ধারাবাহিক - পিনাকী চক্রবর্তী

নাড়ু রহস্য
পিনাকী চক্রবর্তী


প্রথম পর্ব

দিব্যি যাচ্ছিলাম গুটি গুটি, আলো আঁধারে ঢাকা লম্বা করিডোরটা ধরে পূবদিকে। গরমের ছুটির সময়, কলেজে ভিড়ভাট্টা কম, এই ফাঁকে নিজের কাজটা সেরে নেওয়ার ধান্দা ছিল চুপিচুপি। হেডের ঘরটা পার হয়েছি কি হই নি, হঠাৎ প্রবল হ্যাঁচ্চো – হেডের ঘরের সামনে টুলের ওপর বসে বসে কাঁপুনি দিয়ে হাঁচলো গৌরীদা। কি মুশকিল, হাঁচার আর সময় পেলো না বেআক্কেলে লোকটা! যাচ্ছি একটা শুভ কাজে, বলি একটু দেখেশুনে হাঁচতে হয় তো, না কি? আর যদিই বা হাঁচলি, তো আর একবার হাঁচ! দুবার হাঁচলে নাকি দোষ কেটে যায়। একটু দাঁড়ালাম, যদি আর একবার হাঁচে... কিন্তু ধুতির খুঁটে নাক টাক মুছে গৌরীদা একদম ফিট। আমার দিকে জুলজুল করে এমন করে দেখতে লাগলো যেন আমার মতলবটা কি তাই বুঝতে চায়। মূর্তিমান অযাত্রা কোথাকার – মনে মনে মুন্ডুপাত করি আমি...

কিন্তু এখন কি করা যায়? বাধা পড়ে গেল – যাওয়াটা কি আজ উচিত হবে ? নাঃ - হাঁচি, কাশি, টিকটিকি – এই সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে আমাকে। কথাটা আজ যেমন করেই হোক বলে ফেলতেই হবে, ইসপার অথবা উসপার, যাই হোক না কেন। হাতে সময় খুব কম। জুন মাসের মাঝামাঝি, বর্ষা আসি আসি করছে, একে একে আমার সব কটা বন্ধুরই গতি হয়ে গেছে – শেষ বেলায় পড়ে আছি শুধু আমি! কি হবে যে আমার...

গৌরীদাকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করতে করতে চললাম, এবারে একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে। পূব পশ্চিমের মাঝের চত্বরটা পার হয়ে বকের মত গলাটা লম্বা করে উঁকি দিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে চেষ্টা করছি ডানদিকের ঘরটাতে আলো জ্বলছে কি না, হঠাৎ বাঁ কানের পাশে ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল, “কাকে চাই ?”

বিষম খাওয়া শেষ হলে পাশ ফিরে দেখলাম আমাদের সিনিয়র, রিসার্চ স্কলার ফ্যাসাদা। রিসার্চ ল্যাবের দরজাটা একটুখানি খুলে মুখ বের করে মনোযোগ দিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করছে। আমি তখনই বুঝে গেলাম খনা অতি মহীয়সী মহিলা ছিলেন। শুভ কাজে হাঁচি অযাত্রা – একেবারে অব্যর্থ নিদান। কিন্তু তাই বলে, এক হাঁচিতে একেবারে ফ্যাসাদা! এও কপালে ছিল?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না মানে...” ফ্যাসাদা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো, তার পর একটু অভিযোগের সুরে বললো, “তার মানে কমলজ্যোতির কাছে যাচ্ছিস?” আমি এমন চমকে গেলাম যে ঠিকমত না না বলতেও ভুলে গেলাম। শুধু ভ্যাবলার মত বললাম, “তুমি কি করে বুঝলে ?” ফ্যাসাদা বলল, “বছরের এই সময়, পথভোলা পথিকরা যখন করিডরের এইখানটাতে দাঁড়িয়ে বলে ... ‘না, মানে...,’ তখন তারা লুকিয়ে লুকিয়ে কমলজ্যোতির ঘরে যায়। এবং ফিরেও আসে। প্রায় সাথে সাথে। বেশীক্ষণ সময় লাগে না। তুইও একটু দাঁড়া – এখুনি দেখতে পাবি যে তুই নিজেই ফিরে আসছিস, ব্যাজার মুখ নিয়ে!”

ছেলেরা যায়, আবার ফিরেও আসে – তাতো বুঝলাম, কিন্তু ফ্যাসাদা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিপোর্টারের মতো তাদের ইন্টারভিউ নেয় কেন ?

“কেন? বললে বুঝবি?” মুখটুখ ভেংচে ফ্যাসাদা আমার থুৎনিটা নেড়ে দিল। তারপর প্রায় টেনিদা স্টাইলে বলল, “পেছনের ঘরটাতে আয়, আর আগে একটা চা বল।” চা বলব কাকে? আমরা তো ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাই, সেটাতো আবার আটতলার ওপর – সেখান থেকে এই একতলায় কেউ চা দিয়ে যায় নাকি? ফ্যাসাদা হতাশ হয়ে বলল “তুই কি,পাঁচু? জিওলজিও পড়বি, চায়ের খবরও রাখবি না, তোর চলবে কি করে?” তারপর হঠাৎ দৃপ্ত পদক্ষেপে বাইরে করিডোরে বেরিয়ে এসে দুই হাত মাথার ওপর তুলে কাকে যেন নিঃশব্দ ইশারায় ডাকতে লাগল। নাঃ, পুরো কলেজে আজ আমার ব্যাপারটা জানাজানি না করিয়ে ছাড়বে না দেখছি!

ফ্যাসাদার ব্যাপারে কয়েকটা কথা বলে রাখা দরকার। ফ্যাসাদার পোশাকি নামটা কোন এক সময়ে সম্ভবত ছিল প্রশান্ত - তার থেকে প্যাসা এবং তার থেকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে ফ্যাসা। অবশ্য আমি এমন এক প্রশান্তকেও চিনি যে পোস্ত নামে বেশী পরিচিত, সুতরাং সব প্রশান্তই শেষমেশ ফ্যাসায় রূপান্তরিত হয় না। তা সে যাই হোক, আমাদের এই ফ্যাসাদা মানুষটা কিন্তু এমনিতে বড় ভালো। বিপজ্জনক রকম পরোপকারী, উপকার করতে গিয়ে বাধা পেলে খুব ক্ষুণ্ণ হত। ঝামেলা শুধু একটাই – উপকার করতে পারুক বা না পারুক, কোন কথা চেপে রাখতে পারে না। কলেজের আম জনতাকে কিছু জানানোর দরকার থাকলে আমরা ফ্যাসাদাকে বলে দিতাম। বেশী তাড়া থাকলে বিশেষ করে বলে দিতাম – কেউ যেন না জানতে পারে। পরের কাজটুকু ফ্যাসাদাই করত। আর এই কারণেই বোধহয়, ফ্যাসাদার আশপাশে থাকলে ফ্যাসাদে পরাটাও খুব বিচিত্র ছিল না।

তা ফ্যাসাদা যেমনই হোক না কেন, আপাতত নেচে কুঁদে কাকে ডাকতে চায় সেটা জানা দরকার। পেছন ফিরে দেখি সেই নাটের গুরু গৌরীদা – সুড়সুড় করে উঠে এসেছে ফ্যাসাদার নৃত্যনাট্যে। এটা কিরকম ব্যাপার হোল? আমরা ডাকলে তো ভুলেও আসে না! আমরা তো কোন ছার, গৌরীদা সাধারণত হেড ছাড়া অন্য প্রফেসর লেকচারারদেরও বিশেষ পাত্তা দেয় না! শুধু ফ্যাসাদার ক্ষেত্রে ব্যত্যয়? ফ্যাসাদা কিন্তু দেখলাম এব্যাপারে অভ্যস্ত। শান্ত ভাবে বলল, “গৌরী, দুটো চা – ও, তুই খাবি না? আচ্ছা, একটা চা – এর নামে। আর একটা ছোট চার্মস – আমার নামে।” গৌরীদা বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নেড়ে আমার দিকে একবার আড়নয়নে চেয়ে হেলেদুলে চলে গেল।

আমি দেখলাম সমূহ বিপদ। এখন যদি ফ্যাসাদা আটকায় তাহলে আজ আর বলা হবে না কথাটা আমার। তাই কাতর ভাবে বললাম, “তোমার চা টা আসুক না, আমি ততক্ষণ চট করে ঘুরে আসি। বেশী সময় তো লাগবে না, তুমিই তো বললে!” ফ্যাসাদা উদাস ভাবে বলল, “যাবিই? তা হলে যা! কিন্তু কি বলবেন, শুনবি? তুই যেই বলবি ‘আমি আপনার কাছে কাজ করবো’, উনি নিরুৎসুক ভাবে বলবেন ‘কেন?’ – ব্যাস, কথা শেষ, তুই মুখ চুন করে ফিরে আসবি। আর তখন তোকে নিত্যদার কাছে নিয়ে যেতে হবে সেই আমাকেই। তাই বলছি, এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে?” নিত্যদা মানে নিত্যপ্রিয় চ্যাটার্জ্জী, ফাসাদার গাইড, আমাদের পেট্রোলজি পড়ান। আমি যেতে চাই না পেট্রোলজিতে, স্ট্রাকচারাল-এই কাজ করবো, তাই মরিয়া হয়ে বললাম, “তুমি যাও না, আমি আসছি।” ফ্যাসাদা গেল না, শুধু হাতটাকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে নাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানালো। আর নিজে আমার দিকে সতর্ক নজর রেখে দরজাটায় ঠেস দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।

আমি দুরুদুরু বক্ষে এগোলাম সামনের বন্ধ দরজাটার দিকে। বাইরে নেমপ্লেটে লেখা কমলজ্যোতি দাশগুপ্ত। পাশের ঘষা কাঁচের জানালা দিয়ে স্যারের আবছা অবয়বটা দেখা যাচ্ছে। এইবার, যা থাকে কপালে... জয় বাবা নকুলেশ্বর...দরজায় টুকটুক করতেই গম্ভীর আওয়াজ এলো– হুঁ? শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “আসবো স্যার?” এবারেও সেই “হুঁ” – তবে প্রশ্নসূচক নয়, মনে হল একটু ইতিবাচক ভাবে। ঢুকে পড়লাম দুগগা বলে।

ঝটপট করে বলে ফেলতে হবে, নাহলে সাহসে কুলাবে না। তাই দরজায় দাঁড়িয়েই বললাম, “আপনার কাছে কাজ করবো, স্যার।” হেসে ফেললেন তিনি, বললেন, “ভেতরে এসে বসো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সব কথা বলবে নাকি?”... গেলাম ভেতরে, প্রায় উবু হয়ে বসার মতো অস্বস্তিভরে বসলাম সামনের চেয়ারে। ততক্ষণ তিনি এমন হাসিমুখে তাকিয়ে ছিলেন যেন নয়নাভিরাম কোনো দৃশ্য দেখছেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল চোখ দিয়ে আমাকে মাপছিলেন। আমি বসার পরে বললেন, “আমার কাছে কাজ করতে হলে কিন্তু রাজস্থান যেতে হবে, অনেকটাই খরচের ধাক্কা! পারবে তো?”

আমার আবার সব গণ্ডগোল পাকিয়ে গেলো। মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে এসেছি ‘না’ শুনতে, যাই শুনি মনে হচ্ছে না-ই শুনছি। ভয়ে ভয়ে, কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, “না স্যার, আপনার কাছেই কাজ করবো।” সরু গোঁফের বাঁদিকটা আবার একটু কেঁপে উঠলো। বললেন, “বেশ তো, কোরো না হয় কাজ আমার কাছে। কাল বেলা এগারটা নাগাদ এসো, খাতাপত্তর নিয়ে। আর সুপারপোসড ফোল্ডিং এর ব্যাপারে একটু পড়াশোনা করে এস, ঠিক আছে? আর কিছু বলবে? নাহলে তুমি বাপু এবার আসতে পারো, আমার কাজ আছে।”

পুরো ব্যাপারটায় বোধ হয় মিনিট দুয়েক লেগেছিলো। একটা ঘোরের মধ্যে ঘর থেকে বেরোলাম। বাইরে বেরোতে না বেরোতেই ফ্যাসাদা। আমার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কি দেখল কে জানে - হাত ধরে টেনে করিডোর পার করে, সিঁড়ি টপকিয়ে, গেট পেরিয়ে নিয়ে গেল বাইরের রাস্তায়, বিষ্টুদার ঠেকে। বিষ্টুদার চায়ের দোকান সায়েন্স কলেজের গেটের বাইরে, ফুটপাথের ধারে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বা বসে চা খাওয়ায় আমার রক্ষণশীল মনের এমনিতে সায় নেই, বদ ছেলেদের ওইসব বদ অভ্যাস হয়। কিন্তু সেদিন, বিশ্বাস করুন, কিচ্ছু খেয়াল করলাম না। ফ্যাসাদার মুখেও কোন কথা নেই, মনে হলো হাবেভাবে গভীর সহানুভূতি জানাচ্ছে। ভেবে দেখতে গেলে এটাও একটা বিরাট প্রাপ্তি, ফ্যাসাদার এই অসাধারণ নীরবতা। কিন্তু সেটা বেশীক্ষণ টিঁকল না। বিষ্টুদাকে দুটো আঙ্গুল দেখিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ‘জলদি’ – তারপর আমার দিকে করুণাঘন চোখে দেখল কিছুক্ষণ। সেই পাট চুকলে, নিচু গলায় বলল, “কিচ্ছু ভাবিস না – নিত্যদাকে বলছি সব সামলে নিতে।” আমি হাঁসফাঁস করে বললাম, “তার আর দরকার নেই, আমার কাজ হয়ে গেছে।”

বিষ্টুদা ধূমায়িত একটা ভাঁড় সবে ধরিয়েছিল ফ্যাসাদার হাতে, তার থেকে ছলকে খানিকটা ফুটন্ত চা ছাই রঙের প্যান্টের ওপর পড়ল, ফ্যাসাদা তাকিয়েও দেখল না। ভাঁড়টাকে কোনরকমে পাশের রেলিঙের ফাঁকে গুঁজে আমার হাতটা খামচে ধরে বলল, “মাইরী ঠিক করে বল, ঢপ দিচ্ছিস, তাই না?” কি জ্বালা, ঢপ দেব কেন? যদিও ব্যাপারটা আমার নিজেরই তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। ফ্যাসাদা কিন্তু এত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। স্যার কি বলল, তুই কি বললি, তখন কি বলল – এইসব চালিয়ে গেল পাঁচ মিনিট ধরে। তারপর আমার কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে নিজের মনেই স্বগতোক্তি করে চলল, “এত বদমেজাজি লোক, আজ পাঁচ বছর ধরে কাউকে থিসিস করায় নি, লাস্ট বার করিয়েছিল সেই নুন্ডেদাকে, আর আজ তোর মুখ দেখেই নিয়ে নিল? তোর বিএসসি তে কত নম্বর ছিল র‍্যা, স্ট্রাকচারালে?” কমলজ্যোতিবাবুর কাছে আমার থিসিস করার ওপর ফ্যাসাদার থিসিস চলতে লাগল অবশিষ্ট চা আর আধখানা চার্মস সহযোগে। তালেগোলে ওদিকে গৌরীদার চা টার কি হোল সেটাই শুধু জানা হলো না। সেটা নাকি আবার আমার নামে খাতায় তোলা থাকবে...

পরের দিন সক্কাল সক্কাল কলেজে এসে দেখি লিফটম্যান থেকে ক্যান্টিনের বিশুবাবু, কারুরই আর জানতে বাকি নেই যে আমি থিসিস করছি ডক্টর কমলজ্যোতি দাশগুপ্তের কাছে। কেউ কেউ এসে সমবেদনা জানিয়ে গেল, কেউ বা পিঠ থাবড়ে দিল – প্রয়োজনের থেকে একটু বেশীই জোরে। কিন্তু ঈর্ষাকাতর মুখ একটাও না দেখে বেশ দমে গেলাম...কি জানি বাবা, কাজটা ভাল করলাম তো! যাক, যাই হোক, পরে দেখা যাবে...

থিসিস মানে কিছুটা পড়াশোনা, অনেকটা ফিল্ড ওয়ার্ক আর ল্যাব। জিওলজিস্টদের জীবনটা মাঠে ঘাটেই কাটে। তাই পড়াশোনার সাথে সাথে রাজস্থানের মাঠে ঘাটের ছুটকো ছাটকা নানা তথ্য আহরণ করতে লাগলাম- যা রাজ কাহিনীতে নেই। এতদিন পর্যন্ত আমার কাছে রাজ কাহিনীই রাজস্থানের শেষ কথা ছিল। কিন্তু অবন ঠাকুর কতকগুলো জরুরী ডিটেল আমাদের বলে দেন নি, যেমন রাজস্থানে কত ধরণের ভীল আছে, ভীল আর রাজপুত ছাড়া উদয়পুরের আর কত রকম বাসিন্দা আছে, এত বীর যোদ্ধাদের দেশে অহিংস জৈনদের এত প্রতিপত্তি কেমন করে, ইত্যাদি।

গরমের ছুটির পর ক্লাস চালু হয়ে গেছে, দৈনন্দিন সেই পড়া ছাড়াও ম্যাপ ঘেঁটে উদয়পুর, ডুঙ্গারপুর আর বাঁসওয়াড়া জেলার ভূতাত্ত্বিক খুঁটিনাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছি রাত জেগে। শুনেছি ওইসব জায়গাতেই স্যার কাজ করেন এবং করিয়ে থাকেন, যখন কাউকে কাজে নেন। খুব বেশী তথ্য বাড়িতে পাওয়া সম্ভব নয়। গুগল আর্থও ছিল না সেইসময়। তাই কখনও সখনো ক্লাস কেটে জিএসআই-এর দাদাদের কাছ থেকে ম্যাপ আর রিপোর্ট সংগ্রহ করে আনতাম আর রাত জেগে তাই পড়তাম।

এই ভাবেই একদিন প্র্যাক্টিকাল ক্লাস কেটে দেখা করে এলাম বিশ্বজিতদার সাথে তাঁর অফিসে, যাঁর দর্শনেও পুণ্য। ইনিই সেই শেষ ছাত্র, যিনি স্যারের কাছে আমার আগে কাজ করেছিলেন। হাসিখুশি হইহুল্লুড়ে লোক, কিন্তু আমার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন, আরো গম্ভীর ভাবে একটা গোদরেজের আলমারী খুলে নিজের থিসিসের এক কপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, “স্যারকে বোলনা যেন...এবং কাজ হয়ে গেলে এটা ফেরত দিয়ে যেতেও ভুলনা যেন...” বলে ফুরুত করে হাওয়া হয়ে গেলেন। স্যাম্পল থিসিস একটা হাতে পেলাম বটে, কিন্তু ওঁর রকম সকম দেখে আমি আবার ঘাবড়ালাম।

স্যার নিজে কিন্তু মোটেই ঘাবড়ে দেবার মতো লোক নন, লোকে যতই ভয় দেখাক না কেন। যত দেখছি, ততই বুঝছি ভদ্রলোকের স্নেহশীল স্বভাবটা, যেটাকে উনি বাইরের একটা কড়া আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখেন। শুধু একটাই দোষ, উনি নিজে থেকে কিছু বুঝিয়ে দেবেন না, আমাকে নিজে বুঝে নিতে হবে। ক্লাসের পড়াতেও ঠিক তাই, কিন্তু সেখানে ওঁর হয়ে ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হত খানিকটা আমাকেও। সহপাঠী বন্ধুরা স্যারের কাছে বিশেষ পাত্তা না পেয়ে আমার কাছে প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের প্রবলেম-এর সমাধান জানতে আসতো। কিছুটা স্যারের মান আর অনেকটা নিজের সম্মান বজায় রাখতে আমাকে ডবল খাটতে হোত। তা হোক, গুরুর প্রেস্টিজ নিয়ে যেন টানাটানি না হয়, এই জ্ঞানটা আমার চিরকালই টনটনে ছিল...

পূজোর পরে একদিন হঠাৎ স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাউলী কাকে বলে?” ভাবলাম একবার বলি ‘মেয়ে বাউল’ – কিন্তু সামলে নিয়ে বললাম ‘জানি না।’

“কী জানো হে তুমি ?” কথাটা যেমনই হোক, বলার ধরণে কিন্তু মনে হোল না তেমন বিরক্ত... বললেন, “বাউলী হলো খোলা কুয়ো, বুঝলে– ওপেন ওয়েল। রাজস্থানে অনেক দেখবে। কুয়োগুলো বেশ গভীর, চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। জলের লেভেলেরও অনেক নীচে নেমে যায় কখনো কখনো। সেই সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে লোকজন নিচে নেমে জলের মধ্যে হাত পা ধোয়। চান করে না বা কাপড় জামা ধোয় না, কারণ ওই জলই ওরা খায়। আরে না, না, অত আঁতকে ওঠার দরকার নেই, রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে জলের বিশেষ সুবিধে নেই, তাই এইটাই ওদের বহু যুগ ধরে চলে আসা জল বাঁচানোর পদ্ধতি। গ্রামে গঞ্জে পাহাড়ে জঙ্গলে থাকতে হয় আমাদের, সেখানে তোমার আমার কলকাতার অভ্যাস অনুযায়ী চললে হবে না, ওদের সাথে ওদের মতো করেই মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে, এইকথাটি মনে রেখ।।

“কিন্তু একই সাথে নিজের স্বাস্থ্যটিকেও ঠিক রাখতে হবে। তাই ওখানে যখনই জল খাবে, ছেঁকে খাবে, বুঝলে? ওখানে একটা রোগের খুবই সম্ভাবনা থাকে, সেটা হোল গিনি ওয়ার্ম ডিজিজ। এই গিনি ওয়ার্ম হোলো খুব বাজে ধরনের কৃমি। ওই বাউলীর জলে ডিম পাড়ে। সেই ডিমের খোলস খুব শক্তপোক্ত, কোন ওষুধ বিষুধে মারা যায় না। কিন্তু মানুষের পেটে গিয়ে পেটের অ্যাসিডে গলে যায়, আর তার থেকে জন্মায় বাচ্চা গিনি ওয়ার্ম। সেই ওয়ার্ম সরু সুতোর মত হয় কিন্তু ছয় মাস থেকে এক বছর ধরে বড় হয় ও তার পরে মানুষের পা বা হাতের চামড়া ভেদ করে বাইরে লেজটুকু বের করেদিয়ে ডিম ছাড়ে। বাউলীর জলে সেই মানুষ হাত পা ধুলে ডিমগুলো জলে ছড়িয়ে পড়ে। এবং তার থেকে আবার নতুন করে সংক্রমণ হয়। বুঝতে পারলে? কী হলো? এত কি চিন্তা করছো?”

আমি চিন্তা যা করছিলাম তা তো আর স্যারকে বলা যাবে না। আমার তখন অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’... গিনি ওয়ার্মের বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে ভাবছিলাম এনপিসি, মানে প্রফেসর চ্যাটার্জ্জীর কাছে ফ্যাসাদা এখনও আমাকে ঢোকাতে পারে কি না। কিন্তু হঠাৎ করেই মরহুম সৈয়দ মুজতবা আলীর বাতলানো একটা চৈনিক গল্প মনে পড়লো। গ্রামের মোড়লের একমাত্র ছেলে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। সবাই মিলে মোড়লকে সান্ত্বনা দিতে এলে মোড়ল বলল এটা যে খারাপ হয়েছে, তোমরা কি করে বুঝলে? হারানো ছেলে দুদিন পরে ফিরে এলো একটা জংলি ঘোড়া ধরে নিয়ে। সবার অভিনন্দনের মাঝখানে মোড়লের প্রশ্ন, এটা যে ভালো হল, কি করে বুঝলে? ঘোড়াকে পোশ মানাতে গিয়ে ঘোড়া থেকেই পড়ে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙ্গলো ছেলের (এটা কি খারাপ হল?), রাজার পেয়াদারা সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি করার জন্যে গ্রামে ছেলে ধরতে এলো, মোড়লের ছেলে ভাঙ্গা ঠ্যাঙ্গের জন্যে বাদ পড়ল (এটা কি ভাল হল?)... ইত্যাদি প্রভৃতি... অ্যাড ইনফিনিটাম। আলী সাহেব আল্লাতালার অসীম কৃপালাভ করুন, আমাকে তিনি সময়মত সৎসাহস যোগালেন। ভালো থাকলেই তাতে মন্দ থাকবে আর মন্দ থাকলেই তার ভালো আছে, এতে আর সন্দেহ কি! গিনি ওয়ার্মের মন্দের মাঝেই হয়তো লুকিয়ে আছে আমার ভাল, কে জানে?

“শোন হে, মার কিছু পুরোনো শাড়ী আছে বাড়ীতে? না কি সব স্টেনলেস স্টীল হয়ে গেছে?” গল্পের জগত থেকে ফেরত এসেই একি বিপদ... মার পুরোনো শাড়ীর খবর আমি কোত্থেকে জানব? “কেন স্যার?” “পরিষ্কার সাদা শাড়ী, পাড়টা বাদ দিয়ে, বড় রুমালের মত সাইজ করে কেটে নেবে। চল্লিশ থেকে ষাটটার মত এই টুকরো শাড়ী সাথে করে নিয়ে যাবে। এক এক দিন সকাল বেলায় এক এক দিনের জল ছেঁকে নেবে একটা করে কাপড়ের টুকরো চার ভাঁজ করে। ছাঁকার পরে কাপড়টা ফেলে দেবে, কারণ তোমার পরে মনে থাকবে না যে কোন দিকটা ওপরে ছিলো আর কোনটা নিচে। একই টুকরো যদি আবার ব্যাবহার করো, তো পরের বার ছাঁকার সময় উলটে গেলেই চিত্তির! কিপটেমো না করে প্রত্যেকবার নতুন টুকরো নেবে, বুঝেছো!”

থিওরিটাতো বুঝলাম, কিন্তু প্র্যাক্টিকাল ব্যাপারটা তেমন জমলো না আসল জায়গায়। মানে রাজস্থানে।



পরবর্তী অংশ পরবর্তী সংখ্যায়


8 মতামত:

  1. এক কথার মন্তব্য - "দুরন্ত "
    দুই কথার বক্তব্য - "অদ্ভুত অসাধারণ "
    তিন কথার মনোভাব - "পুরো ফাটাফাটি ব্যাপার "
    চার কথার মনোবাঞ্ছা - "পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় রইলাম "

    উত্তরমুছুন
  2. @pinakichakraborty...kakuuuuuuuuuuuuuuu...darun/anekdin...por...narayan...gangopadhyay..ke...mone...porlo/tenida...chokher...samne...fyasada...hoye...unki...dilo/tomar...songe...ei...lekhar...jonyo...sushmita..keo...dhonyobad/chomotkar...lekhoni...:)

    উত্তরমুছুন
  3. raka...chhotto...ektu...anka/cho..cheewt

    উত্তরমুছুন
  4. ak...kathay...bola...jay/samreedhdho...hochhe...lekhoni/samreedhdho...ei...proyas/samreedhdho...amra/samreedhdho...chilekotha

    উত্তরমুছুন
  5. TOMAR BANGLA LEKHAR SABOLIL GOTI AMAY MUGDHO KORE....

    উত্তরমুছুন
  6. ekti osamanyo pranobonto lekha...jehetu amar subjecttao eki..tai porte aro bhalo laglo...ami jodio JU r student...

    উত্তরমুছুন
  7. বাকি পর্ব গুলির অপেক্ষায় রইলাম ।

    উত্তরমুছুন