সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা




ম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা

“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া...”

কবিগুরুর এই গানটি মনে হতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিলেকোঠার পাতা, সারাদিনের পরিশ্রম, দৈনন্দিন হতাশা,পারিবারিক টেনশন, মনের অবসন্নতা... সব কাটাতেই মানুষ ঢুকে পড়ে মুখবই-এর এই পাতাটিতে... আর প্রাণ ভরে টেনে নেয় বাঁচবার অক্সিজেন। হৈ-হুল্লোড়, ঠাট্টা-তামাশা, মজা, হাসি গান, খুনসুটির ঝলমলে আলোতে যেন নিজেকে ভুলে অপরের হয়ে ওঠে। কবিগুরুর ভাষায় “সুখ নয়, আনন্দ খোঁজো”... আমরা প্রতিদিন সেই অপার আনন্দ খুঁজতে এসে পড়ি চিলেকোঠাতে।

বন্ধন—সেতো ভালবাসাতে,

ভালবেসে আমরা তাই হাত দিলাম চিলেকোঠার নতুন উদ্যোগ চিলেকোঠাওয়েবজিন প্রকাশে। অনেকে ভাবতে পারে, এ আর নতুন কি? কত শত অনলাইন ম্যাগাজিন আছে এই ফেসবুকে, আরও একটি নতুন সংযোজন হল।

না, এটি একটি পারিবারিক পত্রিকা, শুধু সাহিত্যপত্রিকা নয়, এটিতে যেমন থাকবে সদস্যদের প্রতিভার সাক্ষর, কবিতা-গল্প-ছবি-প্রবন্ধ-রম্যরচনা, তেমনি থাকবে সদস্য-সদস্যাদের সন্তান-সন্ততিদেরও উদ্যমের প্রতিভাস।

এটিতে যেমন থাকবে অসাধারণ তথ্যাদি, তেমনি থাকবে রান্নার প্রণালীকৌশল।

সমস্ত মিলিয়েমিশিয়ে চিলেকোঠাওয়েবজিন, আর সমস্ত অনলাইন ম্যাগের থেকে একেবারেই ভিন্ন স্বাদের একটি পত্রিকা হয়ে উঠবে।

প্রথমসংখ্যা। তাই, আমরা কারোর লেখা বাদ দিই নি, কারণ, প্রতিটি সদস্যের ভালবাসার চূড়ান্ত প্রমাণ এই উদ্যোগ। তাই কিছু ত্রুটি, ও মান অবনয়ন হতে পারে, তা পাঠক-পাঠিকা নিজগুণে মাফ করবেন।

আমরা চাইব, সব সদস্যরা সবার লেখা খুঁটিয়ে পড়ুন, মতামত দিন, এবং আমাদের জানান, আরো কি করলে এটির মান বাড়তে পারে, আপনাদের মন্তব্য তাই আমাদের পাথেয়।

আশা করব, ভালবাসায়, হাত-ধরাধরি করে চিলেকোঠার পাতার সাথে সাথে এই ওয়েব-ম্যাগাজিনটিও অফুরন্ত রাস্তা হাঁটবে...

ধন্যবাদ,
সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষ থেকে।

চিলেকোঠার ইতিকথা - সৌভিক দে

চিলেকোঠার ইতিকথা
সৌভিক দে


বদ্ধ ছাদের কোণায়,
আলো-ছায়ার খেলায়,
কলম ওঠে অজান্তে,
না বলা কথা বলতে,
আমার চিলেকোঠায়।।

শ্যাওলা মাখা ঘরে,
উঠছে বেজে গীটার,
কোন এক সুরে,
রাগ-অভিমান ভুলে,
আমার চিলেকোঠায়।।

বছর গেছে ঘুরে,
হারান সব ভুলে,
ছাদ থেকে আজ নেমে,
মুখবইটি জুড়ে,
আমার চিলেকোঠায়।।

কখনো কচিকাঁচার ভিড়ে,
পথের ধুলো মেখে,
স্টেশন চত্ত্বরে,
ল্যাম্প পোস্টের নিচে,
আমার চিলেকোঠায়।।

কখনো ভেড়ির ধারে,
কখনো নন্দনে,
আড্ডা-গানে মিশে,
পূজোর সপ্তমীতে,
আমার চিলেকোঠায়।।

জন্মদিনের উৎসব শেষে,
কবি আড্ডা জুড়ে,
হয়েছে সুনিল যাপন,
কাকাবাবুর বিদায় বেলায়,
আমার চিলেকোঠায়।।

এখন রেডিওতে কান পেতে,
কলিকাতা বই মেলা,
পায়ে পায়ে হেঁটে চলা,
চোখের জল, হাসি মুখে নিয়ে,
আমার চিলেকোঠায়।।

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র

চলচিত্র বিনোদন না শিল্প ?
শ্রীশুভ্র


শুধু বাংলা কেন, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই চলচিত্রই জনপ্রিয়তম বিনোদন মাধ্যম! এই নিয়ে সত্যিই বিতর্কের কোনো অবকাশই নেই! বড়ো পর্দায় লার্জার দ্যন লাইফ চলমান ঘটনাবলীর অভিঘাত আমাদের মনে সুখতৃপ্তির সৃষ্টি করে দারুণ সাফল্যের সাথে! তাই চলচিত্রের বিনোদনমূল্য অপরিসীম! আর এই বিনোদনমূল্যের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে বিশাল ইণ্ডাস্ট্রী! যে ইণ্ডাস্ট্রীর উপর নির্ভর বহু মানুষের জীবন জীবিকা! ফলে চলচিত্রের বিনোদনমূল্যের উপরই নির্ভরশীল এই ইণ্ডাস্ট্রীর সাফল্য! আর সেই সাফল্যকে ধরে রাখতেই দর্শকমনে নিত্যনতুন বিনোদন মাত্রা যুক্ত করা হয়! দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি দূর করতে চলচিত্রের বিকল্প খুব কমই আছে!

আমাদের আধুনিক বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবেই জড়িয়ে আছে চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রী! বস্তুত হিরোওরশিপ সংস্কৃতি গড়ে তোলার পিছনে চলচিত্রের অবদান অনেকখানি! আর এই হিরোওরশিপের উপরই নির্ভরশীল, চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রীর ফুলে ফেঁপে ওঠা! বাংলা সিনেমার মহাতারকা উত্তমকুমারকে কেন্দ্র করে এক কালে বাংলা চলচিত্র ব্যবসা রমরমিয়ে চলত! সাধারণ মানুষ সিনেমা হলে যায় তার পছন্দের নায়ক নায়িকাকে দেখতে! সেটা সিনেমা প্রেমে যত না, তার থেকে অনেক বেশি ঐ হিরোওরশিপ মানসিকতার প্রভাবে! ফলে দর্শক প্রতি সিনেমাতেই তার প্রিয় নায়ক নায়িকার পরিচিত ম্যানারিজম গুলি দেখতেই যায় নতুন কোনো গল্পের মোড়কে! এখানেই চলচিত্র ব্যবসার প্রাণ ভ্রমরা!

চলচিত্রের বাণিজ্যিক মূল্যের স্বার্থ রক্ষার উপরেই এর সাফল্য দাঁড়িয়ে থাকে! কারণ যে বিপুল পরিমাণে অর্থ লগ্নী করতে হয় এর নির্মাণের পেছনে, সেই লগ্নী লাভের মুখ না দেখলে অর্থাভাবে এই ইণ্ডাস্ট্রী বন্ধ হয়ে যাবে! আর চলচিত্রের লাভের মুখ দেখতে গেলে দর্শককে হলে টানতেই হবে ব্যাপক সংখ্যায়! এইখানেই এসে দাঁড়ায় সমাজতত্ব! দর্শককে মৌমাছির মতো হলে টানতে গেলে দর্শকের রুচী ও চাহিদাকে অনুসরণ করতে হবে নিবিড় ভাবে!
আবার দর্শকের রুচী ও চাহিদা গড়ে ওঠে মুলত শিক্ষা বিস্তার, জীবন জীবিকার সাচ্ছল্য, জীবন যাপনের মানের উপর! বাণিজ্যিক চলচিত্র নির্মাতারা এসবই মাথায় রেখে ছবি তৈরী করেন! ফলে ছবির মানে দর্শকের রুচীর প্রতিফলন ধরা পড়ে!

ফলে সমাজ বাস্তবতায় জনসাধারণের রুচী ও চাহিদার উপরেই চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রীর বাণিজ্যিক সাফল্য সর্বাংশে নির্ভরশীল! এবং এর কোনো বিকল্প পথও নেই! ঠিক এই কারণেই চলচিত্র নির্মাতারা দর্শকের কথা মাথায় রেখেই মশলাদার ছবি তৈরী করে আর্থিক বৈভব গড়ে তোলার পথে হাঁটেন! তাঁদের মাথায় থাকে, দর্শকের চাহিদা মত জনমনোরঞ্জন মূলক ছবি নির্মাণ! এটাই বাংলার চলচিত্র ইণ্ডাস্ট্রীরও মূল তত্ব! কিন্তু এই ধারার বাইরে যাঁরা পা ফেলেন! যাঁরা দর্শকের রুচীমত মনোরঞ্জনের মোড়কে গল্প পরিবেশন নয়, শিল্পসম্মত আঙ্গিকে নিজের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে চান সেলুলয়েডের মাধ্যমে! তাঁদের বরাতে সাধারণ ভাবেই দর্শকের উদাসীনতার উপেক্ষাই জোটে!

বস্তুত চলচিত্র যে একটি অত্যন্ত সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যার বৌদ্ধিক নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা দর্শকের চেতনায় গভীর জীবনবোধের অনুরণন তুলতে সক্ষম, এই সার সত্যটাই আমরা বিস্মৃত হয়ে থাকি! কারণ সাধারণভাবে আমরা জীবনের দৈন্দিন সমস্যাবলীতে এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকি যে, সিনেমা হলে গিয়ে সাংস্কৃতিক নন্দনতত্বের ঐশ্বর্য উৎকর্ষতায় আমাদের
আর আগ্রহ থাকে না! বস্তুত জীবনযাপনের ক্লেশ থেকে মুক্তি পেতেই সিনেমা হলে গিয়ে আমরা মানসিক ফুর্ত্তির সন্ধানী! তাই সাধারণভাবেই আমরা সৃজনশীলতা বিমুখ! ঠিক এই কারণেই সৃজনশীল চলচিত্রের সাথে জড়িত যারা তাদের পক্ষে নিজের মতো কাজ করা এত কঠিন এবং কষ্টসাধ্য!

জনমনোরঞ্জন মূলক বাণিজ্যিক সিনেমার সমান্তরালে না গিয়ে বস্তুতই স্রোতের বিপরীতে সৃজনশীল চলচিত্র নির্মাণে যাঁরা অগ্রণী তাঁদের মধ্যে বাংলা চলচিত্র শিল্পের তিন প্রধান পুরোহিত অবশ্যই ঋত্বিক সত্যজিৎ এবং মৃণাল সেন!
দুঃখের বিষয় এঁদের অধিকাংশ সৃষ্টিই দর্শকের আনুকুল্য লাভে সমর্থ হয়নি!
এমনকি বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ, তাঁর তৈরি ছবিগুলিও গুপি বাঘা আর ফেলুদা সিরিজ বাদে, খুব বেশি বাঙালিকে টানতে পারেনি! সত্যজিতের বিশ্বখ্যাতিকে বাঙালি সমীহ করলেও তাঁর কটা ছবি ব্লকব্লাষ্টার হয়েছে? স্মরণে আছে, তাঁর শেষ যাত্রায় কলকাতার রাজপথে যে পরিমাণ মানুষের ঢল নেমেছিল, সেই পরিমাণ দর্শক তাঁরই সেই সময়ে মুক্তি পাওয়া আগুন্তুক দেখতে যাননি!

আসলে আমরা সিনেমা হলে গিয়ে ভাবতে রাজী নই! আমরা শুধু প্রিয় নায়ক নায়িকার নড়নচড়ন সাজ পোষাক অসম্ভব অবাস্তব গল্পের মোড়কে দেখতে চাই!
আর এইখানেই যাঁরা আমাদেরই জীবনের টুকরো টুকরো গল্পের প্রতিফলন ঘটিয়ে, জীবন বাস্তবতার সংশয় আর সংকটকে তুলে ধরে, শাশ্বত জীবন বোধের প্রেক্ষাপটে বর্তমান যুগের সমস্যা ও সম্ভাবনার চিত্রপট তৈরী করেন নান্দনিক ও শৈল্পিক মাত্রায়; তাঁদের সৃষ্টিশীলতার বিচিত্র ক্যানভাসে আমরা মগ্ন হতে রাজী নই! রাজী নই গভীর ভাবে ভাবতে! আর তাঁরা আমাদের চেতনায় তুলতে চান দুরন্ত ঢেউ! যে ঢেউগুলি তাদের উদ্বোধিত করে নতুন করে ভাবতে, দেখতে, অনুভব করতে, সেই গুলির সাথে তাঁরা যখন আমাদেরও শরিক করতে চান, আমরাই সরে আসি!

এই যে আমাদের সরে আসা ভাবনার পরিশ্রম থেকে, অনুভবের প্রজ্ঞা থেকে, উপলব্ধির সমৃদ্ধি থেকে, এইখানেই চলচিত্রের বিনোদন মূল্য তার শৈল্পিক ও নান্দনিক মূল্য থেকে অনেক বেশি হয়ে ওঠে আমাদের মতো সংখ্যাগুরু জনসাধারণের অভিপ্রায়! আর সেইখানেই ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃণাল সেনদের জীবন যুদ্ধ অনেক কঠিন হয়ে পড়ে! কঠিনতর হয়ে ওঠে তাঁদের সৃজনশীলতা সৃষ্টিধারায় পল্লবিত করা!
একটু ভেবে দেখলে ধরা পড়ে, চলচিত্রের নান্দনিক ও শৈল্পিক মূল্য অনুধাবন করতে গেলে যে প্রজ্ঞার প্রয়োজন; আমাদের শিক্ষা দীক্ষায় তার সামুহিক অভাব বিদ্যমান! এখানেই পিছিয়ে পড়ে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার বিস্তৃত পরিসরটুকু!

ভরসার কথা সার্বিক এই পরিস্থিতির মধ্যেও অনেক কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পরিসরটুকু সজীব রেখে চলেছেন এদেশের বেশ কিছু চলচিত্র নির্মাতা! ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃণাল সেনের সমগোত্র না হলেও এই যুদ্ধে তাদের অবদানও কম নয়! কিন্তু আমরা যারা বিনোদন পিপাসু, তারা আর একটু সংস্কৃতি মনস্ক হয়ে উঠে, এঁদের এই লড়াইয়ে যদি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পারি, তবেই আন্তর্জাতিক চলচিত্র অঙ্গনে বাংলা চলচিত্র অনেক দূর এগোতে পারবে!
সমৃদ্ধ হবে জাতি! সার্থক হবে ঋত্বিক সত্যজিৎ মৃণাল সেনেদের অবদান! তখন আর সত্যজিতের শেষযাত্রার ভিড় আগন্তুকের মতো তাঁর শেষ সৃষ্টিকে এড়িয়ে যাবে না এমন ভাবে, যাতে সাতদিনও চলে না ছবি!


ছোটগল্প - মৌ দাশগুপ্তা

প্রতীক্ষা
মৌ দাশগুপ্তা

(১)

ওবেলায় দেখে গেছিলাম কবরখানার লোহার রেলিংটার সামনের একচিলতে বাঁধানো জায়গাটায় বসে এক বুড়োটে মানুষ চোখ বুঁজে গান গাইছেন। কাঁচাপাকা ঝুপড়ো চুল,একমুখ না কাটা দাড়ি, অপরিচ্ছন্ন পোশাক, কিন্তু ভিখারীও নন যদিও সামনে মাটির ওপর বেশ কিছু কয়েন খুচরো পয়সা ছড়ানো।এবেলায় কলেজ ফেরতাও দেখি একবগ্গা লোকটা কাঠফাটা রোদে একা একা পুড়ছে। নাকি কড়া রোদে স্নান করছে কে জানে। আমার বাড়ী থেকে কলেজ যেতে বাসে সময় নেয় মিনিট পনেরো। আর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ী হাঁটাপথে প্রায় দশ মিনিট। রাস্তাটা কবরখানা ঘেঁষা বলে সারাবছরই সুনসান। তবে ভীতিপ্রদ নয়। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ী আসার ওটাই শর্টকাট রাস্তা। যাবার সময় যেমন দেখে গেছিলাম কবরখানার বাইরে রেলিং-এ হেলান দিয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গীতে বসেছিল, আসার সময়ও তাই। না একটু ছায়ার দিকে সরে বসেছে, না নিজেরই ছেঁড়া মোজা আর সেলাই করা জুতো থেকে অবাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসা পায়ের বুড়ো আঙুলটার থেকে চোখ সরিয়েছে। এলোচুলে এলোপাথাড়ি ভাবনা নিয়ে কিসে যে সে বিভোর তা ওই জানে।

লোকটাকে আমি চিনি কি চিনি না এ ব্যাপারে আমার নিজেরই একটু সংশয় আছে। হ্যাঁ কি না, যেটাই বলবো সেটাই ৫০% সত্যি আর ৫০% মিথ্যের মিশেল হয়ে দাঁড়াবে। এই ছোট্ট শহরতলীর সবাই ওকে চেনে। ও গানপাগলা, ও নামেই সবাই জানে ওকে। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়ায় কিন্তু ভিখারী নয়। কারো কাছে কিছু চায় না। কারো দিকে মুখ তুলে তাকায়না অবধি। কারো সাথে কথাও বলে না। কেউ যত্ন করে খাওয়ালে খায় নয়ত আপনমনে গান গায়, কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। নিজের মনে কথা বলে কিন্তু কেউ কাছাকাছি গেলে চুপ করে যায়। ও যে পাগল তাও নয়। খালি এক ইউটোপিয়ার জগতে বাস করে। প্রতি বছরই একটা নির্দ্দিষ্ট দিনে ভোররাত থেকে মাঝরাত অবধি এই কবরখানর বাইরে রেলিং-এর ধারে বসে কার জন্য যেন অধীর প্রতীক্ষা করে কিন্তু ভুলেও ভেতরে উঁকিটুকু অবধি দেয়না। ঢোকা তো দুরঅস্ত। সারাদিন কেউ জলটুকু খাওয়াতে পারে না। পরদিন থকে আবার ভুলেও কবরখানার রাস্তার ধারেকাছেও দেখা যায়না ওকে।


(২)

মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসার তাড়া নেই। কেবল ছুটি। বাবা বলেছিলেন আগামী সপ্তাহে বাড়ীর সবাইকে নিয়ে দার্জিলিং যাওয়া হবে। কিন্তু হঠাৎ করে ঠাকুমার শরীর খারাপ হয়ে পড়ায় সব বাতিল। মন খারাপ করে আশা তাই একা একা চলে এসেছে বাড়ীর প্রশস্ত ছাদে। আকাশে তারার মেলা বসেছে,কিন্তু চাঁদ নেই,কিছুটা ঝিরিঝিরি বাতাস ও আছে,মনটা বেশ ভালো হয়ে যায় আশার।আশে পাশের তেমন কেউ নেই,আর অন্ধকারে এত কিছু ভালো করে দেখাও যাচ্ছেনা,আশা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নেয়...…”আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি”…

আশা চোখ খোলে না,একটু অবাক হয়ে আবার খেয়াল করে, কে গাইছে গানটা?এত দরদ দিয়ে,আবার কানে আসে...মনে হচ্ছে আশে পাশেই কোথাও কেউ গাইছে।চোখ বন্ধ করেই আশা গানটা শুনতে থাকে,আস্তে আস্তে মনটা অনেক ভালো হয়ে যায় ওর।

…”কেন আরো ভালোবেসে পারেনা হৃদয়”…

কে গাইছে গানটা?! আশা চোখ খুলে চারপাশে তাকায়,নাহ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না,কিন্তু মনে হচ্ছে খুব পাশেই কেউ গাইছে, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ীর ছাদের অন্যপ্রান্তে চলে আসে আশা, নদীর দিকে, আরে একি?!!! সেই ভ্যাগাবন্ড ছেলেটা!! রহিমপুরার মসজিদের কাছাকাছি কোথাও থাকে। আশাকে দেখলেই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে যতক্ষন দেখা যায়। আশা টের পায় শুধু ওকে একনজর দেখার জন্যই দিনে দুপুরে ভর রোদে কি বৃষ্টি মাথায় ছেলেটা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে স্কুলের সামনে, টিউশন স্যারের বাড়ীর মোড়ে, ওদের বাড়ীর সমনের চায়ের দোকানে। কিছু বলে না। খালি বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। তবে খারাপ লাগে না আশার। কোন অস্বস্তি বোধ হয়না ওর দৃষ্টিতে। বরঞ্চ অবচেতনে এক ভালোলাগাতেই ছেয়ে যায় ওর কিশোরী মন। গান তাহলে ওই গাইছে? এত দিন হয়ে গেল, ছেলেটা এত সুন্দর গান গাইতে জানে সেটা তো আশা জানতো না! ছেলেটা চোখ বন্ধ করে খুব দরদ দিয়ে গান গাইছে,অন্ধকারে ভালোভাবে দেখা না গেলেও আশার মনে হল যেন ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আশা অবাক হয়ে দেখতে লাগল কন্ঠে দরদ আর চোখে জল...মানুষ কিভাবে পারে?!!কার কথা ভেবে এভাবে কাঁদছে ও? খুব জানতে ইচ্ছে করে আশার।তখনই নীচ থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসে। স্বপ্নালু ভালোলাগাটুকু মুঠোয় পুরে নীচে নেমে যায় আশা।

সেই প্রথম আশা বুঝলো ভালোবাসা কি। আশা আর মানিকের বিশেষ সম্পর্কটা কাছাকাছি থাকা, হাত ধরা, লোকচক্ষুর আড়ালে, গাছের ছায়ায়,পার্কের অন্ধকারে ,পোড়ো বাড়ীর নিরাপদ চৌহদ্দীতে, গল্প-গুজব এসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত।কথায় বলে নেশানগরীর অলিতে গলিতে ...মৃত্যু,আর ভালোবাসার নেশা তো সর্বনাশা। সেই সর্বনাশা টানেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাড়ীর অমতে ঘর পালিয়ে বিয়ে করেছিল আশা-মানিক। মানিকের আশিয়া আর আশার সোনামন। দিব্যি সুখের সংসার, নতুন গেরস্থালী, রঙিন প্রজাপতি মন আর হাজার স্বপ্ন। সে সুখ, সুখ পায়রা হয়ে উড়ান দিল বড্ড তাড়াতাড়ি। বিয়ের দুবছরের মাথায় ছয়মাসের শিশু আমন আর আমনের মা আশিয়াকে নিয়ে রিকশায় করে সিনেমা দেখতে যাবার সময় কালান্তক এক মালবোঝাই লরীর ধাক্কা ওদের সুখী গৃহস্থলীকে চিরদিনের মত ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আশিয়া আর আশিয়ার দুহাতে জড়ানো বাচ্চাটাকে আলাদা করে চেনার উপায় ছিলনা। নাঃ নিজের চোখে সে নারকীয় দৃশ্য দেখেনি মানিক,দেখতে হয়নি, ও তো নিজেই তখন আই সি ইউ তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ওর পুরোপুরি জ্ঞান আসার আগেই ধর্মীয় রীতি মেনে আশিয়াদের শেষকাজটা হয়ে গেছিল।

তারপরও শহরের প্রতিটি জানালায় উঁকি দিয়ে গেছে প্রতিটি নতুন দিনের চুমুকভরা কিশলয় রোদ্দুর। তবু আশিয়া আর ফিরে আসেনি। কোন কোন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেত। যেন সেই চিরচেনা কণ্ঠস্বরের আওয়াজ শুনতে পেত সে। “সোনা, আমার সোনামন”..গভীর রাতে চিরচেনা বিছানার মাঝখানে বসে দিশেহারার মত এদিক ওদিক চাইতে গিয়ে একটা সময় মনে হত, সে বসে আছে দুরান্তরের বিজন কোন এক স্বপ্নের দ্বীপে...মানসিক অস্থিরতাটা এক কালান্তক ব্যাধির মত ছেয়ে ফেলেছিল তাকে। আশিয়াহীন মনের হাহাকার , চৌচির ভাঙ্গন, এক সময়ে রূপ নিয়েছিল মানসিক বিষাদে, আপাত উম্মত্ততায়, হ্যালুসিনেসনে । আশিয়া যে আর কোনদিন ফিরবেনা এটা মন থেকে মেনে নিতে না পারায় ওর পৃথিবীটা স্থিতিশীল হয়ে যায়। সেখানেই থমকে দাঁড়ায় সময়। আদি অন্তহীন এক নির্মম প্রতীক্ষায় ও বুঝি মানুষ থেকে পাথরই হয়ে যায়। এরপর প্রতিটি বছর ধরে সেই একই দিনে কবরস্হানের বাইরেই রেলিংটায় হেলান দিয়ে বসে থাকে মানিক অলৌকিক এক প্রত্যাশার আশায়। মানিকের পাওয়া না পাওয়ার যত প্রতীক্ষার আগল, নিজেকে নিজের ভুলিয়ে রাখার যাবতীয় কল্পনার জগতটা প্রতিবছর এই দিনে এখানে এসেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। এখন সবার মত আমিও জানি, আগামী বছরটাতেও একই দৃশ্য এইদিনে ঠিক একভাবেই ফিরে আসবে। যতদিন না মানিককে কেউ কাঁধে চাপিয়ে গেট পেরিয়ে নিয়ে যাবে আশিয়ার পাশে। শেষ বিশ্রামে।

ছোটগল্প - পূজা মৈত্র

নিজের মুখোমুখি
পূজা মৈত্র


বাড়ি ফিরতে বেশ দেরিই হয়ে গেল। রূপসা আটটার মধ্যেই ফিরে যেত। কিন্তু মেট্রোটা মিস করলো। এসপ্ল্যানেডে প্রতিবাদ মিছিলটা ছিল। মৌন প্রতিবাদ, মোমবাতি মিছিল। দিল্লীর ধর্ষণের ঘটনার জন্য। দামিনীর জন্য। ঘড়ি দেখল রূপসা। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। জানুয়ারীর প্রথম। বেশ শীত পড়েছে। যতীন দাস পার্ক মেট্রো থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ ওদের ফ্ল্যাট। তাড়াতাড়ি হবে বলে গলিপথ ধরল। গলিতে ঢুকেই বুকটা ধক করে উঠল। একদম শুনশান আজ। শীতের দাপটে যে যার ঘরে। চাদরটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিল। দিল্লী, কোলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই- সব শহরেই নারীরা বিপন্ন আজ।

ডোরবেলের প্রত্যুত্তরে ছায়ামাসি দরজা খুলবে ভেবেছিল। স্বরাজকে দেখে একটু থমকাল রূপসা। চেম্বার থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে? ফোন করেনি তো? স্বরাজের চোখের ভাষা থমথমে। চোয়াল কঠিন।

____ সরি, লেট হয়ে গেল। মেট্রোটা মিস না করলে...

স্বরাজ হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল---- লেম এক্সকিউজ দিয়ো না, তুতান স্টাডিতে আছে। তোমার জন্য ওয়েট করছে। সম্ভবত ওকে কয়েকটা হোমওয়ার্ক করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল তোমার----

রূপসা হাউসওয়াইফ। স্বরাজ প্রতিষ্ঠিত সার্জেন। অঢেল উপার্জন করে। তাই ঘর সামলানো, ছেলে পড়ানো সব দায় রূপসার। এর পাশাপাশি একটা এন.জি.ও , একটা নারী সংগঠন করে। যাদের আহ্বানেই আজ মিছিলে গিয়েছিল।

------ ছিল। আমি করিয়ে দেব। আই উইল ম্যানেজ...

----- কথা না বাড়িয়ে যাও... স্বরাজের গলায় এমন কিছু ছিল যা রূপসাকে চুপ করিয়ে দিল।

আজ কোন কিছুতেই মন বসছিল না রূপসার। দামিনীর খবরটা শোনার পর থেকেই মন ভাল নেই। আজ মিছিলে গিয়ে আশাবাদের জায়গায় নিরাশা ঘিরে ধরেছে। মোমবাতির নরম আলোর মৌন প্রতিবাদে কি আদৌ কোন প্রভাব পড়ে? মানুষ তো আজ নরপশু। নইলে পাশবিক অত্যাচারের পরেও লোহার রড! দামিনীর কান্না মাঝে মাঝেই কানে ভাসছে। আজ বলে তো নয়, ধর্ষণ চিরদিনই ছিল। এখন বিকৃত কামের বাড়বাড়ন্ত। নীল ভিডিও মোবাইলে মোবাইলে। নারীকে সেখানে ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখানো হয়। কিশোর বয়স থেকেই সেই দৃষ্টিভঙ্গি মনে বাসা বাঁধে। স্বল্পবসনা হিরোইনরা রূপোলী পর্দা থেকে হাতছানি দেওয়ায় কল্পনার ঘোড়া লাগাম ছাড়া হয়। আর হামলার শিকার হয় নিরীহ পথচলতি মেয়েটি। এর শেষ কোথায়? পুরুষের মানসিকতা না বদলালে ধর্ষণ রোখা কি আদৌ সম্ভব? আর মানসিকতা বদলের কোন সম্ভবনাও খুব কম। আগে সব চাপা থাকত, এখন মিডিয়া আছে বলে...

স্বরাজ সারাক্ষণ চুপচাপ ছিল। রূপসার সাথে ভালভাবে কথা বলছিল না। রূপসা জানে ও কোন অন্যায় করেনি। আজ মিছিলে না গেলে, সবার সাথে না হাঁটলে যে টুকু প্রতিরোধ গড়ে উঠছে সেটুকুও হত না। নিজের কাছে নিজে মরমে মরে থাকতো। তুতানকে তো রোজই পড়ায়। আজকেও পড়িয়েছে। কোন অযত্নই হতে দেয়নি কখনো। একার হাতে করেই তো দশ বছরের করে তুলেছে। স্বরাজ সময় পেয়েছে সাহায্য করার? তাহলে আজ সামান্য দেরীর জন্য এত রাগ দেখাচ্ছে কেন?

তুতানের মুখ শুরুতে ভার থাকলেও, এখন আবার স্বাভাবিক। মাম্মা দেরী করে ফিরলেও সবকটা কথা রেখেছে। রাতে তুতানকে ঘুম পারাবে বলেছিল, সেটাও করেছে। তুতান নিজের ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এখন।

নিজেদের ঘরে গেল রূপসা। স্বরাজ লেপের মধ্যে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। রূপসা কথা বলল না। এমনিতেই মেয়েটার জন্য মন খারাপ, তার উপর স্বরাজের ব্যবহার। বিছানায় নিজের পাশে শুয়ে পড়ল ও। চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ঘুমের বদলে চিন্তার স্রোত মাথায় ভিড় করছিল।

স্বরাজের স্পর্শে চমকে উঠল রূপসা। এ স্পর্শ ওর চেনা। স্বরাজ মিলন চায়। অন্যান্য দিন হলে রূপসা আপত্তি করত না।আজকের পরিস্থিতিটাই যে অন্য!

___ স্বরাজ স্টপ ইট! স্বরাজ রূপসার দিকে কঠিন চোখে তাকাল

___ কেন?

____ আমার মুড নেই তাই। আয়াম নট ইন আ মুড। রূপসা স্বরাজকে সরিয়ে দিতে চাইল। অন্য দিন হলে স্বরাজ সরে যেত। কিন্তু আজ সরল না। দ্বিগুন জোরে রূপসার প্রতিরোধ ভাঙ্গতে থাকল।

____ বাট আয়াম ইন আ মুড। তাই তোমার কোন আপত্তি শুনতে চাই না।

রূপসা অবাক চোখে স্বরাজের দিকে তাকাল। বারো বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম বার স্বরাজ জোর করছে। রূপসার চোখের ভাষা স্বরাজ বুঝেও বুঝল না। রূপসার আবরণ সরাতে সরাতে ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলল

____ চেঁচাবে নাকি? তুতান জেগে যাবে কিন্তু...

রূপসা আর বাধা দিল না। ছটফট করল না। উফ টুকুও করল না। নিজের বিশ্বাস চোখের সামনে ভেঙ্গে যেতে দেখলে মানুষ বোবা হয়ে যায়। তৃপ্ত স্বরাজ বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে লক্ষ্য করল রূপসা কাঁদছে।

___ কাম অন। এতে কাঁদবার কি হল? নতুন নাকি? ওঃ! তুমি তো আবার নারীবাদী। তা এটাও রেপ, নাকি? কোথায় পড়ছিলাম যেন, এর জন্যও শাস্তি হওয়া উচিত বলে তোমরা দাবি তুলেছ? পেপারেই মনে হয়। গালভরা নামও দিয়েছ, ম্যারিটাল রেপ! হাইট অফ ফুলিশনেস। নিজের বউকে লা... আই মিন নিজের বউয়ের সাথে সেক্স করবে, তাও নাকি রেপ? ম্যারেজের সংজ্ঞা-ই বদলে দেবেন এরা! দ্যাখো, তুমি-ই সবার আগে চেষ্টা করে দ্যাখো, যদি আমাকে শাস্তি দেওয়াতে পারো...। ইউ উইল বি আ পাইওনিয়ার দেন।

হতবাক রূপসাকে ফেলে স্বরাজ বাথরুমে চলে গেল।

কবিতা - বৈজয়ন্ত রাহা

স্বপ্নহীন শেষ রাস্তায় ...
বৈজয়ন্ত রাহা


আমি মনের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিলাম
প্রাচীন আসবাবের ভিতর থেকে কারা যেন ফিসফাস করে কথা বলছিল--
আকাশের কথা, জলের কথা, জল রঙ এর কথা, ঘরের কথা,
উড়তে চাওয়া প্রজাপতির মুখ থুবড়ে পড়ার কথা,
দূর থেকে ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ ভেসে এলো...
আমি, হাত বাড়িয়ে সাইরেন কে ধরতে চাইলাম, আঙ্গুল কে ছুঁতে চাইলাম, মনের--
আর অমনি আমি ডুবে যেতে লাগলাম, অন্তহীন...
কে যেন, কপালে হাত ছোঁয়াল, ভিজে ভিজে দিন আমার বুকের উপর মাথা রেখে শুল,
কে যেন, আলতো করে আমার চোখের মেঘে ঠোঁট ছোঁয়াল ,
আমার হাত ভর্তি বালি, হাওয়ায় উড়ে যেতে লাগল,
আকাশের রঙ লাল হয়ে উঠল, শরীরে সমুদ্র গর্জন করে উঠল,
আমি তাকে প্রানপণে নিজের দিকে টানতে চাইলাম,
আমি বলতে চাইলাম---আর কখনও আমাকে ছেড়ে যেও না,
ঝড় উঠবে, বিদ্যুৎ চমকাবে, তোমাকে আমার দরকার, ভীষণ, সর্বক্ষণ...
আমাকে ছেড়ে যেও না...

বরফ আর আগুন ধীরে ধীরে স্থির হয়ে গেল,

আমি তখনও হেঁটে যাচ্ছিলাম, একেবারে জনশুন্য হয়ে, পৃথিবীর শেষ রাস্তায়...

কবিতা - শেখর রায়

ছড়া
শেখর রায়


ভাত ঘুম
চাকুম চুকুম
ঢাক ঢোল
হরি বোল
মেঘ বৃষ্টি
মিষ্টি মিষ্টি
আকাশ নীল
শঙ্খ চিল
মেয়েদের স্কুল
সাইকেল এর পথ ভুল
মরন বাঁচন
সুতোয় নাচন
কথা শেষ
রয়েছে রেশ । 


কবিতা - আহুতি ভট্টাচার্য

কোনদিকে শালবন
আহুতি ভট্টাচার্য


দরজা পেরিয়ে কোনদিকে যাই কি করি
যেমন ধরো বলতে পারি দীর্ঘায়ু হও অন্ধকার,
সহিষ্ণু হও আলো তোমায় স্বাগত
তোমায় জানাতে পারছিনা বলে ।
আমরা ঘনিষ্ঠ হব অনেককাল বাদ
পছন্দের জায়গা শালবনে গিয়ে দৃষ্টি ঠেকে।

প্রজাপতিরা যে যেখানে আছো
ঠিক তেমনি ভাবেই থাকো,
মানুষের গন্ধ লাগবে না গায়ে
দূর থেকে দেখেই চলে আসবো।

এই মুহূর্তে যখন আমি প্রজাপতির কথা ভাবছি,
রামধনু এসে যাচ্ছে
তবে কি ডানায় মিশে গেছে রামধনু?
‘মতিভ্রম হয়েছে মেয়ের’ লোকে বলে
না কি দৃষ্টিভ্রম হল?

আলো ও অন্ধকার, ধন্যবাদ তোমাদের
মতি ও দৃষ্টি নিয়ে যে ভ্রম, আপাততঃ থাক,
তার চেয়ে ভেবে নিই আসন্ন যাত্রার কথা ।

পুরুষ ও পাহাড়, তোমাদের ইতিহাস বলো
স্বল্প ব্যাবধানে তোমাদেরই দ্বারে প্রার্থী হব।

কবিতা - অলোক চৌধুরী

তোকে আটকাব না
অলোক চৌধুরী


যদি চলে যেতে চাস, যা......
আর বাধা দেব না তোকে।
ব্যাথায় ভাঙবে বুক,
কুঁকড়ে যাবে মনটা।
তবু নিজেকে ধরে রেখে,
আর তোকে আটকাব না....।

অনেকদিন ছিলি সাথে,
অনেক কথা হয়ছে বলা।
নিয়মের শৃঙ্খল ভেঙে,
মন নিয়ে তোর ছিনিমিনি খেলা।
জানি এবার তুই চাইবি যেতে, যা
আর তোকে আটকাব না....।

যেখানেই যাস ভাল থাকিস,
আমাকে মনে রাখিস বা না রাখিস,
সুখে থাকিস।
আমিও চলে যাব বহুদূরে,
সব কিছু ছেড়ে।
তাই আর তোকে আটকাব না....।

কবিতা - অনিন্দিতা দাসগুপ্তা

অব্যক্ত
অনিন্দিতা দাসগুপ্তা


আমার ভিতরে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা
বার বার চিৎকার করে বলে ,
আমি আছি, আমি থাকব তোমার পাশে,
ছেড়ে যাব না তোমায়, নিশ্চিন্তে থাকো;
তোমার সেই বন্ধুর মতো নই গো আমি
যার কথা ভেবে আজও আসে তোমার চোখে জল--
কই? আমার জন্য তো কখনও জল দেখিনা তোমার চোখে ?
কত রাত তার কথা ভেবে কাটিয়ে দিয়েছ তুমি !
সেই রাতজাগার মুহূর্তে সব সময় পাশে ছিলাম আমি,
অথচ দেখ, আমার দিকে ফিরেও তাকাও নি কোনদিন
আর সে কিন্তু রাতের পর রাত
তার সঙ্গিনীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে;
এক বারের জন্য তোমাকে মনে পড়েনি তার।
আমি, আমি কিন্তু সঙ্গ ছাড়ি নি তোমার...

তোমার অবহেলা মেনে নিয়েই
তোমার সঙ্গে থাকার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছি আমি,
ভালোবাসা সঙ্গে নাই বা থাকল ,
যন্ত্রণা তোমার সঙ্গ ছাড়বে না সারাজীবন;
কথা দিলাম । 


কবিতা - অনুপম দাসশর্মা

দিশার দূর্দশা
অনুপম দাসশর্মা


তেমন করে আর বাঁশি বাজে না
আজানের ডাকে ভাসে না চিমনী
তবু প্রত্যাশা নিঁভাজ কপালে শ্বাস ফেলে
'যদি'র কাঁধে মাথা রেখে
নিমডাল চিবোয়।

তেমন করে আর বিহ্বলতা লজ্জায় ফেলে না
আব্রু বাঁচিয়ে কদম পায়ে পিছনে ডাকো না
পালকের পর্দায় নিতম্ব এগিয়ে
শিরায় সুনামি আনো।

এমন করেই বিহু উৎসব খেউর রাগে ভাসবে
ভাসুক, হাসুক বৃহন্নলা
আস্তাবলে চাঁদের সাথে জমবে জীবন জুয়া
কবিতা সহবাসে সম্মত
শর্ত রেখেছি, ধ্বংস করবো
অপদার্থ বিড়ম্বনার কল্পিত শক্তিমান।

কবিতা - নবনীতা সেন

আমায় মন্দ বোলো
নবনীতা সেন


তোমরা আমায় মন্দ-ই বোলো
ধাতে আমার সয়না ভালো ।
বেঠিক-টা রেখে আমার জন্য
সঠিক ভাই তুমিই থেকো ।

দিন বদলের পালা এলেও
মন্দ কপাল আমার বদলায় না ।
স্বপ্ন কেবল চোখেই ভাসে
বাস্তব হয়ে ওঠে না ।

উদ্ভট যত কীর্তিকলাপ
রেখো সবই আমার নামে ।
তোমরা আমায় মন্দ-ই বোলো
ভালো যে আমার সয়না ধাতে ।


কবিতা - চৈতালী গোস্বামী

জলের মত উদাস হতে চাই
চৈতালী গোস্বামী


জলের মত উদাস হতে চাই
জলের মত হতে চেয়ে
হৃদয়ের বাঁকে বাঁকে,
আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে তৈরী হয়
বর্ণময় চিত্রকল্প
তারই একপাশে হাঁটু মুড়ে বসে
তাকিয়ে রয়েছি অস্থির মগ্নতায়।

নির্মাণ বিনির্মাণের খেলা চলে।

আজও কোন হাসি মনোরম মনে হলে
মৃতের চোখের মত দুটি চোখ নিয়ে
বেঁচে বা মরে যেতে পারি...

কবিতা - রূপময় ভট্টাচার্য

যৌনতা
রূপময় ভট্টাচার্য


তুমিও একটু পাগল আছো
আমিও খানিক মৃদুভাষী
হিসেব কষেই দেখব না হয়
কে কতটা ভালোবাসি

হিসেব কষেই বানান লিখব
বিছানা বা আড়াল খুঁজে
শরীর এবং থার্মোমিটার
উষ্ণ হবে যোনির ভাঁজে

তুমিও আরো পাগল হবে
আমিও,আরো মৃদুভাষী
বুঝবো শরীর মাপার চলে
কে কতোটা ভালবাসি !

কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

শামুক জন্ম
ঊষসী ভট্টাচার্য


ঘুমের ওষুধ খাওয়ার চল বহুদিনের
রাতের অ্যান্টাসিড হজমে বিষাক্ত,
হলুদ মাকড়সা রক্তে জাল বোনে
নীল সুতোর !

লালা ঝরে পড়ে
বুনো আকাঙ্খিত ঘুমের।

দুচোখে আজকাল চশমার আকাল,
আমাদের সভ্যতার ধুলোর বড় বাড়াবাড়ি,
ঘুমের আয়োজন মানেই সেই
ঠাম্মার হাত পাখা, রূপকথা...
জাগরণ ই যখন
বিলাস বহুল স্বপ্ন
স্লিপিং পিলও তখন অপ্রয়োজনীয় গন্তব্য !
পোড়াকাঠ বাসর ঘর,
চিতা ঘুমের তফাৎ কেবল তাই অভিধানেই !

কবিতা - দেবাশিস কাঞ্জিলাল

আমাকে দেখুন
দেবাশিস কাঞ্জিলাল


কথা বলার চাইতে আজকাল
শুনতে কথা ভালো লাগে বেশ।

ফেসবুকেতে,বাজার হাটে,
এদিক-ওদিক,ঘাটে মাঠে,
সবাই বলে চলছে কত কথা,
আকাশ জুড়ে শুধুই কথকতা।

সেই সব কথারই পিছন থেকে
একটি মাত্র বানী আসে ভেসে,--

দেখো আমায়,এই যে আমি,
এই জগতের সকল জানি,
চাঁদের কলা,ব্রহ্ম-কমল,
সমুদ্রের গভীর-অতল,
প্রেম-বিরহ,বসন্তকাল
মালকোষ,কি তান ঝাঁপতাল,
রবিঠাকুর কিম্বা লাদেন
স্বপ্নে আমায় রোজ দেখা দেন,
জানি শ্রেষ্ঠ যত সব রান্না,
শোক দেখিয়ে মড়া-কান্না
সবার থেকে ভালো পারি,
মোনালিসা আঁকি আমি
সে তো বাঁ-আঙ্গুলের তুড়ি !

আরো অনেক কিছু পাবে,
তার লিষ্ট যেহেতু বড়ো হবে,
তাই বলছি না আর তেমন কিছু
হয়ে থেকে আমার কাছে নীচু,
তোমরা শুধু আমায় দেখো
শুধুই আমার কাছে শেখো।

শুনে সব আকাশ-ছোঁয়া দম্ভ,
হীনমন্যে হয়ে হতভম্ব,
এইটুকু আজ বুঝতে পারি মাত্র,
আমি চিরকালই রয়ে যাব ছাত্র !

কবিতা - দেবাশিস মিত্র

তৃপ্ত
দেবাশিস মিত্র


তখনও শিখা তির তির করে কাঁপছিল
কোন এক অজানা আশঙ্কায় ,
আকাশের গর্জন , বৃষ্টির ধারা
মিলেমিশে করে তুলেছিল আরও রহস্যময়;
সে বসে ভাবছিল তার অদৃষ্টের লিখন
যদি সে ধরা পড়ে যায় ...
তখন ও বৃষ্টি আসেনি
যখন সে এসেছিল দমকা হাওয়া হয়ে ,
কি প্রচন্ড তার তেজ
কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব এলোমেলো করে দিল--
আমি পারলাম না
ধরা দিলাম—সেই প্রচন্ড আহ্বানের কাছে
আমি ভেসে গেলাম, দাঁড় ভাঙ্গা নৌকার মতো
কুল নাই, কিনারা নাই,
চারিধার শুধু অতল কলো অমানিশির মতো,
ঝড়ের আওয়াজ, বৃষ্টির আওয়াজ,
সব মিলে হয়ে উঠেছে স্বর্গীয় ঝঙ্কার ,
এক এক করে সব অলঙ্কার খুলে যেতে লাগল,
অবশেষে ঝড় থামল,
চেরা মেঘের ফাঁকে চাঁদের হাসি বলে দিল
সব তৃপ্ত। 


কবিতা - দেবাশীষ সেন

জীবনডুবি
দেবাশীষ সেন


(১)

মধ্যরাত
আকস্মাত
হয় উন্মাদ,

অতর্কিতে
স্মৃতিতে
ইথার সংবাদ।

পিছুটানে
আনচানে
ধূসর অতীত,

হৃদয় তলে
অশ্রুজলে
নিস্তব্ধ সংগীত।

ক্লান্তিহীন
নিদ্রাহীন
নিশ্চুপ রাতে,

তোমার
আমার
কথকথা মাতে।

সময়কাল
ভুলভাল
অগোছালো কষ্ট,

চুপিচুপি
জীবনডুবি
মধ্যরাত নষ্ট।

অবহেলায়
নাগরদোলায়
এলোমেলো খুশি,

মরণজালে
মনপাতালে
মধ্যরাত এলোকেশী।



(২)

দিকভ্রান্ত
অবিশ্রান্ত
স্মৃতির ধারাপাত,

চোরাগলিতে
ঘুলঘুলিতে
গোলোকধাঁধা মধ্যরাত।

অর্ধমতি
উর্ধ্বগতি
ইশারার উস্কানি,

অর্ধমৃত
উদ্বেলিত
পূর্ণাহুতির হাতছানি।

উপাসনায়
আবর্জনায়
ছককাটা ফন্দি,

জন্মান্তরে
যুগান্তরে
মধ্যরাত বন্দী।

মধ্যরাত
অগ্ন্যুৎপাত
নীহারিকার ছবি,

নিরুত্তরে
অন্ধকারে বানভাসি জীবনডুবি।।


কবিতা - দিব্যেন্দু দে সরকার

সামাজিক কাজ
দিব্যেন্দু দে সরকার


সমাজে সামাজিক কাজ বন্ধু তুমিও করো,
রাজনীতির নোংরামি'টা সরাতে আমাদের হাত ধরো।
প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়বো আমরা অন্যায়ের বিরুধ্যে,
দল-টল,জাত-পাত মানিনা মোরা,থাকবো সবার মধ্যে।

কবিতা - ইন্দিরা দাশ

ইচ্ছে পৃথিবী
ইন্দিরা দাশ


চলো ‘দিতি’
আজ তোমাকে নিয়েই যাই নাইট শো’ টাতে
বিশ্বাস কর
জামাখলা ছেলে কিছু কিছু
নেবে নাকো পিছু।

শোনো দিতি
এবারেতে দীঘা গেলে
রাত্রির সবকটা ঢেউ
গুনে নেব তুমি আমি মিলে
ষণ্ডা তিনটে লোক কক্ষনও চাইবে না ছুঁতে তোমার বক্ষবন্ধনী
দিতি, আমি ঠিক জানি।

চলো দিতি, এই বার আষাঢ়ের শুরুটাতে
আউট্রামঘাট ধরে ... ছাতাটাতা ধার দিয়ে দুষ্টু হাওয়াকে
আমরা ভিজব খুব ... মেঘমধু মেখে
ভয় পেয়োনাকো
লোভী চকচকে চোখ খোঁজাখুঁজি করবে না ভেজা পোশাকের
আনাচে কানাচে গুপ্তধন
জান দিতি ... দিন বদলেছে, ... বদলেছে মন।

ঠিক করেই রেখেছি, পরশু’র বেড়ানোর অবশেষে
ইডেনে’তে বসে
গান ধরে নেব আমি তুমি আমি গলা ছেড়ে
‘রিমঝিম ঘন ঘন রে’
পুলিশকাকুরা এলে বাদামভাজাই দুমুঠো চাইবে বড়জোর –
লজেন্সদাদাটা মিঠে হেসে
রানাঘাট লোকালের রসকলি বাউলনী’র গল্পটা শনাবে আবার
যদি পায় অবসর।

এই দিতি, লক্ষ্মীটি
সামনের গরমেতে ধামসানমাদলের ছুটিটাতে, সন্ধে ঘন হলেও
শালবনে ভোজালি-টোজালি নিয়ে আর কেউ ঘোরেনাকো, জানো,
ঠোঁট ছুঁয়ে গেলে প্রেম, প্রেমই শুধু ছুঁয়ে যাবে ঠোঁট
সেই সব তাণ্ডবের দিন গেছে চলে
ঠান্ডা হয়েছে লাভাস্রোত গলে গলে।
সে দিনের নীল ব্যথাময় যোনিদ্বার
নাই আর রাখলে গো মনে
দেখ, ভালবাসা তারাফুল ফুটে আছে আকাশের সব কোণে কোণে।
জেনো বিশ্বাসই পুরুষরা শক্ত আড়ালে আগলে রাখবে তোমাকে
এ গ্রহ বাঁচাতে
তুমিই, তুমিই যে প্রাণ দিতে পারো
আগত যে তাকে।

জানো অদিতি,
আর কোনও কুঁড়ি ডাল থেকে যাবে না গো ঝরে
যতটুকু রূপ-রং-গন্ধ দেবে ফুল হয়ে তুমি
তাতেই পৃথিবী যাবে ভরে।

কবিতা - জয় ভট্টাচার্য

রক্তবীজ-এ রাঙা মাছ
জয় ভট্টাচার্য



সমুদ্র ঢেউ-এর গর্জন,
কোন অক্ষর বা শব্দ দিয়ে
বোঝাতে পারবো না তোমায়-
যেটা পারতাম তা হ'লো,

সেই সমুদ্র
নীলাকাশ সচ্ছতা
আমাদের মাঝে রেখে দিতে...

নুলিয়ার জালে আটকে থাকা
অচেনা মাছের
কানকোয় জমে থাকা প্রেম

সূর্যাস্তে লুটোয়...
আর সমুদ্রতটে ভিজে বালি-তে

তোমার শরীরের প্রতিটি
ভাঁজ, খাঁজ

আমার কবিতার বিষয় হ'য়ে ওঠে...

তুমি আমি সকলেই
নুলিয়ার জাল ছিঁড়ে

যদি আবার ভেসে যাই সমুদ্রে
তোমাকেই শোনাতে পারি
সেই সমুদ্র গর্জন; আর
দেখাতে পারি মাছের
কানকোয় উপুর ক'রে ঢেলে দেয়া

আমার প্রাত্যহিক প্রেম...

কবিতা - শ্রীমন্ত সিকদার

উপাসনা
শ্রীমন্ত সিকদার



জন্মান্তরে দেখা হলেও আমি ঠিক চিনে নেব,
ঘটি-থালার ভিতর রাখা ফুলের সাজি,আর
শরীর ভর্তি বিবাহ।

তুমি শুধু ব্যাবহারের অনুমতি দিয়েছ,
তবু আমি চেয়ে গেছি আরো সমর্পণ!

বুঝিনি তোমার ভিতরে তুমিই ছিলে উপাসনাগৃহ, সর্বক্ষণ।



কবিতা - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

সেরকম নয়
শর্মিষ্ঠা ঘোষ



সর্বগ্রাসী কথার কথা , নদী মোটেই এমন নয়
দেবার জিনিস নেবার হিসেব টনটনা

গর্ভফুলের যোগ সুতোটা অস্থি ভস্ম
তোমার আমার আপনজনের শেষ পারানি
অবলীলায় ঢুকিয়ে ন্যায় তার দেরাজে
সেই তালাটার চাবির খবর মাটির কাছে

সর্বসহা কথার কথা , আমার নদী তেমন নয়
হয় কথাতে নয় কথাতে ঠোঁট ফোলায়

ক্লিভেজ এবং সুগন্ধী ধূপ এরীয়লায় মুখ লুকোনো
টিনএজ ক্রাশ আমার নদী ছদ্মবেশী
এই আদরে উদ্দাম সুখ পায়রা বকম
পরক্ষণেই " ধুত্তোর যা ", নাকাল ডোবায়

ভুল বুঝনা , নদীর মুখোশ পলেস্তারা যেমন যেমন
নদী বড় প্রেমপিপাসু ভেতর ভেতর

বুকের কাছে বসত থেকে কি লাভ যদি
আর্তডাকে আত্মঘাতী ঘুম না ভাঙ্গে
বন্ধুজনে ধর্ষকামী ক্লেদ বাড়ালে
ভাঙ্গনচোখে আমার নদী একলা দোষী ?

কবিতা - শমীক সেনগুপ্ত

নব-প্রভাত
শমীক সেনগুপ্ত



ভোররাত থেকে শুধুই ধর্ণা দিল...

দলিল যত লোপাট করেছে কাল-
এখন শুধুই অনন্ত হাতছানি;
দুহাতে কেবল এলোমেলো জঞ্জাল।।
ভেবেছি এবার এসেছে বুঝি বা দিন...
শোণিতে ধ্বনিতে উত্তাল হবে মন
আশার দিয়া ঘসে চলি আলাদীন;
পোড়া বাংলায় হয়নি উত্তরণ !!
মহাকাল তুমি গ্রাস করে নিলে যাকে-
তাকেই আনব জিনেতে আগুন জ্বেলে..
শহবাগ জুড়ে একটাই কলি ফুল-
মায়ের দুধের বার্তা এনে দিলে।।
এখনো লড়াই নিজের সঙ্গে চলে...
আমার এবং আমাদের নিয়ে দাবী ...
তেভাগা থেকে সিঙ্গুর ছিট-মহল;
রক্তে রক্তে আমাকেই খুঁজে পাবি।।
সে আমি হয় ত' বসিনি শব্দ নিয়ে
সে আমি হয় ত আমারই কোন ভাই;
জন সমক্ষে একটাই ছিল কথা...
শান্তিতে নয় প্রতিবাদে তোকে চাই-
বন্ধুর মত,ভাই এর মত হয়ে
একটু যদি সবাই বাড়াবো হাত...
আমরা ভাঙা বাংলার বুকে তবে;
হয়তো আসবে আবার নব-প্রভাত ।।

খবিতা - শ্যাম রায়

ঠেকে শিখে হুঁশবোধ
শ্যাম রায়


বন্য আদিমতা
এ ডাল ও ডাল ,
মধ্যযুগীয় সভ্যতা
লালসায় লাল ...

বর্তমানের প্রেক্ষাপট
ভার্চুয়াল জগৎ ,
ভুলে গিয়ে সব কিছু্
গ্যাজেটে তে আটক ,

বৃদ্ধ পিতা মাতা
একাকীত্ব ভারি
ব্যস্ততার আলিঙ্গনে
শুধু তাই Sorry !

সময়েতে নেই খোঁজ
মোবাইলে দরদ
কি আর যায় করা
কর্ম ব্যস্ত মরদ্ ...

ভালোবাসি ভালোবাসি
ভাল বাসা দূর
সাত সমুদ্র তেরো নদী
বয়ে যায় সুর...

দৌড়ের মাঝে মাঝে
হাতে নিয়ে tab
like,share,comment এর
নেই কোন মাফ্ ,


যান্ত্রিক জটিলতা
যন্ত্রণা ভারি
ভুলে গিয়ে সব কিছু
ভাবে মরি মরি ...

বাস্তবের করাঘাত
বিবেকের দংশন
সম্বিত ফিরে পেয়ে
বাড়ে শুধু tension ,

কি করি কি করি হায়
শুধু কাটাকুটি
শূণ্যতার হাহাকার
খায় লুটোপুটি.....

সব শেষে ঘুরে ফিরে
তব কাছে আসি
ঠেকে শিখে হুঁশবোধ
হাসি শেষ হাসি...।।

কবিতা - সৌরদীপ গুপ্ত

অন্তহীন
সৌরদীপ গুপ্ত


নির্বিকল্প স্বপ্নের ক্রোধে
তবু ছুঁয়ে থাকি তোর হাত
কি থেকে যে কি বা হয়- মেঘে আর রোদে
দিন কাটে.... শেষ হয় রাত
শরীরের গায়ে লাগে ক্ষত
পাপবোধ, একা একা দুরে
হেঁটে চলা পথিকের মতো
ঘুম মেশে রাতে, রোদ্দুরে........
হয়ত এটাই সুসময়
আমি তুই হাঁটি একা রোজ
আমাদের হতশ্বাসগুলো,
নশ্বর জীবনের খোঁজ.....

কবিতা - সুব্রত পাল

একটু ছোঁব
সুব্রত পাল



এবার জীবন দেখবো কাছ থেকে -
এবার একটু ছোঁব বোধের ভেতর।

এতকাল শুধু মুখ গুঁজে থেকেছি
আর মুখস্ত কথাগুলো আউড়ে গেছি।
এতকাল পাতার পর পাতা পড়েছি -
এবার একটা পাতা পড়ার শব্দ শুনবো।

স্রোত দেখবো নদীর, মেঘের, সময়ের -
সমস্ত জোয়ার ভাঁটা, সমস্ত উদয় অস্ত -
দেখবো পাহাড়ের সাথে কুয়াশার বন্ধুত্ব -
অরণ্যে মিশে গিয়ে শুনবো পাখির শিষ।

আমি পাথর ঘষে ঘষে আগুন জ্বালিয়েছি
আমিই বানিয়েছি চাকা -
আমার সেই ক্ষমতা আছে -
শুধু এতদিন নিজেকে চিনতে পারিনি।

এবার চিনবো সব, সবকিছু বুঝবো -
সব আবর্তন বিবর্তন, সব অক্ষ পক্ষ -
সব স্বার্থ নিঃস্বার্থ, সব আনন্দ হতাশা -
এবার চিনবো সব, সবকিছু জানবো।

এবার মানুষ দেখবো খুব কাছ থেকে
সমস্ত অজানা জীবনকে, একটু ছোঁব।

কবিতা - সুমন মণ্ডল

কলকাতা, তোমাতে ফিরতে চেয়ে
সুমন মণ্ডল


তোমার স্রোতে ফিরতে চেয়েছি, কলকাতা-
যুবকের ঠোঁটে মুখিয়ে, না বলা কথা।
তবু খবরে, কেবল এ, হাওয়া তে যতটা ভেসেছো,
সুখপ্রিয় মনে সুযোগ স্বার্থপরতার।

আগামী বাঁধলে অ্যাম্বুলেন্স-এ সংসার,
ত্যাগ ও প্রীতির ন্যাকামো তখন বন্ধ।
মারতে-মরতে রোমান্টিকতাও জাগবে-
যেমন বৃদ্ধের ঠোঁটে কিশলয়-এর পদ্য।

নতুন শিশু আনবনা আর মর্ত্যে,
স্পার্ম কাউন্ট তা অদ্ভূত ভাবে কম।
যতই জপি উঠে দাঁড়ানোর মন্ত্র,
স্পাইনাল কর্ড জন্ম থেকেই অক্ষম।

ঘরমুখ গরু ভেবেই বা কি করবে !
ফিরতে গিয়ে থমকে ভাবা শক্ত।
বোকা ইতিহাস মাপলে মাপুক রক্ত,
সাপোর্টার এর বাংলা, অন্ধভক্ত।।

কবিতা - সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য


যদি পরজন্ম থাকে সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য


আমি কষ্ট উৎসর্গ করব তোকে—

আমি মেয়ে হতে চাই,
আবার--
পেতে চাই একান্ত নিজের করে
ভিটেমাটি ভেসে যাওয়া উজান-বালক--

শুধু তোকে,
শীত মরসুম থেকে বসন্ত উজিয়ে এসে প্রবল গ্রীষ্মদিনে
তীব্র আশ্লেষে
পেতে চাই শুধু তোকেই,
রাজপ্রাসাদ নয়,
পর্ণ-কুটিরে , প্রেম-বিধুরণে
শুষে নেব তোর অস্ফুট পৌরুষ,
অভিসারে,
চন্ডিদাস-জয়দেবে দ্বিজ উত্তরাধিকার,
তোর,
লন্ডভন্ড করে, বৃষ্টি-দুপুরে
হাঁটুগেড়ে চেয়ে নেব প্রগাঢ় গভীর সব অনুভব
মহাসমারোহে,
কেঁপে ওঠা কুন্ডলিনী আমি,
তোকে প্রেম দেব,
প্রতিদানে, তছনছ করে দেব অখন্ড উষ্ণীষ;

নির্লিপ্ত জ্যোৎস্নায় এসে দাঁড়াব আভরণহীনা আমি,
এ আমার বিদ্রুপ , এ আমার প্রেম,
পরম কৌতুক
এ আমার অনন্ত সন্ধান...

যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে...


কবিতা - তন্ময় গুপ্ত

প্রতিবন্ধকতা
তন্ময় গুপ্ত


তোমার সাথে প্রথম দেখা শৈশবে
যখন মা আমায় ছেড়ে …
যখন বিছানার ধারে আমি।
তোমার সাথে দেখা স্কুলের খেলার মাঠে
যখন বল সাঁই সাঁই ছুটত
যখন মাঠের পাশে একা, আমি।
তোমার সাথে দেখা কলেজে, সিঁড়ির নীচে
যখন ব্যস্ত সবাই ক্লাসে,
যখন এক পা, এক পা, আমি।
তোমার সঙ্গে দেখা আমার বেকারত্বে
যখন কোট, স্যুট, টাই, অফিস – ঝাপসা,
যখন রাস্তার ধারে সুরের দোকানে আমি।
তোমার সাথে দেখা বাঁকা হাসিতে,
যখন কপোত কপোতী ব্যস্ত,
যখন অক্ষমতায় আমি।
তোমার সাথে দেখা তানপুরার চুমায়
যখন সারা পৃথিবী ঘুমায়,
যখন আগুন রাগেতে আমি।
তোমার সাথে দেখা ইজেল ক্যানভাসে
যখন রঙ্গিন দুনিয়া মত্ত
যখন তীব্র কালিমা তুলির রঙেতে আমি ।
তোমার সাথে দেখা লয় ছন্দ শব্দে,
যখন শ্রোতারা সম্মোহিত,
যখন আক্রোশ ভরে কাব্য কে ভাঙ্গি আমি।
তোমার কাছে ঘৃণার মাঝে দেখা
যখন সঙ্গী আমার তোমার সঙ্গটুকু,
যখন লড়াই শেষের ক্লান্ত যোদ্ধা আমি।


তুমি –আমার প্রতিবন্ধকতা।

কবিতা - তনুশ্রী মিত্র

যখন থমকে যায় সময়
তনুশ্রী মিত্র


(প্রিয় বন্ধুর মূত্যুতে)
পরিচিত নাম্বার
আলতো আঙুলে ছোঁয়া
পরিচিত কলারটোন
অসহনীয় অপেক্ষা |

অপরিচিত কণ্ঠস্বর
হতাশায় বলি হ্যালো
ফোনটা ওকে দেবেন ?
-- সে নেই
কবে ফিরবে?
ফিরবে না কোনোদিন |

থমকে যায় সময়
থমকে যায় হৃদয়

আকাশে মেঘভাঙা রোদ
বাতাসে ভাসে আগমনী সুর
গাছে গাছে নতুনের আহ্বান
শুধু জীবনে জীবন্তের মহাপ্রস্থান ।।

রম্য রচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসে কলহ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়


[ সব চরিত্র কাল্পনিক ]

মা মহামায়া নিজের ত্রিনয়নটা সামলে সুমলে রাখে । সব সময় লক করা থাকে । কারণ যদি কোনও কারণে রাগের মাত্রাটা বেড়ে যায় তো ত্রিনয়ন লিক করে আগুন ঠিকরোতে পারে । সেজন্য শুধু লক করাই নয়, একটা ভালভ-এর ব্যবস্থা করেছে। শরীরের হরমোনাল সিস্টেমের ফিড ব্যাক কনট্রোলের মত ব্যবস্থা । শরীরের রাগ একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছলে তবেই ত্রিনয়নের ভালভ খুলবে । আবার রাগ মাত্রার নীচে নামলেই সে ডিসচার্জ বন্ধ করে দেবে ।

আসলে সব কিছুর মত এখন ভগবানও ডিজিটাল হয়ে গেছেন কিনা । টাকা আনার মত ছোটখাট বিষয় এই ডলারের যুগে অচল । তাই আনালগ (পড়ুন অ্যানালগ) সিস্টেম বাতিল হয়েছে । তা, যা বলছিলাম । বাবা সাতসকালে ধ্যানে বসেছেন । হাতের তেলোয় একটা চ্যাপ্টা মোবাইল। যেটা নিয়ে এখন মর্তবাসী সব সময় ধ্যানে মগ্ন সেটা এখন স্বর্গে দেবতাদের হাতে হাতে । কি করবে - ডিজিটাল স্বর্গ যে ।

ধুতুরার সরবতের গ্লাসটা এনে রাখার সময়ই চোখে পড়ল মহামায়ার । একি - মহাদেবের এখন ধ্যানে বসার সময় নয় ? মেডিটেশনের কত উপকার তা কি মহেশ্বর জানে না ? আর ঠিক তখনই রাগটা তার মাথায় চড়ে বসল । কিন্তু এখানে তার ত্রিনয়ন লিক করার সম্ভাবনা নেই । মহাদেবের ত্রিনয়নের জোর একটু বেশি (স্বর্গটাও বোধহয় পিতৃতান্ত্রিক )। এখানেও সেই ফিড ব্যাক কনট্রোল । তাছাড়া একটা অ্যাটমিক পাওয়ার কি আর একটাকে ঘাঁটায় নাকি ? আরে রাম কহো । বড়জোর পায়ে পা লাগিয়ে গায়ে একটু তাপ দেওয়ার চেষ্টা এই যা । আর ওই পরম পুরুষের সাজেশন মেনে একটু আধটু ফোঁস ফাস করা । সেটা তো করতেই হবে নাকি ? নাহলে টেকা যাবে দুনিয়ায় ?

যা বলছিলুম । বাবার হাতে মোবাইল । নারদের নতুন আনা মোবাইল । বাবা বিষ্ণুর দেয়া । দেয়ার সময়ই বিষ্ণু নীরব হাসি হেসেছিলেন । নারদ এর গভীরে লুকিয়ে থাকা অর্থটা অনুধাবন করে মনে মনে হেসেছিল । লাগ ভেলকি লাগ । কৈলাসে এবার কলহ লাগল বলে । নারদ নিজের মনে শুধু বলল, নারদ ! নারদ !!

মোবাইলে বাটন নয়, টাচ স্ক্রিন । আহা পরশের কি পুলক আর চমক ! একটু কষ্ট নেই, নেই এতটুকু ঝামেলা । একটা আঙ্গুলের মধুর পরশ মুহূর্তে খুলে দিতে পারে চরম এক সুখের জগত ।

মহাদেব বসে প্র্যাকটিস করছেন । একটা সুন্দরীর বুকের ওপরে আঙ্গুলের মৃদু পরশে খুলে গেল একটা নাচের সীন । হাতের সরবত হাতেই রইল । মহামায়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যাচ্ছেন । আর ভোলানাথ তো ধ্যান করছেন – মোবাইল হাতে ডিজিটাল ধ্যান । মহামায়ার মনে হল এটা একটা বলিউডি সিনেমা । তারপর মনে হল টলিউডিও হতে পারে । আবার হলী হুডিও হতে পারে । আজকাল হুডখোলা আর কার না ?

এতক্ষন তবু রাগ আর দুঃখ চেপে সব সইছিল । কিন্তু আর তো সয় না । ত্রিনয়ন এলারম বাজাতে শুরু করেছে । আরে একি ! বাবা কিনা সাতসকালে ফেসবুক খুলে বসেছে ? নিজের প্রোফাইল । মহামায়ার সামনে । ফ্রেন্ড লিস্ট খুলতেই দেখা গেল । আরে একি ! উর্বশী, রম্ভা এরকম কত সুন্দরী সেই লিস্টে । কিন্তু সব ডিজিটাল – তাই ঘাগরা কাচুলি-ওড়নার বদলে সব বিকিনি পরে ফেলেছে । হায় হায় এবার কি হবে ? স্বর্গটাকেও কিনা বুক করে ফেলল ফেসবুক ? হরি হে মাধব – বাথটবে কি গা ধোব ?

কোটী কোটী ফেসবুক-সুন্দরীর লিস্ট কুটি কুটি করে ফেলতে ইচ্ছে হল মহামায়ার । কিন্তু এ যে সব ডিজিটাল – মানে মায়া । মহামায়ার থেকেও বড় মায়া । রাগে মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেললেও কি আর সুন্দরীরা যাবে ? এই সুন্দরীদের ধ্যান করবে রোজ মহাদেব ? হায় হায় বিষ্ণুদেব তোমার মনে মনে এই ছিল ?

- কি কি করছ তুমি ? রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহামায়ার প্রশ্ন, এই তোমার ধ্যান ? এসব কি হচ্ছে ? আবার ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছ ?

মহাদেব মুখ তুললেন । গলার স্বর ভারি শান্ত । না হয়ে উপায় কি ? ভাঙ্গের সরবতটা যে এখনও বউ হাতছাড়া করে নি । একটু না তেলালে যে ও ফিরিয়ে নিয়ে যাবে । বললে, প্রিয়ে, তুমি হলে জগতের সেরা সুন্দরীদের সেরা । তুমি হলে মিস হেভেন । তুমি যখন রেগে যাও তখন মনে হয় একশটা সুন্দর লাল গোলাপ গন্ধ বিকিরণ করতে করতে এগিয়ে আসছে ।

মহামায়া একটু নরম হয়ে পড়ছে নাকি ? তার ত্রিনয়নের চার্জ কি কমে যাচ্ছে ? দনুজ দলনী দুর্গা কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন ? ভাবছেন ত্রিনয়নের চার্জ-আরটা আনতে যাবেন কিনা।

- হে প্রিয়ে । মহাদেব আবার শুরু করেছেন, তুমিই আমার ধ্যান । আমি কি করে অন্য সুন্দরীদের –

-- চুপ কর । এসব ডায়ালগ গল্প উপন্যাসে অন্তত কয়েক কোটী বার লেখা হয়েছে । ভেবেছ এই সব বস্তাপচা ডায়ালগে ভুলব আমি ? আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না । ফেসবুকের একাউন্ট তুমি এক্ষুনি ডি -একটিভেট করবে কি না বল ?

- আহা এটা তো বিষ্ণুর দেয়া । দেখ না বিষ্ণুই আমার প্রথম ফ্রেন্ড ।

- সে কি ? বিষ্ণু তোমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড ? আমি নই ?

মহাদেব বললেন, ডার্লিং তোমাকেই তো আমি করতুম কিন্তু তুমি যে ফেসবুক পছন্দ করই না । তাই –

মহামায়া কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কে বললে ? আমাকে ফ্রেন্ড করবে না তাই বল ।

মহামায়ার হাত একটু বোধ হয় ঢিলে হয়ে আসছিল । শিব উঠে সরবতটা সে হাত থেকে নিয়েই ঘোঁট ঘোঁট করে খেয়ে ফেললেন সবটা । তারপর হেসে বললেন, ফ্রেন্ড যে করব তোমারও একটা একাউন্ট থাকা চাই তো ?

- খুলে দাও না বাপু ।

কলহটা হয়ত মিটেই যাচ্ছিল কিন্তু নারদ অলক্ষ থেকে একটু হাসল । নিঃশব্দে বলল, নারায়ন নারায়ন !

মহামায়ার চোখ পড়ে গেল মহাদেবের জটার দিকে । আরে এটা এমন ফুলে উঠেছে কেন ? কি লুকিয়ে রেখেছে এখানে ভোলানাথ ? কিছু বলা যায় না কোনও সুন্দরীকে হয়ত –

- ওখানে কি ? তোমার জটার মধ্যে । কি একটা উঁকি পাড়ছে মনে হচ্ছে ?

মুহূর্তে যেন শিব দুর্গার যৌথ তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল । মহাদেব কিছুতেই জটায় হাত দিতে দেবে না আর জটায় হাত না দিয়ে দুর্গাও ছাড়বে না ।

- আরে আরে করছ কি ? অনর্থ হয়ে যাবে যে । জগত ভেসে যাবে যে ।

- যায় যাক । বলে টেনে জটা খুললেন মহামায়া । পাকের পর পাক খুলতে লাগল জটার । আর স্রোতের পর স্রোত বয়ে যেতে লাগল গঙ্গার । ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভগীরথের শাঁখের আওয়াজ ।

না জটার ঘোর প্যাঁচ আর আটকে রাখতে পারল না গঙ্গাকে । বেরিয়ে এসে মহামায়াকে প্রণাম করে বলল, মা, কি বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না । ওঃ আমার কি গা চুলকচ্ছিল যে কি বলব মা । জটাটা একটু সাবান সোডা দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে পার না মা ?

আবার প্রনাম করল ভগীরথও । বলল, মা সগর রাজার ষাট হাজার ছেলেকে বাচাতে হবে মা । মা গঙ্গাকে চাই । আপনি মুক্ত করে দিয়ে কি ভাল যে করলেন ।

মহামায়া যে কি করবেন তা বুঝতে পারছেন না । সত্যি তো । ঝগড়ার ফল তবে মাঝে মাঝে ভালও হতে পারে ? শিব এবার ধ্যানে বসলেন । সত্যিকার ধ্যানে ।

সবজান্তা বিষ্ণু ওদিকে হাসছেন । নারদ বলতে যাচ্ছিল, নারদ নারদ । মুখে আসার আগেই পালটে নিয়ে বলল,নারায়ন নারায়ন ।

মহাভারতের কথা - সুস্মিতা সিং


প্রতীক্ষা
সুস্মিতা সিং


পাঞ্চাল রাজ্যে মহা সমারোহ , যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী দ্রৌপদী স্বয়ম্বরা হবেন। ঠিক এই সময়, সদ্য বারণাবতের জতুগৃহের অগ্নিকান্ড থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ব্রাহ্মণ ভিক্ষুকের বেশে ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্চাল রাজ্যে এসে উপস্থিৎ হলেন পঞ্চপান্ডব । এর আগে যজ্ঞানলসম্ভূতা দ্রৌপদী কৃষ্ণার জন্মবৃত্তান্তের কথা পান্ডবরা শুনেছেন মহামতি ব্যাসের কাছে। তাকে বিবাহ করার কোন মানসিক প্রস্তুতি পান্ডবদের ছিলনা। কেবলমাত্র রাজবাড়ির উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্যই প্রচ্ছন্নচারী ব্রাহ্মণবেশী পঞ্চপান্ডব অন্যান্য ব্রাহ্মণদের অনুগমণ করলেন।

যথা সময়ে স্বয়ম্বর শুরু হল। স্বয়ম্বরের শর্ত অনুযায়ী, জরাসন্ধ, শিশুপাল, শল্য, দুর্যোধনসহ একে একে সকল প্রথিতযশা রাজন্যবর্গ লক্ষ্যভেদ তো দুরস্ত, গান্ডীবখানি তুলে ধরতেই পারলেননা। এহেন সময়, মঞ্চে উপস্থিত হলেন মহামতি কর্ণ। অনায়াসে তিনি গান্ডীবখানি তুলে ধরে তাতে বাণ সংযোজন করলেন।

এমত সময়ে অকস্মাৎ সভামাঝে ধ্বনিত হল প্রত্যাখ্যান । স্বয়ং বধুবেশী রাজকন্যা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তিনি সুতপুত্র কর্ণকে বিবাহ করবেননা। যে নারীস্বাধীনতার বানী আমরা আজ প্রতিনিয়ত চর্চা করি , তার এমন সোচ্চার বহিঃপ্রকাশ ভারতীয় সাহিত্যে খুব কমই আছে। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি রাজ্য থেকে আসা ছোটবড় অসংখ্য রাজা মহারাজা , রথী-মহারথী , পাত্রমিত্র, আহুত-অনাহুত, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলের সামনে নিজের অপছন্দের কথা জানাতে একটুও দ্বিধা বোধ করেননি যাজ্ঞসেনী। অগ্নিসম্ভূতা দ্রৌপদীর চরিত্রে আগুন। তাই তাঁকে অবদমিত করে রাখা সহজ নয়। সেযুগের ইতিহাসেও নারীর প্রতি অত্যাচার ছিল। কিন্তু তারই মধ্যে ছিল মুক্তির বাতাস। ছিল স্ব-অধীনতা।

এর পরের ইতিহাস সকলেরি জানা। শুধু শুধু সেগুলির পুনরাবৃত্তি করে পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাইনা। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনকে বরমাল্য দিয়ে বরণ করে নিলেন মুগ্ধা যাজ্ঞসেনী। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে স্বামীরূপে তখনি পাওয়া হল না প্রেমাস্পদকে। যুবতী হৃদয়ের প্রথম ভালোবাসা পাথেয় করে নববধূ সুন্দরি দ্রৌপদী একতম স্বামীর হাত ধরে পতিগৃহে এলেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে , মুহূর্তে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হল।

নিজের তৈরি নিয়মেই, প্রথম স্বামী হিসেবে অনিন্দ্যসুন্দরী পাঞ্চালীকে পত্নী হিসেবে প্রথম পেলেন যুধিষ্ঠির। আর শর্তভঙ্গের অপরাধে অর্জুন গেলেন দীর্ঘ বারো বৎসর ব্রহ্মচর্য পালনে। সেদিন রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরের কোন এক অলিন্দে দ্রৌপদী কি একটি ফোঁটাও চোখের জল ফেলেননি--

সে খবর কেউ রাখেননা। দীপ্তিময়ী যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী – তবুও তো তিনি নারী! যুবতী নারীর হৃদয়বৃত্তি দিয়েই তো বীর অর্জুনকে স্বামীরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন!!ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তাঁকে প্রথমেই পাওয়া হল না। তবুও আশা ছিল , তৃতীয় বৎসরে অন্তত তাঁকে পাবেন , কিন্তু হায়! নিষ্ঠুর নিয়তি!! একি নির্মম পরিহাস তোমার!!

অন্যদিকে বীর অর্জুন , ব্রহ্মচারী অর্জুন , তখন অন্যপথে—যাত্রাকালে গঙ্গাতীরে তাঁর সাক্ষাৎ হল নাগরাজকন্যা উলুপির সঙ্গে। সপ্রতিভ উলুপি অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করলেন। কিন্তু, অর্জুনের ব্রহ্মচর্য ব্রতরক্ষার কি হবে? উলুপি মীমাংসা করলেন। বললেন, ব্রহ্মচর্য তো দ্রৌপদীর জন্য, অন্যনারী সঙ্গমে তো বাধা থাকতে পারেনা! অকাট্য যুক্তি, অর্জুন মেনে নিলেন। অনার্য নাগরাজকন্যা উলুপির বাহুবন্ধনে ধরা দিলেন তৃতীয়পান্ডব।

তারপর , অনেকগুলি দেশ পরিভ্রমণ করে অর্জুন এসে পৌঁছলেন মনিপুর রাজ্যে। মনিপুর মানেই সেখানে রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা, মহুয়া ফুলের মতো তাঁর গায়ের রঙ, কটাক্ষে তাঁর পঞ্চশরের নিষ্ঠুর নিক্ষেপণ; দেখা মাত্রই তাঁকে কামনা করলেন ফাল্গুনী। অন্ততঃ মহাভারত তাই বলে। বিশ্বকবির স্বপ্নমাধুর্যের প্রলেপ সেখানে নেই।

দীর্ঘ তিনবৎসর সেখানে কাটানোর পর অর্জুন এলেন দ্বারকার নিকটবর্তী প্রভাসে। খবর পেয়ে, প্রাণসখা কৃষ্ণ এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, সব শুনলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে এলেন রৈবতক পাহাড়ে। সেখানে তার দেখা হল কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার সাথে। সকলের সম্মতিক্রমে, এবং বিশেষতঃ কৃষ্ণএর আনুকূল্যে ও সহযোগিতায় অর্জুন ও সুভদ্রার শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হল। তারপর বারোবৎসর ব্রহ্মচর্যের বাকি সময়টুকু বেশ নিশ্চিন্তেই দ্বারকায় কাটিয়ে অবশেষে ফিরলেন অর্জুন।

অর্জুন , তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর , বীর অর্জুন, তাঁর ক্রমান্বিত প্রেমপর্ব এবং বিবাহযাত্রার কথা শুনতে শুনতে পাঠক এতক্ষণে বুঝি ভুলেই গেছেন অর্জুনের প্রথমতমা স্ত্রী দ্রৌপদীর কথা। কি হল তাঁর? তিনি যাজ্ঞসেনী , তিনি অগ্নিসম্ভূতা, তাই আর পাঁচটা সাধারণ নারীর মতো বিলাপ তিনি করতে পারেননা। তাই বলেকি তাঁর একটি সুকোমল নারী হৃদয় নেই? প্রথম প্রেমের নিদারুণ উচ্ছাস কি তাঁকে পোড়ায় না? অর্জুনই একমাত্র তাঁর বৈধ স্বামী , আপন ভুজবলে তিনি ই তাঁকে জয় করে এনেছিলেন স্বয়ম্বর সভা থেকে—তাঁকেই দ্রৌপদী ভালবেসেছিলেন একমাত্র, কিন্তু এখনও তো তাঁকে পাওয়া হল না! কি করে সহ্য করছেন পাঞ্চালী?!

বিবাহের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই অর্জুন রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী। সুদীর্ঘ বারোবৎসর পর যখন অর্জুন ফিরলেন, পাঠক হিসাব করে দেখবেন, তখনও পাঞ্চালী যুধিষ্ঠিরেরি স্ত্রী। অর্জুন যেহেতু উপস্থিৎ ছিলেননা, তাই বাকি চার স্বামী ক্রমান্বয়ে দ্রৌপদীর স্বামীত্বের অধিকার পেয়েছিলেন । আর সেই হিসাব মতো বারোতম বৎসর গতে, তেরোতম বৎসরেও যুধিষ্ঠিরেরি ক্রম আসে আবার। অর্থাৎ , আরো দেড় বা দুই বৎসর পরে দ্রৌপদী পাবেন অর্জুনকে...

আর অন্যদিকে অর্জুন!! তিনি ফিরেছেন, সঙ্গে সদ্য বিবাহিতা দ্বারকা-নন্দিনী সুভদ্রা। সহৃদয় পাঠক , একটিবার ভাবুন দ্রৌপদীর কথা !! তেজস্বিনী, মনস্বী নারী দ্রৌপদী , তিনি রাজকন্যা, রাজমহিয়সী, আত্মশোকে বিহ্বল হওয়া তাঁর সাজেনা। তবুও তিনি নারী! বারো বৎসর পরেও তাঁর প্রেমাস্পদকে পাওয়া হলনা। আজ যদিবা তিনি ফিরলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন স্বপত্নী সুভদ্রাকে।

এইখানে, যাজ্ঞসেনীকে অশ্রু-বিসর্জন করতে দেখি আমরা, অন্যান্য পান্ডবের দ্রৌপদী ছাড়াও একাধিক পত্নী ছিলেন। কিন্তু, তাতে কখনই বিচলিত হননি পাঞ্চালী, এখন তিনি কাঁদলেন, অনেক কাঁদলেন., এ কান্না তাঁর হেরে যাওয়ার কান্না। হৃদয়ের হুতাশন অবিরল অশ্রুধারায় নির্বাপিত হলনা; ক্ষমা চাইলেন ফাল্গুনী, একবার নয়, বার বার ক্ষমা চাইলেন প্রেমিক পার্থ। কিন্তু দ্রৌপদীর এই দহন তাতে উপসম হবার নয়। তাও তিনি নিজেকে শান্ত করেন একসময়। বিশেষতঃ, নম্র সুকুমারি, সুভদ্রাকে দেখার পর, তাঁর হৃদয়ের আগুন অনেকটাই প্রশমিত হয়। তিনি বোঝেন, সুভদ্রার মতো একজন নিতান্তই সামান্যা, সাধারণীর কোন ক্ষমতাই নেই তাঁকে পরাজিত করার।

সহমর্মী পাঠক , ভেবে দেখুন , যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালী, যজ্ঞবেদীর হোমানলসম্ভূতা পাঞ্চালী, লেলিহান অগ্নিশিখার মতো যিনি সপ্রতিভ, তাঁর ব্যাক্তিগত প্রেমজীবনের কি করুণ পরিণতি!! মহাভারত মতে গান্ডীবধনু তৈরিই হয়েছিল অর্জুনের কথা মাথায় রেখে, অর্থাৎ, জন্মলগ্নেই দ্রৌপদী জানতেন অর্জুনই তাঁর ভাবী স্বামী। বীর-শ্রেষ্ঠ অর্জুনকে সেই সময়ের ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি যুবতী নারীই বুঝি স্বামী হিসাবে কল্পনা করেছেন, কামনা করেছেন। পূর্ণযুবতী যাজ্ঞসেনীও কি কোন এক বসন্তসন্ধ্যায় , যখন, দখিনা বাতাস মাতাল হয়ে উঠেছে, একটি বারের জন্যও কল্পনায় বীরশ্রেষ্ঠের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেননি? ভরা স্বয়ম্বর সভায় যখন কর্ণ কে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখনও তিনি অর্জুনের প্রতীক্ষাই করছেন। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন যখন লক্ষভেদ করলেন, দ্রৌপদীর কুমারি হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। প্রেমাস্পদকে ফুলহারে বরণ করে নিয়েছেন, বীরের চরণে মন-প্রাণ-শরীর, সমস্ত সমর্পণ করেছেন সেই মুহূর্তেই, তারপর স্বামীর সঙ্গে যাত্রা করেছেন পতিগৃহে। এতদিন যাকে স্বপ্নে দেখেছেন , তাঁরই সঙ্গে রচনা করতে চলেছেন বাসর-শয্যা...

.কিন্তু হায়!! ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! পূর্ণযৌবনা, অষ্টাদশী , কৃষ্ণা পাঞ্চালী, যে বাসরশয্যা রচনা করতে চেয়েছিলেন , তার সময় এল বিবাহের প্রায় পনেরো বৎসর পর। অর্জুনকেই তিনি একমাত্র স্বামী হিসাবে মেনেছিলেন, এই পক্ষপাতের পাপেই মহানির্বানের পথে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাঁর সেই একমাত্র স্বামীকেই তিনি পেলেননা জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়ে।

ব্রহ্মচর্যকালে অর্জুনের গতিবিধি ও কার্য্যকলাপের খবর কি রাজসভা হয়ে রাজঅন্তঃপুরে দ্রৌপদীর কাছে এসে পৌঁছত না? সেই সময় হয়ত তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল বা সহদেবের স্ত্রী। তখনও কি তিনি শুষ্ক নয়নে তদানীন্তন স্বামীর আদরে সোহাগে অস্থির হয়েছেন? নাকি, রাজঅন্তঃপুরের অনেক রোশনাইএর নীচের গভীর অন্ধকারে তাঁর আঁখিপল্লব আর্দ্র হয়ে উঠেছে, বুকের কাছে চাপ হয়ে উঠেছে বেদনা?? সে খবর কে রাখে?

বিবাহের পনেরো বৎসর পর প্রৌঢ়া দ্রৌপদী, বাকি চার পান্ডবের সন্তানের জননী দ্রৌপদী, তাঁর কালরাত্রি যাপন সমাপন করেছেন। এতদিন পরে তিনি তাঁকে কাছে পেলেন। সেদিন অর্জুনকে কি নিবেদন করেছিলেন পাঞ্চালী? প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য তার সঙ্গে বাসর-শয্যা রচনা করার জন্য এক জীবনে এত দীর্ঘ কালরাত্রি যাপন ভারতীয় সাহিত্যে আর একটিও আছে কিনা আমার জানা নেই। পাঠকের সমবেদনাই বুঝি তাকে কিছুটা হলেও সংক্ষিপ্ত করতে পারে।
(অনুপ্রেরণা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার - কৃষ্ণা, কুন্তী ও কৌন্তেয়, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরি, মহাভারতের অষ্টাদশী, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরি।)



চিলেকোঠার রান্নাঘর - নন্দিনী লাহা

চিলেকোঠার রান্নাঘর
নন্দিনী লাহা

বাটার প্রণ

উপকরণঃ
হাফ কেজি বড় সাইজের চিংড়ি, ১ টি লেবুর রস, ১ চা চামচ লঙ্কাগুড়ো, নুন আন্দাজমত, ২ টেবিল চামচ সরষের তেল, ৪ টেবিল চামচ মাখন, ১/২ কাপ কোরানো গাজর, ১টি বড় পেঁয়াজ বাটা, মিহি করে কোচানো বীন, মটরশুটি ও ফুলকপি –সব ১/৩ কাপ করে। ১ চা চামচ চিনি, , ১/২ কাপ টম্যাটো পিউরি বা ১ টা টম্যাটোবাটা, ১/২ কাপ ক্রীম । ১ চা চামচ চাট-মসলা, ১ চা চামচ মরিচ গুড়ো, ধনেপাতা ১/২ আঁটি সাজানোর জন্য।

প্রণালীঃ
মাছ পরিস্কার করে নুন, লেবুর রস ও লঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ভেজে রাখুন। ঐ তেলে এবার মাখন মিশিয়ে পেঁয়াজবাটা কষতে হবে। পেঁয়াজ রঙ ধরলে সব সবজি ও নুন দিয়ে নেড়ে চেড়ে চাপা দিতে হবে। আঁচ কমিয়ে দিন। সবজি নরম হলে আদা, চিনি, টম্যাটো পিউরি দিন, ভাজা চিংড়ি ও দিন। আবার ঢাকা দিন, বেশ মাখোমাখো হলে ক্রীম , চাটমসলা ও মরিচ গুঁড়ো দিয়ে নামান। ইচ্ছে হলে ওপরে ধনেপাতা ছড়িয়ে দিতে পারেন। এবার গরম রুটি বা ভাতের সঙ্গে দিন বাটারপ্রণ।

অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার

Upon Westminster Bridge
W. Wordsworth

Earth has not anything to show more fair:
Dull would he be of soul who could pass by
A sight so touching in its majesty:
This City now doth like a garment wear
The beauty of the morning:
silent, bare,
Ships, towers, domes, theatres, and temples
lie Open unto the fields,
and to the sky,
All bright and glittering in the smokeless air.
Never did sun more beautifully steep
In his first splendour valley, rock, or hill;
Ne'er saw I, never felt, a calm so deep!
The river glideth at his own sweet will:
Dear God! the very houses seem asleep;
And all that mighty heart is lying still!




অনুবাদ
ইন্দ্রানী সরকার

ওয়েস্টমিন্সটার ব্রিজের উপরে (উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ)
এই পৃথিবীতে এত সুন্দর আমি কিছুই দেখি নি :
এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যকে যে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে সে তো মূর্খ :
দেখো শহর কেমন সুন্দর সাজ করেছে এই পবিত্র নীরব প্রভাতে,
দেখো জাহাজ, মিনার, গম্বুজ, রঙ্গশালা আর মন্দিরগুলি
কেমন দাঁড়িয়ে আছে মাটির উপর আকাশের নীচে |

সব কিছুই কেমন উজ্জ্বল আর ঝকঝকে বিশুদ্ধ বাতাসের আবরণে |
সুর্য্য কখনো এত সুন্দরভাবে উদিত হয় নি এই পাথরে পাহাড়ি উপত্যকায় |
কখনো এত গভীর প্রশান্তি আমি দেখি নি বা অনুভব করি নি |
নদী কেমন নিজের ইচ্ছেয় বয়ে চলে যায়:
ও ভগবান ! শহরের সব বাড়িগুলি এখনো কেমন সুষুপ্তিতে মগ্ন !

বর্ষার চতুর্দশ কাহন - গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্ষার চতুর্দশ কাহন
গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়


১) বর্ষার প্রিয় গান কি ?......... বারান্দায় রোদ্দুর

২) বর্ষা কাদের কাছে প্রিয়........... স্কুলের ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের কাছে, কারণ বৃষ্টি হলেই স্কুল ছুটি, মজাই মজা

৩) বর্ষা কাদের কাছে অপ্রিয়........... কলকাতা কর্পোরেশনের কাছে, কারণ আবার তো গালাগালি শুরু হবে

৪) বর্ষায় কারা বেশী সজীব ............. সমস্ত ব্যাঙ সমাজ

৫) বর্ষায় কারা বেশী নির্জীব ............... শহরের মিছিলধারীরা

৬) বর্ষার প্রিয় পোশাক কি ............... ছেলেদের গায়ে রেনকোট, বার্মুডা ও পায়ে সান্ডাক জুতো এবং মেয়েদের পরনে সিন্থেটিক শাড়ী, মাথায় ছাতা ও পায়ে সান্ডাক জুতো

৭) বর্ষার প্রিয় খাবার কি ............... দুপুরে খিচুড়ি ও পাপড় ভাজা এবং বিকালে তেলেভাজা ও মুড়ি

৮) বর্ষায় সবচেয়ে লাভ কি ............... যে এলাকায় জলের প্রেশার কম তারা বেশী জল পায়, কিছুদিন জল কষ্ট ভুলে থাকে

৯) বর্ষায় সবচেয়ে ক্ষতি কি ............... সারা ঘরে সোঁদা সোঁদা গন্ধ, কারণ সারা বাড়ী জুড়েই ভেজা জামা কাপড় মেলা থাকে

১০) বর্ষায় কাদের লাভ বেশী ............... ছাতা বিক্রিওয়ালা ও রাস্তা সারাইওয়ালাদের

১১) বর্ষায় কাদের ক্ষতি বেশী ............... বাংলার সুতী বস্ত্র নির্মাতাদের, কারণ পড়লেই তো “ভেজা কাক”, বিক্রি নেই

১২) বর্ষা কেন হয় ............... ছয় ঋতুর দ্বিতীয় ঋতু হিসাবে নিয়মমাফিক সময়মত বর্ষা আসে এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয়

১৩) এখন বর্ষা কেন হয় ............... এখন পঞ্জিকা মেনে সময়মত বর্ষা আসেনা, যখন সময় পায় তখনই এসে পৌঁছয় এবং প্রায় সারা বছরই নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হয়। সারা বাজারে সর্বদা দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধচাপ, মানুষের শরীরে টেনশন জনিত কারনে সর্বদা রক্তে ঊর্দ্ধচাপ, অথচ সারা বছর আকাশে এত নিম্নচাপ আসে কোথা থেকে বুঝিনা

১৪) বর্ষা আমার কেমন লাগে ............... ফাটা-ফাটি যদি না বাইরে বেড়োতে হয় এবং হাতে থাকে গল্পের বই

ম্যাজিক - রাহুল লাহা

ম্যাজিক
রাহুল লাহা


ম্যাজিসিয়ান রাহুলের ডাইরি থেকে -

আমি রাহুল বলছি—
আজ আমি তোমাদের একটা ম্যাজিক শেখাবো, তোমরা শিখবে তো?

বেশ তাহলে শোন—

একটা এমন পাত্র নাও যাতে সামান্য কিছু জল ধরে। আর তাতে একটা টাকার কয়েন ফেলে দিয়ে দর্শকদের দেখিয়ে দাও তুমি কয়েনটা তুললে জল থেকে, কিন্তু তোমার হাতে একটুও জল লাগল না। কি দারুন ম্যাজিক , তাইতো?

দর্শক তো অবাক!

এবার আমি তোমাদের চুপিচুপি শিখিয়ে দিচ্ছি। তোমরাও দেখিয়ে সবাইকে অবাক করে দাও।

দর্শকদের চোখের আড়ালে তুমি নিজের হাতে লাইকোপোডিয়াম গুড়ো মেখে নেবে আর ঐ পাত্রের জলেও ফেলে দেবে। ব্যাস!এবার সবার চোখের সামনে দিয়ে কয়েন তুললে একটুও হাতে জল লাগবে না।

ও , শোন, ম্যাজিক করার সময় মন্ত্র বলবে---

গিলি গিলি ছু মন্তর ছু...

গিলি গিলি গে......

ইংরাজী কবিতা - ইশিতা লাহা

Miniature Adult
Ishita Laha

Hurried child’- rightly termed
By an eminent David Elkind
Highlighting the concerns that goes
Unnoticed and neglected-
Often suppressed beneath the
Overscheduled affairs of the day.

Though only little can be done
With childhood moving indoors
Swapped by iPhones and iPads
Obsessed with Í’, ‘myself’- PRIMACY
On the pretext of current commerce

Parents’ desire turn demands
Of raising an alpha child
Confusing their needs with child’s dreams
Marooning them off their wishes
Blindly pushing them to proviso.

In building up the Protagonist
Etching scars on their innocence
Gambling with little minds
Parents’ fail to translate-
Growing up Fast can Mean
NOT Going Far in Life.