রম্যরচনা‌ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রম্যরচনা‌ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রম্যরচনাঃ নারায়ণ রায়





রম্যরচনাঃ


হ্যাট -ট্রিক
নারায়ণ রায়


পটাইবাবুর ছেলে অবিনাশ চন্দ্র হ্যাট-ট্রিক করেছে। এই নিয়ে পাড়ার চতুর্দিকে বিস্তর আলোচনা চলছে। কোন বিষয়ে পর পর তিনবার একই সাফল্য ধরে রাখা নিছক ছেলে খেলা নয়। ক্রিকেট খেলায় যখন কোন বোলার পর পর দুই বলে দুটি উইকেট পাওয়ার পর তৃতীয় বল করতে যান, কিম্বা ব্যাটস্ ম্যান পর পর দুই বলে দুটি ওভার-বাউন্ডারী মারার পর তৃতীয় বলটি যখন মারতে যান, অথবা স্ট্রাইকার দুটি গোল করার পর তৃতীয় বারের জন্য বল নিয়ে যখন অপর পক্ষের গোল সীমানায় পৌঁছান, তখন সমগ্র মাঠে যে টান টান উত্তেজনা দেখা দেয়, অবিনাশ চন্দ্রের ক্ষেত্রে অবশ্য সেরকম কোন অগ্রিম উত্তেজনার আঁচ পাওয়া যায়নি। মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল ‘বিদ্যাধরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে’র ফল গত কয়েক বৎসরের তুলনায় এবারে অনেক ভালো হয়েছে এবং সেই আনন্দে সবাই যখন নৃত্যরত তখন প্রধান শিক্ষক মহাশয় নজর করলেন যে আগের দুইবারের ন্যায় এবারেও অবিনাশ চন্দ্র অকৃতকার্য হয়েছে। 

দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। যথারীতি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যার পর নাই আশ্চর্য্যান্বিত হয়ে হাতে তিনদিন সময় নিয়ে এক জরুরী মিটিং ডাকলেন, আর সেই মিটিং-এ অবিনাশ চন্দ্র ও তার পিতা পটাই বাবুকে আমন্ত্রণ জানানো হ’ল। কারণ শিক্ষকদের এতদিন একটি ধারণা ছিল যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করা যেমন কিঞ্চিত কঠিন ব্যাপার, মাধ্যমিকে ফেল করা তদাপেক্ষা কঠিন কাজ। কিন্তু অবিনাশ চন্দ্র পর পর তিনবার সেই কঠিন কাজটি করে হ্যাট-ট্রিক করেছে, তাই এ বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি মিটিং ডাকা অবশ্য কর্তব্য। যদিও সুকুমার রায়ের কবিতায় উনিশটিবার ম্যাট্রিকে ঘায়েল হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তবুও বিদ্যাধরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এধরনের প্রয়াস এই প্রথম। তাই শিক্ষক ও ছাত্র মহলে রীতিমত সাড়া পড়ে গেছে। এদিকে বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় যারা স্টার পেয়ে কিম্বা উচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে, তারা পড়ল মহা চিন্তায়, তাহলে এবার কি বিদ্যালয় থেকে তাদেরকে বই, গোলাপ ফুল, উত্তরীয়, মিষ্টির প্যাকেট এসব দিয়ে বরণ করা হবে না? বিদ্যালয়ের ইতিহাসে কঠিনতম কাজটি করার জন্য এসবই কি তাহলে অবিনাশ চন্দ্রকেই দিয়ে দেয়া হবে?

কথায় বলে, বায়ুর আগে বার্তা বয়, তাই এই খবরটাও মুহুর্তের মধ্যে চারিদিকে রটে গেল। পটাইবাবুর পরিচিত পরিজনেরা খবরটি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা সত্তেও পটাইবাবুর সঙ্গে দেখা হলেই তাকে খবরটি জিগ্যেস করে বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। পটাইবাবুও পড়লেন মহা চিন্তায়। কিন্তু যার জন্য এত চিন্তা তার কোন হেল দোল নেই। অবিনাশ চন্দ্র যথারীতি তার ঘরে সারাদিন ধানি পটকা ব্যান্ডের ‘শশ্মানে অশান্তি’ সি ডি টা চালিয়ে প্রবল বিক্রমে নৃত্যরত, অথবা একটি পুরানো হারমোনিয়াম এবং ততোধিক পুরানো একটি গীটার সহযোগে সঙ্গীত চর্চায় রত। 

বিকেলে অবিনাশ চন্দ্র তার সঙ্গীত চর্চা বন্ধ রেখে দোতলার ঘর থেকে নীচে নেমে এসে পটাই বাবুর মুখোমুখি হতেই পটাই বাবু অত্যন্ত ধীর ও শান্ত গলায় যেন কোন আপনজন বিয়োগের খবর দিচ্ছেন, সেইরূপ নীচু গলায় বললেন, “খবরটা শুনেছ ?” অবিনাশ চন্দ্র ততোধিক বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, “তা আর শুনবো না কেন? কিন্তু তোমরা এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন আত্মীয় স্বজন কেউ মরেছে।……… “আচ্ছা লেখাপড়া করে কে কোনকালে বড় হয়েছে শুনি ? চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ, সিরাজদৌল্লা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কে কটা পাশ দিয়েছেন শুনি ? কিন্তু আমার ব্যান্ডের গান যখন লোকের ঘরে ঘরে বাজবে তখন তুমি তো রাস্তায় বেরোতে পারবেনা, সেটা একবার ভেবে দেখেছো কি ?” একথা শুনে পটাইবাবু বড়ই চিন্তায় পড়লেন, কারণ এমনিতেই এক হ্যাট-ট্রিকের ঠ্যালায় আজ সকাল থেকে তার পক্ষে বাড়ির বাইরে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু পুত্রের গানবাজনার সঙ্গে তার বাইরে বেরোনর কি সম্পর্ক তা বুঝতে না পেরে পটাইবাবু যখন মাথা চুলকাচ্ছেন, ঠিক তখনই অবিনাশ চন্দ্র ব্যাপারটা খোলসা করল- “তখন তুমি বাইরে বেরোলে সবাই বলবে—ঐ যে অবিনাশ কুমারের বাবা যাচ্ছে …. তোমার চারিদিকে ভীড় করে তোমাকে পাগল করে দেবে। তোমার অটোগ্রাফ চাইবে, তুমি তখন ভি আই পি-র বাবা হবে, …. তা তুমি সেটা চাও নাকি অবু কেরানীর বাবা হয়েই জীবনটা কাটাতে চাও….যত্তসব !”

পটাইবাবুকে এর পরেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে দেখে অবিনাশ চন্দ্র যথারীতি বাবার অজ্ঞতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে গট গট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে পটাইবাবু পড়লেন মহা বিপদে, স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করলেন কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেলেন না। ছাপোষা পটাইবাবু কোনদিনই গান বাজনার বিরোধী নন, কিন্তু এই অর্বাচীনকে কে বোঝাবে যে সত্যিকারের সঙ্গীত সাধনা বড় কঠিন কাজ, তার চেয়ে সাধারণ পড়াশুনা করে কিছু করা অনেক সহজ। তাই মনে মনে ভাবলেন যেন তেন প্রকারেণ অবিনাশ চন্দ্রকে মাধ্যমিক পাশটা করাতেই হবে। মাধ্যমিক পাশ করার পর বড় সাহেবকে ধরে অবিনাশ চন্দ্রকে যদি একবার নিজের অফিসেই গুঁজে দেওয়া যায় তাহলে তো কেল্লা ফতে।

পরদিন সকালেই পটাইবাবু তাঁর পাড়ার বিলে ডাক্তারের চেম্বারে গেলেন, সবিস্তারে সকল ঘটনা বলা শুরু করার আগেই, ডাক্তার বাবু বললেন, “ঐ হ্যাট-ট্রিকের কথা বলছেন ?” পটাইবাবু বিনয়ের হাসি হেসে পাড়ার ছেলে বিলে ডাক্তারকে বললেন, “তা তুমি যখন সবই শুনেছ, তখন ছেলেটার একটা বিহিত করে দাও বাবা।” অবিনাশ চন্দ্রের পরীক্ষায় পাশের ব্যাপারে বিলেবাবু কি ভাবে সাহায্য করতে পারেন তা বুঝতে যখন বিলেবাবুর কিঞ্চিত সময় লাগছে, তখন পটাইবাবু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, “আজকাল তো কত রকমের ওষুধ, টনিক, দুধ এসব বেরিয়েছে টি ভি তে দেখেছি খাওয়ালেই ছেলেরা টপা-টপ ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে যাচ্ছে, তা তুমি নাহয় একটু কম তেজের ওষুধ দাও যাতে ফার্স্ট সেকেন্ডের দরকার নেই, কোনরকমে পাশটা করতে পারে।” উত্তরে বিলে ডাক্তার পটাইবাবুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে “প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ মেধা নিয়ে জন্মায় এবং জন্মের পর সে যে পরিবেশে বড় হয় সেই পরিবেশের সহায়তায় এবং নিজ প্রচেষ্টায় তার মেধার বিকাশ ঘটে। মেধা ওষুধ খাইয়ে বৃদ্ধি করা যায় না, ওসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোকঠকানোর ব্যবসা। তার চেয়ে ওকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলুন।” বিলে ডাক্তার অল্প বয়সে লেখাপড়ায় এলাকার সেরা ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল, তাই তার কথা পটাইবাবু কি করে ফেলে দেন ? 

এদিকে অবিনাশকে যেন তেন প্রকারে মাধ্যমিক পাশ করাতেই হবে, তা না হলে প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখানোই দুষ্কর। পটাইবাবু সহধর্মিনী সুরবালার সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর অত্যন্ত পরিচিত জ্যোতিষী ঘনাই শাস্ত্রীর নিকট গেলেন। জ্যোতিষার্ণব ঘনাই শাস্ত্রী পটাইবাবুর কথামত একটি সাদা কাগজে অনেক দাগ কাটলেন, অনেক আঁক কষলেন, তারপর চশমাটি কিঞ্চিত নাকের ডগায় নামিয়ে নিয়ে এসে বললেন, “আসলে আপনার ছেলের এখন কাল-সর্প যোগ চলছে, খুবই মারাত্মক অবস্থা।” শেষের কথা ক’টি এমন ভাবে বললেন যেন অবিনাশ চন্দ্র এখন ভেন্টিলেশনে আছে, কখন কি হয় বলা মুশকিল। একথা শুনে পটাইবাবু ছল ছল চোখে হাতদুটি জোড় করে বললেন, “তাহলে কি উপায় গুরুদেব?” …. গুরুদেব বললেন, “উপায় অবশ্যই আছে, আপনি এত ভেঙ্গে পরবেন না পটাইবাবু, বেশ কিছু যাগ-যজ্ঞ-হোম ইত্যাদির প্রয়োজন। আর সে সবের জন্য কিঞ্চিত খরচ তো হবেই….” পটাইবাবুর এখন এমন অবস্থা যে খরচের কথা চিন্তা করলে হবে না, ছেলেকে মাধ্যমিক পাশ করাতেই হবে, আর তার জন্য দু-চার-পাঁচশো টাকা খরচ হতেই পারে। তাই বললেন, “ঠিক আছে, কত খরচ হবে বলুন আপনি? খরচের জন্য আপনি চিন্তা করবেন না দয়া করে।” ঘনাই গুরুদেব বললেন দেখুন “এমনিতে এই ধরনের যজ্ঞের অনুষ্ঠানে হাজার ত্রিশ টাকা খরচা হয়, কিন্তু আপনি আমার বিশেষ পরিচিত, তাই খরচ-টা অর্ধেক অর্থাৎ পনের হাজার এক টাকা দিলেই হবে।” পনের হাজার টাকার কথা শুনে পটাইবাবু মুখে গোঁ গোঁ করে এক অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ঘনাই শাস্ত্রীর চেম্বারেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। 

অবশ্য চোখে মুখে একটু জলের ছিটে দিতেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এল, সম্বিত ফিরে পেতেই পটাইবাবু উঠে দাঁড়ালেন, এখন পটাইবাবুর কোনক্রমেই দমে গেলে চলবে না…ইয়ে ইজ্জত কা সওয়াল। জ্ঞান ফিরে পেয়েই তাই গুরুদেবকে কোনরকমে বিদায় জানিয়ে জোর কদমে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। 

হটাৎ রাস্তায় একজন বেশ শীর্ণ, অত্যন্ত কালো এবং স্বল্প দৈর্ঘের নেড়া মাথার লোক তাঁর পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “বাবু ভালো আছেন?” প্রথমে তাকে চিনতে না পারলেও, স্মৃতির মনিকোঠায় একটু খোঁচা দিতেই পটাইবাবুর মনে পড়ে গেল, আরে এ তো সহদেব! এলাকার সিঁধেল চোর। সেবার দত্তদের বাড়িতে চুরি করে ধরা পড়ে গণপিটুনিতে মারাই যাচ্ছিল, পটাইবাবুই পাড়ার ছেলেদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। …. “তা তুই এখানে কি করছিস?” … “আজ্ঞে এই গতকালকেই জামিন পেয়েছি, তাই একটু পুরনো পাড়ায় ঘুরতে এলুম।” সহদেবের অকপট স্বীকারোক্তি। “শোন, তোর সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে, চল, চা খাবি ?” বললেন পটাইবাবু। সহদেব অবাক হয়ে ভাবে, এটা পটাইবাবুর কোন ফন্দি ফিকির নয়তো ? কারণ সহদেবের সঙ্গে পটাইবাবুর মত লোকের কিইবা দরকার থাকতে পারে ? তাছাড়া জীবনে এই প্রথম কোন ভদ্রলোক তাকে তার সঙ্গে চায়ের দোকানে চা খেতে যেতে বলছে। যাইহোক যে লোকটি একদিন তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তাঁকে এটুকু বিশ্বাস করা যেতেই পারে ভেবে সহদেব তাঁর সঙ্গ নিল। পটাইবাবু সহদেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে তাকে এক কাপ চা একটা টোস্ট বিস্কুট খাইয়ে তাকে আবার বিড়ি খাওয়ার জন্য দুটো টাকাও দিলেন। তারপর সহদেবও হাসতে হাসতে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বিদায় নিল। 

তীব্র গরম, তারপর আবার অবিনাশ চন্দ্রকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, কদিন রাত্রে ভালো করে ঘুমই হচ্ছিল না। গতকাল প্রথম রাত থেকেই বেশ কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, পটাইবাবুর মাঝ রাত্রে বাথরুম যাওয়ার জন্যও ঘুম ভাঙ্গেনি। হটাৎ ভোর রাত্রে চিৎকার চেঁচানিতে ঘুম ভাঙ্গতেই পটাইবাবু ধরফর করে উঠে বসলেন বিছানায়। 

“হায়, হায় এ আমার কি হ’ল ?” চিৎকার করেই চলেছেন সুরবালা দেবী, তার পিছন পিছন অবিনাশ চন্দ্র, মুখে তার কথা বলার ক্ষমতা নেই, মায়ের পিছন পিছন সেও বুক চাপরে চলেছে আর হা হুতাস করে চলেছে। ঘরে ঢুকে সুরবালার প্রথম কথা, “হ্যাঁ গো কাল সদর দরজা ভালো করে বন্ধ করোনি?” 
“কেন কি আবার হ’ল?” শুধান পটাইবাবু।
“আর হ’তে বাকি টা কি আছে?.... মাঝ রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকে আমার অবু সোনার ঘর একদম সাফ করে দিয়েছে, হারমোনিয়াম, গীটার, মিউজিক সিস্টেম সবকিছু নিয়ে গেছে, আহা বেচারার এতদিনের সখের জিনিসগুলো !…. আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল, মাঝ রাত্রে বাথরুম করতে উঠে দেখি, কালো মত নেড়া মাথার রোগা আর ছোটখাটো চেহারার একটা লোক আমাদের বাড়ির সমনে ঘুর ঘুর করছে। হ্যাঁ গো, তা তুমি কি শুয়েই থাকবে, নাকি একটা কিছু করবে?”
“তা চোর কি আমার সম্বন্ধী যে, চুরি করা জিনিসগুলো দেখানোর জন্য আমাকে তার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে গেছে?... যাও যাও মা বেটায় মিলে আর জ্বালিও না, সকাল হতে এখনও দেরী আছে, যাও দরজা বন্ধ করে আবার শুয়ে পরো।” 

মুখে একথা বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন পটাইবাবু আর মনে মনে ভাবলেন… যাক কাল সহদেবের বাড়ি গিয়ে আমার কমিশন পাঁচশোটা টাকা নিয়ে আসতে হবে। আর কথায় বলে চোর পালালে ….. বাড়ে, সামনের বছর নিশ্চই এই বাড়-বাড়ন্ত বুদ্ধি নিয়ে অবু আমার মাধ্যমিকটা উতরে যাবে।

রম্যরচনা - বেলাল হোসেন



রম্যরচনাঃ

তীর্থ
বেলাল হোসেন



হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে আমি খুব ঘুরেছি, যদিও নর্থ-ইস্ট এখনও বাকি রয়েছে। আমি যখন পাশ করে যাই অর্থাৎ পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে গেছি, সে সময়ে এক বন্ধুর সহযোগিতায় আমি একটি তীর্থ স্পেশালের চুক্তি ডাক্তার হয়ে অনেকগুলি তীর্থস্থান ভ্রমণ করি। সমুদ্র ভালো, কিন্তু হিমালয় আমার কাছে ব্যাপক লাগে। এর বিশালতা, অনন্ত সারি সারি পাহাড় পর্বতের মাঝে যদি এক সপ্তাহও কাটানো যায়, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে পৃথিবীতে সমতল ভূমির মত কোনো স্থান থাকতে পারে; সে কারণেই যে কোন অছিলায় হিমালয় আমাকে খুব টানে। একবার, রাণীক্ষেতে গিয়ে ভেবেছিলাম এখানেই সারা জীবন ডাক্তারী করে থেকে যাই । জীবনে দরগা দেখেছি দুটো, কিন্তু প্রায় সমস্ত বিখ্যাত হিন্দু মন্দির আমার দেখা হয়ে গেছে। মন্দিরের মধ্যে গুঁতিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া মসজিদও দেখেছি; সেটা অন্য প্রসঙ্গ; আজ একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।

একটা গ্রুপের সঙ্গে একবার কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী চলেছি। দলের বেশ কিছু লোক আমাকে নিয়ে উৎসাহিত হয়ে পড়ল, তারা তো জানতোনা যে আমি দলের ডাক্তার, যাচ্ছি ফোকটে, ( উল্টে আবার হাওড়া স্টেশনে নামার পরে কিঞ্চিৎ কাঞ্চন লাভও হবে) । আমিও কিছু বলিনি। কেউ কেউ অত্যুৎসাহে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, আমি কেন এই সবের মধ্যে ? আমি একজন নেচার লাভার বলে তাদের আশ্বস্ত করলাম। সালটা ছিল ১৯৮৩। তখনতো আর ইসলামিক টেররিজম নামের বদহজমিগুলি তৈরি হয়নি; বিন লাদেনই জন্মায়নি। যে কারণেই হোক, কয়েকদিনের মধ্যে আমার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেল। দলে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপে ছিলেন ব্যারাকপুর পি টি এস এর প্রিন্সিপ্যাল, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা(কসবা গার্লস এর টিচার, ৪৬ বছর বয়স, সিঙ্গল) এবং প্রিন্সিপ্যালের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বন্ধু(খুব ধনী ব্যক্তি, ইনিও সিঙ্গল। কাজ কিছুই করেননা, পিসির অনেক সম্পত্তি পেয়েছেন, বয়স প্রায় ৬৩)। প্রিন্সিপ্যাল ভদ্রলোক ভারি রসিক মানুষ,সে পরিচয় পরে পেয়েছি। দ্বিতীয় গ্রুপটাতে ছিল এক মাঝ বয়েসি মা ও তার অবিবাহিতা মেয়ে। মেয়েটি ব্যাঙ্কে চাকরি করে, ২৬ বছর বয়েস। এঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। আরেকটি গ্রুপে ছিলেন সস্ত্রীক এক ভদ্রলোক, সঙ্গে তাঁর আশি ঊর্দ্ধ মা। ভদ্রলোক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পোস্টে চাকরি করেন। গ্রুপ ডিসকাশন আর বাড়াচ্ছিনা যদিও এরকম আরও কয়েকটি গ্রুপ ছিল।

আমার আসার কি উদ্দেশ্য এটা যখন সবার কৌতূহল, আমি ও তখন তাঁদের শুধাই যে তাঁরা কি উদ্দেশ্যে এসেছেন। যেন এর চাইতে বোকা প্রশ্ন আর হতেই পারেনা, এই রকম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাঁরা প্রায় সমস্বরে জানালেন তীর্থ করা আর পূণ্য করা ছাড়া আর কীইবা কারণ থাকতে পারে? মরণের পরে যে পাশবই সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে, সেই অ্যাকাউণ্টে যাতে কিছু ক্রেডিট পয়েণ্ট জমা পড়ে শুধু সে জন্যই এত কষ্ট করতে আসা। ভাল কথা।

আমরা খুব আনন্দ করলাম, একটা ব্রিজ ক্লাব করে খুব তাস খেললাম, হোমিও ডাক্তারবাবু প্রায়ই সেখানে এসে যোগদান করতেন, এবং অনতিবিলম্বেই প্রিন্সিপ্যালের ঘর থেকে তাঁর ফিরে যাওয়ার ডাক পড়ত। পরে উনি আমার অসমবয়েসি কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে পড়েন। যাত্রাপথে, একবার, দুই বয়স্কা মহিলা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেজন্য, আমাকে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। কয়েকটা রাতও আমাকে জেগে থাকতে হয়। এর ফল হল, আমি ওঁদের পুত্রের স্থান পেয়ে যাই। ধর্মশালাগুলোতে একজন বলেন তাঁর পাশে শুতে হবে, তো অন্যজন বলেন পরদিন যেন তাঁর পাশে থাকি।

ট্যুরটা খুব যাকে বলে এক্সেলেণ্ট কাটছিল, তবে আমি আর নিরামিষ টানতে পারছিলামনা। সেজন্য সবাই মিলে বদ্রীনাথ থেকে গাড়োয়াল শ্রীনগরে যাওয়া হল। সেখানে, ভেড়ার মাংস খাওয়া হল, খেতে গিয়ে মনে হল গাড়ির টায়ার সেদ্ধ খাচ্ছি। কিন্তু তখন সেটাই অমৃত। 

ট্যুর শেষ হয়েছে, সবাই দেরাদুন স্টেশনে বসে আছি। আমি, দলের পাণ্ডা অর্থাৎ প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়কে বললাম “আশাকরি সবাই খুব এনজয় করেছেন, এবং পূণ্যার্জনের পাশবুক ফুলে ফেঁপে উঠেছে ? যা পাপ করেছেন সেগুলো ডিলিট হয়ে গেছে নিশ্চয় ?” সকলেই হেসে উঠলো । এরকম প্রশ্নের অর্থ কি তা জানতে চায় সবাই।

আমি এবার চালকের আসনে। বললাম, চলুন সচ কা সামনা খেলি । আমি একে একে ব্যাখ্যা করলাম, কে কি উদ্দেশ্যে এসেছেন। প্রিন্সিপ্যালের উদ্দেশ্য ছিল শ্যালিকার সঙ্গে বন্ধুকে ভিড়িয়ে দেওয়ার, সেটা সফল হয়নি, বন্ধুটি বুঝতে পেরেই শিবির চেঞ্জ করে আমাদের কাছে এসে থাকতে শুরু করে। এ জন্য একসময় প্রিন্সিপ্যাল আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মাকে সঙ্গে এনেছিলেন তীর্থ করিয়ে তারপর একটা বিশেষ কাগজে মায়ের সই করিয়ে নেওয়ার জন্য। কাগজটা আর কিছুই নয়, একটি দলিল, যা হাতে পেলে উনি শ্যামবাজার এলাকার একটি তিনতলা বাড়ির একক মালিক হতেন । নিজের ভাইকে বঞ্চিত করে! উনি আমাকে সরাসরি কিছু বলেননি, কিন্তু একটু আভাস দিয়েছিলেন, যেহেতু, তাঁর মা আমাকে ছাড়তেই চাইছিলেননা। আর ব্যাঙ্কের কর্মচারি মেয়েটিতো ভীষণ ইণ্টেলিজেণ্ট। সে আমাকে সরাসরি এক্সপ্লয়েট করেছে। সে লক্ষ্য করেছিল যে তার মা আমাকে ভীষণ পছন্দ করছে, বাড়িতেও ডেকে রেখেছে। একদিন, আমি নদীতে নেমে স্নান করছি, এমন সময় তার আবির্ভাব এবং আবদার যে তাকে নদীতে নেমে স্নান করতে সাহায্য করতে হবে, সে সাঁতার জানেনা সুতরাং আমার সাহায্য প্রয়োজন। এবং তখনই তার সমস্যা সে আমাকে বলে আর সরাসরি সমাধান করে দিতে বলে। সে এক সহকর্মীকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়, ছেলেটি “সাহা”..মা ই একক গার্জেন এবং বেশ কড়া। মা সম্পূর্ণ অমত। মাকে ম্যানেজ করে দিতে হবে।

বলা বাহুল্য, মাকে ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম আর ওর বিয়েতেও গেছলাম।



***একটু ক্ষমাপ্রার্থী, কেননা, দুটো শব্দ ব্যবহার করলাম, যেগুলোর প্রয়োগ ১৯৮৩-তে অজানা ছিল, 'ডিলিট' আর 'সচ কা সামনা' ।

রম্য রচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

(সব চরিত্র কাল্পনিক)
একপাতা ঘুমের ওষুধ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



দেখে সন্দেহ হবার মতই চেহারাখানা । মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো বেয়াড়া ভাবে মুখের এদিকে ওদিকে পড়েছে । চোখগুলো বেশ ফোলা আর লাল । জবাফুল কি করমচা এ হিসেব করার মত ধৈর্য দোকানির নেই । যা অবস্থা, কোনোরকমে তাড়ানো গেলে বাঁচা যায় এমনই মনের ভাব ।

-স্যর, একপাতা ঘুমের ওষুধ দিন না স্যর । প্লিজ ।

ঘুমের ওষুধ ? তার মানে tranquilizer ? হাইলি রেস্ট্রিক্টেড । তাও আবার এক আধটা নয়, একেবারে একপাতা । একবার কেস খেয়ে গেলে কি হবে বুঝছ ? অতএব ও রাস্তায় পা মাড়াবে কে ভাই ? মানে মানে বিদেয় হও মানে সটকে পড় ।

প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারে নি লোকটা । সুতরাং সকলের ঘাড় ধাক্কা । দোকানীদের কেউ মিউ মিউ করে । কেউ গলাবাজি করে । কেউ চোখ পাকিয়ে বলেছে, উইদাউট প্রেসক্রিপশন তো এ ওষুধ হয় না দাদা । ডাক্তার দেখিয়েছেন তো ? প্রেসক্রিপশন দেখান ।

-যাব যাব । ওষুধ খেয়ে এ বেলা একটু ঘুমিয়ে ও বেলা যাব ডাক্তারের কাছে । আপনি দাদা না হয় অন্ততঃ একখানা দিন । মাত্র একখানা ?

মোড়ের ও মাথা থেকে এ মাথা পর্যন্ত যে কটা দোকানে ট্রাই করা হল তার সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়।

-কোথাও পেলাম না স্যর, কেউ দিল না । লোকটার কাকুতি মিনতি সাদিকের দোকানেও অব্যাহত, কত করে ঘুরে মরছি একটা দিন না কাইন্ডলি ?

সাদিক দোকানের মালিক । তার কাজ সেলসম্যানদের বিক্রি করা ওষুধগুলোর পেমেন্ট নিয়ে বিল দেওয়া । এখন বিশেষ ভিড় ছিল না দোকানে । পেমেন্টের কাজ নেই । সামনের খবরের কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছিল আর কানে ডটপেনের পেছন দিকটা দিয়ে আরাম করে কানের খোল বার করছিল ।

কাগজ পড়বে কি । খবর আর কোথায় ? শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ । গুলি গোলা খুন রাজনীতি। ধুস জান একেবারে কয়লা হয়ে গেল । এসব যেদিন বন্ধ তো ঝড় বৃষ্টি বন্যা । আর কি যে সব বিদঘুটে খবর মাইরি । যেখানে বন্যা হবার কথা নয় সেখানে বন্যা । আর যেখানে খরা বিগত হাজার বছরে কখনও কেউ ভাবে নি সেখানে খরা ।

লোকটার কথা-বার্তা বেশ কিছুক্ষন ধরে শুনছিল সাদিক। বিশেষ মন দেয় নি । ও তার কর্মচারীরাই সামলে নেবে । তাই তাদের সঙ্গে একটু রসিকতার লোভ সামলাতে পারছিল না ।

কান খুঁটতে খুঁটতে বলল, বুঝলে কালি, এখন দেখছি রাজস্থানে বন্যা হচ্ছে । আর বঙ্গোপসাগরে নাকি যে খরা চলছে তা নাকি বিগত একশ বছরেও হয় নি । এসব যদি সত্যি হয় তো কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলোর পোয়া বার । ওদের হৈ হৈ কাটতি আর রৈ রৈ টি-আর-পি রোখে কে ? জগতটা সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে রে কালি সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে ।

-- ওই জন্যেই তো আমার ঘুমের ওষুধটা লাগবে স্যার ।

কর্মচারীদেরকিছুতেই ম্যানেজ করতে না পেরে লোকটা এতক্ষনে ছুটে এসেছে মালিকের কাছে । একেবারে দৌড়ে এসেছে যেন হাতে চাঁদ বা পরিত্রাতা পেয়েছে ।

-এমন সব ঘটছে বলেই তো আর একটু ঘুমোতে চাই স্যার । একটা পাতা না দেন একটা ট্যাবলেট অন্তত দিন ।

একজন কর্মচারীকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু গলায় বললেন, পেট গরম হয়েছে লোকটার বুঝতে পারছ না ? জেলুসিল আর হাল্কা কটা সিডেটিভ দিয়ে ছেড়ে দাও ।

-এক পাতা দিলেই ভাল হত । লোকটা তবু গাঁইগুই করে ।

-কেন এক পাতা পেলে কি করবেন ? একটা চোখ কুঁচকে প্রশ্নটা করল সাদিক ।

-কি আর করব । একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে লোকটা বলল, আরও গোটা কুড়ি বছর শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারতুম আর কি ।

- কু –ড়ি বছর ! এমন একটা হাফ পাগলকে এত কাছ থেকে পেয়ে সবাই যেমন আশ্চর্য তেমনি খুশি । সত্যি পাগলরা এমন কৌতুকের খোরাক জোগাতে পারে যা নামকরা সার্কাসের নামকরা জোকাররাও পারে না ।

কর্মচারী আর মালিকে চোখাচুখি হল যার মানে হল লোকটাকে এখন ছেড়ো না । ওকে বেশ কিছুক্ষণ খদ্দের করা যাবে ।

দোকানে ভীড় নেই । কর্মচারী ঢিমেতালে ওষুধ সার্ভ করছে । মালিক রসিয়ে আলাপ জুড়েছে । হচ্ছে রাজনীতি, রণনীতি, আবহাওয়া এই সব আলোচনা ।

-আবহাওয়া পাগলা হয়ে গেছে স্যার একেবারে just পাগলা । উস্কোখুস্কো পাগলা লোকটার ঝটতি মন্তব্য ।

মালিকের মুখে অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্য আর চোখের কোণে ইশারা দেখে কর্মচারীরাও মুখ টিপে হাসছে । সত্যি এমন খদ্দের কি হয় বড় একটা ।

মেডিসিন সারভ করা হয়ে গেছে । জেলুসিল আর হাল্কা সিডেটিভ । দোকানের মালিকের প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী একজন কর্মচারী দিয়েছে । সাদিক এবার পেমেন্ট নিয়ে বিল লিখবে । Quantity, দাম, ব্যাচ নম্বর এসব লেখা হয়ে গেছে । এসব হাল্কা ব্যাপারে ক্রেতার নাম কেউ লেখে না । তবু সাদিকের মনে হল নামটা হলে মন্দ হয় না । “খদ্দের” যখন হয়েছে তখন একটু “নামী” খদ্দের হলে ক্ষতি কি?

-নামটা কি লিখব দাদা ?

-আমার নাম স্যার ?

হাসিটাকে বাঁকা ঠোঁটের আড়ালে আটকে রেখে সাদিক বলল, তবে কার ? আপনি তো কিনছেন ?

-আমার নাম স্যার - লোকটা ইতস্ততঃ করল, নাম - কুড়ি বছরে অনেক কিছু গুলে মেরে দিয়েছি স্যার । কিন্তু এটা তো আমার দেশও নয় মনে হচ্ছে । আচ্ছা স্যর, সারা পৃথিবীটা কি এখন একটা দেশ হয়ে গেছে ? দুনিয়া কি সত্যি একটা মুঠির মধ্যে এসে গেছে ।

কর্মচারীরা হাসছে । একজন বলল, তাই তো মনে হয় দাদা । একজন শিল্পপতি স্লোগান তুলেছে যখন । সাদিক গম্ভীর । উত্তর দেওয়াটা জরুরী মনে করল না ।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে ।

-কি মনে পড়েছে ? সাদিক কৌতূহলী । ঠেলায় পড়লে নিজের বাপের নাম অনেকেই নাকি ভুলে যায় । কিন্তু নিজের নাম ভুলে যায় এমন লোক তো এখনও দেখে নি সাদিক । কৌতূহলী হবারই কথা ।

-নাম স্যার । মনে পড়েছে মনে পড়েছে । লোকটা প্রবল উৎসাহে বলে উঠল, লিখুন রিপ ভ্যান উইংকল । শুনেছেন কখনও ?

রম্য রচনা - নারায়ণ রায়

জ্যোতিষার্ণব ঘনাইশাস্ত্রী
নারায়ণ রায়



পটাইবাবুর বাড়ির রকে আমাদের চারজনের আড্ডাটা দিনে দিনে ভালই জমে উঠেছে, তবে ইদানিং ঘনাইবাবুকে আড্ডায় সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। টানা একমাস আড্ডায় ঘনাইবাবুর অনুপস্থিতি আমাদেরকে বেশ চিন্তায় ফেলল। ব্যাপারটা কি ? জানার জন্য আমরা তিনজন অর্থাৎ আমি, পটাইবাবু এবং লাটাইবাবু, ঘনাইবাবুর বাড়ি যাওয়া মনস্থ করলাম। এতদিনের পুরানো বন্ধু, আমাদের অবশ্যই উচিত তাঁর খবরাখবর নেওয়া।

একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে আমরা হাজির হলাম । কিন্তু এ আমরা কোন ঘনাইবাবুকে দেখছি? হটাৎ ঘনাইবাবু যেন কেমন পাল্টে গেছেন, আমাদের সেই আগেকার ঘনাইবাবু কোথায় গেলেন? ঘনাইবাবুর এ কি হ’ল ?

ঘনাইবাবু আমাদের দেখেও যেন চিনতে পারলেন না। মুখে অদ্ভুত সব কথাবার্তা। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই তার উত্তরে ওনার মুখ থেকে ‘কালসর্পযোগ’, ‘রাহুর বক্র দৃষ্টি’, ‘শনির সাড়ে সাতি’ এই ধরনের অবোধ্য সব শব্দ বেরোতে লাগলো। বেশ কিছুদিন ধরে চুল দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিয়েছেন, কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। গলায় ইয়া বড় একটা রুদ্রাক্ষের মালা আর পরনে গৈরিক বসন। ঘনাইবাবু ভীষন ভাবে জ্যোতিষ চর্চা শুরু করেছেন, বাড়ির বাইরের দেওয়ালে ইয়া বড় একটা সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন- ““জ্যোতিষার্ণব ঘনাইশাস্ত্রী—সন্তানের ভবিষ্যত ? স্ত্রী কিম্বা স্বামী অন্যের প্রতি আসক্ত ? মামলায় দুঃশ্চিন্তা ? সকল সমস্যার সমাধনে—‘বাবা ঘনাই শাস্ত্রী’।””

বৈঠক খানা ঘরটিতে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে চেম্বার খুলে বসেছেন। সঙ্গে কয়েকটি পুরানো পঞ্জিকা; লগ্ন, রাশিফল ইত্যাদি বিচারের বই, একটি আতস কাঁচ আর রঙ্গীন কাঁচের মত দেখতে কয়েকটা টুকরো টুকরো পাথর। সহকারী এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন পাড়ারই ছেলে কিচলুকে। কিচলু ঘনাইবাবুর কাছ থেকে বারোশ টাকা ধার নিয়েছিলেন তিন বছর আগে, সুদে আসলে সেটি এখন বত্রিশশো টাকার মত হয়েছে। বহু তাগাদা দিয়েও তা আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঘনাইবাবু এখন ঠিক করেছেন কিচলুকে মাসে পাঁচশো টাকার বেতনের কর্মী হিসেবে রেখে মাসে মাসে তিনশো টাকা করে কেটে নেবেন।

এমন সময়ে ঘনাইবাবুর অর্ধাঙ্গিনী ঘন্টুরানী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

এ কি? ঘন্টুদেবীকে তো চেনাই যাচ্ছে না, মাত্র গত একমাসেই চেহারা অর্ধেক হয়ে গেছে। কারণ জিগ্যেস করায় জানা গেল, ঘনাইবাবুর অর্ধাঙ্গিনী দীর্ঘদিনের উচ্চ রক্তচাপের রোগী, নিয়মিত তাকে দু’বেলায় পাঁচটি- করে ট্যাবলেট গলাধঃকরন করতে হয়, কিন্তু Charity Begins at Home এই নীতি মেনে ঘনাইবাবুর নির্দেশে এক নিমেষে সেসব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে ঘনাইবাবু ঘন্টুরানীর সর্বাঙ্গে মোট সাতটি তাবিজ ও কবচ বেঁধে দিয়ে বলেছেন, “রাহু আর কেতু দুই শয়তানকেই এমন আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে দিলাম যে কেউ আর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারে না। বেটারা নিজেরাই এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে পালাবে।”

আমরা যখন ঘনাইবাবুর এই সব কীর্তিকলাপ দর্শনে ব্যস্ত তখনই আমাদের মধ্যে উপস্থিত লাটাইবাবু সাহস সঞ্চয় করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ঘনাইবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনি এত বড় একজন জ্যোতিষ শাস্ত্রী হওয়ায় আপনার বন্ধু হিসেবে আমরা গর্বিতই”।

ঘনাইবাবু লাটাই বাবুকে জিগ্যেস করলেন, ওনার রাশি ও লগ্ন কি ? যখন জানলেন যে লাটাইবাবুর রাশি ‘কন্যা’ এবং লগ্ন ‘বৃশ্চিক’, অমনি গড়গড় করে বলে গেলেন, “আপনার রাশির অধিপতি বুধ, বর্তমান বছরটি আগের তুলনায় বেশ শুভ, আপনার আত্ম বিশ্বাস প্রবল থাকার ফলে যে কোনও অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতা আপনার থাকবে।”

একথা শ্রবণ করে লাটাইবাবু নিতান্তই কাচুমাচু মুখ করে বললেন, “কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী ? একথা যে এই ভূভারতে কেহই বিশ্বাস করবে না”।

ঘনাইবাবু বললেন, “আপনি অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু সেটি আপনার ভিতর হ’তে প্রকাশ পাচ্ছে না, আর এর জন্য চাই তিনরতি ক্যাটস্ আই কিম্বা সাত রতি গোমেদ। আর আপনার লগ্ন ‘বৃশ্চিক’ তাই লগ্নের অধিপতি মঙ্গল, এই লগ্নের জাতক-জাতিকারা সত্যবাদী ও নিষ্ঠাবান হয়ে থাকেন, অপরিসীম ইচ্ছা শক্তির বলে সব কাজেই অগ্রসর হয়ে থাকেন।”

লাটাইবাবু আবার আমতা আমতা করে ক্ষীন স্বরে প্রতিবাদ করে বলেন-“বরং ঐ জিনিসটারই আমার জীবনে সর্বাপেক্ষা অভাব, আজ যদি আমার অপরিসীম তো দূরের কথা সামান্য একটু ইচ্ছাশক্তি থাকলেও থাকতো তাহলে আজ নিশ্চয়ই আপনার মত প্রতিভাবান কেউ একটা হতাম।” সে যাই হোক আমরা খবর নিয়ে জানলাম যে ঘনাইবাবুর প্রতিদিন দুই তিন জন করে খরিদ্দার হচ্ছে এবং দৈনিক দুই-তিন শত টাকা আমদানিও হচ্ছে।

তবে সেদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, দুই একটি সৌজন্যমূলক বাক্য বিনিময় ছাড়া ঘনাইবাবুর বাড়িতে পুরো সময়টাই পটাইবাবু অদ্ভুত ভাবে শুধু নিশ্চুপ ছিলেন তাই নয়, ওনার চোখ মুখের মধ্যেও একটা অবিশ্বাস আর বিরক্তি ফুটে উঠছিল। যদিও ঘনাইবাবুর বাড়ি থেকে ফেরার সময়ে রাস্তায় ব্যাপারটা পরিস্কার হ’ল।

আমরা তিনজনই বাঙালী তাই যথারীতি ফেরার সময়ে রাস্তায় নেমেই ঘনাইবাবুর নিন্দা শুরু হ’ল, আর এব্যাপারে পটাইবাবুই অগ্রনী ভূমিকা নিলেন। বললেন, “বুঝলেন রায়বাবু, জ্যোতিষী হওয়া মোটেই অতো সহজ ব্যাপার নয়, অনেক সাধ্য সাধনা এবং দীর্ঘদিনের তপস্যার দ্বারাই প্রকৃত জ্যোতিষী হওয়া যায়। ও ব্যাটা ভেকধারী জ্যোতিষী হয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, আর এই লাইনে এখন ইনকাম বেশ ভালই।”

আমি পটাইবাবুর কথায় সম্মতি জানাতেই তিনি দ্বিগুন উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তবে হ্যাঁ প্রকৃত জ্যোতিষী জীবনে আমি একজনকেই দেখেছিলাম, তিনি হলেন বাবা কনখলানন্দ মহারাজ!” এই কথা বলে পটাইবাবু দুবার দুহাত করজোড় করে কপালে ঠেকালেন।

আমি সভয়ে জিগ্যেস করলাম, “আপনি তার দেখা কেমন করে পেলেন ?”

উত্তরে পটাইবাবু বলে চললেন, “তিনি সুদূর হিমালয়ের কনখলে গভীর জঙ্গলে বর্হিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এক গুহার মধ্যে বসবাস করেন, আমি কৈশোরে একবার হিমালয় দর্শনে গিয়ে ঐ মহামানবের সাক্ষাৎ পাই এবং কেন জানিনা প্রথম দর্শনেই আমাকে বাবার খুব ভালো লেগে যায়।”

আমি এবং লাটাইবাবু উভয়ে বললাম, “সত্যই তো এমন মহামানবের সাক্ষাৎ কয়জন পায়? আপনি প্রকৃতই ভাগ্যবান পটাইবাবু।”

পটাইবাবু আরও বলে চলেন, “আমি বাবার কাছে কিছু না চাইতেই বাবা আমাকে বললেন, আমি তোর কপালে এক দেবজ্যোতি দেখতে পাচ্ছি, তুই একদিন এই পৃথিবীতে একটা বিরাট কিছু হ’বি। এবং আরও নির্দিষ্ঠ ভাবে বলেছিলেন বড় হয়ে আমি অবশ্যই একজন কেউকেটা হ’ব, হয় উত্তম কুমারের মত অভিনেতা কিম্বা ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের মত ডাক্তার, অথবা গোষ্ট পালের মত ফুটবল খেলোয়ার হবই হব। অত বড় একজন জ্যোতিষী তার কথা কখনো বিফলে যেতে পারে?”

আমরা আরও কৌতুহল প্রদর্শন করে পটাইবাবুর দিকে তাকাতেই পটাইবাবু এক গভীর তৃপ্তির হাসি হেসে বলে চলেন “এখন আমাকে দেখে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে বাবা কনখলানন্দ মহারাজ কতবড় জ্যোতিষী ছিলেন। বাবা নিজেও বোধ হয় জানতেন না যে তার কথা এই ভাবে মিলবে, কারণ বাবা বলেছিলেন উপরের তিনজনের মধ্যে যেকোন একজনের গুণ আমার মধ্যে বর্তাবে। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা বাবার আশীর্বাদে এবং তাঁর শ্রী- চরণের স্পর্শে উক্ত তিনজনের গুনই আমি পেয়েছি।”

পটাইবাবুর একথা শ্রবণ করে আমি যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যখন ভাবছি, তা কিভাবে সম্ভব ? একজন মানুষ কি করে একই সঙ্গে বিধানবাবুর মত ডাক্তার, গোষ্টবাবুর মত খেলোয়ার আর উত্তমবাবুর মত অভিনেতা হবেন ? আর তাছাড়া কনখলের গভীর জঙ্গলে বসবাস করে বহির্জগত থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন থেকে তিনি বিধান রায়, উত্তম কুমার কিম্বা গোষ্ট পালের মত বাঙালীদের চিনলেন কিভাবে ? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তাঁর মুখপানে তাকাতেই তিনি ব্যাপারটি খোলসা করলেন, “আসলে আপনারা নিশ্চই পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অংক করেছেন… ব্যাপারটা সেইরূপ। একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিলেই আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি অবশ্যই উক্ত তিনজনের গুণ পেয়েছি, তবে গুণগুলিকে সামান্য একটু ঘুরিয়ে নিলেই হবে। অর্থাৎ আমি উত্তম কুমারের মত ডাক্তার, বিধান রায়ের মত ফুটবলার এবং গোষ্ট পালের মত অভিনেতা অবশ্যই হয়েছি।”

হাস্যকৌতুক - দেবাশিস কাঞ্জিলাল

সুকুমার রায়ের কথা
দেবাশিস কাঞ্জিলাল



আমাদের বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের কথা এলেই প্রথমেই যাঁদের নাম মনে আসে,সুকুমার রায় তাঁদের অন্যতম। এমন কোন বাঙ্গালী পাঠক নেই যিনি সুকুমার রায়ের রচনার সাথে পরিচিত নন।

কিন্তু তাঁর প্রায় সব রচনার সাথে আমরা পরিচিত থাকলেও ,তাঁর কিছু লেখা অনেকের এখনও খুব একটা পরিচিত নয়। সে সব লেখা ছড়িয়ে আছে নানা যায়গায়,চিঠিপত্রে। তাঁর জীবন-চর্যার মাঝেই জড়িয়ে ছিল যে হাস্যরস, তা তার চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়েও ঝলকানি দিয়ে যেত।

তাঁর ছাত্রাবস্থায় প্রেসিডেন্সী কলেজে তিনি ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সেখান থেকে ‘সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত নিয়মিত। সেই পত্রিকাই ছিল তাঁর ননসেন্স-লেখার ধাত্রীভূমি।

পরবর্তী কালে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এই ধরনের আরেকটি সংস্থা সৃষ্টি করেছিলেন,যার নাম দিয়েছিলেন ‘মন্ডা-ক্লাব’। এই আড্ডায় সদস্যরা প্রতি সোমবারে মিলতেন নানা বিষয়ে আড্ডা দিতে,যেখানে এমন কোন বিষয় থাকত না যা নিয়ে আলোচনা হত না।

সুকুমার মজার ছড়ায় এই আড্ডার আমন্ত্রণ-পত্র লিখে ক্লাবের সদস্যদের কাছে পাঠাতেন। যদিও সেগুলি প্রধানতঃ থাকত সভার ঘোষণা হিসেবে,তবু সেই সব চিঠির সরস সাহিত্য-মূল্য যে কতখানি তা সেই চিঠিগুলি পড়লেই বোঝা যাবে।

সেই চিঠিগুলির কয়েকটি এখানে সংগ্রহ করে দেওয়া গেল,আশা করি সেই লেখাগুলি থেকে সুকুমার রায়ের প্রতিভার ব্যাপ্তি কিছুটা হলেও সচেতন পাঠকেরা অনুভব করতে পারবেন।


চারটি আমন্ত্রণ-পত্র



এক

সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি তো যায় যায়।

তাই বলি সোমবারে
মদ-গৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।

রকমারি পুঁথি কত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে।

করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।


দুই

[এটি রবিঠাকুরের ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’ গানের প্যারডি]

কেউ বলেছে খাবো খাবো, কেউ বলেছে খাই
সবাই মিলে গোল তুলেছে, আমি তো আর নাই।

ছোটকু বলে, রইনু চুপে
ক’মাস ধরে কাহিল রূপে!
জংলি বলে “রামছাগলের, মাংস খেতে চাই।”

যতই বলি “সবুর কর”, কেউ শোনে না কালা,
জীবন বলে কোমর বেধে, কোথায় লুচির থালা ?

খোদন বলে রেগেমেগে
ভীষণ রোষে বিষম লেগে-
বিষ্যুতে কাল গড়-পারেতে
হাজির যেন পাই।


তিন

শনিবার ১৭ ই, সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়-পারে হৈ হৈ, সরবতী মেলা।

অতএব ঘড়ি ধরে, সাবকাশ হয়ে
আসিবেন দয়া করে, হাসি মুখে লয়ে।

সরবৎ সদালাপ, সঙ্গীত – ভীতি
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ, জেনে রাখ-ইতি।


চার


আমি, অর্থাৎ সেক্রেটারি,
মাস-তিনেক কল‌কেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে।

বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া,
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া!
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়
আমার প্রাণে এসব কি সয়?

এখন থেকে সম্‌‌ঝে রাখ,
এ সমস্ত চলবে নাকো,
আমি আবার এইছি ঘুরে,
তান ধরেছি সাবেক সুরে।

শুনবে এস সু-প্রবন্ধ
গিরিজার বিবেকানন্দ,
মঙ্গলবার আমার বাসায়।
আর থেক না ভোজের আশায়।।

রম্যরচনা - নারায়ণ রায়

টি উইথ পটাইবাবু
নারায়ণ রায়



আমাদের উত্তর কলকাতায় রকবাজি ব্যাপারটা এখনও চালু আছে। রকবাজি শব্দটার মধ্যে একটা ভালগারিটি আছে, তাই আমরা ভদ্র ভাষায় বলি ‘রকে বসে গল্প করা’। আরও সুন্দর করে বললে, বলতে হয় দুই বা ততোধিক ব্যাক্তির একত্রে একটি খোলা বারান্দায় বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। আমাদের পাড়ায় পটাইবাবুর পৈতৃক বাড়িতে রাস্তা বরাবর একটা সুন্দর বারান্দা আছে, সেখানে আমি, পটাইবাবু এবং পটাইবাবুর বন্ধু লাটাইবাবু এই তিনজন সকালে এবং সন্ধ্যায় কিছু সময় বসে গল্প গুজব করি। মাঝে মধ্যে কোন কোন দিন আরও দু এক জন জুটে যায়, তবে আমরা তিনজন এই ব্যাপারে খুবই নিয়মিত। আর সংখ্যায় তিনজনের অধিক হ’লে একটা অসুবিধাও আছে, পটাইবাবুর স্ত্রী সুরবালা আমাদের তিনজনের জন্য দৈনিক মোট তিনকাপ চা বরাদ্দ করে রেখেছেন, সেকারণে আড্ডাবাজের সংখ্যা তিনের অধিক হলে চায়ের পরিমান বৃদ্ধি পাবে না, বড়জোর সেই অতিরিক্ত সংখ্যার খালি কাপ পাওয়া যেতে পারে। বাঙ্গালি তো এমনিতেই চিরকাল আড্ডাবাজ বলে পরিচিত, ঘনাদা, টেনিদা, ব্রজদা এই সব প্রাতঃস্মরনীয় ব্যক্তিরা তেমন কোন কাজ না করে শুধু আড্ডা দিয়েই বিশ্ব খ্যাত হয়েছেন। শুধু আড্ডার জন্যই কফি হাউস ছাড়াও কলকাতার বেশ কয়েকটি রেস্তোরার আজ ভুবন জোড়া নাম। তবে পটাইবাবুর দুঃখ এ পোড়া বাংলাদেশে তাঁর প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হ’ল না, তিনি যদি ইউরোপ বা আমেরিকায় জন্মাতেন তাহলে নোবেল পুরস্কার না হলেও দু-চারটে অস্কার কিম্বা বুকার অবশ্যই পেতেন। তবে হ্যাঁ, পটাইবাবুর স্মরণ শক্তির জবাব নেই, এই এলাকার গত ষাট বছরের সমস্ত ঘটনা তাঁর মুখস্ত।



এখন আমাদের আড্ডা সম্বন্ধে কিছু বলার আগে আমাদের এলাকার একটি বর্ননা দেওয়া যাক। এই পাড়াটি নিতান্তই নিম্নবিত্ত এবং কিছুটা মধ্যবিত্ত এলাকা, এখনও বেশ কিছু ধুতিপরা লোক দেখতে পাওয়া যায়, বেশীরভাগ লোক সকালে লুঙ্গি পড়ে বাজার করতে যায়। এখনও এই এলাকায় প্রচুর পুরানো বাড়ি আছে, তবে আস্তে আস্তে সেসব বাড়ি ভেঙ্গে সেখানে বহুতল নির্মিত হচ্ছে, কিছুদিন পূর্বেও এমনই একটি বাড়ির গেটে একটি প্লাকে লেখা ছিল “এই বাড়িতে ভরতের প্রথম ডাচ গভর্ণর বাস করিতেন”। সম্প্রতি সেই বাড়িটিও ধূলিসাৎ হয়ে সেখানে একটি বহুতল নির্মিত হয়েছে। নিকটস্থ আর একটি বাড়ি, এলাকায় ‘বোবা স্কুল’ নামে পরিচিত ছিল, এই বাড়িটিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন বাস করেছিলেন এবং কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছিলেন, আজ সেই বাড়িটিও বহুতলের গহ্বরে ধূলিসাৎ ।



পটাইবাবুর বাড়ির সামনের রাস্তার উল্টোদিকে ডানদিকে একটি পুরানো বাড়িতে ‘আদর্শ মাতৃ সদন’ নামে একটি নার্সিং হোম আছে । রাস্তার উল্টোদিকে বাঁদিকে আগে একটি পুরানো জীর্ণ বাড়ি ছিল, সম্প্রতি সেখানে একটি বহুতল নির্মিত হয়েছে যার প্রথম দুটি তল বিবাহ অথবা ঐ ধরনের কোন উৎসবে ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম দেয়া হয়েছে ‘সুবর্ণরেখা’।



আমাদের আড্ডা-বারান্দার সামনের রাস্তাটি সোজা নাক বরাবর গঙ্গায় গিয়ে পড়েছে, পাশেই শ্রী রামকৃষ্ণ মহাশ্মশান, প্রায় প্রতি ঘন্টায় একটি দুটি করে মৃতদেহ যেতে দেখা যায়। মোটামুটি এই হ’ল আমাদের এলাকার বর্ননা।



এ পাড়ায় আমি মাত্র গত কয়েক বছরের বাসিন্দা। তাই যে কোন খোঁজ খবরের জন্য আমাকে পটাই বাবুর উপরেই নির্ভর করতে হয়। সে যাই হোক, অন্যান্য দিনের মত সেদিনও আমরা তিনজন যথারীতি বারন্দায় সবে বসেছি, এমন সময় দেখি সামনের নার্সিং হোমটায় একটি রিক্সা এসে দাঁড়াল এবং রিক্সা থেকে নেমে এক যুবক ভিতরে ঢুকে গেলেন। এই দৃশ্য দর্শণ করে পটাইবাবু যা বললেন তার সারমর্ম হ’ল - নার্সিং হোমটির আসল নাম ‘আদর্শ মাতৃ সদন’ হলেও সবার কাছে সেটি ‘বিলে ডাক্তারের নার্সিং হোম’ বলেই পরিচিত। গরিবের ডাক্তার বলে পাড়ায় বিলে ডাক্তারের বেশ সুনাম আছে। নিতান্তই সাদামাটা নার্সিং হোম, ডাক্তারবাবুর মত বাড়িটিও প্রাচীন, ডাক্তারবাবু ছাড়া দুইজন নার্স ও দুইজন মাত্র কর্মী আছেন। পাড়ায় ছোট খাটো কোন ঘটনা ঘটলে ডাক্তারবাবু নিজের হাতে রোগীর ক্ষতস্থানে মারকিউরোক্রোম লাগিয়ে এবং একটা অ্যান্টি টিটেনাস ইঞ্জেকশান দিয়ে আর জি করে পাঠিয়ে দেন, এছাড়া নার্সিংহোমে সন্তান প্রসবা মায়েদের চিকিৎসা এবং প্রসব হয়ে থাকে। বিলে ডাক্তারের আসল নাম ডাঃ বলেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত, বিলে ডক্তারের বাবা পরলোকগত ধীরেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত স্থানীয় বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক ছিলেন । সে যুগে শিক্ষকদের সমাজে বিশেষ মর্যাদা ছিল, অমন একজন পিতার পুত্র, তায় আবার চিকিৎসক, তাই পরিবারটিকে এলাকার লোকেরা বিশেষ সমীহ করে। কিছুক্ষন পরেই সেই যুবকটি তার কিশোরী বধূকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এসে রিক্সায় উঠলেন, কিশোরী বধুটির কোল আলো করে রয়েছে একটি সদ্যজাতক। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল,কিন্তু গোল বাধলো এর পরেই, যখন পটাইবাবু আমাকে জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা রায়বাবু আপনি কি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন?” আমি অসম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই তিনি বললেন, “এই হয়েছে মুশকিল, দু’কলম বিজ্ঞান পড়েই আপনারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। অথচ স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ প্লানচেটের মাধ্যমে পরলোকগত তাঁর প্রিয় ব্যক্তিদের আত্মাকে এই ধরাধামে আনতে সক্ষম ছিলেন।” হঠাৎ এসব কথা অবতারনার কারন জানতে চাওয়ায় পটাইবাবু বললেন, “ আসলে ঐ শিশুটির ললাট এবং মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটি দর্শন করে আমি নিশ্চিত জানতে পেরেছি যে শিশুটি পূর্বজন্মে কোন রাজনীতিবিদ ছিল।” যদিও সদ্যজাত শিশুর হাত সবসময় মুষ্টিবদ্ধই থাকে এবং বেশিরভাগ সময়ে চক্ষু দুটি বুজে থাকার জন্য কারও কারও কাছে তাকে চিন্তাশীল ব্যক্তির মতই লাগে, তবে পটাইবাবুর মুখের উপর একথা বলার সাহস আমার নেই, তাই মৌনব্রত অবলম্বন করাই শ্রেয় বলে মনে করলাম।



এদিকে ইতিমধ্যে পটাইবাবুর স্ত্রী সুরবালা একটা ভাঙ্গা প্লেটে তিনটে হাতল ভাঙ্গা কাপে তিনকাপ চা ঢিপ করে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। লাটাইবাবু প্রতিদিন এই একটি দায়িত্ব পালন করেন ! এক অদ্ভুত কায়দায় তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা একটি একটি করে কাপ এক এক জনের হাতে তুলে দেন। আমরা সবাই সবে চায়ে প্রথম চুমুক দিতে উদ্যত হয়েছি এমন সময়ে একটি গাড়ি এসে আমাদের আড্ডা বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ালো এবং একজন যুবক গাড়ি হ’তে গলা বার করে শুধালেন,. “আচ্ছা এখানে সুবর্ণরেখা বিয়েবাড়িটা কোথায় বলতে পারেন ?” লাটাইবাবু তার উত্তরে জানালেন যে, “আপনারা সেই বাড়িটির সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।”



এ কথা শুনে পটাইবাবু আমাদেরকে বললেন,“আপনারা কি এই বিয়ে বাড়িটির ইতিহাস কিঞ্চিত জানেন ?”



আমরা উভয়ে না বলায় পটাইবাবু যা বললেন তার মর্মার্থ হল,ঐ স্থানে আগে একটি পুরানো জীর্ণ বাড়ি ছিল, বাড়িটিতে একজন অশীতিপর বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা তাঁর অসুস্থা ষাটবর্ষীয়া কন্যাকে নিয়ে থাকতেন। এইরকম একটি জনবহুল এলাকায় বাড়িটিতে খুবই ভূতের উপদ্রব ছিল। প্রায়ই দিনে-দুপুরে ভূতেরা বাড়িটির উপর বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করত। একদিন সারাদিন ধরে বাড়িটির উপর অনেক বোমা পড়ল, বিকেলের দিকে গোলাগুলিও চলল। আহত দুই অসহায় বৃদ্ধাকে এলাকার কয়েকজন স্বঘোষিত সমাজসেবী যুবক হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন, তারপর থেকে তাঁরা আর এপাড়ায় ফিরে আসেননি, ঐ বাড়িটিতে, ভূতেদেরও আর দেখা মেলেনি। অতঃপর সেখানে একটি বহুতল নির্মিত হয়,যার প্রথম দুটি তল বিবাহ অথবা কোন উৎসব অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়, এবং এই হল ‘সুবর্ণরেখা’। এ’কথা বলার পর পটাইবাবু আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে এত কিছু শোনার পরেও আমার ভূত-প্রেতের ন্যায় অপদেবতায় বিশ্বাস আছে কিনা। আমি আমার বক্তব্য জানাবার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আমাদের সকলের নজর গিয়ে পড়ল ঐ বিবাহ বাড়িটির দিকে। গতকাল রাত্রে বিবাহ হওয়া দম্পতি সপার্ষদ শঙ্খধ্বনি সহযোগে বাইরে আসছে, নববধূ অবনত মস্তকে লাজুক বদনে এবং সিঁদুর রঞ্জিত সিঁথি নিয়ে প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতে চলেছেন। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে এক জোড়া নর নারীর মধ্যে এ কি এক অদ্ভুত পরিবর্তন। বিবাহিত জনেরা সকলেই এই পরিবর্তনটা উপলব্ধি করেছেন। মনে মনে যখন এই সব সাত পাঁচ ভাবছি তখন পটাইবাবু বললেন, “জানেন, শীতকালে কারো বিবাহ দেখলে আমার একটি বিশেষ কথা মনে পড়ে, ‘এক মাঘে শীত যায় না’ ! আমার জীবনে কিন্তু একটা মাঘেই জীবনের সব শীত চলে গিয়েছিল । লাটাইবাবু জিগ্যেস করলেন যে, কেন তিনি এমন কথা বলছেন ? তার উত্তরে পটাইবাবু বললেন-- “আমাদের বিয়ে হয়েছিল মাঘ মাসে, বিবাহে শ্বশুর মশাই দান সামগ্রী ও বিছানার সঙ্গে একটি খুবই মোলায়েম, ভেলভেটের লেপ দিয়েছিলেন, নতুন বিবাহের পর পরই মাঘ মাসে ঐ লেপের ভিতর শয়নের যে উষ্ণতা, তা’ আর জীবনের পরবর্তী বছর গুলির কোন মাঘ মাসেই আর ফিরে এলো না ? তাই আমার জীবনে ঐ এক মাঘেই জীবনের সমস্ত শীত চলে গিয়েছে। ”

আমাদের আড্ডার সময় ফুরিয়ে আসছিল, এমন সময় একটি শবযানে একটি মৃতদেহ যেতে দেখে লাটাইবাবু বললেন, “আজকাল মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার খুবই ভালো ব্যবস্থা হয়েছে। সুন্দর কাচে ঢাকা গাড়িতে ফুলের অলংকারে সজ্জিত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত অবস্থায় নীরবে চলে্‌ যাওয়া যায়।অথচ আগেকার দিনে একগাদা লোক মদ্য পান করে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে একটি মৃতদেহকে কাঁধে নিয়ে যেভাবে লাফাতে লাফাতে যেত,তা বড়ই দৃষ্টিকটু ছিল।” একথা শুনে পটাইবাবু বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন লাটাইবাবু, শুধু তাই নয় সাংসদ কিম্বা বিধায়কদের নাম শোভিত কিছু কিছু গাড়ি তো আবার রীতিমত শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত, যাতে মৃত ব্যক্তির স্বর্গ যাত্রার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়।” আমরা দুজনে পটাইবাবুর কথায় সম্মতি জানাতেই তিনি বলে চললেন,“আপনাদের অবগতির জন্য জানাই যে শুধু শবযান নয় আমার পরিচিত একজন জনপ্রতিনিধি তাঁর এলাকায় পুরো শ্মশান এমনকি চুল্লীর ভিতরটিও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছেন,কারণ ঐ জনপ্রতিনিধি ভদ্রলোক একেবারেই গরম সহ্য করতে পারেন না। তাঁর বাড়ির রান্নাঘর বাথরুম সবই শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত। তাই তিনি তাঁর এলাকার শ্মশানের চুল্লীটি পযর্ন্ত শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন,যাতে মৃত্যুর পর তিনি অত্যন্ত আরামদায়ক শীতল পরিবেশে পুড়তে পুড়তে স্বর্গে গমন করতে পারেন।” এ কথা শোনার পর অত্যন্ত সাহস সঞ্চয় ক’রে আমি পটাইবাবুকে জিগ্যেস করি, “সদ্যজাত শিশুর পূর্ব জন্মের পরিচয়, কিম্বা এক মাঘে শীত না কাটা পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল কিন্তু শ্মশানে চুল্লীর ভিতরটাও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত—এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না কী ?” এর উত্তরে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে পটাইবাবু বলে উঠলেন, “ঐ যে আপনারা দুকলম বিজ্ঞান পড়ে নিজেদেরকে বড্ড পন্ডিত ভাবে্‌ন, তাই এসব ব্যাপার নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করাই বৃথা।” সত্যি পটাইবাবুর মতো পন্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে আমার তর্ক করতে যাওয়া উচিৎ হয়নি,আমি যখন একথা ভাবছি তখনই লাটাইবাবু বললেন, “আপনারা বৃথাই তর্ক করছেন, আজ একটা ব্যাপার আপনারা লক্ষ করেছেন কি ?” ব্যপারটা কী জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন,“এখানে এতদিন বসছি, কিন্তু আজকেই প্রথম আমরা গত দুই ঘন্টায় জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু পর পর তিনটেই প্রত্যক্ষ করলাম।”

রম্যরচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ব্যক্তিগত জাতীয় সঙ্গীত
(সব চরিত্র কাল্পনিক )

অরুণ চট্টোপাধ্যায়



এখন মহাকাশ পরিক্রমা খুব সহজ হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা নাকি পরীক্ষা করে দেখেছেন সাহিত্য, কাব্য, এসব থেকে খুব শক্তিশালী এক ঝাঁক তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ মানে electromagnetic wave বেরোয়, যার সাহায্যে নাকি মহাকাশ পরিক্রমা করা যায় খুব সহজে।

আমার এক বন্ধু তার অন্য এক শক্তিশালী লেখক-বন্ধুর সাহিত্য-রস নিংড়োন তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবে কিছুদিন আগে আমাদের থেকে প্রায় আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। অবাক করা ব্যাপারটা হল এই যে, সেখানেও এক হবু-রাজ্যের সন্ধান সে পেয়ে গেল।

পেয়ে খুব খুশিও হল। হবু রাজা খুব অতিথি-পরায়ণ। আমার বন্ধুকে কিছুদিন থাকতে বললেন। আর বললেন, তোমাদের পৃথিবীতে ওই যে রবিঠাকুর বলে এক বিরাট ব্যক্তি আছেন, যার খুব বড় বড় দাড়ি আর দাড়ির চুলের সংখ্যার সমান তাঁর লেখা? আমি অবাক হই একটা মানুষ একটা মাত্র জীবনে এত কিছু লেখেন কি করে?

- আছেন নয়, রাজামশাই, ছিলেন। দেড়শ বছর আগে জন্মেছিলেন। আমার বন্ধু সার সত্যতা মনে করিয়ে দিল হবু রাজাকে।

- ও একই কথা। তাঁর মত মানুষ কি এখনও নেই তোমাদের মনের মধ্যে? তিনি কি অতীত হয়ে গেছেন? বর্তমানের পাতা থেকে মুছে দেয়া হয়েছে তাঁকে? বিদেয় করে দিয়েছ ইতিমধ্যে? ঝেড়ে ফেলে দিয়েছ নাকি?

- সেরকম চেষ্টা তো নিরন্তর চলছে রাজামশাই। বন্ধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাদের মত কিছু লোক নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছি তাঁকে রাখার জন্যে।

হবু শ্রদ্ধা-গদগদ ভাবে বললেন, শুনেছি ঠিক আমার মত একটা রাজা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন আর সেই রাজ্যের একটা চর্মকার প্রথম “জুতা আবিষ্কার “ করে?

বন্ধু ঘাড় নাড়ে। আর ভাবে আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহ কথাটা জানলেও আমরা কজন আর জানি?

রাজা আবার বললেন, শুনেছি তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে একশ বছর আগে তিনি তোমাদের বিশ্বের সেরা পুরস্কার পেয়েছিলেন?

হতাশভাবে বন্ধু ঘাড় নাড়ে।

- শুনেছি বেশ কিছু বছর আগে একটা চোর নাকি সে নোবেলটা –

বন্ধু এবার আর থাকতে পারে না। খুব রেগে গিয়ে বলল, কিচ্ছু জানেন না। তাতে কি শুনি? রেপ্লিকা তো রয়েছে?

হবু রাজা মৃদু হেসে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে বললেন, কুল ডাউন, মাই বয়। হ্যাভ পেসেন্স। ( এটাই এখন ইউনিভার্সের লিংক ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে গেছে )।

বলতে বলতেই হঠাৎ রাজার সামনের টেবিলে রাখা মোবাইল বাজল।

- হ্যালো গবু বলছ? – বল বল? – খুশি? খুব খুশি? আনন্দে নাচছে? বা বা। তুমি নাচো, আমিও নাচব।

ফোন বন্ধ করে আমার সেই বন্ধুর দিকে চেয়ে খুব খুশির সঙ্গে রাজা বললেন, আমি আজ আমার দেশটা ভেঙ্গে অনেক রাজ্য করে দিয়েছি জান? ওরা খুব খুশি। সব আলাদা আলাদা, মানে সেপারেট। ঠিক যেন সকলের একটা করে সেপারেট বেডরুম।

মিনিট খানেক যায়নি। হাতের মোবাইল এখনো হাতেই ধরা আছে। আবার ফোন বাজল।

- হ্যালো – কি - কি বলছ?

ওপারের গবু মন্ত্রী বলল, স্যার রাজ্যের সব জেলাগুলো আলাদা আলাদা রাজ্য হতে চাইছে।

রাজা একটু ভেবে বললেন, করে দাও, করে দাও। এমন খুশির দিনে –

মোবাইল টেবিলে রাখতে না রাখতেই আবার বাজল।

- হ্যালো।

ওপারের গবু বলল, স্যার বড় বিপদ।

- কি আবার হল?

- জেলার সব পুরসভাগুলো পুরো সভা, মানে পুরো রাজ্য হতে চাইছে স্যার। ওরা আর অর্ধ, মানে কারোর অধীনে থাকবে না বলছে।

রাজা একটু রেগে গিয়ে বললেন, এতে আবার বিপদ কিসের? করে দাও আলাদা রাজ্য। আজকের এই খুশির দিনে -

রাজা নিশ্চিন্ত হয়ে বন্ধুর সঙ্গে আবার বাতচিত শুরু করার মুহূর্তেই আবার রিং।

- স্যার আবার বিপদ। গবু বলল, সব পাড়াগুলো আলাদা রাজ্য হতে চাইছে যে। কি করব?

- কি আবার করবে? করে দাও। হা হা আজকের এই খুশির দিনে –

আবার ফোন, স্যার –

- কি হল?

- স্যার, সব বাড়ীগুলো আলাদা আলাদা –

- করে দাও না, বাপু। আজকের এই খুশির দিনে –

- বাড়ীর সব ফ্যামিলি মেম্বাররা ভোট দিয়ে হেড অফ দা ফ্যামিলি, মানে পরিবারের রাজা ঠিক করবে বলছে।

- করে দাও। এত চিন্তা কিসের? আজকের এই খুশির দিনে –

রাজার মেজাজ বেশ টং হচ্ছে বোঝা গেল। বন্ধুর সঙ্গে আর কথা হল না। নিজের ঘরে চলে গিয়ে খিল দিয়ে দিলেন। বন্ধু বসেই রইল। ভাবল পৃথিবীতে ফিরেই আসে। কিন্তু এত তাড়া কিসের? ব্যাপারটা কোন্‌ দিকে গড়াচ্ছে দেখে নিলে ভাল হয় না? আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূর থেকে ফিরতে তো মাত্র আশি মিনিট লাগবে।

আবার ফোন বাজল রাজার বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে। বন্ধু দরজায় কান পাতে।

- স্যার, বাড়ীর সব মেম্বার আলাদা আলাদা রাজ্য চাইছে। ওদের প্রত্যেকের রাজ্যে অন্ততঃ একটা করে বেডরুম, একটা ড্রয়িং, একটা ডাইনিং, একটা কিচেন, বাথরুম-পায়খানা, একটা লন আর একটা করে গার্ডেন থাকতেই হবে।

- কি বললে?

- হ্যাঁ স্যর, ওরা বলছে ওরা সবাই রাজা।

হবু বললেন, তা – ক রে দাও। আ জ কে র এ ই খুশির দিনে –

একটু পরে আবার ফোন, স্যার কেউ আর কাজের লোক পাচ্ছে না স্যার।

- কেন কি হল? বিব্রত আর বিধ্বস্ত হবুর প্রশ্ন।

- একজনের কাজের লোক বলেছে আমি তোমার বাড়ীতে কাজ করব কেন? এক রাজা কি আর এক রাজার বাড়ী কাজ করে? আপনার ফরমানে সবাই এখন রাজা হয়ে গেছে স্যার। প্রত্যেক ব্যক্তিগত বাড়ীতে এক একটা জাতীয় সঙ্গীত বা ন্যাশন্যাল এন্দেম চালু হবে স্যার।

- ও তাই বুঝি? এ তো বেশ ভাল খবর। একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন রাজা।

গবু একটু ইতস্ততঃ করে বলল, একটা কথা বলব স্যার?

- বল বল। আজকের এই খুশির দিনে –

- স্যার, আজ থেকে আমি কিন্তু আপনাকে আর স্যর বলব না, স্যার । কারণ আমিও তো একজন রাজা নাকি? পৃথিবীর একটা দেশের রাজা পুরু আলেকজান্ডারকে কি বলেছিল জানেন, স্যার? বলেছিল, আমি চাই রাজার প্রতি রাজার ব্যবহার। আর বীর আলেকজান্ডার তাতে খুশি হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল। আজকের এই খুশির দিনে আপনিও তো খুশি হয়ে আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন – না, স্যার, আর বলব না, স্যার।

এর পর আর কিছু শোনা গেল না। একটু খড়মড় খড়মড় আওয়াজ হল। আর তাঁর একটু পরে হবুর নাক ডাকার শব্দ পেল সে। বুঝল রাজা একটা ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিল।

এরপর সব মানুষ এক একটা আলাদা আলাদা রাজা হয়ে গেল। একটা ভীষণ ভাল কিন্তু হল এতে। কারণ কোনও প্রজা আর রইল না, তাই প্রজাপালনের ঝক্কি ঝামেলা কিছুই রইল না। রাজায় রাজায় যুদ্ধটা বেড়ে গেল কিনা সেটা হবুরাজা দেখতে পায় নি। সে তো এখন গভীর নিদ্রামগ্ন।

সব রাজার জাতীয় সঙ্গীত কিন্তু ওই একই র‍য়ে গেল। কে লিখল সেটা? কেন, দাদু আছে না? দাদুর ঝুলিতে কি নেই? সময় বুঝে শুধু বার করে দেবার অপেক্ষা। কথায় বলে, যা আছে ভারতে, তা আছে ভারতে, মানে মহাভারতে। তেমনি যা আছে রবিঠাকুরে, তা আছে সব ঠাকুরে, মানে সব সাহিত্যে।


তাই সবাই একটা গানই বেছে নিল এক বাক্যে। “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে –“। প্রত্যেক রাজা নিজের সুরে, নিজের ভাবে, নিজের ভঙ্গিতে গাইতে লাগল গানটা ।

রম্যরচনা - পিনাকি চক্রবর্তী

বোম্বে হাইওয়ে 
পিনাকি চক্রবর্তী



সাহাব, ই তো কারবুরেটর ওভারফালোট হ্যায়...

এক সপ্তাহ ধরে তিওয়ারীজীকে যতোটা চিনেছি, গাড়ীর আভ্যন্তরিক ব্যাপারে ইনি সাঙ্ঘাতিক রকম সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলে থাকেন। কিন্তু কারবুরেটার ওলোট পালোট মানে কি? ভেঙ্গেচুরে গেল নাকি ইঞ্জিনটা? জীপের বনেট খুললে সেটা এসে উইন্ডস্ক্রীনের ওপর চেপে বসে, ভেতরে বসে কিছুই বোঝা যায়না বাইরে কি হচ্ছে। তড়াক করে নেমে এসে তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আড়ে আর বহরে জীপের প্রায় সমমাপের তিওয়ারীজীর পাশ দিয়ে কিছু দেখা সহজ নয়। শুধু এইটুকু বুঝলাম যে তিনি অভিমানিনী প্রিয়ার মানভঞ্জন করার জন্য একটা স্প্যানারের উলটো দিকটা দিয়ে ইঞ্জিনের প্রত্যন্ত প্রদেশে কোথাও আলতো করে ঠোনা মেরে যাচ্ছেন একমনে। কোনো কথায় কান দিচ্ছেন না। হতাশ হয়ে বিকল জীপটার সঙ্গ ছেড়ে রাস্তার পাশের একটা মাইলস্টোনের ওপর চেপে বসে গত সপ্তাহের ঘটনাবলী মনে মনে রোমন্থন করতে লাগলাম।

একটা তেলের কম্পানিতে জিওলজিস্টের চাকরী করি, দেশের ঈশান কোণের পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই তেলের সন্ধানে, হাতে হাতুড়ি আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং তাম্বুমন্দিরে। হঠাৎ হেডকোয়ার্টারে তলব।

পিনাকী, তোমাকেই গাড়ীদুটো নিয়ে যেতে হবে ভাই কাঁঠালিয়া পর্যন্ত। বলবিন্দর সিং রানাওয়াত, আমার পার্টী চীফ এবং বন্ধু, অনুরোধের সুরে বলেছিলো আমাকে। হাবেভাবে মনে হচ্ছিল ‘সিধে রাস্তা, সোয়া ঘন্টার পথ, গেলেই হল’ – এইরকম কিছু একটা বোঝাচ্ছে আমাকে। পার্টীচীফ যখন বলছে, সেটা তো আর অনুরোধ নয়, হুকুম, সুতরাং যেতেই হবে। কিন্তু, সত্যি করে তো আর কিছু সোয়া ঘন্টার পথ নয়, কলকাতা থেকে ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্ত, হিসেব মত দু হাজার কিলমিটারের ওপর। দুই দুটো জীপ, পেছনে ট্রেলারে ভর্তি যন্ত্রপাতি, তাঁবু, খাটিয়া মায় বিছানা পর্যন্ত, মাক্সিমাম স্পীড উঠবে চল্লিশ। দিনে দুশো কিলোমিটার গেলে মোট লাগবে দশ এগারো দিন, তাও যদি গাড়ী ঠিকঠাক চলে। নাহলে খোদায় মালুম কবে পৌঁছাবো।

তাও নাহয় হলো, কিন্তু সঙ্গে যাবে কে? ড্রাইভার তিওয়ারীজী আর জোরা সিং এবং অ্যাটেন্ডেন্ট ভুট্টিপ্রসাদ। অন্য একজন অফিসার কই? আর কেউ নেই, তোমাকেই সামলাতে হবে দুটো গাড়ী। যাব্বাবা! রাস্তাঘাটে কিছু বিপদ আপদ হলে কি হবে? আপদ বিপদ কিছু হবে না, গাড়ী দুটো টনাট্টন সারানো আছে। প্লীস্ পিনাকী, আর কেউ নেই আমার হাতে!

মানে? আমি ওর হাতে আছি? আহ্লাদের ঘনঘটা আর কি! আমাকে পেয়েছে কি ও? আর, এই তো গাড়ী সারানোর নমুনা! প্রথম দিনে বারাসাত পৌঁছতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। তিওয়ারীজীর গাড়ী “মৌসম পাকড়তিহী নহী।” অনেক হাঁচোড়পাঁচোড় করে বুঝলাম মৌসম মানে মোশন, সাদা বাংলায় গাড়ী পিকআপ নিচ্ছে না। আমরা যতক্ষণ চাঁপাডালির মোড়ে পাইস হোটেলে ডালভাত খেলাম, তিওয়ারীজী গাড়ীর মৌসম ঠিক করলেন। তারপর সন্ধ্যেবেলা মধ্যাহ্নভোজন করলেন তিনি। বহু কষ্টে বহরমপুর পৌঁছলাম মাঝরাতে।

প্রথম দিনের ধাক্কায় পরের দিন দেরী হয়ে গেল বেরোতে বেরোতে। বহরমপুর থেকে লালগোলা, ফরাক্কা, মালদা হয়েরায়গঞ্জ এসে সব্বাই ক্লান্ত। থেকে গেলাম রায়গঞ্জ ডাকবাংলোতে। পরের দিন রায়গঞ্জ থেকে বেরিয়ে ইসলামপুর সবে পেরিয়েছি আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে, এমন সময়ে ঘটংঘট করে গাড়ী ফুলস্টপ। আশীর্বাদের ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নেবেন না। যাঁরা রাস্তাঘাটে যাতায়াত করেন তাঁরা বুঝবেন ইন্টারস্টেট বাউন্ডারি একবার এপার একবার ওপার করা কি যন্তর জিনিস! আর এই ঘটনাটা ঘটে ডালখোলা থেকে কিষাণগঞ্জ হয়ে ইসলামপুরের পথে দুই দুবার। সারা পৃথিবীর যত ট্রাক, টেম্পো, ঠেলাগাড়ী – সব দাঁড়িয়ে থাকে বর্ডার চেকপোস্টে – লাইন দিয়ে নয়, জট পাকিয়ে। সেই যানজট দুবার করে ঠেলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি সবে, এমন সময় “রেডিওয়াটার লীক হোগয়া।” এটা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য রোগ। রেডিয়েটর লিক করে জল সব বেরিয়ে গেছে। তা মাঝরাস্তায় রেডিয়েটর ঝালাইমিস্ত্রী কোথায় পাই? জোরা সিংএর জীপটাকে ট্রেলারমুক্ত করে মিস্ত্রী আনতে পাঠাবো নাকি? তিওয়ারীজী পরম আশ্বাসে বললেন, “হজৌর, ঘাবড়াইয়ে মত, অভী দুরুস্ত কর দেতে হেঁ।”

নিজের কালো রঙের একটা টয়লেট ব্যাগ থেকে ঝপ করে বের করলেন একটা কাপড় কাচার ৫০১ বার সাবান। ছুরি দিয়ে তার একটা টুকরো কেটে নিয়ে, অল্প জল দিয়ে টিপেটুপে সেটাকে একটা নরম পুট্টি বানিয়ে ফেলে যেখানে যেখানে লিক বলে সন্দেহ ছিল সেখানে নিপুণ হাতে তাপ্পি দিয়ে দিলেন। আমি তাজ্জব! তারপর একটা জেরিক্যানে এইরকম সম্ভাবনার কথা ভেবেই বোধহয় জমিয়ে রাখা জল দিয়ে “রেডিওয়াটার” আবার শূন্য হতে পূর্ণ হল, এবং অচল গাড়ী আবার সচল হোলো। কিন্তু দশ-বারো কিলোমিটার যেতে না যেতেই আবার লিক, আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই উপর্যূপরি যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি শিলিগুড়ি পৌঁছে, ফাটা রেডিওয়াটার ঝালাই করিয়ে।

শিলিগুড়ি থেকে গোঁসাইগাঁও তিওয়ারীজীর গাড়ী কোনোরকম বেগড়বাঁই করে নি। রাস্তায় গুচ্ছ গুচ্ছ নদী, আমি মনে মনে স্কুলের ভূগোল বইএর পাতায় ডুব দিয়ে মহানন্দা, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক গুণতে গুণতে চলেছিলাম। কিন্তু তখনই এল জোরা সিংএর পালা। তার জীপের ট্রেলার টানার হূক-ব্লকটার “রিপিট” গেল কেটে, হাসিমারার কাছাকাছি। এটার আর কোন টোটকা দাবাই হয় না। ট্রেলার খুলে জোরা সিং ভুট্টিকে সাথে নিয়ে গিয়ে রিভেট করিয়ে আনল কোথার থেকে যেন, ঠিক মনে নেই। আমার যা মনে আছে তা হোলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে থেকে হঠাৎ হঠাৎ কানফাটা শব্দ তুলে জোড়ায় জোড়ায় যুদ্ধবিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো, আর আমি হাঁ করে তাদের ডেলটা উইং আর নোজকোন দেখে এরা মিগের কোন প্রজাতী বোঝার চেষ্টামাত্র করছিলাম।

রিভেট করে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেল, আর তাই আমরাও মেরেকেটে বড়পেটা ডাকবাংলো পর্যন্ত পৌঁছলাম রাত আটটায়। মাঝখানে গোঁসাইগাঁওএ আসামের সীমানা শুরু। সেখানে সব কাজও হয় লাহে লাহে (মানে আস্তে ধীরে)। জীপের সামনে “ভারত সরকার” লেখাটা আবার ওই মুল্লুকে ব্যাকফায়ার করতো সেই যুগে। সে যাইহোক, বড়পেটা জায়গাটা বড়ই মনোরম। একবার ভেবেছিলাম শেষজীবনে বড়পেটায় একটা ছোট্ট কাঠের বাড়ি বানিয়ে থাকব। পাশে নদী, পেছনে ভুটানের হিমালয় পাহাড় আর নীল জঙ্গল, সামনে সবুজ মাঠ। ভাগ্যিস আজকাল আর ভাবি না!

পরদিন বড়পেটা ছেড়ে গৌহাটীর পথে রঙ্গিয়ায় দেখা হলো ব্রহ্মপুত্রের সাথে। আর জীপ তাই দেখে চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তিওয়ারীজীর কম্পাউন্ডারি বিদ্যেতে এবার আর কুলালো না। ভালো জীপটা প্রথমে খারাপটাকে টেনে নিয়ে গেলো গৌহাটীতে মাহিন্দ্রা ওয়ার্কশপএ, তারপর একে একে দুটো ট্রেলারকে টেনে নিয়ে এলো গৌহাটীর একটা হোটেলে। রাত কাটলো দুশ্চিন্তায় আর বদহজমে।

পরদিন সক্কালবেলা ভগ্নদূতের মতো তিওয়ারীজী এলেন হোটেলে, জানালেন যে জীপের “ইলিক্ট্রিক ফায়ার ফুঁক গয়া”... ইলেকট্রিকের আগুণ, মানে স্পার্ক প্লাগের কো্নো গন্ডগোল? আরে নহী সাহাব, তিওয়ারীজী আমাকে বোঝানোর আশা অনেক আগেই ত্যাগ করেছেন বোঝা গেল, পকেট থেকে একটা ছোট্ট তেঁতুলেবিছে টাইপের দাঁড়াওয়ালা কি যেন বের করে আমার হাতে দিলেন। তখন বয়েস কম, চোখের তেজ বেশী, দেখলাম ক্ষুদে ক্ষুদে হরফে লেখা আছে লুকাস আরসিটি ১২ভি এসি। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে একটা প্রশ্ন এল, বললাম, এটা কি অলটারনেটারের রেক্টিফায়ার? এক প্রশ্নে আমার হৃত সম্মান পুনরূদ্ধার হয়ে গেলো। সসম্ভ্রমে তিওয়ারীজী বললেন, জী হজৌর!

সেই যে গাড়ী ঠিক হলো, তারপর গৌহাটী থেকে জোড়াবাট, উমস্নিং, শিলং, জোয়াই হয়ে বদরপুর টপকে নীলমবাজার থেকে ধর্মনগর যাবার পথে আর কোন ঝামেলা হয় নি। সেটা হতে হোল শেষমেশ এই উগ্রপন্থীদের আড্ডা বারোমূড়ায়? আগরতলা আর মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূর, জানাচ্ছে আমার নীচে থেকে এই মাইলস্টোনটা!

কি করে পার পেলাম সে যাত্রা? কিভাবে পৌঁছলাম কাঁঠালিয়া? আদৌ পৌঁছলাম কি? আর না পৌঁছালেই বা ক্ষতি কি? সে সব প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলে রাত কাবার হয়ে যাবে। অন্য কোনোদিন হবে, যদি আপনারা সত্যিই জানতে চান। কিন্তু একটা কথা আজ বলা দরকার, সেটা হোল এই গল্পের নামের সাথে গল্পটার সম্পর্কের কথা।

এই ঘটনার সাত বছর পরে আমি ফিরেছি তিওয়ারীজীর সাথে, মিজোরাম থেকে। ফিরেই হাতে পেলাম ট্রান্সফার অর্ডার। যেতে হবে বোম্বে উপকূলে, আরব সাগরের মাঝে তেলের সন্ধানে। সেই সময়ে বোম্বে হাই দৈত্যপ্রায় তেলের খনী, দেশবাসী মাত্রেই এর নাম জানেন। সেই অঞ্চলে কাজ করতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। সহকর্মীরা সবাই ব্যাজার, ফিল্ডপার্টীর কাজে সবাই এক পরিবারভুক্ত হয়ে কাজ করেন, তাই কারুর যাওয়াটাই সহজে মেনে নেন না। কিন্তু বোম্বে হাই বলে কথা!

বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সবাই একে একে ভাষণ দিলেন, আমার নিজের গুণপনার কথা নিজের কানে শুনতে শুনতে আমার মত নির্লজ্জেরও কান লাল হলো। আমাকে যিনি এতদিনে সবচেয়ে ভাল করে চিনেছেন, সেই তিওয়ারীজী বলতে উঠলেন সবার শেষে। পাত্থর থেকে ইঞ্জিন পর্যন্ত সব ব্যাপারে আমার জ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি জানালেন যে আমি যেরকম আসাম থেকে ত্রিপুরা, সর্বত্র সুনাম অর্জন করেছি, তিনি আশা করছেন যে বোম্বে হাইওয়েতেও আমি ততটাই কর্মদক্ষতা দেখাতে পারব!

অভিজ্ঞ ড্রাইভার মানুষ, বোম্বে হাই কে বোম্বে হাইওয়ে করে নিয়েছিলেন নিজগুণে!

বয়োজ্যেষ্ঠ তিওয়ারীজীর আশীর্বাদে আর আপনাদের শুভেচ্ছায় আমি কিন্তু পেরেছি!ওই কর্মদক্ষতা দেখাতে, আর কি!

রম্যরচনা - শকুন্তলা দে

নাগরদোলা
শকুন্তলা দে


আমার বাড়ি থেকে একটু এগোলেই বেশ বড় একটা পার্ক আছে। অবশ্য পার্ক বলতে যা বোঝায় এটা সেই রকম নয়, চারিদিকটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পাঁচিল, আর তার উপরে গ্রিল দিয়ে নকশা করা। পার্কের ভেতরটা সবুজ ঘাস, আর ধারে ধারে বেশ বড় কিছু গাছ।এর মধ্যে বকুল ফুলের গাছই বেশি। আমার খুব প্রিয় এই ফুল- ছোট্ট সুন্দর ফুলটা মোহময় গন্ধ ছড়িয়ে রাখে চারিদিকে। এই বড় গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ আছে। সাধারণত ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলাতে বেশ কিছু নানান বয়েসের মানুষ এখানে হাঁটতে আসে। এই পার্কের আর একটা বৈশিষ্ট্য হোল ভেতরে বেঞ্চ আর গাছের সারির সামনে দিয়ে বেশ ভালোভাবে হাঁটার জন্য বাঁধানো রাস্তা আছে। একজন মানুষ নিশ্চিন্তে চোখ বুজে পার্কের চারদিকে হেঁটে বেড়াতে পারবে। আর হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার জন্য সুন্দর বাঁধানো বেঞ্চও আছে। এক কথায় এই পার্কটা আমার কাছে খুব মনোরম জায়গা। তাই নিয়মিত আমিও এখানে আসি। মাঝখানে খোলা জায়গাটাতে প্রায় সময়ই কিছু না কিছু মেলা লেগেই থাকে, আর সেই উপলক্ষে নানান লোকের আনাগোনা হয়। তাদের কাজ করা দেখা, তাদের কথোপকথন শোনা, এই সব নিয়ে আমার বেশ ভালোই সময় কেটে যায়।

আজ ঠিক করেই এসেছিলাম যে হাঁটবো না, তাই একটু বেলা থাকতে এসে বসে আছি আর মেলার লোকজনদের দেখছি। এখনো বাইরের লোকজন আসা সেই ভাবে শুরু হয়নি তাই মেলার দোকানের যারা নিজস্ব লোকজন তারা একটু গাছাড়া দিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি, ঠাট্টা আর আড্ডায় ব্যস্ত। আমার সামনেই একটা বাচ্চাদের নাগরদোলা। মাঝখানে একটা মোটা খুঁটি পোঁতা আছে আর তাকে ঘিরে চারিদিকে হাতি, ঘোড়া ,বাঘ, সিংহ, কুমীর সব লোহার দড়ি দিয়ে ঝোলানো। ছোটো বাচ্চাদের তার উপরে বসিয়ে দিয়ে বন বন করে ঘোরানো হয়। বাচ্চারা তো দারুণ উপভোগ করেই, এমনকি তাদের নিয়ে আসা কাছের মানুষেরাও বেশ উপভোগ করে বাচ্চাদের এই হাসিমুখ আর আনন্দের চিৎকার। আমিও এখানে বসেই ওদের সাথে ওদের আনন্দের শরিক হই।

এই নিয়ে এতো বেশী করে ভাবার হয়তো এটাও একটা কারন যে, আমার এই ভাবনার ফাঁকে বেশ কয়েকজন বাচ্চা এসে বসেছে ঐ নাগরদোলাতে আর চীৎকার করে বলছে-“আরও জোরে আরও জোরে...। ” ওদের চীৎকারের সাথে সাথে আমার মনটা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। মনে হোলও আমি যেন ঐ নাগরদোলার খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর আমাকে ঘিরে ঐ সব হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, কুমীর বন বন করে ঘুরছে আমাকে ঘিরে। আমি তাকিয়ে আছি। আমার চোখের সামনে দিয়ে ওরা ছুটছে। হঠাৎ মনে হোলো -ওগুলো জন্তু নয়, আমার চেনা সব মানুষের মুখ। আমাকে ঘিরে ওরা ছুটছে বন বন করে। কখনো জন্তুর মুখউ, আবার কখনো আমার চেনা সব মানুষদের মুখ। আমি দিশেহারা হয়ে তাকাচ্ছি ওদের দিকে। ওদের ছুঁতে চাইছি, ওদের ধরতে চাইছি, ওদের থামাতে চাইছি। কিন্তু কোনটাই করতে পারছি না। সারাটা মন অস্থির হয়ে উঠছে, আকূল হয়ে অপেক্ষা করছি, কেউ একজন আসুক যে আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে।


বর্ষার চতুর্দশ কাহন - গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্ষার চতুর্দশ কাহন
গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়


১) বর্ষার প্রিয় গান কি ?......... বারান্দায় রোদ্দুর

২) বর্ষা কাদের কাছে প্রিয়........... স্কুলের ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের কাছে, কারণ বৃষ্টি হলেই স্কুল ছুটি, মজাই মজা

৩) বর্ষা কাদের কাছে অপ্রিয়........... কলকাতা কর্পোরেশনের কাছে, কারণ আবার তো গালাগালি শুরু হবে

৪) বর্ষায় কারা বেশী সজীব ............. সমস্ত ব্যাঙ সমাজ

৫) বর্ষায় কারা বেশী নির্জীব ............... শহরের মিছিলধারীরা

৬) বর্ষার প্রিয় পোশাক কি ............... ছেলেদের গায়ে রেনকোট, বার্মুডা ও পায়ে সান্ডাক জুতো এবং মেয়েদের পরনে সিন্থেটিক শাড়ী, মাথায় ছাতা ও পায়ে সান্ডাক জুতো

৭) বর্ষার প্রিয় খাবার কি ............... দুপুরে খিচুড়ি ও পাপড় ভাজা এবং বিকালে তেলেভাজা ও মুড়ি

৮) বর্ষায় সবচেয়ে লাভ কি ............... যে এলাকায় জলের প্রেশার কম তারা বেশী জল পায়, কিছুদিন জল কষ্ট ভুলে থাকে

৯) বর্ষায় সবচেয়ে ক্ষতি কি ............... সারা ঘরে সোঁদা সোঁদা গন্ধ, কারণ সারা বাড়ী জুড়েই ভেজা জামা কাপড় মেলা থাকে

১০) বর্ষায় কাদের লাভ বেশী ............... ছাতা বিক্রিওয়ালা ও রাস্তা সারাইওয়ালাদের

১১) বর্ষায় কাদের ক্ষতি বেশী ............... বাংলার সুতী বস্ত্র নির্মাতাদের, কারণ পড়লেই তো “ভেজা কাক”, বিক্রি নেই

১২) বর্ষা কেন হয় ............... ছয় ঋতুর দ্বিতীয় ঋতু হিসাবে নিয়মমাফিক সময়মত বর্ষা আসে এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয়

১৩) এখন বর্ষা কেন হয় ............... এখন পঞ্জিকা মেনে সময়মত বর্ষা আসেনা, যখন সময় পায় তখনই এসে পৌঁছয় এবং প্রায় সারা বছরই নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হয়। সারা বাজারে সর্বদা দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধচাপ, মানুষের শরীরে টেনশন জনিত কারনে সর্বদা রক্তে ঊর্দ্ধচাপ, অথচ সারা বছর আকাশে এত নিম্নচাপ আসে কোথা থেকে বুঝিনা

১৪) বর্ষা আমার কেমন লাগে ............... ফাটা-ফাটি যদি না বাইরে বেড়োতে হয় এবং হাতে থাকে গল্পের বই