প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


















প্রবন্ধঃ


পঞ্চকবির তিনজন
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



[ আগামী ২৬শে জুলাই কান্তকবি রজনীকান্ত সেন’এর ১৫০তম জন্মবর্ষ পূর্ণ হবে (জন্ম ২৬জুলাই ১৮৬৫), আর গতবছর আমরা পেরিয়ে এসেছি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সার্ধশত জন্মবর্ষ । এই দুজনের কথা বললেই এসে যায় আর একজনের নাম – অতুলপ্রসাদ সেন । রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক তিন সংগীত ব্যক্তিত্বের জীবন ও সৃষ্টিকে ফিরে দেখার প্রয়াস এই নিবন্ধে ] 



বাঙালির সংগীতভুবনে রবীন্দ্রগানের সমুদ্রপ্রমাণ পরিসরের বাইরে যে চারজনের গানের কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাঁরা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং অতুল প্রসাদ সেন । নজরুল এসেছিলেন বাংলা গান বিপণন যোগ্য হয়ে ওঠার সময়কালে । অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে গ্রামফোন আসার পর আধুনিক বাংলা গানে যখন ব্যাপক বৈচিত্র এলো । বাংলা গানকে বিপণনযোগ্য করে তোলার পেছনে নজরুলের অসামান্য অবদান রয়েছে । নিজের সংগীত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন যে বাঙালিকে সুখে দুঃখে তাঁর গান গাইতেই হবে। ঠিক তেমনই নজরুল ইসলামও প্রত্যয় জ্ঞাপন করেছিলেন এই বলে “সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এইটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি । সংগীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা নাহলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে”(১৯৩৯এ জন সাহিত্য সংসদে ভাষণ) । নজরুল আমার এই আলোচনায় থাকছেন না । দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদের গানের সঙ্গে নজরুলের গানকে একত্র মিশিয়ে ফেলাও যায়না । তাঁর সংগীত ভাবনা ও গানের কথা পৃথক ভাবেই আলোচনা হওয়া সঙ্গত ।

দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমসাময়িক । অতুলপ্রসাদ কিছুটা কনিষ্ঠ । দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে এলাম গত বছর আর এ বছর জুলাইএ রজনীকান্ত পা দেবেন সার্ধশতবর্ষে, তারও ছবছর পরে অতুলপ্রসাদ পূর্ণ করবেন জন্মের দেড়শো বছর । দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতযাত্রার পথ ও রজনীকান্ত অপেক্ষা একটু ভিন্ন । রজনীকান্ত তাঁর কাব্যগীতিতে আশ্রয় করেছিলেন ভক্তির পথ, তাঁর গান আত্মনিবেদনের গান । অতু্লপ্রসাদের আশ্রয় ব্রহ্মসংগীত, গজল ও ঠুমরি আঙ্গিক । কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে শাস্ত্রীয় সংগীতের ধ্রুপদ ও খেয়াল আঙ্গিকের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন । পাশ্চাত্য সুরের সার্থক মিশ্রণও পাওয়া যায় তাঁর গানে । অতুলপ্রসাদকে বাংলা ঠুংরি গানের প্রবর্তক বলা হয়ে থাকে, দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে ঠুংরি আঙ্গিক গ্রহণ করেন নি ।

দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন একাধারে সার্থক নাট্যকার, কবি ও সংগীত স্রষ্টা । সার্থক ঐতিহাসিক নাটক বলতে এখনও আমরা দ্বিজেন্দ্রলালের কাছেই যাই । তাঁর নাটকগুলি প্রায় সবই দেশপ্রেম মূলক । ঐতিহাসিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের নাট্যায়নই যে তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তা নয় । ইতিহাসের উপাদানকে আশ্রয় করে স্ব-কালের সমাজ ও মানুষের ভাবনা ও সংগ্রামের নাট্যভাষ্য নির্মাণ করাই উদ্দেশ্য ছিল । ইতিহাসের পটভূমিতে স্বদেশের যন্ত্রণা ও সংগ্রামের ইচ্ছাই বিধৃত হয়েছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে । সে কালের থিয়েটারে নাটকে গানের প্রয়োগ অনিবার্য ছিল, কারণ সেকালে বাঙালির বিনোদনমূলক গান শোনার সেরা মাধ্যম ছিল থিয়েটার । 

বাঙালির দেশাত্মবোধক গানের ভান্ডারকে সম্ভবত সর্বাধিক ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে দ্বিজেন্দ্রলালের গান । তাঁর দেশপ্রেমের প্রেরণা নিশ্চিত ভাবেই বঙ্গজননী । ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছিল । তাঁর নাটকে দেশাত্মবোধক গানগুলির সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন । দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলির মুখ্য বার্তা ছিল দেশাত্মবোধের সঞ্চার এবং তাঁর সার্থক নাটকগুলির প্রায় সবই – রাণাপ্রতাপ, দুর্গাদাশ, নূরজাহান, সোরাব রুস্তম, মেবার পতন, সাহজাহান, চন্দ্রগুপ্ত প্রভৃতির রচনা বা প্রথম অভিনয় ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সময়কালে । এই সময়টা ছিল বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী তীব্র আন্দোলনের কাল । আজও কোন গৃহকোণ থেকে ভেসে আসা গান ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ কিংবা ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’ পথচলতি আমাদের দু’দন্ড দাঁড় করিয়ে দেয় সেই সব গানের কথা আর সুরমাধুর্য । সমবেত সংগীত, সংগীতের হার্মোনাইজেশন বা স্বরসঙ্গতির যে ধারণা তাও প্রথম পাওয়া যায় দ্বিজেন্দ্রলালের গানে । স্মরণ করতে পারি সাহজাহান নাটকে রাজপুত রমণীদের কন্ঠে গীত ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’গানটি। গানটি আজও শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক সমবেত সংগীতের শিরোপা ধারণ করে আছে ।

দ্বিজেন্দ্রলালের পূর্ববর্তী নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের ধর্মমূলক ভক্তিসংগীত বা ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটকে চটুল গানের প্রাবল্য ছিল । দ্বিজেন্দ্রলাল নাট্যগীতির রচনা ও সুর প্রয়োগে কাব্যের লাবণ্য, মার্জিত ও পরিশীলিত রুচির ভিত্তিভূমির প্রতিষ্ঠা করলেন । সাহজাহান নাটকে ‘আজি এসেছি, এসেছি বধুহে’, ‘নূরজাহান’নাটকে ‘আয়রে বসন্ত ও তোর কিরণ মাখা পাখা তুলে’, সাহজাহান নাটকেই ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে সাধের মালাটি গেথেছি’, মেবার পতন নাটকে ‘ভেঙ্গে গেছে মোর স্বপ্নের ঘোর’ কিংবা চন্দ্রগুপ্ত নাটকে ‘ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে’ আজও আমাদের দোলা দেয়, আবিষ্ট করে । ১৯১১তে লিখেছিলেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ । এবং আজও অমর দেশাত্মবোধক গান ‘যেদিন সুনীল জলধী হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ । আমার মত হয়তো অনেকেরই নিশ্চিত বিশ্বাস দ্বিজেন্দ্রলাল যদি আর একটিও সংগীত সৃষ্টি না করতেন, তাহলেও শুধুমাত্র ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ ও ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ এই দুটি গানের সুবাদেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন । রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন “রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত অপেক্ষা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বঙ্গ আমার’ অধিক জনপ্রিয় হইল।…প্রাকৃতজনের মনোহরণ করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল, রবীন্দ্রনাথ তাহা পারেন নাই ।



অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল । পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন কৃষ্ণনগরের দেওয়ান, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত গায়ক । উনিশ শতকের নবজাগরণের কৃতিপুরুষের অনেকেই – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, ভুদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কার্তিকেয় চন্দ্র । এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, কৃষি বিদ্যা সম্পর্কে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাত গিয়েছিলেন । দেশে ফিরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রূপে সরকারী পদে যোগ দেন । বিলাতে দুবছর থাকাকালীন পাশ্চাত্য সংগীত ও নাটক সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন । দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম কাব্য সংকলন ‘আর্যগাথা’ প্রকাশিত হয় ১৮৮২তে তাঁর ১৯ বছর বয়সে । দ্বিজেন্দ্রলাল পাঁচশতাধিক গান লিখেছিলেন বলে জানা যায় কিন্তু তাঁর অধিকাংশ গানেরই কোন স্বরলিপি নেই, কোন গায়কীও জানা যায় না । যে সামান্য সংখ্যক দ্বিজেন্দ্রগীতি আমরা শুনি, সেগুলি থিয়েটারে প্রয়োগ হয়েছিল এবং কিছু গান গ্রামফোন রেকর্ডে ধ্বনিবদ্ধ হয়েছিল বলে সেগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা গেছে । তিনি নিজেও কয়েকটি গান গ্রামফোন রেকর্ডে গেয়েছিলেন । পারিবারিক বিপর্যয়ই তাঁর সংগীত সম্পদ সংরক্ষিত না হওয়ার প্রধাণ কারণ । মাত্র পঞ্চাশ বছরের আয়ু ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের । চাকুরী জীবনে প্রবল মর্যাদাসম্পন্ন ও দৃঢ়চেতা হওয়ায় বারংবার বদলি হয়েছেন ভারতের নানান প্রান্তে । দ্বিজেন্দ্রলালের দাম্পত্যজীবন ছিল মাত্র ১৩ বছরের । তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে, ১৯০৩এ পত্নী সুরবালা দেবীর মৃত্যু হয় । পুত্র দিলীপ কুমার তখন ছয় বছরের শিশু । ১৯০৫ পরবর্তী সাত বছরে তাঁর কর্মস্থল বদল হয় খুলনা, মুর্শিদাবাদ, কান্দি, বাঁকুড়া, জাহানাবাদ,গয়া, মুঙ্গের প্রভৃতি নানান প্রান্তে । ১৯১২য় মুঙ্গেরে বদলী হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন । কয়েকমাস পরে ১৯১৩র ১৭ই মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয় মাত্র পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবার দুমাস আগে । পিতার মৃত্যুর পর পিতামহের গৃহে প্রতিপালিত দিলীপকুমারও সংসার ত্যাগ করেন যৌবনে । ফলে দ্বিজেন্দ্রলালের অসামান্য সংগীত সম্পদের কোন উত্তরসুরিই আর থাকল না । তবুও রবীন্দ্রনাথের গানের সর্বগ্রাসী প্রভাব সত্তেও তাঁরই সমকালের অনন্য প্রতিভা দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মবোধক গান, নাট্যগীতি, হাসির গান বাঙালির সংগীতভুবনের চিরকালীন অক্ষয় ঐশ্বর্য ।

আমাদের বাল্যকালে পড়া একটা কবিতা – ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই / কুঁড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই......’ । এখন কে আর মনে রেখেছি কবিতাটি রজনীকান্ত সেনের লেখা । রজনীকান্ত সেন মানে সেই উদ্দীপক দেশাত্মবোধক গান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই /দীন দুঃখিনী মা যে আমার এর বেশি আর সাধ্য নেই’ /ঐ মোটা সুতোর সঙ্গে মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই আমরা এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ, পরের দোরে ভিক্ষে চাই” । রজনীকান্ত সেন মানেই স্নিগ্ধ প্রশান্তির আত্ম নিবেদনের গান ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্ম মুছায়ে’ । 

রজনীকান্তর আদি নিবাস পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে । সংগীত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশে জন্ম রজনীকান্তর। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন সেই স্পময়ের দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ । লিখেছিলেন ‘পদচিন্তামণি’ নামে একটি কীর্তন সংকলন ও ‘অভয়া বিহার’ নামে একটি গীতিকাব্য সংকলন । 

খুব চটজলদি গান লিখে সুরকরে গাইতে পারতেন রজনীকান্ত । রাজশাহীতে থাকাকালীন নানান আসরে, সাহিত্যসভায় তাঁর ডাক পড়তো আর সেইসব আসরে অবধারিত ভাবে গান করতে হ’ত রজনীকান্তকে । চটজলদি গান বাঁধার এই গুণ পরবর্তী সময়ে আর একজনের মধ্যে ছিল, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম । কবি সঙ্গীতকার দ্বিজেন্দ্রলাল কর্মসূত্রে রাজশাহী আসতেন সেই সুবাদে দুজনের সখ্যতাও গড়ে উঠেছিল । সেকালে হাসির গান রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন । বস্তুত দ্বিজেন্দ্রলালই ছিলেন বাংলা হাসির গান রচনার পথ প্রদর্শক । দ্বিজেন্দ্রলালের প্রেরনায় রজনীকান্তও অনেক হাসির গান রচনা করেছিলেন । ১৯০২এ রজনীকান্তর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় অক্ষয়কুমার মৈত্রর সম্পাদনায় । এটি ছিল মূলত গীতিকবিতার সংকলন। ১৯০৫এ প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কল্যাণী’ও গানের সংকলন । ১৯১০এ ৪৮টি নীতিমূলক কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ‘অমৃত’ । রজনীকান্তর একটি নীতি কবিতার কথা বোধকরি অনেকেরই মনে পড়ে যাবে - “নদী কভু নাহি করে নিজ জল পান, তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল, গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান, কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান” । মৃত্যুর পর তাঁর আরো পাঁচটি গ্রন্থ – ‘অভয়া’, ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’,’সদ্ভাব কুসুম’ ও ‘শেষ দান’ প্রকাশিত হয় । ১৮৯১এ আইন বিষয়ে পাশ করে রাজশাহী আদালতে আইন ব্যবসায় শুরু করেছিলেন । জীবন ধারণের জন্য ওকালতি শুরু করেছিলেন বটে কিন্তু সংগীতরচনা ও কাব্যসাধনায় নিবেদিতপ্রাণ রজনীকান্ত আইনব্যবসাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেন নি । তাঁর নিজের ভাষায়, “আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই। শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম ণ্ড আমার চিত্ত তাই লইয়াই জীবিত ছিল। সুতরাং আইনের ব্যবসায় আমাকে সাময়িক উদরান্ন দিয়াছে, কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য অর্থ দেয় নাই” ।

মাত্র ৪৫ বছরের আয়ু ছিল রজনীকান্তর, তাও শেষ একটা বছর দূরারোগ্য কর্কট রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন । কথাও বলতে পারতেন না । কলকাতায় হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত শয্যাশায়ী বাকশক্তিহীন কবিকে দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । রোগ শয্যা থেকেই একটি গীতি কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন রজনীকান্ত । রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই । পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই । আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।” 

ঈশ্বরভক্তিই তাঁর গানের মুখ্য বিষয় । সরল শব্দের বুননে ভক্তিমূলক এই গানগুলি্তে রয়েছে হূদয় মথিত করা আবেগ । বহুশ্রুত ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ গানটিতে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, শোক-তাপ এবং পাপ মোচনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আরও কয়েকটি ভক্তিরসের গান হলো: ‘আমিতো তোমারে চাহিনি জীবনে’, ‘কেন বঞ্চিত তব চরণে’, ‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছ’, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ প্রভৃতি। গানগুলির মধ্য দিয়ে ভক্তিরস ও আত্মনিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি রয়েছে জীবন ও জগতের প্রতি আপন বিষন্নতা ও বৈরাগ্যভাবনা ।

রজনীকান্তর গানের সুরে বাংলা গানের মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদান – কীর্তন, বাউল, পাঁচালি, রামপ্রসাদী গানের প্রভাব পাওয়া যায় । রজনীকান্তর সাঙ্গীতিক ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়নি কোন প্রথাগত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষায় কিংবা রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের মত পাশ্চাত্ত সঙ্গীতের রূপরস আত্মস্থ করেন নি । তাই তাঁর গানে সুরবৈচিত্রের অভাব থাকলেও ভক্তিভাবের সহজ অভিব্যক্তি ও সুরের আবেদন হৃদয়গ্রাহী । তাই রজনীকান্তর পঁচাত্তর ভাগ গানেরই স্বরলিপি না থাকলেও যে সামান্যসংখ্যক গান আছে ও এখনো গীত হয়, তার জোরেই রজনীকান্ত সেন বাংলার পঞ্চকবির একজন হয়ে আছেন, তাঁর গান আজও বাংলার সঙ্গীত ভান্ডারে অক্ষয় সম্পদ ।

‘মোদের গরব, মোদের আশা 
আমরি বাংলা ভাষা’ । 

বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার এমন চিরকালীন গান যিনি বেঁধেছিলেন তাঁর জীবনের বেশিরভাগটাই কেটেছে বাংলার বাইরে – উত্তর ভারতে । তিনি পঞ্চকবির চতুর্থজন অতুলপ্রসাদ সেন । বাংলার পঞ্চকবির চতুর্থ জন অতুলপ্রসাদ সেনের কাব্য ও সাঙ্গীতিক জীবন সুখের ছিল না । ব্যক্তিজীবনের নানান বিসংগতি, অসুখী দাম্পত্যজীবনে নিঃসঙ্গতার দহন ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী । আর তাই, গানের ভুবনে নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বই ছিল তাঁর সংগীত সৃষ্টির উৎস । 

কৈশোরে পিতৃবিয়োগ হয় অতুলপ্রসাদের । তাঁর বয়স তখন সতেরো । বাবার উপনিষদ গানে ঘুম ভাঙত বালক অতুলপ্রসাদের । সন্ধ্যায় ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে ব্রহ্মসঙ্গীতের সুর ছড়িয়ে যেত প্রাণে। বালক অতুলপ্রসাদের গান শুনে মা আদরে জড়িয়ে ধরতেন । সেই মা – ছয় সন্তানের জননী হেমন্তশশি আবার বিবাহ করলেন চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহনকে । তখনকার ব্রাহ্মসমাজও এই বিবাহ মেনে নিতে পারে নি । অতুলপ্রসাদও পারেন নি । তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্রটাই বদলে গেলো – শুরু হ’ল একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা । তিনবোনকে মায়ের কাছে রেখে অতুল চলে এলেন কলকাতায় মেজমামার কাছে । মেজমামা তাঁকে বিলেতে ওকালতি পড়তে পাঠালেন । পাঁচ বছর বিলেতে ছিলেন তিনি । সেইসময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পাশ্চাত্ত সঙ্গীত শিক্ষার উদ্দশ্যে ইংল্যান্ডে ছিলেন । অতুলপ্রসাদ সেখানে প্রবাসী ভারতীয়দের সান্ধ্য আড্ডায় মিশে গেলেন । এইসময় ওখানকার একটি লোক সুর ভেঙ্গে রচনা করলেন এক উদ্দীপক সংগীত ‘ওঠোগো ভারত লক্ষী’ । তবুও পাশ্চাত্ত সংগীত অতুলপ্রসাদকে মোটেই টানেনি । আসলে প্রথাগত সংগীতশিক্ষা তিনি করেন নি, তাঁর জীবনের লক্ষ্যও ছিলনা সংগীত রচনা করার । নিজের পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া, তিন বোনের ভবিষ্যৎ - এটাই একমাত্র চিন্তা ছিল তাঁর । এই সময় বড়মামা স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সপরিবারে লন্ডন আসেন । মামাতো বোন হেমকুসুম সঙ্গে প্রণয় হয় অতুলপ্রসাদের, স্থির করেন হেমকুসুমকে বিবাহ করবেন । কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে কলকাতায় ফিরে গেলেন । ওকালতি পড়া শেষ করে অতুলপ্রসাদও ফিরে গেলেন কলকাতায় । স্বদেশে ফেরার আর্তি থেকে গান বেঁধেছিলেন ‘প্রবাসী চল রে, দেশে চল; আর কোথায় পাবি এমন হাওয়া, এমন গাঙের জল’।

কলকাতা গিয়ে হেমকুসুমকে বিবাহের প্রস্তাব হেমকুসুমের পরিবার মেনে নিলেও তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো না । মামাতো-পিসতুতো বোনের বিবাহ তখন আইনসিদ্ধও ছিল না । কলকায় ফিরে অতুলপ্রসাদ তখন বিখ্যাত ব্যারিস্টার স্যার সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের সহকারী হয়ে প্রাকটিস শুরু করেছেন । সত্যেন্দ্রপ্রসন্নের পরামর্শে অতুলপ্রসাদ হেমকুসুমকে বিয়ে করলেন স্কটল্যান্ডে গিয়ে । ওখানে ভাই-বোনের বিবাহ আইনসিদ্ধ ছিল । হেমকুসুমকে নিয়ে অতুলপ্রসাদ বাসা বাঁধলেন বিলাতে । লন্ডনে ওকালতি শুরু করলেও মোটেই পসার জমাতে পারলেন না, লেগে থাকলো আর্থিক অনটন । ব্যর্থতা সঙ্গে করে ফিরে এলেন দেশে । কিন্তু কলকাতা নয়, বাসা বাধলেন উত্তর ভারতের লখনৌতে । সেখানেই ওকালতি শুরু করলেন । পসার জমতেও সময় লাগলো না । কিন্তু পারিবারিক শান্তি এলো না, সুখ এলো না দাম্পত্যজীবনে । স্ত্রী হেমকুসুমের সঙ্গে বিচ্ছেদ । একই শহরে দুজন আলাদা থাকতেন । ‘আমিও একাকি, তুমিও একাকি বাহিরে শ্রাবণরাতে/নীদ নাহি আখিপাতে’ গানটি শুনে স্রোতার হৃদয়ছোঁয়া সুর ও কথা মুগ্ধ করে । সে গানের পেছনে আছে কবির একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার বিষণ্ণতা । মাত্র ২০৮টি গান রচনা করেছিলেন অতুলপ্রসাদ । অন্য উপলক্ষ্যে গাওয়া সামান্য ৮/১০টি ছাড়া সব গানেই তাঁর একাকিত্বের বিষাদ-বেদনার ছায়াপাত ঘটেছে । 

দীর্ঘ বত্রিশ বছর লখণৌএ প্রবাসী জীবন কাটিয়েছেন অতুলপ্রসাদ । বলতেন ‘গান আর হাসিই আমার জীবন’ । একাকিত্বের যন্ত্রণা ভুলতে চাইতেন গানের মধ্যে । দীর্ঘকাল লখনৌতে থাকার সুবাদে হিন্দুস্থানী সংগীতের রূপ-রীতির মিশ্রণ ঘটাতে পেরেছিলেন তাঁর গানে । কীর্তন । বাউল, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকসুরেরও মিশ্রণ পাওয়া যায় তাঁর গানে । রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তর মত তাঁর দেশপ্রেমের গানগুলিও সমান ভাবে এখনো আদৃত । ‘আমরি বাংলা ভাষা’ গানটি তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চেতনা-মন্ত্রের কাজ করেছিল ।

দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ এই তিন গীত-কবির জীবনের একটা মিল পাওয়া যায় তা হ’ল নিঃসঙ্গতা । স্বল্পায়ু দ্বিজেন্দ্রলালের মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে পত্নী বিয়োগ, একমাত্র পুত্র দিলীপকুমারের যৌবনে সংসার ত্যাগ, যদিও ব্যক্তিজীবনের বিষন্নতার ছায়াপাত ঘটেনি দ্বিজেন্দ্রলালের সৃষ্টিতে । আরো স্বল্পায়ু রজনীকান্তর ক্যান্সারাক্রান্ত রোগশয্যায় শেষ একবছর কথা বলতে না পারা এবং অতুল প্রসাদের অসুখী দাম্পত্যজীবন জনিত একাকিত্ব । হয়তো বা নিঃসঙ্গতার বেদনা সব সার্থক কবিরই অবধারিত প্রাপ্য। বিশ্বসাহিত্যে যে বৃত্তান্ত রয়েছে অজস্র !


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন