ব্যক্তিগত জাতীয় সঙ্গীত
(সব চরিত্র কাল্পনিক )
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
এখন মহাকাশ পরিক্রমা খুব সহজ হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা নাকি পরীক্ষা করে দেখেছেন সাহিত্য, কাব্য, এসব থেকে খুব শক্তিশালী এক ঝাঁক তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ মানে electromagnetic wave বেরোয়, যার সাহায্যে নাকি মহাকাশ পরিক্রমা করা যায় খুব সহজে।
আমার এক বন্ধু তার অন্য এক শক্তিশালী লেখক-বন্ধুর সাহিত্য-রস নিংড়োন তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবে কিছুদিন আগে আমাদের থেকে প্রায় আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। অবাক করা ব্যাপারটা হল এই যে, সেখানেও এক হবু-রাজ্যের সন্ধান সে পেয়ে গেল।
পেয়ে খুব খুশিও হল। হবু রাজা খুব অতিথি-পরায়ণ। আমার বন্ধুকে কিছুদিন থাকতে বললেন। আর বললেন, তোমাদের পৃথিবীতে ওই যে রবিঠাকুর বলে এক বিরাট ব্যক্তি আছেন, যার খুব বড় বড় দাড়ি আর দাড়ির চুলের সংখ্যার সমান তাঁর লেখা? আমি অবাক হই একটা মানুষ একটা মাত্র জীবনে এত কিছু লেখেন কি করে?
- আছেন নয়, রাজামশাই, ছিলেন। দেড়শ বছর আগে জন্মেছিলেন। আমার বন্ধু সার সত্যতা মনে করিয়ে দিল হবু রাজাকে।
- ও একই কথা। তাঁর মত মানুষ কি এখনও নেই তোমাদের মনের মধ্যে? তিনি কি অতীত হয়ে গেছেন? বর্তমানের পাতা থেকে মুছে দেয়া হয়েছে তাঁকে? বিদেয় করে দিয়েছ ইতিমধ্যে? ঝেড়ে ফেলে দিয়েছ নাকি?
- সেরকম চেষ্টা তো নিরন্তর চলছে রাজামশাই। বন্ধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাদের মত কিছু লোক নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছি তাঁকে রাখার জন্যে।
হবু শ্রদ্ধা-গদগদ ভাবে বললেন, শুনেছি ঠিক আমার মত একটা রাজা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন আর সেই রাজ্যের একটা চর্মকার প্রথম “জুতা আবিষ্কার “ করে?
বন্ধু ঘাড় নাড়ে। আর ভাবে আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহ কথাটা জানলেও আমরা কজন আর জানি?
রাজা আবার বললেন, শুনেছি তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে একশ বছর আগে তিনি তোমাদের বিশ্বের সেরা পুরস্কার পেয়েছিলেন?
হতাশভাবে বন্ধু ঘাড় নাড়ে।
- শুনেছি বেশ কিছু বছর আগে একটা চোর নাকি সে নোবেলটা –
বন্ধু এবার আর থাকতে পারে না। খুব রেগে গিয়ে বলল, কিচ্ছু জানেন না। তাতে কি শুনি? রেপ্লিকা তো রয়েছে?
হবু রাজা মৃদু হেসে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে বললেন, কুল ডাউন, মাই বয়। হ্যাভ পেসেন্স। ( এটাই এখন ইউনিভার্সের লিংক ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে গেছে )।
বলতে বলতেই হঠাৎ রাজার সামনের টেবিলে রাখা মোবাইল বাজল।
- হ্যালো গবু বলছ? – বল বল? – খুশি? খুব খুশি? আনন্দে নাচছে? বা বা। তুমি নাচো, আমিও নাচব।
ফোন বন্ধ করে আমার সেই বন্ধুর দিকে চেয়ে খুব খুশির সঙ্গে রাজা বললেন, আমি আজ আমার দেশটা ভেঙ্গে অনেক রাজ্য করে দিয়েছি জান? ওরা খুব খুশি। সব আলাদা আলাদা, মানে সেপারেট। ঠিক যেন সকলের একটা করে সেপারেট বেডরুম।
মিনিট খানেক যায়নি। হাতের মোবাইল এখনো হাতেই ধরা আছে। আবার ফোন বাজল।
- হ্যালো – কি - কি বলছ?
ওপারের গবু মন্ত্রী বলল, স্যার রাজ্যের সব জেলাগুলো আলাদা আলাদা রাজ্য হতে চাইছে।
রাজা একটু ভেবে বললেন, করে দাও, করে দাও। এমন খুশির দিনে –
মোবাইল টেবিলে রাখতে না রাখতেই আবার বাজল।
- হ্যালো।
ওপারের গবু বলল, স্যার বড় বিপদ।
- কি আবার হল?
- জেলার সব পুরসভাগুলো পুরো সভা, মানে পুরো রাজ্য হতে চাইছে স্যার। ওরা আর অর্ধ, মানে কারোর অধীনে থাকবে না বলছে।
রাজা একটু রেগে গিয়ে বললেন, এতে আবার বিপদ কিসের? করে দাও আলাদা রাজ্য। আজকের এই খুশির দিনে -
রাজা নিশ্চিন্ত হয়ে বন্ধুর সঙ্গে আবার বাতচিত শুরু করার মুহূর্তেই আবার রিং।
- স্যার আবার বিপদ। গবু বলল, সব পাড়াগুলো আলাদা রাজ্য হতে চাইছে যে। কি করব?
- কি আবার করবে? করে দাও। হা হা আজকের এই খুশির দিনে –
আবার ফোন, স্যার –
- কি হল?
- স্যার, সব বাড়ীগুলো আলাদা আলাদা –
- করে দাও না, বাপু। আজকের এই খুশির দিনে –
- বাড়ীর সব ফ্যামিলি মেম্বাররা ভোট দিয়ে হেড অফ দা ফ্যামিলি, মানে পরিবারের রাজা ঠিক করবে বলছে।
- করে দাও। এত চিন্তা কিসের? আজকের এই খুশির দিনে –
রাজার মেজাজ বেশ টং হচ্ছে বোঝা গেল। বন্ধুর সঙ্গে আর কথা হল না। নিজের ঘরে চলে গিয়ে খিল দিয়ে দিলেন। বন্ধু বসেই রইল। ভাবল পৃথিবীতে ফিরেই আসে। কিন্তু এত তাড়া কিসের? ব্যাপারটা কোন্ দিকে গড়াচ্ছে দেখে নিলে ভাল হয় না? আশি হাজার কোটী আলোকবর্ষ দূর থেকে ফিরতে তো মাত্র আশি মিনিট লাগবে।
আবার ফোন বাজল রাজার বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে। বন্ধু দরজায় কান পাতে।
- স্যার, বাড়ীর সব মেম্বার আলাদা আলাদা রাজ্য চাইছে। ওদের প্রত্যেকের রাজ্যে অন্ততঃ একটা করে বেডরুম, একটা ড্রয়িং, একটা ডাইনিং, একটা কিচেন, বাথরুম-পায়খানা, একটা লন আর একটা করে গার্ডেন থাকতেই হবে।
- কি বললে?
- হ্যাঁ স্যর, ওরা বলছে ওরা সবাই রাজা।
হবু বললেন, তা – ক রে দাও। আ জ কে র এ ই খুশির দিনে –
একটু পরে আবার ফোন, স্যার কেউ আর কাজের লোক পাচ্ছে না স্যার।
- কেন কি হল? বিব্রত আর বিধ্বস্ত হবুর প্রশ্ন।
- একজনের কাজের লোক বলেছে আমি তোমার বাড়ীতে কাজ করব কেন? এক রাজা কি আর এক রাজার বাড়ী কাজ করে? আপনার ফরমানে সবাই এখন রাজা হয়ে গেছে স্যার। প্রত্যেক ব্যক্তিগত বাড়ীতে এক একটা জাতীয় সঙ্গীত বা ন্যাশন্যাল এন্দেম চালু হবে স্যার।
- ও তাই বুঝি? এ তো বেশ ভাল খবর। একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন রাজা।
গবু একটু ইতস্ততঃ করে বলল, একটা কথা বলব স্যার?
- বল বল। আজকের এই খুশির দিনে –
- স্যার, আজ থেকে আমি কিন্তু আপনাকে আর স্যর বলব না, স্যার । কারণ আমিও তো একজন রাজা নাকি? পৃথিবীর একটা দেশের রাজা পুরু আলেকজান্ডারকে কি বলেছিল জানেন, স্যার? বলেছিল, আমি চাই রাজার প্রতি রাজার ব্যবহার। আর বীর আলেকজান্ডার তাতে খুশি হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল। আজকের এই খুশির দিনে আপনিও তো খুশি হয়ে আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন – না, স্যার, আর বলব না, স্যার।
এর পর আর কিছু শোনা গেল না। একটু খড়মড় খড়মড় আওয়াজ হল। আর তাঁর একটু পরে হবুর নাক ডাকার শব্দ পেল সে। বুঝল রাজা একটা ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিল।
এরপর সব মানুষ এক একটা আলাদা আলাদা রাজা হয়ে গেল। একটা ভীষণ ভাল কিন্তু হল এতে। কারণ কোনও প্রজা আর রইল না, তাই প্রজাপালনের ঝক্কি ঝামেলা কিছুই রইল না। রাজায় রাজায় যুদ্ধটা বেড়ে গেল কিনা সেটা হবুরাজা দেখতে পায় নি। সে তো এখন গভীর নিদ্রামগ্ন।
সব রাজার জাতীয় সঙ্গীত কিন্তু ওই একই রয়ে গেল। কে লিখল সেটা? কেন, দাদু আছে না? দাদুর ঝুলিতে কি নেই? সময় বুঝে শুধু বার করে দেবার অপেক্ষা। কথায় বলে, যা আছে ভারতে, তা আছে ভারতে, মানে মহাভারতে। তেমনি যা আছে রবিঠাকুরে, তা আছে সব ঠাকুরে, মানে সব সাহিত্যে।
তাই সবাই একটা গানই বেছে নিল এক বাক্যে। “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে –“। প্রত্যেক রাজা নিজের সুরে, নিজের ভাবে, নিজের ভঙ্গিতে গাইতে লাগল গানটা ।
osadharon bolleo kom bola hoy , salute dada
উত্তরমুছুন