বাংলা ঠুংরি গানের প্রবর্তক বলা হয়ে থাকে, দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে ঠুংরি আঙ্গিক গ্রহণ করেন নি ।

দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন একাধারে সার্থক নাট্যকার, কবি ও সংগীত স্রষ্টা । সার্থক ঐতিহাসিক নাটক বলতে এখনও আমরা দ্বিজেন্দ্রলালের কাছেই যাই । তাঁর নাটকগুলি প্রায় সবই দেশপ্রেম মূলক । ঐতিহাসিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের নাট্যায়নই যে তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তা নয় । ইতিহাসের উপাদানকে আশ্রয় করে স্ব-কালের সমাজ ও মানুষের ভাবনা ও সংগ্রামের নাট্যভাষ্য নির্মাণ করাই উদ্দেশ্য ছিল । ইতিহাসের পটভূমিতে স্বদেশের যন্ত্রণা ও সংগ্রামের ইচ্ছাই বিধৃত হয়েছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে । সে কালের থিয়েটারে নাটকে গানের প্রয়োগ অনিবার্য ছিল, কারণ সেকালে বাঙালির বিনোদনমূলক গান শোনার সেরা মাধ্যম ছিল থিয়েটার । 

বাঙালির দেশাত্মবোধক গানের ভান্ডারকে সম্ভবত সর্বাধিক ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে দ্বিজেন্দ্রলালের গান । তাঁর দেশপ্রেমের প্রেরণা নিশ্চিত ভাবেই বঙ্গজননী । ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছিল । তাঁর নাটকে দেশাত্মবোধক গানগুলির সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন । দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলির মুখ্য বার্তা ছিল দেশাত্মবোধের সঞ্চার এবং তাঁর সার্থক নাটকগুলির প্রায় সবই – রাণাপ্রতাপ, দুর্গাদাশ, নূরজাহান, সোরাব রুস্তম, মেবার পতন, সাহজাহান, চন্দ্রগুপ্ত প্রভৃতির রচনা বা প্রথম অভিনয় ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সময়কালে । এই সময়টা ছিল বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী তীব্র আন্দোলনের কাল । আজও কোন গৃহকোণ থেকে ভেসে আসা গান ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ কিংবা ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’ পথচলতি আমাদের দু’দন্ড দাঁড় করিয়ে দেয় সেই সব গানের কথা আর সুরমাধুর্য । সমবেত সংগীত, সংগীতের হার্মোনাইজেশন বা স্বরসঙ্গতির যে ধারণা তাও প্রথম পাওয়া যায় দ্বিজেন্দ্রলালের গানে । স্মরণ করতে পারি সাহজাহান নাটকে রাজপুত রমণীদের কন্ঠে গীত ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’গানটি। গানটি আজও শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক সমবেত সংগীতের শিরোপা ধারণ করে আছে ।

দ্বিজেন্দ্রলালের পূর্ববর্তী নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের ধর্মমূলক ভক্তিসংগীত বা ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটকে চটুল গানের প্রাবল্য ছিল । দ্বিজেন্দ্রলাল নাট্যগীতির রচনা ও সুর প্রয়োগে কাব্যের লাবণ্য, মার্জিত ও পরিশীলিত রুচির ভিত্তিভূমির প্রতিষ্ঠা করলেন । সাহজাহান নাটকে ‘আজি এসেছি, এসেছি বধুহে’, ‘নূরজাহান’নাটকে ‘আয়রে বসন্ত ও তোর কিরণ মাখা পাখা তুলে’, সাহজাহান নাটকেই ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে সাধের মালাটি গেথেছি’, মেবার পতন নাটকে ‘ভেঙ্গে গেছে মোর স্বপ্নের ঘোর’ কিংবা চন্দ্রগুপ্ত নাটকে ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ আজও আমাদের দোলা দেয়, আবিষ্ট করে । ১৯১১তে লিখেছিলেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ । এবং আজও অমর দেশাত্মবোধক গান ‘যেদিন সুনীল জলধী হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ । আমার মত হয়তো অনেকেরই নিশ্চিত বিশ্বাস দ্বিজেন্দ্রলাল যদি আর একটিও সংগীত সৃষ্টি না করতেন, তাহলেও শুধুমাত্র ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ ও ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ এই দুটি গানের সুবাদেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন । রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন “রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত অপেক্ষা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বঙ্গ আমার’ অধিক জনপ্রিয় হইল।…প্রাকৃতজনের মনোহরণ করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল, রবীন্দ্রনাথ তাহা পারেন নাই ।



অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল । পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন কৃষ্ণনগরের দেওয়ান, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত গায়ক । উনিশ শতকের নবজাগরণের কৃতিপুরুষের অনেকেই – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, ভুদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কার্তিকেয় চন্দ্র । এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, কৃষি বিদ্যা সম্পর্কে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাত গিয়েছিলেন । দেশে ফিরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রূপে সরকারী পদে যোগ দেন । বিলাতে দুবছর থাকাকালীন পাশ্চাত্য সংগীত ও নাটক সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন । দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম কাব্য সংকলন ‘আর্যগাথা’ প্রকাশিত হয় ১৮৮২তে তাঁর ১৯ বছর বয়সে । দ্বিজেন্দ্রলাল পাঁচশতাধিক গান লিখেছিলেন বলে জানা যায় কিন্তু তাঁর অধিকাংশ গানেরই কোন স্বরলিপি নেই, কোন গায়কীও জানা যায় না । যে সামান্য সংখ্যক দ্বিজেন্দ্রগীতি আমরা শুনি, সেগুলি থিয়েটারে প্রয়োগ হয়েছিল এবং কিছু গান গ্রামফোন রেকর্ডে ধ্বনিবদ্ধ হয়েছিল বলে সেগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা গেছে । তিনি নিজেও কয়েকটি গান গ্রামফোন রেকর্ডে গেয়েছিলেন । পারিবারিক বিপর্যয়ই তাঁর সংগীত সম্পদ সংরক্ষিত না হওয়ার প্রধাণ কারণ । মাত্র পঞ্চাশ বছরের আয়ু ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের । চাকুরী জীবনে প্রবল মর্যাদাসম্পন্ন ও দৃঢ়চেতা হওয়ায় বারংবার বদলি হয়েছেন ভারতের নানান প্রান্তে । দ্বিজেন্দ্রলালের দাম্পত্যজীবন ছিল মাত্র ১৩ বছরের । তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে, ১৯০৩এ পত্নী সুরবালা দেবীর মৃত্যু হয় । পুত্র দিলীপ কুমার তখন ছয় বছরের শিশু । ১৯০৫ পরবর্তী সাত বছরে তাঁর কর্মস্থল বদল হয় খুলনা, মুর্শিদাবাদ, কান্দি, বাঁকুড়া, জাহানাবাদ,গয়া, মুঙ্গের প্রভৃতি নানান প্রান্তে । ১৯১২য় মুঙ্গেরে বদলী হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন । কয়েকমাস পরে ১৯১৩র ১৭ই মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবার দুমাস আগে । পিতার মৃত্যুর পর পিতামহের গৃহে প্রতিপালিত দিলীপকুমারও সংসার ত্যাগ করেন যৌবনে । ফলে দ্বিজেন্দ্রলালের অসামান্য সংগীত সম্পদের কোন উত্তরসুরিই আর থাকল না । তবুও রবীন্দ্রনাথের গানের সর্বগ্রাসী প্রভাব সত্তেও তাঁরই সমকালের অনন্য প্রতিভা দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মবোধক গান, নাট্যগীতি, হাসির গান বাঙালির সংগীতভুবনের চিরকালীন অক্ষয় ঐশ্বর্য ।

আমাদের বাল্যকালে পড়া একটা কবিতা – ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই / কুঁড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই......’ । এখন কে আর মনে রেখেছি কবিতাটি রজনীকান্ত সেনের লেখা । রজনীকান্ত সেন মানে সেই উদ্দীপক দেশাত্মবোধক গান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই /দীন দুঃখিনী মা যে আমার এর বেশি আর সাধ্য নেই’ /ঐ মোটা সুতোর সঙ্গে মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই আমরা এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ, পরের দোরে ভিক্ষে চাই” । রজনীকান্ত সেন মানেই স্নিগ্ধ প্রশান্তির আত্ম নিবেদনের গান ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্ম মুছায়ে’ । 

রজনীকান্তর আদি নিবাস পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে । সংগীত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশে জন্ম রজনীকান্তর। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন সেই স্পময়ের দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ । লিখেছিলেন ‘পদচিন্তামণি’ নামে একটি কীর্তন সংকলন ও ‘অভয়া বিহার’ নামে একটি গীতিকাব্য সংকলন । 

খুব চটজলদি গান লিখে সুরকরে গাইতে পারতেন রজনীকান্ত । রাজশাহীতে থাকাকালীন নানান আসরে, সাহিত্যসভায় তাঁর ডাক পড়তো আর সেইসব আসরে অবধারিত ভাবে গান করতে হ’ত রজনীকান্তকে । চটজলদি গান বাঁধার এই গুণ পরবর্তী সময়ে আর একজনের মধ্যে ছিল, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম । কবি সঙ্গীতকার দ্বিজেন্দ্রলাল কর্মসূত্রে রাজশাহী আসতেন সেই সুবাদে দুজনের সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল । সেকালে হাসির গান রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন । বস্তুত দ্বিজেন্দ্রলালই ছিলেন বাংলা হাসির গান রচনার পথ প্রদর্শক । দ্বিজেন্দ্রলালের প্রেরনায় রজনীকান্তও অনেক হাসির গান রচনা করেছিলেন । ১৯০২এ রজনীকান্তর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় অক্ষয়কুমার মৈত্রর সম্পাদনায় । এটি ছিল মূলত গীতিকবিতার সংকলন। ১৯০৫এ প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কল্যাণী’ও গানের সংকলন । ১৯১০এ ৪৮টি নীতিমূলক কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ‘অমৃত’ । রজনীকান্তর একটি নীতি কবিতার কথা বোধকরি অনেকেরই মনে পড়ে যাবে - “নদী কভু নাহি করে নিজ জল পান, তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল, গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান, কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান” । মৃত্যুর পর তাঁর আরো পাঁচটি গ্রন্থ – ‘অভয়া’, ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’,’সদ্ভাব কুসুম’ ও ‘শেষ দান’ প্রকাশিত হয় । ১৮৯১এ আইন বিষয়ে পাশ করে রাজশাহী আদালতে আইন ব্যবসায় শুরু করেছিলেন । জীবন ধারণের জন্য ওকালতি শুরু করেছিলেন বটে কিন্তু সংগীতরচনা ও কাব্যসাধনায় নিবেদিতপ্রাণ রজনীকান্ত আইনব্যবসাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেন নি । তাঁর নিজের ভাষায়, “আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই। শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম ণ্ড আমার চিত্ত তাই লইয়াই জীবিত ছিল। সুতরাং আইনের ব্যবসায় আমাকে সাময়িক উদরান্ন দিয়াছে, কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য অর্থ দেয় নাই” ।

মাত্র ৪৫ বছরের আয়ু ছিল রজনীকান্তর, তাও শেষ একটা বছর দূরারোগ্য কর্কট রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন । কথাও বলতে পারতেন না । কলকাতায় হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত শয্যাশায়ী বাকশক্তিহীন কবিকে দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । রোগ শয্যা থেকেই একটি গীতি কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন রজনীকান্ত । রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই । পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই । আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।” 

ঈশ্বরভক্তিই তাঁর গানের মুখ্য বিষয় । সরল শব্দের বুননে ভক্তিমূলক এই গানগুলি্তে রয়েছে হূদয় মথিত করা আবেগ । বহুশ্রুত ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ গানটিতে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, শোক-তাপ এবং পাপ মোচনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আরও কয়েকটি ভক্তিরসের গান হলো: ‘আমিতো তোমারে চাহিনি জীবনে’, ‘কেন বঞ্চিত তব চরণে’, ‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছ’, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ প্রভৃতি। গানগুলির মধ্য দিয়ে ভক্তিরস ও আত্মনিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি রয়েছে জীবন ও জগতের প্রতি আপন বিষন্নতা ও বৈরাগ্যভাবনা ।

রজনীকান্তর গানের সুরে বাংলা গানের মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদান – কীর্তন, বাউল, পাঁচালি, রামপ্রসাদী গানের প্রভাব পাওয়া যায় । রজনীকান্তর সাঙ্গীতিক ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়নি কোন প্রথাগত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষায় কিংবা রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের মত পাশ্চাত্ত সঙ্গীতের রূপরস আত্মস্থ করেন নি । তাই তাঁর গানে সুরবৈচিত্রের অভাব থাকলেও ভক্তিভাবের সহজ অভিব্যক্তি ও সুরের আবেদন হৃদয়গ্রাহী । তাই রজনীকান্তর পঁচাত্তর ভাগ গানেরই স্বরলিপি না থাকলেও যে সামান্যসংখ্যক গান আছে ও এখনো গীত হয়, তার জোরেই রজনীকান্ত সেন বাংলার পঞ্চকবির একজন হয়ে আছেন, তাঁর গান আজও বাংলার সঙ্গীত ভান্ডারে অক্ষয় সম্পদ ।

‘মোদের গরব, মোদের আশা 
আমরি বাংলা ভাষা’ । 

বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার এমন চিরকালীন গান যিনি বেঁধেছিলেন তাঁর জীবনের বেশিরভাগটাই কেটেছে বাংলার বাইরে – উত্তর ভারতে । তিনি পঞ্চকবির চতুর্থজন অতুলপ্রসাদ সেন । বাংলার পঞ্চকবির চতুর্থ জন অতুলপ্রসাদ সেনের কাব্য ও সাঙ্গীতিক জীবন সুখের ছিল না । ব্যক্তিজীবনের নানান বিসংগতি, অসুখী দাম্পত্যজীবনে নিঃসঙ্গতার দহন ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী । আর তাই, গানের ভুবনে নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বই ছিল তাঁর সংগীত সৃষ্টির উৎস । 

কৈশোরে পিতৃবিয়োগ হয় অতুলপ্রসাদের । তাঁর বয়স তখন সতেরো । বাবার উপনিষদ গানে ঘুম ভাঙত বালক অতুলপ্রসাদের । সন্ধ্যায় ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে ব্রহ্মসঙ্গীতের সুর ছড়িয়ে যেত প্রাণে। বালক অতুলপ্রসাদের গান শুনে মা আদরে জড়িয়ে ধরতেন । সেই মা – ছয় সন্তানের জননী হেমন্তশশি আবার বিবাহ করলেন চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহনকে । তখনকার ব্রাহ্মসমাজও এই বিবাহ মেনে নিতে পারে নি । অতুলপ্রসাদও পারেন নি । তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্রটাই বদলে গেলো – শুরু হ’ল একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা । তিনবোনকে মায়ের কাছে রেখে অতুল চলে এলেন কলকাতায় মেজমামার কাছে । মেজমামা তাঁকে বিলেতে ওকালতি পড়তে পাঠালেন । পাঁচ বছর বিলেতে ছিলেন তিনি । সেইসময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পাশ্চাত্ত সঙ্গীত শিক্ষার উদ্দশ্যে ইংল্যান্ডে ছিলেন । অতুলপ্রসাদ সেখানে প্রবাসী ভারতীয়দের সান্ধ্য আড্ডায় মিশে গেলেন । এইসময় ওখানকার একটি লোক সুর ভেঙ্গে রচনা করলেন এক উদ্দীপক সংগীত ‘ওঠোগো ভারত লক্ষী’ । তবুও পাশ্চাত্ত সংগীত অতুলপ্রসাদকে মোটেই টানেনি । আসলে প্রথাগত সংগীতশিক্ষা তিনি করেন নি, তাঁর জীবনের লক্ষ্যও ছিলনা সংগীত রচনা করার । নিজের পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া, তিন বোনের ভবিষ্যৎ - এটাই একমাত্র চিন্তা ছিল তাঁর । এই সময় বড়মামা স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সপরিবারে লন্ডন আসেন । মামাতো বোন হেমকুসুম সঙ্গে প্রণয় হয় অতুলপ্রসাদের, স্থির করেন হেমকুসুমকে বিবাহ করবেন । কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে কলকাতায় ফিরে গেলেন । ওকালতি পড়া শেষ করে অতুলপ্রসাদও ফিরে গেলেন কলকাতায় । স্বদেশে ফেরার আর্তি থেকে গান বেঁধেছিলেন ‘প্রবাসী চল রে, দেশে চল; আর কোথায় পাবি এমন হাওয়া, এমন গাঙের জল’।

কলকাতা গিয়ে হেমকুসুমকে বিবাহের প্রস্তাব হেমকুসুমের পরিবার মেনে নিলেও তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো না । মামাতো-পিসতুতো বোনের বিবাহ তখন আইনসিদ্ধও ছিল না । কলকায় ফিরে অতুলপ্রসাদ তখন বিখ্যাত ব্যারিস্টার স্যার সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের সহকারী হয়ে প্রাকটিস শুরু করেছেন । সত্যেন্দ্রপ্রসন্নের পরামর্শে অতুলপ্রসাদ হেমকুসুমকে বিয়ে করলেন স্কটল্যান্ডে গিয়ে । ওখানে ভাই-বোনের বিবাহ আইনসিদ্ধ ছিল । হেমকুসুমকে নিয়ে অতুলপ্রসাদ বাসা বাঁধলেন বিলাতে । লন্ডনে ওকালতি শুরু করলেও মোটেই পসার জমাতে পারলেন না, লেগে থাকলো আর্থিক অনটন । ব্যর্থতা সঙ্গে করে ফিরে এলেন দেশে । কিন্তু কলকাতা নয়, বাসা বাধলেন উত্তর ভারতের লখনৌতে । সেখানেই ওকালতি শুরু করলেন । পসার জমতেও সময় লাগলো না । কিন্তু পারিবারিক শান্তি এলো না, সুখ এলো না দাম্পত্যজীবনে । স্ত্রী হেমকুসুমের সঙ্গে বিচ্ছেদ । একই শহরে দুজন আলাদা থাকতেন । ‘আমিও একাকি, তুমিও একাকি বাহিরে শ্রাবণরাতে/নীদ নাহি আখিপাতে’ গানটি শুনে স্রোতার হৃদয়ছোঁয়া সুর ও কথা মুগ্ধ করে । সে গানের পেছনে আছে কবির একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার বিষণ্ণতা । মাত্র ২০৮টি গান রচনা করেছিলেন অতুলপ্রসাদ । অন্য উপলক্ষ্যে গাওয়া সামান্য ৮/১০টি ছাড়া সব গানেই তাঁর একাকিত্বের বিষাদ-বেদনার ছায়াপাত ঘটেছে । 

দীর্ঘ বত্রিশ বছর লখণৌএ প্রবাসী জীবন কাটিয়েছেন অতুলপ্রসাদ । বলতেন ‘গান আর হাসিই আমার জীবন’ । একাকিত্বের যন্ত্রণা ভুলতে চাইতেন গানের মধ্যে । দীর্ঘকাল লখনৌতে থাকার সুবাদে হিন্দুস্থানী সংগীতের রূপ-রীতির মিশ্রণ ঘটাতে পেরেছিলেন তাঁর গানে । কীর্তন । বাউল, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকসুরেরও মিশ্রণ পাওয়া যায় তাঁর গানে । রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তর মত তাঁর দেশপ্রেমের গানগুলিও সমান ভাবে এখনো আদৃত । ‘আমরি বাংলা ভাষা’ গানটি তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চেতনা-মন্ত্রের কাজ করেছিল ।

দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ এই তিন গীত-কবির জীবনের একটা মিল পাওয়া যায় তা হ’ল নিঃসঙ্গতা । স্বল্পায়ু দ্বিজেন্দ্রলালের মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে পত্নী বিয়োগ, একমাত্র পুত্র দিলীপকুমারের যৌবনে সংসার ত্যাগ, যদিও ব্যক্তিজীবনের বিষন্নতার ছায়াপাত ঘটেনি দ্বিজেন্দ্রলালের সৃষ্টিতে । আরো স্বল্পায়ু রজনীকান্তর ক্যান্সারাক্রান্ত রোগশয্যায় শেষ একবছর কথা বলতে না পারা এবং অতুল প্রসাদের অসুখী দাম্পত্যজীবন জনিত একাকিত্ব । হয়তো বা নিঃসঙ্গতার বেদনা সব সার্থক কবিরই অবধারিত প্রাপ্য। বিশ্বসাহিত্যে যে বৃত্তান্ত রয়েছে অজস্র !

বিশেষ রচনাঃ শর্মিষ্ঠা ঘোষ


























বিশেষ রচনাঃ



‘প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর তো জানা’ 
শর্মিষ্ঠা ঘোষ

পেশা সূত্রে হরদম টিন এজ ছেলে মেয়েদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ আমার হয়েছে এবং হয় । এই রকম একটা বয়সে তাদের আমি পেয়েছি খুব কাছ থেকে যখন তাদের বয়ঃসন্ধির একটা টালমাটাল পিরিয়ড । তাদের তখন পিঠে সদ্য ডানা গজিয়েছে, ডেডালাসের মত অবাধ্য ইচ্ছেয় সূর্যের দিকে ওড়ার চেষ্টা ঐ নিয়েই ... হোক সে ডানা মোমের । তাদের চোখ তখন তির্যক মাপে ছোট থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা সহপাঠিনীর ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স । তাদের চোখের সামনে সদ্য পঁচিশের দিদিমনি একটু সঙ্কোচে ... নাকি অতীব বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান সেটা ? সে হেঁটে গ্যালে আড়ালে উড়ে আসে হাল্কা সিটি ... প্রেমিকের বাইকে দিদিমনি পথ যদি না শেষ হবার গান গাইলে কচি গোঁফের ছাত্রের দল হায় হায় করে ... ক্লাসের মাঝে একটু হাসি একটু প্রশ্রয় একটু ভ্রুকুটি একটু বিভঙ্গ একটু আদর মাখা শাসন ... পড়াশোনা শুধু চলে না, দৌড়য় । তো এমনই এক অনুভবের কথা উঠে এল আমার একটা কবিতায় ... একটি বছর চৌদ্দর ছেলের চোখে তার দিদিমনি, তার প্রতি ছেলেটির বিশেষ নরম গোপন একান্ত অনুভবের কথা বলা আছে তাতে । যার কয়েকটি লাইন এমন ছিল ...

‘ জামার বাঁদিকে নীল জেল পেন, কালি মাখামাখি আমার শার্টে / যেন গো আমার কিশোর হৃদয়ে বান ভাসাভাসি তোমার জন্যে / তখন আমার সদ্য তেরো, শরীরের আড় ভাঙছে কেবল / ঠোঁটের ওপর সবুজ আভা, নরম গালে রেশমি কোমল / তলপেটে এক শিরশিরানি সুপর্ণা ম্যাম, তোমায় দেখলে / গলার আওয়াজ বদলে যাচ্ছে, বাবার মতই ভারি হয়ে যাবে / আমি হতে চাই রুদ্রকাকু, সুপর্ণা ম্যাম, তোমার প্রেমিক’...

ফেসবুকের একটি তথাকথিত তরুণ কবিদের কবিতার গ্রুপে কবিতাটি পোসটানোর পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল । কারুর ভাল লাগলো এবং কারুর মনে হল, একজন মহিলার লেখার বিষয়বস্তুটি এমন হবে কেন ? তাদের মধ্যে সদ্য যুবা এক ভ্রাতৃপ্রতিম উঠতি কবিও ছিল । প্রসঙ্গত তার লেখা আমার নিজের বেশ প্রিয় । তো তাকে সেদিন হাল্কাচালে বড় হয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলাম । মনে মনে হেসেছিলাম । আমার এক কবিবন্ধু আর একবার দেখা করতে এল সুদূর বাংলাদেশ থেকে। একরাত্রির অতিথি সে আমার । অনেকই আলোচনা হোল সেখানকার লেখার ধারা নিয়ে এখন এই সময় যারা লিখছেন তাদের সামনে কোন আলোর দিশা আছে সেসব নিয়ে । সে আমায় আলোচনার ছলে বলেছিল, আমার লেখা মোটেই ‘মেয়েলি’ নয় । আমি ভেবে পাইনি , এটাকে নিন্দে না প্রশংসা হিসেবে নেব । আমার একাধিক লেখায় দেহবাদের প্রতি আমার ‘অনৈতিক’ ঝোঁকের বিষয়ে বোদ্ধাদের ‘সুপরামর্শ’ আছে ।

একাধিকবার তথাকথিত ‘অশ্লীলতার’ দায়ে অভিযুক্ত হয়েছি, অভিযোগ এমন, যে কবিতাকে ইন্ডাস্ট্রি বানিয়ে তুলছি নাকি । তার উত্তরে আর একটি কবিতা লেখাই শুধু হোল ... ধারা বদলাল না । কারণ, যা অনুভব করি সত্য বলে, তাকে নিরোধ পরিয়ে ইমপোটেনট প্রমাণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখি না । কলমের খাপ খুলেই তো লিখতে বসা, ফের লেখার মুখে খাপ কিম্বা কিংখাব পরালে শুধু যে সাবলীলতা নষ্ট হয়, তাই না, সেটা মেকি সুশীল আঁতলামো হয়ে ওঠে বলে আমার বিশ্বাস ।

একজন লেখক তার নারী বা পুরুষ স্বত্বা বিসর্জন দিয়ে একাধারে পুরুষ ও প্রকৃতি হয়ে না উঠতে পারলে একটা ফালতু গণ্ডীতে আটকে পড়েন, যেখানে মেয়েরা মেয়েদের নিয়ে, তার ছলাকলা, লাস্য, ন্যাকামি, বোকামি, নাকি কান্না, বোবা কষ্ট, বঞ্চনা আর চাহিদার সাতসতেরো নিয়ে আর ছেলেরা কেবল মাচো মাচো মুশকো জওয়ানদের চোখে নারীর চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার নিয়ে ছাড়া লেখা বারণ ... অনেকে বলবেন, কেন রে বাওয়া, দুনিয়ায় কি লেখার বিষয়ের অভাব পড়েছে ? কত কি ই তো আছে, চাঁদ তারা ফুল পাখি নদী সমাজ রাজনীতি ধর্ম দর্শন ... তা না, খালি রগরগে গল্প ফাঁদে ফালতু পাব্লিক ... তা, আমি বলি কি, সব নিয়েই লেখা হবে যখন, এই মানবদেহ জমিন টাই বা বৃথা অকর্ষিত ফেলে রাখা কেন ? আর মুষ্টিমেয়ের হাতেই বা তাকে কালটিভেট করার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা কেন ? তারচেয়ে, দশে মিলি করি কাজ ... ইত্যাদি ...

মাঝে মাঝে মনে হয় মাইকেল্যাঞ্জেলো, র্যাফায়েল, র্যঁদা, পিকাসো যা রেখে গ্যাছেন দুনিয়ায় তার অনেকটাই তো তাহলে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হবার কথা ... শেক্সপিয়ার তো প্রেম করার জন্য একটা ঠিকঠাক ‘মহিলা’ও জোটাতে পারেন নি, কে এক মিস্টার অজানার উদ্দেশ্যে রাশি রাশি অপূর্ব চতুর্দশপদী ফেঁদে বসলেন, ... মোনালিসার হাসি টা যে অমন ঠোঁট টেপা তা কি দাঁত দেখানো অশ্লীলতা বলেই ? ব্রাউনিং এর লাস্ট ডাচেস তো যখন তখন হাসার দায়ে প্রাণটাই দিলেন, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের তো বেশ কয়েকখানা স্বীকৃত প্রেমিকা ছিলেন, তা কবি বেচারা কি সারা জীবন দেবতাকে প্রিয় আর প্রিয়কে দেবতা করার কথা বলে গ্যালেন বিবেকের তাড়নায় ? তাই যদি হয় তো চলুন, ল্যুভরে মিউজিয়মে আগুন লাগানো যাক ... কি যে সব অশ্লীল ছাইপাঁশ প্রদর্শন করে, বস্ ! কবিদের মানস প্রতিমারা সব তুলসী মালা পরিহিত নিপাট বৈষ্ণব তো ? ... নিরামিষ আচরণের সদাচারী বীতকাম ?

সাহিত্যের অঙ্গনে এইসব মোটা দাগের বিভাজন রেখা কার মস্তিষ্ক প্রসূত কে জানে, তবে সেটা যে খুবএকটা মেনে চলেন সবাই, এমন ও নয় । এসব গুরুত্বসহকারে মানতে গেলে, সাহিত্য জননী নিজেই বঞ্চিত হতেন । কে কি কিভাবে লিখবে বা লিখবে না সেটা নিক্তি মেপে বলে দিতে গেলে তো এটাও সেইসাথে বলতে হয় যে, এই সুমহান বিচার কর্মটি কে কোন সুবাদে কোন যোগ্যতায় সমাধা করলেন ? কিছু লেখা অতীতে নিষিদ্ধ হয়েও পরে সমাদৃত হয়েছে, যুগে যুগে, কালে কালে এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে ... তার মানেই যে কালের সাথে মানুষের নৈতিক বোধ এর প্রসারণ বা সঙ্কোচন ঘটেছে এটা বলা মুর্খামি, কারণ নীতি একটি মানুষের ব্যাক্তিগত মত, কখনোই তা সমষ্টিগত নয় ... এইসমস্ত শ্লীল অশ্লীল প্রসঙ্গ অনেকসময় আদালত অবধি ও গড়ায়, ব্যাপক আকচাআকচি চলে, বাদী বিবাদী দিন কতক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেন, তুই মুই চলে ভক্তগণের শিবিরে শিবিরে ... তারপর ও বেলাশেষে পাঠকের দরবারেই নিরূপিত হয় শিল্প সাহিত্যের স্থায়িত্বের হিসেব নিকেশ । ‘এহি হ্যায় রাইট চয়েস বেবি ... আহা’ !

রম্যরচনাঃ স্বপন দেব






রম্যরচনাঃ


ওঁ গণেশায় নমোঃ
স্বপন দেব


বিডন ষ্ট্রীট এর “আসছে বছর আবার হবে” ক্লাব গত বছর এক অভিনব দুর্গা পূজার থিম করেছিলো। সে বছর ওদের দুর্গা প্রতিমার সব দেব-দেবীই হবেন জ্যান্ত ! আয়োজন শুরু হয়েছিলো প্রায় ১০ মাস আগে থেকে এবং তখন থেকেই নানান রকম বিপত্তি। সেক্রেটারির স্ত্রী, যমুনা বৌদি কে দুর্গা করতে কারোরই আপত্তি ছিলও না কারণ, প্রতিদিন রাতেই সেক্রেটারি মশাই মাতাল হয়ে টলতে টলতে বাড়ী ফিরতেন এবং তারপরেই যমুনা বৌদি মহিষাসুর-মর্দিনী রূপ ধারণ করতেন! কিন্তু, সমস্যা হোল ঐ টিংটিঙে চেহারার সেক্রেটারি কে তো অসুর বলে কেউ মানবেনা। ওদিকে সেক্রেটারি সাহেব ও গোঁ ধরে বসে আছেন, নিজের স্ত্রী কে তিনি পর-পুরুষের হাতে কিছুতেই ছাড়বেন না ! এদিকে আবার নির্দেশক মশাই-এর প্রথম পছন্দ ছিল মোড়ের মাথার “বিবেকানন্দ ব্যায়াম সমিতি”র মালিক ভুনো’দা কে। বলিষ্ঠ এবং পেশীবহুল, সবসময়েই খালি গায়ে ঘেমো গন্ধ ওয়ালা ভুনো’দা ছিল আদর্শ অসুর। যাই হোক, সবাই মিলে সেক্রেটারি সাহেবকে বললেন, দাদা মাত্র তো তিন দিনের মামলা ! ঐ তিন দিনে কি বৌদি ভুনো’দার প্রেমে পড়ে যাবেন ? ওর ঘেমো গন্ধটার কথা একবার ভাবুন ! কথাটা সেক্রেটারির মনে ধরলো। যে বউ বাংলা মদের সু-গন্ধ সইতে পারেনা, সে কিছুতেই ঐ ঘেমো গন্ধ সইতে পারবেনা। তিনি নিমরাজি হলেন, কিন্তু একটা শর্ত দিলেন। পূজোর তিনদিন তো বটেই, এমনকি যতদিন মহড়া চলবে, ঐ ভুনো কোন ডিওডোরেন্ট বা পারফিউম ব্যবহার করতে পারবেনা ! যাক, ভালোয় ভালোয় অসুর-দুর্গা পর্ব মিটে যাওয়ার পর শুরু হোল লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ-এর সন্ধান। যাই হোক, গণেশ নিয়ে খুব একটা সমস্যা হলনা। পাড়ার তুলসী মাস্টারের ছেলে, হাবুল ইতিমধ্যেই পাড়ায় ক্যাবলা গণেশ নামে পরিচিত। কিন্তু, ঘোরতর সমস্যা দেখা দিল কার্তিক, আর সরস্বতী নিয়ে। পাড়ার মহা-কালী বিদ্যামন্দিরের সামনের রোয়াকে যাদের সকাল-বিকেল নিত্য হাজিরা দিতে হয়, তাদের প্রায় গোটা পনের ছেলের সবার দাবী কার্তিক হবার। নির্দেশক মশাই যাকেই বাছেন, বাকি চোদ্দজন সমস্বরে বলে ওঠে, ফোঁট শালা ! তোকে কাল থেকে এখানে দেখলে, পেঁদিয়ে পগার-পাড় করে দেবো ! পূজো প্রায় বানচাল হবার জোগাড় ! যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পাড়ার কাউন্সিলর হারাধন বাবু, যিনি এই ক্লাবের সভাপতি তাঁর মধ্যস্ততায় ঠিক হোল ঐ পনেরো জন ই পালা করে ঘণ্টা হিসেবে সাড়ে তিন দিন কার্তিক সাজবে ! লক্ষ্মী নিয়েও কোনও ঝামেলা হোলনা। পাড়ার পুরুত কানাই বাবুর পুত্রবধূ যিনি প্রায় সবসময়েই কানাই বাবুর যজমানীর দৌলতে পাওয়া লাল পাড় শাড়ী আর মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলাফেরা করেন, এক বাক্যে সবাই তাঁকে লক্ষ্মী বলে মেনে নিলেন। কিন্তু, আবার মুশকিল বাঁধলো সরস্বতী কে নিয়ে ! সরস্বতীর জন্যে মোট পাঁচজন প্রতিযোগিনী ছিলেন। পাঁচজনই পাড়ার উঠতি যুবকদের হার্টথ্রব ! কিন্তু তাদের মধ্যে দুজন, অমৃতা আর মমতা শিক্ষাগত যোগ্যতায় বাদ চলে গেলো ! অমৃতা ক্লাস এইট পাস আর মমতা মাধ্যমিক ফেল ! বাকি তিনজন, মানে, পায়েল, পিয়ালি আর মধুছন্দার লড়াই ছিলো হাড্ডাহাড্ডি ! পায়েল পাড়ার নিশাপতি বাবুর একমাত্র মেয়ে। নিশাপতি বাবুর আলুর তিনটে কোল্ড স্টোরেজ আছে। এবং তিনিই এই ক্লাবের প্রধান-পৃষ্ঠপোষক। পায়েল পাড়ার সব থেকে উঁচু বাড়ীটার চারতলায় থাকে এবং রোজ সকালে ব্যালকনি তে শর্ট প্যান্ট পরে কানে মোবাইল নিয়ে হুশ হুশ করে নীচের রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাইক আরোহীদের উদ্দ্যেশ্যে হাত নাড়েন। একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় সেম এর ছাত্রী। পিয়ালিও কিছু কম যায়না। মেদহীন স্লিম সুঠাম দেহ, মাথার চুল প্রায় কোমরের আধ হাত নীচে পর্যন্ত ঢেউ খেলানো, এম বি এ এর ফাইনাল ইয়ার এর ছাত্রী, অসম্ভব ভালো গান করে। পায়েল-এর মত মড নয় তবে যথেষ্ট আকর্ষনীয়া। আর রূপে গুণে মধুছন্দা তো সাক্ষাৎ মা সরস্বতী ! কেউ কারো চেয়ে কম যায়না। সুতরাং আবার প্রস্তাব উঠলো তিন জনেই পালা করে সরস্বতী হবে কার্তিক দের মত। কিন্তু মুশকিল হোল এরা কেউ পালা করে সরস্বতী সাজতে চায়না। এদের ফুল টাইম পার্ট চাই ! মহা সমস্যা ! একজন প্রস্তাব দিলো ঠিক আছে, আগামী রোববার পাড়ার সবাই এই তিনজন কে ভোট দেবেন। যিনি সব চেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনি ই হবেন সরস্বতী অফ দি ইয়ার ! ঠিক হোল রবিবারের আগে পাড়ার প্রত্যেক কে আলাদা আলাদা করে তিনজনের নাম লেখা তিন টি করে কাগজ দেওয়া হবে। কেউ একজনের বেশী কাউকে ভোট দিতে পারবেন না। এবং কাগজের টুকরো গুলো একটি বা কয়েকটি লক্ষ্মীর ভাঁড়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে। ঐ দিন ই সন্ধ্যায় গনণা হবে এবং গণনার সময়ে পাড়ার মান্যগণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। মোট ১১৭ টি ভোট পরেছিল। গণনার পরে দেখ গেল, মধুছন্দা ৫২ টি, পায়েল ৪১ টি এবং পিয়ালি ২৪ টি। যাক, দেব-দেবী নির্বাচন পর্ব তো চুকলো। পাড়ার সফট টয়েজ এর কারখানার মালিক তপন বাবু কথা দিলেন, দুর্গার আট টি হাত এবং গণেশের শুঁড় তিনি বানিয়ে দেবেন। পরদিন থেকেই প্র্যাকটিস। মানে পোজ নিয়ে একটানা দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাস করা। কিন্তু কদিন পরেই আবার একটা বিতর্ক। পাড়ার পুরোহিত কানাই বাবুর ফরমান, পুজো যদি হয়, তা সে মৃন্ময়ী বা চিন্ময়ী যে রূপেই হোক, দশমীর দিন বিসর্জন ও দিতে হবে ! এ তো আর এক সমস্যা ! যাই হোক, দেখা গেলো অভিনেতা অভিনেত্রী দের সবাই সাঁতার জানেন। আর কার্তিকের দলে অন্তত ৩ জন লাইফ সেভার সাঁতারু। হাবুল, মানে ক্যাবলা গনেশ তো প্রতিদিন সকালে প্রায় মাঝ গঙ্গা অবধি গিয়ে ফিরে আসে। মধুছন্দা শুধু একটু গাঁইগুই করছিল। সেই কোন ছোটবেলায় শিখেছিলাম, এখন কি মনে আছে ? শোন, সাঁতার কাটা আর সাইকেল চালানো কেউ একবার শিখলে সারা জীবন মনে রাখে। তুই বরং ঐ কার্তিকদের কাউকে নিয়ে ৩/৪ দিন ঝালিয়ে নিস, সবাই এক বাক্যে বলে উঠলো। যাই হোক, দশমীর দিন বিকেল পাঁচটায় বিসর্জন হবে সাব্যস্ত হোল। এদিকে মাস তিনেক রিহার্সালের পরেই দেখা গেল সবাই আধ ঘণ্টা একটানা পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে। তবুও, নির্দেশক মশাই ঝুঁকি না নিয়ে কুড়ি মিনিট অন্তর পর্দা ফেলার নির্দেশ দিয়ে রাখলেন। যাই হোক ষষ্ঠীর দিন রাত আটটায় যে যার পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং পর্দা উত্তোলন হোল ! বাইরে তখন শ পাঁচেক দর্শক একসঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠলেন। এমন অভিনব দূর্গা-দর্শন করে তারা বিমোহিত। সপ্তমীর সকাল থেকে রাত অবধি ও নিশ্চিন্তে কাটলো। খালি হাজার হাজার দর্শকের অসংখ্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি তে মাঝে মাঝেই সকলের চোখ একটু পিট পিট করে উঠছিলো ! হাবুল, মানে পাড়ায় ক্যাবলা গণেশ নামে পরিচিত এবং এখানে সাক্ষাৎ গণেশ কে কিন্তু কোন কিছুই এক বিন্দু টলাতে পারেনি। ভীষন সিরিয়াস ভাবে সে এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল। সপ্তমীর দিন এবং রাত ও নির্বিঘ্নেই কাটলো এবং দর্শক সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকলো। কেলেঙ্কারি ঘটল অষ্টমীর দিন ! সেবার সন্ধি পূজা ছিল দুপুর বেলায়। পোজ নিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, সন্ধি পূজা এবং জ্যান্ত ঠাকুর দেখতে উপস্থিত দর্শককুল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা আরশোলা উড়ে এসে সটান সরস্বতী মধুছন্দার গায়ে এসে পড়ল। বাবা গো ! বলেই লাফিয়ে উঠল মধুছন্দা এবং সঙ্গে সঙ্গে আরশোলাটা মধুছন্দার থেকে উড়ে গিয়ে কানাই বাবুর পুত্রবধু, এখানে লক্ষ্মী র গায়ে এসে বসল। আর যায় কোথায় ! মধুছন্দা তৎকালীন কার্তিকের কোলে, আর লক্ষ্মী কে কাছে টেনে নিয়েছেন স্বয়ং মহিষাসুর মর্দিনী !! দর্শকদের হাসি আর টিটকারির মধ্যে সেক্রেটারি চেঁচিয়ে উঠলেন, পর্দা ফেলো পর্দা ফেলো ! কিন্তু শম্ভু, যার পর্দা ফেলার কথা, সে তো তখন চা খেতে গেছে !! অগত্যা ইলেক্ট্রিসিয়ান বুদ্ধি করে সব অন্ধকার করে দিলো ! যাই হোক, ঘণ্টা খানেক পর আবার আলো জ্বলে উঠলো এবং আবার সবাই জ্যান্ত প্রতিমা দর্শন করতে ভীড় জমালো। নবমীর দিন নতুন করে আর কিছু হয়নি এবং খুব সফল এবং সার্থক ভাবেই এই নতুন থিম সকলেই খুব উপভোগ করেছিল। দশমী। আজ বিসর্জন। সকাল থেকেই সকলের মন খারাপ, বিশেষত ক্যাবলা গণেশ মানে হাবুলের। ঠিক হল যে বিকেল ৫টায় সিমলে থেকে দেব-দেবীরা পোজ নিয়ে একটা লরিতে উঠবেন। বিডন স্ট্রীট থেকে নিমতলা ঘাট আর কতই বা দূর, মিনিট দশেক এর মধ্যেই পৌঁছে যাবে। তারপর নৌকায় উঠে সবাই আবার পোজ নিয়ে দাঁড়াবে। নৌকা নিমতলা থেকে শোভাবাজার ঘাটের কাছাকাছি এলে, সেক্রেটারি মশাই একটা হুইশেল বাজাবেন আর তক্ষুনি সবাই একসঙ্গে পেছন দিকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। সেখানে দু তিনজন লাইফ সেভার থাকবে আর তাছাড়া ক্যাবলা গণেশ একাই দু-তিন জনকে টেনে নিয়ে আসতে পারবে। লরি, শোভাবাজার ঘাটে অপেক্ষা করবে এবং সবাই উঠে এলে, মেয়েরা কাপড় ছাড়ার ঘরে গিয়ে পোশাক পালটে একে একে লরিতে এসে উঠবে। যেমন কথা, তেমনি ভাবেই কাজ এগোচ্ছিল। বিডন ষ্ট্রীট দিয়ে লরি করে যাওয়ার সময় পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র মানুষ অবাক বিস্ময়ে এই জ্যান্ত দুর্গা দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। নৌকায় উঠে আবার সবাই পোজ নিয়ে দাঁড়ালো এবং নৌকা ধীরে ধীরে শোভাবাজার ঘাটের দিকে চললো। ঘাটের প্রায় একশ ফুট দূরে এসে সেক্রেটারী পিঁ পিঁ করে হুইশেল বাজালেন আর সবাই একসাথে গঙ্গার দিকে পেছন করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পাড়ে উঠে, মহিলাদের ঘরে মহিলারা আর পুরুষদের ঘরে পুরুষেরা পোশাক ছাড়তে চলে গেলেন। বাকি সবাই লরির পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আধ ঘণ্টা খানেক পরে ছেলেরা এবং তার মিনিট দশেক পরে মহিলারাও বেড়িয়ে এলেন। লরি ছাড়ার উপক্রম, হঠাৎ তুলসী মাষ্টার চেঁচিয়ে উঠলেন, হাবুল কোথায়? সত্যি ই তো ! হাবুল তো জল থেকে ওঠেনি ! তবে কি ও অন্য ঘাটে চলে গেল ? “ঐ জন্যেই ওকে সবাই ক্যাবলা বলে !” সেক্রেটারি সাহেব বলে উঠলেন। ঘাট থেকে একশ ফুট দূরে, হাবুলের মত ওস্তাদ সাঁতারু ডুবে যাবে এটা কারোর ই বিশ্বাস হলনা। ব্যাটা ঠিক আবার সাঁতরে নিমতলা ঘাটে গিয়ে উঠেছে ! হৈ চৈ করতে করতে সবাই পাড়ার দিকে রওনা দিলো। পাড়ায় এসে সবাই হাবুলের খোঁজ করতে জানা গেল, হাবুল মোটেই পাড়ায় ফেরেনি। তাহলে ? এবার সবাই খুব ভয় পেয়ে, পুলিস, অ্যাম্বুলেন্স আর বন্দর কর্ত্তীপক্ষ কে জানানো হোল। কাউন্সিলার হারাধন বাবুর তত্বাবধানে সবাই হাবুলের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ল। না,হাবুল কোথাও নেই। সমবেত আনন্দ নিমেষে ঢাকা পড়লো গভীর বিষাদে। অবশেষে হাবুলের খোঁজ পাওয়া গেল, তবে দু’দিন পর। ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া হাবুলের দেহটা বরানগরের রতনবাবুর ঘাটে এসে ভিড়েছে। পুলিশের কাছে খবর পেয়ে তুলসী মাষ্টার কে নিয়ে সবাই গেলেন এবং বিস্ময়-বিমূঢ় চোখে সবাই দেখলেন, হাবুল শুঁড় টা অবধি খোলেনি ! সারা জীবন সকলের পরিহাস আর বিদ্রুপের ডাক ক্যাবলা হাবুল শোনার থেকে সিদ্ধিদাতা গণেশ হয়েই চলে গেল হাবুল। সে কখোনোই এটাকে মজা বা নাটক বলে ভাবেনি। যারা তাকে নিয়ে এ যাবৎ বিদ্রুপ করে এসেছেন, তাঁরা ঠিক করলেন বিজয়া সন্মিলনীর দিনটি হাবুলের স্মরণ সভা হবে। ক্লাবের নাম পালটে রাখা হোল, হাবুল স্মৃতি ক্লাব।

রম্যরচনাঃ নারায়ণ রায়





রম্যরচনাঃ


হ্যাট -ট্রিক
নারায়ণ রায়


পটাইবাবুর ছেলে অবিনাশ চন্দ্র হ্যাট-ট্রিক করেছে। এই নিয়ে পাড়ার চতুর্দিকে বিস্তর আলোচনা চলছে। কোন বিষয়ে পর পর তিনবার একই সাফল্য ধরে রাখা নিছক ছেলে খেলা নয়। ক্রিকেট খেলায় যখন কোন বোলার পর পর দুই বলে দুটি উইকেট পাওয়ার পর তৃতীয় বল করতে যান, কিম্বা ব্যাটস্ ম্যান পর পর দুই বলে দুটি ওভার-বাউন্ডারী মারার পর তৃতীয় বলটি যখন মারতে যান, অথবা স্ট্রাইকার দুটি গোল করার পর তৃতীয় বারের জন্য বল নিয়ে যখন অপর পক্ষের গোল সীমানায় পৌঁছান, তখন সমগ্র মাঠে যে টান টান উত্তেজনা দেখা দেয়, অবিনাশ চন্দ্রের ক্ষেত্রে অবশ্য সেরকম কোন অগ্রিম উত্তেজনার আঁচ পাওয়া যায়নি। মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল ‘বিদ্যাধরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে’র ফল গত কয়েক বৎসরের তুলনায় এবারে অনেক ভালো হয়েছে এবং সেই আনন্দে সবাই যখন নৃত্যরত তখন প্রধান শিক্ষক মহাশয় নজর করলেন যে আগের দুইবারের ন্যায় এবারেও অবিনাশ চন্দ্র অকৃতকার্য হয়েছে। 

দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। যথারীতি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যার পর নাই আশ্চর্য্যান্বিত হয়ে হাতে তিনদিন সময় নিয়ে এক জরুরী মিটিং ডাকলেন, আর সেই মিটিং-এ অবিনাশ চন্দ্র ও তার পিতা পটাই বাবুকে আমন্ত্রণ জানানো হ’ল। কারণ শিক্ষকদের এতদিন একটি ধারণা ছিল যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করা যেমন কিঞ্চিত কঠিন ব্যাপার, মাধ্যমিকে ফেল করা তদাপেক্ষা কঠিন কাজ। কিন্তু অবিনাশ চন্দ্র পর পর তিনবার সেই কঠিন কাজটি করে হ্যাট-ট্রিক করেছে, তাই এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি মিটিং ডাকা অবশ্য কর্তব্য। যদিও সুকুমার রায়ের কবিতায় উনিশটিবার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তবুও বিদ্যাধরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এধরনের প্রয়াস এই প্রথম। তাই শিক্ষক ও ছাত্র মহলে রীতিমত সাড়া পড়ে গেছে। এদিকে বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় যারা স্টার পেয়ে কিম্বা উচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে, তারা পড়ল মহা চিন্তায়, তাহলে এবার কি বিদ্যালয় থেকে তাদেরকে বই, গোলাপ ফুল, উত্তরীয়, মিষ্টির প্যাকেট এসব দিয়ে বরণ করা হবে না? বিদ্যালয়ের ইতিহাসে কঠিনতম কাজটি করার জন্য এসবই কি তাহলে অবিনাশ চন্দ্রকেই দিয়ে দেয়া হবে?

কথায় বলে, বায়ুর আগে বার্তা বয়, তাই এই খবরটাও মুহুর্তের মধ্যে চারিদিকে রটে গেল। পটাইবাবুর পরিচিত পরিজনেরা খবরটি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা সত্তেও পটাইবাবুর সঙ্গে দেখা হলেই তাকে খবরটি জিগ্যেস করে বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। পটাইবাবুও পড়লেন মহা চিন্তায়। কিন্তু যার জন্য এত চিন্তা তার কোন হেল দোল নেই। অবিনাশ চন্দ্র যথারীতি তার ঘরে সারাদিন ধানি পটকা ব্যান্ডের ‘শশ্মানে অশান্তি’ সি ডি টা চালিয়ে প্রবল বিক্রমে নৃত্যরত, অথবা একটি পুরানো হারমোনিয়াম এবং ততোধিক পুরানো একটি গীটার সহযোগে সঙ্গীত চর্চায় রত। 

বিকেলে অবিনাশ চন্দ্র তার সঙ্গীত চর্চা বন্ধ রেখে দোতলার ঘর থেকে নীচে নেমে এসে পটাই বাবুর মুখোমুখি হতেই পটাই বাবু অত্যন্ত ধীর ও শান্ত গলায় যেন কোন আপনজন বিয়োগের খবর দিচ্ছেন, সেইরূপ নীচু গলায় বললেন, “খবরটা শুনেছ ?” অবিনাশ চন্দ্র ততোধিক বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “তা আর শুনবো না কেন? কিন্তু তোমরা এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন আত্মীয় স্বজন কেউ মরেছে।……… “আচ্ছা লেখাপড়া করে কে কোনকালে বড় হয়েছে শুনি ? চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ, সিরাজদৌল্লা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কে কটা পাশ দিয়েছেন শুনি ? কিন্তু আমার ব্যান্ডের গান যখন লোকের ঘরে ঘরে বাজবে তখন তুমি তো রাস্তায় বেরোতে পারবেনা, সেটা একবার ভেবে দেখেছো কি ?” একথা শুনে পটাইবাবু বড়ই চিন্তায় পড়লেন, কারণ এমনিতেই এক হ্যাট-ট্রিকের ঠ্যালায় আজ সকাল থেকে তার পক্ষে বাড়ির বাইরে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু পুত্রের গানবাজনার সঙ্গে তার বাইরে বেরোনর কি সম্পর্ক তা বুঝতে না পেরে পটাইবাবু যখন মাথা চুলকাচ্ছেন, ঠিক তখনই অবিনাশ চন্দ্র ব্যাপারটা খোলসা করল- “তখন তুমি বাইরে বেরোলে সবাই বলবে—ঐ যে অবিনাশ কুমারের বাবা যাচ্ছে …. তোমার চারিদিকে ভীড় করে তোমাকে পাগল করে দেবে। তোমার অটোগ্রাফ চাইবে, তুমি তখন ভি আই পি-র বাবা হবে, …. তা তুমি সেটা চাও নাকি অবু কেরানীর বাবা হয়েই জীবনটা কাটাতে চাও….যত্তসব !”

পটাইবাবুকে এর পরেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে দেখে অবিনাশ চন্দ্র যথারীতি বাবার অজ্ঞতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে গট গট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে পটাইবাবু পড়লেন মহা বিপদে, স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করলেন কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেলেন না। ছাপোষা পটাইবাবু কোনদিনই গান বাজনার বিরোধী নন, কিন্তু এই অর্বাচীনকে কে বোঝাবে যে সত্যিকারের সঙ্গীত সাধনা বড় কঠিন কাজ, তার চেয়ে সাধারণ পড়াশুনা করে কিছু করা অনেক সহজ। তাই মনে মনে ভাবলেন যেন তেন প্রকারেণ অবিনাশ চন্দ্রকে মাধ্যমিক পাশটা করাতেই হবে। মাধ্যমিক পাশ করার পর বড় সাহেবকে ধরে অবিনাশ চন্দ্রকে যদি একবার নিজের অফিসেই গুঁজে দেওয়া যায় তাহলে তো কেল্লা ফতে।

পরদিন সকালেই পটাইবাবু তাঁর পাড়ার বিলে ডাক্তারের চেম্বারে গেলেন, সবিস্তারে সকল ঘটনা বলা শুরু করার আগেই, ডাক্তার বাবু বললেন, “ঐ হ্যাট-ট্রিকের কথা বলছেন ?” পটাইবাবু বিনয়ের হাসি হেসে পাড়ার ছেলে বিলে ডাক্তারকে বললেন, “তা তুমি যখন সবই শুনেছ, তখন ছেলেটার একটা বিহিত করে দাও বাবা।” অবিনাশ চন্দ্রের পরীক্ষায় পাশের ব্যাপারে বিলেবাবু কি ভাবে সাহায্য করতে পারেন তা বুঝতে যখন বিলেবাবুর কিঞ্চিত সময় লাগছে, তখন পটাইবাবু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, “আজকাল তো কত রকমের ওষুধ, টনিক, দুধ এসব বেরিয়েছে টি ভি তে দেখেছি খাওয়ালেই ছেলেরা টপা-টপ ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে যাচ্ছে, তা তুমি নাহয় একটু কম তেজের ওষুধ দাও যাতে ফার্স্ট সেকেন্ডের দরকার নেই, কোনরকমে পাশটা করতে পারে।” উত্তরে বিলে ডাক্তার পটাইবাবুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে “প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ মেধা নিয়ে জন্মায় এবং জন্মের পর সে যে পরিবেশে বড় হয় সেই পরিবেশের সহায়তায় এবং নিজ প্রচেষ্টায় তার মেধার বিকাশ ঘটে। মেধা ওষুধ খাইয়ে বৃদ্ধি করা যায় না, ওসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোকঠকানোর ব্যবসা। তার চেয়ে ওকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলুন।” বিলে ডাক্তার অল্প বয়সে লেখাপড়ায় এলাকার সেরা ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল, তাই তার কথা পটাইবাবু কি করে ফেলে দেন ? 

এদিকে অবিনাশকে যেন তেন প্রকারে মাধ্যমিক পাশ করাতেই হবে, তা না হলে প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখানোই দুষ্কর। পটাইবাবু সহধর্মিনী সুরবালার সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর অত্যন্ত পরিচিত জ্যোতিষী ঘনাই শাস্ত্রীর নিকট গেলেন। জ্যোতিষার্ণব ঘনাই শাস্ত্রী পটাইবাবুর কথামত একটি সাদা কাগজে অনেক দাগ কাটলেন, অনেক আঁক কষলেন, তারপর চশমাটি কিঞ্চিত নাকের ডগায় নামিয়ে নিয়ে এসে বললেন, “আসলে আপনার ছেলের এখন কাল-সর্প যোগ চলছে, খুবই মারাত্মক অবস্থা।” শেষের কথা ক’টি এমন ভাবে বললেন যেন অবিনাশ চন্দ্র এখন ভেন্টিলেশনে আছে, কখন কি হয় বলা মুশকিল। একথা শুনে পটাইবাবু ছল ছল চোখে হাতদুটি জোড় করে বললেন, “তাহলে কি উপায় গুরুদেব?” …. গুরুদেব বললেন, “উপায় অবশ্যই আছে, আপনি এত ভেঙ্গে পরবেন না পটাইবাবু, বেশ কিছু যাগ-যজ্ঞ-হোম ইত্যাদির প্রয়োজন। আর সে সবের জন্য কিঞ্চিত খরচ তো হবেই….” পটাইবাবুর এখন এমন অবস্থা যে খরচের কথা চিন্তা করলে হবে না, ছেলেকে মাধ্যমিক পাশ করাতেই হবে, আর তার জন্য দু-চার-পাঁচশো টাকা খরচ হতেই পারে। তাই বললেন, “ঠিক আছে, কত খরচ হবে বলুন আপনি? খরচের জন্য আপনি চিন্তা করবেন না দয়া করে।” ঘনাই গুরুদেব বললেন দেখুন “এমনিতে এই ধরনের যজ্ঞের অনুষ্ঠানে হাজার ত্রিশ টাকা খরচা হয়, কিন্তু আপনি আমার বিশেষ পরিচিত, তাই খরচ-টা অর্ধেক অর্থাৎ পনের হাজার এক টাকা দিলেই হবে।” পনের হাজার টাকার কথা শুনে পটাইবাবু মুখে গোঁ গোঁ করে এক অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ঘনাই শাস্ত্রীর চেম্বারেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। 

অবশ্য চোখে মুখে একটু জলের ছিটে দিতেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এল, সম্বিত ফিরে পেতেই পটাইবাবু উঠে দাঁড়ালেন, এখন পটাইবাবুর কোনক্রমেই দমে গেলে চলবে না…ইয়ে ইজ্জত কা সওয়াল। জ্ঞান ফিরে পেয়েই তাই গুরুদেবকে কোনরকমে বিদায় জানিয়ে জোর কদমে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। 

হটাৎ রাস্তায় একজন বেশ শীর্ণ, অত্যন্ত কালো এবং স্বল্প দৈর্ঘের নেড়া মাথার লোক তাঁর পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “বাবু ভালো আছেন?” প্রথমে তাকে চিনতে না পারলেও, স্মৃতির মনিকোঠায় একটু খোঁচা দিতেই পটাইবাবুর মনে পড়ে গেল, আরে এ তো সহদেব! এলাকার সিঁধেল চোর। সেবার দত্তদের বাড়িতে চুরি করে ধরা পড়ে গণপিটুনিতে মারাই যাচ্ছিল, পটাইবাবুই পাড়ার ছেলেদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। …. “তা তুই এখানে কি করছিস?” … “আজ্ঞে এই গতকালকেই জামিন পেয়েছি, তাই একটু পুরনো পাড়ায় ঘুরতে এলুম।” সহদেবের অকপট স্বীকারোক্তি। “শোন, তোর সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে, চল, চা খাবি ?” বললেন পটাইবাবু। সহদেব অবাক হয়ে ভাবে, এটা পটাইবাবুর কোন ফন্দি ফিকির নয়তো ? কারণ সহদেবের সঙ্গে পটাইবাবুর মত লোকের কিইবা দরকার থাকতে পারে ? তাছাড়া জীবনে এই প্রথম কোন ভদ্রলোক তাকে তার সঙ্গে চায়ের দোকানে চা খেতে যেতে বলছে। যাইহোক যে লোকটি একদিন তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তাঁকে এটুকু বিশ্বাস করা যেতেই পারে ভেবে সহদেব তাঁর সঙ্গ নিল। পটাইবাবু সহদেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে তাকে এক কাপ চা একটা টোস্ট বিস্কুট খাইয়ে তাকে আবার বিড়ি খাওয়ার জন্য দুটো টাকাও দিলেন। তারপর সহদেবও হাসতে হাসতে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বিদায় নিল। 

তীব্র গরম, তারপর আবার অবিনাশ চন্দ্রকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, কদিন রাত্রে ভালো করে ঘুমই হচ্ছিল না। গতকাল প্রথম রাত থেকেই বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, পটাইবাবুর মাঝ রাত্রে বাথরুম যাওয়ার জন্যও ঘুম ভাঙ্গেনি। হটাৎ ভোর রাত্রে চিৎকার চেঁচানিতে ঘুম ভাঙ্গতেই পটাইবাবু ধরফর করে উঠে বসলেন বিছানায়। 

“হায়, হায় এ আমার কি হ’ল ?” চিৎকার করেই চলেছেন সুরবালা দেবী, তার পিছন পিছন অবিনাশ চন্দ্র, মুখে তার কথা বলার ক্ষমতা নেই, মায়ের পিছন পিছন সেও বুক চাপরে চলেছে আর হা হুতাস করে চলেছে। ঘরে ঢুকে সুরবালার প্রথম কথা, “হ্যাঁ গো কাল সদর দরজা ভালো করে বন্ধ করোনি?” 
“কেন কি আবার হ’ল?” শুধান পটাইবাবু।
“আর হ’তে বাকি টা কি আছে?.... মাঝ রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকে আমার অবু সোনার ঘর একদম সাফ করে দিয়েছে, হারমোনিয়াম, গীটার, মিউজিক সিস্টেম সবকিছু নিয়ে গেছে, আহা বেচারার এতদিনের সখের জিনিসগুলো !…. আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল, মাঝ রাত্রে বাথরুম করতে উঠে দেখি, কালো মত নেড়া মাথার রোগা আর ছোটখাটো চেহারার একটা লোক আমাদের বাড়ির সমনে ঘুর ঘুর করছে। হ্যাঁ গো, তা তুমি কি শুয়েই থাকবে, নাকি একটা কিছু করবে?”
“তা চোর কি আমার সম্বন্ধী যে, চুরি করা জিনিসগুলো দেখানোর জন্য আমাকে তার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে গেছে?... যাও যাও মা বেটায় মিলে আর জ্বালিও না, সকাল হতে এখনও দেরী আছে, যাও দরজা বন্ধ করে আবার শুয়ে পরো।” 

মুখে একথা বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন পটাইবাবু আর মনে মনে ভাবলেন… যাক কাল সহদেবের বাড়ি গিয়ে আমার কমিশন পাঁচশোটা টাকা নিয়ে আসতে হবে। আর কথায় বলে চোর পালালে ….. বাড়ে, সামনের বছর নিশ্চই এই বাড়-বাড়ন্ত বুদ্ধি নিয়ে অবু আমার মাধ্যমিকটা উতরে যাবে।

কবিতাঃ সুমন মল্লিক






কবিতাঃ


ইনকিউবাস
সুমন মল্লিক



অনুভূতির ভেতর কোন পরমাণুতে
মন্থিত হয় বুকের চোরাবালি
উঠে আসে চূর্ণ বিচূর্ণ প্রেম
আর বিষবাষ্পে জীবাশ্ম হয়
আমার ভাবনার আকাশ
অতি বিক্ষিপ্ত এই মন তবুও
ঘরভর্তি ছাইয়ের ওপর তৈরী করে নেয়
তোমার ইনকিউবাস

কবিতাঃ শ্রীশুভ্র





কবিতাঃ


ঠিকানা
শ্রীশুভ্র



চৌকাঠ ডিঙানোর ছাড়পত্র পাইনি! কলিং বেলের নরম শরীরে বৈদিক মন্ত্র জপার ইচ্ছেসুতোয় আগুন দিয়ে বসে আছি! প্রেয়সী তোমার বিদগ্ধ চুম্বনের আলসেতে ভর দিয়ে যারা আরাম পোহায়, কিংবা মিছিলের অগ্রভাগে যারা প্রেমের কবিতা পড়ে; তাদের হৃদয়
কিংবা অফুরন্ত সময়! ঠিক আমার মতোন তো নয়!
এ নয় শালবীথির নির্জনে
মোনালিসা হাসির সংলাপ
কিংবা বহুতল রজনীর বাৎসায়ন সিম্ফোনী!
এ নয় আমরণ মঞ্চসজ্জায় বসন্তবিলাপ কিংবা যৌথ বিবৃতির আঁতুরে ডিএনএ বাহিনী!
রঙমহলের হাততালির চৌকাঠে নয়! রংমশালের নীচে অন্ধকার বরং বাসি হয়ে এলে, অমলিন রোদের শিরোনামে আমার দুন্দুভি-
তোমার কানে বাজবে!
নিস্তব্ধ দুপুরের বৈশাখী প্রহর
তোমায় সেদিন, ঠিকই আমার ঠিকানা জানাবে!

কবিতাঃ সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়






কবিতাঃ


ইউথ্যানাসিয়া
সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়






সীমানা শেষের শহরে আলো তরল
কেন জানিনা সেদিনও
মৌতাতের চোখে ফ্যারোসের লাইটহাউস
গড়িয়ে যায় ছড়িয়ে
কেউ ধরবার নাই কেউ
কবে বলেছিল আমি অ্যামনেসিয়া
মনে পড়েনা রাংতা কাগজের ওপর
সুগন্ধী তুমি পুড়েছে
আমার মত … আগাছার মত সবাই





কাছেই কান ঘোরের নার্কোটিকে
আওয়াজ যেন ধাতব চুড়ির কোথাও
সাইরেন দ্বীপের মোহজাল ছিঁড়ে
আঁধারে হাত বাড়িয়েছিল কেউ
কালো কিছুর কানাচে
আমি ভুলতে চাইনি বিশ্বাস ধরো





মন্ডপের দূর থেকে শোরগোল অবহেলায়
হেসেছিল সেই শিশু ক্যালডেরাস
কেন নাচের আসরে ফক্সট্রট আমি
সত্যিই পচে গেছি মৎস্যকন্যা
নৌকা বাইচে রূপকথার হ্যান্স
স্ট্রীটলাইট জ্বলার শব্দে অসহায়
চুড়িদার ছলকে পড়েছিল নরম
ইটালির আঙুরক্ষেত গ্লাসে চুর
সর্পিল নর্তকীর আরবী কোমর
বুভুক্ষার ঠোঁট স্তন নাভি জরায়ু কত কত





টেবিলে নারীশরীর টুকরো টুকরো ভোজবাজি
কাঁড়ি কাঁড়ি দেশ ফলবে সোনায়
অপেরা হাউস ফাটার করতালিতে
চোখের কোণে দু’ফোঁটা পানীয়
ধার দিও ওদের নোনা
ক্যালিপ্সোর পান্তা বিয়েতে না গিয়ে
বনসাই সূত্রেরা বুঝেছিল
মানুষ আজও রক্ত ভালোবাসে
রডোডেনড্রনের লোমশ টেডি বিয়ার
তুইও তো ভালোবাসতিস যখন
হাশিশ ধোঁয়ার আমি থেকে
বেজন্মা কবিতা ঝরে খুব …
খুব …