ছোটগল্পঃ রুমণী সেন





ছোটগল্পঃ


একটি কৃতদাসীর কাহিনী
রুমণী সেন

আরতির বাবা মেয়ের জন্য অনেক পাত্র দেখার পর অবশেষে এক জায়গায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন। তার স্নেহের ধনটি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যেন কষ্ট না পায়, সে বিষয়ে তিনি খুবই সতর্ক। যে ছেলেকে তিনি পছন্দ করেছেন সে বেশ ধনী আর বিনয়ীও বটে। তার চারটে লরি আছে, অন্য বিজনেসও আছে। নিজের গাড়ি আছে। পড়াশুনা খুব বেশীদূর এগোয় নি, ক্লাস নাইন টেন পর্যন্ত। তা হোক। কৃতী ব্যবসায়ী ছেলে। পড়াশুনার সময়ই বা পেল কোথায়? ছোটবেলা থেকেই তো ব্যবসার জোয়াল ঘাড়ে নিয়েছে। বাবা মা দুজনেই তার ছোটবেলায় মারা গেছে। আর আরতিকেও তো আমি ক্লাস নাইনে ওঠার পর স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছি। 

মেয়েকে বললেন, 

তুই খুব ভাগ্যবতী। অমন ছেলে লাখে একটা দেখা যায়। 

নির্দিষ্ট দিনে ধুমধাম করে আরতির বিয়ে হয়ে গেল। 

বিয়ের পর মাস তিনেক আরতি বাপের বাড়িতেই ছিল। সুরেশ তার পৈতৃক পুরনো বাড়ি বিক্রি করে একটা হাল ফ্যাশনের নতুন বাড়ি করেছিল। বাড়ির মালিক সে আরতিকে বানিয়েছিল। 

স্বামীর ঘরে এসে আরতি বুঝতে পারল, সে যেমনটি ভেবেছিল, যে রঙীন কল্পনার জাল বুনেছিল স্বামীকে নিয়ে, বাস্তবে ঠিক তেমনটা ঘটছে না। স্বামী সুরেশ ব্যবসার কাজে ব্যস্ত, সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। স্বামীকে সে পায় শুধু রাতে শোওয়ার সময়। কিন্তু তাকে কি পাওয়া বলে? 

বিয়ের বারো বছরের মধ্যে আরতি নটা সন্তানের জন্ম দিল। তার মধ্যে একটি মৃত জন্মেছে, আর দুটি শৈশবেই মারা গেছে। তার সন্তানসংখ্যা বর্তমানে ছয়, দুটি ছেলে, চারটি মেয়ে। বিয়ের পর থেকেই সুরেশ তার সঙ্গে বিশেষ ভালো ব্যবহার করে নি। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় একটা গাম্ভীর্যের আবরণ রাখত। মেয়ে মানুষকে বেশী তোল্লাই দিতে নেই, সম্ভবত এটাই তার ধারণা ছিল। কিন্তু ইদানীং সে বেশ খারাপ ব্যবহার শুরু করেছে। আরতি বুঝতে পারে সুরেশ কোন কারণে খুব দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। সে ভাবে ও আমাকে বলে না কেন কি তার সমস্যা? আমি হয়ত সমাধান বের করতেও পারি। 

একদিন সুরেশ দুপুরবেলা অসময়ে বাড়ি ফিরে এল। এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। তাকে দেখে আরতির বুকটা কেমন করে উঠল। নিশ্চয়ই ব্যবসায় কোন কিছু হয়েছে। সে সুরেশের কাছে গেল।

শরীর খারাপ লাগছে? 

না।

কিছু খাবে?

না বিরক্ত কোরো না।

আচ্ছা তোমার কি সমস্যা? আমার মনে হচ্ছে তুমি কোন সমস্যায় পড়েছ, আমাকে বলো না। আমি হয়ত কোন সাহায্যে লাগতে পারি।

সুরেশ গনগনে চোখে আরতির দিকে চেয়ে রইল। তারপর বিকট চিৎকার করে বলল,

যাও এখান থেকে। 

আরতি রান্নাঘরে বসে অনেকক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদল, স্বামীর ব্যবহার দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠেছে। সে তার কাছে খাটাখাটনি করা ও সেক্স করার মেশিন ছাড়া আর কিছু না। উফ্‌, এখান থেকে যদি চলে যেতে পারতাম। কিন্তু কোথায় যাবে। বাপের বাড়ি? সেখানে তো বাবা নেই। তার বিয়ের কয়েকবছর পরই বাবা মারা গেছে। ভাইদের সংসার। ছটা বাচ্চা নিয়ে তাদের ঘাড়ে চাপলে তারাই বা মেনে নেবে কেন? 

সুরেশ একদিন আরতিকে এসে বলল,

তোমার বিয়ের গয়নাগুলো দাও তো।

কেন? কি হবে?

লাগবে। আমি একটু আটকে গেছি। 

কিন্তু ...

কিন্তু কি? আমি একটা সমস্যায় আছি, এখন তুমি গয়না নিয়ে বসে থাকবে? আমার এখন রোজগারপাতি একদম বন্ধ। গয়নাগুলো পেলে ব্যবসায় লাগাব। যাতে তোমাদের গেলাতে পারি।

আমার গয়নার কোন লোভ নেই। কিন্তু চার চারটে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে।

ও সব কথা রাখো। বড়টার বয়স তো এখনও তেরোও হয় নি। ওর বিয়ের জন্য তোমায় ভাবতে হবে না। ওর বাপ আছে না?

আরতি গয়নাগুলো দিয়ে দিল। 

এর পরের কিছু ঘটনাবলী খুব দ্রুত ঘটে গেল। সুরেশের ব্যবসার ভরাডুবি হয়েছিল, কোনভাবেই সামাল দেওয়া গেল না। শেয়ারে টাকা রেখে সে বিপুল লস খেয়েছিল। তার দুটি ট্রাক রোড অ্যাকসিডেন্ট করেছিল, কিছু মানুষ মেরেছিল। ক্রুদ্ধ জনতা ট্রাকদুটি জ্বালিয়ে দেয়। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে ও পুলিসকে ঘুষ দিতে সে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। বাকী দুটি ট্রাক বিক্রি হয়ে যায়, তারপর স্ত্রী গয়না। সুরেশ এখন সম্পূর্ণ কপর্দকশূণ্য। 

এবার সে স্ত্রীকে সব জানাল। আরতির বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেল। প্রথমেই মন হল ছটি সন্তানের কথা। ওদের কি হবে? 

আরতি বাপের বাড়ি গেল। বড়দাকে সব কথা জানাল। বড়দা বলল,

দেখ্‌, আমরা সবাই ছাপোষা মানুষ। নিজের সংসার চালাতেই হিমসিম খেয়ে যাই। তোকে আমি কি করে সাহায্য করি বল দেখি। আচ্ছা ঠিক আছে। এই পাঁচশো টাকা রাখ। আর সুরেশকে বলিস হাতে হাত দিয়ে বসে না থেকে কিছু কাজকর্ম যেন জোটানোর চেষ্টা করে।

আরতি টাকা নিয়ে ফিরে এল। সে বুঝতে পারল, বড়দা একবারই তাকে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়বার গেলে সে কোন সাহায্য পাবে না। 

আরতি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইতে উঠে পড়ে লাগল। ঠোঙা বানানো, ব্লাউজ সেলাই করা, বিড়ি বাঁধা সব কিছুই করতে লাগল। এমন কি রাত জেগেও কাজ করত। ছেলে মেয়েরাও তার কাজে হাত লাগাত। এরপর ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুলও তৈরি করতে শুরু করল। এই কাজে মজুরি কিছু বেশী। ঠোঙা বানানো, বিড়ি বাঁধার মত নয়। 

সুরেশ একটা কাজ জোগাড় করল। কোর্টের মুহুরীর কাজ। খুবই সামান্য রোজগার।

সুরেশ এখন বেশ বিনয়ী হয়েছে। সব সময় দাঁত বের করে কথা বলে। একসময় সে স্বামীর মুখ থেকে মিষ্টি কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত। এখন স্বামী খুবই মিষ্টি কথা বলে, কিন্তু আরতির রাগে গা জ্বলে যায়। 

অনেক কষ্ট করেও আরতি ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা চালিয়ে গেছে, বন্ধ করে নি। 

কয়েক বছর কেটে গেছে। আরতির ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। মেয়েরা বিয়ের যুগ্যি হয়েছে। আরতি অনেক খোঁজ খবর করে বড় মেয়ে শম্পার বিয়ে দিল, এক দাবীহীন পাত্রের সাথে। এবার মেজো মেয়ে স্বপ্না। তারও বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু সোমার বিয়ে কিছুতেই হচ্ছিল না। পাত্রপক্ষরা মেয়েকে পছন্দ করলেও তাদের কিছু দাবী দাওয়াও থাকত। তাই সে কিছুতেই এই মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারছিল না। অবশেষে দুই জামাই এগিয়ে এল সাহায্যে। তারা কিছু খরচপত্র করল, আর আরতির সামান্য সঞ্চয়ের সবটাই বেরিয়ে গেল সোমাকে পাত্রস্থ করতে। এর মধ্যে সুরেশের মৃত্যু হয়েছে। 

আরতি এখনও নিশ্চিন্ত নয়। দুই ছেলেকে নিয়ে চিন্তা নেই। তারা কলকাতায় প্রাইভেট ফার্মে কাজ নিয়েছে। কিন্তু ছোট মেয়ে রুমা? তার কি হবে? 

সে দুই ছেলে অমল আর বিমলকে ডেকে বলল,

তোরা রুমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগ। মেয়েটার বয়স হয়ে যাচ্ছে।

আমরা কি করব? 

আমার হাতে একদম টাকা নেই।

আমারও না।

বোনটার ভবিষ্যৎ দেখবি না? একবার ভাব ওর কি হবে? এটা তো তোদেরই দায়িত্ব।

বিমল গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল,

না, আমাদের কোন দায়িত্ব নেই। তোমরা এতগুলো পয়দা করেছ, আমাদের পারমিশন নিয়ে করেছ যে, এখন দায়িত্ব দেখাচ্ছ?

কি বললি? মেরে মুখ ভেঙে দেব।

হ্যাঁ, তাই তো করবে। আর কি করার আছে? শালাদের কাছে আমরা যেন জন্ম নেওয়ার জন্য হাতজোড় করেছিলাম।

তুই বেরিয়ে যা, এক্ষুনি বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব যাব, কোন্‌ শালা থাকে এই নরকে।

ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা আর বিশেষ এগোল না। 

পরদিন খুব ভোরে বিমল বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তখনও কেউ বিছানা ছেড়ে ওঠে নি। 

আরতি কেঁদে ভাসাল। আমার কথায় সে এত আঘাত পেয়েছে? ওরে ফিরে আয়, আর কখনও কিছু বলব না তোকে। 

কিন্তু পরে জানতে পারল, বিমল কলকাতায় একজন ধনী বিধবা মহিলার সঙ্গে প্রেম করত। তাকে বিয়ে করে তার বাড়িতেই ঘরজামাই হয়ে থাকবে, এমনই ঠিক হয়েছিল। হয়ত আরও দুএকমাস পরে যেত। কিন্তু মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় সে তখনই যাওয়ার একটা ছুতো পেয়ে গেল। 

কিছুদিন পর অমল নিজেও একজনকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এল। রুমাকে নিয়ে আরতির চিন্তার শেষ ছিল না। সে অমলকে বলল,

ভাবছি বাড়িটা বিক্রি করে দেব। তাহলে রুমার বিয়ের খরচটা উঠে আসবে?

বাড়ি বিক্রি করবে মানে? আমরা থাকব কোথায়?

আমি ওসব নিয়ে ভাবছি না। আমার এখন একটাই কাজ রুমার বিয়ে।

তুমি এক মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য আর এক ছেলেকে পথে বসাবে? 

ধরে নে তাই।

ওটা আমার বাবার বাড়ি। আমাদের সবার সমান অধিকার আছে।

বাড়িটা তো আমার নামে।

তুমি এত জঘন্য!

কি করব বল? তোদের দেখেই তো শিখেছি।

আরতি বাড়ি বিক্রির চেষ্টা শুরু করে দিল। 

একদিন অমল এসে বলল, 

তুমি যদি বাড়ি বিক্রিই করো তাহলে আমাকে বিক্রি করো। তার বদলে আমি রুমার বিয়ের ভার নেব। 

আরতি মেয়ে জামাইদের ডেকে পাঠাল। তারা সবাই বলল, 

ঠিক আছে, এতো ভালো কথা। 

আরতি ছেলেকে বাড়ি লিখে দিল। দাম রুমার বিয়ে। খুব সস্তায় বাড়িটা পেল অমল। বাজারে এর চারগুণ দাম হবে বাড়িটার। 

যথাসময়ে রুমারও বিয়ে হয়ে গেল। আরতির তিন জামাইই সরকারী চাকুরে। কিন্তু ছোট জামাই হল ব্যবসায়ী। আরতির মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করতে লাগল। সে ব্যবসায়ীদের পছন্দ করে না। 

আরতির আর কোন কাজ বাকী থাকল না। সব কর্তব্য শেষ। এবার শান্তি। 

কিন্তু সত্যিই কি সে শান্তিতে থাকতে পেরেছিল? ছেলে আর তার বৌয়ের দুর্ব্যবহার, দিন দিন চরমে উঠছিল। এক মুহূর্ত শান্তি ছিল না। মেয়েদের কাছে গেলে তারা বিরক্ত হত। সব চেয়ে বেশী বিরক্ত হত রুমা। একমাত্র মেজো মেয়ে স্বপ্নার কাছেই একটু আদরযত্ন পেত, কিন্তু তার শ্বশুরবাড়িতে এক গাদা লোক। সেখানে গিয়ে মেয়ের ঘাড়ে চাপা তার পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়। আর কোন মেয়েই মাকে শেষ জীবনটা নিজের কাছে রাখতে রাজী নয়। 

এইভাবে কয়েক বছর কেটে গেল। বৃদ্ধ বয়সে ছেলের সংসারে অযত্নে অবহেলায় থেকে অনেক কষ্ট পেয়ে অবশেষে আরতির মৃত্যু হল। তার বয়স তখন ৭৫ বছর। 

আরতির শ্রাদ্ধে আমি গিয়েছিলাম। তার ছেলেমেয়েরা সকলেই আমার পরিচিত। প্রচুর লোকজনকে নিমন্ত্রণ করেছে। খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও ভালো করেছে। আরতির ছয় ছেলেমেয়ে ও তাদের স্বামী/স্ত্রীরা সকলেই একত্র হয়েছে। সবাই সবার সঙ্গে কথা বলছে, গল্প করছে, হাসাহাসি করছে। বেশ একটা আনন্দদায়ক পরিবেশ। অবশ্য অমল মাঝে মাঝে বলছিল, মা চলে গেছে। বড় বটগাছটাই চলে গেছে। 

অমলের শোয়ার ঘরে তার মায়ের এনলার্জ করা একটা বড় বাঁধান ফটো দেখলাম, টেবিলের উপর রাখা। ফটোতে ফুলের মালা চড়ানো হয়েছে। আমি তার মুখটা দেখলাম। বেঁচে থাকতে তাকে কখনও এভাবে দেখি নি। ফটোটা সাদা কালো। অনেক পুরনো হলেও এখনও চমৎকার রয়েছে। আরতির গায়ে হলুদের সময় তোলা। ছিপছিপে, সুন্দর কমনীয় চেহারা। আটপৌরে ভাবে পরা শাড়ির উপর নতুন গামছা জড়ানো। গলায় সোনার হার। উজ্জ্বল দুটো চোখ। চোখে মুখে হাসি। খুশীতে উচ্ছল। আমি দেখতেই থাকলাম। প্রায়শই দেখা যায় ছেলেমেয়েরা মৃত বাবা মায়ের সাম্প্রতিক ফটো টাঙায় না। মা কি ছিলেন সেটাই হয়ত দেখাতে চায়। মা কি হইয়াছেন, সেটা দেখাতে চায় না। 

আমি খানিকক্ষণ তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম, তার আত্মার শান্তি কামনা করলাম। তার পর বাড়ি ফিরে এলাম।


1 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৯ জুলাই, ২০১৪ এ ৮:১০ PM


    রূমনী সেনের ছোট গল্প 'একটি কৃতদাসীর কাহিনী' পড়ে মেয়েদের যুগসঞ্চিত যন্ত্রনার অপরিবর্তনীয়তার কথা জেনে মন অসহায় এক যন্ত্রনায় কষ্ট পায় । কিন্তু এই সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত মানসিকতার অভাব এই সমস্যা থেকে বেরোতে দেয় না ।
    রুমণী সেন তাঁর শক্তিশালী কলমে যথাযথ ভাবে সেই অসহায়তার এক এপিক লিখে গেছেন বড়ো নিরপেক্ষ হয়ে

    উত্তরমুছুন