সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা



সম্পাদকের কলম থেকে



বন্ধুরা,

আবার বেরোল আমাদের প্রিয় চিলেকোঠার দ্বিতীয় সংখ্যা।

চেষ্টা করেছি আগের বারের চেয়ে ভুল কম করতে, কিন্তু মানুষের কাজ মাত্রই ভুল ত্রুটি হবে। সেটা সকলে ক্ষমা করে নেবেন।

এবারের সংখ্যায় গল্পের পরিমাণ সামান্য হলেও বেশী, থাকছে ইন্দিরা দাসের গল্প, শ্রীশুভ্রর গল্প ও অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প। সঙ্গে থাকছে অগুন্তি সদস্যের কবিতা ।

আমাদের দুটি বিশেষ বিভাগ, নির্দিষ্ট মাসে খ্যাতনামা ব্যাক্তির জন্ম-মৃত্যু ও মহাভারতের কথা এবারেও থাকছে আপনাদের জন্য, যাতে লিখেছেন গৌরি বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুস্মিতা সিং।

রম্যরচনা বিভাগে এবারে লিখেছেন শকুন্তলা দে, তার সঙ্গে থাকছে একটি বিশেষ প্রবন্ধ, যা তুলে ধরেছে ইতিহাস হয়ে যাওয়া টেলিগ্রামের জন্ম-মৃত্যু, বিস্তার...

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, রান্নাঘর বিভাগে কোন লেখা না আসায়, এবারে ঐ বিভাগটি আমাদের বন্ধ রাখতে হল।

ছোটদের পাতায় এবারেও সকলের মন ভরিয়েছেন ঈশিতা লাহা।

চিলেকোঠার দুটি পাখা, একটি মুখবই এর পাতা, অপরটি এই ব্লগজিন। চিলেকোঠার উড়ান যেন আদিগন্ত হয়—এর দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের, পাঠকদের, সদস্যদের...

আশা করব আপনাদের মূল্যবান মতামতে আগেরবারের মতই আমাদের পথচলা মসৃণ ও সুগম্য হবে।


ধন্যবাদ

চিলেকোঠার সম্পাদক মন্ডলীর পক্ষ থেকে

প্রবন্ধ - বৈজয়ন্ত রাহা



টরে টক্কা টরে টক্কা টক্কা টক্কা টরে টরে
বৈজয়ন্ত রাহা



আজ থেকে একশ’ বছর আগেও বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম আসলে হয় ঘরের লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত, নয়, হৃৎস্পন্দন ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেত; একশ’ কেন ১৯৯২ সালের আগে পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে এই দৃশ্য কিছু বিরল ছিলনা। দূর কার্গিল থেকে যুদ্ধরত জওয়ানের তরুণী বধূ অপেক্ষা করে বসে থাকত স্বামীর ফেরার খবর নিয়ে পিয়নের হাত ধরে আসবে টেলিগ্রাম, অথবা বৃদ্ধ বাবার কাছে বয়ে নিয়ে আসবে কোন অমোঘ সংবাদ, যা থেকে ধ্বসে যাবে ভবিষ্যতের সমস্ত আশা ও স্বপ্ন...



১৬৩ বছরের সেই অবিসংবাদিত যোগাযোগ ব্যবস্থা আজ আর নেই, ১৫ ই জুলাই, ২০১৩, প্রায় নিঃশব্দেই তার মৃত্যু ঘটল-- শুধু এইটুকু প্রতিশ্রুতি রেখে , শেষদিনের শেষ টেলিগ্রামের একটা মর্যাদাপূর্ণ বাসস্থান হবে --- মিউজিয়াম। এ ঘটনা ঘটল কেন--এই বিশ্লেষণে যদি যাই, তবে দেখতে পাব, ১৯৯২ সালে সারা বিশ্ব জুড়ে প্রযুক্তি জগতে এক অসাধারণ বিবর্তন দেখা দিয়েছিল, দুনিয়া এসে গিয়েছিল মানুষের হাতের মুঠোয় , মানুষ দেখতে পেয়েছিল ইন্টারনেটের প্রযুক্তি। মানুষ শিখতে শুরু করেছিল, ই-মেইল, মানুষ শিখে ফেলছিল দূরভাষ যন্ত্রের দূরতম ব্যবহার, এস টি ডি , আই এস ডি, শিখে ফেলছিল মুঠোফোনের প্রয়োগ, এস এম এস এর মাধ্যমে প্রত্যন্ত প্রদেশেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যোগাযোগ করার কৌশল। এই মুহূর্তে নব্বই লক্ষ মানুষের হাতে মুঠোফোন আর বারো কোটি মানুষ গ্রামে ও শহরে ব্যবহার করছে আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের সুবিধা, যে পরিসংখ্যান প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাই, যেমন ধীরে ধীরে পোস্টকার্ডের ব্যবহার সাধারণ মানুষ ভুলতে বসেছে, ঠিক তেমনি সময়ের অমোঘ নিয়মে টেলিগ্রাম পাঠানোর প্রয়োজনও মানুষ ভুলে যেতে শুরু করেছিল।



ভারতীয় সূচনা



১৮৫০ সালে শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক ভাবে হুগলি নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে, কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবার , এর প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন উইলিইয়াম ও’শঘনেসি সাহেব যার দূরত্ব ছিল মাত্র সাড়ে তের’ কিলোমিটার। উনি ছিলেন একজন সার্জেন ও আবিষ্কারক। ব্যবহারের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টেলিগ্রাফ ব্যবস্থাকে ভারতবাসীর হাতে তুলে দেয় ১৮৫৪ সালে, কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের মতো বৃহৎ দেশে যা প্রমাণিত হল দ্রুততম যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে।





যদিও শঘনেসি সাহেবের এই আবিষ্কারের ছ’ বছর আগেই ওয়াশিংটন ডি সি তে পৃথিবীর প্রথম টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেখিয়েছিলেন স্যামুয়েল এফ বি মোর্স সাহেব। কিন্তু শঘনেসি সাহেব সে খবর জানতেননা, তিনি একেবারে ভিন্ন সংকেতে বৈদ্যুতিক সিগনাল এর মাধ্যমে খবরটি পাঠান ডায়মন্ডহারবারে। ভারতের গভর্নর লর্ড ডালহৌসি সঙ্গে সঙ্গে এর ক্ষমতা অনুধাবন করে শঘনেসি সাহেবকে অনুমতি দেন একটি ২৭ মাইল লাইন তৈরি করতে। ১৮৫৬ সালে, সমগ্র ব্রিটিশ রাজ জুড়ে ৪০০০ মাইল লম্বা টেলিগ্রাফ লাইনের সূচনা হল পরিকল্পিতভাবে। কলকাতা, আগ্রা, বম্বে, পেশোয়ার ও মাদ্রাজ সংযুক্ত করে এক দীর্ঘ টেলিগ্রাফ লাইন তৈরি হল, আর তার ফসল হিসেবে আমরা দেখলাম, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ কে কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রিটিশ শক্তি অনায়াসে দমন করল। একটি মাত্র ভারতীয় সেনানী কে তারা ধরল, আর টেলিগ্রামের সেই বাক্যটিকে তারা প্রচার করল, “There is the accursed string that strangles us”.



সামাজিক গুরুত্ব

ক্রমশঃই বিভিন্ন ভাবে এর ব্যবহার মানুষকে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল করে তুলল। আমরা যদি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটি, তাহলে দেখতে পাব, চরমপন্থী বিপ্লবীরা ইংরেজদের আক্রমণ করার আগে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথমেই কেটে দিত টেলিগ্রাম লাইন, যাতে ব্রিটিশরা অন্য প্রান্তে যোগাযোগ করতে না পারে; মনে করুন মাষ্টারদা সুর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, আগের রাতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তার বাহিনী নিয়ে প্রথমেই চারিদিকের টেলিগ্রাম লাইন উৎখাত করলেন, মনে করুন রাসবিহারি বসুর বুড়িবালামের প্রস্তুতি, তিনি প্রথমেই নির্দেশ দিচ্ছেন টেলিগ্রাম তার কেটে ফেলার...ভারত শাসন করার জন্য ব্রিটিশরা, কি প্রবল ভাবে নির্ভর করত এই যোগাযোগ মাধ্যমটিকে, যা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, তারা আংশিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ত। সেইসময় কারোর বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছলে তিনবার নমস্কার করে সেই টেলিগ্রাম খুলতেন বাড়ির মানুষ, যেন কোন দৈববার্তা এসেছে। সেনাবাহিনীর কর্মীরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটি বাড়ানোর জন্য, স্থানান্তরণের জন্য বা কর্মে যোগদানের জন্য দ্রুততম পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করতেন টেলিগ্রাম প্রেরণ। উকিলরা টেলিগ্রামকে ব্যবহার করতেন ভারতীয় প্রমাণ আইনে গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে, এমনকি আমরা বহু পুরোন বাংলা সিনেমায় দেখি, কাহিনীতে আচমকা মোড় ঘোরাবার জন্য টেলিগ্রামকে ব্যবহার করতে।



আদি ইতিহাস


টেলিগ্রাফ শব্দটি উদ্ভূত Telegraphein থেকে, Tele শব্দটির অর্থ হল ‘দূর থেকে’, আর graphein শব্দটির অর্থ হল ‘লিখিত বক্তব্য’। এটি এমন একটি পদ্ধতি যাতে, নির্দিষ্ট একটি সাংকেতিক ভাষায় বক্তব্য পাঠান হয়, যা প্রেরক ও প্রাপক দুজনেই জানে। এখানে প্রেরক ও প্রাপক হল দূর দুই বিন্দুতে বসান দুটি যন্ত্র। বক্তব্য পাঠানর মাধ্যমটি এখানে গুরুত্ত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে , ধূম্র-সংকেত, বীকন , বা বিচ্ছুরিত আলোকবর্তিকা কে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হত। ‘ফ্ল্যাগ সিমাফোর’ ও ব্যবহৃত হত। কিন্তু ঊনিশ শতকে, বৈদ্যুতিক সিগনালের মাধ্যমে সংকেত পাঠান শুরু হল, যা প্রকৃতপক্ষে বহু বহু মাইল দূর অবধি পাঠান সম্ভব ছিল। ১৭৯২ সাল থেকে ইওরোপে, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা, সিমাফোর লাইনের মাধ্যমে বা ‘অপটিকাল’ টেলিগ্রাফের মাধ্যমে কাজ করত। টেলিগ্রাফ শব্দটির উদ্ভাবক ক্লড স্যাঁপে, ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে তিনি সিমাফোর লাইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটিকে চালু করেন যা ১৮৪৬ অবধি সমগ্র ইওরোপে বহাল ছিল, যা নেপোলিয়ন কে অত্যন্ত সাহায্য করেছিল ইওরোপ ও আমেরিকা বিজয়ে। পেনিনসুলার যুদ্ধে (১৮০৭-১৮১৪) অ্যাংলো-পর্তুগীজ বাহিনী একি রকম ব্যবস্থা প্রবর্তন করে টরেস-ভেদ্রাস লাইনের মাধ্যমে। ১৮৩০ সালে প্রুশিয়ান ব্যবস্থা চালু হয়। এগুলি সবই আসলে সিমাফোর লাইনের বিভিন্ন প্রয়োগ । সিমাফোরের সাহায্যে বক্তব্য অনেক সংক্ষিপ্ত ভাবে , অনেক দ্রুতগতিতে , অনেকখানি অঞ্চলজুড়ে পাঠান সম্ভব হত, আর কোন জ্বালানীও লাগতনা। কিন্তু ধুম্র সংকেত বা বীকন বা বিচ্ছুরিত আলোকবর্তিকার মতই এক্ষেত্রেও অনুকূল আবহাওয়া ও দিনের আলোর উপর নির্ভর করতে হত। সিমাফোর বা অপ্টিকাল ব্যবস্থার জন্য, প্রতি ৩০ কিলোমিটার অন্তর অন্তর টাওয়ারের ও কর্মীর প্রয়োজন হত, এবং প্রতি মিনিটে দুটি শব্দের বেশী পাঠান সম্ভব হতনা। ফলে, তা অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ হত। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত সুইডেনে এই ব্যবস্থা চালু ছিল।


বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ আসায় খরচ ৩০ গুন কমে গেল, এর মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা বার্তা প্রেরণ করা সম্ভব হল ধারাবাহিকভাবে। ফলে পূর্ববর্তী প্রযুক্তিব্যবস্থা ধীরে অন্তরালে চলে গেল।


মোর্স টেলিগ্রাফঃ





আমেরিকায়, ১৮৩৭ সালে সম্পুর্ণ মৌলিকভাবে শ্যামুয়েল মোর্স আবিষ্কার করেন বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ। ওনার সহকারি, আলফ্রেড ভ্যালি তৈরি করেন মোর্স কোড বা মোর্স সংকেত। প্রথম টেলিগ্রাফ , আমেরিকায় ১১ই জানুয়ারী ১৮৩৮ সালে পাঠান হল। ৩ কিলোমিটার দূরত্ত্বে। পরে, ২৪শে মে’, ১৮৪৪, ওয়াশিংটনের ওল্ড সুপ্রীম কোর্ট চেম্বার থেকে বাল্টিমোরের মাউন্ট ক্লেয়ার ডিপোতে মোর্স পাঠালেন এই বার্তাটি ঃ “WHAT HATH GOD WROUGHT”। সফল ভাবে প্রাপক তার বক্তব্যটি গ্রহণ করা মাত্রই বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফের যুগ সূচিত হল। মোর্স/ভ্যালি টেলিগ্রাফ পরবর্তী কয়েক দশকে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ অবধি ক্রমাগতই টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে নানান দেশে, multiplexing, frequency-division-multiplexing, telegraphese ইত্যাদি প্রযুক্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে ইওরোপ আমেরিকা ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ছোট বড় সব দেশেই উন্নততর যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে থাকে।

কালের অবশ্যম্ভাবী নিয়মে, নতুন প্রযুক্তির সাথে সাথে, পুরোনর বিদায় ঘটে। গত দুদশকে, বিভিন্ন দেশ থেকে আস্তে আস্তে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা বিদায় নিয়েছে, বিশেষতঃ ব্যবসায়িক মাধ্যম হিসেবে। ইংল্যান্ডে প্রাইভেট কোম্পানী এটা পরিচালনা করে, তাও শুধু greetings card আর নিমন্ত্রণ পত্র পাঠানর জন্য। আমেরিকায় ২০০৬ সালেই টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। তবে সারা পৃথিবীর দেশ গুলির মধ্যে, রাশিয়া, কানাডা ও জার্মানীতে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার এখনও প্রচলিত।



উপসংহার ও কিছু প্রশ্ন



“কিছু কিছু গ্রামীন ক্ষেত্রে মানুষ আজও যদিও এই পরিষেবাটি ব্যবহার করে তবুও ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিবিদ্যা আর নতুনতর মাধ্যমের কথা মাথায় রেখে টেলিগ্রাম প্রযুক্তিকে অবলুপ্ত করা হল”, বললেন বি এস এন এল এর সি এম ডি, আর কে উপাধ্যায়, “the service will not be available from 15th July”. টেলিকম ও আইটি মন্ত্রী কপিল সিবাই বললেন, “We will bid it a very warm farewell and may be the last telegram sent should be a museum piece. That's the way in which we can bid it a warm farewell”। একজন আধিকারিক জানালেন, “এখন আমরা ৫০০০ টেলিগ্রাম প্রতিদিন পাঠিয়ে থাকি, ফ্যাক্স মেসিন আসার আগে যা দৈনিক ১০০০০০ ছিল”। কেন্দ্র পরিচালিত টেলিকম সংস্থা BSNL এর তথ্য অনুসারে টেলিগ্রাম প্রযুক্তিকে প্রত্যাহৃত করার কারণ, লাভের ঘাটতি ও ক্ষতির পরিমাণ ক্রমশঃই বাড়ছে। এর থেকে বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ ৭৫ লক্ষ টাকা, আর এই ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য ব্যয় এর পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালের মে’ মাসে ৬০ বছর পর, অন্তুর্দেশীয় টেলিগ্রামের শব্দহার বাড়ানো হয়, প্রতি ৫০ শব্দের জন্য ২৭ টাকা, যাতে আয়ের পরিমাণ কিছুটা হলেও বাড়ে, কিন্তু তাও নাকি সামাল দেওয়া গেল না; সারাভারতে ৭৫ টি টেলিগ্রাফ অফিসে কর্মরত প্রায় ১০০০ কর্মচারী কে BSNL সংস্থা, তাই, মোবাইল পরিষেবা, দূরভাষ পরিষেবা ও ব্রডব্যান্ড পরিষেবায় অন্তর্নিযুক্ত করে কর্মীরোষ থেকে বাঁচলেন, কিন্তু যে অর্থে ‘পরিষেবা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সেই শব্দটি নিরর্থক হয়ে রইল...আর কেন রইল , তার জবাব দেবার কেউ রইল না। বহু বহু দেশে, যেমন জার্মানি, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইজ্রায়েল, মেক্সিকো, সুইডেন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি , কোরিয়াতে, যদি “heritage service” সরকার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রক্ষা করে, ও ব্যবহারের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, ভারতবর্ষে কেন সেটা হবে না--এর উত্তর কে দেবে?


ছোটগল্প - শ্রীশুভ্র

হারজিৎ
শ্রীশুভ্র



এই শহরে বদলি হয়ে আসার পর আলাপ হলো অফিসের বড়বাবুর সাথে! ওনার সাথে আলাপটা ধীরে ধীরে বেশ জমে উঠল! ওনার অন্তঃকরণটা বেশ নির্মল! অফিসের কুটিল রাজনীতির বাইরেই থেকে গিয়েছেন বুঝলাম! আশ্চর্যও লাগল খুব! ক্ষমতা আছে বলতে হয়! দেখলাম চারিদিকের স্বার্থপরতার বেড়াজালের মধ্যে ভদ্রলোকের সাথে দু-দণ্ড কথা বলে একটা নির্মল তৃপ্তি পাওয়া যায়! নতুন জায়গায় বিদেশ বিভুঁইয়ে এরকম মানুষের সঙ্গ ভরসা জোগায়! বন্ধুত্ব জমে উঠতেই সেই খাতিরে অনেকদিন ধরেই ওনার বাড়িতে একদিন বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছিলেন! শহরের অন্য প্রান্তে বেশ নাকি একটা ছোটো বাড়ি বানিয়েছেন! দেশের বাড়িও বেশি দূরে নয়! জমি জমাও কিছু আছে!

যাব যাব করেও শেষ পর্য্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি! নিজেরই তাগিদের অভাব! আসলে বড়োই কুঁড়ে মানুষ আমি! অফিস আর বাসার বাইরে আর কোথাও বিশেষ যাওয়া হয়ে ওঠে না! তারপর একলা মানুষের পক্ষে সময়ের অভাবটাও একটা অন্যতম অজুহাত! যদিও বুঝতে পারি আমার প্রতি ওনারও একটা আন্তরিক টান জন্মেছে! এটাই হয়ত হয়! মনের নিভৃতে আমরা প্রত্যেকেই নির্মল বন্ধুত্বের আকাঙ্খা বয়ে বেড়াই! তাই যার সাথে মনের খানিকটা মেলে, তাকে কাছে টানতে চাই আন্তরিক ভাবেই! যাই হোক গত কদিন ধরেই ভদ্রলোক প্রায় একরকম জোর করেই ওনার বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য আমায় বলে রেখেছিলেন! অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেড়ানো গেল! ওনার স্কুটারেই প্রায় আধঘণ্টা লাগল ওনার বাড়ি পৌঁছাতে!

শহরের একেবারে উল্টো দিকে রেল লাইন পেড়িয়ে ওনাদের অঞ্চল! পাড়াটি বেশ অভিজাত বলেই মনে হল! সাজানো গোছানো ডিজাইনার বাড়িগুলি দেখলেই বাসিন্দাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা পরিস্কার বোঝা যায়! পীচ রাস্তা ছেড়ে বেশ চওড়া কংক্রিটের বাঁধানো গলি ধরে এগোলেই ডান দিকে খান তিনেক বাড়ি পড়েই ওনার আবাস! উচুঁ পাঁচিল ঘেরা চওড়া গেট! গেটের দুধারে ব্যুগোনভিলার ঝাড়! প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যায়! বেশ বাংলো ধাঁচের, গোলাপী রঙের বাড়ি! ছোট্ট কিন্তু নয়নাভিরাম! বাড়ির সামনে বাঁধানো চত্বরের দুই ধারে নানান ধরনের হরেক রঙের মরশুমি ফুল! খুবই মনোরম পরিবেশ! শ্যামলিমায় ঘেরা একটুখানি বাসা! পিছনের দিকে ছোটো একটা সবজী বাগানও আছে!

বল্লাম --বাঃ খুবই সুন্দর । খুব ভালো লাগছে এসে! আপনার রুচিরও প্রশংসা করতে হয়! সুন্দর একটা শান্তিকুঞ্জ তৈরী করেছেন!

-বলছেন তাহলে? মুখে একটা অনাবিল হাসি ফুটিয়ে বল্লেন রমেনবাবু, এসব পরিকল্পনা আমার মাথায় আসত নাকি? সব প্ল্যান যা দেখছেন সব আমার স্ত্রীর! আরে মশাই আমি চিরকালই আগোছালো মানুষ! বিয়ের পর ওর হাতে পড়ে এখন তো অনেক ভদ্রস্থ হয়েছি! আমি শুধু উপার্জন করেই খালাস তার পর সব ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত পরম নিশ্চিন্ত আছি মশাই! বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন নতুন অফিসের বড়বাবু রমেন্দ্রনাথ মিত্র!
রমেনবাবুর প্রাণখোলা হাসিতে আমার অনেকদিনের পুরানো চাপা দীর্ঘশ্বাসটা হঠাৎই বেrরোতে গিয়েও যেন আবার চাপা পড়ে গেল!

সত্যিই তো এমন পরিপূর্ণ জীবন মানুষকে এত প্রাণবন্ত করে তুলবেই! রমেনবাবুর প্রাণখোলা নির্মল অন্তঃকরণের পেছনে তবে নারীর প্রেরণা ও সাহচর্যের সচেতন যত্ন বর্তমান! আমরা বারান্দায় উঠতেই ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসে রমেনবাবুর কন্যা বোধহয় রোজকার অভ্যাস মতোই এক লাফে বাবার কোলে উঠে পড়ল! সদ্য ফোটা একটা ফুল যেন! ফুটফুটে পরীর মতন রূপ! কতই বা আর বয়স হবে! বড়জোড় চার কি পাঁচ! চোখে মুখে রমেনবাবুর মতোই প্রফুল্লতা! এই সাজানো সুন্দর বাড়ি, রমেনবাবুর মতো অমায়িক মানুষ, এই কচি কিশলয় শিশু তার একরাশ আনন্দ নিয়ে; যেন বিভিন্ন যন্ত্রীর হাতে একটাই আনন্দের মঙ্গলধ্বনি মুর্ত্ত হয়ে উঠেছে!

মেয়েকে আদর করে কোল থেকে নামিয়ে মাকে ডাকতে বলতেই রমেনবাবুর শিশুকন্যা মিষ্টি কচি কণ্ঠে - মা দেখো বাপি এসেছে বলেই ভেতরে একছুট! রমেনবাবুও আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন! যে ঘরটায় ঢুকলাম স্বভাবতঃই সেটি বসার ঘর! খুব বড় নয়! ঘরটা ছোটোই, কিন্তু এমন সুন্দর করে সাজানো যে একবার ঢুকলে আর চট করে বেরোতে ইচ্ছে করবে না! অফিস থেকে এতটা পথ এসে এইরকম একটা ঘরে আসলে ক্লান্তি উপশম হতেই হবে!
-আপনার বাড়িটা কিন্তু বড়ই ভালো লেগে গেল! ঘরে বাইরে সর্বত্রই সুন্দর একটা শান্তি বিরাজ করছে!
আমার প্রশংসার উত্তরে উনি আবার সেই তৃপ্তির হাসিটা হাসলেন; -যা দেখছেন সব কৃতিত্ব কিন্তু ওরই! বুঝলাম ভদ্রলোক স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসেন!

-সত্যি আপনার সৌভাগ্যে কিন্তু ঈর্ষা হওয়া উচিত! মজা করে হাসতে হাসতে বল্লাম বটে, কিন্তু মনের অতলে যে দীর্ঘশ্বাসটা চাপা পড়ল তার পরিসরে যে সামান্যও ঈর্ষার বাষ্প ছিল না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না!
-আরে মশাই সেটাই তো আমার গর্ব!
বলেই আবার প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠলেন! হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাত মুখ ধোবেন নাকি? জলটলের কিন্তু কোনো অভাব নাই!
অসম্মতি জানিয়ে বল্লাম বাড়ি ফিরে একবারে চান করে নেব ওটাই আমার বরাবরের অভ্যাস!
-আরে সেটাতো এখানেই সেরে নিতে পারেন!
ওনাকে কোনোক্রমে নিরস্ত করি! কিন্তু ভদ্রলোকের এই নিপাট আন্তরিকতায় ওঁর এই আলোকিত মনের পরিসরে সত্যিই একটা আত্মিক টান অনুভব করতে থাকলাম!

-ওঃ ওই তো ও এসে গেছে, এসো আলাপ করিয়ে দিই!
ভদ্রলোকের এই নির্মল শুদ্ধ অন্তঃকরণের সানন্দ প্রভায় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম বোধহয়! সম্বিত ফিরল ওঁর কণ্ঠস্বরে! আর তখনই ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ফেরাতেই প্রচণ্ড চমকে উঠলাম!
-যুথী তুমি?
আমার অজান্তেই যেন মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল যুথিকার নামটা!
এবার অবাক হওয়ার পালা রমেনবাবুর!
ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে একবার আমার দিকে আর একবার যুথিকার দিকে চাইতে থাকেন!
ওদিকে যুথীও স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে!
এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে যে, যাকে এক কথায় বলা যায় হতবাক হয়ে যাওয়া!
আমারও অবস্থা তথৈবচ!
যুথী? এতদিন বাদে! এভাবে আমাদের দেখা হয়ে যাবে আবার, সে কথা কি অন্তর্যামীও জানতেন? মনে হয় না!

প্রায় একমিনিটের স্তম্ভিত নীরবতা ভাঙল রমেনবাবুরই প্রশ্নে! ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে তিনি বিস্মিত হয়েই আমায় জিজ্ঞাসা করেন,
-কি ব্যাপার বলুনতো আপনি ওকে চেনেন নাকি?
চিনি যে সে তো আমার মুখে যুথীর নাম শুনেই বোঝার কথা! বিস্মিত রমেনবাবুকে ঘাড় নেড়েই আশ্বস্ত করি!
নিজের স্ত্রীর কাছেও ভদ্রলোক জানতে চান একই কথা!
যুথিকা কিছু বলল না!
ওর সেই বিখ্যাত ঠোঁট চাপা হাসিতে বাঁ গালে সামান্য টোল পড়ল!
এটাই ওর স্বভাব! অধিক আনন্দ উত্তেজনায় ও কোনোদিনো বেশি কথা বলে না! ঐ হাসিই ওর ট্রেডমার্ক! বুঝলাম এতদিন বাদে এভাবে আচমকা আমায় দেখে ও ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত! কিন্তু যারা ওকে জানে না তার টেরও পাবে না! রমেনবাবু নিশ্চয় বুঝেছেন!

এবার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা রমেনবাবুর! তাঁর বিস্ময় বাড়ল বই কমলো না!
তিনি একবার আমার দিকে আর একবার যুথিকার দিকে তাকান! যুথীই তখন রমেনবাবুকে বলল,
-আগে বলবে তো?
- আগে বলবো? কি আগে বলব?
-কি আবার, তুমি যে ওকে আনবে সে কথা বলোনি তো? সামান্য হেসে উত্তর দেয় যুথিকা!
-হ্যাঁ সে তো তোমায় বলেই গিয়েছিলাম! রমেনবাবুর সোজো উত্তর!
-অফিসের এক নতুন কলিগ বেড়াতে আসবেন, এর বেশি কিছু বলেছিলে নাকি?
অনেকটাই সপ্রতিভ হয়ে ওঠে যুথী! এও ওর মস্তবড়ো গুণ! যে কোনো পরিস্থিতিকে সহজে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে!
বুঝলাম রমেনবাবু এখনও অথৈজলে! ওনাকে ধরে পাশে বসাই! যুথিকাও সমনের সোফায় এসে বসে!মুখে সেই বাঁ গালে আলতো টোল পড়া হাসি!

রমেনবাবুর একরাশ বিস্ময় মাখা বড়ো বড়ো চোখদুটির দিকে তাকিয়ে, আমি যে কে সেটা বলতে গিয়েও সামলিয়ে নিলাম! যুথীর দিকে তাকালাম! রমেনবাবুকে এতদিন অন্ধকারে রেখেছে কিনা সেটা না জেনে...
আমার সাথে চোখাচোখি হতেই, আমার মনের কথা পড়ে নিতে দেরি হয় না যুথিকার! হেসে রমেনবাবুকে দেখিয়ে বলল, -ও সব জানে!
-কি? কি জানি?
রমেনবাবুর অবস্থার অবশ্য তাতে তারতম্য হয় না কোনো!
বললাম, আপনার সাথে বিবাহটা যুথিকার যে দ্বিতীয় বিবাহ সেটা জানেন তো?
-হ্যাঁ জানব না কেন? কিন্তু তাতে কি হয়েছে? রমেনবাবু পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাকেই!
বুঝলাম, রমেনবাবু যুথীর ঠিক উল্টো এই ব্যাপারে!
ওঁর চিন্তাশক্তি জট পাকিয়ে গিয়েছে! সহজ কথাটাও ধরতে পারছেন না সহজে!

সাতটি বছর আগে আমার কষা অংকটার ধুলো পড়া স্মৃতি ঝেড়ে নিজেকে সহজ
রেখেই বলি, না কিছু হয়নি, তবে ঘটনাটা হল আমিই সেই....
মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন আপনিই? ওর প্রথম....?
ওনাকে আশ্বস্ত করতে মুখের কষ্টকল্পিত হাসিটাকে আরও একটু চওড়া করি!
হঠাৎই উনি আমাদের চমকে দিয়ে হো হো করে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে ওঠেন! দু হাতে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে আনন্দের আতিশয্য কোনোক্রমে চেপে বলে ওঠেন, আরে সেকথা তো আগে বলতে হয়? তার মানে আমি আপনার ব্রাদার ইন ল? আমরা এত কাছের আত্মীয়! অথচ এত কাছে থেকেও দূরে রয়ে গিয়েছি! কি আশ্চর্য!

ওঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্তি পেয়ে দেখি শিশুর মত আপন আনন্দে উনি বিভোর! সারা মুখে অনিন্দ্য সুন্দর এক স্বর্গীয় আভা ফুঠে উঠেছে! আশ্চার্য্য লাগল এই যুগেও, সমাজ সংসারে মানুষ নিজেকে এমন নির্মল রাখতে পারে কি করে? এই ভাবে যুথীর সাথে এরকম আচমকা দেখা হয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে আনন্দের না বেদনার, কতটা স্বস্তির আর কতটা অস্বস্তির সেসব অনুভবেরও সময় পাওয়া গেল না রমেনবাবুর এই আনন্দ লহরীতে! বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভদ্রলোকের প্রভায় সত্যিই কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম! নিজেকে কেমন যেন অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল! যুথীকে বল্লাম, তুমি ভাগ্যবতী ওঁর মতো মানুষ খুঁজে পেয়েছ!

-না না অমন কথা বলবেন না, প্রতিবাদ করে উঠলেন রমেনবাবু; আমারই সাতজন্মের পূন্য যে ওকে পেয়েছি!
সাত বছর আগের আমার কষা অংকটা যে কত বড় ভুল ছিল, সেটা নিজের অজান্তেই আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিলেন উনি! যে গ্লানিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ার কথা, আমায় পেয়ে ওনার আনন্দের জোয়ারে তা জানান দেওয়ার সুযোগটুকুও পেল না!
যুথীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম দৃষ্টি ওর আমার দিকেই নিবদ্ধ! মুখে যেন যুদ্ধ জয়ের দৃপ্ত দীপ্তি ওর ঠোঁট চাপা হাসিতে আলোকিত! বুঝলাম সাত বছর আগের বাজিটায় জেতার জয়টা ও বেশ উপভোগ করছে!

ছোটগল্প - ইন্দিরা দাশ

অন্তর আলোক
ইন্দিরা দাশ



কমলজেঠু আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির সাথে জড়িত। বাবার ওপার বাংলার বন্ধু কমলজেঠু। দেশভাগের পর দুইবন্ধুই পাশাপাশি পথ চলে সহ্য করেছে উদ্বাস্তু জীবনের খাঁখাঁ গ্রীষ্ম দুপুরের দিশেহারা সময়, তারপর তিলতিল করে কাদামাটিতে যেভাবে শেকড় জমায় গাছ, তেমনি করে জীবন-চাকরি-সংসার-সন্তান লালন-পালন। বাবা চলে গেছেন ওপারের পথ ধরে বছরখানেক হোল। শেষ দেখা কমলজেঠুর সাথে বাবারই শ্রাদ্ধশান্তির সময়। প্রবাসে থাকি, রুজি রোজগারের তাগিদে। প্রবাস মানে সাগরপারের ঝাঁ-চকচকে বিদেশ নয়, লখনউ শহরের চাকরির জায়গা। সরকারি চাকরি তাই বেতনের দুশ্চিন্তা পীড়ন কম করে, তবে গাড়ি-বাড়ীর উচ্চাশাও বিশেষ জ্বালায় না। তাই ফাইলপত্তরের ফাঁকে ফাঁকে অল্পবয়েসের বদভ্যাস, লেখার নেশা বছর চারেক ধরে চাগার দিয়ে উঠেছিল, কিছু কবিতার চটি বইএর পর ঠিক করেছিলাম জয়-মা বলে গল্প-উপন্যাসের অথৈপারাবারে ডুব দিয়েই দেখি, প্রকাশ হোল সে যথা সময়ে।

সেবার বর্ষাটা বিশেষ জমল না। কিন্তু অদ্ভুত নিয়মে আকাশে মেঘের দলের রূপবদল হয়ে গেল শুরু, ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা ভেড়ার পাল নীল আকাশের মধ্যে মনে করিয়ে দিল যে শরৎ আসছে। পৈত্রিক সম্পত্তির কিছু দেখাশোনার করতে যেতে হোল কলকাতা অল্পদিনের জন্য। নতুন উপন্যাসের বইটি আর একটি কবিতার বই সুটকেসে ঢুকিয়ে নিলাম কমলজেঠুকে দেখাব বলে। তার কারণ দুটো। ভদ্রলোকের এক সময়ে বেশ একটি প্রেস ছিল, আর ছিল এক পৃথিবী ভালবাসা দাড়িবুড়োর কবিতা গানের জন্য। ছোটবেলায় কখনও ওনাদের বাড়ি গেলে আমায় নিয়ে সাইকেলে সামনে বসিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। একটু মফঃস্বলে মধ্যমগ্রামে বাড়ি ছিল ওনাদের। জেঠিমা যতই চেঁচাতেন – ‘আরে ছেলেটাকে নাওয়া খাওয়া করতে দেবে তো’। কমলজেঠু আর আমি ততক্ষণে মাঠ পেরিয়ে, নীলদীঘির পাশ কাটিয়ে সাঁ-সাঁ ভোকাট্টা ঘুড়ির মত মহানন্দে চলমান। সাইকেলের গতির সাথে সাথে কমলজেঠুর গলা ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও ...’।

কলকাতার কাজকর্ম মিটিয়ে যেদিন কমলজেঠুর বাড়ি গেলাম, তখন দুপুর পেরিয়ে প্রায় বিকেল। দরজা খুলল নবীনদা ... জেঠুর বড় ছেলে। ওপরতলায় জেঠুর ঘরে যেতে যেতে জানলাম, ছোট ছেলে প্রবীণের চাকরীস্থল কুচবিহার। নীচের তলাটিতে দোকানঘর নবীনদাই চালায়। বয়স হলেও কমলজেঠু খুব বৃদ্ধ হননি। লম্বা মানুষটি খালি গায়ে পাজামা পরে তক্তপোশে বসে আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – আমার কাজ, বাড়ি, সংসার, সরমা, বাবলি-বুকাইদের কথা। আর হোল স্মৃতিচারণ ... বাবার সাথে ভাতের মাড় চুরি ঘুড়ির মাঞ্জার জন্য, টাঙ্গাইলের চারাবাড়ির চমচম, বিন্দুবাসিনী স্কুলজীবন আর উপড়ে ফেলা শিকড় নিয়ে যুবক বয়েসের জীবিকার সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, তারপর দুই বন্ধুর দুটি সংসারের ধীরে ধীরে ডালপালা মেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।

সময় পেরিয়ে যায়। জেঠুর হাতে আমার বইদুটো দিয়ে বললাম তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা। অনেক যত্নে কভারএ, পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে গন্ধ শুঁকলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রিন্টিং কেমন লাগছে?’ খুশিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘চমৎকার,

যেমন পরিস্কার হরফ, তেমনি কাগজ, কভার আর্টও তোফা’! জেঠিমা কি কারণে মাথায় কাপড়টা আর একটু টেনে উঠে পড়লেন কে জানে? নবীনদা বলে উঠল, ‘সন্ধ্যের ট্রেনের জন্য সাড়ে পাঁচটার লোকালটাই ভাল রে সন্তু – এরপর ভিড় হয়ে যায়’। জেঠুর থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে দেরী হোল না যে বই পড়ে নিশ্চয়ই জানাবেন মতামত। প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম, সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিলেন কমলজেঠু হাসিমুখে – একবার বললেন, ‘মনে আছে রে সন্তু সেই লাইন ক’খানা তুই আর আমি যে গাইতাম “আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও”’। খুশি হয়ে দু কলি গেয়েও উঠলাম জেঠুর সাথে।

তারপর রওনা। নীচে এসে রিক্সায় ওঠার আগে নবীনদা কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বাবা গতবছর ছানির অপারেশনের পর আর চোখে দেখেনারে সন্তু’। আকাশ থেকে পড়লাম আমি। তার মানে সমস্তটাই স্নেহের অভিনয়! অথচ মুখময় অনাবিল হাসির অভাব তো দেখলাম না। বরং আমিই প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাটা, পে কমিশন, অত্যন্ত স্বল্প ইঙ্ক্রিমেন্ট, মূল্যবৃদ্ধি, বাবলির জন্য পাত্রের খোঁজ, বুকাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স না পাওয়া নিয়ে সাতকাহন গেয়ে এলাম।

রিক্সা ঢিমে তেতালায় রওনা দিল স্টেশনের পথে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কমলজেঠু হাসিমুখে কাকে যেন হাত নাড়তে থাকলেন। তার মুখের রেখাচিত্রে যেন শুনতে পেলাম অদ্ভুত মনোবলে, সদানন্দ মানুষটি তখনও গাইছেন, গেয়ে শোনাচ্ছেন, ‘নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও ... মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও’।

ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

সৎ মা
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



- হয়, খুব হয় । বিকাশ একটু মুখ ভার করে বলল, তোমাকে বিয়ে করলুম আর একটু সুখ দিতে পারব না ? আমার প্রস্তাবটা তোমার অপছন্দ কিসের ?

উত্তরটা মিনতির ঠোঁটের কাছে এসেও বেরোচ্ছিল না । কয়েকবার ঠোঁটটাই শুধু কাঁপল । বিকাশ বলল, বুঝেছি । আমি দোজবরে বলে ? তা একটিও তো পয়সা খরচ করতে হয় নি তোমার বাবাকে । আমি কি একটা ফেলনা বর ? আমার তো কত পণ নেবার কথা । বল, দাবী করেছি সে সব কোনদিন তোমার বাবার কাছে ? নেহাত এতবড় একটা ছেলের ঝক্কি বইতে হবে তাই --

শেষ কথাটা বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলল সে ।

মিনতি শুধু কাঁদছিল । বিকাশ বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ ? কিচ্ছু চিন্তার নেই ডিয়ার। তাছাড়া ধর না, রমলার তো আরও একটা ছেলে হতে পারত । তাহলে আমার দুই ছেলেই তো আমার মানুষ হত । আজ রমলা নেই তাই --

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার বলল, তাই তো রমলার জায়গায় তোমাকে বসিয়েছি । তোমার নিজের একটা জিনিস তুমি চাও না ? অবাক করলে ।

সৌম্য স্কুল থেকে ফিরল । ধপাস করে ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে টেবিলের ওপর রেখেই মায়ের কোলে বসে পড়ল । মাকে খুব ভালবাসে সে । মায়ের জন্যে তার কত গরব হয় মাঝে মাঝে । তার মা যেমন এমন মা আর কারোর নেই । সকলকে বুক ফুলিয়ে বলে সে ।

ইস্কুল থেকে বা সন্ধ্যায় খেলার মাঠ থেকে ফিরতে দেরি হলে বাড়ী ফিরে মায়ের মুখে বেশ একটা দুশ্চিন্তার ছাপ তার নজরে পড়ে । প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে শিখেছে আর তাই দেরির কৈফিয়ত সে আগাম দিয়ে দেয় ।

- জানিস, আমার মা আমার বাড়ী পৌঁছতে দেরি হলে শুধু বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে সারাক্ষন । একদিন গিয়ে দেখি মশা একেবারে ছেঁকে ধরেছে । ফুলিয়ে দিয়েছে সারা গা ।

বন্ধুর দল হেসে ফেটে পড়ে । - মা ? মা কিরে ? মা কাকে বলছিস ? ও তো তোর সৎ মা ।

সৎ মা কথাটার মানে জানে সৌম্য । মা নয় কিন্তু মায়ের মত । শুনেছে কিছু বাবা নাকি দুবার করে বিয়ে করে । তাই সেই ছেলেদের দুটো করে মা হয় । একটা আসল মা আর একটা সৎ মা ।

কিন্তু তার মাকে তার সৎ মা কেন বলে তাই তো বুঝতে পারে না সে । প্রথম থেকেই সে দেখছে মা তার একটাই । তবে আবার সৎ মাটা আসবে কেমন করে ?

অর্ক হল সৌম্যর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মানে বেস্ট ফ্রেন্ড । মাঝে মাঝে তার বাড়ীতে যায় সৌম্য । তার বাবা তাকে বেশ ভালবাসে । অনেক গল্প করে । একদিন তিনি বললেন, তোমার এখনকার মা তোমাকে ঠিকঠাক ভালবাসে তো ? ঠিক প্রথম মায়ের মত ভালবাসে তো ?

অর্ক কেমন ঘাবড়ে গিয়ে কিছুই উত্তর দিতে পারল না । তার মনে একটা প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খেতে থাকে প্রথম মা টা কি জিনিস ? তার তো একটাই মা ?

অর্কর বাবা জানাল তার বাবার সেই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ।

- বাচ্চা ছেলে ছিলি তুই । এমন সময় তোর মা মানে আগেকার মা - মানে তোর আসল মা আর কি - মারা যায় । তোর বাবা বিয়ে করে আনল তোর নতুন মা কে মানে এই মিনতিকে । কি আর করতে পারে বল তোর বাবা । বেচারি ।

সৌম্যর নিজেকে হঠাত খুব বোকা বোকা মনে হতে লাগল । আর আশপাশের সকলকে খুব চালাক । সে একটা জিনিস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না । সে তো একটা মাকেই দেখছে চিরকাল । তাহলে সেই আর একটা মা এলো কোথা থেকে ?

বেশ কিছুদিন এমনি করেই চলল । সৌম্যর মনটা ক্রমে যেন খুব ভারি হতে থাকে । কিন্তু কেন এই ভারবোধ সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ।

সৌম্য বিকেলে ইস্কুল থেকে বাড়ী ফেরে নি । বিকেল তার দৈনন্দিন কাজের ভার সন্ধ্যার হাতে দিয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রামে গেল । কিন্তু মিনতি নিশ্চিন্ত হতে পারছে কই ? বিষণ্ণ রাতও এক সময় ঢাকনা খুলে সকাল হল ।

বাইরে শোরগোল । প্রচুর লোক । তারা সব ক্ষোভে ফুঁসছে । সৌম্যকে নাকি খুন করা হয়েছে । অমন ভাল ছেলেকে খুন ? কে করল ? কে আবার এই ডাইনিটা আবার কে ? সবাই মিনতির বাড়ীর সামনে জড় হল । গ্রিলে টুং টাং আওয়াজ করেই চলল । মিনতি বেরিয়ে এল চিন্তাচ্ছন্ন মুখে ।

- এই ডাইনিটা খুন করেছে অমন দুধের ছেলেটাকে । মার মার -

সবাই ইট পাটকেল ছুঁড়তে লাগল মিনতিকে লক্ষ করে । মিনতি শুধু কেঁদেই চলেছে ।

এমন সময় জীপের শব্দ । থানার দারোগা সাহেব এসেছেন । নামলেন তিনি । পেছন পেছন কনস্টেবলের হাতে হাতকড়া পরান তিনজন । দুজন গুণ্ডার সঙ্গে একই দড়িতে বাঁধা বিকাশও।

- কে ডাইনী ? দারোগা সাহেব ব্যাঙ্গের সঙ্গে বললেন জনতাকে, যে মেয়েটা তার সৎ ছেলেকে খুনের হাত থেকে বাঁচাল সে ? ছি ছি ! মনে রাখবেন এটা গ্রাম নয় শহর । আপনাদের এমন বুদ্ধির বহরের জন্যেই গ্রামে গঞ্জে ডাইনী করা হচ্ছে আজও কত নিরীহ মেয়েদের । এই একবিংশ শতকেও । লজ্জা করে না ?

গম্ভীর আওয়াজখানা বুলেটের কাজ করল । যেন শূন্যে একটা ফাঁকা গুলি ছোঁড়া হল ।

এবার শান্ত জনতা আসল ঘটনায় মন দেয় । দারোগা সাহেব বলছিলেন আসল গল্পটা । মিনতিকে বিয়ে করেছিল বিকাশ সৌম্যকে মানুষ করার জন্যে এটা ঠিক । কিন্তু ভালবাসার বহরটা বেশী করে বইল নতুন বৌ মিনতির খাতেই । আর ভাল করে ভালবাসতে গেলে আর একটা বাচ্চাকে তো আনতেই হয় নাকি ? কিন্তু মিনতি কিছুতেই নিজের ছেলে নিতে চাইছে না । আসলে সৌম্যর ভালবাসা তাকে একটা অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল । তাই তার ভালবাসা আর ভাগ হোক তা চায় নি সে ।

অসহায় বিকাশ প্ল্যান ছকে নিয়েছিল । সৌম্যকে সরানোর প্ল্যান । বিকাশ জানে মিনতি তাকে সমর্থন করবে না । তাই তাকেও সতর্ক করেছিল, সাবধান মিনতি । আমার পথে কাঁটা হয়ে এলে তোমার গলাটা নামিয়ে দিতে হাত আমার কাঁপবে না এতটুকু । আর একটা বিয়ে করা ? ও তো একটা তুড়ির কাজ । পয়সা থাকলে বাঘের দুধ মেলে তো - ছোঃ ।

দারোগা সাহেব এবার নিজেই ফুঁসছেন জনতার দিকে চেয়ে, এই মেয়েটা সময় মত থানায় গিয়ে আমাদের না জানালে প্রাণে বাঁচত ওই দুধের শিশুটা ? নিজের প্রাণের কি ভীষণ ঝুঁকি নিতে হয়েছিল বেচারিকে । অথচ বাচ্চাটা তার নিজের পেটের কেউ নয় । এ তো সত্যিকারের একজন সৎ মা মানে অনেস্ট মাদার ।

দুজন গুণ্ডার সঙ্গে এক দড়িতে বাঁধা হয়ে বিকাশ উঠল জীপে । স্টার্ট দেবার আগে একজন কনস্টেবল মিনতির কোলে সৌম্যকে দিয়ে গেল । একটা প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল বেচারি। সৎ মায়ের কোলে মুখ লুকোল ছেলেটা । চিরকালের সেই চেনা একটা আশ্রয়ে দুটো হ্রদয় একসঙ্গে স্পন্দিত হতে লাগল ।

[ একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে । কাগজ ও টিভির রিপোরট থেকে । ]

কবিতা - আহুতি ভট্টাচার্য্য

অরণ্যযাত্রা
আহুতি ভট্টাচার্য্য



অসীম মমতা ছিল মনে,
অসম্ভব দৃঢ় হয়েছিল আমার এ মুঠো করা হাত,
বড় যত্ন করে অরণ্যগভীরে
সাজিয়েছি এই সৌধসোপান।

জ্যোৎস্নার মায়াবী আঁচলে শুয়ে থাকি আমি, রাতভোর,
জলাধারে সোপানের শেষ বিস্তার...
যেখানে বর্ণময় মাছেদের চতুর সংসার...
নগ্ন হয়ে রৌদ্রস্নানে কেটে যায় আধেক দুপুর।

চুলে গেঁথে রাখি আঁধফোটা বকুলের কুড়ি
অরণ্য ঢেকে রাখে অঙ্গ আমার --বুনোট সবুজ।
আমার সমস্ত অহঙ্কার
মলিন হয় তোমার সে দৃপ্ত পৌরুষ ছটায়---
ভুলে যাই জন্ম সন,গ্রহের বিন্যাস
সেকি শুধু মমতা ঝরাব বলে, তোমার পাথর হৃদয়ে?

জ্যোৎস্নার মায়াবী আঁচলে শুয়ে থাকি রাতভোর,
নগ্ন হয়ে রৌদ্রস্নানে কেটে যায় আধেক দুপুর
সেকি মগ্ন হয়ে শুনব বলে—
তোমার ঐ শরীরের বাউলিয়া মেঠো সুর?

কবিতা - অলোক চৌধুরী

অন্য জীবন
অলোক চৌধুরী



ব্রীজের উপরে
আজও গিটার বাজায় ছেলেটা।
ক্লান্তিহীন মনোবলে চমকায় বিদ্যুৎ--
বিদ্রোহীর রুমাল উড়ে আসে,
তার মনের গহন কোণে।
একগুচ্ছ সুরের চমক,
ছড়িয়ে দেয় দিকচক্রবালে।
একান্ত নিবিড় অন্ধকারে,
ক্যানসারের যাতনায়,
বাড়িতে তার অসুস্থা মাতা।

মন উড়ে যায় শ্মশানবৃত্তের পাখনায়,
বাকরুদ্ধ নাগরিক জীবনে।
নদীর কূল ছাপিয়ে,
বহুদূরে বহুদূরে।
তবুও গিটার বাজায় ছেলেটা,
ব্রীজের উপরে, আপনমনে।

কবিতা - অনুপম দাশ শর্মা

প্রদোষপুত্র
অনুপম দাশ শর্মা



দ্বিধা ছিল না মোটেই
তাই খেলার অঙ্গীকার সহজেই বাতাস বুকে ভরে দৌড়ল
দৌড় দৌড় দৌড় ......
তোয়াক্কাহীন শক্তি একে একে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভালমন্দের সাঁকো,
পেরিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছের নাগরদোলা
সব সব জানলার বুভুক্ষূ দোলাচল।
দ্বিধা ফিকে নীলাকাশে
উড়ন্ত বকের পিঠ থেকে দিনের শেষ
রোদ্দুর মেখে মুক্তমনা,
সেই পিছল জোৎস্নায় আসন পেতে অকাট্য মন,
তেমন কোন রাজ্যপাটের দাবীদার নয়
তেমন কোন মেহগনি বার্নিসের বসন্ত নয়,
অবোধ উৎসে ঘনীভুত তাড়না শুধু জানায়,
ওহে পথিক দৌড়ও
শুধু দৌড়ও
দেখো না চোখের মরুঝড়
দেখো না গুপ্ত অধিকার ,আঁধার চেরা চৈতন্য
তোমায় গড়ে নিক নির্বাক নির্লোভ প্রদোষপুত্র।

কবিতা - অরিন্দম চন্দ্র

ঘুড়ি
অরিন্দম চন্দ্র


বুস্টার দেওয়া জোড়া এন্টেনার ফাঁকে
লটকে থাকা এক-তে ঘুড়ির মতন
জীবনে আটকে রয়েছি--
রোদে পুড়ে, জলে ভিজে।
আকাশ যখন পড়ন্ত সূর্যের
নিভু নিভু আঁচে লাল,
তখন ইচ্ছা করে মেঘগুলোকে ছুঁই।
কাকজোছনায় ঘুমন্ত শহরের বুকে
হাওয়ায় ফড়ফড় করি,
লাটও খাই দু-এক বার--
উড়তে পারিনা আর।
তোমার লাটাই অনেক সুতো ছেড়েছিল,
দলা পাকানো, মাঞ্জাহীণ জড়িয়ে রয়েছে সব।
কাগজ ফাঁসা , কান্নিকের ভার দেখে
এই ঘুড়ি নিতেও আসে না কেউ।
শুধু অপেক্ষার দিন গুনি--
কখন সেই ঝড়টা আসবে,
শেষবারের মতন উড়ে যাবো।

কবিতা - বাবুই

আমার শহর
বাবুই



আমার শহর চেনেনা আমায়
চিনিনা আমিও তোমায়,
যতই ঢাকি নুতনের আড়ালে
শহর কি ভোলা যায় ?
ও শহর তুই চিনলি না আমায়
ভাবলি বিদেশীনি !
আজও তোকে জানবো বলে দাম দিয়ে কিনি |
মাঝে মাঝে সত্যি বড় অচেনা আনমনে...
শহর , তুই বদলে যাচ্ছিস অকারণে |
যারা তোর ছদ্মবেশে করছে সর্বনাশ,
কেন তবে তাদের কাছেই ছুটে ছুটে যাস ?
বিদেশীকে করলি আপন প্রবাসীকে পর..
নিজেই নিজের অজান্তে ডাকলি ভীষণ ঝড়..!
ফিরে আয় শহর আমার অতীতের কাছাকাছি ,
তোর কোলেই মাথা রেখে,
শেষ প্রাণটায় বাঁচি....|


কবিতা - দেবাশীষ মিত্র

মনে পড়ে?
দেবাশীষ মিত্র



আজও তোমায় খুঁজে চলেছি, বিয়াসের পাড় ধরে...
চলেছিলাম অনেকটা পথ হাতে হাত রেখে...
কত আদরে, সোহাগে, কত গান আর কবিতাতে...
আজও বিয়াস বয়ে ছলেছে, পাহাড়ের বুক চিরে, নীরবে...
নুড়ি-পাথর আর স্মৃতিগুলো সঙ্গে নিয়ে, ভালবাসায় জড়িয়ে ধরে...
আজও আমি অপেক্ষায়, তোমার ওই হাসি মাখা মুখের সন্ধানে...

কবিতা - দিব্যেন্দু দে সরকার

মাঝ রাতে
দিব্যেন্দু দে সরকার



মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গা চোখে
দেখি তুমি আছো আমার পাশে,
মনটা যে কি আনন্দ পেল
বলে বুঝাতে পারব না কখনো কাউকে ।
কিছুক্ষণ পর দেখি তুমি নেই
চার পাশে ঘুরে তাকিয়ে রইলাম,
তবুও তুমি চোখে ধরা দিলে না
অবুঝ মন বুঝতে পেল অবশেষে,
আসলে তুমি যে আমার স্বপ্ন
তাই তন্দ্রা চোখে তুমি এসেছিলে ।

কবিতা - দীপঙ্কর বেরা

অবগাহন
দীপঙ্কর বেরা



শুকনো জল ছিটিয়ে
মনের উথাল পাথাল বন্ধ করি।

চল চলে যাই ,
হাত ধরতে পারি আর নাই পারি
চেনা সুরে গুনগুনিয়ে উঠতে
আমার বাধা নেই বিন্দুমাত্র ,
পাশের কেউ কিছু শুনুক না শুনুক
কোন উত্তর দিক না দিক
চলার ছন্দে আমরা সামনে এগিয়ে যাবই।

যতই মেরুদণ্ড বরাবর শিরশির করা
লাভার স্রোত নামুক
ঝতে তো হবেই।

আর খুব খুব তেষ্টা পেলেই
তোমার কাছে বসে
তোমার দেওয়া জলে
আমার প্রাণের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেব
আর আবার চলব।




কবিতা - শ্রীমন্ত সিকদার

জানা নেই
শ্রীমন্ত সিকদার



কতটা এগিয়ে গেলে
কতটা থামতে হয়,
কতটা থেমে থাকলে
সম্পর্কের ডানা পুড়ে যায়,
ঠিক, জানা নেই।

কোনভাবে দিতে গেলে
অহেতুক শব্দ হয়
কতটা কাছে বসলে
নীরবতা ঋজু হয়
তাও দেখি, ঠিক জানা নেই।

প্রকাশ্যে আর গোপনে
জলে ও পাথরে
জীবন যে একটাই হয়
তাও যে সঠিক জানা নেই।



কবিতা - মৌ দাশগুপ্তা

পঙ্কজ
মৌ দাশগুপ্তা



অনাদরে অবহেলায় পুকুরের কর্দমাক্ত তলদেশ থেকে,
যেখানে সন্দেহাতুর মনের মত কালো ছায়াটি জমানো আছে জলে,
যেখানে ঈষৎ কাঁপা কাঁপা সবজেটে জলে ঘাই দিয়ে
কৌতুহলী প্রতিবেশীনির মত মাছের ঝাঁক উঁকি মেরে যায়,
সেখানেই পাঁকের দুর্গন্ধময় দেহের নাভি থেকে উত্থিত হয়ে,
চোখ মেলে নগ্ন মনসিজ।

কোরকের ঘুমভাঙ্গা চোখ থেকে ঝরে পড়া আড়ষ্ট স্বপ্নগুলো
বড় আদরে জড়িয়ে নেয় দিনের প্রথম আলো-কে।
স্বৈরিনী দ্বিচারিকার মত কখনো আলোর বুকে,
কখনো হাওয়ার কাঁধে,ঢলে পড়ে,
কখনো বা মধূপের তীব্র দংশন খোলা বুকে সয়ে
হাসিমুখে যৌবন-লীলায় মাতে নেশাগন্ধী পদ্মবালা।

তারপর পরিবর্তন আর পরিবর্তন,
বর্ণহীনা কমলকলি শুচিশুভ্র পোশাক বদলে সেজে ওঠে অভিসারিকার
লাজ-রাঙা বসনে, গর্বোদ্ধত ভঙ্গীমায় ভরে ওঠে কামদীপ্ত লালিমায়,
অরন্যসুলভ অস্ফুট উচ্চারণে গুনগুনিয়ে আসে প্রেমদূতের দল,
শিকড়বদ্ধ কমলিকার সন্ধানে এগোয় লালসার হাত,
মধূলোভীরা চাহিদা মিটিয়ে উড়ে যায়
অন্য-উদ্ভিন্নযৌবনার সন্ধানে।

তারপর...তারপর আরকি?
পদ্মের ঝরে পড়া পাপড়ির আড়াল থেকে, নবীন শিকড়ে
একটা গোটা কবিতা হয়ে জন্ম নেয় আরেকটা নতুন কোরক।
বুকভরা মধু নিয়ে নিস্তরঙ্গ জলের বুক চিরে কোরক থেকে কুমুদে -
আত্মপরিচয়,পিতৃপরিচয়, খুঁজতে মাথা কুটে মরে।
গল্পটা এখানেই শেষ,এর বেশি কিছু ছিল না ,
এর বেশি তো সে জানায় নি কখনো...


কবিতা - দেবাশীষ মজুমদার

নোনতা ঠোঁট এবং রূপালী মোহ
দেবাশীষ মজুমদার (অন্যদিন)



সমুদ্র মন্থনে মত্ত আমরা ক’জন
মুক্তো খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত দেহে নোনা স্বাদ নিয়ে
আঁকিবুঁকি খেলি বালির ক্যানভাসে।
এখানে জোছনা ছুঁয়েছে জল, এখানে সমস্তটাই
অপার্থিব মনে হয়। মাঝে মাঝে ফ্লাশ ব্যাকে ইতিহাস
হানা দ্যায়, সময় ফুরল নাকি! রাইজলে ডুবাই
নোনতা ঠোঁট, মেঘহীন আকাশ থেকে রূপালী মোহ
ঝরে ঝরে পরে।
বাৎস্যায়নের গল্পের ধার ফুরিয়ে এলে –
জমাট আঁধারে ওড়াই আটত্রিশটি আগুন ফানুস।



কবিতা - রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

আওয়াজ
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ



নিস্তব্দ কুশ ,
তালপাতার কুরসি যুদ্ধেরই ভাবসম্প্রসারন
চাহনির গতিধারা কুমেরু ভেদ করে
আমাদের বরফ সংসারে উদোম বেলার আরব আর্জি ,
নিযুত অমাবস্যায় হাতড়ায় যৌন সম্প্রদায়।

কুয়োতলায় মুহুমুহু কাফরি আওয়াজ
পায়ের শব্দে উতলে উঠে কানাঘুষো।

কবিতা - রত্নদীপা দে ঘোষ

দইওয়ালা চাঁদ
রত্নদীপা দে ঘোষ



আজ অমল আসবে নক্ষত্র বাগানে …. মরশুমি পাখির চাষ পোষা তাঁবুর ভেতরে শীতকালীনপ্রখর অমল আসবে সাথে পরিযায়ী কুয়াশাপাইন ।

সুর দেওয়া কবিতায় আঙুল গড়বে গহরজান । জিয়নকাঠির তিনতালে চুড়ির শব্দকোষ ... অন্ধকার পেরিয়ে জরিমানা ধুলোর ধমনীতে সুসিদ্ধ ফারেনহাইট ।

অমল নির্ভেজাল পড়ুয়া কিশোরঘুড়িতে খরাদিন ভেঙে আসবে , হাঁটুতে লেগে পিত্যুইটারির কাদা ... বাস্তুসাপের পাখনায় জোনাকির সাথে জ্বলবে দইওয়ালা চাঁদ আর আমরা ভুলে যাবো ফ্রেমজন্মের কাহিনী । বিবর্তনের কাঁটায় সান্দ্র হবে আসবাব , দেওয়ালে টুংটাং মৃদুখোদাই , পথিকের মতো দীর্ঘপথ উল্লাস হয়ে সাঁতারঅমল আসবে উচ্চারণে ...

আর খোলা জানলায় অমলের জন্যে প্রকৃত উদ্ভিদমুখবন্ধ লিখে রাখবো আমরা ...

কবিতা - রিয়া দাশগুপ্তা

অবগাহন
রিয়া দাশগুপ্তা


পতন অগ্রাহ্য করে ক্লান্তি বিহীন উঠে এসেছি
অনাবশ্যক বাস্তবের মুখোমুখি
বশ্যতা স্বীকার করিনি কখনো
অথচ আমাকে টেনে নেয় অন্যমনস্ক রথ

আমার বন্ধ খাঁচার পাশে নেচে বেড়ায়
মুক্ত স্বাধীন হাওয়া। ছুটি নেই,
কঠিন অঙ্কের পাশে ছন্দবদ্ধ জীবন
উদাসীন চিত্রকল্প নিয়ে আমি
ছুঁয়ে ফেলি নৈরাশ্যের ঠিকানা

দূরে শঙ্খ বাজে সন্ধ্যার স্বর্গে
কিন্তু আমার ঘরে রাত্রি বারোমাস
হয়তো কাদাবালি ছেড়ে শূন্যে
উঠেছিল স্বপ্নের রথ,

আকাশ জুড়ে উড়ে চলেছে রাত জাগা পাখি
যে নির্জন বাড়িটা তেপান্তরের মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছে
এখন তার প্রহরী আমি, এক সময় শঙ্খ বেজেছিল এখানে
কিন্তু এখন বুকের পাশে অমাবস্যা বারমাস

কবিতা - সৈকত ঘোষ

ঘুমন্ত পৃথিবীর রেপ্লিকা
সৈকত ঘোষ


বৃত্তের কেন্দ্রে থাকে মানুষ, স্পর্শক বরাবর ঈশ্বর...

তিনকোনা আকাশ, মাথার ওপর অসীম শূণ্যতা নিয়ে
উপলব্ধির কযেকটা স্তর পেরিয়ে সবকিছু বিলীন হয়ে যাক

এই শহর,সময়ের বলিরেখা জারক-বিজারক
দৈর্ঘ্য থেকে প্রস্থে কেষ্টপুর-VIP ট্রাফিক জ্যাম
one step closer পঞ্চম ব্রম্ভান্ডে আইনস্ট|ইন ও
অগরুম-বাগরুম | রাত্রিভাষা পাল্টে ফ্যালে চতুরঙ্গের দেশে
রুপোলি ক্লীয়পেত্রা

                         অসংখ্য 'কু' কাটছে হ্যাজাকের আলোয়
তোমার নাভি আমার পাশবালিশের ক্রসিংওভার...

                         ওয়ান শর্টে ভার্জিনিটি লুজ করে পৃথিবী
সেকেন্ড শর্টে অবাধ্য নীহারিকা

কবিতা - সন্দীপ নস্কর

চাঁদের হাটে বেশ্যা কবিতা
সন্দীপ নস্কর


সাহিত্য,কাব্য,রূপ-রস-মাদকতা,কাব্যরস...
সব কেড়ে নেব।কাব্য-ও ল্যাংটা হবে-
রাস্তার ধারের ল্যাংটা ছেলেটার মত।
কলম দিয়েই খুঁচিয়ে দেব কবিতার সব ক্ষত।
নাঃ,কবিতা আর অন্য ভাষা বলবে না,
লাশ কাটা ঘরের শহরে কাব্যের ক্লাস বসবে না।
যে ভাষায় কথা হয়,চলে জীবনের সব লেনদেন,
সে ভাষায় বলবে কথা, কবিতার বনলতা সেন।
গুনমুগ্ধ পাঠক-পাঠিকার গুনকীর্তনে, জমকালো
বইমেলায় পাঞ্জাবি পরা ন্যাকা কবির ভাষণে,
কি বদলায় ?শহরের কটা ঘাস ছেঁড়া যায় ?
তার চেয়ে বরং উলঙ্গ কবিতার শরীরে,
কলমের খোঁচায় ঝরাব তাজা কবিতার রক্ত,
কবিতার খাতা হবে বেশ্যার রক্তাক্ত বিছানা,
কবিতাও তার অতীত ভেবে,বেশ্যার মত খিস্তি দেবে,
আর,অর্ধনগ্ন দেহে খদ্দের ধরতে দাঁড়িয়ে থাকবে-
শহরের কিনারায়,যেখানে চাঁদের হাট বসে...।

কবিতা - শেখর রায়

পুত্র পিতাকে
শেখর রায়


রক্তমাখা অন্ধকার পেরিয়ে
প্রথম যাকে চিনলাম
তার সিঁথিতে ছিল
তোমার হাতের সিঁদুর ।
তোমাকে কবে চিনলাম ?
মনে আছে সেই দিনটা ।
আমার স্তন্যপান দেখার
একমাত্র অধিকার ছিল তোমার।
রাতের বিছানায়
আমাকে কাঁদিয়ে তুমি
মেতেছো কামনার খেলায়।
অঙ্কে ভুল হলে চপেটাঘাত ।
দুআঙ্গুলের মাঝে পেন্সিল রেখে
চাপ...উফফ... ভয়,
শুধু ভয় পেয়েছি তোমায়।
আমার প্রেম
তোমার কাছে সরীসৃপ হয়ে থাকল।
ঘরেতে নিলে না তারে
বেসেছিলেম ভালো যারে।
আমার যেদিন আস্তানা হল
তুমি এলেনা আমার কাছে।
বুক ফাটা কান্নায় বলছি
আজ ভালো থেকো
তুমি পিতা হয়ে...

কবিতা - শমীক (জয়) সেনগুপ্ত

বৈদ্যনাথ
শমীক (জয়) সেনগুপ্ত


আজ আমি পাগল বৈদ্যনাথ; তোমরা কি কেউ সৎ ব্রাক্ষ্মণ আছো? তোমাদের কি কলার গাছে মোচা থোড় হয় ? আমি তবে অর্দ্ধেকে তার ভাগ বসাবো চুরি করে । আমি আজ বদ্যি পাগলা- পৃথিবীতে সৎ ব্রাক্ষ্মণ বড্ড কমে গেছে ।

মায়ের মুখে শোণা কথা, বদ্যি থাকত' মামাবাড়ির পাড়ায়- তখনকার মামাবাড়ি এখনকার শহর ছিল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জজপুকুরের দিকে তাকালে শুধু জল টলমল ঘাটে- সবুজে ছায়ার খেলা দেখা যেত !! আজকের রেলিঙে বা ছেলেবেলার কচুরিপানায় ডাহুক আর পানকৌড়িরও আগের কথা- জল কিলিবিলানি ছায়ায় টুপুস করে ডুবে যেত সূয্যি ঠাকুর । সূর্যের সাথে আজ পুকুরের আড়ি !- মস্ত মস্ত বাড়ি উঠেছে সবুজ ভেঙে - হারিয়ে গেছে বদ্যিনাথের ঘর ওরই মতন করে .. রাতের কানে বদ্যির কানা দিদি ডাক ছাড়ত' -" অ বৈ-দ-দো-" পাগলায় উত্তর করত' "হ" ।

হাততালি দিয়ে বলতাম "আবার বল মা, আবার বল-" মা কিন্তু আর কিছু বলত না।।

দাদামশায়ের নাম ছিল সৎ ব্রাক্ষ্মণ হিসেবে- জীবনে মিথ্যে বলতেন না; আবার ছুঁত-মার্গ ও ছিল না। আয় কম ছিল তবু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছের অভাব হয়নি কোনদিন। তাই বদ্যিনাথের চুরির জন্য মামাবাড়ির কলাগাছ মাঁচার লাউ, পুঁইচারা কেউ রক্ষে পেত না। দিদা বলতেন -"নিবি যখন পুরোটা নিয়ে যা-" বদ্যি জীভ কাটত ! সৎ ব্রাক্ষ্মণকে ভাগ না দিয়ে চুরি করলে পাপ হয়- পাগল ছিল, তাই পাপ-পুণ্যির বিচার ছিল; আমরা পাগল নই- তাই সে বিচারও আমাদের নেই।।

দাদামশাই মারা যেতে- বদ্যি নাকি আমাদের দাওয়ায় আছরে পরে কেঁদেছিল খুব। কতকাল আগের কথা - আমি জানি না, সব শোণা। তারপর একদিন, বৈদ্যনাথ কোথায় চলে গেল। কেউ জানলো না- কোথায় ধানের শীষে; নবান্নের কাস্তের বোলে আবার দিন বয়ে যায়। আবার হেহনতী হাত ঠুকঠাক কামারের ঘাম ঝরা গান শুনিয়েছে নিঃশব্দ কামারশালায় ।

আবার আশ্বিণে ভরে ওঠা জজপুকুর দীঘল কালো জলে ইমারতী ছায়া ফেলে- লাইট জ্বলে ত্রিফলায়; আর রেলিঙে রেলিঙে দিন বদলেছে।

আচ্ছা সৎ ব্রাক্ষ্মণের হদিশ দিতে পার কেউ? কোথায় যেন বৈদ্যনাথ; আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে; সেই শোণা গল্পের ভিড় ঠেলে- চারুকলা আর থোড়-কলা সব মিলে গেল। শুধু আকাশের দিকে তোলা হাত আর বিড়বিড় করা মুখ ব্রাক্ষ্মণ খুঁজে ফেরে।

আর আমার অন্তরের ভগ্নাংশে মেটামর্ফোসিস হয় অজানা উদ্ভ্রান্ত এক চন্দ্রাহত প্রাণের।

আমিও তাই আজ পাগল বৈদ্যনাথ ।।

কবিতা - সৌরদীপ গুপ্ত

প্রাত্যহিক
সৌরদীপ গুপ্ত


প্রতিদিনের যাবজ্জীবন দণ্ডভোগ
প্রতিদিনের জাবর কাটা, কুঅভ্যেস
প্রতিদিনের নখের আঁচড়, গুপ্তরোগ
জীবন এবং আর্দ্রতাদের রাখছে রেশ....

প্রতিদিনের একলা ফেলা চোখের জল
প্রতিদিনের কাশির শেষে রক্তপাত
জীবন নাকি তারল্যে ফের চিরোচ্ছ্বল
প্রাত্যহিকের সীমন্তে রং জড়ায় রাত

তবুও আজ ঘুম ভাঙ্গালো অন্ধকার
তবুও আজ দুচোখ সায়র, নীলোত্পল?
তবুও আজ একলা ঘরের ঘুমঘোরে
দূর আলেয়ায় ডাক পাঠালো, 'জলকে চল.....'

কবিতা - সুদীপ্তা চ্যাটার্জী

উড়ান
সুদীপ্তা চ্যাটার্জী


উচ্ছ্বাস থেকে আলো গড়িয়ে গেলে
নিরাপদ দূরত্বে
পাখী আর তার উড়ান
মধ্যবর্তী মিথে পুরনো শহর
মোহময় কিছু শিউলি ভোর
এরপর
প্রতিটি ঠিকানা বদলের সাথে
অপহৃত
কিছু না লেখা প্রতিশ্রুতি ।।

কবিতা - সুমন কুমার সাহু

চিরতরে
সুমন কুমার সাহু

তোমাকে পড়ে মনে
তুমি উড়ে যাও নীল আকাশের কোণে
বহু দূরে বহু দূরে
ধোঁয়াটে সুরে
তুমি গেয়ে যাও ক্ষণিকের গান গেয়ে
শুধু আমি যাই শুনে।

শত কল্পনা জাগে
তুমি কেটে চলো বুলি মাথার পরে
নরম আলতো হাতে
ঘুম নেমে আসে
আর তুমি জেগে রও সারা রাত ধরে
নব প্রভাতের তরে।

স্নিগ্ধ প্রভাতের আগে
তুমি চলে যাও বাস্তব জগতে
শুধু তোমার জগতে
তব এ খুশির আমেজে
তুমি ভালবেসে চলো নিজের প্রেমে
আমি এখন ও ঘন অন্ধকারে।

আমি চির নির্বাসনে
তুমি কবে ডুবে গেছো অস্তাচলে
ডুবেও যে ডোবনি মনে
এ ঘন অন্ধকারে
তোমার ছবি হৃদয়ে চাঁদ হয়ে ভাসে
আমি ডুবে গেছি চিরতরে।।

কবিতা - সুমন মণ্ডল

বেইমান বর্ষা
সুমন মণ্ডল


সকাল ছিল মেঘ করা মন, দুপুর হলো ফাঁকা।
নীলচে আকাশ উসকালো প্রেম, আসবে তুমি একা।

আসবে তুমি জিন্স টপ-এ তেই, কাদায় শাড়ি বারণ।
খোলা চুলের খুশবু শুঁকেই, মাতিয়ে নেবো মন।

প্ল্যান গুলো সব আঁকতে গিয়ে, গড়িয়ে দু-এক ঘন্টা-
শেষের দিকে ঘুম আসলো, জুড়িয়ে চোখের পাতা।

চটকালো ঘুম, টিনের চালে, চড় বড়া বড় শব্দে।
শেষ দুপুরেই আমার মনে, ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যে।

টেবিলে রাখা নতুন ডিও- ভেংচি কেটে হাসছে,
ঠোঁট উল্টানো ইনবক্স-এ, "সরি সোনা" ভাসছে।

মেঘ করা মন ভালই ছিল, সকাল ছিল শান্ত।
নীলচে আকাশ ধোঁকায় ভরা! উস্কানিটা ভ্রান্ত।

কবিতা - তন্ময় গুপ্ত

তুইও আছিস
তন্ময় গুপ্ত


ওরাও আছে তুইও আছিস
এটাই আশা তুইও আছিস।
ওদের মুখোস ফাটল ধরা
আসল মুখের কদর্যতা
বেরিয়ে আসেই।
এটাই আশা পুরানো তুই
রঙ্গিন মুখের ভিড়ের মাঝে
থাকিস পাশেই।
বিষজর্জর ভগ্নহৃদয়
রণক্লান্ত রক্ত ঝরা
দিনের শেষে,
হঠাৎ এসে ভরসা যোগাস
ওঠ দেখি তুই বুক চিতিয়ে
এক নিমেষে ?’
ভাঙ্গা গড়া সবই দেখিস
এটাই আশা তুইও আছিস।



কবিতা - সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য্য

তোমাকে বলিনি
সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য্য


গাছপাতা থেকে রঙ,
পাহাড়ের চূড়ো থেকে রঙ,
নদীর বুক থেকে রঙ,
আকাশের গা ছেনে রঙ,
সমুদ্র কিনার থেকেও রঙ নিয়ে
রোজ ভোর থেকে
মাঝরাত পেরিয়ে
নিজের ওপর তুলি
বোলাতে বোলাতে
তুমি...ঘনশ্যাম..

প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেও
গাঢ় অন্ধকার বেয়ে ওঠা
জোয়ারের নিষ্ফলা ঢেউ
শরীরে মাখতে মাখতে
নীলবর্ণ হয়ে গেছ
বুঝতে পার নি...
পোষাক ও প্রসাধনে
মুখের গভীর থেকে টানটান নির্বাচিত
শব্দ উচ্চারণের পরও
কের মাঝখানে অপেক্ষার
ঝাড়বাতি জ্বেলে রেখে গেছ
অথচ
ভরা ভাগিরথীর তীর ছুঁয়ে
তখন তুমি
দূর্বাদল শ্যাম...
সহনীয় করে নিজের চারিপাশ
হতাশা অহঙ্কারে পরিপূর্ণ আমি
কলম আর সাদা পাতা নিয়ে
আলোর খোঁজে
ধরা পরে যাই
নিজের কাছেই,
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মন
পালঙ্কে শয়ান
রান্নাবাটির রোজনামচা
অস্থির বুকের ভেতর অন্য স্মৃতি অন্য দেশ
আর পুড়ে যাওয়া দগদগে
জমাট ঘনশ্যাম...
জন্মাষ্ঠমীর রাতে এ আমার সুখ , এ আমার রোমন্থন...



কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

দেয়াল
ঊষসী ভট্টাচার্য



নিঃশ্বাসের শব্দ এঘর থেকে ওঘরে।
সকালের ব্রাশে জীবনের চুইঙ্গাম আটকে;
আঠালো আকর্ষণ,
চশমা হারিয়েছি সম্প্রতি
দৃষ্টি নেহাত ঝাপসা ঝাপসা।
এক প্রেয়সীর প্রেমিক আকাশ খুলেছে তার হাতের মুঠোয়,
চিঠিতে লিখেছে-
‘ডানা মেলে ওড়ো’ ....
এখন, আকাশ বলতে বেনামী প্রচ্ছদ
দৃশ্যত জলের পড়ন্ত ছায়া-
ডুবে থাকা আর ভেসে যাওয়া স্রোতে তাই
একে অন্যের নামান্তর।
এক কবিকে প্রত্যুত্তরে বলেছি,
‘হাঁটতে শিখেছি, চলতে পারিনা
ঝুঁকতে শিখেছি, উঠতে পারিনা’

পাশের বাড়ির ছেলেটি উঠেছে ফাইভে,
রাতের পণ্য মেয়েটির থেঁতলে যাওয়া রঙ মাখা শরীর
ক্লান্ত রাত কাটিয়ে উঠেছে সকালে।
আমার ওঠা অগ্নি সহবাস সংযোগে ...
জরায়ুর গতি থেমে থেকেছে
রোজের মাতলামো আবদ্ধে।

প্রেমিককে তার প্রেয়সী লিখেছে চিঠিতে-
‘আমায় নিয়ে ভেবোনা
অস্ত উদয় নিয়েই জীবন
সূর্যের আলো টুকু নাও
দহন হাতড়াতে গেলে ,
পুড়ে ছাই হবে একেবারে...
আমায় নিয়ে ভেবোনা’। 


মহাভারতের কথা - সুস্মিতা বসু

নারী তুমি
সুস্মিতা বসু


নারী তুমি ধর্ষিতা-সে কবে থেকে কে জানে !! দামিনীর আর্তচিৎকার তো সভ্যতার আদি প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে, একটু কান পাতলেই শোনা যায়......

পুরাণ মতে মহারাজ দুষ্মন্ত ও আশ্রমকন্যা শকুন্তলার পুত্র ভরত-ই ভারতবর্ষের আদি রাজা এবং ভারতবাসীরা তাঁরই বংশধর । সেই সুত্রে মহাভারতকে যদি ভারতবর্ষের জন্মের আদিবৃত্তান্ত হিসাবে ধরে নিই, তবে তো বলতে হয়, গোড়াতেই গলদ । সে ইতিহাসের দায় কোনোভাবেই এড়ানো সম্বব নয় ।

মূল কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে মহাভারাতের উপকাহিনীগুলি ঘাঁটলে দেখা যায় সেখানে নারীর প্রতি অসংখ্য পীড়ণ, অত্যাচার, দমন, পরাজিতকরণ – এক কথায় ধর্ষন; শারিরীক ও মানাসিক ।।

এইরূপ অসংখ্য ধর্ষনের মধ্যে অন্তত দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মূল কাহিনীর অন্তর্গত এই দুইটি ঘটনা না ঘটলে ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়ত অন্যরকম হতো । সেই ঘটনা দুটিই বর্তমান আলোচনার উপজীব্য।

***

প্রথম ঘটনাটির ঘটনাকাল মহারাজ বিচিত্রবীর্যের অকাল প্রয়ানের ঠিক পরবর্তী সময় । বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী, অম্বিকা ও অম্বালিকা নিঃসন্তান । বিচিত্রবীর্যের অপর ভ্রাতা, চিত্রাঙ্গদ পুর্বেই প্রয়াত; প্রথা মতে, বংশরক্ষার দায় বর্তায় বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, মহারাজ শান্তনুর প্রথম পুত্র দেবব্রত-ভীষ্মের ওপর । কিন্তু তিনি যে পিতার কাছে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের ভীষণ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ !!

এদিকে মাতা সত্যবতী চিন্তিতা । মহারাজ শান্তনুর বংশ লোপ পেতে চলেছে । কোনও উপায় না দেখে তিনি প্রায় সমবয়সী পুত্র, ভীষ্ণের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো, নিয়োগপ্রথা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায়ান্তর নেই।

এমত অবস্থায় সত্যবতীর মনে পড়লো একটিই নাম – তিনি হলেন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ মুনিশ্রেষ্ঠ পরাশরের ঔরসে আদিমাতা সত্যবতীর গর্ভে , তাঁর কুমারী কালে জাত পুত্র, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। না, এই মিলনে কোনো বলপ্রয়োগ ছিলো না। যদিও বিবাহ বহির্ভূত, তবুও দুই পক্ষের সম্মিলিত মিলনেচ্ছাতেই জন্ম ব্যাসদেবের। বল প্রয়োগের ইতিহাস এর পরবর্তী...

সত্যবতীর একান্ত আনুরোধে ব্যসদেব রাজী হলেন পরকামে নিযুক্ত হতে। পাঠক, একটি বার ভাবুন, সেই সদ্য বিগত-ধবা দুই কিশোরী সুন্দরী অনাথবৎ রাজমহিষীদ্বয়ের কথা, ভীষ্ণ যাঁদের স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করে আনলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য; রাজমহিষী তাঁরা, কিন্তু নিঃসন্তান! শাস্ত্রে বলে, নিঃসন্তান বিবাহিতা নারীর পরলোকে নরক প্রাপ্তিও নাকি হয় না। একদিকে অনিশ্চিত পারলৌকিক জীবনের উৎকন্ঠ উদ্বিগ্নতা, অন্যদিকে বংশরক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের অক্ষমতার লজ্জা ও কুণ্ঠা । এমনিতেই তাঁরা অর্ধমৃতা, তার ওপর অন্তিম আঘাতটি পড়ল এই নিয়োগপ্রথার নির্মম সিদ্ধান্তে। একটিবারও কেউ তাঁদের মতামত জানতেও চাইলেন না।

ব্যাসদেব শর্ত দিলেন; একবৎসর কঠিন ব্রতধর্ম আচার অনুষ্ঠান পালনে আত্মিক শুদ্ধিকরণ, যাতে তেজঃদীপ্ত দ্বিজশ্রেষ্ঠ ঋষিপ্রবরের ঔরস যথার্থ গর্ভাধান লাভ করে । ঋষিশ্রেষ্ঠ হয়তো বা কিছুটা সময় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যবতী রাজী হলেন না, এতোদিন অপেক্ষা করা যাবে না।

অগত্যা দিন ধার্য হল। সত্যবতী বধূদের প্রস্তুত করলেন। রাত্রির আঁধার ঘনিয়ে এলো। দেবকন্যার মত রূপবতী, দেবোপম সুখবিলাসে অভ্যস্তা, সুস্নাতা, সালঙ্কারা, সদ্য বিগত-ধবা জ্যেষ্ঠা রাজমহিষী আম্বিকা শয়নকক্ষের শয্যায় অপেক্ষমানা। দীপ্যমান প্রদীপালোকে সেখানে ব্যাস উপস্থিত হলেন। ঘন কৃষ্ণ তাঁর গায়ের রং, তপস্যার রুক্ষতায় তাঁর কনকপিঙ্গল জটাকলাপ, আগুনের ভাঁটার মতো তপোঃদীপ্ত দুই চোখ, মুখে একরাশ দাড়ি, পাঁশুটে গোঁফ, কালো মুখোগহ্বর, পরনে অজিন আবরণ, গায়ে বিকট দুর্গন্ধ।

ভয়ে, ঘৃনায়, অনীহায় রাজমহিষী চক্ষু মুদলেন। তবুও মৈথুনক্রিয়া সম্পন্ন হলো। সত্যবতী জানতে চাইলেন, ফল? বলশালী, বিদ্বান, রাজপ্রতীম, কিন্তু মাতার আচরণ হেতু অন্ধপুত্র!!

হাহাকার করলেন সত্যবতী, সতর্ক করে দিলেন অম্বালিকাকে। দৃষ্টান্ত স্মরণ করে অম্বালিকা চোখ খুলে রাখলেন ঠিকই, কিন্তু ওই বীভৎসদর্শন, অসুরপ্রতীম ঋষিপ্রবরকে দেখে ভয়ে বিবর্না হয়ে গেলেন। জন্ম হলো পান্ডু-র ।।

মহারাজ শান্তানুর বংশ রক্ষা পেল। ধর্ষণ ছাড়া এই দুই রতিক্রিয়াকে কি অন্য কোনো নাম দেওয়া যায়? পাঠক, আপনিই বিচার করুন!! মহারাজ ভরতের কালে যে বংশের সূচনা, মহারাজ শান্তনুর পরবর্তীতে যে বংশ লোপ পেতে বসেছিলো, সেই বংশের ধারায় আবার প্রানপ্রবাহ প্রতিষ্ঠিত হলো দুটি ধর্ষনের ফলে, পুরাণমতে যে বংশপ্রবাহ আজও বর্তমান।

হায় ভারতবাসী, হায় মহারাজ ভরতের বংশধর, যে মায়ের ধর্ষনে আজ তুমি প্রতিবাদে সোচ্চার, যে জ্যেষ্ঠা-কনিষ্ঠা ভগিনীর আর্তচিৎকারে তোমার কর্নপটহ বিদীর্ণ, তাকে তুমি উপেক্ষা করবে কি করে !! তোমার নিজের জন্মের ইতিহাসও যে কালিমালিপ্ত !!! এ দায় আজ তোমায় নিতেই হবে ।।

***

দ্বিতীয় ঘটনাটির ঘটনাকাল ঠিক এক প্রজন্ম পরে, স্থান মহারাজ কুন্তিভোজের রাজঅন্তঃপুর, দর্পিত পুরুষের লালসার শিকার রাজা কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা পৃথা-কুন্তী; জন্মসূত্রে যিনি যাদব, মহারাজ শূরের প্রথম কন্যা, মহামতী বাসুদেবের ভগিনী, সেই সূত্রে কৃষ্ণের পিতৃস্বসা।

রাজা কুন্তিভোজের প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করলেন প্রখরস্বভাবা মুনি দূর্বাসা। উগ্রস্বভাব, হঠাৎক্রোধী, আভিশাপপ্রবণ এই মুনির আতিথেয়তার গুরু দায়িত্ব পড়ল পালিতা কন্যা পৃথার উপর। রাজা কন্যাকে সতর্ক করলেন ঃ কন্যার কোমল অথচ কর্তব্যনিষ্ঠ স্বভাবের কথা বলার পরে তিনি কুন্তীর জন্ম পরিচয় উল্লেখ করে তাঁকে অনেক প্রসংশা করলেন। কিন্তু অবশেষে উল্লেখ করতে ভুললেন না, শূরনন্দিনী পৃথার হাতেই এখন রাজা কুন্তিভোজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব। এ যেন পিতার সতর্কীকরণ নয়, রাজার আদেশ ।।

রাজাজ্ঞা পালিত হল অক্ষরে অক্ষরে। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হলেন। অলোকসামান্যা রূপবতী কুমারী কুন্তীকে ইচ্ছামত দেব-সঙ্গমের মন্ত্র বর দিলেন মুনিশ্রেষ্ঠ।

বিপত্তির সূত্রপাত এখানেই। দুর্বাসা দেব-সঙ্গমের রহস্যমন্ত্র সদ্য যৌবনবতী কুন্তীকে শিখিয়ে দিয়ে চলে যেতেই কুন্তীর কুমারী হৃদয়ের অজ্ঞতা, চঞ্চলতা ও কৌতুহলপ্রিয়তা তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলেন না মন্ত্রের বলাবল পরোখ করার প্রবল বাসনা...............

বালখিল্য চপলতায়, একদিন প্রত্যুষে রাজঅন্তঃপুরের পুষ্প শয্যায় শায়িতা পুষ্পবতী কুন্তী নবোদিত কোমল কিরণময় সূর্যকে আহ্বান করলেন মন্ত্রবলে। মুহূর্তে মূর্তমান হলেন আদিত্যদেব। নম্র সম্ভাষণে কুন্তীর আনুগত্য স্বীকার করলেন, মন্ত্রের শর্ত অনুযায়ী। কিন্তু এই অনুগতভাব বেশীক্ষণ রইল না, যখন কুন্তী তাঁকে ফিরে যেতে বললেন।

দেবপুরুষ হাতের কাছে কৃশকটি, অলসগমন, মধুর হাস্যময়ী, সদ্য যৌবনবতী, সুন্দরী কুন্তীকে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। কুন্তীর শত কাকুতিমিনতী উপেক্ষা করে এক দীর্ঘ বচসার পর নিজেকে আর দমিত রাখতে পারলেন না। স্পষ্টতই তিনি কুন্তীকে লোকলজ্জা ও অভিশাপ প্রদানের ভয় দেখিয়ে কুন্তীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হলেন, স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ।।

পুরুষের ধর্ষণ মুখরতায় যৌবন শোভার আধার কুন্তী মহাবিষ্টা লতার মত সংজ্ঞা হারিয়ছেন । আর দুর্ধর্ষ সূর্য সঙ্গম সম্পন্ন করে অচৈতন্য কুন্তীকে ফেলে রেখে চলে গেছেন। জন্ম হয়েছে কর্ণের।।

স্বাভাব অভিমানী, অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী ও প্রতিশোধস্পৃহ কর্ণ নিজের স্বার্থে অন্ধ পিতৃস্নেহে ক্রমাগত দুর্বিনীত ও দুর্দান্ত হয়ে ওঠা, অহংকারী অথচ কিছুটা মূর্খ ও সুক্ষতাহীন দুর্যোধনকে ব্যবহার করেছেন। মহাভারতের সুবিশাল ভারতযুদ্ধ, যা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে অন্য এক রূপ দিয়েছে, তা ত্বরান্বিত ও সংঘটিত করার পেছনে কর্ণের বিশেষ অবদান আছে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

মহাভারতের সুপ্রসারিত পরিসরে এইরূপ ঘটনা আরো আছে, কিন্তু এই দুইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ এই দুই ঘটনাই কাহিনীর গতিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রন করেছে, ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে বিশেষভাবে। যে কাহিনী দুটির অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে ধর্ষনের মতো এক মর্মান্তিক ঘটনা, ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তা নিয়ন্ত্রিত করেছে, ভাবতেই বেদনার্ত হয় মন।

আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়ভাব অনুষঙ্গের প্রস্তাবনা, তার যথার্থ মূল্যায়ন করা গেল কিনা জানিনা, তবুও পাঠকের চিত্তবৃত্তিতে যদি কিছুমাত্র আবেদন রেখে থাকে প্রবন্ধটি, তবে লেখিকার প্রয়াস সার্থকতা লাভ করবে, এ কথা অনস্বীকার্য।।


অনুপ্রেরনা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ-

মহাভারতের ছয় প্রবীণ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয়, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

রম্যরচনা - শকুন্তলা দে

নাগরদোলা
শকুন্তলা দে


আমার বাড়ি থেকে একটু এগোলেই বেশ বড় একটা পার্ক আছে। অবশ্য পার্ক বলতে যা বোঝায় এটা সেই রকম নয়, চারিদিকটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পাঁচিল, আর তার উপরে গ্রিল দিয়ে নকশা করা। পার্কের ভেতরটা সবুজ ঘাস, আর ধারে ধারে বেশ বড় কিছু গাছ।এর মধ্যে বকুল ফুলের গাছই বেশি। আমার খুব প্রিয় এই ফুল- ছোট্ট সুন্দর ফুলটা মোহময় গন্ধ ছড়িয়ে রাখে চারিদিকে। এই বড় গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ আছে। সাধারণত ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলাতে বেশ কিছু নানান বয়েসের মানুষ এখানে হাঁটতে আসে। এই পার্কের আর একটা বৈশিষ্ট্য হোল ভেতরে বেঞ্চ আর গাছের সারির সামনে দিয়ে বেশ ভালোভাবে হাঁটার জন্য বাঁধানো রাস্তা আছে। একজন মানুষ নিশ্চিন্তে চোখ বুজে পার্কের চারদিকে হেঁটে বেড়াতে পারবে। আর হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার জন্য সুন্দর বাঁধানো বেঞ্চও আছে। এক কথায় এই পার্কটা আমার কাছে খুব মনোরম জায়গা। তাই নিয়মিত আমিও এখানে আসি। মাঝখানে খোলা জায়গাটাতে প্রায় সময়ই কিছু না কিছু মেলা লেগেই থাকে, আর সেই উপলক্ষে নানান লোকের আনাগোনা হয়। তাদের কাজ করা দেখা, তাদের কথোপকথন শোনা, এই সব নিয়ে আমার বেশ ভালোই সময় কেটে যায়।

আজ ঠিক করেই এসেছিলাম যে হাঁটবো না, তাই একটু বেলা থাকতে এসে বসে আছি আর মেলার লোকজনদের দেখছি। এখনো বাইরের লোকজন আসা সেই ভাবে শুরু হয়নি তাই মেলার দোকানের যারা নিজস্ব লোকজন তারা একটু গাছাড়া দিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি, ঠাট্টা আর আড্ডায় ব্যস্ত। আমার সামনেই একটা বাচ্চাদের নাগরদোলা। মাঝখানে একটা মোটা খুঁটি পোঁতা আছে আর তাকে ঘিরে চারিদিকে হাতি, ঘোড়া ,বাঘ, সিংহ, কুমীর সব লোহার দড়ি দিয়ে ঝোলানো। ছোটো বাচ্চাদের তার উপরে বসিয়ে দিয়ে বন বন করে ঘোরানো হয়। বাচ্চারা তো দারুণ উপভোগ করেই, এমনকি তাদের নিয়ে আসা কাছের মানুষেরাও বেশ উপভোগ করে বাচ্চাদের এই হাসিমুখ আর আনন্দের চিৎকার। আমিও এখানে বসেই ওদের সাথে ওদের আনন্দের শরিক হই।

এই নিয়ে এতো বেশী করে ভাবার হয়তো এটাও একটা কারন যে, আমার এই ভাবনার ফাঁকে বেশ কয়েকজন বাচ্চা এসে বসেছে ঐ নাগরদোলাতে আর চীৎকার করে বলছে-“আরও জোরে আরও জোরে...। ” ওদের চীৎকারের সাথে সাথে আমার মনটা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। মনে হোলও আমি যেন ঐ নাগরদোলার খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর আমাকে ঘিরে ঐ সব হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, কুমীর বন বন করে ঘুরছে আমাকে ঘিরে। আমি তাকিয়ে আছি। আমার চোখের সামনে দিয়ে ওরা ছুটছে। হঠাৎ মনে হোলো -ওগুলো জন্তু নয়, আমার চেনা সব মানুষের মুখ। আমাকে ঘিরে ওরা ছুটছে বন বন করে। কখনো জন্তুর মুখউ, আবার কখনো আমার চেনা সব মানুষদের মুখ। আমি দিশেহারা হয়ে তাকাচ্ছি ওদের দিকে। ওদের ছুঁতে চাইছি, ওদের ধরতে চাইছি, ওদের থামাতে চাইছি। কিন্তু কোনটাই করতে পারছি না। সারাটা মন অস্থির হয়ে উঠছে, আকূল হয়ে অপেক্ষা করছি, কেউ একজন আসুক যে আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে।


ছোটদের পাতা - ইশিতা লাহার কবিতা

The 'plugged-in' world
Ishita Laha



Living in this self-absorbed world
Of music and private thoughts
What appears more bizarre-
Talking, arguing, debating in own heads
Masking the feelings under the veil of technology

One consciously tries to avoid any eye-contact
Lest a need to talk shall arise
An ear-plug in such scenario-comes handy
To blank out the noise called 'talk'
Marking conversation- a dying art!

This restriction on easy exchange
Cripples our sensation to expression
Leaves little room for reaction
Compromises with our ability to self-reflect
Silently erodes away off one's panache.

One of the biggest casualties of this connected world
The art of communication
The bedrock of development
Conversation-a word endangered
In the lexicon of GenNext.

The silence of this world is deafening
When communication only means texting and tweeting
Engulfing us in an impersonal virtual space
Where the patience to talk and listen
Simply stands an option no more!