ছোটগল্প - ইন্দিরা দাশ

অন্তর আলোক
ইন্দিরা দাশ



কমলজেঠু আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির সাথে জড়িত। বাবার ওপার বাংলার বন্ধু কমলজেঠু। দেশভাগের পর দুইবন্ধুই পাশাপাশি পথ চলে সহ্য করেছে উদ্বাস্তু জীবনের খাঁখাঁ গ্রীষ্ম দুপুরের দিশেহারা সময়, তারপর তিলতিল করে কাদামাটিতে যেভাবে শেকড় জমায় গাছ, তেমনি করে জীবন-চাকরি-সংসার-সন্তান লালন-পালন। বাবা চলে গেছেন ওপারের পথ ধরে বছরখানেক হোল। শেষ দেখা কমলজেঠুর সাথে বাবারই শ্রাদ্ধশান্তির সময়। প্রবাসে থাকি, রুজি রোজগারের তাগিদে। প্রবাস মানে সাগরপারের ঝাঁ-চকচকে বিদেশ নয়, লখনউ শহরের চাকরির জায়গা। সরকারি চাকরি তাই বেতনের দুশ্চিন্তা পীড়ন কম করে, তবে গাড়ি-বাড়ীর উচ্চাশাও বিশেষ জ্বালায় না। তাই ফাইলপত্তরের ফাঁকে ফাঁকে অল্পবয়েসের বদভ্যাস, লেখার নেশা বছর চারেক ধরে চাগার দিয়ে উঠেছিল, কিছু কবিতার চটি বইএর পর ঠিক করেছিলাম জয়-মা বলে গল্প-উপন্যাসের অথৈপারাবারে ডুব দিয়েই দেখি, প্রকাশ হোল সে যথা সময়ে।

সেবার বর্ষাটা বিশেষ জমল না। কিন্তু অদ্ভুত নিয়মে আকাশে মেঘের দলের রূপবদল হয়ে গেল শুরু, ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা ভেড়ার পাল নীল আকাশের মধ্যে মনে করিয়ে দিল যে শরৎ আসছে। পৈত্রিক সম্পত্তির কিছু দেখাশোনার করতে যেতে হোল কলকাতা অল্পদিনের জন্য। নতুন উপন্যাসের বইটি আর একটি কবিতার বই সুটকেসে ঢুকিয়ে নিলাম কমলজেঠুকে দেখাব বলে। তার কারণ দুটো। ভদ্রলোকের এক সময়ে বেশ একটি প্রেস ছিল, আর ছিল এক পৃথিবী ভালবাসা দাড়িবুড়োর কবিতা গানের জন্য। ছোটবেলায় কখনও ওনাদের বাড়ি গেলে আমায় নিয়ে সাইকেলে সামনে বসিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। একটু মফঃস্বলে মধ্যমগ্রামে বাড়ি ছিল ওনাদের। জেঠিমা যতই চেঁচাতেন – ‘আরে ছেলেটাকে নাওয়া খাওয়া করতে দেবে তো’। কমলজেঠু আর আমি ততক্ষণে মাঠ পেরিয়ে, নীলদীঘির পাশ কাটিয়ে সাঁ-সাঁ ভোকাট্টা ঘুড়ির মত মহানন্দে চলমান। সাইকেলের গতির সাথে সাথে কমলজেঠুর গলা ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও ...’।

কলকাতার কাজকর্ম মিটিয়ে যেদিন কমলজেঠুর বাড়ি গেলাম, তখন দুপুর পেরিয়ে প্রায় বিকেল। দরজা খুলল নবীনদা ... জেঠুর বড় ছেলে। ওপরতলায় জেঠুর ঘরে যেতে যেতে জানলাম, ছোট ছেলে প্রবীণের চাকরীস্থল কুচবিহার। নীচের তলাটিতে দোকানঘর নবীনদাই চালায়। বয়স হলেও কমলজেঠু খুব বৃদ্ধ হননি। লম্বা মানুষটি খালি গায়ে পাজামা পরে তক্তপোশে বসে আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – আমার কাজ, বাড়ি, সংসার, সরমা, বাবলি-বুকাইদের কথা। আর হোল স্মৃতিচারণ ... বাবার সাথে ভাতের মাড় চুরি ঘুড়ির মাঞ্জার জন্য, টাঙ্গাইলের চারাবাড়ির চমচম, বিন্দুবাসিনী স্কুলজীবন আর উপড়ে ফেলা শিকড় নিয়ে যুবক বয়েসের জীবিকার সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, তারপর দুই বন্ধুর দুটি সংসারের ধীরে ধীরে ডালপালা মেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।

সময় পেরিয়ে যায়। জেঠুর হাতে আমার বইদুটো দিয়ে বললাম তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা। অনেক যত্নে কভারএ, পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে গন্ধ শুঁকলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রিন্টিং কেমন লাগছে?’ খুশিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘চমৎকার,

যেমন পরিস্কার হরফ, তেমনি কাগজ, কভার আর্টও তোফা’! জেঠিমা কি কারণে মাথায় কাপড়টা আর একটু টেনে উঠে পড়লেন কে জানে? নবীনদা বলে উঠল, ‘সন্ধ্যের ট্রেনের জন্য সাড়ে পাঁচটার লোকালটাই ভাল রে সন্তু – এরপর ভিড় হয়ে যায়’। জেঠুর থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে দেরী হোল না যে বই পড়ে নিশ্চয়ই জানাবেন মতামত। প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম, সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিলেন কমলজেঠু হাসিমুখে – একবার বললেন, ‘মনে আছে রে সন্তু সেই লাইন ক’খানা তুই আর আমি যে গাইতাম “আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও”’। খুশি হয়ে দু কলি গেয়েও উঠলাম জেঠুর সাথে।

তারপর রওনা। নীচে এসে রিক্সায় ওঠার আগে নবীনদা কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বাবা গতবছর ছানির অপারেশনের পর আর চোখে দেখেনারে সন্তু’। আকাশ থেকে পড়লাম আমি। তার মানে সমস্তটাই স্নেহের অভিনয়! অথচ মুখময় অনাবিল হাসির অভাব তো দেখলাম না। বরং আমিই প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাটা, পে কমিশন, অত্যন্ত স্বল্প ইঙ্ক্রিমেন্ট, মূল্যবৃদ্ধি, বাবলির জন্য পাত্রের খোঁজ, বুকাইয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স না পাওয়া নিয়ে সাতকাহন গেয়ে এলাম।

রিক্সা ঢিমে তেতালায় রওনা দিল স্টেশনের পথে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কমলজেঠু হাসিমুখে কাকে যেন হাত নাড়তে থাকলেন। তার মুখের রেখাচিত্রে যেন শুনতে পেলাম অদ্ভুত মনোবলে, সদানন্দ মানুষটি তখনও গাইছেন, গেয়ে শোনাচ্ছেন, ‘নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও ... মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও’।


4 মতামত:

  1. Ashakori puro golpoti porte perchhen , ami to besh kichhu line shudhui square dekhte pachhi. ... ektu kharap i laglo...Indira Das

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. khub porishkar porete parchhi, kono asubidhei to nei....khubi monograhi lekha...agami te onek porbo, dabi rakhi.
      pujo sonkhyar lekha joto taratari sombhob pathie din, parle 15 th er modhye, jotno niye prokaser upojukto kore tulte ektu besi somoy pabo tahole amra....
      onek onek suvechha janben, khub khub bhalo thakben :)

      মুছুন