মুক্ত গদ্যঃ শমীক জয় সেনগুপ্ত






















মুক্ত গদ্যঃ


নষ্টগদ্য-২

শমীক জয় সেনগুপ্ত
পরিচয়




আমার মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিঙের ওপর থেকে আকাশটাকে যতটা কাছের মনে হয়

মাটিটাকে আরো ছোট থেকে ছোট দ্যাখায়। আর দৃষ্টিসুখের গতিপথে মন যখন প্রবোধ মানে না তখন জিতেন্দ্রিয় অন্তরের স্বত্তাকে প্রমোত্ত চোখ লাগাম টানতে অক্ষম হয়। আচ্ছা, কার্নিশে ঝুলতে থাকা কাগজটা রোদে পুড়ে জলে ধুয়ে ফ্যাকাসে

হয়ে গেছে। ওটা যে কোন একসময় আকাশে ওড়েনি সে কথা জোড় গলায় বলতে পারিনা কারন আজকের রঙ না জানা ঐ কাগজে বিগতদিনের কোন স্বপ্নমোড়ক ছিল না এ মানতে পারবো না। আচ্ছা মানিপ্ল্যান্টের হলদেটে পাতাগুলো কি জানে না এখন ওদের চিক্কন হবার সময়। ওর কথাও কি ঐ ঘুড়িতে ঘুরপাক খাচ্ছে, না কি ও জানে না যে হাল্কা হয়ে আসা স্মৃতিতে কুয়াশা আর হিমের স্পর্শ।

ব্যালকোনিতে বসে যখন কফির ধোঁয়া ওঠা মগে একটু একটু ঠোঁটের যত কাছে আসছে চোখটা তত স্থির হয়ে যাচ্ছে বুলবুলিদের বাসা ছাড়িয়ে আমগাছের মগডালের ঐপারে যে ব্লু-ক্যানভাসের দিকে। চক্রাকারে উড়ে চলেছে একটা চিল

আর চক্রবালরেখায় এখন আমার মনও এক ভোকাট্টা ঘুড়ির মত।।

খাপছাড়া মেঘে একটা চেনা সুর ভেসে আসে। যেন ঋতুদার "উৎসব"এ রবিঠাকুর নিজে বীণা হাতে বাজিয়ে চলেছেন আর গানে ভেসে যায় বিশ্ব-চরাচর।

"অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া।"

এই সুর বাজলেই আমি বুঝতে পারি যে ভানুদাদা আমাকে ডাকছে... সে ডাক আমার বড় বেশী চেনা।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে রেডিওতে। আমার বয়স কত জানতাম না .. কত মাস,কত দিন কিছুই জানতাম না । শুনেছি বেতারে রবিঠাকুরের গান বাজলে আমি কান্না খেলা এসব ভুলে ঐদিকেই জুলজুল করে চেয়ে থাকতাম। আর আমাকে কোনভাবে ঠান্ডা করতে হলে নাকি "আকাশ ভরা সূর্য তারা" গেয়ে শোণাতে হত। তা সে যেমন সুরই হক না কেন... যেমন গলাতেই হক। আমার ঠাকুর্দার গানের গলা ভালো ছিল। নাটক যাত্রা করতেন

কাজের ফাঁকে ফাঁকে। দূর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে চাকরি করতেন দাদু। বাড়িতে থাকলে তার হাজার একটা অপকর্মের সাথে আমাকে গান কবিতা শেখানোর চেষ্টা চলতো।

মা ভালো কবিতা পড়ত, আমাকে শান্ত করতে সঞ্চয়িতা খুলে পড়ে শোনাতেন। ভাবতেন হয়ত ছেলেমানুষ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বো, কিন্তু ড্যাবড্যাবে চোখে

অফুরান বিস্ময়ে আমি শুনতাম সেগুলো।ভুল হল, গোগ্রাসে গিলতাম ঐ গান কবিতা।

সারাদিন আম্মা শেখাতো নানা রকম গল্প,ছড়া,মেটাতো সব আবদার। তারপর অক্ষর জ্ঞান হলে সহজপাঠ আর কিশলয়ে দেখতাম কত ছবি,কত শত লেখা..

বাড়িতে একটা কালো রঙের মাটির মূর্তি ছিল রবিঠাকুরের। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি থেকে

আনা মূর্তিটাকে আগে ভাবতাম কোন দেবতা, কিন্তু শিশুমনে ঐ লেখাগুলো ছবিগুলো এনে দিলে সখ্যতার মাধুর্য্য, আর বিশ্বাসটাই কখন পালটে গেল-

ঠাকুর হয়ে গেল ভানুদাদা ।

তারপর একদিন কি যে হল জানি না। বৃষ্টির বুকে মুখ লুকিয়ে আমিও ভাসছিলাম।

তখন কি আর শিশু ছিলাম,বোধহয় নয়। একুশ বছরে মন যতই বালখিল্যের মত কাজ করুক শরীরে যে উদ্দাম যৌবণ। আর যুবকের জীবনে প্রথম প্রেমের মতই চিনচিনে ভাব হয় আকস্মিক পূর্বরাগে। একজন বললে " আমার মধ্যে অনেক আলো আছে, এস, লুটেপুটে গায়ে মাখো নিজের।" আবার কেউ বললে আকাশের পাখির মতই উড়িয়ে দেব ভাবনাগুলো। রঙিণ চশমায় গোলকধাঁধা বড় বেশী। সেই সময়ের প্রিয় বন্ধুকে বললাম "বাবুরে কি করি, এ যে বিশাল সমস্যা -"

ও বললে "পালাই চল।"

পালাতে গিয়ে মনে হল যেন হাতে একটা সাদা শঙ্খ পেলাম।। তবে কি সত্যি আর ভয় পাব না। বেশ হয় যদি এখন হাঁকডাক করে বলতে পারি-

"ভালোবাসি,

বল ভালোবাসো ।।"

বুঝিনি শাঁখ নয় ..সে ছিল শাঁখের করাত তাই পঁচা শামুকে এবার বাস্তবেই পা কাটলো আমার। রক্তের নোনতা স্বাদে আরো কিছু লোনাজল মিশিয়ে বাইরে

সেদিন বাইশে শাওন। গীতবিতানটাকে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে মুখটাকে লুকিয়ে রাখলাম অন্ধকারে। ভানুদাদা,ছেলেবেলায় যখন মান অভিমান হত কি করতাম বলত'?

অন্ধকার থেকেই হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম গীতবিতান। যারা গাইতে পারেনা তাদের ভিতর এক অদ্ভুত কষ্ট কাজ করে। তারা বুঝে পায়না নিজেদের যে বেদনাগুলো উজাড় করা যায় গানে তাকে বুকে চেপে কি ভাবে রাখা যায়। বিশ্বাস কর গীতবিতান যদি পড়া যায় না , ঐ অনুভূতিটা একটু হলেও ম্লান হবে। যেন একদম নিজের কথাই।

তারপরো যখনই মন খারাপের ঘরে আচমকা ঝড় আসে সেই ব্যাথাটাই এখনো আছে খালি তাদের দেখাবার ভাবটা আস্তে আস্তে পালটাচ্ছে বয়সের সাথে সাথে।।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন