সম্পর্ক - শকুন্তলা দে


দাদু-ঠাকুমা
শকুন্তলা দে


রাস্তায় বেরিয়ে দেখি ছোটো ছেলেটা দাদুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল বাস ধরবে বলে। দাদুর চোখ রাস্তার দিকে আর ছেলেটা সামনের দোকানের সাজানো লোভনীয় জিনিসগুলো দেখে এক মনে বক বক করেই চলেছে। দাদুর এতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, বোঝা গেলো এ রোজকার ঘটনা, মনটা যেন কেমন হয়ে গেল, আজকাল আর নাতিরা কি সত্যি সে ভাবে দাদু দিদাদের সঙ্গ পায়, আমার চোখে তো পড়ে না, আগে দেখেছি বিকালে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দাদুর হাত ধরে পার্কে, মাঠে অথবা রাস্তায় হেঁটে বেড়াত, আজকাল তারা ঐ সময়, হয় গান, নয় ছবি আঁকা, নয় নাচ শেখা, না হয় পড়তে যাওয়া। আগে সকালে ঠাকুমা দিদামারা ব্যস্ত থাকত সংসারের রান্নাঘরের সব কাজে, সেই সময়ে মা কাকিমারা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, বড়দের কলেজ অফিসে যাওয়ার জন্য হাতের কাছে সব জোগাড় দিত। সন্ধ্যার পর মা-কাকিমা- মামীমারা ঢুকে যেতো রান্নাঘরে আর ঠাকুমা দিদারা সেই সময়টা বাড়ির সব ছোট, ছোট ছেলে মেয়েদের শান্ত করে রাখার জন্য নিয়ে বসত নিজেদের কাছে , কখনো কখনো কিছু পৌরাণিক রূপকথার গল্প শোনাত, কখনো বা নিজেদের ছোট বেলার সব মজার মজার ঘটনা গল্পের মত করে বলত। এতে বাচ্চারা তো খুশী হতই আর তারা নিজেরাও যেন ফিরে যেত নিজেদের সেই ছোটবেলাতে । আমার দিদা সেন্ট মারগারেট স্কুলের হস্টেলে থাকত, সেই সময়ে যে সব নানান ঘটনা ঘটেছিল সেগুলো আমাদের গল্পের মত করে বলেছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে দিদার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো দিদা যেন ছোট কোন বাচ্চা, সেই সময় দিদার মুখটা কি সুন্দর দেখতে লাগত সেটা আমার এখনও বেশ মনে আছে। তার মুখের ঐ সব বলিরেখার মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকত কত শত গল্প । আমার মনে হয় এই সময়টার জন্য দিদারাও বোধ হয় অপেক্ষা করে থাকত। বাচ্চাদের সামলানোর ছলে নিজেদের স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে ফিরে যেত নিজেদের ছোটবেলায়। আগেকার দিনে তাদের তো আর সেইভাবে সুযোগ হতো না ছোট বেলার বন্ধুদের সাথে দেখা করবার বা কথা বলবার। কোন অনুষ্ঠানেও অনেক পুরনো মানুষ জনের সাথে দেখা হলেও হাজার কাজের মাঝে মনের কথা বলার সুযোগও হত না। কাজেই ভাল মন্দ যা কিছু বলার থাকতো তা এই নাতি নাতনিদের কাছেই.........আর নাতি নাতনিরাও এই সময়টা তাদের ঠাকুমা দাদুর কাছ ছাড়া হতে চাইত না। তাদেরও খুব প্রিয় ছিল সেইসব গল্প। আর আজকাল সংসার সামলানোর জন্য আছে কাজের লোকেরা। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সময় নেই ঠাকুমা দিদাদের গল্প শোনবার। তাই সন্ধ্যা হলেই দাদু দিদা ঠাম্মারা সব গুছিয়ে নিয়ে বসে পড়ে টিভির সামনে। চোখের পলক ফেলারও সময়ও পায় না তারা, একের পর এক ধারাবাহিকে ডুবে যায়। এই সময়ে বাড়িতে কেউ এলে ব্যাজার মুখে ভুলভাল সব উত্তর দিয়ে ফেলে। কারণ চোখ কান দুটোই তো টিভির দিকে। আর ছোট ছোট নাতি নাতনিরা সামনে এলেই বলে উঠবে-“আয়,বস, দেখ, কি হচ্ছে সব।“ উদ্দেশ্য একটাই যেভাবেই তাদের মধ্যেও ঐ সব ধারাবাহিক সম্পর্কে একটা আকর্ষণ তৈরি করা, যাতে দেখার সময়ে তারা বিরক্ত না করে। আমার এখন বেশ মনে আছে ছোটবেলাতে ঐ সব রূপকথার গল্প শোনার পর সেগুলো ছবি সহ লেখার অক্ষরে দেখা, তার পর সেগুলোকে নিজে পড়ার যে কি আনন্দ তা বলে বোঝান যাবে না। আগে জন্মদিন বা যে কোনও উৎসবে বই দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল, বাচ্চা বড় সবাই খুব পছন্দ করত এই উপহার, অনেক সময়ে জেনে নেওয়া হত কার কি বই পছন্দ। আজকাল বাচ্চাদের সেই সব কাল্পনিক আজগুবি গল্প বলার আর কেউ নেই প্রায়, নেই সেই ছবি দেওয়া গল্পর বইগুলো পড়ে শোনানোর লোক। বাচ্চারাও আজকাল সুযোগ পেলেই বসে যাচ্ছে টিভির সামনে কার্টুন দেখতে। মনটা খারাপ হয়ে গেল, ঐ ঠাকুমা দাদুরা নাতিদের সাহচর্যে নিজেদের শৈশবে ফিরে যাওয়ার আনন্দ পেত, আজ সে তা হারালো, তেমনি শিশুরা এই রকমই ঠাকুমা দাদুর সঙ্গ না পেয়ে শৈশব হারাল ,আমি ঠাকুমা হলেই শুরু করব সেই সব গল্প বলা। সুযোগ পাবোতো?


6 মতামত:

  1. দেবাশিস কাঞ্জিলাল১৩ নভেম্বর, ২০১৩ এ ৫:২৭ PM

    শকুন্তলা দে 'র 'সম্পর্ক' এক মর্স্পমর্শী অনুভূতিকে জাগালো। এই গতির যুগে ছোট ছোট ভালোলাগা।খুসি ,মানুষে মানুষে সম্পর্ক এখন যান্ত্রিকতার গন্ডীবদ্ধ ! সেই ফেলে আসা দিনগুলির সম্পর্কের কথা আবার নতুন করে মনে করিয়ে শকুন্তলা আমাদের সকলের ভালোলাগাকে সুন্দর ভাবে ফেরালেন। আশা করতে ইচ্ছে জাগে,হয়ত আবার মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কগুলি আবার নতুন করে ফিরবে জীবনে।

    উত্তরমুছুন
  2. ছোটবেলার দাদু দিদার অনেক সান্নিদ্ধ মনে করিয়ে দিলেন।

    উত্তরমুছুন
  3. আমার ছেলেবেলা কে মনে করয়ে দেওার জন্য শাকুন্তলা দী কে অশেষ ধন্যবাদ, অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে আসছহে.. বেশির ভাগই ঝাপসা.. কিন্তু তবু এক অদ্ধুত ভালো লাগা গ্রাস করছে আমায়।

    উত্তরমুছুন
  4. ছোটবেলার দাদু দিদার অনেক সান্নিদ্ধ মনে করিয়ে দিলেন।

    উত্তরমুছুন
  5. সমাজের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরলেন।তবে আমি আমার দিদা মানে ঠাকুমার কাছে প্রচুর গল্প শুনেছি।কি ভাল যে লাগতো আর বাবার কাছে গল্প না শুনলে ত ঘুম-ই আসতো না...
    আপনি ঠাকুমা হলে নিশ্চয়ই পারবেন নয়তো এত সুন্দর গল্পগুলো থাকবে কোথায় !
    খুব ভাল লাগলো :)

    উত্তরমুছুন
  6. সত্যি, কালের স্রোতে প্রতিদিন আমরা কত কি হারিয়ে ফেলছি, শকুন্তলা দের লেখাটি পড়ে আমার নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়, তখন আমাদের বাড়িতে বিদ্যুত ছিল না, শুধু আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে এই ভয়ে ঠাম্মা নিজে না ঘুমিয়ে আমাকে পাখার বাতাস করে যেতেন।

    উত্তরমুছুন