আমার মল্লিকা বনে
নারায়ণ রায়
সুকমল ঘোষ, মাত্র একমাস হ’ল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন, ইতিমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। এখন মনে হয়, এর চেয়ে চাকরীতে থাকাটাই ভালো ছিল। আসলে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের ছকে বাঁধা জীবনে মানুষ এমন অভ্যস্থ হয়ে ওঠে, যে অবসরের পর পরই যেন একটা বিরাট শূন্যতা। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে একটা বয়সের পর কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়, তারা তাদের মত থাকে। সে সারাজীবন তার স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে সব সময় পাশে পাশেই পেয়েছে, এ ব্যাপারেও তার কোন ক্ষোভ নেই। একটা সময় বরং বিষ্ণুপ্রিয়ারই অভিযোগ ছিল যে, সুকমল তাকে ঠিকমত সময় দেয় না, সুকমল রসিকতা করে বলতো, ‘অবসরের পর সব সুদে আসলে মিটিয়ে দেব’। কিন্তু মাত্র এক মাসেই যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে। আর ঠিক এই সময়ে মেয়ে, মৌটুসি বলল, ‘বাবা, তুমি একটা ফেসবুক একাউন্ট খোল, দেখবে দারুন সময় কেটে যাবে, আমার প্রায় সব বন্ধুদের বাবা মায়ের ফেসবুক একাউন্ট আছে, সেদিন তনিমার মা বলছিল, ওর বাবাকে নাকি ঠেলে ঠেলে বাজার পাঠাতে হয়, এমন ফেসবুকের নেশা হয়ে গেছে’ ।
অফিসে থেকে অবসর গ্রহণের বছর দুই আগে কোম্পানী একটা পি সি দিয়ে ছিল, তবে তাতে কোন নেট কনেকশন ছিল না। শুধু চিঠি টাইপ করা, আর সেগুলোকে সেভ করে রাখা, কপি পেস্ট এই রকম সামান্য কিছুই জানে সে, তবে অফিসার হয়েও এক সময়ে টাইপের হাত খুব ভালো ছিল বলে খুব শীঘ্রই ব্যাপারটা সড়গড় হয়ে গেছিল ওর কাছে। যাইহোক, মেয়ের সাহায্যে একটা ফেসবুক একাউন্ট খোলা হ’ল, প্রথম দু এক সপ্তাহ যেতেই এবং বন্ধুর সংখ্যা একটু বাড়তেই, ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সুকমলের বেশ ভালো লেগে গেল। কত রকমের মানুষ, নারী, পুরুষ, বয়স, দূরত্ব, সব মিলে মিশে একাকার…. এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ, বেশ সুন্দর হাসি মুখের একটি প্রোফাইল পিকচার আর নেট থেকে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি ডাউনলোড করে নিজের পেজটাকে যতোটা পারলো আকর্ষনীয় করে তুললো। সুকমল সবার কাছে মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো বলেই পরিচিত হলেও বরাবরই একটু লাজুক স্বভাবের, নিজে হতে যেচে কারও সঙ্গে ঘনিষ্টতা করতে এগিয়ে যেতে পারে না, অথচ এখানে সবার সঙ্গে কত সহজেই মনের কথা খুলে চ্যাট, মানে গল্প করতে পারছে। সমবয়সী শুধু নয়, এখন কত অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরাও ওর ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হয়েছে, তাদের কেউ ওকে দাদা বলে, কেউ ওকে কাকু বলে। সে ব্যাপারটাকে ও বেশ উপভোগ করে, তাছাড়া আর একটা জিনিস ও লক্ষ্য করেছে, এখনকার ছেলে মেয়েরা সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটকের মত কলা শাস্ত্রে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল। তাছাড়া এরা কত সহজেই সবাইকে আপন করে নিয়ে কি সুন্দর প্রথম থেকেই ‘কাকু’ এবং ‘তুমি’ সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়, ওর ফ্রেন্ড লিস্টে তেমনই একজন হ’ল শতরূপা সাহা। সুকমলর ছাত্রাবস্থায় একসময়ে পাড়ার লিট্ল ম্যাগাজিনে একটু আধটু লেখার অভ্যেস ছিল, এতদিন পরে এখানে অনেককে লেখালিখি করতে দেখে মাথার পোকাটা আবার নড়ে উঠলো। যেটুকু যা পারে একটু আধটু লেখার চেষ্টা করে, ফেসবুকের একটা সবচেয়ে বড় সুবিধা কোন কিছু পোস্ট করলে ভালো খারাপ যাই হোক হাতে হাতে ফল, তবে বেশীরভাগই “বা বেশ হয়েছে” গোছের। একমাত্র শতরূপা সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, “কাকু এই জায়গাটায় তুমি ব্যাপারটা আর একটু বিস্তারিত বললে আরও ভালো হ’ত, কিম্বা কাকু অমুক জায়গায় দুম করে তুমি ওটা বলে দিলে কেন? ওখানে সাসপেন্সটা আর একটু ধরে রাখলে গল্পটা জমতো ভালো।” সুকমল পরে চিন্তা করে দেখে শতরূপা ঠিকই বলেছে, আস্তে আস্তে তার লেখার পরিমাণ বাড়তে থাকে, আর ‘লেখক’ সুকমলের একমাত্র ফ্যান শতরূপা তাকে নানা ভাবে উৎসাহ দিয়ে যায়। হ্যাঁ সত্যি, সুকমল মজা করে শতরূপাকে একথাই বলল একদিন ইনবক্সে,
“লেখক সুকমল ঘোষের একমাত্র এবং একনিষ্ঠ ফ্যান কুমারী শতরূপা সাহা, হা হা হা” আর তার উত্তরে শতরূপা জানালো “না গো কাকু আরও একজন আছে,”
সুকমল জানতে চায়, কে সে?
“আমার মা” জানায় শতরূপা,
“তোমার মায়েরও কি ফেসবুক একাউন্ট আছে নাকি?” জিগ্যেস করে সুকমল।
“না, আমিই পড়ে শোনাই কিম্বা মা কে প্রিন্ট বার করে দেই, মা ছোট গল্প পড়তে খুব ভালোবাসে, আর তোমার লেখা পড়তে নাকি মায়ের খুব ভালো লাগে”, বলে শতরূপা।
সুকমলের নিজেকে সেদিন বেশ অপরাধী বলে মনে হ’ল, এতদিন হল মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়েছে, নাইবা হল সামনা সামনি দেখা, কিন্তু কোনদিন ও মেয়েটির বাবা-মা, বাড়ি-ঘরের খবর নেয়নি। আর সেদিনই প্রথম সুকমল জানতে পারলো যে, বছর দুয়েক হ’ল শতরূপা ইতিহাস নিয়ে এম এ পাশ করেছে, টুক টাক টিউশনি করে নিজের হাত খরচাটা জোগাড় করে নেয় সে। শতরূপা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, ওর বাবা নেই, পাঁচ বছর আগে একদিন সকালে হটাৎ এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মূহুর্তের মধ্যেই সব শেষ। মা ও গত বছর দুয়েক অস্টো-আর্থাইটিসে আক্রান্ত হয়ে এক প্রকার শয্যাশায়ী। তবে আর্থিক অসুবিধা নেই, বাবা একটা উচ্চ পদে সরকারি চাকরি করতেন, বারুইপুরে একটা ছোট্ট দুই কামরার একতলা বাড়িও করে দিয়ে গেছেন, আর মা মাসে পনের হাজার টাকার মত ফ্যামিলি পেনশন পান।
এদিকে সুকমলও ফেসবুকের সঙ্গে বেশ ভালো ভাবেই জড়িয়ে পরেছে। দু তিনটে গ্রুপেরও সদস্যও হয়েছে, কেমন যেন নেশা হয়ে গেছে, সকালে কোন রকমে বাজার করে এসে টিফিন করেই বসে পরে। আবার দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু ভাত ঘুম দিয়েই আবার বসে পরে, আস্তে আস্তে বন্ধুর সংখ্যাও এখন বেড়ে প্রায় দুশো ছাড়িয়েছে। এখন আবার সেই ছাত্র বয়সের মত নিজের অন্তর থেকেই যেন কিছু একটা লেখার তাগিদ অনুভব করে। অবসর সময়ে আস্তে আস্তে তিন চার দিন ধরে লিখল একটা ছোট গল্প ‘রায়কতপাড়ার রূপকথারা’ আর পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই ভালোই সাড়া পেল। অনেকেই কমেন্টস্ দিল ‘বা! বেশ হয়েছে’ বা ‘সুন্দর লিখেছেন’ গোছের। গল্পটা আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা, জলপাইগুড়ি শহরের রায়কতপাড়ার একটা ডানপিঠে মেয়েকে নিয়ে, যে সেই সময়ে মেয়ে হয়েও গাছে উঠে আম পাড়তো, সাইকেল চালাতো, পুকুরে সাঁতার কাটতো আর ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলত। যথারীতি সবাই কমেন্টস্ও দিল, অথচ দুদিন হয়ে গেল তার ফ্যানের কোন খবর নেই কেন? মনে মনে ভাবে সুকমল। শতরূপার ফোন নাম্বার টাও নেয়নি ও কোনদিন। চারদিন পরে শতরূপাকে অনলাইনে পেয়েই জিগ্যেস করল “কি খবর রে তোর? কদিন ধরে দেখাই নেই?” ততক্ষণে অপর প্রান্ত থেকেও মেসেজ চলে এসেছে “মায়ের শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে, তাই কদিন বসতে পারিনি, তবে ডাক্তার বলেছেন, চিন্তার কিছু নেই…… একে তো শরীর খারাপ, তারপর বারবার মা তোমার লেখা ঐ গল্পটা পড়তে চাইছে, যখনই তোমার লেখাটা পড়ছে, মায়ের চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, আর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠছে। আমি আড়াল থেকে দেখি মা কাঁদছে।” সুকমল অবাক হয়ে যায়, লেখাটা তো পুরোটাই কমেডি, চোখের জল পরবে কেন? তাছাড়া সে এমন কিছু লেখক নয় যে তার লেখা কাউকে হাসাবে, কাঁদাবে বা ভাবাবে। শতরূপাকে একথা জানাতেই ওদিক থেকে আবার মেসেজ এল, “না গো কাকু, যখনই তোমার লেখাটা পড়ছে, মায়ের চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে যায়, মা বলছিল যদি ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা করা যেত… কাকু, তোমার কি একটু সময় হবে? একবার আমাদের বাড়িতে এস না, প্লিজ।” সুকমল কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না যে, তার মত একজন অতি নগন্য লেখকের লেখা এভাবে কাউকে নাড়া দিতে পরে। জীবনে এই প্রথম, এই পৃথিবীতে কেউ একজন ‘লেখক সুকমল ঘোষের’ সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। ও ঠিক করল ও অবশ্যই যাবে, ওর উপস্থিতি যদি একজন অসুস্থ মানুষকে কিছুক্ষণের জন্যও আনন্দ দেয়, তাহলেই ও নিজেকে কৃতার্থ্য মনে করবে। সেই অনুযায়ী ওরা পরস্পরের ফোন নম্বর নিয়ে নিল এবং ঠিক হ’ল আগামী রবিবার বেলা চারটের সময় শতরূপা বারুইপুর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
যথা সময়ে ডাউন প্লাটফর্মে নেমে ওভার ব্রীজ দিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে বেরোতে গিয়েই দেখলো শতরূপা কাউন্টার থেকে হাসতে হাসতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। দুজনেই দুজনের বিভিন্ন ছবি ফেসবুকে এত দেখেছে যে পরস্পরকে চিনতে সামান্য অসুবিধাও হ’ল না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা একটা রিকশায় উঠলো, যেতে যেতে একথা সেকথার মধ্যে শতরূপা বললো, “মায়ের কাছে শুনেছি মা তার ছোটবলায় একটা সময় কয়েক বছর জলপাইগুড়িতে ছিলো। তোমার গল্পে হয়তো সেই শহরটাকে মনে পড়ে যায়, আর ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে পড়তেই হয়তো তার চোখ দুটো ভিজে যায়”, সুকমল চমকে ওঠে, কিন্তু শতরূপাকে জানতে দেয় না, মনে মনে ভাবে সে নিজেও তো ছোটবেলায় একসময় জলপাইগুড়ি শহরেই ছিল। মিনিট দশেক লাগলো। শতরূপা বললো, “নামো কাকু, এই সাদা বাড়িটা”, একতলা ছোট্ট বাড়িটাতে মালিকের রুচির ছাপ স্পষ্ট । কলিং বেল বাজাতেই কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকতেই কেমন যেন মন ভালো করা পরিবেশ, খুবই পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। ড্রইংরুম পার হয়ে পরদা ঠেলে একটা ঘরে ঢুকতে গিয়ে শতরূপা বলে, “কাকু এই ঘরে এসো।” পিছন পিছন পরদা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই বিছানায় আধশোয়া এক মধ্য বয়সি ভদ্রমহিলা অসুস্থ শরীরে মুখে ম্লান হাসি এনে বললেন, “আয় বুচান…, না না ওখানে নয় এই বিছানাতেই বোস।” বু… চা… ন ? মা মারা যাওয়ার পরে এই পৃথিবীতে ওকে বুচান বলে ডাকার বা তুই বলে সম্বোধন করার তাহলে এখনও একজন আছে ?
“মল্লিকা তু…ই” শতরূপা অবাক হয়ে যায়, ওর মা’র নাম তো মল্লিকা নয়!
“তোমরা গল্প করো, আমি চা করে নিয়ে আসি” শতরূপা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
“কতদিন পরে তোকে দেখলাম, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, আসলে তোকে বুচান বলেই ডেকেছি বরাবর, তোর আসল নামটাই ভুলে গেছি, কিন্তু এই গল্পটা পড়ার পরই তোর পরিচয়টা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল”, বলে মল্লিকা।
চুপ করে সব শুনে যায় সুকমল। কত দিনের পুরনো সব কথা, অথচ এখনও সব কিছু যেন সিনেমার মতো পরিস্কার সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
“এক সময় তুই তো আমার কম চোখের জল ফেলাস নি ? তুই ভালো করেই জানিস, আমাকে সব ছেলেরাই ভয় পেতো একমাত্র, তোকেই আমি কেন জানিনা কিছু বলতে পারতাম না, তোর হাতে মার খেয়ে চোখের জল ফেলেও চুপ করে থাকতাম।”
এবার মল্লিকা বেশ জোরে হেসে বলল, “আচ্ছা আমার মল্লিকা নামটা কি করে হ’ল, তোর মনে আছে? তখনকার দিনে মেয়েরা পনের বছর বয়স হলেই শাড়ি পরতো, আমি কিন্তু তখনও ছেলেদের মতো প্যান্ট শার্ট পরে যাচ্ছি, সেবার সরস্বতী পূজোয় আমাকে শাড়ি পরতে দেখে তুই বলেছিলি .. ‘আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি’ সেই থেকে তুই আমাকে ‘আমার মল্লিকা’ বলে ডাকতিস, মনে আছে সেকথা ?”
“আজ সকালে কি দিয়ে ভাত খেয়েছি জিগ্যেস করলে বলতে পারবো না, কিন্তু সেদিন তুই তোর মা’র একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছিলি, সেকথা আজও মনে আছে”
এই সময়ে শতরূপা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে,অনেকদিন পর মাকে বেশ জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলো।
সুকমল ঘোষ, মাত্র একমাস হ’ল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন, ইতিমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। এখন মনে হয়, এর চেয়ে চাকরীতে থাকাটাই ভালো ছিল। আসলে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের ছকে বাঁধা জীবনে মানুষ এমন অভ্যস্থ হয়ে ওঠে, যে অবসরের পর পরই যেন একটা বিরাট শূন্যতা। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে একটা বয়সের পর কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়, তারা তাদের মত থাকে। সে সারাজীবন তার স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে সব সময় পাশে পাশেই পেয়েছে, এ ব্যাপারেও তার কোন ক্ষোভ নেই। একটা সময় বরং বিষ্ণুপ্রিয়ারই অভিযোগ ছিল যে, সুকমল তাকে ঠিকমত সময় দেয় না, সুকমল রসিকতা করে বলতো, ‘অবসরের পর সব সুদে আসলে মিটিয়ে দেব’। কিন্তু মাত্র এক মাসেই যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে। আর ঠিক এই সময়ে মেয়ে, মৌটুসি বলল, ‘বাবা, তুমি একটা ফেসবুক একাউন্ট খোল, দেখবে দারুন সময় কেটে যাবে, আমার প্রায় সব বন্ধুদের বাবা মায়ের ফেসবুক একাউন্ট আছে, সেদিন তনিমার মা বলছিল, ওর বাবাকে নাকি ঠেলে ঠেলে বাজার পাঠাতে হয়, এমন ফেসবুকের নেশা হয়ে গেছে’ ।
অফিসে থেকে অবসর গ্রহণের বছর দুই আগে কোম্পানী একটা পি সি দিয়ে ছিল, তবে তাতে কোন নেট কনেকশন ছিল না। শুধু চিঠি টাইপ করা, আর সেগুলোকে সেভ করে রাখা, কপি পেস্ট এই রকম সামান্য কিছুই জানে সে, তবে অফিসার হয়েও এক সময়ে টাইপের হাত খুব ভালো ছিল বলে খুব শীঘ্রই ব্যাপারটা সড়গড় হয়ে গেছিল ওর কাছে। যাইহোক, মেয়ের সাহায্যে একটা ফেসবুক একাউন্ট খোলা হ’ল, প্রথম দু এক সপ্তাহ যেতেই এবং বন্ধুর সংখ্যা একটু বাড়তেই, ব্যাপারটা আস্তে আস্তে সুকমলের বেশ ভালো লেগে গেল। কত রকমের মানুষ, নারী, পুরুষ, বয়স, দূরত্ব, সব মিলে মিশে একাকার…. এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ, বেশ সুন্দর হাসি মুখের একটি প্রোফাইল পিকচার আর নেট থেকে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি ডাউনলোড করে নিজের পেজটাকে যতোটা পারলো আকর্ষনীয় করে তুললো। সুকমল সবার কাছে মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো বলেই পরিচিত হলেও বরাবরই একটু লাজুক স্বভাবের, নিজে হতে যেচে কারও সঙ্গে ঘনিষ্টতা করতে এগিয়ে যেতে পারে না, অথচ এখানে সবার সঙ্গে কত সহজেই মনের কথা খুলে চ্যাট, মানে গল্প করতে পারছে। সমবয়সী শুধু নয়, এখন কত অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরাও ওর ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হয়েছে, তাদের কেউ ওকে দাদা বলে, কেউ ওকে কাকু বলে। সে ব্যাপারটাকে ও বেশ উপভোগ করে, তাছাড়া আর একটা জিনিস ও লক্ষ্য করেছে, এখনকার ছেলে মেয়েরা সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটকের মত কলা শাস্ত্রে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল। তাছাড়া এরা কত সহজেই সবাইকে আপন করে নিয়ে কি সুন্দর প্রথম থেকেই ‘কাকু’ এবং ‘তুমি’ সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়, ওর ফ্রেন্ড লিস্টে তেমনই একজন হ’ল শতরূপা সাহা। সুকমলর ছাত্রাবস্থায় একসময়ে পাড়ার লিট্ল ম্যাগাজিনে একটু আধটু লেখার অভ্যেস ছিল, এতদিন পরে এখানে অনেককে লেখালিখি করতে দেখে মাথার পোকাটা আবার নড়ে উঠলো। যেটুকু যা পারে একটু আধটু লেখার চেষ্টা করে, ফেসবুকের একটা সবচেয়ে বড় সুবিধা কোন কিছু পোস্ট করলে ভালো খারাপ যাই হোক হাতে হাতে ফল, তবে বেশীরভাগই “বা বেশ হয়েছে” গোছের। একমাত্র শতরূপা সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, “কাকু এই জায়গাটায় তুমি ব্যাপারটা আর একটু বিস্তারিত বললে আরও ভালো হ’ত, কিম্বা কাকু অমুক জায়গায় দুম করে তুমি ওটা বলে দিলে কেন? ওখানে সাসপেন্সটা আর একটু ধরে রাখলে গল্পটা জমতো ভালো।” সুকমল পরে চিন্তা করে দেখে শতরূপা ঠিকই বলেছে, আস্তে আস্তে তার লেখার পরিমাণ বাড়তে থাকে, আর ‘লেখক’ সুকমলের একমাত্র ফ্যান শতরূপা তাকে নানা ভাবে উৎসাহ দিয়ে যায়। হ্যাঁ সত্যি, সুকমল মজা করে শতরূপাকে একথাই বলল একদিন ইনবক্সে,
“লেখক সুকমল ঘোষের একমাত্র এবং একনিষ্ঠ ফ্যান কুমারী শতরূপা সাহা, হা হা হা” আর তার উত্তরে শতরূপা জানালো “না গো কাকু আরও একজন আছে,”
সুকমল জানতে চায়, কে সে?
“আমার মা” জানায় শতরূপা,
“তোমার মায়েরও কি ফেসবুক একাউন্ট আছে নাকি?” জিগ্যেস করে সুকমল।
“না, আমিই পড়ে শোনাই কিম্বা মা কে প্রিন্ট বার করে দেই, মা ছোট গল্প পড়তে খুব ভালোবাসে, আর তোমার লেখা পড়তে নাকি মায়ের খুব ভালো লাগে”, বলে শতরূপা।
সুকমলের নিজেকে সেদিন বেশ অপরাধী বলে মনে হ’ল, এতদিন হল মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়েছে, নাইবা হল সামনা সামনি দেখা, কিন্তু কোনদিন ও মেয়েটির বাবা-মা, বাড়ি-ঘরের খবর নেয়নি। আর সেদিনই প্রথম সুকমল জানতে পারলো যে, বছর দুয়েক হ’ল শতরূপা ইতিহাস নিয়ে এম এ পাশ করেছে, টুক টাক টিউশনি করে নিজের হাত খরচাটা জোগাড় করে নেয় সে। শতরূপা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, ওর বাবা নেই, পাঁচ বছর আগে একদিন সকালে হটাৎ এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মূহুর্তের মধ্যেই সব শেষ। মা ও গত বছর দুয়েক অস্টো-আর্থাইটিসে আক্রান্ত হয়ে এক প্রকার শয্যাশায়ী। তবে আর্থিক অসুবিধা নেই, বাবা একটা উচ্চ পদে সরকারি চাকরি করতেন, বারুইপুরে একটা ছোট্ট দুই কামরার একতলা বাড়িও করে দিয়ে গেছেন, আর মা মাসে পনের হাজার টাকার মত ফ্যামিলি পেনশন পান।
এদিকে সুকমলও ফেসবুকের সঙ্গে বেশ ভালো ভাবেই জড়িয়ে পরেছে। দু তিনটে গ্রুপেরও সদস্যও হয়েছে, কেমন যেন নেশা হয়ে গেছে, সকালে কোন রকমে বাজার করে এসে টিফিন করেই বসে পরে। আবার দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু ভাত ঘুম দিয়েই আবার বসে পরে, আস্তে আস্তে বন্ধুর সংখ্যাও এখন বেড়ে প্রায় দুশো ছাড়িয়েছে। এখন আবার সেই ছাত্র বয়সের মত নিজের অন্তর থেকেই যেন কিছু একটা লেখার তাগিদ অনুভব করে। অবসর সময়ে আস্তে আস্তে তিন চার দিন ধরে লিখল একটা ছোট গল্প ‘রায়কতপাড়ার রূপকথারা’ আর পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই ভালোই সাড়া পেল। অনেকেই কমেন্টস্ দিল ‘বা! বেশ হয়েছে’ বা ‘সুন্দর লিখেছেন’ গোছের। গল্পটা আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা, জলপাইগুড়ি শহরের রায়কতপাড়ার একটা ডানপিঠে মেয়েকে নিয়ে, যে সেই সময়ে মেয়ে হয়েও গাছে উঠে আম পাড়তো, সাইকেল চালাতো, পুকুরে সাঁতার কাটতো আর ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলত। যথারীতি সবাই কমেন্টস্ও দিল, অথচ দুদিন হয়ে গেল তার ফ্যানের কোন খবর নেই কেন? মনে মনে ভাবে সুকমল। শতরূপার ফোন নাম্বার টাও নেয়নি ও কোনদিন। চারদিন পরে শতরূপাকে অনলাইনে পেয়েই জিগ্যেস করল “কি খবর রে তোর? কদিন ধরে দেখাই নেই?” ততক্ষণে অপর প্রান্ত থেকেও মেসেজ চলে এসেছে “মায়ের শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে, তাই কদিন বসতে পারিনি, তবে ডাক্তার বলেছেন, চিন্তার কিছু নেই…… একে তো শরীর খারাপ, তারপর বারবার মা তোমার লেখা ঐ গল্পটা পড়তে চাইছে, যখনই তোমার লেখাটা পড়ছে, মায়ের চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, আর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠছে। আমি আড়াল থেকে দেখি মা কাঁদছে।” সুকমল অবাক হয়ে যায়, লেখাটা তো পুরোটাই কমেডি, চোখের জল পরবে কেন? তাছাড়া সে এমন কিছু লেখক নয় যে তার লেখা কাউকে হাসাবে, কাঁদাবে বা ভাবাবে। শতরূপাকে একথা জানাতেই ওদিক থেকে আবার মেসেজ এল, “না গো কাকু, যখনই তোমার লেখাটা পড়ছে, মায়ের চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে যায়, মা বলছিল যদি ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা করা যেত… কাকু, তোমার কি একটু সময় হবে? একবার আমাদের বাড়িতে এস না, প্লিজ।” সুকমল কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না যে, তার মত একজন অতি নগন্য লেখকের লেখা এভাবে কাউকে নাড়া দিতে পরে। জীবনে এই প্রথম, এই পৃথিবীতে কেউ একজন ‘লেখক সুকমল ঘোষের’ সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। ও ঠিক করল ও অবশ্যই যাবে, ওর উপস্থিতি যদি একজন অসুস্থ মানুষকে কিছুক্ষণের জন্যও আনন্দ দেয়, তাহলেই ও নিজেকে কৃতার্থ্য মনে করবে। সেই অনুযায়ী ওরা পরস্পরের ফোন নম্বর নিয়ে নিল এবং ঠিক হ’ল আগামী রবিবার বেলা চারটের সময় শতরূপা বারুইপুর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
যথা সময়ে ডাউন প্লাটফর্মে নেমে ওভার ব্রীজ দিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্ম দিয়ে বেরোতে গিয়েই দেখলো শতরূপা কাউন্টার থেকে হাসতে হাসতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। দুজনেই দুজনের বিভিন্ন ছবি ফেসবুকে এত দেখেছে যে পরস্পরকে চিনতে সামান্য অসুবিধাও হ’ল না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা একটা রিকশায় উঠলো, যেতে যেতে একথা সেকথার মধ্যে শতরূপা বললো, “মায়ের কাছে শুনেছি মা তার ছোটবলায় একটা সময় কয়েক বছর জলপাইগুড়িতে ছিলো। তোমার গল্পে হয়তো সেই শহরটাকে মনে পড়ে যায়, আর ছোটবেলার সেই স্মৃতি মনে পড়তেই হয়তো তার চোখ দুটো ভিজে যায়”, সুকমল চমকে ওঠে, কিন্তু শতরূপাকে জানতে দেয় না, মনে মনে ভাবে সে নিজেও তো ছোটবেলায় একসময় জলপাইগুড়ি শহরেই ছিল। মিনিট দশেক লাগলো। শতরূপা বললো, “নামো কাকু, এই সাদা বাড়িটা”, একতলা ছোট্ট বাড়িটাতে মালিকের রুচির ছাপ স্পষ্ট । কলিং বেল বাজাতেই কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকতেই কেমন যেন মন ভালো করা পরিবেশ, খুবই পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর ভাবে সাজানো। ড্রইংরুম পার হয়ে পরদা ঠেলে একটা ঘরে ঢুকতে গিয়ে শতরূপা বলে, “কাকু এই ঘরে এসো।” পিছন পিছন পরদা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই বিছানায় আধশোয়া এক মধ্য বয়সি ভদ্রমহিলা অসুস্থ শরীরে মুখে ম্লান হাসি এনে বললেন, “আয় বুচান…, না না ওখানে নয় এই বিছানাতেই বোস।” বু… চা… ন ? মা মারা যাওয়ার পরে এই পৃথিবীতে ওকে বুচান বলে ডাকার বা তুই বলে সম্বোধন করার তাহলে এখনও একজন আছে ?
“মল্লিকা তু…ই” শতরূপা অবাক হয়ে যায়, ওর মা’র নাম তো মল্লিকা নয়!
“তোমরা গল্প করো, আমি চা করে নিয়ে আসি” শতরূপা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
“কতদিন পরে তোকে দেখলাম, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, আসলে তোকে বুচান বলেই ডেকেছি বরাবর, তোর আসল নামটাই ভুলে গেছি, কিন্তু এই গল্পটা পড়ার পরই তোর পরিচয়টা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল”, বলে মল্লিকা।
চুপ করে সব শুনে যায় সুকমল। কত দিনের পুরনো সব কথা, অথচ এখনও সব কিছু যেন সিনেমার মতো পরিস্কার সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
“এক সময় তুই তো আমার কম চোখের জল ফেলাস নি ? তুই ভালো করেই জানিস, আমাকে সব ছেলেরাই ভয় পেতো একমাত্র, তোকেই আমি কেন জানিনা কিছু বলতে পারতাম না, তোর হাতে মার খেয়ে চোখের জল ফেলেও চুপ করে থাকতাম।”
এবার মল্লিকা বেশ জোরে হেসে বলল, “আচ্ছা আমার মল্লিকা নামটা কি করে হ’ল, তোর মনে আছে? তখনকার দিনে মেয়েরা পনের বছর বয়স হলেই শাড়ি পরতো, আমি কিন্তু তখনও ছেলেদের মতো প্যান্ট শার্ট পরে যাচ্ছি, সেবার সরস্বতী পূজোয় আমাকে শাড়ি পরতে দেখে তুই বলেছিলি .. ‘আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি’ সেই থেকে তুই আমাকে ‘আমার মল্লিকা’ বলে ডাকতিস, মনে আছে সেকথা ?”
“আজ সকালে কি দিয়ে ভাত খেয়েছি জিগ্যেস করলে বলতে পারবো না, কিন্তু সেদিন তুই তোর মা’র একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছিলি, সেকথা আজও মনে আছে”
এই সময়ে শতরূপা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে,অনেকদিন পর মাকে বেশ জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলো।
Onek Onek din por Chokhe Jol chole elo...Idaning kichu musthimeyo manusher jonyo FB onek opobad koracche......Sekhane ei golpo ti chokhe angul die dekhie day je Duti Manusher ruchibodh-er mil thakle tara eke oporer porom bondhu hoe uthte pare FB te....
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনএকটি সার্থক ছোটগল্প কি হতে হয়,তা' আবার মনে করালো নারায়ন রায়ের ছোটগল্প 'আমার মল্লিকা বনে' ! ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে নেওয়া কিছু ঘটনাকে সাজিয়েছেন তিনি তাঁর এই লেখাটিতে অসাধারন নৈপুণ্যে । ভাষার সাবলীলতা,পরিমিতি-বোধ, সম্পর্কের মানবিক অনুভূতির যে পরিণতি ও চমক তিনি তাঁর লেখায় দেখালেন,তা' আশ্চর্য্য করার মত ! মুগ্ধ হলাম একটি সার্থক ছোটগল্প তাঁর কলমের থেকে উপহার পেয়ে।
উত্তরমুছুনশেষটুকু পড়ে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম।
উত্তরমুছুন“আজ সকালে কি দিয়ে ভাত খেয়েছি জিগ্যেস করলে বলতে পারবো না, কিন্তু সেদিন তুই তোর মা’র একটা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছিলি, সেকথা আজও মনে আছে” ......... এই লাইনের প্রত্যেকটা শব্দ সোজা মনে গেঁথে গ্যালো।
নারায়নদার লেখা ছোট গল্প আর ছোট গল্প রইল না, অনেক বড়, অনেক বিশাল হয়ে গ্যালো।
Debashis da amake baddo wrini kore dilen..
উত্তরমুছুন