প্রতিশোধ
সুজাতা ঘোষ
খোলা জানলা দিয়ে সকালের সূর্যের হাল্কা একফালি রোদ সোজা ঢুকে পড়েছে অঞ্জলি দত্তের শোবার ঘরে। মুখের উপর পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসেন। সারারাত দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে করতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেছিল টেরই পান নি।
দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে বিছানা থেকে নেমে ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। এখনো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এবারে পায়ে পায়ে পাশের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফাঁকা ঘর আর একরাশ ভাবনা। আর পারলেন না চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কি করা যায়? পায়চারি করতে লাগলেন আর নানা চিন্তা এলোমেলোভাবে মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল।
কোথায় যেতে পারে মানুষটা? সারারাত ফিরল না। সকাল আটটা বাজে, একটা ফোন পর্যন্ত আসে নি। কারোর বাড়িতে গেছে – নাকি কাজে আটকে গেছে কোথাও? নাকি অন্য কিছু! ভয়ে বুকের ভিতরের ওঠানামা আরও বেড়ে গেল। রাগও হচ্ছে মাঝে মধ্যে, একটা ফোন তো করতে পারত। ছেলেটা কি করে ঘুমাচ্ছে এতক্ষণ? কোন চিন্তা নেই!
এখন কি করা যায়? সব জায়গায় ফোন করা হয়ে গেছে। আর কিছু চিন্তা না করতে পেরে অঞ্জলি দত্ত নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসটা জ্বালালেন চা করার জন্য। রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছে। ভাবলেন চা খেলে হয়তো মাথাটা ঠিকমত কাজ করবে।
দরজায় কলিং বেলের শব্দ........., প্রচণ্ড রাগ আর অভিমান নিয়ে দরজা খুলতে গেলেন গজগজ করতে করতে। কিন্তু একি! দরজা খুলেই দেখেন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক বললেন – বাড়িতে আর কে আছেন?
অঞ্জলি – আমার ছেলে, কেন বলুন তো?
পুলিশ – একটু ডেকে দিন, দরকার আছে।
অঞ্জলি দত্ত দরজা থেকেই ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন – শঙ্কর, অ্যাই শঙ্কর, একটু বাইরে আয় তো।
ততক্ষণে শঙ্করেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বাইরে এসে দেখে পুলিশ আর মা মুখোমুখি ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ ভদ্রলোক বললেন – ভি. আই. পি রোডে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, যে ভদ্রলোকের বডি পাওয়া গেছে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সে এই বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। নাম কমল দত্ত। আপনাদের কেউ হয় কি? একবার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে বডিটা দেখে আসতে হবে।
খবর শুনেই অঞ্জলি দত্ত পাথরের মেঝেতে পড়ে যান প্রচণ্ড শব্দে। শঙ্কর ব্যস্ত হয়ে মাকে তুলে ডিভানে শুইয়ে দিয়ে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে থাকেন। জ্ঞান ফিরলে, তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরে রেখে পুলিশের সাথেই বডি দেখতে চলে যান।
রাতের সমস্ত অন্ধকার যেন ঝড়ের গতিতে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। ঘরটাই যেন ব্ল্যাকহোল হয়ে অঞ্জলি দত্তকে গিলে নিয়েছে। চারপাশের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে, বহু পুরনো স্মৃতি তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে........., প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিচ্ছে তাকে। অঞ্জলি দত্ত চেষ্টা করছেন নিজেকে এর থেকে আড়াল করার। তাঁর সাদা অবস্থানকে বহু বছর পর আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বেশী গাঢ় ভাবে।
টেবিলের উপর কমল দত্তের ছবিতে রজনীগন্ধার মালা আর ধূপের গন্ধ, সামনে পাথর মূর্তি অঞ্জলি দত্ত। অমিত দত্তের স্ত্রী, একটা ঝটকা লাগল মাথার মধ্যে কথাটা মনে হতেই। একটু নড়ে উঠলেন যেন অঞ্জলি দত্ত। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এই পোশাক পড়ে বসতে হয়েছিল আর একজনের ছবির সামনে। তিনি তাঁর স্বামী অমিত দত্ত। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বছরের অর্ধেক সময় বাইরে থাকতেন। যখন বাড়ি ফিরতেন স্ত্রী-পুত্রের জন্য অকৃপণ হাতে যতটা সম্ভব ভালো ভালো জিনিস নিয়ে আসতেন ঘরে। হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-ভালবাসা, ঘোরাফেরা সব মিলিয়ে বেশ সুন্দরভাবে কেটে যেত কটা মাস। তারপর আবার ছেলেকে নিয়ে একঘেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন।
কমল দত্ত ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে অমিত দত্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছেন অঞ্জলিদেবীর সামনে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক রাগ, অভিমান, দুঃখ, লজ্জা, হীনমন্যতা একসাথে স্রোতের মতন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসল বুকের গভীর থেকে। একে থামাবার ক্ষমতা তাঁর নিজেরও নেই। তিরিশ বছর ধরে যে সুখ ভোগ করে এসেছেন, তা এই মুহূর্তে পাপ বোধ হয়ে অঞ্জলি দত্তকে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে।
কান্না দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিকট শব্দ তুলছে হাসির। ঘরের চারপাশের সেই হাসি সারা ঘরময় ঘুরে তাণ্ডব নৃত্য করে অঞ্জলি দত্তের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে এতদিন ধরে চেপে রাখা সেই ঘটনা। যা বিশ্বাসঘাতকতার বা নীতি নৈতিকতাহীন এক চরম লজ্জার ঘটনা।
রাত প্রায় তিনটে, শঙ্করের ঘরে জোরালো আলো। শেষ ঘাটে পাখা জোরে শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে। ঘরে কোন মানুষ নেই। ছাদের সিঁড়িতে আলো জ্বলছে, যার একটুকরো অংশে হাল্কা প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে শঙ্করের লম্বা অবয়বের। আজ এই মুহূর্তে বড় বেশি লম্বা মনে হচ্ছে তাকে। অনেকটা দানবের মতন। সন্তুষ্ট দানব। হাতে সুরাপাত্র, সমস্ত শরীরে আগুনের হল্কা, মুখে আত্মতৃপ্তি। বিকট কালো রাতও ফিকে হয়ে গেছে, ওর মুখের হাসির আলোতে।
তিরিশ টা বছর! কি সে সাংঘাতিক যন্ত্রণা – আজ অর্ধেক ক্ষত পূর্ণ হল। এতগুলো বছর ওর কাছে কেঁদেছে মৃত্যুযন্ত্রণায়। এমন কোন রাত নেই যেদিন ও ঐ ভয়ানক স্বপ্নটা দেখেনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভয়ে ভয়ে পাশে তাকিয়ে দেখত মা কে, আর কুঁকড়ে যেত ভয়ে। পাশ বালিশটা দুজনের মাঝে টেনে এনে কেন্নোর মতন গুটিয়ে শুয়ে থাকত জোর করে চোখ দুটোকে বন্ধ করে। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকত, তাড়াতাড়ি সূর্যের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য।
আজ এত বছর পরে সূর্যের ঘুম ভেঙেছে। শান্তির শ্বাস ফেলে আবার গ্লাস ভরে নিল সোনালী জলে। গলায় ঢালতেই সমস্ত শরীরকে ঠাণ্ডা করে দিল মুহূর্তে। কি শান্তি! আরও, আরও চাইছে শরীর। মন, মাথা সব শান্ত হতে চাইছে আজ।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, নিস্তেজ হয়ে আসছে মাথা, বসে পড়ল শঙ্কর। কষ্ট হচ্ছে বসে থাকতে। আস্তে আস্তে শরীরটা পড়ে গেল জলছাদের উপর। শান্ত দুটো চোখ নেশা মেখে তাকিয়ে রইল বিশাল খোলা আকাশটার দিকে। আজ তো চাঁদ ওঠে নি, তবে এত স্নিগ্ধ মুখ কার? আরে বাবা তো, দেখ কাণ্ড। তিরিশ বছর পরে হাসিমুখটা দেখছে তো, তাই একবারে চিনতে পারে নি।
অমিত দত্ত, শঙ্কর দত্তের বাবা। এতদিনে বোধ হয় একটু শান্তি পেয়েছেন মনে। তাই ঐ শান্তি সারা মুখে মেখে ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শঙ্করের বেশ ভালো লাগছে বাবার হাসি মুখ দেখতে। এত বছর শুধু চাপা গোঙানি শুনে এসেছে ঘুমের মধ্যে। আজ হাসি দেখতে খুব ভালো লাগছে।
বিড়বিড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল – তুমি চিন্তা করো না বাবা, আমি আছি তো। তোমার ছেলে, আমি শোধ নেব। সব শোধ নেব আমি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, আমি ----
দু চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে গেল (ওর অজান্তে)
কমল দত্তের মৃত্যুর পর প্রায় বছর দুয়েক হবে অঞ্জলি দত্ত শয্যাশায়ী। বাড়িতেই ডাক্তার এসে নিয়মিত দেখে যাচ্ছেন। সবসময় এর জন্য নার্সও রাখা হয়েছে। শঙ্করের নিজের হাতে বিশেষ সময় থাকে না মাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। সারাদিনই ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে তাড়াতাড়ি মাকে সুস্থ করে তুলতে।
ছেলেকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য অঞ্জলি দত্ত অনেক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু কোন ফল হয় নি। সাঁইত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে তবুও বিয়েতে মত নেই, কারণ জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। তবে কাজে খুব মন, ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকে সর্বক্ষণ।
অঞ্জলি দত্ত সারাটা দিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেন। মাঝে মাঝে একটু বসার মতন উঠে শুয়ে থাকেন ঘাড়ের নীচে মোটা বালিশ দিয়ে। কথা বলার লোকও নেই, ইচ্ছাও নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই যেন স্মৃতিকে হাতড়ে বেড়ান। তাতেই শান্তি, বর্তমানের সাথে যেন কোন যোগাযোগই নেই। ছেলের বিয়ে নিয়েও হয়তো ভাবেন না।
দুজন পুরুষ – দুজন দুরকমের। একজন সামাজিক আর অন্যজন অসামাজিক, আজ কেউ কাছে নেই। দুজনেই চলে গেছেন বহুদূরে। আর ঐ দূরের পথ চেয়েই অপেক্ষা করা, ওখানে পৌঁছবার জন্য। এই অপেক্ষাই শরীর–মন দুটোকেই বড় কাহিল করে ফেলেছে। ছেলে অনেক চেষ্টা করছে মাকে সুস্থ করে তোলার, কিন্তু তিনি জানেন এ জন্মে আর তা হওয়ার নয়। চানও না। অতীতের সুখ আজ দুঃখেরই প্রতিবিম্ব যেন। অমিত দত্ত আর কমল দত্ত – দুজনের সাথেই কাটান মুহুর্তগুলো এখন ফণার মতন খোঁচা দিচ্ছে সমস্ত শরীরে। আগে যা সোহাগ অনুভুতি ছিল আজ তা লজ্জা আর পাপের মিশ্রন হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এভাবেই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে শঙ্কর এসে পাশে বসেছে খেয়ালই হয়নি ওনার। মায়ের বাঁ হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করল – এখন একটু ভালো বোধ করছ? তখন হুঁশ হোল।
ছেলেকে কাছে পেয়ে একটু (অন্য রকম) খুশি খুশি ভাব এনে হেসে উত্তর দিল – হ্যাঁ। তুই এত কাজে ব্যস্ত থাকিস কেন সব সময়? একটু বিশ্রাম নিতে পারিস না?
শঙ্কর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠো তারপর আমি বিশ্রাম নেবো। তুমি একটু বাগানে হাঁটাচলার চেষ্টা করো না- নাহলে কখনোই সুস্থ হতে পারবে না।
অঞ্জলি – আমার কথা থাক্, বিয়ের জন্য কি ভাবলি?
শঙ্কর – আগে তুমি সুস্থ হও –
অঞ্জলি – সুন্দর একটা বউ নিয়ে আয়, তাহলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব।
শঙ্কর – এখন উঠতে হবে, শোরুমে ক্লায়েন্ট এসে অপেক্ষা করছে, পরে কথা হবে।
অঞ্জলি – সাবধানে যাস বাবা।
শঙ্কর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আস্তে আস্তে শব্দটা মিলিয়ে যেতে অঞ্জলি দত্ত শুয়ে পড়লেন আর একবার। ডুবে গেলেন ভাবনার সাগরে।
শোরুমে ঢুকতেই এক ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন,
- নমস্কার শঙ্করবাবু
- নমস্কার, বেশীক্ষণ অপেক্ষা করাই নি তো?
- নাহি – নাহি। চলিয়ে আপকে ঘর মে চলতে হ্যায়।
শঙ্কর লাল কার্পেটের উপর পা ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে শর্মাজীর সাথে মুখোমুখি সোফায় বসল। এবারে শর্মাজী সুটকেস খুলে নীল ভেলভেটের একটা বাক্স বের করে টেবিলের উপর খুলে ধরলেন। তারপর শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে মনোভাব আন্দাজ করার চেষ্টা করে বললেন –
আচ্ছি তর্হা সে দেখ্ লিজিয়ে। রেট কে বারেমে বাদ মে বাত কর লেঙ্গে, প্যাহলে পসন্দ তো কিজিয়ে।
শঙ্কর ভালো করে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে নিয়ে, যেগুলো পছন্দ হোল সেগুলো আলাদা করে রাখল। শর্মাজী হিসেব করে রেট বলে দিলেন। এরপর দরাদরি করে শঙ্করবাবু ক্যাশে পেমেন্ট মিটিয়ে দিলেন।
একটা বড় কাজ হয়ে গেল। এবারে নিশ্চিন্ত মনে অন্য ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে লাগল ফোনে।
সারাদিন খাটাখাটনির পরে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একবার ‘পাবে’ ঢুঁ মারার ইচ্ছা হল। বাইরে খুব কমই হাতে রঙ্গীন গ্লাস নেয় সে। তবে আজ একবার না নিয়ে পারল না। আজ মনটা খুব ভালো লাগছে। মা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, হীরেগুলো হাতে এসেছে।
নীল আলোতে রক্ত রঙের রঙ্গিন পাত্রটা আরও বেশী রোমহর্ষক করে তুলেছে টেবিলটাকে। আর পাশেই গরম ‘বিফ্’-এর ডিশ থেকে ধোঁয়া বেড়িয়ে শঙ্করের ভিতরের ঘুমিয়ে থাকা দানবটাকে জাগিয়ে তুলল।
আজ বেশ কয়েকটা পেগ হয়ে গেছে, খেয়াল হয়নি আগে। পা দুটো বেসামাল ঠেকছে। তবুও যতটা সম্ভব সতর্কভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে। বাইরের ফুড়ফুড়ে হাওয়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে ইচ্ছা করল। বেশ রাত হয়েছে ঘড়িতে। অথচ কি আশ্চর্য - বাইরে কত আলো, ঠাণ্ডা হাওয়া পুরো শরীরটাকে হাল্কা করে ভাসিয়ে নিতে চাইছে পালকের মতন। ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে রঙিন প্রজাপতির সাথে। শঙ্কর রঙিন প্রজাপতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে, এরা এত এত রং মেখে রোজ রাতে তাঁর মতন কত মানুষকে স্বপ্নে ভাসাতে আসে, আবার ভোরে - ভোরের স্বপ্নের মতন মাঝপথে উধাও হয়ে যায়।
মাথার ভারটা কিছুটা ছেড়েছে মনে হচ্ছে। গাড়ীতে বসতেই দেখে দরজায় হাল্কা হলুদ রং এর মিষ্টি একটা বাচ্চা মতন প্রজাপতি অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে খুব মায়া হল। হয়তো আজ কাউকে পায় নি স্বপ্ন দেখানোর জন্য। অথবা বাধ্য হয়েই এসেছে ডানা মেলতে এই প্রথম।
মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল – কোথায় থাক?
এরপরেই মনে হোল বোকার মতন প্রশ্ন হয়ে গেল, শুধরে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল – কোথায় যাবে? আমি ছেড়ে দিতে পারি।
কোন উত্তর না দিয়ে সোজা ফড়ফড় করে উড়ে পাশের দরজা দিয়ে ঢুকে শঙ্করের গায়ে লেপটে বসে পড়ল। শঙ্কর ছাড়াতে চাইলেও পারছে না। বড় মায়া ওর শরীরের গন্ধে, এ গন্ধ আগে খুব একটা পায়নি সে। খুব ইচ্ছা হোল সমস্ত শরীরে ওর গন্ধ চুরি করে মাখার।
গাড়ীর ভিতরে যখন গন্ধে লুটোপুটি খেতে ব্যস্ত শঙ্কর, তখন বাইরে রাতের রাজত্ব, আকাশে তারাদের ছোটাছুটি।
অঞ্জলি দত্ত পূজার ঘরে আত্মমগ্ন হয়ে ঠাকুরের সামনে হাতজোড় করে বসে আছেন প্রায় আধঘণ্টা তো হবেই। সারা ঘরে ফুল, চন্দন, বেলপাতা আর প্রসাদের পবিত্র গন্ধ।
শঙ্কর কাজে বের হওয়ার আগে মায়ের সাথে দেখা করতে এসে দরজার বাইরে স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুটা সময়। মনটা ভেজা ভেজা হয়ে উঠেছে, কত বছর পরে আজ মাকে এ ভাবে দেখছে। সেই কোন ছেলেবেলায় দেখেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে পূজোর পাঠটাই উঠে গেছিল বাড়ি থেকে। তখন শঙ্কর খুব ছোট, প্রায় সময় বাবা জাহাজে থাকার জন্য কাকুই ওদের কাছের নির্ভরযোগ্য আপন মানুষ ছিলেন। যত বড় হয়েছে দেখেছে মা আস্তে আস্তে কেমন যেন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন ওনার উপর। সমস্ত ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতেন কাকা। এমনকি মায়ের ভালোলাগাগুলোও পরিবর্তিত হতে হতে কাকার ভালোলাগার রূপ নিল। শঙ্করের দিকেও ভালো করে নজর দিতে পারতেন না মা, কাকার যত্ন করতে গিয়ে।
হঠাৎ মনটা কেমন যেন বিষিয়ে গেল পুরনো কথা মনে পড়ে........., মাকে কিছু না বলেই সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ নেমে চলে গেলেন।
গাড়ির শব্দে চোখ খুললেন অঞ্জলি দত্ত। বারান্দায় এসে দেখলেন ছেলে বেড়িয়ে যাচ্ছে। একটু অবাকই হলেন। তারপর ভাবলেন, পূজো করতে দেখে বোধহয় চলে গেছে। গাড়ী বেরিয়ে যাওয়ার পরে আবার পূজোর ঘরে ঢুকলেন। কাজের মহিলাও পিছন পিছন এসে জিজ্ঞাসা করলো – কি রান্না করব মাসিমা?
অঞ্জলি দত্ত কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললেন – আজ আমিই করব, তুমি শুধু সাহায্য করবে। মহিলাটি দৌড়ে গেল রান্নাঘরে আনন্দে। আজ মাসিমা রান্না করবেন, কত আনন্দের কথা। ফ্রিজ থেকে সব বের করতে লাগল। অঞ্জলি দত্ত একটু পরেই রান্নাঘরে গেলেন এবং দুজনে মিলে সুস্বাদু সব রান্নার জোগাড় করতে লাগলেন।
কাজ করতে করতেই পুরনো জীবন সামনে এসে দাঁড়ায় মাঝে মধ্যে। আবার সেই পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। প্রত্যেকদিন তাঁর মনের মতন করে রান্না করে রাখতে হত। একদিনও যদি অন্যথা হয়েছে তো আর রক্ষে নেই। কিছুতেই মুখে তুলবে না সেই খাবার – ঠাকুর পো খাও, খেয়ে নাও, লক্ষ্মীটি আমার............... বলে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়াতে হত। শুধু কি খাওয়া, স্নানও করতে হত তাঁর পছন্দের বিদেশী কোলন দিয়ে, এরপর গোলাপজল আর শেষে মাথার উপর পারফিউম স্প্রে করে স্নানঘর থেকে বেরতে হত। বাপ রে বাপ, না হলেই বলবে – আরামটা কি পুরোপুরি দেবে না? এসব মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। আবার রান্নায় মন দিলেন। দুপুরে শঙ্কর বাড়িতে খেতে এল মায়ের ফোন পেয়ে। বাড়িময় নানা সুস্বাদু গন্ধ হাওয়ার সাথে মিশে গেছে। অনেকগুলো বছর পিছনে চলে গেল মনটা, কোন ছোটবেলায় এমন সব খাবার খেয়েছে।
শব্দ তুলে আঙুল চাটতে চাটতে বলল – মা, মনে আছে শেষ কবে তুমি এমন রান্না করেছিলে? বাবা কি ভালোবাসতো না? বাড়িতে এসব রান্না মানেই বাবা এসেছে। কাকা অবশ্য একটু অন্য খাবার বেশী পছন্দ করত।
অঞ্জলি দেবী – অন্য খাবার কেন? এসবও তো খেত।
শঙ্কর – বাবার সাথে কোন মিলই ছিল না। সবই অন্য রকম ছিল।
অঞ্জলি দেবী কথা ঘুরিয়ে বললেন – তোর মামা কাল একটি পাত্রীর খোঁজ দিয়েছেন। এম. এ পাশ, গান জানে, আঁকেও।
শঙ্কর – আমার চেয়েও বেশী পাশ? তবে গতি হচ্ছে না কেন?
অঞ্জলি দেবী – বিয়ের বাজারে তোমার যথেষ্ট দাম আছে। টাকার কি কোন দাম নেই নাকি? সামনের রবিবার দেখতে আসবে।
শঙ্কর – আমাকে একটু সময় দাও ---
অঞ্জলি দেবী – অনেক সময় নিয়েছ, আর না, এবার টোপর পড়তেই হবে।
শঙ্কর – একমাস সময় দাও প্লিজ।
অঞ্জলি দেবী – মনে থাকে যেন, একদিনও বেশী নয়।
শঙ্কর বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন – মিশ্রাজী অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। রাতে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব।
ছেলে চলে যাওয়ার পর কথাগুলো মাথাটার মধ্যে লাফাতে থাকলো। ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক যে কি পছন্দ করতেন – ভাবা যায় না। ছুটিতে আসলেই কচুর সমস্ত প্রিপারেশান রোজ চাই–ই–চাই।
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিভাবে তিনি স্বামী – ছেলেকে ভুলে অন্যের কাছে নিজেকে তুলে দিতে পেরেছিলেন। নিজেকেও ভীষণ নীচ বলে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।
একদিন মনে হয়েছিল, যাকে বছরের বেশিটা সময় কাছে পাবেন নিজের মতন করে তাকেই তো মনে জায়গা দেবেন। এটাই তো স্বাভাবিক, এতে তো কোন দোষ নেই। তাহলে এখন এত পাপবোধ কোথা থেকে এসে জড়ো হচ্ছে? নাকি বয়সের চাহিদার কাছে ফিকে হয়ে যাওয়া আদর্শ আজ শেষ বয়সে এসে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বুকের ভিতর একটা চাপা দম বন্ধ করা কষ্ট টের পেলেন।
সকালে ঘুম ভাঙতেই রজনীগন্ধা আর ধূপের মিষ্টি গন্ধ নাকে এল শঙ্করের। হালকা রোদও ঢুকে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। সরাসরি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে এল। টেবিলে সাদা চাদর পেতে বাবা অমিত দত্তের ছবি রাখা হয়েছে। পূজার আয়োজন করছেন মা আর ঠাকুরমশাই মিলে। এত সকালেই মার স্নান হয়ে গেছে। একমনে আয়োজন করে চলেছেন দেখে শঙ্কর আস্তে আস্তে ভারী মন নিয়ে ছাদে উঠে এল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে গেল, আর পারা যাচ্ছে না। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হল। বাবার ছুটির শেষ দিন ছিল সেটা, হ্যাঁ মনে পড়েছে।
রাতে ঘুম ভেঙে যায় শঙ্করের। পাশে মা-বাবা কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখে কাকার ঘরে আলো জ্বলছে। চ্যাঁচানোর শব্দ শুনে পর্দার পিছনে এসে সে দাঁড়ায়। বাবা ঘৃণার ভঙ্গিতে বলছে – তোমরা দুজনে এত নোংরা ? আমার অবর্তমানে কি কর, তা এখন টের পাচ্ছি। সারা বছর বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরি মাত্র ক’দিনের জন্য, তখনও – ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
মা – এত ছিঃ ছিঃ করো না, তুমি কি বাইরে সন্যাসী হয়ে থাক? বললেই বিশ্বাস করব?
এরপর জোরে থাপ্পড় মারার শব্দ।
মা – এত সাহস তোমার? লজ্জা করে না, ছেলেকে আমার কাঁধে ফেলে নিজে ফুর্তি করে বেড়াও। নিজে যা খুশি করবে আর আমি .........
কাকা – দাদা আমাকে ক্ষমা করে দিস্, আসলে বৌদিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে ............
বাবা – তোর সাথে কথা বলতে চাই না। ভাই হয়ে – ছিঃ। (মার দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে জানিয়ে দিলেন – তাদের সম্পর্কটা আর রাখার দরকার নেই, কালই যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় মা)।
বাইরে এসে বাবার খুব মায়া হল, ছেলের ভয়ার্ত চোখ দুটো দেখে। ওকে কোলে তুলে ঘরে এনে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলেন।
সকালে ঘুম ভাঙার পরে পাশে বাবা ছিল না। বাড়ি ভর্তি লোক। নীচের বসার ঘরে বাবার শরীরটা পড়ে আছে। মা হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে আর কাকা রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। যতদিন গেছে আস্তে আস্তে কাকাই বাবার জায়গা নিয়েছে। শঙ্কর যত বড় হয়েছে তত বুঝতে শিখেছে - অনেক রকমের দৃশ্য, যা দেখা উচিৎ নয় তা দেখে ফেলেছে।
কখন ও পড়া থেকে উঠে জল খেতে গিয়ে, কখনো বাথরুমে যেতে গিয়ে, আবার গরমকালে আনমনে ছাদে উঠতে গিয়ে। কি বীভৎস লাগতো তার নিজের মাকে। শঙ্করের গা গুলিয়ে উঠত। বহুদিন দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছে। এরপর যত বড় হয়েছে, সাহস বেড়েছে সঙ্গে ঘৃণাও, তারপরেই বাবার মৃত্যুর কারণটা খুঁজতে শুরু করেছে।
শোরুমের ঠাণ্ডা ঘরে বসেও মনটা ঠিকঠাক কাজে বসাতে পারছে না। মা এখন ভালোই সুস্থ হয়ে গেছেন। শুধু শুধু আর দেরী করে লাভ কি? তাড়াতাড়ি না করলে বাবার কাছেই বা কি কৈয়িফত দেবে শঙ্কর। একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি! চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকা কষ্টকর। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। চোখের সামনে মনিটরটায় নানা ছবি নাচছে। হঠাৎ মনে পড়ল কাকার সেই কথাগুলো – মাকে কাছে নিয়ে বলছে – তুমি যে দুম করে বালিশ চাপা দিয়ে দেবে তা কি করে জানব? ভাগ্যিস তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম, না হলে তুমি একলা কিছুতেই পারতে না।
মা আহ্লাদি গলায় বলছে – যাকগে বাবা, ঝামেলা তো মিটেছে, আবার কি। বাদ দাও ওসব বাজে কথা, মনে না আনাই ভালো।
কিন্তু শঙ্করকে তো মনে আনতেই হবে। কাকা নিজের সোর্সে ধামাচাপা দিয়েছিল কেসটাকে।
এত বছর অপেক্ষার পর সময় হয়েছে সেদিনের ঘটনার ইতি টানার।
অনেক ভাবতে ভাবতে একটা পরিকল্পনা মাথায় এল। কাকার মতনই রাস্তায় শেষ করে দিলে কেমন হয় মাকে? তবে মা তো একসাথে বের হবে না? তাহলে ঘরেই কিছু একটা – হ্যাঁ, কারেন্টে – না হবে না। এতে নিজেরও বিপদ হতে পারে। তাহলে গ্যাস - হ্যাঁ, এটাই ভালো। মা আজকাল রান্নাও করছে। তবে কাজের মাসির কোন বিপদ কাম্য নয়। ফাঁক খুঁজতে হবে। অফিসে বসে, বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ চিন্তা করতে লাগলো শঙ্কর। কিভাবে কি করা যায়। রাস্তা বের করতেই হবে।
সাফ্, সুতরা হয়ে অফিসের চেয়ারে বসে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে চলেছে শঙ্কর। মন অপেক্ষা করছে ফোনের। আজ মায়ের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আজ মা তাঁর পছন্দের অনেক রকমের রান্না করবে বলেছে, আর ........... না! আর সে ভাবতে পারছে না। সবুরে মেওয়া ফলে। রিং হোল ---- সি. এল. আই তে বাড়ির নম্বর। উত্তেজনায় আঙুল কাঁপছে। রিসিভার তুলে নিল কানে –
- হ্যালো।
- দাদাবাবু, আমি পারুলের মা বলছি, মার সঙ্গে কথা বলেন।
- কিরে খেতে এলি না?
শঙ্কর একটু থতমত খেয়ে ঢোক গিলে বলল,
- একটু কাজে আটকে পড়েছিলাম, আসছি......।
এখন অনেক রাত, জানলার শিক পেরিয়ে মেঘের ফাঁক থেকে বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করলো শঙ্করের অনেক দিন পরে ঘুমের নেশা জড়িয়ে আসা চোখদুটো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দেবে............ যখন সে তার মাকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছে, এই আশা নিয়ে অনেক দিন পর ঘুমানোর চেষ্টা করলো শঙ্কর।
মেঘের ফাঁক থেকে কেউ যেন নজর রাখছেন, যাতে এত বছরের পরে শান্তির ঘুম নষ্ট না হয়।।
সুজাতা ঘোষ
প র্ব – ১
খোলা জানলা দিয়ে সকালের সূর্যের হাল্কা একফালি রোদ সোজা ঢুকে পড়েছে অঞ্জলি দত্তের শোবার ঘরে। মুখের উপর পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসেন। সারারাত দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে করতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেছিল টেরই পান নি।
দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে বিছানা থেকে নেমে ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। এখনো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এবারে পায়ে পায়ে পাশের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফাঁকা ঘর আর একরাশ ভাবনা। আর পারলেন না চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কি করা যায়? পায়চারি করতে লাগলেন আর নানা চিন্তা এলোমেলোভাবে মাথার মধ্যে জট পাকাতে লাগল।
কোথায় যেতে পারে মানুষটা? সারারাত ফিরল না। সকাল আটটা বাজে, একটা ফোন পর্যন্ত আসে নি। কারোর বাড়িতে গেছে – নাকি কাজে আটকে গেছে কোথাও? নাকি অন্য কিছু! ভয়ে বুকের ভিতরের ওঠানামা আরও বেড়ে গেল। রাগও হচ্ছে মাঝে মধ্যে, একটা ফোন তো করতে পারত। ছেলেটা কি করে ঘুমাচ্ছে এতক্ষণ? কোন চিন্তা নেই!
এখন কি করা যায়? সব জায়গায় ফোন করা হয়ে গেছে। আর কিছু চিন্তা না করতে পেরে অঞ্জলি দত্ত নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসটা জ্বালালেন চা করার জন্য। রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছে। ভাবলেন চা খেলে হয়তো মাথাটা ঠিকমত কাজ করবে।
দরজায় কলিং বেলের শব্দ........., প্রচণ্ড রাগ আর অভিমান নিয়ে দরজা খুলতে গেলেন গজগজ করতে করতে। কিন্তু একি! দরজা খুলেই দেখেন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক বললেন – বাড়িতে আর কে আছেন?
অঞ্জলি – আমার ছেলে, কেন বলুন তো?
পুলিশ – একটু ডেকে দিন, দরকার আছে।
অঞ্জলি দত্ত দরজা থেকেই ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন – শঙ্কর, অ্যাই শঙ্কর, একটু বাইরে আয় তো।
ততক্ষণে শঙ্করেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বাইরে এসে দেখে পুলিশ আর মা মুখোমুখি ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ ভদ্রলোক বললেন – ভি. আই. পি রোডে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, যে ভদ্রলোকের বডি পাওয়া গেছে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সে এই বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। নাম কমল দত্ত। আপনাদের কেউ হয় কি? একবার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে বডিটা দেখে আসতে হবে।
খবর শুনেই অঞ্জলি দত্ত পাথরের মেঝেতে পড়ে যান প্রচণ্ড শব্দে। শঙ্কর ব্যস্ত হয়ে মাকে তুলে ডিভানে শুইয়ে দিয়ে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে থাকেন। জ্ঞান ফিরলে, তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরে রেখে পুলিশের সাথেই বডি দেখতে চলে যান।
রাতের সমস্ত অন্ধকার যেন ঝড়ের গতিতে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। ঘরটাই যেন ব্ল্যাকহোল হয়ে অঞ্জলি দত্তকে গিলে নিয়েছে। চারপাশের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে, বহু পুরনো স্মৃতি তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে........., প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিচ্ছে তাকে। অঞ্জলি দত্ত চেষ্টা করছেন নিজেকে এর থেকে আড়াল করার। তাঁর সাদা অবস্থানকে বহু বছর পর আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বেশী গাঢ় ভাবে।
টেবিলের উপর কমল দত্তের ছবিতে রজনীগন্ধার মালা আর ধূপের গন্ধ, সামনে পাথর মূর্তি অঞ্জলি দত্ত। অমিত দত্তের স্ত্রী, একটা ঝটকা লাগল মাথার মধ্যে কথাটা মনে হতেই। একটু নড়ে উঠলেন যেন অঞ্জলি দত্ত। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এই পোশাক পড়ে বসতে হয়েছিল আর একজনের ছবির সামনে। তিনি তাঁর স্বামী অমিত দত্ত। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বছরের অর্ধেক সময় বাইরে থাকতেন। যখন বাড়ি ফিরতেন স্ত্রী-পুত্রের জন্য অকৃপণ হাতে যতটা সম্ভব ভালো ভালো জিনিস নিয়ে আসতেন ঘরে। হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-ভালবাসা, ঘোরাফেরা সব মিলিয়ে বেশ সুন্দরভাবে কেটে যেত কটা মাস। তারপর আবার ছেলেকে নিয়ে একঘেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন।
কমল দত্ত ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে অমিত দত্ত স্পষ্ট হয়ে উঠছেন অঞ্জলিদেবীর সামনে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক রাগ, অভিমান, দুঃখ, লজ্জা, হীনমন্যতা একসাথে স্রোতের মতন কান্না হয়ে বেরিয়ে আসল বুকের গভীর থেকে। একে থামাবার ক্ষমতা তাঁর নিজেরও নেই। তিরিশ বছর ধরে যে সুখ ভোগ করে এসেছেন, তা এই মুহূর্তে পাপ বোধ হয়ে অঞ্জলি দত্তকে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে।
কান্না দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিকট শব্দ তুলছে হাসির। ঘরের চারপাশের সেই হাসি সারা ঘরময় ঘুরে তাণ্ডব নৃত্য করে অঞ্জলি দত্তের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে এতদিন ধরে চেপে রাখা সেই ঘটনা। যা বিশ্বাসঘাতকতার বা নীতি নৈতিকতাহীন এক চরম লজ্জার ঘটনা।
রাত প্রায় তিনটে, শঙ্করের ঘরে জোরালো আলো। শেষ ঘাটে পাখা জোরে শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে। ঘরে কোন মানুষ নেই। ছাদের সিঁড়িতে আলো জ্বলছে, যার একটুকরো অংশে হাল্কা প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে শঙ্করের লম্বা অবয়বের। আজ এই মুহূর্তে বড় বেশি লম্বা মনে হচ্ছে তাকে। অনেকটা দানবের মতন। সন্তুষ্ট দানব। হাতে সুরাপাত্র, সমস্ত শরীরে আগুনের হল্কা, মুখে আত্মতৃপ্তি। বিকট কালো রাতও ফিকে হয়ে গেছে, ওর মুখের হাসির আলোতে।
তিরিশ টা বছর! কি সে সাংঘাতিক যন্ত্রণা – আজ অর্ধেক ক্ষত পূর্ণ হল। এতগুলো বছর ওর কাছে কেঁদেছে মৃত্যুযন্ত্রণায়। এমন কোন রাত নেই যেদিন ও ঐ ভয়ানক স্বপ্নটা দেখেনি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ভয়ে ভয়ে পাশে তাকিয়ে দেখত মা কে, আর কুঁকড়ে যেত ভয়ে। পাশ বালিশটা দুজনের মাঝে টেনে এনে কেন্নোর মতন গুটিয়ে শুয়ে থাকত জোর করে চোখ দুটোকে বন্ধ করে। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকত, তাড়াতাড়ি সূর্যের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য।
আজ এত বছর পরে সূর্যের ঘুম ভেঙেছে। শান্তির শ্বাস ফেলে আবার গ্লাস ভরে নিল সোনালী জলে। গলায় ঢালতেই সমস্ত শরীরকে ঠাণ্ডা করে দিল মুহূর্তে। কি শান্তি! আরও, আরও চাইছে শরীর। মন, মাথা সব শান্ত হতে চাইছে আজ।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, নিস্তেজ হয়ে আসছে মাথা, বসে পড়ল শঙ্কর। কষ্ট হচ্ছে বসে থাকতে। আস্তে আস্তে শরীরটা পড়ে গেল জলছাদের উপর। শান্ত দুটো চোখ নেশা মেখে তাকিয়ে রইল বিশাল খোলা আকাশটার দিকে। আজ তো চাঁদ ওঠে নি, তবে এত স্নিগ্ধ মুখ কার? আরে বাবা তো, দেখ কাণ্ড। তিরিশ বছর পরে হাসিমুখটা দেখছে তো, তাই একবারে চিনতে পারে নি।
অমিত দত্ত, শঙ্কর দত্তের বাবা। এতদিনে বোধ হয় একটু শান্তি পেয়েছেন মনে। তাই ঐ শান্তি সারা মুখে মেখে ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শঙ্করের বেশ ভালো লাগছে বাবার হাসি মুখ দেখতে। এত বছর শুধু চাপা গোঙানি শুনে এসেছে ঘুমের মধ্যে। আজ হাসি দেখতে খুব ভালো লাগছে।
বিড়বিড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল – তুমি চিন্তা করো না বাবা, আমি আছি তো। তোমার ছেলে, আমি শোধ নেব। সব শোধ নেব আমি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, আমি ----
দু চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে গেল (ওর অজান্তে)
পর্ব - ২
কমল দত্তের মৃত্যুর পর প্রায় বছর দুয়েক হবে অঞ্জলি দত্ত শয্যাশায়ী। বাড়িতেই ডাক্তার এসে নিয়মিত দেখে যাচ্ছেন। সবসময় এর জন্য নার্সও রাখা হয়েছে। শঙ্করের নিজের হাতে বিশেষ সময় থাকে না মাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। সারাদিনই ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে তাড়াতাড়ি মাকে সুস্থ করে তুলতে।
ছেলেকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য অঞ্জলি দত্ত অনেক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু কোন ফল হয় নি। সাঁইত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে তবুও বিয়েতে মত নেই, কারণ জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। তবে কাজে খুব মন, ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকে সর্বক্ষণ।
অঞ্জলি দত্ত সারাটা দিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেন। মাঝে মাঝে একটু বসার মতন উঠে শুয়ে থাকেন ঘাড়ের নীচে মোটা বালিশ দিয়ে। কথা বলার লোকও নেই, ইচ্ছাও নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই যেন স্মৃতিকে হাতড়ে বেড়ান। তাতেই শান্তি, বর্তমানের সাথে যেন কোন যোগাযোগই নেই। ছেলের বিয়ে নিয়েও হয়তো ভাবেন না।
দুজন পুরুষ – দুজন দুরকমের। একজন সামাজিক আর অন্যজন অসামাজিক, আজ কেউ কাছে নেই। দুজনেই চলে গেছেন বহুদূরে। আর ঐ দূরের পথ চেয়েই অপেক্ষা করা, ওখানে পৌঁছবার জন্য। এই অপেক্ষাই শরীর–মন দুটোকেই বড় কাহিল করে ফেলেছে। ছেলে অনেক চেষ্টা করছে মাকে সুস্থ করে তোলার, কিন্তু তিনি জানেন এ জন্মে আর তা হওয়ার নয়। চানও না। অতীতের সুখ আজ দুঃখেরই প্রতিবিম্ব যেন। অমিত দত্ত আর কমল দত্ত – দুজনের সাথেই কাটান মুহুর্তগুলো এখন ফণার মতন খোঁচা দিচ্ছে সমস্ত শরীরে। আগে যা সোহাগ অনুভুতি ছিল আজ তা লজ্জা আর পাপের মিশ্রন হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এভাবেই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে শঙ্কর এসে পাশে বসেছে খেয়ালই হয়নি ওনার। মায়ের বাঁ হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করল – এখন একটু ভালো বোধ করছ? তখন হুঁশ হোল।
ছেলেকে কাছে পেয়ে একটু (অন্য রকম) খুশি খুশি ভাব এনে হেসে উত্তর দিল – হ্যাঁ। তুই এত কাজে ব্যস্ত থাকিস কেন সব সময়? একটু বিশ্রাম নিতে পারিস না?
শঙ্কর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠো তারপর আমি বিশ্রাম নেবো। তুমি একটু বাগানে হাঁটাচলার চেষ্টা করো না- নাহলে কখনোই সুস্থ হতে পারবে না।
অঞ্জলি – আমার কথা থাক্, বিয়ের জন্য কি ভাবলি?
শঙ্কর – আগে তুমি সুস্থ হও –
অঞ্জলি – সুন্দর একটা বউ নিয়ে আয়, তাহলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব।
শঙ্কর – এখন উঠতে হবে, শোরুমে ক্লায়েন্ট এসে অপেক্ষা করছে, পরে কথা হবে।
অঞ্জলি – সাবধানে যাস বাবা।
শঙ্কর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আস্তে আস্তে শব্দটা মিলিয়ে যেতে অঞ্জলি দত্ত শুয়ে পড়লেন আর একবার। ডুবে গেলেন ভাবনার সাগরে।
শোরুমে ঢুকতেই এক ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন,
- নমস্কার শঙ্করবাবু
- নমস্কার, বেশীক্ষণ অপেক্ষা করাই নি তো?
- নাহি – নাহি। চলিয়ে আপকে ঘর মে চলতে হ্যায়।
শঙ্কর লাল কার্পেটের উপর পা ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে শর্মাজীর সাথে মুখোমুখি সোফায় বসল। এবারে শর্মাজী সুটকেস খুলে নীল ভেলভেটের একটা বাক্স বের করে টেবিলের উপর খুলে ধরলেন। তারপর শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে মনোভাব আন্দাজ করার চেষ্টা করে বললেন –
আচ্ছি তর্হা সে দেখ্ লিজিয়ে। রেট কে বারেমে বাদ মে বাত কর লেঙ্গে, প্যাহলে পসন্দ তো কিজিয়ে।
শঙ্কর ভালো করে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে নিয়ে, যেগুলো পছন্দ হোল সেগুলো আলাদা করে রাখল। শর্মাজী হিসেব করে রেট বলে দিলেন। এরপর দরাদরি করে শঙ্করবাবু ক্যাশে পেমেন্ট মিটিয়ে দিলেন।
একটা বড় কাজ হয়ে গেল। এবারে নিশ্চিন্ত মনে অন্য ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে লাগল ফোনে।
সারাদিন খাটাখাটনির পরে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একবার ‘পাবে’ ঢুঁ মারার ইচ্ছা হল। বাইরে খুব কমই হাতে রঙ্গীন গ্লাস নেয় সে। তবে আজ একবার না নিয়ে পারল না। আজ মনটা খুব ভালো লাগছে। মা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, হীরেগুলো হাতে এসেছে।
নীল আলোতে রক্ত রঙের রঙ্গিন পাত্রটা আরও বেশী রোমহর্ষক করে তুলেছে টেবিলটাকে। আর পাশেই গরম ‘বিফ্’-এর ডিশ থেকে ধোঁয়া বেড়িয়ে শঙ্করের ভিতরের ঘুমিয়ে থাকা দানবটাকে জাগিয়ে তুলল।
আজ বেশ কয়েকটা পেগ হয়ে গেছে, খেয়াল হয়নি আগে। পা দুটো বেসামাল ঠেকছে। তবুও যতটা সম্ভব সতর্কভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল গাড়ির দিকে। বাইরের ফুড়ফুড়ে হাওয়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে ইচ্ছা করল। বেশ রাত হয়েছে ঘড়িতে। অথচ কি আশ্চর্য - বাইরে কত আলো, ঠাণ্ডা হাওয়া পুরো শরীরটাকে হাল্কা করে ভাসিয়ে নিতে চাইছে পালকের মতন। ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে রঙিন প্রজাপতির সাথে। শঙ্কর রঙিন প্রজাপতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে, এরা এত এত রং মেখে রোজ রাতে তাঁর মতন কত মানুষকে স্বপ্নে ভাসাতে আসে, আবার ভোরে - ভোরের স্বপ্নের মতন মাঝপথে উধাও হয়ে যায়।
মাথার ভারটা কিছুটা ছেড়েছে মনে হচ্ছে। গাড়ীতে বসতেই দেখে দরজায় হাল্কা হলুদ রং এর মিষ্টি একটা বাচ্চা মতন প্রজাপতি অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে খুব মায়া হল। হয়তো আজ কাউকে পায় নি স্বপ্ন দেখানোর জন্য। অথবা বাধ্য হয়েই এসেছে ডানা মেলতে এই প্রথম।
মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল – কোথায় থাক?
এরপরেই মনে হোল বোকার মতন প্রশ্ন হয়ে গেল, শুধরে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল – কোথায় যাবে? আমি ছেড়ে দিতে পারি।
কোন উত্তর না দিয়ে সোজা ফড়ফড় করে উড়ে পাশের দরজা দিয়ে ঢুকে শঙ্করের গায়ে লেপটে বসে পড়ল। শঙ্কর ছাড়াতে চাইলেও পারছে না। বড় মায়া ওর শরীরের গন্ধে, এ গন্ধ আগে খুব একটা পায়নি সে। খুব ইচ্ছা হোল সমস্ত শরীরে ওর গন্ধ চুরি করে মাখার।
গাড়ীর ভিতরে যখন গন্ধে লুটোপুটি খেতে ব্যস্ত শঙ্কর, তখন বাইরে রাতের রাজত্ব, আকাশে তারাদের ছোটাছুটি।
প র্ব – ৩
অঞ্জলি দত্ত পূজার ঘরে আত্মমগ্ন হয়ে ঠাকুরের সামনে হাতজোড় করে বসে আছেন প্রায় আধঘণ্টা তো হবেই। সারা ঘরে ফুল, চন্দন, বেলপাতা আর প্রসাদের পবিত্র গন্ধ।
শঙ্কর কাজে বের হওয়ার আগে মায়ের সাথে দেখা করতে এসে দরজার বাইরে স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুটা সময়। মনটা ভেজা ভেজা হয়ে উঠেছে, কত বছর পরে আজ মাকে এ ভাবে দেখছে। সেই কোন ছেলেবেলায় দেখেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে পূজোর পাঠটাই উঠে গেছিল বাড়ি থেকে। তখন শঙ্কর খুব ছোট, প্রায় সময় বাবা জাহাজে থাকার জন্য কাকুই ওদের কাছের নির্ভরযোগ্য আপন মানুষ ছিলেন। যত বড় হয়েছে দেখেছে মা আস্তে আস্তে কেমন যেন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন ওনার উপর। সমস্ত ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতেন কাকা। এমনকি মায়ের ভালোলাগাগুলোও পরিবর্তিত হতে হতে কাকার ভালোলাগার রূপ নিল। শঙ্করের দিকেও ভালো করে নজর দিতে পারতেন না মা, কাকার যত্ন করতে গিয়ে।
হঠাৎ মনটা কেমন যেন বিষিয়ে গেল পুরনো কথা মনে পড়ে........., মাকে কিছু না বলেই সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ নেমে চলে গেলেন।
গাড়ির শব্দে চোখ খুললেন অঞ্জলি দত্ত। বারান্দায় এসে দেখলেন ছেলে বেড়িয়ে যাচ্ছে। একটু অবাকই হলেন। তারপর ভাবলেন, পূজো করতে দেখে বোধহয় চলে গেছে। গাড়ী বেরিয়ে যাওয়ার পরে আবার পূজোর ঘরে ঢুকলেন। কাজের মহিলাও পিছন পিছন এসে জিজ্ঞাসা করলো – কি রান্না করব মাসিমা?
অঞ্জলি দত্ত কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললেন – আজ আমিই করব, তুমি শুধু সাহায্য করবে। মহিলাটি দৌড়ে গেল রান্নাঘরে আনন্দে। আজ মাসিমা রান্না করবেন, কত আনন্দের কথা। ফ্রিজ থেকে সব বের করতে লাগল। অঞ্জলি দত্ত একটু পরেই রান্নাঘরে গেলেন এবং দুজনে মিলে সুস্বাদু সব রান্নার জোগাড় করতে লাগলেন।
কাজ করতে করতেই পুরনো জীবন সামনে এসে দাঁড়ায় মাঝে মধ্যে। আবার সেই পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। প্রত্যেকদিন তাঁর মনের মতন করে রান্না করে রাখতে হত। একদিনও যদি অন্যথা হয়েছে তো আর রক্ষে নেই। কিছুতেই মুখে তুলবে না সেই খাবার – ঠাকুর পো খাও, খেয়ে নাও, লক্ষ্মীটি আমার............... বলে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়াতে হত। শুধু কি খাওয়া, স্নানও করতে হত তাঁর পছন্দের বিদেশী কোলন দিয়ে, এরপর গোলাপজল আর শেষে মাথার উপর পারফিউম স্প্রে করে স্নানঘর থেকে বেরতে হত। বাপ রে বাপ, না হলেই বলবে – আরামটা কি পুরোপুরি দেবে না? এসব মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। আবার রান্নায় মন দিলেন। দুপুরে শঙ্কর বাড়িতে খেতে এল মায়ের ফোন পেয়ে। বাড়িময় নানা সুস্বাদু গন্ধ হাওয়ার সাথে মিশে গেছে। অনেকগুলো বছর পিছনে চলে গেল মনটা, কোন ছোটবেলায় এমন সব খাবার খেয়েছে।
শব্দ তুলে আঙুল চাটতে চাটতে বলল – মা, মনে আছে শেষ কবে তুমি এমন রান্না করেছিলে? বাবা কি ভালোবাসতো না? বাড়িতে এসব রান্না মানেই বাবা এসেছে। কাকা অবশ্য একটু অন্য খাবার বেশী পছন্দ করত।
অঞ্জলি দেবী – অন্য খাবার কেন? এসবও তো খেত।
শঙ্কর – বাবার সাথে কোন মিলই ছিল না। সবই অন্য রকম ছিল।
অঞ্জলি দেবী কথা ঘুরিয়ে বললেন – তোর মামা কাল একটি পাত্রীর খোঁজ দিয়েছেন। এম. এ পাশ, গান জানে, আঁকেও।
শঙ্কর – আমার চেয়েও বেশী পাশ? তবে গতি হচ্ছে না কেন?
অঞ্জলি দেবী – বিয়ের বাজারে তোমার যথেষ্ট দাম আছে। টাকার কি কোন দাম নেই নাকি? সামনের রবিবার দেখতে আসবে।
শঙ্কর – আমাকে একটু সময় দাও ---
অঞ্জলি দেবী – অনেক সময় নিয়েছ, আর না, এবার টোপর পড়তেই হবে।
শঙ্কর – একমাস সময় দাও প্লিজ।
অঞ্জলি দেবী – মনে থাকে যেন, একদিনও বেশী নয়।
শঙ্কর বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন – মিশ্রাজী অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। রাতে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব।
ছেলে চলে যাওয়ার পর কথাগুলো মাথাটার মধ্যে লাফাতে থাকলো। ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক যে কি পছন্দ করতেন – ভাবা যায় না। ছুটিতে আসলেই কচুর সমস্ত প্রিপারেশান রোজ চাই–ই–চাই।
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিভাবে তিনি স্বামী – ছেলেকে ভুলে অন্যের কাছে নিজেকে তুলে দিতে পেরেছিলেন। নিজেকেও ভীষণ নীচ বলে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।
একদিন মনে হয়েছিল, যাকে বছরের বেশিটা সময় কাছে পাবেন নিজের মতন করে তাকেই তো মনে জায়গা দেবেন। এটাই তো স্বাভাবিক, এতে তো কোন দোষ নেই। তাহলে এখন এত পাপবোধ কোথা থেকে এসে জড়ো হচ্ছে? নাকি বয়সের চাহিদার কাছে ফিকে হয়ে যাওয়া আদর্শ আজ শেষ বয়সে এসে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বুকের ভিতর একটা চাপা দম বন্ধ করা কষ্ট টের পেলেন।
প র্ব – ৪
সকালে ঘুম ভাঙতেই রজনীগন্ধা আর ধূপের মিষ্টি গন্ধ নাকে এল শঙ্করের। হালকা রোদও ঢুকে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। সরাসরি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে এল। টেবিলে সাদা চাদর পেতে বাবা অমিত দত্তের ছবি রাখা হয়েছে। পূজার আয়োজন করছেন মা আর ঠাকুরমশাই মিলে। এত সকালেই মার স্নান হয়ে গেছে। একমনে আয়োজন করে চলেছেন দেখে শঙ্কর আস্তে আস্তে ভারী মন নিয়ে ছাদে উঠে এল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে গেল, আর পারা যাচ্ছে না। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হল। বাবার ছুটির শেষ দিন ছিল সেটা, হ্যাঁ মনে পড়েছে।
রাতে ঘুম ভেঙে যায় শঙ্করের। পাশে মা-বাবা কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখে কাকার ঘরে আলো জ্বলছে। চ্যাঁচানোর শব্দ শুনে পর্দার পিছনে এসে সে দাঁড়ায়। বাবা ঘৃণার ভঙ্গিতে বলছে – তোমরা দুজনে এত নোংরা ? আমার অবর্তমানে কি কর, তা এখন টের পাচ্ছি। সারা বছর বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরি মাত্র ক’দিনের জন্য, তখনও – ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
মা – এত ছিঃ ছিঃ করো না, তুমি কি বাইরে সন্যাসী হয়ে থাক? বললেই বিশ্বাস করব?
এরপর জোরে থাপ্পড় মারার শব্দ।
মা – এত সাহস তোমার? লজ্জা করে না, ছেলেকে আমার কাঁধে ফেলে নিজে ফুর্তি করে বেড়াও। নিজে যা খুশি করবে আর আমি .........
কাকা – দাদা আমাকে ক্ষমা করে দিস্, আসলে বৌদিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে ............
বাবা – তোর সাথে কথা বলতে চাই না। ভাই হয়ে – ছিঃ। (মার দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে জানিয়ে দিলেন – তাদের সম্পর্কটা আর রাখার দরকার নেই, কালই যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় মা)।
বাইরে এসে বাবার খুব মায়া হল, ছেলের ভয়ার্ত চোখ দুটো দেখে। ওকে কোলে তুলে ঘরে এনে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলেন।
সকালে ঘুম ভাঙার পরে পাশে বাবা ছিল না। বাড়ি ভর্তি লোক। নীচের বসার ঘরে বাবার শরীরটা পড়ে আছে। মা হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে আর কাকা রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। যতদিন গেছে আস্তে আস্তে কাকাই বাবার জায়গা নিয়েছে। শঙ্কর যত বড় হয়েছে তত বুঝতে শিখেছে - অনেক রকমের দৃশ্য, যা দেখা উচিৎ নয় তা দেখে ফেলেছে।
কখন ও পড়া থেকে উঠে জল খেতে গিয়ে, কখনো বাথরুমে যেতে গিয়ে, আবার গরমকালে আনমনে ছাদে উঠতে গিয়ে। কি বীভৎস লাগতো তার নিজের মাকে। শঙ্করের গা গুলিয়ে উঠত। বহুদিন দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছে। এরপর যত বড় হয়েছে, সাহস বেড়েছে সঙ্গে ঘৃণাও, তারপরেই বাবার মৃত্যুর কারণটা খুঁজতে শুরু করেছে।
শোরুমের ঠাণ্ডা ঘরে বসেও মনটা ঠিকঠাক কাজে বসাতে পারছে না। মা এখন ভালোই সুস্থ হয়ে গেছেন। শুধু শুধু আর দেরী করে লাভ কি? তাড়াতাড়ি না করলে বাবার কাছেই বা কি কৈয়িফত দেবে শঙ্কর। একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি! চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকা কষ্টকর। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। চোখের সামনে মনিটরটায় নানা ছবি নাচছে। হঠাৎ মনে পড়ল কাকার সেই কথাগুলো – মাকে কাছে নিয়ে বলছে – তুমি যে দুম করে বালিশ চাপা দিয়ে দেবে তা কি করে জানব? ভাগ্যিস তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম, না হলে তুমি একলা কিছুতেই পারতে না।
মা আহ্লাদি গলায় বলছে – যাকগে বাবা, ঝামেলা তো মিটেছে, আবার কি। বাদ দাও ওসব বাজে কথা, মনে না আনাই ভালো।
কিন্তু শঙ্করকে তো মনে আনতেই হবে। কাকা নিজের সোর্সে ধামাচাপা দিয়েছিল কেসটাকে।
এত বছর অপেক্ষার পর সময় হয়েছে সেদিনের ঘটনার ইতি টানার।
অনেক ভাবতে ভাবতে একটা পরিকল্পনা মাথায় এল। কাকার মতনই রাস্তায় শেষ করে দিলে কেমন হয় মাকে? তবে মা তো একসাথে বের হবে না? তাহলে ঘরেই কিছু একটা – হ্যাঁ, কারেন্টে – না হবে না। এতে নিজেরও বিপদ হতে পারে। তাহলে গ্যাস - হ্যাঁ, এটাই ভালো। মা আজকাল রান্নাও করছে। তবে কাজের মাসির কোন বিপদ কাম্য নয়। ফাঁক খুঁজতে হবে। অফিসে বসে, বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ চিন্তা করতে লাগলো শঙ্কর। কিভাবে কি করা যায়। রাস্তা বের করতেই হবে।
প র্ব – ৫
সাফ্, সুতরা হয়ে অফিসের চেয়ারে বসে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে চলেছে শঙ্কর। মন অপেক্ষা করছে ফোনের। আজ মায়ের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আজ মা তাঁর পছন্দের অনেক রকমের রান্না করবে বলেছে, আর ........... না! আর সে ভাবতে পারছে না। সবুরে মেওয়া ফলে। রিং হোল ---- সি. এল. আই তে বাড়ির নম্বর। উত্তেজনায় আঙুল কাঁপছে। রিসিভার তুলে নিল কানে –
- হ্যালো।
- দাদাবাবু, আমি পারুলের মা বলছি, মার সঙ্গে কথা বলেন।
- কিরে খেতে এলি না?
শঙ্কর একটু থতমত খেয়ে ঢোক গিলে বলল,
- একটু কাজে আটকে পড়েছিলাম, আসছি......।
এখন অনেক রাত, জানলার শিক পেরিয়ে মেঘের ফাঁক থেকে বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করলো শঙ্করের অনেক দিন পরে ঘুমের নেশা জড়িয়ে আসা চোখদুটো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করে দেবে............ যখন সে তার মাকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছে, এই আশা নিয়ে অনেক দিন পর ঘুমানোর চেষ্টা করলো শঙ্কর।
মেঘের ফাঁক থেকে কেউ যেন নজর রাখছেন, যাতে এত বছরের পরে শান্তির ঘুম নষ্ট না হয়।।
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন