মহাভারতের কথা
একটি প্রান, একটি আলেখ্য
সুস্মিতা সিং
অভিশপ্ত ভাগ্যের এই চরম বিপর্যয়ের সঠিক কারণ নির্ধারন করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভবই। হঠাৎক্রোধী বিচিত্রবুদ্ধি মুনিপ্রবর দুর্বাশার আদ্ভূত বর, নাকি উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী পৃথার বালখিল্য কৌতূহলপ্রিয়তা, নাকি মহাভারতের দ্বিতীয় প্রধান Tragic Hero র ললাট লিখনই এমন ছিল? মর্মী পাঠক, ঠিকই ধরেছেন, দানবীর মহামতি কর্ণ চরিত্রই বর্তমান আখ্যানের উপজীব্য বিষয়াভিলাষ।।
মহারাজ কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা কুমারী পৃথার গূঢ়জাত প্রথমজন্মা সুর্যসম্ভবা দীপ্তিময় কানীন পুত্রসন্তান কর্ণ। দেবোপম প্রথম পুত্রের জন্মে আনন্দ উৎসব হল না, মঙ্গলশঙ্খ বাজল না, নিজের এবং বিশেষতঃ পালক পিতার সামাজিক সম্মান রক্ষার প্রবল তাড়নায় পৃথা সদ্যজাত শিশুকে ধাত্রীর সহায়তায় বেতের পেটিকায় ভাসিয়ে দিলেন অশ্বনদীর জলে। না, পৃথা কোন নামকরণও করলেন না পুত্রের। নাড়ী ছেঁড়ার চেয়ে জননীর সে যন্ত্রণা কিছু কম নয়।
ওদিকে সুদূর হস্তিনাপুরের নিকটস্থ চম্পাপুরীতে অধিরথ সূতপত্নী রাধা গঙ্গাস্নানকালে পেলেন সেই ভেসে আসা দেবতার ধন, সূর্যের মতো উজ্জ্বল দীপ্তিময়, সহজাত সুবর্ণ কবচকুণ্ডল পরিহিত দিব্য শিশুটিকে বুকে তুলে নিলেন পুত্রহীনা রমণী। তাই তিনি কৌন্তেয় নন, রাধেয়। সোনার কবচকুণ্ডল পরিহিত, তাই আধিরথ পুত্রের নামকরণ করলেন বসুষেণ – বসু, অর্থাৎ সোনা – সোনার ছেলে।
কিন্তু এমন সোনার ছেলের ভাগ্যে সারা জীবন যে এত বঞ্চনা আর প্রতারণা, অভিসম্পাত আর অপমান অপেক্ষা করে ছিল, একথা সেদিন কে অনুমান করতে পেরেছিল!!
সূতেরা বংশ পরম্পরায় রাজপুরুষদের কীর্তি স্মৃতিতে ধারণ করে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে পরিপোষক রাজার বন্দনা করতেন। এই স্তাবকতার কারণেই ক্ষত্রীয় পুরুষদের কাছে তাঁদের আত্মমর্যাদা ছিল অনেকটাই কম। সূত অধিরথ কিন্তু ছিলেন কুরুকুলপতি ধৃতরাষ্ট্রের সুহৃদ, তবুও পালক পিতার পেশার কারণেই সারাজীবন কর্ণকে স্থানে-অস্থানে সূতপুত্র সম্ভাষণে ধিক্কৃত হতে হয়েছে।
আপন বংশের সূতগ্লানি তিনি নিজে ভোগ করেছেন বলেই পুত্রকে সযত্নে ক্ষত্রীয় মর্যাদায় প্রতিপালন করতে চেয়েছেন অধিরথ; স্বয়ং কুলাধিপতি ধৃতরাষ্ট্রের আনুমোদনেই কুরু-পাণ্ডব রাজপুত্রদের সঙ্গেই অস্ত্রশিক্ষা শুরু করেন বসুষেণ কর্ণ। প্রথমে কৃপাচার্য এবং পরবর্তীকালে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা বিদ্যাভ্যাস করতে থাকেন তিনি। সবই ঠিক ছিলো, প্রবল উচ্চাভিলাষই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো এক সময়......
দ্রোণাচার্যের বিদ্যাগারে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর ছিলেন অর্জুন, কোন মতেই কর্ণ তাঁকে অতিক্রম করতে পারছিলেন না। অনন্যোপায় কর্ণ অগত্যা গুরুর কাছে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণ এবং সম্বরণ বিদ্যা শিক্ষার দাবি রাখলেন সরাসরি। অসম্ভব দূরদর্শী গুরু কর্ণের অহঙ্কারী ও প্রতিযোগী মনোভাব এবং বিশেষতঃ দুরাত্মা দুর্যোধনের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার কারণেই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। ছলনা করে কর্ণকে জানিয়ে দেন, সদাচারী ব্রাহ্মণ এবং সচ্চরিত্র ব্রতধারী ক্ষত্রীয় ছাড়া আর সকলেই ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার বিদ্যা শিক্ষার অনধিকারী।
দ্রোণের কাছে এই প্রত্যাখ্যানের জন্য কর্ণ হয়তো বা মনে মনে প্রস্তুতই ছিলেন। তাই তিনি কালক্ষেপ না করে সোজা চলে গেলেন মহেন্দ্র পর্বতে ক্ষত্রীয়-নিধন-কল্পী পরম বীর ভার্গব মুনি পরশুরামের কাছে। সেখানে নিজেকে ভার্গব বংশীয় বলে পরিচয় দিয়ে অস্ত্র শিক্ষা শুরু করলেন কর্ণ। লক্ষ্যভেদ অনুশীলনকালে
নিজের অজ্ঞাতসারেই সেখানে একদিন অকস্মাৎ এক ব্রাহ্মণের হোমধেনু নিহত হোল তাঁর নিক্ষিপ্ত বাণে। ব্রাহ্মণ অভিশাপ দিলেন, অন্তিমকালে রথচক্র মাতা মেদিনী গ্রাস করবেন।।
এহেন সময়ে, বীর্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত, সেবাপরায়ণ শিষ্যের একাগ্রতায় প্রীত হয়ে পরশুরাম কর্ণকে শিখিয়ে দিলেন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণ ও সম্বরণের নিগূঢ় কৌশল। কিন্তু বিধি বাম। শেষরক্ষা হল না। ঘটনাচক্রে গুরু জানতে পারলেন কর্ণের আসল পরিচয়!! মারণাস্ত্রলুব্ধ শিষ্যের মিথ্যাচারণে ক্ষুব্ধ গুরু অভিশাপ দিলেন, বিনাশকালে বিস্মৃত হবেন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপণের গূঢ়মন্ত্র।
মহাভারতের দুই নায়কোচিত চরিত্র, - ভীষ্ম ও কর্ণ – দুজনেই মহামতি।। পাঠক, লক্ষ্য করবেন, পরশুরামের এই দুই বীর শিষ্য সমগ্র মহাকাব্য জুড়ে যথাক্রমে ধর্ম ও অধর্মের মূর্ত প্রতীক হিসাবে প্রতিভাত হয়েছেন; অথচ আশ্চর্যের বিষয়, অষ্টাদশ পর্ব সমাপনে দুজনেই বীরোচিত সদ্গতি লাভ করেছেন সরাসরিভাবে নিজেদের কোন স্বার্থসিদ্ধির কারণে নয়। দুজনেই সমস্ত জীবন ধরে কেবলমাত্র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের গুরুভার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। জন্ম মুহূর্তে যে বঞ্চনা বসুষেণ কর্ণকে আলিঙ্গন করেছে, সারা জীবন এক মুহূ্র্তের জন্যও সে আলিঙ্গনপাশ শিথিল হয়নি একবিন্দুও.........
পরশুরামের কাছে অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা সমাপন অন্তে হস্তিনাপুরে ফিরে এসেছেন কর্ণ – রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন তখন সমুপস্থিত; তোড়জোড় প্রায় সমাপ্ত। পরবর্তী ইতিহাস সকলের জানা। মুহূর্ত কালক্ষেপ না করে দুর্যোধন চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন কর্ণকে; অন্যায়, অধর্ম জেনেও যে বন্ধন থেকে সারাজীবন নিজেকে মুক্ত করতে পারেন নি এই মহাবীর। সেই অসহায় দায়বদ্ধতার ধারাবাহিকতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে সুমহান মহাকাব্যের সুবিশাল পরিসর। বার বার বঞ্চিত, প্রতারিত, অপমানিত হতে হয়েছে অভিমানী বীর প্রথম কৌন্তেয়কে।।
মহাভারতের যে দুটি চরিত্রকে বিনাদোষে সর্বাধিক অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে, তাঁরা হলেন বসুষেণ কর্ণ এবং কৃষ্ণা দ্রৌপদী। দ্রৌপদী ন্যায়পরায়ণ, বলশালী, সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, সুদর্শণ এবং ধীমান এক স্বামী কামনা করেছিলেন। পাঠক, লক্ষ্য করুন, এই সমস্ত গুনই কি একাধারে কর্ণের মধ্যে উপস্থিত ছিল না?? যোগ্যতার দিক দিয়েও তিনি কি কোন অংশে পাণ্ডবদের থেকে হীন ছিলেন??? অথচ, একান্ত রাজনৈতিক কারণেই স্বামী নির্বাচনে কোন স্বাধীনতাই প্রকৃতপক্ষে দ্রৌপদীর ছিলনা। পঞ্চপাণ্ডবের তুলনায় কর্ণ বহুলাংশেই একতম স্বামী হিসাবে যোগ্যতর ছিলেন, একথা অনস্বীকার্য। একসময় দ্রৌপদী কৃষ্ণের কাছে কর্ণের কৌন্তেয় পরিচয় জানার পর এর জন্য আক্ষেপ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, পঞ্চপাণ্ডবকে বিবাহ না করে কর্ণকে বিবাহ করলে অন্ততঃ ভরা সভায় তাঁকে বারবনিতা নামে ধিক্কৃত হতে হত না; এই জ্যেষ্ঠ কুন্তিনন্দনই কিন্তু অজ্ঞাতবাসকালে ধর্ষনোন্মূখ বাসুকির লালসার গ্রাস থেকে উদ্ধার করেছেন যাজ্ঞসেনীকে। শ্রীকৃষ্ণের পর, তাঁর বীর পঞ্চস্বামী নন, একমাত্র কর্ণই সুরক্ষা দিয়েছেন কৃষ্ণাকে। কৃতজ্ঞ নারী পাদস্পর্শ করে প্রণাম করেছেন কর্ণকে। পরস্পর পস্পরের কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন।
দ্রৌপদী সারাজীবন অর্জুনকে ভালবেসেছেন সর্বাধিক, কিন্তু, হায়!! আর্জুন নিজ জয়লব্ধ পুরস্কার অপর চার ভ্রাতার সঙ্গে বিভক্ত করে নেওয়ায় বিশেষ খুশী হন নি। বরঞ্চ, সুভদ্রাকে পার্থ সেই কারণেই প্রচ্ছন্ন ভাবে অধিক প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারণ তিনিই ছিলেন সুভদ্রার একতম স্বামী। বিদগ্ধা রমনী দ্রৌপদীর অর্জুনের এই সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় নি। আর সেই কারণেই ক্রমে কর্ণের প্রতি পাঞ্চালীর হৃদয় তীব্র অথচ প্রচ্ছন্ন এক কোমলতায় আর্দ্র হয়ে উঠেছে; এক সময় ভরা সভায় যাঁকে ধিক্কার দিয়েছেন, তাঁকেই শ্রদ্ধার আসনে বসাতে দ্বিধা করেন নি কুরুকুললক্ষ্মী।।
শিশুকাল থেকেই জন্মের নিগূঢ় অভিমান যেন বহন করে চলেছেন বসুষেণ কর্ণ। প্রতি পলে পলে অকারণ বঞ্চনা, অবজ্ঞা ও অপমান তাঁকে করে তুলেছে অসম্ভব অভিমানী, দুর্বিনীত ও অসহিষ্ণু। সমস্ত দিক দিয়ে যোগ্যতর হওয়া সত্ত্বেও অর্জুনকে অতিক্রম করতে না পারার প্রবল অন্তর্দহন তাঁকে প্রতিহিংসা পরায়ণ করে তুলেছে। অন্যয়, অধর্ম জেনেও দুর্যোধনের সঙ্গে তিনি মিলিত হয়েছেন। জতুগৃহে পাণ্ডব নিধন প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন শকুনির সঙ্গে। কুরুকুললক্ষ্মী দ্রৌপদীকেও কুরুরাজসভায় লাঞ্ছিত করেছেন তিনি। আর এই অধর্মাচারণের অপরাধেই ভীষ্ম কর্ণকে প্রথম দশ দিন তাঁর সৈনাধিপত্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে দেন নি। ভীষ্ম কিন্তু প্রথম থেকেই জানতেন কর্ণের আসল পরচয়। তাই দশম দিন অন্তে কর্ণ যখন শরসয্যায় শায়িত দেবব্রত ভীষ্মের দর্শণপ্রার্থী হয়েছেন, তখন মহামতি ক্ষমা করে দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ কুন্তীনন্দনকে, যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন এবং সর্বোপরি, যশস্বী হওয়ার আশীর্বাদও করেছেন।
যুদ্ধের একাদশ থেকে পঞ্চদশ দিবস, এই সময়সীমার মধ্যে অঙ্গরাজ বসুষেণ কর্ণ যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, সকলকেই নিধন করার সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। কেননা, তিনি কুন্তীর কাছে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ঃ শেষ পর্যন্ত কুন্তী পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন; একমাত্র তিনি পরাস্ত্র ও নিহত করতে চেয়েছিলেন অর্জুনকে। যুদ্ধের ষষ্ঠদশ দিবসান্তে সেই কনিষ্ঠ কৌন্তেয়, তৃতীয় পাণ্ডব ধনঞ্জয় পার্থকেও তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় পেয়েছেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়ায় কর্ণ তাঁকেও ছেড়ে দিয়েছেন।
সূর্যপুত্র মহামতি কর্ণ তাঁর সৈনাধিপত্যে যুদ্ধের কোনও নিয়মই লঙ্ঘিত হতে দেননি আর। ভীষ্মের পর তিনিই একমাত্র ও একাকী বীর যোদ্ধা, যিনি একান্ত নিজস্ব কোনো জাগতিক অভীষ্ট লাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যতিরেকে অপ্রতিরোধ্য জেনেও শুধুমাত্র বীরগতি লাভের নিমিত্তই যুদ্ধ করে গেছেন।
এ হেন বীর যোদ্ধা মহামতি বসুষেণ সারা জীবন ধরে বারংবার চাতুরী ও ছলনার স্বীকার হয়েছেন। দেবাদিদেব ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাঁর সহজাত সুরক্ষা কবচকুণ্ডল হরণ করেছেন নিজপুত্র অর্জুনের সুরক্ষা ও জয় নিশিত করার জন্য। আপন জননীও তাঁকে অন্যায় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করেছেন।
দ্রোণাচার্য তাঁকে ছলনা করেছেন তাঁর কাছে শিষ্যত্ব কালে। স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁকে ইন্দ্রপ্রস্থ ও দ্রৌপদীর প্রলোভন দেখিয়েছেন। দ্রৌপদী তাঁকে অপমান করেছেন আপন স্বয়ম্বর সভায়। শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের রথে শল্যকে নিযুক্ত করেছেন গুপ্তচর হিসাবে, তাঁর মনোবল ও মনঃসংযোগ বিনষ্ট করার জন্য। কৃষ্ণ জানতেন কর্ণ অর্জুনের চেয়ে অনেক বড় ধনুর্ধর; তাই যুদ্ধের সপ্তদশ দিবসে যখন অন্তিমকাল আগত, কর্ণের রথের বাম চক্র যখন মাতা মেদিনী গ্রাস করেছেন, পার্থসারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই তখন আর এক মুহূর্তও কালক্ষেপ করতে দেননি ধনঞ্জয়কে। তিনি অর্জুনকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই কর্ণই জতুগৃহ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, তিনিই ভরা রাজ সভায় দ্রৌপদীকে অসম্মান করেছিলেন, সর্বোপরি, অন্যায় সমরে অর্জুনপুত্র কিশোর বীর অভিমন্যুকেও তিনিই নিধন করেছেন। অর্জুনও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেননি আর। অনৈতিক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন মহাকাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর.........
কর্ণ ছিলেন সেই একমাত্র বীর, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজহস্তে যাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করেছেন। সারা জীবনে কর্ণ কিছুই পাননি, যা তাঁর একান্তই প্রাপ্য ছিল। প্রথম কৌন্তেয় হিসাবে তিনিই রাজপরিবার, ইন্দ্রপ্রস্থ, দ্রৌপদী, সব কিছুরই অধিকারী ছিলেন। অসম্ভব সাহসী, বীর যোদ্ধা এবং নীতিপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও বারবার অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়েছেন ভাগ্যের অমোঘ পরিহাসে। বন্ধু তথা পরম শ্ত্রুর শ্ত্রু-র প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণে অন্যায় জেনেও তাঁকে ত্যাগ করতে পারেননি। এ যেন সমস্ত পৃথিবীর প্রতি এক প্রগাঢ় অভিমানে জীবন-বিমুখ হয়ে মরণের পানে ছুটে চলা!!!
অঙ্গরাজ কর্ণ। অঙ্গদেশ, অধুনা ভাগলপুর ও মুঙ্গের। সূর্যপুত্র বসুষেণ কর্ণ দ্বিপ্রহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সূর্যবন্দনা করতেন প্রতিদিন। আঞ্চলিক মানুষ প্রথম কৌন্তেয় সূর্যপুত্রের এই সূর্যবন্দনার ইতিহাস আজও বিস্মৃত হননি। মহাভারতীয় এই বীর যোদ্ধার উত্তরাধিকার বহন করে আজও বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যবন্দনা করেন তাঁরা, ছট্পূজো নামে যা অধিক পরিচিত।
মহাবীর কর্ণ। হতভাগ্য কর্ণ। নিজের ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য নিজের জন্মপরিচয় জানার পর থেকে মাতা কুন্তীকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারেননি। অথচ, গূঢ়তর দোষে দুষ্ট পিতা সূর্যদেবকে তিনি অর্চ্চনা করেছেন প্রতিদিন!! এক সময় কৃষ্ণের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন, সুহৃদ দুর্যোধনকে তুষ্ট করতে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদীর প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন তিনি। আর এই অকারণ পাণ্ডব বৈরীতার কারণেই কুরুকুল প্রধাণ ভীষ্মের বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি।
জ্ঞানে, গুনে, দানে, ধ্যানে শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র জন্ম ও সংস্কারের বিরুদ্ধতার কারণেই তাঁর চরিত্রে বিপরীতমুখী বিশিষ্ট উন্মেষিত হয়েছে। মহত্ত্বের সঙ্গে হীনতা, বীরত্বের সঙ্গে ভীরুতা, উদারতার সঙ্গে ক্রুরতা - কর্ণ-চরিত্রকে এক অপূর্ব বৈচিত্র দান করেছে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত, লোকসমাজে অশেষ লাঞ্ছিত, দৈবাভিশপ্ত মহাবীরের এই অসহায় বিনষ্ট পরাক্রম পাঠকের হৃদয় আর্দ্র করে তোলে। পুত্রকে জন্মদানকালে যে পাপ আদিত্যদেব করেছিলেন, তার ফলস্বরূপ অন্তিমকালে সমস্ত দৈবসহায়তা একে একে প্রত্যাহিত হয়েছে। দৈব কবচকুণ্ডল, অমোঘ দৈবশক্তি, দৈবসম্পদ সর্পবাণ, সমস্ত কিছু একে একে বিনষ্ট হয়েছে। আর অভিশপ্ত বীরের এই চরম অসহায়তাই জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয় বসুষেণকে সর্বকালীন বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ Tragic Hero করে তুলেছে।।
সুস্মিতা, বেশি কিছু বলবো না, কেবল এইটুকুই বলতে চাই যে তোমার লেখা পড়ে অনেক কিছুই নতুন করে জানছি, ভাবতে শিখছি।
উত্তরমুছুনTHNX, DS...
মুছুনwao.......... Good ...I love it
উত্তরমুছুনTHNX, RE...
মুছুনamra jara mahabharata sammondhe prai kichhui janina tader kachhe sushmita singh -er lekha besh informative
উত্তরমুছুনTHNK U, DADA
মুছুনমহাভারতের এক অন্যতম প্রধান চরিত্র কর্ণ। কর্ণ-চরিত্র বিশ্লেষণ খুব দূরুহ । সেই চেষ্টাই করেছেন সুস্মিতা এই অল্প পরিসরে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কর্ণ-কুন্তী-সংবাদে কর্ণের চরিত্রের যে দোলায়মানতা দেখিয়েছেন,সেখানে কিন্তু কর্ণকে দুর্বল দেখালেও সঠিক ভাবেই অন্যায়কারী বলে চিত্রিত করেন নি।
উত্তরমুছুনকর্ণ চিরবঞ্চিতের প্রতিভূ ! তাঁর বঞ্চনার ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কৌরবেরা সুকৌশলে তাঁকে পক্ষভুক্ত করে তাঁকে ব্যবহার করার জন্য। কর্ণ যে সে কথা বুঝতেন না,তা' নয়, কিন্তু তাঁর কাছে বিশ্বাস রক্ষার মর্য্যাদা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার চেয়েও অনেক বেশি কাঙ্খিত ছিল। এই ন্যায়নিষ্ঠতাকে আমাদের সম্ভ্রম না করে উপায় নেই ! কুন্তী তাকে ফিরিয়ে নিয়ে রাজার আসনে বসাতে চেয়েছিলেন,নিজের অন্যায়ের স্খালনে। মাতৃস্নেহবঞ্চিত কর্ণ কিছুটা দুর্বল হয়েও পড়েছিলেন,কিন্তু তিনি কৃতঘ্নতা করতে পারেন নি কৌরবদের সাথে। তিনি কুন্তীকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বহু যন্ত্রনা সহ্য করেও !
সুস্মিতা মহাভারতের চরিত্র নিয়ে আগেও লিখেছেন । তাঁর শব্দচয়ন,লেখার বাঁধুনী যথেষ্ঠ পরিণত ।
তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এই চমৎকার লেখাটি আমাদের উপহার দেবার জন্য।
DHNYOBAD, DADA
মুছুনঅনেক ভালো লিখেছেন। পড়ে ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন