রম্যরচনা - শকুন্তলা দে

নাগরদোলা
শকুন্তলা দে


আমার বাড়ি থেকে একটু এগোলেই বেশ বড় একটা পার্ক আছে। অবশ্য পার্ক বলতে যা বোঝায় এটা সেই রকম নয়, চারিদিকটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পাঁচিল, আর তার উপরে গ্রিল দিয়ে নকশা করা। পার্কের ভেতরটা সবুজ ঘাস, আর ধারে ধারে বেশ বড় কিছু গাছ।এর মধ্যে বকুল ফুলের গাছই বেশি। আমার খুব প্রিয় এই ফুল- ছোট্ট সুন্দর ফুলটা মোহময় গন্ধ ছড়িয়ে রাখে চারিদিকে। এই বড় গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ আছে। সাধারণত ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলাতে বেশ কিছু নানান বয়েসের মানুষ এখানে হাঁটতে আসে। এই পার্কের আর একটা বৈশিষ্ট্য হোল ভেতরে বেঞ্চ আর গাছের সারির সামনে দিয়ে বেশ ভালোভাবে হাঁটার জন্য বাঁধানো রাস্তা আছে। একজন মানুষ নিশ্চিন্তে চোখ বুজে পার্কের চারদিকে হেঁটে বেড়াতে পারবে। আর হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে বসার জন্য সুন্দর বাঁধানো বেঞ্চও আছে। এক কথায় এই পার্কটা আমার কাছে খুব মনোরম জায়গা। তাই নিয়মিত আমিও এখানে আসি। মাঝখানে খোলা জায়গাটাতে প্রায় সময়ই কিছু না কিছু মেলা লেগেই থাকে, আর সেই উপলক্ষে নানান লোকের আনাগোনা হয়। তাদের কাজ করা দেখা, তাদের কথোপকথন শোনা, এই সব নিয়ে আমার বেশ ভালোই সময় কেটে যায়।

আজ ঠিক করেই এসেছিলাম যে হাঁটবো না, তাই একটু বেলা থাকতে এসে বসে আছি আর মেলার লোকজনদের দেখছি। এখনো বাইরের লোকজন আসা সেই ভাবে শুরু হয়নি তাই মেলার দোকানের যারা নিজস্ব লোকজন তারা একটু গাছাড়া দিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি, ঠাট্টা আর আড্ডায় ব্যস্ত। আমার সামনেই একটা বাচ্চাদের নাগরদোলা। মাঝখানে একটা মোটা খুঁটি পোঁতা আছে আর তাকে ঘিরে চারিদিকে হাতি, ঘোড়া ,বাঘ, সিংহ, কুমীর সব লোহার দড়ি দিয়ে ঝোলানো। ছোটো বাচ্চাদের তার উপরে বসিয়ে দিয়ে বন বন করে ঘোরানো হয়। বাচ্চারা তো দারুণ উপভোগ করেই, এমনকি তাদের নিয়ে আসা কাছের মানুষেরাও বেশ উপভোগ করে বাচ্চাদের এই হাসিমুখ আর আনন্দের চিৎকার। আমিও এখানে বসেই ওদের সাথে ওদের আনন্দের শরিক হই।

এই নিয়ে এতো বেশী করে ভাবার হয়তো এটাও একটা কারন যে, আমার এই ভাবনার ফাঁকে বেশ কয়েকজন বাচ্চা এসে বসেছে ঐ নাগরদোলাতে আর চীৎকার করে বলছে-“আরও জোরে আরও জোরে...। ” ওদের চীৎকারের সাথে সাথে আমার মনটা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। মনে হোলও আমি যেন ঐ নাগরদোলার খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর আমাকে ঘিরে ঐ সব হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, কুমীর বন বন করে ঘুরছে আমাকে ঘিরে। আমি তাকিয়ে আছি। আমার চোখের সামনে দিয়ে ওরা ছুটছে। হঠাৎ মনে হোলো -ওগুলো জন্তু নয়, আমার চেনা সব মানুষের মুখ। আমাকে ঘিরে ওরা ছুটছে বন বন করে। কখনো জন্তুর মুখউ, আবার কখনো আমার চেনা সব মানুষদের মুখ। আমি দিশেহারা হয়ে তাকাচ্ছি ওদের দিকে। ওদের ছুঁতে চাইছি, ওদের ধরতে চাইছি, ওদের থামাতে চাইছি। কিন্তু কোনটাই করতে পারছি না। সারাটা মন অস্থির হয়ে উঠছে, আকূল হয়ে অপেক্ষা করছি, কেউ একজন আসুক যে আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে।



2 মতামত: