জানেন কি? সবজান্তা

















জানেন কি?

তাজমহল
সবজান্তা 


তাজমহল। ভালোবাসার অনন্য প্রতীক। মধ্যযুগীয় সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম একটি। বিশ্ববাসী তাজমহলকে এক পলক দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। তাজমহল যেমন সবাইকে এর শৈল্পিকতায় বিমুগ্ধ করে, তেমনি এটি তৈরির ইতিহাসও পৃথিবী বিখ্যাত। 


তাজমহলের সর্বজন স্বীকৃত ইতিহাস হল, মুঘল বাদশা জাহাঙ্গীর পুত্র সম্রাট শাহজাহানের ৩য় প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৬৩১ সালে ১৪তম সন্তান গওহারা বেগমকে জন্মদানকালে মৃত্যুবরণ করেন। শাহজাহান স্ত্রী বিয়োগে শোকাতুর হয়ে পড়েন এবং মমতাজের প্রতি তার ভালোবাসার নিদর্শন পৃথিবীবাসীর কাছে অমর করে রাখতে তিনি প্রিয় বেগম মমতাজের সমাধিস্থলে তাজমহল তৈরি করেন। 


১৬৩২ সালেই যমুনা নদীর তীরে শুরু হয় তাজমহল তৈরির কাজ। তাজমহলের নির্মাণশৈলী ও এর উপকরণ থেকে বোঝা যায় তৎকালে পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যয়বহুল প্রাসাদ এটি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে সাদা মার্বেল পাথর ও অত্যন্ত মূল্যবান কিছু দুর্লভ পাথর। তাজমহলের বিভিন্ন দেয়াল ও গম্বুজের নকশায় এবং কারুকাজে ফুটে ওঠে মুসলিম মুঘল, পারস্য ও তুর্কি স্থাপত্যের চিহ্ন। এর প্রধান নকশাকার ছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহুরি। আরও ছিলেন আবদুল করিম মামুর খান এবং মাকরামাত খান, যারা সে সময়ের সবচেয়ে নিখুঁত, পারদর্শী ও উচ্চ পর্যায়ের প্রকৌশলী এবং নকশাকার ছিলেন। এছাড়া তাজমহলের বিখ্যাত ক্যালিওগ্রাফিগুলো করেছিলেন তৎকালের ক্যালিওগ্রাফার আবদুল হক, যার প্রশংসনীয় ক্যলিওগ্রাফি দেখে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট নিজেই তাকে ‘আমানত খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাজমহলে পবিত্র আল-কোরআনের ১৫টি সূরা লিপিবদ্ধ হয়েছে। কয়েক হাজার শিল্পী দিয়ে পুরো তাজমহল তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় ২২ বছর। অর্থাৎ ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ সাল পর্যন্ত। যদিও ১৬৪৮ সালেই এর কাজ শেষ হয়ে যায়, তবে বাইরের বাগান, গেট এবং এর চারপাশের অন্যান্য স্থাপনা তৈরি শেষ করতে আর ৫ বছর সময় অতিবাহিত হয়েছিল। মোটকথা তাজমহলের ইতিহাস ও এর গঠন, নির্মাণশৈলী থেকে বিশ্ববাসী মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের অমর প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই জেনে আসছে। 


কিন্তু ভালোবাসার এ বিমূর্ত শিল্পকলা তাজমহলের ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন প্রফেসর পি. এন. অক তার ‘তাজমহল : দ্য ট্রু স্টরি’তে । তিনি দাবি করেন, তাজমহল বেগম মমতাজের সম্মানে নির্মিত কোন প্রেমের সমাধিস্থল নয়, বরং এটি প্রাচীন হিন্দু দেবতা শিবের মন্দির। এ মন্দিরের নাম ছিল ‘তেজ মহালয়’। এই মন্দিরে আগ্রার রাজপুতরা পূজা-অর্চনা করত, তাই সাধারণের কাছে এ মন্দির অতটা পরিচিত ছিল না। আর ‘তেজ মহালয়’ থেকেই তাজমহলের নামকরণ। এটি পরে সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রীর স্মরণে স্মৃতিশালা হিসেবে গড়ে তোলেন। 


ইতিহাস অনুসন্ধান করে প্রফেসর অক যে পিলে চমকানো কথাগুলো ব্যক্ত করেন তা হল, সম্রাট শাহজাহান অন্যায়ভাবে জয়পুরের মহারাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে শিব মন্দিরটি অর্থাৎ তাজমহলটি দখল করে নেন। অক যে দলিল উপস্থাপন করেন, সম্রাট শাহজাহান নিজেই তার দিনপঞ্জি ‘বাদশাহনামা’তে উল্লেখ করে গেছেন, রাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে আগ্রার এক চমৎকার প্রাসাদোপম ভবন মমতাজ মহলের সমাধিস্থলের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে এবং এর জন্য সম্রাটের পক্ষ থেকে রাজা জয় সিংকে অন্যত্র জমিও কিনে দেয়া হয়েছে। 


‘তাজমহলের’ নাম নিয়েও প্রফেসর অক সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মুঘলামলে এমনকি খোদ শাহজাহানের আমলেও কোন দলিলাদি ও কোর্টের নথিপত্রে কোথাও ‘তাজমহলের’ নাম উল্লেখ নেই। আর সে সময়ে মুসলিম শাসনামলে কোন ভবন বা প্রাসাদের নাম ‘মহল’ রাখার প্রচলন ছিল না। 


এছাড়া ‘তাজমহল’ নামটি এসেছে মমতাজ মহল থেকে, এ বিষয়টিও প্রফেসর অক মেনে নেননি। তিনি এর পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেন। প্রথম কারণ, সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রীর প্রকৃত নাম কখনোই মমতাজ ছিল না। দ্বিতীয় কারণ, সাইকোলজিক্যাললি কেউ কারও নামে প্রাসাদ নির্মাণ করলে নামের প্রথম দুই অক্ষর বাদ দিয়ে অর্থাৎ মমতাজের ‘মম’ বাদ দিয়ে ‘তাজ’ নাম রাখাটা মানব স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। 


নামকরণের ইতিহাসকে ভুল প্রমাণিত করেই প্রফেসর থেমে থাকেননি, তিনি শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমকাহিনীর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তার লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, মমতাজ ও শাহজাহনের ভালোবাসার গল্প মূলত রূপকথা যা লোকমুখে সৃষ্ট। কারণ এত গভীর ও চমৎকার প্রেমের কথা ভারতের ওই সময়কার কোন সরকারি নথিপত্রে বা গ্রন্থে উল্লেখ নেই। 


তিনি আরও কিছু ডকুমেন্টরি উপস্থাপন করেন যা প্রমাণ করে তাজমহল কখনোই সম্রাট শাহজাহানের আমলের নয়। সেগুলো হল, নিউইয়র্কের আর্কিওলজিস্ট মারভিন মিলার যমুনা নদীর তীর সংলগ্ন তাজমহলের দেয়ালের নমুনা পরীক্ষা করেন। তিনি এর কার্বন টেস্ট করে যে তথ্য পান, এই কার্বন সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলেরও চেয়ে ৩০০ বছর বেশি পুরনো! 


এছাড়া আরেকটি ব্যাপার হল কোন এক ইউরোপীয়ান পর্যটক ১৬৩৮ সালে আগ্রা ভ্রমণ করেন। সময়টি শাহজাহান স্ত্রী মমতাজের মারা যাওয়ার মাত্র ৭ বছর পর। কিন্তু তিনি তার লিখিত ভারতবর্ষ ভ্রমণ গ্রন্থে তাজমহল নামক প্রাসাদের বা তাজমহল নির্মাণের মতো বিপুল কর্মযজ্ঞের কোনও উল্লেখ করেননি। 


প্রফেসর অক তাজমহলের স্থাপত্য শৈলীর কিছু অসামঞ্জস্যতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তাজমহল মূলত হিন্দু শিব মন্দির ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি আরও যুক্তি দেখান, তাজমহলের কিছু কামরা শাহজাহানের আমল হতেই তালাবন্দি যা এখনও জনসাধারণের অজানা রয়ে আছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন, ওই সব কামরার একটাতে রয়েছে দেবতা শিবের মস্তকবিহীন মূর্তি অর্থাৎ শিব লিঙ্গ, যা হিন্দুদের শিব মন্দিরে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। 


পরে বিখ্যাত তাজমহল নিয়ে প্রফেসর অকের প্রচলিত ইতিহাস বিরোধী বক্তব্য এবং তার বই বিশ্লেষণে গবেষকরা এতটুকু মত দিতে পেরেছেন, তাজমহলের মার্বেল পাথর, ইসলামিক সংস্কৃতি, আলকোরআনের আয়াত ক্যালিওগ্রাফি এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত গমু্বজের কারুকাজ এসব কিছুই সম্রাট শাহজাহানের সময়ে হয়ে থাকলেও তাজমহলের প্রাথমিক স্থাপনা শাহজাহান কর্তৃক না হয়েও থাকতে পারে। 


তবে তাজমহল তৈরির আসল ইতিহাস যতই বির্তকিত হয়ে থাকুক, তবু তাজমহল মুঘল মুসলিম স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে গৌরবান্বিত অলঙ্কার, একটি অনন্য কীর্তি, এ কথা অনস্বীকার্য।


সংগ্রহঃ Internet


2 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল৯ জুলাই, ২০১৪ এ ৮:২৯ PM

    তাজমহল নিয়ে একটি মনোজ্ঞ রচনা লিখেছেন সবজান্তা । খুব সুন্দর ভাবে বিধৃত হয়েছে তথ্যগুলি !
    ভালো লাগল বেশ।

    উত্তরমুছুন