ছোটগল্প - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

সৎ মা
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



- হয়, খুব হয় । বিকাশ একটু মুখ ভার করে বলল, তোমাকে বিয়ে করলুম আর একটু সুখ দিতে পারব না ? আমার প্রস্তাবটা তোমার অপছন্দ কিসের ?

উত্তরটা মিনতির ঠোঁটের কাছে এসেও বেরোচ্ছিল না । কয়েকবার ঠোঁটটাই শুধু কাঁপল । বিকাশ বলল, বুঝেছি । আমি দোজবরে বলে ? তা একটিও তো পয়সা খরচ করতে হয় নি তোমার বাবাকে । আমি কি একটা ফেলনা বর ? আমার তো কত পণ নেবার কথা । বল, দাবী করেছি সে সব কোনদিন তোমার বাবার কাছে ? নেহাত এতবড় একটা ছেলের ঝক্কি বইতে হবে তাই --

শেষ কথাটা বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলল সে ।

মিনতি শুধু কাঁদছিল । বিকাশ বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ ? কিচ্ছু চিন্তার নেই ডিয়ার। তাছাড়া ধর না, রমলার তো আরও একটা ছেলে হতে পারত । তাহলে আমার দুই ছেলেই তো আমার মানুষ হত । আজ রমলা নেই তাই --

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার বলল, তাই তো রমলার জায়গায় তোমাকে বসিয়েছি । তোমার নিজের একটা জিনিস তুমি চাও না ? অবাক করলে ।

সৌম্য স্কুল থেকে ফিরল । ধপাস করে ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে টেবিলের ওপর রেখেই মায়ের কোলে বসে পড়ল । মাকে খুব ভালবাসে সে । মায়ের জন্যে তার কত গরব হয় মাঝে মাঝে । তার মা যেমন এমন মা আর কারোর নেই । সকলকে বুক ফুলিয়ে বলে সে ।

ইস্কুল থেকে বা সন্ধ্যায় খেলার মাঠ থেকে ফিরতে দেরি হলে বাড়ী ফিরে মায়ের মুখে বেশ একটা দুশ্চিন্তার ছাপ তার নজরে পড়ে । প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে শিখেছে আর তাই দেরির কৈফিয়ত সে আগাম দিয়ে দেয় ।

- জানিস, আমার মা আমার বাড়ী পৌঁছতে দেরি হলে শুধু বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে সারাক্ষন । একদিন গিয়ে দেখি মশা একেবারে ছেঁকে ধরেছে । ফুলিয়ে দিয়েছে সারা গা ।

বন্ধুর দল হেসে ফেটে পড়ে । - মা ? মা কিরে ? মা কাকে বলছিস ? ও তো তোর সৎ মা ।

সৎ মা কথাটার মানে জানে সৌম্য । মা নয় কিন্তু মায়ের মত । শুনেছে কিছু বাবা নাকি দুবার করে বিয়ে করে । তাই সেই ছেলেদের দুটো করে মা হয় । একটা আসল মা আর একটা সৎ মা ।

কিন্তু তার মাকে তার সৎ মা কেন বলে তাই তো বুঝতে পারে না সে । প্রথম থেকেই সে দেখছে মা তার একটাই । তবে আবার সৎ মাটা আসবে কেমন করে ?

অর্ক হল সৌম্যর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মানে বেস্ট ফ্রেন্ড । মাঝে মাঝে তার বাড়ীতে যায় সৌম্য । তার বাবা তাকে বেশ ভালবাসে । অনেক গল্প করে । একদিন তিনি বললেন, তোমার এখনকার মা তোমাকে ঠিকঠাক ভালবাসে তো ? ঠিক প্রথম মায়ের মত ভালবাসে তো ?

অর্ক কেমন ঘাবড়ে গিয়ে কিছুই উত্তর দিতে পারল না । তার মনে একটা প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খেতে থাকে প্রথম মা টা কি জিনিস ? তার তো একটাই মা ?

অর্কর বাবা জানাল তার বাবার সেই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ।

- বাচ্চা ছেলে ছিলি তুই । এমন সময় তোর মা মানে আগেকার মা - মানে তোর আসল মা আর কি - মারা যায় । তোর বাবা বিয়ে করে আনল তোর নতুন মা কে মানে এই মিনতিকে । কি আর করতে পারে বল তোর বাবা । বেচারি ।

সৌম্যর নিজেকে হঠাত খুব বোকা বোকা মনে হতে লাগল । আর আশপাশের সকলকে খুব চালাক । সে একটা জিনিস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না । সে তো একটা মাকেই দেখছে চিরকাল । তাহলে সেই আর একটা মা এলো কোথা থেকে ?

বেশ কিছুদিন এমনি করেই চলল । সৌম্যর মনটা ক্রমে যেন খুব ভারি হতে থাকে । কিন্তু কেন এই ভারবোধ সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না ।

সৌম্য বিকেলে ইস্কুল থেকে বাড়ী ফেরে নি । বিকেল তার দৈনন্দিন কাজের ভার সন্ধ্যার হাতে দিয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রামে গেল । কিন্তু মিনতি নিশ্চিন্ত হতে পারছে কই ? বিষণ্ণ রাতও এক সময় ঢাকনা খুলে সকাল হল ।

বাইরে শোরগোল । প্রচুর লোক । তারা সব ক্ষোভে ফুঁসছে । সৌম্যকে নাকি খুন করা হয়েছে । অমন ভাল ছেলেকে খুন ? কে করল ? কে আবার এই ডাইনিটা আবার কে ? সবাই মিনতির বাড়ীর সামনে জড় হল । গ্রিলে টুং টাং আওয়াজ করেই চলল । মিনতি বেরিয়ে এল চিন্তাচ্ছন্ন মুখে ।

- এই ডাইনিটা খুন করেছে অমন দুধের ছেলেটাকে । মার মার -

সবাই ইট পাটকেল ছুঁড়তে লাগল মিনতিকে লক্ষ করে । মিনতি শুধু কেঁদেই চলেছে ।

এমন সময় জীপের শব্দ । থানার দারোগা সাহেব এসেছেন । নামলেন তিনি । পেছন পেছন কনস্টেবলের হাতে হাতকড়া পরান তিনজন । দুজন গুণ্ডার সঙ্গে একই দড়িতে বাঁধা বিকাশও।

- কে ডাইনী ? দারোগা সাহেব ব্যাঙ্গের সঙ্গে বললেন জনতাকে, যে মেয়েটা তার সৎ ছেলেকে খুনের হাত থেকে বাঁচাল সে ? ছি ছি ! মনে রাখবেন এটা গ্রাম নয় শহর । আপনাদের এমন বুদ্ধির বহরের জন্যেই গ্রামে গঞ্জে ডাইনী করা হচ্ছে আজও কত নিরীহ মেয়েদের । এই একবিংশ শতকেও । লজ্জা করে না ?

গম্ভীর আওয়াজখানা বুলেটের কাজ করল । যেন শূন্যে একটা ফাঁকা গুলি ছোঁড়া হল ।

এবার শান্ত জনতা আসল ঘটনায় মন দেয় । দারোগা সাহেব বলছিলেন আসল গল্পটা । মিনতিকে বিয়ে করেছিল বিকাশ সৌম্যকে মানুষ করার জন্যে এটা ঠিক । কিন্তু ভালবাসার বহরটা বেশী করে বইল নতুন বৌ মিনতির খাতেই । আর ভাল করে ভালবাসতে গেলে আর একটা বাচ্চাকে তো আনতেই হয় নাকি ? কিন্তু মিনতি কিছুতেই নিজের ছেলে নিতে চাইছে না । আসলে সৌম্যর ভালবাসা তাকে একটা অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল । তাই তার ভালবাসা আর ভাগ হোক তা চায় নি সে ।

অসহায় বিকাশ প্ল্যান ছকে নিয়েছিল । সৌম্যকে সরানোর প্ল্যান । বিকাশ জানে মিনতি তাকে সমর্থন করবে না । তাই তাকেও সতর্ক করেছিল, সাবধান মিনতি । আমার পথে কাঁটা হয়ে এলে তোমার গলাটা নামিয়ে দিতে হাত আমার কাঁপবে না এতটুকু । আর একটা বিয়ে করা ? ও তো একটা তুড়ির কাজ । পয়সা থাকলে বাঘের দুধ মেলে তো - ছোঃ ।

দারোগা সাহেব এবার নিজেই ফুঁসছেন জনতার দিকে চেয়ে, এই মেয়েটা সময় মত থানায় গিয়ে আমাদের না জানালে প্রাণে বাঁচত ওই দুধের শিশুটা ? নিজের প্রাণের কি ভীষণ ঝুঁকি নিতে হয়েছিল বেচারিকে । অথচ বাচ্চাটা তার নিজের পেটের কেউ নয় । এ তো সত্যিকারের একজন সৎ মা মানে অনেস্ট মাদার ।

দুজন গুণ্ডার সঙ্গে এক দড়িতে বাঁধা হয়ে বিকাশ উঠল জীপে । স্টার্ট দেবার আগে একজন কনস্টেবল মিনতির কোলে সৌম্যকে দিয়ে গেল । একটা প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল বেচারি। সৎ মায়ের কোলে মুখ লুকোল ছেলেটা । চিরকালের সেই চেনা একটা আশ্রয়ে দুটো হ্রদয় একসঙ্গে স্পন্দিত হতে লাগল ।

[ একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে । কাগজ ও টিভির রিপোরট থেকে । ]


3 মতামত: