প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

















প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ


ভারতের রাজপুত্র স্বামী বিবেকানন্দ
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায় , গার্লল্যান্ড , টেক্সাস 



“পথ হতে গেঁথে এনেছি সিক্তযূথীর মালা, সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা-” 

আমরা অনেক কিছু জানি বা অনেক কিছু জানি না -এই দুই মতের বিরুদ্ধে গেলে একশত ভাগের দশ ভাগ হয়ত আমরা তাঁর সম্বন্ধে জানতে পেরেছি, বা জানবার চেষ্টা করেছি তাই না? 

তিনিই একজন ভারতীয় যিনি শুধু ধর্মই প্রচার করেন নি, তিনি আমাদের রীতি নীতি আচার ব্যাবহারের বৈশিষ্ঠ ও ঐতিহ্য তুলে ধরেছিলেন প্রাশ্চাত্যের বিভিন্ন মানুষের সামনে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তিনি কি খাদ্যও প্রচার করেছিলেন? অথবা তিনি কি খাদ্যরসিক ছিলেন? 

আমার স্বল্প জ্ঞানে তা হলোঃ তিনি প্রাশ্চাত্যে বেদান্ত এবং বিরিয়ানী তার সাথে চা-এর প্রচার করেছিলেন। চা যে শরীরের পক্ষে উপকারী তা তিনি স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ভালবাসতেন জিঘেবাগাস, সুইটমিট এবং খিচুড়ি, নলেন গুড়ের সন্দেশ, শুক্তো, মোচার ডালনা, ইলিশ মাছ, চকলেট আইসক্রিম, ভারতীয় পালং শাক ও পুঁইশাকের চচ্চড়ি, ছোলার ডালের সাথে গরম লুচি, চানাচুর, জীবে গজা, ঝাল করে রান্না ঝিনুক। তাঁর কথায় আমরা জানতে পারিঃ 

“তোমরা অন্যদের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রচার করে বেড়াও, কিন্তু তাদের সুখাদ্য দিতে পারো না। গত চার বছর ধরে আমি এই সমস্যাটি নিয়ে ভাবছি। গম থেকে এক ধরণের মোটা চাল তৈরিই করা যায় কিনা সে বিষয়ে নিরীক্ষা করার ইচ্ছে আছে। পানীয় জলের ক্ষেত্রে, আমাদের দেশে লাগে- এমন একটি বিশোষক যন্ত্রের খোঁজ করেছি। আমি একটি বাটির মত চীনামাটির পাত্র দেখেছিলাম আর তার মধ্য দিয়ে জল নিষ্কাশন করা হচ্ছে ও জীবাণুগুলি সেই বাটিতে রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রমে ঐ জল -বিশোষক বাটিটিই সমস্ত জীবাণুর কেন্দ্রস্থল হয়ে যাবে। সকল বিশোষক যন্ত্রের ক্ষেত্রেই একই বিপদ। অনেক অনুসন্ধানের পর আমি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করি জল পরিশোধনের পর অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতির প্রয়োগে জল এত বিশুদ্ধ হচ্ছে যে নিঃসন্দেহে সেই জলের ব্যবহারে স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব।” 

খেতরি বাসকালে একটি সভায় ব্যবহারিক ভারতীয় জীবনে হিন্দুধর্মের শোচনীয় অবস্থা দেখে তিনি ব্যথিত হন। এই প্রসংগে তিনি বলেন- “ আমরা হিন্দু নই, আমরা বৈ্দান্তিক ও নই-আমরা ছুঁৎমার্গীর দল। রান্না ঘর হল আমাদের মন্দির, ভাতের হাঁড়ি উপাস্য দেবতা আর দুখানা মন্ত্র'- সমাজের এই অন্ধ কুসংস্কার সত্বর দূর করা প্রয়োজন।”

মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠার আগে কম বয়সী নরেনের সাংঘঠনিক শক্তির প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছে এই রান্নার ক্ষেত্রেই। নরনারায়নের সেবার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে এক অভাবনীয় প্রতিষ্ঠান 'গ্রিডি ক্লাব' সংগঠন, যার বাংলা মহেন্দ্রনাথ করেছেন “পেটুক সঙ্ঘ'। উদ্দেশ্য ছিল- কেবল ভোজ়ন নয়, সেই সঙ্গে রান্না নিয়ে রীতিমত রিসার্চ। প্রতিষ্ঠার দৃষ্টি সারা বিশ্বের দিকে প্রসারিত। ভবিষ্যতের বিশ্ববিবেক এই সময় পুরনো বইওয়ালার কাছ থেকে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত ফেঞ্চ রান্নার বই কিনতে আরম্ভ করেছেন। যে ফরাসী জাত অর্ধসভ্য ইউরোপকে ভদ্রভাবে রান্না বান্না করে খেতেদেতে শিখিয়েছে, যে ফরাসীজাত ও সভ্যতার গুণগানে সন্নাসী বিবেকানন্দ একদিন মুখর হয়েছিলেন, তার আদিতে কমবয়সের -ফ্রেঞ্চকুকিং- এর সাধনা। 

~ আবিষ্কার ~ হাঁসের ডিম খুব ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে কড়াইশুঁটি ও আলু দিয়ে ভুনি-খিচুড়ি। পলোয়ার চেয়ে এই রান্না যে অনেক উপাদেয় বহু বছর পরেও বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন। বাবা রাঁধতেন কালিয়া এবং পলোয়া, আর সুযোগ্যপুত্র আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে নতুন ডিশের মাধ্যমে পূর্বপশ্চিমকে একাকার করে দিলেন। প্যারিস রাজধানীর একটি বিখ্যাত স্যুপ-এর রেসিপি তিনি দিয়েছিলেনঃ “কচি কলাইশুটি খুব সিদ্ধ করে, তারপর তাকে পিষে জলের সাথে মিশিয়ে ফেল। একটা দুধ ছাঁকনির মতো তারের ছাঁকনিতে ছাঁকলেই খোসাগুলো বেরিয়ে আসবে। এখন হলুদ, ধনে, জি্রে, মরিচ, লঙ্কা, যা দেবার দিয়ে সাঁতলে নাও-উত্তম সুস্বাদু সুপাচ্য ডাল হল। যদি পাঁঠার মুড়ি বা মাছের মুড়ি তার সংগে থাকে তো উপাদেয় হয়।” তাঁর সব কথার মধ্যেই দেখতে পাই সব কিছুর তুলনা করা হয়েছে কিছু না কিছু খাদ্য জাতীয় শব্দের মাধ্যমে। এইভাবে কি সুন্দর ভাবে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন আপামর বিদেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে, আর আমাদের হিন্দুধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

তাঁর সমস্ত চিঠিপত্র খুঁটিয়ে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় -

(মিঃ ই.টি.শটার্ডিকে লেখা)- 
“আমার প্রতি খুবই দয়াপরবশ হয়ে জাহাজের পার্সার আমাকে একলা একটি কেবিন ছেড়ে দিয়েছেন। খাবার নিয়েই যা একমাত্র অসুবিধা- মাংস আর মাংস। কেবল মাংস। আজ অবশ্য কিছু সবজী দেবে কথা দিয়েছে।” 

(মিস মেরী হ্যালেকে লেখা)-
“আমি একটা আলপিন নই যে শস্যের বোঝার নীচে হারিয়ে যাব। কাল রাত্রিবেলা আমি একটি খাবার তৈ্রী করেছিলাম। জাফরান, ল্যাভেন্ডার, জৈত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারুচিনি, লবং, এলাচ, ক্রীম, লাইমজুস। পিঁয়াজ, মনাক্কা, বাদাম, মরিচ এবং চাল- সব মিলিয়ে কী উপাদেয় পাঁচমিশালী, নিজেও একটু খেতে পারি নি। হিঙ্গ অবশ্য ছিল না, থাকলে গিলবার পক্ষে সুবিধা হত যদিও”।

এর থেকে বোঝা যায় তিনি গরম মশলাও কিভাবে করে-বিদেশীদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। 


২ 

তাঁর এই অসাধারণ বক্তব্যে আমরা কিছুটা আঁচ করি যে আমরা যে লোভী তার সমাধানের পথ ও তিনি বলে দিয়ে গেছেন- 
“একটি দম্পতির কথা জানি, স্বামী স্ত্রীরূপে পরিণত হবার পক্ষে তদের সব কিছুই অনুকূল ছিল, শুধু কনের বাবা এই বলে হেঁকে বসলেন, যে পাত্র অন্ততঃ দশলাখপতি না হবে তাকে তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন না। ছেলেটি আর মেয়েটি নৈরাশ্যে ভেঙে পড়ে, এমন সময় দেখা দিল এক চতুর ঘটক। সে বরকে গিয়ে বল্লে দশ লাখের বদলে সে তার নাকটি দিতে প্রস্তুত কিনা। বর বললে, না। কনের বাবার কাছে গিয়ে তখন ঘটক বললে, এমন সব জিনিসের মজুত আছে তার মূল্য কয়েক কোটি; বিবাহ পাকা হয়ে গেল! তুমি যেন এরকম 'কোটি' গ্রহণ কোরো না। 

তাহলেই দেখো, তুমিও লাখপতি জোগাড় করতে পারলে না, আমিও টাকা পেলুম না। অতএব আমার দুশ্চিন্তা হল প্রচুর। বহু পরিশ্রম করতে হল বৃথাই; তাই রোগে ধরল। আমার মতো মগজ চাই আসল কারণ খুঁজে বার করতে -নিজের প্রতি নিজেই মোহিত হয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা ঘটেছে এই দক্ষিণ ভারতেই; লন্ডন থেকে ফিরবার পর এখানকার লোকেরা আমাকে প্রচুর খাওয়াতে লাগল, ভোজ দিতে লাগল আর আমার কাছ থেকে যত পারে কাজ আদায় করে নিতে লাগল। আমরা সাত সমুদ্রে বিশ্বাস করি-এক দুধের সাগর, এক মধুর, এক দধির, এক সুরায়, এক আখের রসের, এক লবণের, আর একটা যেন কী ভুলে গেছি।” 

(স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা)-
“দেখতেই পাচ্ছো এখন আমি যাত্রাপথে। কলকাতায় কমলালেবু পাওয়া গেলে শ'খানেক মাদ্রাজে আলাসিঙ্গার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ো, যাতে মাদ্রাজে পৌঁছে আমি তা পাই। তুমি সমালোচনা বন্ধ করেছো; তা নইলে এর মধ্যে আরো ঠান্ডা কোনো যায়গায় চলে যেতাম-আর কিছু না হলেও মজা করার জন্য। তুমি কি সত্যি ওসব মূর্খের কথা শুনে চলো? এ যেন আমাকে তোমার কলাই ডাল খেতে না দেওয়া-ওতে শ্বেতসার আছে বলে! আরো কত -ভাত বা রুটি সেঁকে নিয়ে খেলে নাকি শ্বে্তসার থাকবে না! কি অসাধারণ জ্ঞান বৎস। রাত্রির খাবার টা খুব হালকা করে নেব ভাবছি । সকালে দুপুরে পেট বোঝাই করে খাব। রাতে শুধু দুধ , ফল ইত্যাদি। তাই তো এই ফল বাগিচায় আছি “ফলের আশায়”! বুঝতে পারো না?”
-কি অদ্ভুত তুলনা। 

তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে আমরা জানতে পারি এত ব্যস্ততা সত্বেও তিনি কিভাবে সবার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আমাদের শিখিয়ে গেছেন কিভাবে অন্য কাজকর্মের সাথেও খাদ্য-এর প্রয়োজনীয়তা আমাদের শরীরে ও মনে। 

(মারী হালবয়স্টারকে লেখা)- 
“ইউরোপে যাওয়া মানেই ত কাজ, তাই নয়? না কাজ, না রুটি। এখানে হলদে কাপড় যথেষ্ট, খাদ্যও পাব পর্য্যপ্ত। যেভাবেই হোক বহু আকাঙ্খিত বিশ্রামটি পাচ্ছি, আশা করি তা আমার শরীরের পক্ষে ভালো হবে। বেশ কয়েকটা বছরের জন্য ভালো রকমের বিশ্রাম, কোনো কাজ নয়-এরকমটা ইচ্ছে করে না তোমার? ঘুম আর খাওয়া আর ব্যায়াম; ব্যায়াম, খাওয়া আর ঘুম-আরো কয়েকমাস আমার এই রকমই চলবে। 

খুব ঘোড়ায় চাপা এবং ব্যায়াম চালিয়েছি , কিন্তু ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপ্সন অনুসারে প্রচুর মাখন তোলা দুধ খেতে হয়েছে, ফলে পিঠের চেয়ে পেট মোটা হয়েছে বেশী। সামনের দিকটা আমার বরাবরই কিছু বেশী কিন্তু এক্ষুনি আর তা বাড়াতে চাই না-তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তোমার আহারে রুচি এসেছে জেনে খুব খুশী হলাম। হ্যাঁ ভালো কথা, আমি দারুণ খুশী -অতি তাড়াতাড়ি বুড়ো হচ্ছি, চুল পাকতে লেগেছে। “সোনালীর মধ্যে রুপোলী সূত্র”- মানে কালোর মধ্যে আর কি- দ্রুত বাড়ছে। ধর্ম্প্রচারকদের পক্ষে যুবাপুরুষ হওয়া ভালো নয় , তাই না? আমার তো তাই মনে হয়, সর্বদাই মনে হয়েছে। বৃ্দ্ধদের ওপর লোকের বিশ্বাস বেশি হয়, আর অনেক বেশী শ্রদ্ধাস্পদ লাগে। তথাপি বুড়ো বদমায়েসরাই দুনিয়ায় সব চেয়ে বড় বজ্জাত, তাই নয়?”



অসাধারণ মজার মানুষ ছিলেন আমাদের রাজপুত্র বিবেক ও আনন্দ। বিদেশে তাঁকে অনেক নামে ডাকা হতো তার মধ্যে বিবেক ও আনন্দ নামটাই বেশি পরিচিত ছিল সবার কাছে। 

(সিস্টার নিবেদিতাকে লেখা)- 
“আমি দুর্বিক্ষের মোকাবিলায় খুব ব্যস্ত; আগামী দিনের কাজের জন্য কয়েকটি ছেলেকে শিক্ষাদান ছাড়া ট্রেনিং-এর কাজে আর বেশি পরিশ্রম দিতে পারছি না। “খাওয়ানোর কাজটাতেই” আমার সব শক্তি এবং সম্বল শুষে নিচ্ছে।” 

(মিসেস ওলি বুলকে লেখা)- 
“জো একজন মহিলা চিকিৎসক খুঁজে বার করেছে, তিনি সম্মোহনী চিকিৎসা করে থাকেন। আমরা দুজনেই তাঁর চিকিৎসাধীন। জো-র ধারণা-তিনি আমাকে বেশ চাঙ্গা করে তুলেছেন। আর বলছে, তার নিজের ওপর অলৌ্কিক ফল ফলছে। সম্মোহনী চিকিৎসার ফলে হোক, ক্যালিফোর্নীয়ার ওজনের গুণে হোক, কিংবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার দরুনই হোক, আমি সেরে উঠছি। রাতে পেটভরা খাবার পরেও তিন মাইল হাঁটতে পারা একটা মস্ত ব্যাপার।”

- তিনি বোঝাতে চেয়েছেন শুধু কাজ করলেই হবে না, শরীরে রক্ত চলাচল সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। - 

“আমাদের অন্যান্য জাতের কাছে অনেক শেখবার আছে। বলি- খাওয়া তো সব দেশেই এক; তবে আমরা পা গুটিয়ে বসে খাই, বিলাতিরা পা ঝুলিয়ে বসে খায়। এখন মনে কর যে, আমি এদের রকমের রান্না খাওয়া খাচ্ছি, তা বলে কি এদের মতো ঠ্যাং ঝুলিয়ে থাকতে হবে? আমার ঠ্যাং যে যমের বাড়ী যাবার দাখিলে পড়ে-টনটনানিতে যে প্রাণ যায়, তার কি? কাজেই পা গুটিয়ে, এদের খাওয়া খাব বইকি। ঐ রকম বিদেশী যা কিছু শিখতে হবে, সেটা আমাদের মতো করে -পা গুটিয়ে আসল জাতীয় চরিত্রটি বজায় রেখে। বলি কাপড়ে কি মানুষ হয়, না মানুষে কাপড় পরে? শক্তিমান পুরুষ যে পোশাকই পরুক না কেন, লোকে মানে; আর আমার মতো আহাম্মক ধোপার বস্তা ঘাড়ে করে বেড়ালেও লোকে গ্রাহ্য করে না। 

তবে দু-দেশ তুলনা করা সোজা হবে, এই ভণিতার পর। এরাও ভাল, আমরাও ভাল। ‘কাকো নিন্দো, কাকো বন্দো, দুয়ো পাল্লা ভারি।' তবে ভালোর রকমারি আছে, এইমাত্র।” 

“প্রিন্স ইন্ডিয়ান” কি ভাবে সরলরেখায় দু-দেশ কে এক জায়গায় এনেছেন তা আমাদের চোখে সত্যি ই অভাবনীয়। আবার রাঁধুনী-কেও কিন্তু বাদ দেন নি। এমনই মজাদার ছিলেন তিনি। আমরা অন্য দেশের খারাপগুলো আগে অনুকরণ করার চেষ্টা করি, কিন্তু নিজেদের দেশের ভালোগুলো বয়কট করি। কারণ , আমরা ভীষণ অনুকরণপ্রিয়। 

“বারে ফিরে ফিরে তোমার পানে দিবারাতি ঢেউয়ের মতো চিত্ত বাহু হানে...।” 

-তিনি আবার বলেছেন, 
“আমাদের রান্নার মতো পরিষ্কার কোথাও নেই। বিলেতি খাওয়ার শৃঙখ্লার মতো পরিষ্কার পদ্ধতি আমাদের নেই। আমাদের রাঁধুনি স্নান করেছে, কাপড় বদলেছে; হাঁড়িপত্র, উনুন-সব ধুয়ে মেজে সাফ করেছে; নাকে মুখে গায়ে হাত ঠেকলে তখনি হাত ধুয়ে তবে আবার খাদ্যদ্রব্যে হাত দিচ্ছে। বিলাতি রাঁধুনির চৌদ্দপুরুষে কেউ স্নান করেনি; রাঁধতে রাঁধতে চাখছে, আবার সেই চামচ হাঁড়িতে ডোবাচ্ছে। 

-রুমাল বার করে ফোঁৎ করে নাক ঝাড়লে, আর সেই হাতে ময়দা মাখলে। শৌচ থেকে এল-কাগজ ব্যবহার করে, সে হাত ধোবার নামটিও নেই-সেই হাতে রাঁধতে লাগলো। কিন্তু ধপধপে কাপড় আর টুপি পরেছে। হয়ত একটা মস্ত কাঠের টবের মধ্যে দুটো মানুষ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রাশীকৃত ময়দার উপর নাচছে-কি না ময়দা মাখা হচ্ছে। গরমি কাল-দরবিগলিত ঘাম পা বেয়ে সেই ময়দায় সেঁধুচ্ছে। তার পর তার রুটি তৈয়ার যখন হল, তখন দুগ্ধফেননিভ তোয়ালের উপর চীনের বাসনে সজ্জিত হয়ে পরিষ্কার চাদর বিছানো টেবিলের উপর, পরিষ্কার কাপড় পরা কনুই পর্যন্ত সাদা দস্তানা পরা চাকর এনে সামনে ধরলে! 

কোনও জিনিস হাত দিয়ে পাছে ছুঁতে হয়, তাই কনুই পর্যন্ত দস্তানা। 

আমাদের স্নান করা বামুন, পরিষ্কার হাঁড়িতে, শুদ্ধ হয়ে রেঁধে গোময়সিক্ত মাটির উপর থালশুদ্ধ অন্নব্যঞ্জন ঝাড়লে; বামুনের কাপড়ে খামছে ময়লা উঠছে। হয়তো মাটি ময়লা গোবর আর ঝোল কলাপাতা ছেঁড়ার দরুণ একাকার হয়ে এক অপূর্ব আস্বাদ উপস্থিত করলে !! চাই কি? --- পরিষ্কার শরীরে পরিষ্কার কাপড় পরা। মুখ ধোয়া দাঁতমাজা-সব চাই, কিন্তু গোপনে। পরিষ্কার রাঁধুনি, পরিষ্কার হাতের রান্না চাই। আবার পরিষ্কার মনোরম স্থানে পরিষ্কার পাত্রে খাওয়া চাই--'আচারঃ প্রথমো ধর্মঃ' । এত ওলাউঠা, এত মহামারী, ম্যালেরিয়া-কার দোষ? আমাদের দোষ। আমরা মহা অনাচারী!!!!” 


৪ 

স্বামীজী আমিষ খাওয়া বেশি পছন্দ করতেন- নানা উদাহরণ সহ আমরা জানতে পারি । তিনি একজন খ্যাতনামা রাঁধুনী ও ছিলেন। নানা অকেশনে তিনি মাটন পুলাও রান্না করতেন তাঁর শিষ্যদের বাড়িতে। বেলুড় মঠে একদিন এক ভক্ত আসেন মাংস নিয়ে নিজের গুরুদেবের জন্য। সব চেয়ে বেশী মজার কথা হলো তিনি যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমনি রান্না করতেও ভালবাসতেন। এবং তাঁর প্যাশন ছিল নানা রকম চা এর। তিনি ভেজিটেরিয়ান ছিলেন না মোটেই, শুধু মাছ না- মাংস-এ মধ্যে গরুর মাংস ও বাদ দিতেন না। 

তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে কোলকাতায় গুরুভাইদের লিখেছিলেন যে, 

“এখন তোমরা অনেক ইলিশ খাচ্ছো তোমাদের ইচ্ছামত-এখানে অনেকরকমের শাক যেগুলো খেতে nate এর মত আর তারা বলে -'এ্যস্প্যারাগাস' অনেকটা ঠিক ছোট কচি dengo-এর মত খেতে”। 

তাঁর কথায়ঃ 

“খাদ্য শুধু পেট ভরানোর জন্যই নয় শারীরিক শক্তি যোগানোর পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শক্তির সম্পূরকই হলো সু-খাদ্য”।

তিনি গরম খাবার পছন্দ করতেন, তা বেলুড় মঠে গেলে এখনও বোঝা যায় যে, ইন্সটিটিউশন-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমাদের প্রবাদপুরুষ স্বামীজী। 

খেতে খুব ভালবাসতেন, কিন্তু জীবনের শেষ দিকে ২১ দিন ভালো খাওয়া তো দূরের কথা, জল পর্যন্ত না খেয়ে কাটাতে হয়েছে, কবিরাজের অনুরোধে। 

নরেন তাদের পাড়ায় স্থাপন করেছিলেন greedy club, যাদের মূল motto ছিল ভোজন ও নানা দেশের রান্না নিয়ে রিসার্চ, ফ্রেঞ্চ রান্না করেছিলেন নরেন থাকাকালিন-হাঁসের ডিম ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে করাইশুঁটি আর আলু দিয়ে ভুনি খিচুড়ি মত। ভালবাসতেন জীবে গজা, কারণ তার একটা ঘটনা আছে, একবার এক যায়গায় জীবে গজা এসেছে, তিনি একটা তুলে নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে গোটা হাঁড়িটায় সেই এঁটো গজা টা ফেলে দিলেন, তাতে করে সবটা এঁটো হল, কেউ খেতে পারলো না, তিনি একাই খেয়ে ফেললেন, এটা নরেন থাকাকালিন। এ-থেকেই বুঝতে পারা যায় তিনি কতখানি চঞ্চল ছিলেন কিশোর বয়সে। 

নরেন একদিন পুলিন মিত্র নামে সেই সময়ের তৎকালীন গায়কের বাড়ি গেছেন, কচুরী ভেজে দেওয়া হয়েছে তাঁকে, খুব খুশী, হয়ে বলছেন, “বেশ চমৎকার”। যদিও বিবেকানন্দ রূপে লেখাতে কচুরীর তীব্র সমালোচনা করেছেন, বলেছেন কচুরী জিলিপি খানায় ফেলে দিতে। 

আবার সেই ঠাকুরের অসুখের সময় হোটেলে গিয়ে মহানন্দে মুরগীর ফাউল কারী খেয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এই সময়েই তীব্র অভাব বাড়িতে, টানা উপবাসে কাটাতে হয়েছে। 

বরানগরে থাকার সময় কিছুই জুটতো না, ভিক্ষার চাল সিদ্ধ করে তা কাপড়ের ওপর ঢেলে সকলে মিলে খেতেন এবং সঙ্গে ছিল নুন আর লংকার একটা ঝোল। তাতে সকলে মিলে হাত ডোবাতেন, অনেকটা টাকনার মত, আর ভাত খেতেন।- আসলে তিনি দেখিয়ে গেছেন আমাদের যে, যে কোন খাদ্য-ই হোক না কেন- তৃপ্তি সহকারে তা গ্রহণযোগ্য। 

এরপর দেশভ্রমণ কালে আবার অনাহার, এক সময় প্রায় মৃত্যুমুখে, শেষে এক ফকিরের দেয়া শসা খেয়ে প্রাণরক্ষা। বিদেশে পৌঁছে সব টাকা শেষ, আলসিঙ্গাকে টেলিগ্রাম করলেন টাকা পাঠাও। তবে এরপর বিদেশে কিছুদিন-এর পরে খাবার সমস্যা আর হয় নি, জানতেন খাবার আদব কায়দা, সারদানন্দকে শিখিয়েছিলেন কি ভাবে knife ডান হাতে ধরতে হয়, কিভাবে স্যুপ খেতে হ্য়, কিভাবে চামচ ধরতে হয়। সত্যি কি অসাধারন জীবনীশক্তি না থাকলে সব কিছু একধারে সুষ্ঠুভাবে পালন করা যে কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। একদিন ভাই মহেন্দ্রনাথ এক বিদেশীনির বাড়ি খেয়ে এলেন, চাপাটি রুটি মাংসের একটা তরকারী,আরো দুটো তরকারী। শুনে স্বামীজীও ওই রকম খাবার সেই বিদেশীনির বাড়ি গিয়ে খেতে ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন, যদিও তা আর হয়ে ওঠে নি। তাঁর অত্যধিক বালকসুলভ ব্যবহার এর থেকে আমরা পাই। 


৫ 

ঝাল খেতে খুব ভালবাসতেন, পরিব্রাজকরূপে একবার রাখাল মহারাজ খিচুড়ি রান্নার সময় এক ডেলা মিছরী দিয়ে দেন, তাতে তিনি খুব রেগে যান, তাতে মনে হয় মিষ্টি পছন্দ নয়, যদিও লুচি পায়েস পছন্দের খাবার, তা খেয়ে যেতেন সুগার হবার পরেও। কাঁচালংকার প্রতি খুব টান, বিদেশে গিয়ে খুঁজেছেন। কিনে নিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাচ্ছেন একের পর এক, একবার কোন শিষ্যের সাথে বাজী ধরে ৫০টা শুকনো লঙ্গা খেয়ে ফেলেছিলেন। 

তাঁর রান্নায় থাকত প্রচুর মশলার সমাগম, লোকে খেয়ে বলত, elaborate and alarming for health! 

শ্যামবাজারের ঢাকাই পরোটা, ছোলার ডাল আর জিলিপি খুব ভালবাসতেন। আবার ভালোবাসতেন ঝিনুক রান্না করে বেশ ঝাল করে খেতে। 

আরেকটা সূত্র জানাচ্ছে, একই বাড়িতে থাকতো, সুপ, মাছ বা মাংস, সবজি এবং আমেরিকান পাই। তবে ডিনারে ও দেশে কফির চল থাকলেও তিনি খেতেন না। বরং চাপাটি আর কারি চেয়ে নিতেন। 

ফল হিসাবে পছন্দ আঙ্গুর, লিচু, আম। আম ভালবাসতেন বরফ দিয়ে ভিজিয়ে , লিচু ভক্তদের কাছে দীক্ষাদানের সময় চেয়ে নিতেন গুরু দক্ষিণা হিসাবে। সম্ভবত ভালোবাসতেন বলেই। আর আঙ্গুর সম্বন্ধে বলেছেন খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়, খাওয়া খুব ভাল। ভাই মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন- একাবার ম্যাকলাউডের বাড়িতে আনারস কেটে গুঁড়ো চিনি দিয়ে খাবার কথা ও অন্যান্যদের দেবার কথা। 

পেঁয়াজ সম্বন্ধে বলেছেন আধ্যাত্ম পথের লোকের জন্য পেঁয়াজ সেরা খাদ্য নয়। যদিও নিজে ছেলে বেলায় খেতেন খুব, এবং বলেছেন, 

“ছোটো বেলায় আমি কি ভীষণ ভালোবাসতাম, পিঁয়াজ খেয়ে মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে খোলা হাওয়ায় অনেকক্ষণ হাঁটা চলা করতাম।” 

ডাল ভালবাসতেন, বিশেষ করে কড়াইয়ের ডাল, অনেকের কাছে খেতে চেয়েছেন। আর ভীষণ প্রিয় আইস্ক্রিম, ডিনার টেবিল ছেড়ে চলে যেতে চাইলেই মিসেস লেগেট ঘোষণা করতেন আইস্ক্রিম-এর কথা। অমনি বাচ্ছাদের মতো বসে থাকতেন। বিশেষ করে আইসক্রীমের ক্রীমটা খুব পছন্দ করতেন। খেয়ে বলেছেনঃ “food for Gods! Really divine.” 

আরেকবারের বর্ণনা, ২য় বার বিদেশে গিয়ে california তে থাকার সময় প্যাসাদোনায় স্বামীজীর ব্রেকফাস্টের পছন্দ ফল, ডবল ডিমের পোচ, দুটি টোস্ট, চিনি ও ক্রিম সহ কফি। আর দুপুরে মাটন আর নানারকমের শাকসব্জি ওনার জন্য রাখা হতো। ডেসার্ট হিসাবে ফল বিশেষত আঙ্গুর। একবার বিদেশ (ভারতবর্ষের বাইরে) সফর শেষে, স্বামীজী কোলকাতায় ফিরলেন মাদ্রাজ হয়ে। ট্রেণ শিয়ালদহ পৌঁছালো তখন প্রায় সকাল ৯টা । বহু কষ্টে ঘোড়ার গাড়ীতে করে বেলুড় পৌঁছালেন তখন প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজে। পৌঁছে দেখলেন মঠের গেট বন্ধ হয়ে গেছে। তখন কোনো চেঁচামিচি ডাকাডাকি তে গেট খুললো না, এদিকে খিদেয় প্রাণ যায় যায়। ভিতর থেকে কিছু খাবার এর গন্ধ ও আসছে। তাই আর দেরি না করে পাঁচিল টপকালেন। 

পৌঁছে গেলেন সোজা খাবার ঘরে। সবাই তো দেখে অবাক-

“তুমি কি করে ভিতরে এলে? আমরা তো জানি না তুমি আসছো” 

স্বামীজী বললেনঃ 

“শালা! তোমরা বসে খিচুড়ি আর পাঁপড় খাবে, আর আমি শালা বাইরে খালি পেটে ভজন কোরবো? তাতো চলবে না।” 

স্বামীজীর খিচুরী অত্যন্ত প্রিয় খাবার ছিল। তিনি নিজে খুব ভাল খিচুড়ী রান্না করতেন, নানা রকম মশলা , ডাল চাল দিয়ে খিচুড়ি নিজে হাতে রান্না করতে। পরিবেশন করতে ভালবাসতেন। বহুবার সিস্টার নিবেদিতাকেও উনি নিজ হাতে খিচুড়ী রান্না করে পরিবেশন করে সম্পূর্ণ মঠ সহ সবাইকে খাইয়েছেন। এমনি ছিলেন খাদ্যরসিক। 

তিনি সব দেশ ঘুরে বলেছিলেনঃ 

“হিঁদুরাই ঠিক অর্থাৎ হিঁদুদের ঐ যে ব্যবস্থা যে জন্ম -কর্ম-ভেদে আহারাদি অবশ্যি পৃ্থক, এইটিই সিদ্ধান্ত। নানান দেশ দেখেছি, নানান রকমের খাওয়াও দেখেছি। তবে আমাদের ভাত-ডাল-ঝোল-চচ্চড়ি-সুক্তো-মোচার ঘন্টের জন্য পুনর্জন্ম নেওয়াও বড় বেশী কথা মনে হয় না। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝছ না, এইটাই আপসোস।”

“কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো...” 

এক আউন্স পরিমাণ আনন্দ আর এক পাউন্ড পরিমাণ যন্ত্রণার কারণ। একটি শক্তি এক এক সময় আনন্দরূপে, আবার অন্য সময় বেদনার আকারে প্রতীয়মাণ হয়। যে মুহূর্ত্তে একদল চেতনা স্তব্ধ হয়। আর এক দলের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। 



তথ্য সংগ্রহঃ
বিবেকানন্দের রচনা সংগ্রহ, শ্রী শ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, Western Women in the footsteps of Swami Vivekananda, and Internet Wikipedia.


2 মতামত:

  1. Seema . Ek niswase pode fellum . Jadio tomar sathe ei bepayre katha hoichilo kintu eto sundoor roope je likhbe bhabini . Swamijir randhan potuta ar randhaner iccha je kata probol chilo nitya natun roope khub sundoor parchoy roilo . Lovely .

    উত্তরমুছুন
  2. ek osadharon lekha porlam.. khub khub bhalo laglo..

    উত্তরমুছুন