বিশেষ রচনাঃ শর্মিষ্ঠা ঘোষ


























বিশেষ রচনাঃ



‘প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর তো জানা’ 
শর্মিষ্ঠা ঘোষ

পেশা সূত্রে হরদম টিন এজ ছেলে মেয়েদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ আমার হয়েছে এবং হয় । এই রকম একটা বয়সে তাদের আমি পেয়েছি খুব কাছ থেকে যখন তাদের বয়ঃসন্ধির একটা টালমাটাল পিরিয়ড । তাদের তখন পিঠে সদ্য ডানা গজিয়েছে, ডেডালাসের মত অবাধ্য ইচ্ছেয় সূর্যের দিকে ওড়ার চেষ্টা ঐ নিয়েই ... হোক সে ডানা মোমের । তাদের চোখ তখন তির্যক মাপে ছোট থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা সহপাঠিনীর ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স । তাদের চোখের সামনে সদ্য পঁচিশের দিদিমনি একটু সঙ্কোচে ... নাকি অতীব বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান সেটা ? সে হেঁটে গ্যালে আড়ালে উড়ে আসে হাল্কা সিটি ... প্রেমিকের বাইকে দিদিমনি পথ যদি না শেষ হবার গান গাইলে কচি গোঁফের ছাত্রের দল হায় হায় করে ... ক্লাসের মাঝে একটু হাসি একটু প্রশ্রয় একটু ভ্রুকুটি একটু বিভঙ্গ একটু আদর মাখা শাসন ... পড়াশোনা শুধু চলে না, দৌড়য় । তো এমনই এক অনুভবের কথা উঠে এল আমার একটা কবিতায় ... একটি বছর চৌদ্দর ছেলের চোখে তার দিদিমনি, তার প্রতি ছেলেটির বিশেষ নরম গোপন একান্ত অনুভবের কথা বলা আছে তাতে । যার কয়েকটি লাইন এমন ছিল ...

‘ জামার বাঁদিকে নীল জেল পেন, কালি মাখামাখি আমার শার্টে / যেন গো আমার কিশোর হৃদয়ে বান ভাসাভাসি তোমার জন্যে / তখন আমার সদ্য তেরো, শরীরের আড় ভাঙছে কেবল / ঠোঁটের ওপর সবুজ আভা, নরম গালে রেশমি কোমল / তলপেটে এক শিরশিরানি সুপর্ণা ম্যাম, তোমায় দেখলে / গলার আওয়াজ বদলে যাচ্ছে, বাবার মতই ভারি হয়ে যাবে / আমি হতে চাই রুদ্রকাকু, সুপর্ণা ম্যাম, তোমার প্রেমিক’...

ফেসবুকের একটি তথাকথিত তরুণ কবিদের কবিতার গ্রুপে কবিতাটি পোসটানোর পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল । কারুর ভাল লাগলো এবং কারুর মনে হল, একজন মহিলার লেখার বিষয়বস্তুটি এমন হবে কেন ? তাদের মধ্যে সদ্য যুবা এক ভ্রাতৃপ্রতিম উঠতি কবিও ছিল । প্রসঙ্গত তার লেখা আমার নিজের বেশ প্রিয় । তো তাকে সেদিন হাল্কাচালে বড় হয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলাম । মনে মনে হেসেছিলাম । আমার এক কবিবন্ধু আর একবার দেখা করতে এল সুদূর বাংলাদেশ থেকে। একরাত্রির অতিথি সে আমার । অনেকই আলোচনা হোল সেখানকার লেখার ধারা নিয়ে এখন এই সময় যারা লিখছেন তাদের সামনে কোন আলোর দিশা আছে সেসব নিয়ে । সে আমায় আলোচনার ছলে বলেছিল, আমার লেখা মোটেই ‘মেয়েলি’ নয় । আমি ভেবে পাইনি , এটাকে নিন্দে না প্রশংসা হিসেবে নেব । আমার একাধিক লেখায় দেহবাদের প্রতি আমার ‘অনৈতিক’ ঝোঁকের বিষয়ে বোদ্ধাদের ‘সুপরামর্শ’ আছে ।

একাধিকবার তথাকথিত ‘অশ্লীলতার’ দায়ে অভিযুক্ত হয়েছি, অভিযোগ এমন, যে কবিতাকে ইন্ডাস্ট্রি বানিয়ে তুলছি নাকি । তার উত্তরে আর একটি কবিতা লেখাই শুধু হোল ... ধারা বদলাল না । কারণ, যা অনুভব করি সত্য বলে, তাকে নিরোধ পরিয়ে ইমপোটেনট প্রমাণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখি না । কলমের খাপ খুলেই তো লিখতে বসা, ফের লেখার মুখে খাপ কিম্বা কিংখাব পরালে শুধু যে সাবলীলতা নষ্ট হয়, তাই না, সেটা মেকি সুশীল আঁতলামো হয়ে ওঠে বলে আমার বিশ্বাস ।

একজন লেখক তার নারী বা পুরুষ স্বত্বা বিসর্জন দিয়ে একাধারে পুরুষ ও প্রকৃতি হয়ে না উঠতে পারলে একটা ফালতু গণ্ডীতে আটকে পড়েন, যেখানে মেয়েরা মেয়েদের নিয়ে, তার ছলাকলা, লাস্য, ন্যাকামি, বোকামি, নাকি কান্না, বোবা কষ্ট, বঞ্চনা আর চাহিদার সাতসতেরো নিয়ে আর ছেলেরা কেবল মাচো মাচো মুশকো জওয়ানদের চোখে নারীর চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার নিয়ে ছাড়া লেখা বারণ ... অনেকে বলবেন, কেন রে বাওয়া, দুনিয়ায় কি লেখার বিষয়ের অভাব পড়েছে ? কত কি ই তো আছে, চাঁদ তারা ফুল পাখি নদী সমাজ রাজনীতি ধর্ম দর্শন ... তা না, খালি রগরগে গল্প ফাঁদে ফালতু পাব্লিক ... তা, আমি বলি কি, সব নিয়েই লেখা হবে যখন, এই মানবদেহ জমিন টাই বা বৃথা অকর্ষিত ফেলে রাখা কেন ? আর মুষ্টিমেয়ের হাতেই বা তাকে কালটিভেট করার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা কেন ? তারচেয়ে, দশে মিলি করি কাজ ... ইত্যাদি ...

মাঝে মাঝে মনে হয় মাইকেল্যাঞ্জেলো, র্যাফায়েল, র্যঁদা, পিকাসো যা রেখে গ্যাছেন দুনিয়ায় তার অনেকটাই তো তাহলে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হবার কথা ... শেক্সপিয়ার তো প্রেম করার জন্য একটা ঠিকঠাক ‘মহিলা’ও জোটাতে পারেন নি, কে এক মিস্টার অজানার উদ্দেশ্যে রাশি রাশি অপূর্ব চতুর্দশপদী ফেঁদে বসলেন, ... মোনালিসার হাসি টা যে অমন ঠোঁট টেপা তা কি দাঁত দেখানো অশ্লীলতা বলেই ? ব্রাউনিং এর লাস্ট ডাচেস তো যখন তখন হাসার দায়ে প্রাণটাই দিলেন, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের তো বেশ কয়েকখানা স্বীকৃত প্রেমিকা ছিলেন, তা কবি বেচারা কি সারা জীবন দেবতাকে প্রিয় আর প্রিয়কে দেবতা করার কথা বলে গ্যালেন বিবেকের তাড়নায় ? তাই যদি হয় তো চলুন, ল্যুভরে মিউজিয়মে আগুন লাগানো যাক ... কি যে সব অশ্লীল ছাইপাঁশ প্রদর্শন করে, বস্ ! কবিদের মানস প্রতিমারা সব তুলসী মালা পরিহিত নিপাট বৈষ্ণব তো ? ... নিরামিষ আচরণের সদাচারী বীতকাম ?

সাহিত্যের অঙ্গনে এইসব মোটা দাগের বিভাজন রেখা কার মস্তিষ্ক প্রসূত কে জানে, তবে সেটা যে খুবএকটা মেনে চলেন সবাই, এমন ও নয় । এসব গুরুত্বসহকারে মানতে গেলে, সাহিত্য জননী নিজেই বঞ্চিত হতেন । কে কি কিভাবে লিখবে বা লিখবে না সেটা নিক্তি মেপে বলে দিতে গেলে তো এটাও সেইসাথে বলতে হয় যে, এই সুমহান বিচার কর্মটি কে কোন সুবাদে কোন যোগ্যতায় সমাধা করলেন ? কিছু লেখা অতীতে নিষিদ্ধ হয়েও পরে সমাদৃত হয়েছে, যুগে যুগে, কালে কালে এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে ... তার মানেই যে কালের সাথে মানুষের নৈতিক বোধ এর প্রসারণ বা সঙ্কোচন ঘটেছে এটা বলা মুর্খামি, কারণ নীতি একটি মানুষের ব্যাক্তিগত মত, কখনোই তা সমষ্টিগত নয় ... এইসমস্ত শ্লীল অশ্লীল প্রসঙ্গ অনেকসময় আদালত অবধি ও গড়ায়, ব্যাপক আকচাআকচি চলে, বাদী বিবাদী দিন কতক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করেন, তুই মুই চলে ভক্তগণের শিবিরে শিবিরে ... তারপর ও বেলাশেষে পাঠকের দরবারেই নিরূপিত হয় শিল্প সাহিত্যের স্থায়িত্বের হিসেব নিকেশ । ‘এহি হ্যায় রাইট চয়েস বেবি ... আহা’ !


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন