বিশেষ রচনা - দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

আয় মরি
দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত



কি বল্লি? রবিঠাকুর? শনিঠাকুরের ছোটো ভাই? কবে র‍্যা পুজোটা? অ্যাঁ? দেড়শ বছরের পুরনো ঠাকুর, দারুন ফুর্তি না পূর্তি হবে! সেই লোভে ছুট্টে এলুম, আ মরি কি জ্বালালি মাইরি! আসল পব্লেম হল এই হাসপাতালগুলোতে আমরা বড়োঠাকুরকে পূজি না, অপদেবতা বলে মুখ ঘুরাই। তাই এত দুগগতি! সবকটা হাসপাতাল কিষনোঠাকুরের নয়, শনিরমন্দির হবে, পোণামীর থালা উপচাবে শ'গুন। দেখবি বিপদ স-ব দূর! তা না রব্যেঠাকুর!

বেসমেন্টে গ্যাস রেখেছি? বে---স করেছি। আমার গ্যাস আমার গভভে। তোদের কি? সে দু একবার আগুন লাগতেই পারে, এত চিল্লামিল্লি করার কি আছে রে মদনা? কিসের দমকল? ফোট। আমার ছেলে ইতিহাস পড়ছিলো, সুনিসনি? পানিপথের যুদ্ধ, সন ১৫২৬। মাইরি, দমকলের যন্তরগুলোও ঐ সময়কার! এরা পানিপথের যুদ্ধে জিতবে? হাসালি বাওয়া! এদিকে যে কেলো! বদনাম হবে না? হাসপাতালে আগুন। দুদিক পুড়বে। ভিতর বাইর। তার থেকে চুপ মেরে যা। আয় রে শ্যামলা, মালপত্তর সামলা। মনে নেই, সোদপুরের পোশাকের দোকান? দোকান জ্বলছিল দাউদাউ, ভিতরের পাব্লিক হাঁউমাউ। মালিক ঠিক টাইমলি মাল সরাচ্ছিলো। দামী দামী জিনিস! বেনারসী, স্যুট, শাল। মোটে তেরোটা টেঁসেছিলো। মরুক গে। ওঃ সব খাস্তা মাল! সস্তায় কেনা যায়। জীয়ন্তে কি মরন্তে!

পাব্লিক হলো গে উদোম ভোঁদড়। মরণও কেনে গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে। দেখছিস নিওন আলোয় জ্বলজ্বল করে লাশপাতালগুলো ডাকছে আয় মরি! গাধাগুলো তবু লাখ লাখ খসাচ্ছে। সালারা মরবিই যদি সরকারি হাসপাতালে যেতে পারতিস। বেড নেই? মেঝেতে সুতিস। পাসাপাসি হেঁপো টিবি রুগির সাথে। মাঝরাতে বউ ভেবে ভুল করে চুমু খেলেই হল। যক্ষ্মার জীবাণু তোকে আস্টেপিষ্টে ভালোবাসবে। এটা কেউ খেয়াল করলি না, কত সান্তিতে মরল বলত রুগীগুলো? জ্বালা নেই, পোড়া নেই। স্টিফেন হাউসের উপর থেকে যখন হুদো হুদো জ্বলন্ত মানষেগুলো টপাটপ নীচে পড়ছিলো তখন ভদ্দরলোকগুলোর কি তড়পানি! কোনও শালা একটা চাদর নিয়ে এসেও কি আদর করে ওদের রেসকিউ করেছে? আহা, টিভিতে রিয়েলিটি শো। কলকাতা সার্কাস। ভেনুঃ পার্ক স্ট্রীট। মেনুঃ মানুষপকোড়া। দ্যাখ দ্যাখ আরেকটা পড়লো। মরেছে? ইসসসস..........জেমিনি সার্কাসেও এমন দেখায়নি রে। কেলেংকারী! হবে না? জায়গাটা দ্যাখ- পার্ক স্ট্রীট। যীশুভক্তের ছড়াছড়ি। শণিঠাকুরকে কে পোঁছে! হাতে হাতে ফল, দেখলি গুরু?

অ্যাই শূয়োর গোন। গোন। দ্যাক, ক'টা নড়ছে না, চড়ছে না-একদম পাথর। নে মিলা। টীক দে। মড়া নাম্বার ওয়ান। ছোঁড় এদিকে। ফ্যাল। ডাম্প কর। হেব্বি হয়েছে। আরে উল্লুক, মড়া জমাতে পাল্লি না-পাইভেট হাসপাতালে কাজ করতে এয়েছ? ইন্টারভুতে পাস করলি কি করে মামদো ভুত? উপরে দুটো নার্স কি আকাম করছে! এর মধ্যে কেউ কারও প্রান বাঁচায়? এই নার্স দুটো ঠিক ফুটে যাবে দেখিস। একানব্বুই, বিরানব্বুই ........লাশ, কত হল? আরে লাইসেন্স বাতিলের কথা ছাড় ননসেন্স। ও তো গ্রহের ফের। বড়োঠাকুর চটেছে। সিন্নি চড়াতে হবে। পাব্লিক? দুদিন বাদেই ভুলে যাবে। বড়ো জোর বিরানব্বুই দিন। মড়াপিছু একদিন করেই ধল্লাম। কুতকুতে চোখ নাচিয়ে সব্দজব্দ করবে। নয়তো টিভিতে মীরাক্কেল।

অ্যাই ক্কে, কে রে-কার এত বুকের পাটা, আমি থাকতেও মড়া শুঁকতে ডাক্তার ডাকছিস? ডাক্তার কে বে লাইফ ডেথ এর! আমি যেমন রেগে লাটাই নাড়ি, ডাক্তার তেমনি বেগে সুতো ছাড়ে। এ কি সরকারী হাসপাতালের মুখ্যু মাল পেয়েছো বাওয়া, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার! তুলো নেই, গজ নেই, স্পিরিট নেই; জনগণের দুমাদ্দুম ঘুষি খেয়েও রক্তাক্ত স্পিরিটেড অবস্থায় তবু কাজ করছে!

ওরে, ধর ধর ধর। এইযে ব্যাটা সাংবাদিক, এই মরণধোঁয়া গিলতে গিলতে উপরে উঠছো কেন বাপ, তোমাদের কি পেরাণের মায়া নেই? কী-ই বল্লি মরা শিশু? নাঃ নাঃ শিশু তো আমাদের যীশু! কোনও শিশুর কিচ্ছুটি হয়নি। অ্যাই কে কোথায় আছিস, ক্যালাতে পারছিস না ইডিয়টগুলোকে? ভাঙ্‌, ভাঙ্‌, ক্যামেরাগুলো। এর মধ্যে জুটেছে আবার হনুমান রাইটস। মুখপোড়াগুলোর কি খটোমটো কতা! ইউথেনেশিয়া-মানে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে ওরা তো খুব লাফঝাঁপ করে; আরে গাড়োল, আগুন লাগলো বোলে তাই তো পেলি মুফতে। কতো ক্যান্সার রুগী তো স্বেচ্ছামৃত্যু চেয়েছিলো। কেমো নিয়ে ধুঁকছিলো, খালাস করলুম। ভর্তি আছে এমন রুগীর জন্য কতো পার্টী জমিজমা বন্ধক দিয়েছিলো, ফুৎকারে সৎকার করলুম। এগুলো মানবাধিকার নয়?

ফ্যাকড়া বাঁধলো পিছনের বস্তির জন্য। জীবনেও শুধরালো না এগুলো। বংশ পরম্পরায় সব খাঁটি জানোয়ার। নয়তো নিজের জীবন তুচ্ছ করে কি কেউ অন্যের জীবন বাঁচায়? মানুষ তো মানুষের জন্য নয়, এ কথাটা সবাই জানে। আচ্ছা শোন, এখন অনেক কাজ বাকি। ১) যত্ত ভুলভাল গেম খেলেছি সব ডিলিট করা। ২) সুইস ব্যাঙ্ক উপুড় কোরে সব লেভেলের মুখে লেবেল সাঁটা। ৩) মিডিয়াকে ম্যানেজ করা। বড্ডো বেশী রবরবাচ্ছে।

আ রে রে, এই, এই! আধমরাগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস কেন, এই গবেট ডাক্তার? আজকের কাগজে তোদের হেব্বি গালিটা দিয়েছে-'খেপখাটা মৌনকর্মী'। কি বল্লি, তোরা ক'জন খেপ খাটিস না? উঃ, এই তোদের মতো সংখ্যালঘুগুলোর সংরক্ষণ করেই পৃথিবীটার বারোটা বাজাল ঐ হিপোক্রিটাস লোকটা। আচ্ছা, বলত, শপথ কেউ করে না রাখে?

তবে যতই চিল্লাস, আগুন নিভবে না। দমকল, সরকার, সাংবাদিক, ডাক্তার-কেউ কিসসুটি করতে পারবে না। আসল হল চাঁদির জোর। চাঁদি দিয়ে চাঁদও কেনা যায়। এ তো একটা শহর। তাছাড়া মানুষ মারার এই ব্যবসা আমাদের বহু পুরনো। সুধু ভুল হয়ে গেছে, ডোম রিক্রুট করা হয়নি। এবারে ভুল সুধরে নেব। তা'লে কেল্লা ফতে। পিজির মর্গেও রেফার করতে হবে না। আয়, মরি; স্বর্গে, থুড়ি মর্গে। ডিরেক্ট অ্যাডমিশন। উলটে পাঁচলাখের সিকিউরিটি ডিপোজিট! জয়, শনিবাবা কী জয়! আগুনটা শুক্কুরবারের বদলে শনিবারে লাগলে আমরি নিয়ে কোনও কামড়াকামড়ি হতো না। পুরো চেপ্পে দেওয়া যেতো। কোন ব্যাটা নামাজে আল্লাকে ডেকেছিলো --শুক্কুরবারে কেস জন্ডিস হল রে আমাদের।


৯ ই ডিসেম্বর ২০১১, ভয়াবহ বিধ্বংসী আগুনে আমরি হাসপাতালের দুর্ঘটনা স্মরণে ……………………..


8 মতামত:

  1. দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত, কুর্নিশ জানলাম... এতো সহজ, সরল আর সাবলীলতায় গোটা লেখাটায় সুতীব্র ব্যাঙ্গ আর শ্লেষ জড়িয়ে আছে তা সত্যি মন ছুঁয়ে গ্যালো।

    উত্তরমুছুন
  2. Mam Dolonchampa................lakho kuris.apnar ei lekhatir janyo.....no word is enough....Chilekothar webjin er ekti sompod ei lekhati.........roo likhun ......

    উত্তরমুছুন
  3. dolonchampa-r lekhar akta swakiyota achhe... tibro slesher chabuk mere samajer andhokar dik take tule dhara.... darun... khub bhalo laglo

    উত্তরমুছুন
  4. dolonchampa-r lekhar akta swakiyota achhe... tibro slesher chabuk mere samajer andhokar dik take tule dhara.... darun... khub bhalo laglo

    উত্তরমুছুন
  5. apnar lekha sob somoy chittakarsok... rosikatar moroke somajer andhokar dik take tule dhara... khub bhalo laglo.

    উত্তরমুছুন
  6. এই মন বেঁচে থাক, এ'কলম দীর্ঘজীবি হোক
    আমাদের ইচ্ছেগুলো মুছে দিক সময়ের শোক

    উত্তরমুছুন