ছোটগল্পঃ পার্থ ঘোষ





ছোটগল্পঃ


আকাশ বৃষ্টি আর রথযাত্রা
পার্থ ঘোষ

রথের লোহার চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ভালোবাসা। বৃষ্টি দেখছে। তার দু’ চোখের কোল বেয়ে অঝোর ধারায় নেমে আসছে শ্রাবণের বারিধারা। নোনতা জলের স্বাদ ওর ঝাল লাগা পাতলা ঠোঁটে। স্বপ্নালু দুই নয়ন থেকে নিটোল গালের মসৃণতায় পিছলে পড়ে মুক্তোর ন্যায় স্বচ্ছ অশ্রু বিন্দু ফুল – পাখি আঁকা নয়নমনোহর সুতীর ফ্রকটার শুষ্কতাকে ‌আর্দ্র করে তুলছে। কান্না থামার কোন লক্ষণ না দেখে আকাশের চোখে ফুটে উঠছে হতাশা।

আজ রথযাত্রা। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার, তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেঘের গর্জনে ‌এক অন্য রকম পরিস্থিতির সূচনা। ভিজে বাতাস আর ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ মাখা মাদকীয় আবহাওয়ায় ভর করে অতিক্রান্ত দুপুরের নিস্তব্ধতা। এখন বিকেল। অগুণতি মানুষের ভীড়ে, কোলাহলে, পাঁপড় ভাজার গন্ধে, নাগর দোলার যান্ত্রিক শব্দে, ফুচকা-আলুকাবলি-তেলেভাজার লোভনীয় স্বাদে রথযাত্রা জমজমাট।

সারা সকাল, দুপুর ধরে অধীর প্রতীক্ষার শেষে বিকেল হতেই আকাশের হাত ধরে বৃষ্টি বেরিয়ে পড়েছে রথ দেখতে। আনন্দের আতিশয্যে রাস্তায় বেরিয়েই পায়ের গতির সঙ্গে মনের গতির সমতা বজায় রাখতে পারছে না দু’জনে। মন যেন উড়ে যাচ্ছে হাঁটার গতির সঙ্গে তাল না মিলিয়ে পথের বাঁক থেকে বাঁক পেরিয়ে অতি দ্রুত, ঝড়ের বেগে। 

রেল ষ্টেশনকে পেছন‌ে ফেলে পাকা রাস্তা ধরে বাঁ-দিক ডান দিক করে কলেজ ছাড়িয়ে দক্ষিণে এগিয়ে পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ল ওরা মেলার জন অরণ্যে। পাঁপড় ভাজার লোভনীয় গন্ধে জীবে জল এসে গেল ওদের। দোকানীর কাছ থেকে পাঁপড় ভাজা কিনে খেতে খেতে বৃষ্টি আর আকাশ গা ভাসাল ভীড়ের স্রোতে। কয়েক পা যেতেই ফুচকার টকের গন্ধে মন আনচান করে উঠল দুজনের। ওরা ফুচকার দোকান থেকে বেরিয়ে ঘুগনির দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। ঝাল-ঝাল গরম ঘুগনি হুস্-হাস্ শব্দে গলাধঃকরণ করে এক মুখ ঝালের স্বাদ নিয়ে নাগর দোলায় চেপে বসল ওরা। 

বেশ কয়েকবার পাক খাওয়ার পর নাগরদোলা থেকে নেমে আকাশ আর বৃষ্টি খেলনার দোকানে গিয়ে ঢুকল। হরেকরকম খেলনা দর্শন করে উদাস হয়ে গেল ওদের কোমল মন। অনেক বাছাই করে একটা বড়সড় পুতুল পছন্দ করল আকাশ। মার কাছ থেকে নিয়ে আসা টাকার অনেকটাই ওরা খাবার খেয়ে আর নাগরদোলায় চেপে খরচা করেই ফেলেছে; বাকি টাকা দিয়ে পুতুলটা কিনে পঞ্চম বর্ষীয়া বৃষ্টির হাতে তুলে দিল অষ্টম বর্ষীয় ‌আকাশ। 

পুতুলটাকে বুকে আঁকড়ে ধরল বৃষ্টি । তার নিষ্পাপ কোমল মুখে খুশির ছটা লাগল। সেদিকে তাকিয়ে আকাশের মনটা আনন্দে নেচে উঠল। বোনকে যে সে খুব ভালোবাসে, বোনও যে দাদা বলতে অজ্ঞান। 

খেলনার দোকান থেকে বেরিয়ে ‌এসে দুই ভাই বোনে ঠাকুরদালানের দিকে এগোতে লাগল। হঠাৎই হুড়মুড় করে জনতার রশির টানে বিরাট রথটা ওদের সামনে এসে পড়ল। মানুষের বিশাল ভীড়ে, চ‌েঁচামেচি, হুড়োহুড়ি আর জগন্নাথের জয়ধ্বনির মধ্যে কানে এলো কারো শরীরে আঘাত লাগার ফলে ছিটকে বেরিয়ে আসা আর্তনাদ। মহিলাদের চীৎকার, কম বয়সীদের গালিগালাজ সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। সেই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে ‌ঐ ভারী রথটার গড়িয়ে আসা দেখে কিছু মানুষ দৌড়ে সরে গেল নিজেকে বাঁচাতে, ঠিক তখনি ভীড়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বৃষ্টির হাতের সদ্য কেনা পুঁতুলটা ছিটকে গেল রথের চাকার সামনে। অগণিত মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে গেল প্লাস্টিকের সুন্দর পুতুলটা, পরক্ষণেই রথের চাকা গড়িয়ে গেল পুতুলটার পেটের ওপর দিয়ে। রথের চাকায় পিষ্ট হয়ে বিকৃত হয়ে গেল বৃষ্টির আদরের পুতুলটা। বৃষ্টি কেঁদে ফেলল। ওর ছোট্ট নরম হৃদয়ের বাঁধ ভেঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে আসতে লাগল কান্না। 

আকাশ বোনকে নানান ভাবে বোঝাতে লাগল, কান্না বন্ধ করার জন্য। কালকে আবার মার কাছ থেকে টাকা এনে মেলায় এসে পুতুল কিনে দেবে – এমন আশ্বাসও দিল, কিন্তু তাতেও বৃষ্টির চোখের বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখতে পেল না সে।

আস্তে আস্তে ভীড় পাতলা হয়ে গেল। মানুষের জটলা ক্রমশঃ সরে যেতে লাগল রথের সঙ্গে। স্বাভাবিক হয়ে উঠল মেলার পরিবেশ, তবু বৃ‌ষ্টির কান্নার অবসান হ’ল না। দাদাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে এক দৃষ্টিতে থ্যাতলানো কাদা মাকা পুঁতুলটার বিকৃত শরীরের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে চলল। অপারগ, হতাশাগ্রস্থ আকাশ বোনের মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখল। তার শূন্য দৃষ্টি হারিয়ে গেল মেলার মানুষের ভীড়ে। বোনের জন্য তার দুঃখ হ’তে লাগল।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন