সম্পাদকীয়



সম্পাদকীয়ঃ


প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।।
এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস–
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ।।
আমের বনে দোলা লাগে, মুকুল প’ড়ে ঝ’রে–
চিরকালের চেনা গন্ধ হাওয়ায় ওঠে ভ’রে ।
মঞ্জরিত শাখায় শাখায়, মউমাছিদের পাখায় পাখায়,
ক্ষণে ক্ষণে বসন্তদিন ফেলেছে নিশ্বাস–
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ।।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চৈত্র; বাংলা সনের দ্বাদশ ও সমাপনী এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের প্রথম মাস। বসন্তের শেষ। নামটি এসেছে চিত্রা নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে।

চিরনবীন ঋতুরাজের কনিষ্ঠা কন্যা, চৈত্রের বাসন্তী প্রকৃতিতে বকুলে-পারুলে-অশোকে-শিমুলে-পলাশে-কৃষ্ণচূড়ায় রঙের আগুন, মুকুলে মুকুলে মধুকরের গুঞ্জরন, অকারণ কুহুরবে কোকিলের ব্যকুলতা, দিবস-শর্বরী নবপত্রালিকায় নবীন দখিণা সমীরণের আকুলি বিকুলি; কনকচাঁপা আর করবীর সুঘ্রাণী সুমিষ্ট সুবাসে প্রকৃতি মাতাল। কবিচিত্তও আলুলায়িত বিচিত্র প্রেমে পরিপূর্ণ। 

এই বছর এই মাসেই ছিল দোলযাত্রা। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলি মূলতঃ দুই প্রকার - প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি রাধাকৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনী। এগুলি ছাড়াও এই দিনটির একটি ধর্মনিরপেক্ষ তাৎপর্যও আছে। এই দোলপূর্ণিমার দিনটিতেই শান্তিনিকেতনে উদযাপিত হয় বসন্তোৎসব; রঙের উৎসব, সৌভ্রাতৃত্বের উৎসব হিসাবে যা বিশ্ববিখ্যাত।

আদিগন্ত বিস্তৃত বোরো ধানের নয়নাভিরাম গাঢ় সবুজ প্রান্তর আর কচি আমের অপূর্ব সুগন্ধে চারিদিক যতই ম’ ম’ করুক চৈত্র তবুও বেলা শেষের ভগ্ন আসরের সুরমুর্ছনায় দীর্ণ। বছরের সব আনন্দ উৎসব শেষ। কিন্তু কালের রথচক্রে শেষ বলে তো কিছুই নেই!! তাই শূণ্য চৈত্র, রিক্ত চৈত্র বিবর্ণ, জীর্ণ, হতাশার ম্লান স্মৃতিকে ধুয়ে মুছে সুন্দর আগামীর বার্তা নিয়ে আসে বৈশাখের দ্বারে। নতুন বছর আসে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা নিয়ে।। 

চিরনূতনের সেই চিরন্তন আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যা। এই সংখ্যায় থাকছে গানের সুরের জাদুকর শাচীন কত্তাকে নিয়ে লেখা একটি মনোজ্ঞ প্রচ্ছদ নিবন্ধ, তিনটি ভিন্ন স্বাদের প্রবন্ধ, একটি অনুবাদ কবিতাসহ আরো কবিতা, রম্যরচনা, ছয়টি ছোটগল্প, দুইটি ধারাবাহিক, কৌতুক নাটিকা, ফটোগ্রাফি, রঙ ও তুলি, ইত্যাদি। এছাড়া, চিলেকোঠা সরগরম, ছোটোদের পাতা, হাস্যকৌতুক, রান্নাঘরের মতো নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে। 

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আপনাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকাটির মানোন্নয়ণে সহায়তা করবে।


জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।। 



নমস্কারান্তে, 

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ

গানের সুরের রাজপুত্র
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


‘বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের আরম্ভ’ – রবীন্দ্রনাথ । 

গান বাঙালির বড় প্রিয় অবলম্বন । সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, প্রেমে-বিরহে গানই তার শেষ আশ্রয় । “গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আদর করে আপন হাতে আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরী করতে চেয়েছে”। আধুনিক বাংলা গান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলি বলেছিলেন ১৯৩৬ এ ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সংগীতের স্থান’ প্রবন্ধে । বাঙালির গান শোনার কান তৈরী হওয়ার সেটা প্রথম যুগ । গত শতকের তিরিশের দশক - বাঙ্গালির পরিশীলিত সাঙ্গীতিক রুচির শুরুয়াত হয়েছে সবে মাত্র । শুধু সাঙ্গীতিক রুচিই বা বলি কেন ? বাঙালি মননের উর্বর ভূমিতে তখন নানান ধারার সৃষ্টির প্রাচুর্য । বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হয়েছে, রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের বাইরে আধুনিক বাংলা কবিতার পথচলা শুরু হয়েছে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত প্রমুখের প্রবল আবির্ভাবে, বাংলা গানে লালচাঁদ বড়াল, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, আঙ্গুর বালা, কমলা ঝরিয়া, ইন্দুবালা, কে মল্লিকদের যুগ পেরিয়ে এসেছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, যুথিকা রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, জগন্ময় মিত্র, শচিনদেব বর্মণরা । 

তিরিশ থেকে ষাটের দশক ছিল বাংলা গানের ‘সোনার দিন, প্রাণভরে আধুনিক বাংলা গান শোনার দিনও । আর বাংলা গানের সেই সোনার দিনের নির্মাণ যাঁদের হাতে হয়েছিল তাঁদের এক অগ্রজন ছিলেন শচিন দেববর্মণ । আধুনিক বাংলা গানের গায়কীর অনেকটাই তৈরী করে দিয়েছিলেন শচিন দেববর্মণ । হওয়ার কথা ত্রিপুরার রাজা, হয়ে গেলেন আধুনিক বাংলা গানের মুকুটহীন রাজা । ‘সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের কোল’ আজও যে গান তার সুরের মায়ায় আমাদের দুলিয়ে দেয় । 

ইতিহাস বিস্মরণের এই দিনে কতজনই বা মনে রাখি সেই সুরের যাদুকরকে ? আমাদের সংবেদনশীলতা কি ক্ষণিকের জন্যেও চমকে উঠেছিল এই সংবাদ জেনে যে সেই মায়াবী সুরের স্রষ্টার সহধর্মিনী শিল্পী নবতিপর মীরা দেববর্মণের শেষ জীবনের আশ্রয় হবে মুম্বাই শহরতলীর বারো ফুট বাই দশফুট ঘরের এক বৃদ্ধাশ্রমে, যার ত্রিপুরার রাজবধু হওয়ার কথা ছিল ? আর মুম্বাই ফিল্ম জগতে শচিনদেবের অবদান আর নিজেরও প্রতিষ্ঠার মূলে যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশি তাও ভুলে গিয়েছিলেন শচিনদেবেরই পুত্রবধু আশা ভোসলে । সে সময়ে রাহুলদেবও চলে গেছেন । মুম্বাই ফিল্ম জগতও চমকে ওঠেনি । বৃদ্ধাশ্রমের কতৃপক্ষও জানলেন কে এই বৃদ্ধা, যখন মীরাকে সম্মানিত করার কথা জানিয়ে ত্রিপুরা সরকারের চিঠি তাদের ঠিকানায় পৌছেছিল । 

শচিনদেবের জন্ম কুমিল্লাতে । পিতা ঈশাণ চন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে চলে আসেন কুমিল্লাতে । সেখানেই জন্ম শচিনদেবের । বাল্য ও কৈশোরে দিনগুলো কাটে কুমিল্লাতেই, কলেজ শিক্ষাও । পিতা চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার পর পুত্র আগরতলায় ফিরে এসে রাজকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন , কিন্তু শচিন আবদ্ধ হলেন সুরের মায়ায় । চেতনায় তখন ত্রিপুরার বাঁশের বাশি, ভাটিয়ালির সুর, মাঝিমাল্লাদের জীবন ও জীবিকার সুর, গোমতী নদীর অপরূপ ছন্দ, কুমিল্লার গাছ-গাছালি, নদী-নালা আর মাঝি-মাল্লাদের মাটির গন্ধমাখা সুর । জীবন সায়াহ্নে শচিনদেব আত্মকথায় বলেছিলেন “কেন জানিনা জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলেই থাকতে ভালোবাসতাম । আর বড় ভালো লাগত সেই সহজ সরল মানুষগুলোকে, গুরুজনরা যাদের সাধারণ লোক। যাইহোক, অসাধারণের দিকে না ঝুঁকে আমি ওই সাধারণ লোকের মাঝেই নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে এক হয়ে গেলাম শৈশব থেকেই”(‘শচিন কর্তা’/পান্নালাল রায়) । 

আসলে শচিনদেবের সঙ্গে কুমিল্লার সংস্পর্শ না বললে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা সম্পূর্ণ হয় না । আগরতলা তাঁকে দিয়েছিল পারিবারিক আভিজাত্য, কুমিল্লা দিয়েছিল সুর আর বাকি জীবনের চলার ছন্দ, কলকাতা দিয়েছিল শচিনদেবের প্রতিষ্ঠা আর মুম্বাই দিয়েছিল যশ ও খ্যাতির আকাশ । ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত আত্মকথায় তিনি নিজেই লিখেছিলেন “খতিয়ে দেখলে আমার এ জীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায় । শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনা গোমতী নদীর তীরে কুমিল্লায়, যৌবনের উন্মত্ততা ভাগীরথীর তীরে কলকাতায় – যা জীবনে প্লাবন এনে দিয়েছিল এবং প্রৌঢ়ত্বের ছোঁয়া দিল আরব সাগর - এই মুম্বাইতে । রাজ পরিবারের আভিজাত্য গায়ে মেখেও শচিনদেব মাটির প্রতি মমত্ব বোধ আর মাটির গন্ধমাখা সুর আহরণ করে আধুনিক বাংলা গানের পথচলার কায়দাটাই যেন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন । কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রথম গান গাইলেন ১৯২৫এ, তখন সবে কলকাতা বেতারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯২৪এর অগস্ট মাসে । শচিনদেবের প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হল ১৯৩২এ হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে । তাঁর কিছুটা আনুনাসিক কন্ঠস্বরের জন্য প্রথমে তখনকার মুখ্য রেকর্ড কোম্পানী এইচ এম ভি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল । হিন্দুস্থান থেকে প্রথম রেকর্ড প্রকাশের পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি । 

ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান হওয়ার পারিবারিক আভিজাত্য শচিনদেবের শিল্পী হয়ে ওঠা বা প্রতিষ্ঠায় অনুঘটকের কাজ করেনি বিন্দুমাত্র, বরং কিছুটা অভিমানই ছিল রাজ পরিবারের প্রতি । ১৯৪৪এ স্থায়ীভাবে মুম্বাই চলে যাবার পর ত্রিপুরার প্রতি ভালোবাসার টান থাকলেও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হতে থাকে । ১৯৪৬এর পর শচিনদেব আর আগরতলায় যাননি । কোন রাজপরিবারের আভিজাত্যের ছাপ না থাকা মীরা দাশগুপ্তাকে বিবাহ আগরতলায় তাঁর পরিজনরা মেনে নেয় নি । তাঁর অভিমান ও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো এটাই । সহধর্মিনী মীরার সঙ্গীত শিক্ষার প্রথম পাঠ শান্তি নিকেতনে, পরে শচিনদেবের কাছেই সঙ্গীত শিক্ষা । কলকাতায় থাকা কালীন ১৯৩৮এর ফেব্রুয়ারিতে শচিনদেব বিবাহ করেন ছাত্রী মীরাকে । মীরা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে অমিতা সেনের কাছে নাচ ও অনাদি দস্তিদারের মত মানুষের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখেছিলেন । নিজে গানের রেকর্ড করেছিলেন এবং শচিনদেবের সহকারী ছিলেন, নিজেও মুম্বাইতে ফিল্মএ গান করেছেন, লিখেছেনও অনেক গান ।

এক আশ্চর্য সাঙ্গীতিক আভিজাত্যের মোড়ক তাঁকে মর্যাদা মন্ডিত করেছিল । কৃষ্ণ চন্দ্র দের কাছে গান শিখেছিলেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে । হিন্দি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনায় গগনচুম্বি খ্যাতি পেয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে এক মর্যাদামন্ডিত ‘ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে দেননি কাউকে, কলকাতার শহুরে বাংলা’ ভাষাও রপ্ত করার কোন চেষ্টা করেন নি , ভোলেননি কুমিল্লার ভাষাভঙ্গি । “সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল” এ শুধু তাঁর গানের পংক্তি নয়, আশ্চর্য বৈভব মন্ডিত শচিনদেবের সঙ্গীত জীবনের চলার ছন্দ । আবার এপার বাংলার প্রতি অনেক অভিমানও ছিল শচিনদেবের । বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক নারায়ন চৌধুরীকে বলেছিলেন “... আজ যদি কেউ আমাকে কলকাতা থেকে প্রস্তাব করে পাঠাত, তোমাকে পাঁচশো টাকা করে মাসোয়ারা দেব, তুমি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসো, আমি তন্মুহুর্তে মুম্বাই-এর তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতা চলে আসতুম – আবার সেই পুরনো দিনের মত গানে গানে মেতে উঠতুম’ । জীবন সায়াহ্নে নিজের উপলব্ধি লিখে গেছেন তিনি “নিজের শুধু এই পরিচয় যে আমি বাংলা মায়ের সন্তান এবং আমার সুরসৃষ্টি সমগ্র ভারতবাসীর সম্পদ – আমার সুর ভারতবর্ষের প্রতীক” (সূত্রঃ’ শচিন কর্তা’/পান্নালাল রায়) । 

শচিনদেব প্রথম গানের রেকর্ড করেন ১৯৩২এ আর শেষ গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৬৯এ । এই দীর্ঘ ৩৭ বছরে শচিনদেব রেকর্ডে বাংলা গান গেয়েছেন মাত্র ১৩১টি । ১২৭টি একক এবং ৪টি দ্বৈত কন্ঠে স্ত্রী মীরার সঙ্গে । এর একটা কারণ শচিনদেব অন্যের সুরে গান প্রায় গাইতেনই না, এবং নিজের পছন্দ মত গীতিকার ছাড়া অন্যের গীত রচনাতেও গান গাইতেন না । বাংলা গানের জগতে শচিনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ঘটনায় আরো দুজন মানুষের কথা একই সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন – তারা হলেন শচিনদেবের কুমিল্লার সাথী সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য । তাঁর গাওয়া ১৪১টি বাংলা গানের মধ্যে সুরসাগর হিমাংশু দত্তর সুরে ৮টি, কাজী নজরুলের সুরে ৬টি ছাড়া সব গানই গেয়েছিলেন নিজের সুরে । শচিনদেবের বেশিরভাগ লোকপ্রিয় গানের গীত রচনা করেছিলেন অজয় ভট্টাচার্য । আধুনিক বাংলা গানের গায়ন শৈলীতেই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন । শুধুমাত্রে ঈষৎ আনুনাসিক ও দরাজ কন্ঠস্বরের জন্যই নয়, বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় আত্মীয়তার ফলে বাংলার লোক সুর আর মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে মিশে তাদের সুর তুলে এনেছিলেন আর আশ্চর্য দক্ষতায় শাস্ত্রীয় সুরের সঙ্গে মাটির সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা গানকে দান করেছিলেন অপার ঐশ্বর্য । শচিনদেব তাঁর জীবন কথায় লিখে গেছেন “১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত এই ৫/৬ বছরে লোকসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সংমিশ্রনে নিজস্ব ধরণের সুর রচনা করলাম – যা অন্য কারো সঙ্গে মিললো না । এইভাবে আমি আমার নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম”(সূত্র- ‘শচিনকর্তা’/পান্নালাল রায়) । এই পর্বে ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’(১৯৩৬), কিংবা ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ (১৯৪০)র মত রাগাশ্রয়ী আধুনিক গান কিংবা লোক সুরের মিশ্রণে ‘সেই যে বাঁশি বাজাবার দিনগুলি’(১৯৫১), ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে’(১৯৫১), কিংবা ষাটের দশকের শেষ দিকে রেকর্ড করা ‘মন দিল না বধু’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা’ এখনো গানপ্রিয় বাঙালির হৃদয়ে দোলা দেয় । অথচ আমাদের অপার বিস্ময় বাংলা ছায়াছবি শচিনদেবের সুরের ঐশ্বর্য প্রায় বর্জনই করেছিল । ১৯৩২এ বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর ১৯৩৮এর মধ্যে মাত্র ৫/৬টি বাণিজ্যিক ভাবে অসফল বাংলা ছায়াছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন ।

একথাও মনে করা যেতে পারে যে শচিনদেবের সাঙ্গীতিক রুচি ও আভিজাত্য সেকালের ছায়াছবির জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি । তিনি অন্যের সুরে গান করতেন না । সঙ্গীত পরিচালক অন্য কেউ হলেও তাঁর গীত গানের সুর তিনি নিজেই করতেন । শুধুমাত্র একটি ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে একটি গান করতে সম্মত হয়েছিলেন । আর একটি সর্ত থাকত তাঁর, তাঁর গাওয়া গান ছবির কোন চরিত্রের কন্ঠে থাকবে না, শুধুমাত্র নেপথ্য দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে গীত হবে । কিন্তু ক্ষতি যে বাংলা চলচ্চিত্রের হয়েছিল তাতে সংশয় নেই । বাংলা ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসাবেও শচিনদেব কোন সুযোগ পাননি । ১৯৩২এ বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর দুটি অসফল ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, তারপর কোন প্রযোজক, পরিচালক তাঁকে ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ দেন নি । কোন ডাক না পেয়ে কিছুটা অভিমান নিয়েই বাংলা ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন । ১৯৪২এ মুম্বই যাওয়ার প্রথম ডাক পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । চেয়েছিলেন বাংলাতেই থাকার । কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র জগত থেকে কোন ডাক না পেয়ে অভিমানাহত হয়ে ১৯৪৪এ মুম্বাই চলে গেলেন পাকাপাকি ভাবে । ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আত্মকথনে (মার্চ ১৯৬৯) শচিনদেব লিখেছিলেন “বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করার আকাঙ্খা ছিল খুব । কিন্তু কোন সুযোগই পাচ্ছিলাম না ......। কোথাও কোন চলচ্চিত্র সংস্থা আমাকে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ না দেওয়াতে মনে খুবই দুঃখ হয়েছিল” । তাই ১৯৪৪এ দ্বিতীয়বার যখন মুম্বাই থেকে ডাক পেলেন, আর ফিরিয়ে দিলেন না ।


তারপর হিন্দি সিনেমার গান তাঁর সুরের জাদুতে কি অসামান্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল তা তো ইতিহাস হয়ে আছে । মুম্বাই সিনেমার গান ঐশ্বর্যময়ী হয়ে উঠলো বাংলার মাটির সুরের স্পর্শে আর বাংলা ছায়াছবি কোন শচিনদেবের ছোঁয়া পেল না । কিন্তু যেটুকু পেয়েছে বাংলা সঙ্গীত জগত তাই বা কম কি ? শচিনদেব চলে গেছেন আজ প্রায় চার দশক হ’ল(মৃত্যু- ৩১ অক্টবর ১৯৭৫)। বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারে যে ১৩১টা গান রেখে গেছেন শচিনদেব, আজও সব প্রজন্মের মানুষ অবাক বিস্ময়ে শোনেন, দোলায়িত হন তাঁর সুরের মায়ায় ।

প্রবন্ধ - অমিতাভ প্রামাণিক


















প্রবন্ধঃ

সুকুমার রায়ের কবিতা - অনন্য হাস্যরস
অমিতাভ প্রামাণিক


যে কোন বালখিল্যের কাছে ফটোগ্রাফি একটা অত্যন্ত সহজ কাজ। শুধু একটা ক্যামেরা হলেই চলে। সে সেটাকে বাগিয়ে ধরে চোখের সামনে থাকা যে কোন মানুষ, গরু-কুকুর-বাঁদর আদি মনুষ্যেতর প্রাণী বা আকাশ-নদী-ফুল-পাথর জাতীয় প্রকৃতির অংশবিশেষকে তাক করে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে বিজ্ঞের মত শাটার টিপে দেয়। ব্যাস, ক্যামেরাটা ডিজিট্যাল হলে – আর আজকাল তো সব ক্যামেরাই ডিজিট্যাল – ছবি উঠে গেল। ক্যামেরার লেন্সটার সামনে ঢাকনা থাকলে সেটা খুলে শাটারটা টিপলে সাধারণতঃ ছবিটা আর একটু ভালো ওঠে। অর্থাৎ যে কেউ ফটো তুলতে পারে, মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা নেই।


হায়, ট্যাঁশগরু গরু নয়, সব কবি কবি নয়, ফটো তুললেই ফটোগ্রাফার হওয়া যায় না।


কিন্তু না, ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে জ্ঞান দেওয়ার কোন অভিপ্রায় আমার নেই, আমি নিজেই চার অক্ষরের এই শব্দটার প্রথম ফ’ও জানিনে। তা সত্ত্বেও কোন ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে’, আর সেটা চোখ-কান দিয়ে মাথার ভেতরে ঢুকে আমার অবচেতন মনের অনেকগুলো ফোকরে একেবারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছে, তা এক্কেবারে হলফ করে বলতে পারি।


‘আবোল তাবোল’ নামের কবিতার বইতে যখন এই কবিতাটা পড়েছিলাম, বয়সে চুনো হলেও এটুকু বুঝেছিলাম যে ফুটোস্কোপ বলে কিছু নেই, আর মুণ্ডুর ভেতরে সেঁধিয়ে কিছু খুঁটিয়ে দেখার জন্য কবিতার পাশে সাঁটানো ছবিটার মত কোন যন্ত্র নিতান্তই অক্ষম। নির্মল হাস্যরস ঐ বইটার সবকটা কবিতার আসল রেসিপি। বাংলা সাহিত্যে এই ধরণের কবিতার সম্ভবত এই বইটাই প্রথম উদাহরণ। আজ অবধি এর সার্থক কোন উত্তরাধিকারীও আসে নি। ক্ষণজন্মা সুকুমার রায় মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে কালাজ্বরে ভুগে পরলোকগমন করেন। আরও ছত্রিশ বছর কবিতা লিখতে পারলে তাঁর কলম থেকে যে কী চিজ বের হত, তা নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।


কবি নিজে এর ধরণকে খেয়াল রস বলেছিলেন, আবোল তাবোল বইয়ের মুখবন্ধে এক কৈফিয়তে তিনি কবিতাগুলো সর্বজনগ্রাহ্য নাও হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। এখন একে ‘ননসেন্স’ বলা হয়, বাংলায় কী বলা যায়, আজগুবি? সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ ‘সুকুমার সমগ্র’ প্রকাশকালে বইটার ভূমিকায় বাবার রচনার অত্যন্ত মনোগ্রাহী আলোচনা ও বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে তার সুন্দর মূল্যায়ণ করেছেন।


মাত্র আট বছর বয়সে শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত মুকুল পত্রিকায় ‘নদী’ নামের একটা কবিতা প্রকাশিত হলেও সত্যজিতের আলোচনা থেকে জানা যায়, সুকুমার ছাত্রাবস্থায় বিশেষ সাহিত্যচর্চা করেন নি। ১৯১৩ সালে বাবা উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকা বের হওয়ার সময় থেকেই ছাব্বিশ বছর বয়সে সুকুমারের মূল সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ ও বিকাশ। মাত্র দু’ বছর যেতে না যেতেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হলে সেই দায়ভার সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। অকালমৃত্যুতে তাঁর সাহিত্যক্রীড়া শেষ হয় মাত্র দশ বছরের পরিসরেই। তার মধ্যে রোগশয্যায় শেষ আড়াই বছর বিশেষভাবে সৃজনশীল। 


কবিতা, ছোটগল্প, সঙ্গীত, নাটিকা, প্রবন্ধ ও শব্দের ধাঁধাঁ নিয়ে তাঁর প্রভূত কারবার। কবিতাগ্রন্থে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘আবোল তাবোল’, কাহিনীসংকলনে ‘পাগলা দাশু’ আর নাটিকায় ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। ‘খাই খাই’ ও ‘হ-য-ব-র-ল’, ‘শব্দকল্পদ্রুম’, ‘অবাক জলপান’ ইত্যাদিও তাঁর অনবদ্য ও ভীষণ জনপ্রিয় রচনাসংগ্রহ। 


আসা যাক সুকুমারের কবিতায় দমফাটা হাসির উৎস সন্ধানে। এই হাসি পেটে কাতুকুতু দিয়ে হাসানো নয়। আবোল তাবোলের প্রত্যেকটা কবিতাতেই হাস্যরস তৈরীর অসাধারণ সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আমি এই সৃজনশীলতাকে চারটে আলাদা আলাদা প্রকারের উপাদানের সমন্বয় বলব। এরা হল -

(ক) আজব যতসব প্রাণীসকলের সৃষ্টি,

(খ) মানুষের উদ্ভট খেয়াল,

(গ) হাস্যকর প্রযুক্তির অসামান্য কল্পনা, আর 

(ঘ) প্রাকৃতিক সাধারণ ঘটনাকে অনন্য অব্যয়ে প্রকাশ। উদাহরণ দেওয়া যাক এক এক করে।


প্রথমে আজব প্রাণী। তার আগে বলে নিই, বাংলা সাহিত্যে অভিনব প্রাণীর ব্যবহার কিছু নতুন নয়। রূপকথা থেকে শুরু করে পুরাণের পাতায় পাতায় অনেক রকম প্রাণীর বর্ণনা আছে, শিশুসাহিত্যে তো বটেই। রাক্ষস-খোক্কস, পক্ষীরাজ ঘোটক, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী পক্ষীদম্পতি, হনুমান নামের বানর ও জাম্বুবান নামের ভল্লুক, সর্পরাজ বাসুকি ও পক্ষীকুলশ্রেষ্ঠ গড়ুর, ময়দানে ডিম্বপ্রসবিনী হাট্টিমাটিমটিম, খুকুর বিয়েতে কনেযাত্রী হিসাবে কটিতটে বন্ধনী নিয়ে প্রস্তুত হুলো মার্জার, সোনামণির বিয়েতে নৃত্যরত হস্তী-অশ্ব সম্প্রদায়, তন্তুবায়ের গৃহে বসবাসকারী খাদ্যে পুষ্ট ও গায়ন-রত কোলা ভেক-এর সন্ততি, কী নেই! কিন্তু সুকুমার এদের সবার চেয়ে আলাদা। ‘খিচুড়ি’-তে দুটো প্রাণীকে স্রেফ শব্দ দিয়ে ব্রীডিং করে – মানে একটার নামের শেষ আর আরেকটার নামের প্রথম অংশ সমান, সেটাকে জুড়ে দিয়ে – উদ্ভট নতুন প্রজাতির সৃষ্টি, তাদের নাম হাঁসজারু, বকচ্ছপ, গিরিগিটিয়া, সিংহরিণ, হাতিমি, বিছাগল, মোরগরু, জিরাফড়িং। রামগড়ুর রাম নামের পক্ষীকুলশ্রেষ্ঠ প্রাণী নয়, বরং মনুষ্যসদৃশ একজন, যার হাসি ব্যান্‌ড্‌। ট্যাঁশগরু গরু-ই না, একটা পাখি, যার দর্শনপ্রাপ্তি সম্ভব হারুদের আপিসে। হুঁকোমুখো হ্যাংলা-র হ্যাংলামির কোনো নিদর্শন নেই, সে তার দুটো পুচ্ছ নিয়ে নাস্তানাবুদ, কোনো দুষ্ট মাছি সেই লেজ দুটোর ঠিক মধ্যিখানে বসলে কোন লেজ দিয়ে মেরে তার জীবনহানি সম্ভব, সেই বিশেষ সমস্যাটা নিয়ে। কুমড়োপটাশ সেই রকম এক বিচিত্র প্রাণী, সে যে কাজটাই করবে তাতেই আমাদের বিপদের আশঙ্কা, তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিচিত্র বিধান দিয়াছেন কবি। যথা, সে কান্না জুড়লে ছাদে উপবেশন নিষিদ্ধ, লেপ-কম্বল কাঁধে নিয়ে মাচায় উপুড় হয়ে শুয়ে বেহাগ-সুরে রাধাকৃষ্ণের স্তুতি করা সঙ্গত। কিম্ভূত কিমাকার অন্য একটা বিদঘুটে জন্তু, তার আবদারের শেষ নেই, কোকিলের সুর, পক্ষীর ডানা, হস্তীর দন্ত, সিংহের কেশর, ক্যাঙ্গারুর মত লম্ফবান পদ, গোসাপের মত পুচ্ছ, সে ব্যাটার সব চাই। এই বিচিত্র আইডিয়াগুলোই হাসির দমক এনে দেয়।


আজগুবি মনুষ্যেতর প্রাণীসৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের আজগুবি খেয়াল তাঁর হাস্যরসের আর একটা অন্যতম উপাদান। ‘সৎপাত্রে’ এমন এক পাত্রের অবতারণা, যার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেয়ে মেয়েকে কলসী-দড়ি বেঁধে জলে ডুবিয়ে দেওয়াও শ্রেয়, এমনই হাস্যকর সেই পাত্রের ভাইট্যাল ও অন্যান্য স্ট্যাটিস্‌টিক্স। তার গাত্রবর্ণ, ফেস কাটিং, অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন, পয়সাকড়ি মানে ইকনোমিক স্ট্যাটাস, স্বাস্থ্য, সহোদরদের বৃত্তান্ত জানলে যে কেউ ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে, কিন্তু গঙ্গারাম যে উঁচু বংশের ছেলে। আজকের দিনের এম এল এ বা এম পি-দের কোরাপ্ট চ্যাংড়া ছেলেদের ইকুইভ্যালেন্ট! সুতরাং পাত্র হিসাবে বেজায় ‘সৎ’! ‘গোঁফচুরি’তে রহস্যময় ভাবে ঝিমোনো বড়বাবুর মোচ উধাও, নাকি উধাও না! আয়নায় নিজের গোঁফ দেখে বড়বাবুর বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা তার হতে পারে, কেননা – ‘নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা, এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা’! ‘কাঠবুড়ো’তে বিচিত্র কাষ্ঠতত্ত্ববিদ সৃষ্টি, দাড়িওলা এক বুড়ো, যে কিনা রোদে বসে ভিজে কাঠ সিদ্ধ চেটে খায়! তার থিয়োরীর কাছে কোথায় লাগে নিউটন-আইনস্টাইনের তত্ত্ব – ‘আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত’!‘একুশে আইন’-এ বিচিত্র দন্ড, সব কিছু একুশ খানা, সে জরিমানার টাকাই হোক, বা হাঁচির সংখ্যা, সেলাম করানো বা দুপুর রোদে ঘামিয়ে কত হাতা জল গিলতে হবে তার বিধান, কত পাতা হিসেব বা কত ঘন্টা ঝুলে থাকার শাস্তি! ‘কাতুকুতু বুড়ো’ তেমনি আজগুবি গল্প শোনায়, যেগুলো শুনলে নাকি ‘হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি’। ভীষ্মলোচন শর্মার গানের গুঁতোয় লোকের মাথা বনবন ঘুরতে থাকে, কেউ জখম হয়, কেউ মরেও যায়! শুধু মানুষ না, যাবতীয় জীবজন্তুও, সে ডাঙার হোক, বা জলের। একমাত্র শিং-ওয়ালা এক পাগলা ছাগল তাকে ঠান্ডা করতে পারলো। লড়াই ক্ষ্যাপা পাগলা জগাই, ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলা প্যালারাম বিশ্বাস, বিচিত্র বোম্বাগড়ের রাজা-রানী-মন্ত্রী-ওস্তাদ-পণ্ডিত, আদ্যানাথের মেশোর খোঁজ করা সেই ব্যক্তি যে ‘খুব সহজে’ বুঝিয়ে দেয় আদ্যানাথ কে, ডানপিটে সেই ছেলে যে ‘হামা দিয়ে আলমারি চড়ে, খাট থেকে রাগ করে দুমদাম পড়ে’, এদের কথা যতবার পড়া যায়, ততবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে হয়। আহ্লাদী-তেও সেই হাসির খোরাক, বিনা চশমাতে পান্তভূতের জ্যান্ত ছানাদের কাজ কারবার পরিদর্শন, হাত দেখিয়ে অমায়িক শান্ত বুড়ো নন্দখুড়োর বেবাক পরিবর্তন, মন্ত্রীর জামার গন্ধ শুঁকতে অনিচ্ছুক তাবৎ লোকের আজব বাহানা, আইডিয়া কিছু ঘুরঘুর করতো সুকুমারের মাথায়! সেই যে নোটবই, যাতে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে ‘আঙুলেতে আঠা দিলে কেন লাগে চটচট, কাতুকুতু দিলে গরু কেন করে ছটফট’, অথবা ‘তেজপাতে তেজ কেন, ঝাল কেন লঙ্কায়, নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়’, সেটা দেখার এক প্রবল ইচ্ছা জাগে না কী? এই যে টিভি জুড়ে ডব্লিউ ডব্লিউ এফের এতো নাচন কোঁদন দেখায় এখন, এরা কেউ কি ষষ্ঠিচরণের নখের যোগ্য, যিনি খেলার ছলে যখন তখন হাতি লোফেন, বা ওপর থেকে দৈববশে যার মাথায় ইঁট এসে পড়তেই - না, তার মুন্ডুটা না - ইঁটটা ধুলোর মত গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যায়? এ সবের প্রত্যেকটার বর্ণনা যে কোন রামগড়ুরের ছানাদেরও পেট থেকে হাসি টেনে এনে বার করে দেবে। 


স্মরণ রাখা উচিৎ, সুকুমার ছিলেন পদার্থ ও রসায়নশাস্ত্রে ডাবল অনার্স এবং মুদ্রণ প্রযুক্তির বিশারদ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর রচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে বিচিত্র প্রযুক্তির সমাহার। ‘খুড়োর কল’-এ পাঁচ ঘন্টার রাস্তা দেড় ঘন্টায় অতিক্রম করার অদ্ভুত প্রযুক্তি। 

‘বলব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা,
ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা।
সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যে রকম রুচি –
মন্ডা মিঠাই চপ কাটলেট খাজা কিংবা লুচি।
মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে,
মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে’।

আহা, আজকের এই ওবেসিটির যুগে লোকজন জিমে গিয়ে ফালতু ট্রেডমিলে দৌড়ানোর ভান করছে। এ রকম খুড়োর কল পেলে তাদের যে কী পোয়াবারো হত তা বলাই বাহুল্য। 


তারপর ছায়া ধরার ব্যবসাদারের হরেক রকম ছায়াবাজি ব্যবসার ফন্দি।

‘আষাঢ় মাসের বাদ্‌লা দিনে বাঁচতে যদি চাও,
তেঁতুল গাছের তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও।
মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া ব্লটিং দিয়ে শুষে
ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে’। 

-এই সব বিচিত্র ছায়ার ছায়াছবি কেমন হবে, বোঝাই যাচ্ছে।


সদাহাস্যবদনী চালভাজা ও মুড়িপ্রেমিকা সেই বুড়ির অদ্ভুত বাড়ি বানানোর টেকনোলজিটা মনে আছে? ‘কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর – আঠা দিয়ে সেঁটে, সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে’! আর সেই হাতুড়ে ডাক্তার, যার ‘কয়েছেন গুরু মোর, ‘শোন শোন বৎস, কাগজের রুগী কেটে আগে কর মক্‌স’’! অথবা ‘পাঁচখানা কাটলেট, লুচি তিন গন্ডা, গোটা দুই জিবেগজা, গুটি দুই মন্ডা’ চুরি হয়ে যাওয়ার পর চোর ধরার সেই বিচিত্র ব্যবস্থা! বিজ্ঞান শিক্ষায় ফুটোস্কোপ দিয়ে মগজের অন্দরমহলের তত্ত্বতালাশ, আবার এক কিতাবের বর্ণনা, যেখানে চাটনি-পোলাও-সাবান-কালি-দাঁতের মাজন আদি সবকিছুর প্রযুক্তি দেওয়া আছে, কিন্তু কী মুস্কিল! পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করলে কেমন করে তাকে ঠেকানো যায়, তার বিধান দেওয়া নেই!


এত যে সায়েন্স ফিকশন আমরা পড়ি, তার কোনোটা কি এ রকম হাসির খোরাক দিতে পারে?


পরিশেষে সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাকে অসাধারণ হাস্যকর বর্ণনায় উপস্থাপন সুকুমারে আর এক মারকাটারি স্টাইল। শব্দ কল্প দ্রুমের ‘ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা’ অথবা ‘চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? -গব্‌ গব্‌ গবা-স্‌' এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তেমনই ‘ফসকে গেল’-তে ‘ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি পড়্‌ পড়্‌ পড়্‌বি পাখি–ধপ্‌’, ‘গল্প বলা’-তে ‘থোও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি / আচ্ছা বল চুপ্‌ করেছি’, ‘হুলোর গান’-এ ‘চুপ্‌চাপ চারিদিকে ঝোপঝাড়গুলো- / আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো’-তে বর্ণনা অনবদ্য। আবার ‘আহ্লাদী’-তে ‘ভাবছি মনে, হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ করে / ভাবতে গিয়ে ফিকিফিকিয়ে ফেল্‌ছি হেসে ফ্যাক্‌ করে’-তে ফ্যাক্‌ করে শব্দবন্ধটা,‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’-এ ‘এই দেখ না চাঁদ্‌নি রাতের গান এনেছি কেড়ে / দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম! দেড়ে দেড়ে দেড়ে’তে শেষ অংশটা বা ‘আসল কথা বুঝছ না যে, করছ না যে চিন্তা / শুনছ না যে গানের মাঝে তবলা বাজে ধিন্‌তা’তে ধিন্‌তা-র ব্যবহারে অনাবিল হাসির উদ্ভব। ‘ভূতুড়ে খেলা’-তে ‘শুনতে পেলাম ভূতের মায়ের মুচ্‌কি হাসি কট্‌কটে / দেখছে নেড়ে ঝুন্টি ধরে বাচ্চা কেমন চট্‌পটে’তে কট্‌কটে হাসি কী রকম হতে পারে, তা ভাবার বিষয়। ‘কাতুকুতু বুড়ো’-তে একই রকম ‘অষ্টপ্রহর গাইত পিসী আওয়াজ করে মিহি / ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম্‌ বাকুম্‌ ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি’র বর্ণনা শুনলে অতীব গোমড়ামুখো মানুষও না হেসে পারবে না। ডানপিটে ছেলেদের কাহিনী ভুলে যাওয়া কঠিন, কেননা ‘আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে / কপ্‌ কপ্‌ মাছি ধরে মুখে দেয় তুলে’ আর ‘সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে / রেগে তাই দুই ভাই ফোঁস্‌ ফোঁস্‌ ফোলে’। নারদ নারদ-এর প্রত্যেক লাইনই অসামান্যঃ ‘ক্যান রে ব্যাটা ইস্‌টুপিড / ঠেঙিয়ে তোরে কর্‌ব ঢিট’ বা ‘ডোন্ট পরোয়া অল্‌ রাইট / হাউ ডুয়ুডু গুড্‌ নাইট’। এই ধরণের বর্ণনা অজস্র কবিতায়, এমনকি অনামা একটি পাদপূরক ছড়াতেও,‘ধুপধাপ বাপ্‌ বাপ্‌ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা / বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা’। এটা সুকুমারের এক অনন্য ধরণ। 


রবীন্দ্রনাথ সুকুমার সম্বন্ধে বলেছেন, “সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তাঁর ভাবসমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেইজন্যেই তিনি তার বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে। কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীয় রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল-মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল”।


প্রশ্ন করা যেতেই পারে, প্রায় এক শতাব্দী হতে চলল, এর পুনর্নিমাণ সে রকম কেন হল না? হাস্যরসের চর্চা যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা তো নয়। রম্যরচনা বলে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির প্রয়াস অনেক কালের। ছন্দ নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, এখনও করছেন। কবিতা তো কিছু শব্দসমষ্টি নিয়েই রচনা, বাংলা শব্দভাণ্ডার দিন দিন পুষ্ট হচ্ছে অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ তুলে নিয়ে। তবু নির্ভেজাল সুকুমারী হাস্যরসের পরবর্তী উদাহরণ খুঁজতে গেলে ফুটোস্কোপের কেন প্রয়োজন?


‘শব্দকল্পদ্রুমে’ বৃহস্পতির দশ লাইনের মন্ত্র থেকে প্রথম দুটো আর শেষ দুটো লাইন নিয়ে দ্রিঘাংচু-র মন্ত্র। দ্রিঘাংচু’র চার লাইন সবাই জানে, কিন্তু সমস্ত দশ লাইনই স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাকঃ 



হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাটকেল চিৎপটাং
গন্ধগোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি
নন্দী ভৃঙ্গী সারেগামা
নেই মামা তার কানা মামা
চিনে বাদাম সর্দি কাশি
ব্লটিং পেপার বাঘের মাসি
মুশকিল আসান উড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি


এই মন্ত্র প্রসঙ্গে সত্যজিৎ বলেছেনঃ ‘খাঁটি ননসেন্সের এর চেয়ে সার্থক উদাহরণ পাওয়া মুশকিল। কোথায় বা কেন যে এর সার্থকতা, এই অসংলগ্ন অর্থহীন বাক্যসমষ্টির সামান্য অদল বদল করলেই কেন যে এর অঙ্গহানি হতে বাধ্য, তা বলা খুবই কঠিন। এর অনুকরণ চলে না, এর বিশ্লেষণ চলে না এবং জিনিয়াস ছাড়া এর উদ্ভাবন সম্ভব নয়’।


সম্ভবতঃ এই শেষ কথাটাই সুকুমারী হাস্যসাহিত্যের পুনর্নিমাণের পথে এক বড়সড় বাধা। রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎসহ বহু সাহিত্যিক শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন, অনেকেই অত্যন্ত গুণী ও সফল। কিন্তু তাঁরা কেউই সম্ভবতঃ সুকুমারের উত্তরসূরী নন।


বালখিল্যের ফটোগ্রাফি দিয়ে শুরু করেছিলাম। বালখিল্যের মতো আমিও ভেবেছিলাম – আরে, এ আর এমন কী, এমন মন্ত্র আমিও রচনা করতে পারি। খাতা পেনও লাগে নি, মুখে মুখে চার লাইন বানিয়ে ফেললাম ফটাফট –



ভিজে গামছা চিটেগুড়
পাটলিপুত্র মধুপুর
বুড়ো হাবড়া সরু থোড়
গা ছমছম গরুচোর 


কিন্তু ফুটোস্কোপ ছাড়াই স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে, এটা একেবারে অন্ধ অনুকরণ মাত্র, এরমধ্যে এক ছটাকও নিজস্বতা নেই। আর নিজস্বতা ছাড়া হাওয়াই চটি সেলাই চলতে পারে, সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়।


ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে আজকের আলোচনায় ইতি টানব। সুকুমারের বাবা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষে ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণ শিল্পের এক উজ্জ্বল তারকা। খ্যাতনামা ব্রিটিশ প্রিন্টিং জার্নাল 'পেনরোজ অ্যানুয়াল'-এ নিয়মিত প্রকাশিত হত উপেন্দ্রকিশোরের প্রবন্ধ, বিষয়বস্তু রঙীন ছাপার মান উন্নয়ন। ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ছাপাখানা ছিল কারিগরি দক্ষতায় দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ। রঙীন হাফটোন ব্লক প্রিন্টিংযে তিনি প্রভূত গবেষণা করে ছাপার মান উন্নয়ন করেছিলেন, এবং এই প্রযুক্তিতে তাঁর নিজস্ব পেটেন্ট ছিল। ১৯১১ সালে সুকুমার ফটোগ্রাফিতে উন্নত শিক্ষালাভের জন্য গুরুপ্রসন্ন স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যান্ড যান ও পরের বছর রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন। বাবার মত তিনিও পেনরোজ অ্যানুয়ালে 'Halftone Facts Summarized' আর 'Standardizing the Original' নামে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।‘পিন হোল থিয়োরি’র উপর সুকুমারের এক অসাধারণ প্রবন্ধ ব্রিটিশ জার্নাল অফ ফটোগ্রাফিতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে, যে বছর সন্দেশ প্রকাশনা শুরু হয়। যদিও সত্যজিৎ লিখেছেন সুকুমার ছবি আঁকা শেখেন নি এবং তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখলে তা বোঝা যায়, আমার ক্ষুদ্র অভিমত হল, ছবিগুলোর জন্যেই ‘খিচুড়ি’র সমস্ত আজগুবি প্রাণীগুলো আমাদের চোখের সামনে ভাসে, হুঁকোমুখো হ্যাংলাকে দেখে আমাদের কষ্ট হয়, কুমড়োপটাশকে দেখে গা ছমছম করে, খুড়োর কলের ছবি দেখে আমরাও আইডিয়া পাই। ছবিগুলো কবিতার চরিত্রকে পরিস্ফুট করে হাসির ফোয়ারা ছোটাতে সাহায্য করেছে, এটাও এক অত্যন্ত বড় নির্মাণ।


একশো বছরের ওপর হয়ে গেল ‘সন্দেশ’-এর বয়স। আর একজন সুকুমার রায়ের জন্যে আমাদের আর কত অপেক্ষা করতে হবে?

প্রবন্ধ - পারমিতা চ্যাটার্জ্জী


















প্রবন্ধঃ

রবীন্দ্রযুগে নারীর অগ্রগতি
পারমিতা চ্যাটার্জ্জী



অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার নারী সমাজ অনেক পেছনে ছিল।তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার প্রথম দিশারী বিদ্যাসাগর মহাশয়। স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া তিনি আইনের মাধ্যমে বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রোধকরেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের বহু বিদ্রুপ সহ্য করেও তিনি তাঁর কাজে অচল ছিলেন।বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। আজকের নারী যে জায়গায় আছে তার জন্য বিদ্যাসাগর চিরস্মরণীয় ।

পরবর্তীকালে স্ত্রীশিক্ষাকে রক্ষা ও নারীপ্রগতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের অবদান অসীম।বহুবিবাহ নামক নারকীয় প্রথা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সময় বহু হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হন।

ঠাকুরবাড়ি এবং ব্রাহ্মসমাজের মহিলারানারীমুক্তি ও নারী প্রগতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

ঠাকুর বাড়ীর মেয়ে বধূদের যে দু-তিনটি উজ্জ্বল নাম আছে তার মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী।তিনি নারী কল্যাণমূলক কাজ আরম্ভ করেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত সখী সমিতির মধ্য দিয়ে।বিধবাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবী রাখে।অসহায় বিধবাদের যন্ত্রণা, তাদের মর্মবেদনা তিনি তার বহু নাটকে ফুটিয়ে তোলেন। স্বর্ণকুমারীর জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি ছিল “কাহাকে”,এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিতা আধুনিকা নারীদের অধিকার বোধ বিশ্লেষণ করেন। তিনি কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। তাছাড়া সংস্কারের কাজের জন্য তিনি এই কাব্য ও উপন্যাসের জগত ছেড়ে মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ লেখার কাজে।তিনি দীর্ঘদিন ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য হাতের কাজ শেখানোর চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।



এর পরে যার নাম আসে তিনি হলেন মহর্ষির মধ্যম পুত্র সতেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি বাংলার নারী জাগরণের অন্যতমা ছিলেন;বাঙালী মেয়েদের আধুনিক শাড়ী পড়ার ধরণতিনি আবিষ্কার করেন।তিনি তখনকার দিনে এমন একজন ভারতীয় রমণী,যিনি স্বামীর সাথে বিলেত যান এবং ভারতের বহু শহর ভ্রমন করেন । সঙ্গীত, কাব্য অভিনয়,সব কিছুতেই তার অদম্য উৎসাহ ছিল।ভারতী পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখেন । এছাড়া ছোটদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।তাঁর রচিত ছোটদের সাত ভাই চম্পা ও তাক ডুমা ডুম খ্যাতি অর্জন করে।



রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নীপময়ীর নাম এ বিষয়ে উল্লেখ করার বিশেষ প্রয়োজন । তাঁর ছবি আঁকার অসাধারণ প্রতিভা পরবর্তী কালে তাঁর সন্তানদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। পুণ্য পত্রিকায় তাঁর আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়।

স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সরলাদেবীর নাম খুবই উল্লেখযোগ্য । তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন । রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের স্বরলিপি তিনি করে দেন। “বন্দেমাতরম” সঙ্গীতে সুর তিনি দেন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি স্বক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ “জীবনের ঝরা পাতা” থেকে তাঁর এবং ঠাকুরবাড়ী সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।



জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবীর নাম অত্যন্ত সুপরিচিত । রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের এবং স্নেহভাজন ছিলেন । রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচুর স্বরলিপি তিনি রচনা করেন।



সবশেষে আসা যাক রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে।ক্ষিতিমোহন সেনের রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন বইটিতে রবীন্দ্রনাথের মতে,নারীর সাধনায় নারী সমন্ধে কবির মনোভাব সুন্দর ভাবে আলোকিত হয়েছে। 

মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে গুজরাটে সাহিত্য সভায় যোগ দেবার জন্য গুরুদেব গুজরাট যাত্রা করেছিলেন। সন্মেলন শেষে গুজরাটের মহিলাদের আমন্ত্রণে কবি সেখানকার বণিতা আশ্রমের একটি প্রতিষ্ঠানে যান।সেখানে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন,প্রত্যেক নারীর মধ্যে সুপ্ত আছেন গৌরী,যিনি তপস্যায় শিবকে জাগ্রত করে দৈত্যকুলের হাত থেকে স্বর্গকে উদ্ধার করেন।নারী যেন নিজের আত্মমর্যাদা ভুলে কখনই অন্ধের মতো পুরুষকে অনুকরণ না করেন। এই কথাই কবিগুরু তাঁর বিশ্বলক্ষ্মী কবিতায় বলেছিলেনঃ ‘ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হল ত্যাগের হোমাগ্নিতে’...



বরোদায় একটি সন্মেলনে তিনি নারী দুটি রূপ বর্ণনাকরেছিলেন একজন সৌন্দর্যের প্রতিমা আর একরূপ তপস্বিনীর। বলাকা কাব্যে এই দুটি রূপ সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে 

“কোন ক্ষণে

সৃজনের সমুদ্র মন্থনে

উঠেছিল দুই নারী

অতলের শয্যাতল ছাড়ি

একজনা উর্বশী,সুন্দরী,

বিশ্বের কামনা রাজ্যে রাণী,

স্বর্গের ঈশ্বরী।_______

আরজন ফিরিয়া আনে 

অশ্রুর শিশির স্নানে স্নিগ্ধ বাসনায়”।



মহুয়ায় সবলা নামক কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার

কেন নাহি দিবে অধিকার 

হে বিধাতা?



রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মেয়ে,গৃহবধূদের মর্মবেদনা গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন । এই উপলব্ধি আমরা পাই তাঁর ‘সাধারণ মেয়ে’ আর ‘মুক্তি’ নামক কবিতার মধ্যে দিয়ে। গৃহবধূদের জীবন যে শুধু রাঁধা আর খাওয়ার মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত, এর বাইরে তাদের চিন্তা করার কোনো অবকাশ ছিলনা,তা কবি মুক্তি কবিতায় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।





তাই রবীন্দ্রযুগে মহিলা সমিতি ও নানারকম হাতের কাজ, ছোট পত্রিকা যেখানে মহিলারা তাদের কথা লিখতে পারেন,এইসব সূচনা হয়। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক,এই অগ্রগতিতে ব্রাহ্মসমাজ যতো দ্রুত এগিয়ে ছিলেন, হিন্দুসমাজের এই জায়গায় আসতে অনেক সময় লেগেছিল।

প্রবন্ধ - শ্রীশুভ্র












প্রবন্ধঃ

রাজনীতি ও বঙ্গসমাজ
শ্রীশুভ্র


আমাদের এই আধুনিক সমাজ ও সভ্যতায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আমাদের জীবনকে প্রতি মুহূর্ত্তেই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করেই এবং এরই মধ্যে আমাদেরকেই একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয় জীবনের প্রয়োজনেই।


বৃটিশ প্রবর্তিত গণতন্ত্রের সাংবিধানিক পরিকাঠামোয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠিত শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতি একটি প্রক্রিয়ার নাম। যে প্রক্রিয়ায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কাজকর্মের উপর জনগণের কোনো প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সরকারের গৃহীত নীতিরীতিগুলি এবং সরকার বিরোধী শক্তিগুলির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে।


আমাদের বঙ্গসমাজের চালচিত্রও কোনো ব্যতিক্রম নয় এই ব্যাপারে। বরং বাংলার সমাজ জীবনে রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব সমাজকে বিশেষ ভাবেই নিয়ন্ত্রিত করে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলার সমাজ জীবন এই বিষয়ে বিশেষ ভাবেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বিগত সাত দশকের সময় সীমায় আমাদের সমাজ জীবনের প্রায় প্রত্যেক স্তরেই রাজনীতি তার সুস্পষ্ট প্রভাব রেখে চলেছে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস আমল থেকে শুরু করে বামফ্রন্টের সাড়ে তিন দশকের রাজত্বকালে সমাজ জীবনকে রাজনীতির আওতায় নিয়ে আসার কাজটা এদেশের রাজনীতিবিদরা অতি সুচারু ভাবেই সুসম্পন্ন করেছেন। পরিবর্তনকামী নেতৃবৃন্দ অবশ্য এই বিষয়ে কোনো পরিবর্তনের দিশা দেখাতে উৎসাহী নন।


দুঃখের বিষয় রাজনীতি যখন ভোট সর্বস্ব হয়ে ওঠে, সমাজ জীবনের উন্নতি তখন ব্যহত হতে বাধ্য। যার ফলে জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি স্লথ হয়ে পড়ে। আর ঠিক এই কারণেই সমাজের সর্বস্তরেই দূর্নীতি ব্যাপক হয়ে ওঠে। রাজনীতি ও অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই লাগামছাড়া দূর্নীতি সাধারণের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে চলে। এই ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের কোনো হুঁশ দেখা যায় না। তারা শুধু নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। অথচ ভোটের বাজারে মানুষের জন্যে তাদের মুখে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। ভোট শেষ হলেই তাদের দেখা পাওয়া ভার। ব্যাহত হয় উন্নয়ণ প্রক্রিয়া। এইরূপ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মানুষের আশা আকাঙ্খা বাস্তবের মুখ দেখতে পায় না।


এদিকে রাজনৈতিক দলগুলির যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এলাকা দখলের লড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। দেশের সার্বিক উন্নয়ণের ব্যাপারে তাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা দেখা যায় না। দলীয় প্রার্থীকে ভোটে জেতানোই তাদের কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র বিরোধী পক্ষের নিন্দা প্রচারই যেখানে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। 


যে কোনো দেশের পক্ষেই এরূপ অবস্থা সমাজ জীবনে অবক্ষয়ের সূচনাই করে থাকে। জাতির সামগ্রিক উন্নতি সুদূরপরাহত হয়ে ওঠে। আর আমাদের বঙ্গসমাজে ঠিক সেই ঘটনাই ঘটে চলেছে গত সাত দশক ধরেই। এই ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই অন্য কোনো দলের প্রকৃতিগত কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। সব দলগুলিরই এক পন্থা এক স্বর। 


আসলে সমাজ জীবন যখন ভিতর থেকেই অবক্ষয়ের পথে ধাবমান হয়ে চলে তখন এটাই তো স্বাভাবিক পরিণতি। এখন এই অবক্ষয়ের মূল কারণ জাতির সামনে অনুসরণ যোগ্য কোনো নেতৃত্ব না থাকা। মুশকিল হল সঠিক নেতৃত্ব উঠে আসে জাতির তৃণমূল স্তর থেকেই। কিন্তু সেই তৃণমূল স্তরেই যদি মানুষের চরিত্রে সুনীতির অভাব ঘটতে থাকে তবে অনুসরণ যোগ্য নেতা উঠে আসবে আর কি করেই বা। বাংলার সমাজ জীবনে ঠিক এটাই ঘঠেছে।


দেশের সার্বিক শিক্ষার হার যে পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেই পরিমাণে তা কিন্তু ঘটেনি। শুধু শিক্ষার হারই নয়, শিক্ষার মান সবচেয়ে জরুরী বিষয়। অর্থাৎ দেশের সার্বিক শিক্ষার মানের উন্নতি ঘটাতে না পারলে তৃণমূল স্তর থেকে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিও ঘটনো অসম্ভব। দুঃখের বিষয় আমদের বাংলা এই এক চক্রব্যূহে আটকা পড়ে গিয়েছে। এখান থেকে গোটা জাতিকে উদ্ধার করতে না পারলে প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অভিমুখ যে দিকে তাতে আমরা অধিকতর অন্ধকারের দিকেই দ্রুত ছুটে চলেছি। আর সত্যি করে বলতে গেলে সাধারণ জনগণ এরই মধ্যে যে যতটা পারছে দূর্নীতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে এবং অধিকাংশ জনসাধারণ এখন বুঝে গিয়েছে ক্ষমতায় থাকা দলের লেজুর হতে পারলেই দুর্নীতির সুফল কিছুটা হলেও ঘরে তোলা যাবে। যার যতটুকু ক্ষমতা সে ততটুকুই সুফল ঘরে তুলতে পারবে। এই বিষয়ে দেশের সংবিধান যাই বলুক তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো যে, কোনো বড়ো ব্যাপার নয় সে কথা সবাই বুঝে গিয়েছে এত দিনে। একমাত্র স্বল্প বুদ্ধির ভিতু প্রকৃতির জনগণই সুনীতি নিয়ে চলার চেষ্টা করে। বাকিরা তাদেরকেই শোষণের জন্য বেছে নেয়। এটাই বঙ্গসমাজের রাজনীতির মূল অভিমুখ।


অথচ দুঃখের বিষয় হল এখান থেকে জাতির উত্তরণ ঘটাতে গেলে যে বুদ্ধিজীবি সমাজের জেগে ওঠা দরকার দুঃখের বিষয় এই বাংলায় সেটা এখনো সম্ভব হয়নি। বরং বুদ্ধিজীবি সমাজের নৈতিক অধঃপতন সমাজের সর্বস্তরে দূর্নীতির ব্যাপক প্রসারকেই আরো ত্বরান্বিত করে চলেছে। তাদের এই অধঃপতন থেকে ফয়দা তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যে যেমন পারছে। একটি জাতির জীবনে বুদ্ধিজীবি সমাজের মধ্যে অবক্ষয় ধরলে সমগ্র জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের পক্ষেই তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। 


সমাজ জীবনের এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণ যে বিভ্রান্তির স্বীকার হবেন সে কথা বলাই বাহুল্য। আর তারই ফয়দা তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি যে যেমন পারছে। বুদ্ধিজীবিরা বুদ্ধিমান, ক্ষমতাশীল দলের ছত্রছায়া থাকতেই তারা বেশী নিরাপদ মনে করেন। শুধু তাই নয়, সরকারী দলের পৃষ্ঠপোষকতা করলে যে ধনে ধান্যে লক্ষ্মীলাভ হয়, সেই সুযোগের পুরোমাত্রায় সদব্যবহার করতে তারা অতি মাত্রায় স্বক্রিয়। এখন যে বুদ্ধিজীবির জনপ্রিয়তা যত বেশী তিনি তত লাভের গুড় ঘরে তুলতে স্বচেষ্ট হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক ময়দানে তার দর তত বেশী। পশ্চিমবাংলার এই রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে, যে যেমন পারে নিজেকে অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে স্বচেষ্ট হবে সেটাই স্বাভাবিক। 


এইভাবেই সমাজ জীবনে রাজনীতির প্রভাবে দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলে। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই অবস্থা জাতির জীবনে খুব বেশীদিন চললে জাতির মেরুদণ্ড গড়ে ওঠে না। ভগ্ন মেরুদণ্ড স্বরূপ জাতির যা দশা হয় আজ বাঙালিরও ঠিক তাই হয়েছে। কেবল দলাদলি আর পারস্পরিক হানাহানি আজ আমাদেরকে একটা সবল জাতি হিসেবে গড়ে উঠতেই দেয়নি। আর এইখানেই দরকার ছিল বুদ্ধিজীবিদের সদর্থক ভূমিকার। তারাই পারতেন দেশের সাধারণ জনগণকে সঠিক পথের হদিশ দিতে। যার থেকে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্ম নিতে পারতো। গড়ে উঠতে পারত একটা সামাজিক আন্দোলন, যার হাত ধরে হতে পারত প্রকৃত রাজনৈতিক পরিবর্তন, নিছক রাজনৈতিক পালাবদল নয়, নয় কেবল মাত্র প্রশাসকের গদিতে বিরোধী পক্ষের আসীন হওয়া। আর পূর্বতন সরকারের পথেই দ্রুত ধাবমান হওয়ার প্রাণান্তকর প্রয়াস। যে প্রয়াসে নাভিশ্বাস উঠে পরার উপক্রম সেই সাধারণ জনগণেরই।

চিলেকোঠা সরগরম



চিলেকোঠা সরগরমঃ


এই সংখ্যার বিষয়ঃ 
"অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ লাভ ম্যারেজ এর থেকে অনেক ভালো"
(বিশেষ সূচনাঃ এই বিভাগে প্রকাশিত প্রতিটি মন্তব্য অংশগ্রহণকারীর একান্তই নিজস্ব মতামত, এ বিষয়ে চিলেকোঠা ওয়েবজিন কোনোভাবে দায়ী নয়)


পক্ষেঃ

সভার মতের পক্ষে কোন লেখা জমা পরেনি



বিপক্ষেঃ 


১) অরুণ চট্টোপাধ্যায়

“যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব” –প্রায় একঘণ্টা ধরে চলা বিয়ের অনুষ্ঠানের মূলমন্ত্র কিন্তু মাত্র এইটুকুই । অর্থাৎ এতদ্বারা তোমার হৃদয় আমার হল আর বিপরীত ক্রমে আমারটা তোমার। তাহলে এটা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে বিবাহ নামক সামাজিক অনুষ্ঠানটি প্রকৃত পক্ষে হৃদয় ঘটিত । 

অনেকে বলবেন বিবাহ একটি সামাজিক বন্ধন – একটি পারিবারিক বন্ধন । এইসব স্বীকার করেও আমি বলব বিবাহ হল দুই প্রাপ্তবয়স্ক নর নারীর হৃদয়-বন্ধনের সামাজিক স্বীকৃতি । প্রকৃতির নিয়মে একটি পুরুষ ও নারী পরস্পর মিলিত হয় বংশরক্ষার নিমিত্ত । অন্যান্য প্রাণিদের ক্ষেত্রে যৌনমিলন, সন্তানধারণ, সন্তানের ভূমিষ্ঠ করণ ও সামান্য কিছুকাল সে সন্তানের প্রতিপালন পর্বটুকু ছাড়া পশু মা বা বাবার আর কোনও ভূমিকা থাকে না । কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে রয়েছে এর বিরাট ব্যতিক্রম । মানুষকে তার সারা জীবন ধরে একটি সংসার প্রতিপালন করতে হয় যার মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান থাকে মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে । 

এক কাল ছিল যখন বিবাহের পাত্র পাত্রী ঠিক হত বাবা মা বা অন্যান্য গুরুজনদের মর্জিমাফিক । সেক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে বিশেষ ভাবে মেয়েদের মতামতের মূল্য থাকত সীমিত পরিসরে বন্দী । স্বামী-স্ত্রী বিবাহের পরে পারস্পরিক পরিচিতি লাভ করত । প্রেম গড়ে ওঠার আগেই হয়ত দেহকে সমর্পণ করতে হত । 

ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনেক সংসার “ সং”-সার অর্থাৎ একটি অশান্তির লীলাভূমি হয়ে দাঁড়াত । কারণ এই স্বামীস্ত্রীর মধ্যে আইন কিংবা নীতির দায়বদ্ধতা থাকত কিন্তু প্রেম থাকত না । কয়েক হাজার ইটকে পরের পর সাজালে তারা একটা আড়াল সৃষ্টি করলেও দেওয়াল সৃষ্টি করতে পারে না । কারণ সেই ইটগুলির মধ্যে কোনও বন্ধন থাকে না । সামান্য ঠেলাতেই তা পড়ে যেতে পারে । তবে এর মাঝে সিমেন্ট বালি আর জলের মিশ্রণ দিলে ইটের সেই আড়াল টুকু দিয়েই পাকা ইমারত গড়া সম্ভব । স্বামী-স্ত্রীর সংসারে পারস্পরিক এই দাম্পত্য প্রেম দুই ইটের মাঝে ওই মশলার কাজ করে সংসারের স্থায়িত্ব, সুখশান্তি বৃদ্ধি করে ।

আজকাল নারীপুরুষে ভেদ ক্রমশ কমে আসছে । তাই অন্যের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া আর আগের মত সম্ভব নয় । মনে রাখতে হবে বিবাহ কিন্তু সাময়িক একটি অনুষ্ঠান নয় । এটি দুই নারীপুরুষের সারা জীবনের ঘটনা । মনের মিল না থাকলে অফিসে যেখানে বস আর কর্মচারীদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগে তো এ একটা চব্বিশ ঘণ্টা, সাত দিন আর সারা বছরের ব্যাপার । 

সুতরাং আমার মনে হয় বিবাহ যদি প্রেমের ফসল হয় তবে একটি সুখী পরিবারই গড়ে উঠবে । 





২) রুমনি সেন

প্রকৃতিতে সর্বত্র দেখা যায় স্ত্রী পুরুষ পরস্পরকে দেখা, পছন্দ করা, সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার কাজটা নিজেরাই করে। সেখানে পেরেন্টের কোন ভূমিকাই থাকে না। থাকা উচিতও নয়। ‘ক’ এবং ‘খ’ যদি পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় ও মিলন করে আনন্দ পায়, তাতে পেরেন্টের কি করার আছে? প্রকৃতি চায় তারা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হোক, তাই অপোজিট সেক্সের প্রতি আকর্ষণ ভরে দিয়েছে জীবের মধ্যে। মিলনের আনন্দ ভরে দিয়েছে। এই ঘুষটুকু না দিলে জীব তো সন্তান উৎপাদন করবেই না। দেখা যায় স্ত্রী পশুরা যে সঙ্গী নির্বাচন করে, সেরা সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য নির্বাচনটা সঠিকই হয়। আসলে সবই তো সন্তান উৎপাদনের জন্য, প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু মানুষ সন্তানের সব কিছুতেই নাক গলায়, খবরদারি করে। এই নাক গলানোর স্বভাবটা মানুষের জন্মগত। আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা। বাচ্চা কাঁদছে আলু ভাজা খাবে বলে। আলুভাজা বাড়িতে তৈরি হয়েছে। কিন্তু মা দেবে না। দুধ সাবু দিয়ে একটা বিকট পদার্থ বাচ্চাকে জোর করে খাওয়াচ্ছে। বাচ্চা তীব্র আপত্তি জানাচ্ছে, কাঁদছে, কিন্তু মায়ের সঙ্গে গায়ের জোরে পারছে না আর ওই খাবার গিলতে বাধ্য হচ্ছে। আলুভাজা না কি বাচ্চার জন্য খারাপ। কিন্তু যে খাওয়া আনন্দের হয় না, বরং যন্ত্রণার হয়, তা কখনও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হয় না। মানুষ ঠিক করে সন্তান কার সঙ্গে মিলন করবে। এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না। বিশেষত কন্যা সন্তানের উপর জোরজুলুমটা বেশী চলে। মেয়ে কাউকে পছন্দ করেছে, বিয়ে করতে চায়। ব্যস শুরু হয়ে যায় শাসন, তর্জন। ওর সঙ্গে মিশবি না। ওর সঙ্গে মিশবি না, এর সঙ্গে মিশবি না, তার সঙ্গে মিশবি না। মিশবি না, মিশবি, না মিশবি না। তারপর মেশার লোক ধরে নিয়ে আসে। হয়ত তার সুন্দর একটি ভুঁড়ি আছে, হয়ত মাথায় টাক, হয়ত তাদের বংশে অর্শ, হাঁপানির ইতিহাস আছে, স্ত্রীজাতিকে আকৃষ্ট করার কিছুমাত্র গুণ তার মধ্যে নেই। তা হোক। ভালো চাকরি করে ভালো মাহিনা পায়। দামী ফ্ল্যাট আছে। তার সঙ্গে তোমাকে মিশতে হবে, মিশতেই হবে, মিশতে তুমি বাধ্য। গিলতে তুমি বাধ্য। এটা তোমার কর্তব্য। তবে সব পেরেন্ট নিশ্চয়ই এমন নয়। অনেকেই সন্তানের পছন্দকেই মেনে নেয়। সাধারণত দেখা যায়, যে সব ছেলেমেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে তাদের সন্তান অনেক বেশী বুদ্ধিমান হাসিখুশী, এনার্জেটিক হয়, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের সন্তানদের থেকে। তবে সব ক্ষেত্রেই এমন হয়, সেই দাবি আমি করছি না, কারণ এতে হয়ত বিতর্ক আরও বাড়বে। হয়ত লক্ষ্য করেছেন, ‘প্রেম’ শব্দটা আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। প্রেম কোথায়? কোথাও প্রেম নেই। মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম নেই, প্রকৃতির প্রতি প্রেম নেই, পশুপাখির প্রতি প্রেম নেই। সেখানে স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি প্রেম কি আকাশ থেকে পড়বে? প্রেম অত সস্তা নয়। ‘লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয় রাখনু তবু হিয়ে জুড়ন না গেল’ এই হল প্রেম। এই প্রেম কোটিকে গুটিক হয়। তাই এখানে প্রেম আমার আলোচ্য বিষয় নয়।



৩) অনুপম দাশশর্মা

অভিভাবকেরা চাইবেনই তাঁদের মনোমত পাত্র বা পাত্রীর সাথে বিয়ে দিতে। এটাই সুস্থ স্বাভাবিক সামাজিক ব্যাবস্থা। তবে যেভাবে যুগের পালে সম্পর্কের নূতন হাওয়া লেগেছে উত্তরোত্তর যান্ত্রিক আনুকূল্যে, সেখানে আজকের যৌবন নিজেরাই মনের মিলের মেলবন্ধনে এগিয়ে আসছে। ক্ষতি কি ?? তাঁরাই ঠিক করে নিক না ভেসে উড়বে না কি ভেঙ্গে পড়বে 'সন্ধ্যের গুঁড়ো হওয়া কাঁচের মতো'..

আসলে, বাঁধা ছক ভাঙ্গার প্রবণতা নূতন কিছু নয়। বরং চাপিয়ে দেবার বাধ্যতা ভবিষ্যত্বের দায়ভার অভিভাবকদের আজীবন দায়বদ্ধতার শেকল পরায়।



৪) বেলাল হোসেন

কোন ভণিতা না করে সরাসরি প্রসংগে আসি। আমার মতে, অজানা অচেনা মানুষকে লাইফ পার্টনার করার রিস্ক বেশি। এখনকার দিনে, যেখানে মাথার উপরে অভিভাবকদের ছায়া সরে গেছে, মানে, জোর করে পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার চাপটা বেশ হাল্কা, সেখানে অ্যাডজাস্টমেন্ট কম হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। কাজেই, নিজের চেনা জানা, অন্ততঃপক্ষে তার বাহ্যিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থেকেই তাকে নির্বাচন করা মনে হয় বেশি ভালো হবে। যদিও একথা সত্য যে একজন মানুষ আরেকজনকে কখনোই সম্পূর্ণ চিনে উঠতে পারেনা। ২৪X৭ একসংগে থাকলে নেগেটিভ দিক আবিষ্কার হতে বেশিদিন লাগেনা, কিন্তু মা বাবা যদি তাদের পছন্দের পাত্র/পাত্রী ঠিক করেন এবং পরে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন ওনাদের মনের কষ্ট অনেক বেশি হয় বৈকি।

আরো একটি অতি ঘৃণ্য সামাজিক রীতিকেও শীঘ্রই বিদায় জানানো উচিৎ। সেটি হল ‘মেয়ে দেখা’ । ভীষণ জঘন্য লাগে আমার এই ধরণের আয়োজন। এই আয়োজনে, আমার মনে হয় কেউ সম্মানিত হননা, এবং অন্যকে করেননা। নিজে ঘটা করে নিজের জন্য মেয়ে দেখতে গেলে মানুষ কি দেখে ? আর যে মেয়েটি নীরবে সেই অপমানটা হজম করে , তার কি কোন কথা বলার বা প্রতিবাদ করার অপশন আছে সেখানে ?

আমার বাবা রিটায়ার করেন ১৯৮৩ সালে, তার পাঁচ বছর পর থেকেই আমার তিন বোনকে পাত্রস্থ করতে আমাদের তিন ভাইএর জান বেরিয়ে গেছে। তিন বোনকে বিয়ে দিতে বোধহয় তিরিশবার ...সেই শেষ। কেউ মেয়ে দেখতে গেছে শুনলেই আমার গা রি রি করে । প্রেম করে বিয়েতেও অসফল দাম্পত্যর ঘটনা কম নেই..কিন্তু তাতে আফসোশ নেই..কারণ হয়তো সেটা ‘জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ ।


৫) স্বপন দেব

সভার মতের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হল, যেহেতু ভারতবর্ষের ৮৫% বিবাহই অ্যারেঞ্জ বিবাহ, তাই গ্লোবাল রেট এর তুলনায় ভারতে বিবাহবিচ্ছেদের শতকরা পরিমাণ অনেক কম, প্রায় নগণ্য। কিন্তু আসুন, একবার আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করে দেখি যে এই “নগন্য বিবাহবিচ্ছেদ” এর “চোলি কা পিছে” কেয়া হ্যায় !! এর পেছনে আছে আমাদের চরম অশিক্ষা। যে শিক্ষা এক মহিলাকে কর্মসংস্থান এর দিশা দেখাতে পারে বা স্বাবলম্বী হওয়ার আশ্বাস যোগাতে পারে, ভারতবর্ষের গ্রাম্য মহিলারা সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আর ভারতের ৮০% ই গ্রাম। সুতরাং, পরিবারের পছন্দ মত পাত্রটিকে বিয়ে করে এই গ্রাম্য বধুটির কিন্তু ফিরে যাবার আর কোন রাস্তা থাকেনা। হাজার অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, গঞ্জনা মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকেনা ! তাই, সভার মতের সপক্ষের বন্ধুগণ, আপনাদের দেওয়া পরিসংখ্যান অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এর মহিমা বাড়ায় না, বরং ওই পরিসংখ্যান এ লুকিয়ে থাকে অসহায় নারীর বুকফাটা যন্ত্রনা আর দমবন্ধ হয়ে আসা পরিবেশ কে মেনে নেওয়ার অসহায় নিরুপায়তা !! ভারতের সর্বোচ্চ শিক্ষিত রাজ্যের নাম কেরল। সেখানে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার ৩.৪% আর ভারতের সবথেকে অশিক্ষিত রাজ্যের নাম বিহার। সেখানে বিবাহ-বিচ্ছেদ এর হার ০০.৩% !! 

সভার মতের সপক্ষে আর একটি সওয়াল হল, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আমাদের বহু পুরাতন সামাজিক আচার। হাজার হাজার বছর প্রাচীন এটাই সনাতনী হিন্দু প্রথা।

অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ কস্মিনকালেও সনাতনী হিন্দু প্রথা ছিলোনা। বরং সনাতনী হিন্দু প্রথায় অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ এর কনসেপ্ট ই ছিলোনা! বৈদিক এবং পৌরাণিক যুগে, সবথেকে প্রচলিত বিবাহ পদ্ধতি ছিল, স্বয়ংবর সভা এবং গান্ধর্ব বিবাহ প্রথা। এ দুটোই কিন্তু বর্তমান লাভ ম্যারেজ এর আদি রূপ। সীতা রাম কে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন, তাঁর হর-ধনু ভঙ্গের পর। দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় মালা দিয়েছিলেন স্বয়ংবর সভায়। কৃষ্ণ শত নৃপতিকে যুদ্ধে পরাস্ত করে রুক্মিণীকে তাঁর স্ব-ইচ্ছায় অপহরণ করে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেছিলেন। রাজ-পরিবার থেকে আম-জনতা, সেই সময়ে কোন বিবাহই অ্যারেঞ্জড ছিলনা। এর সবগুলোই কিন্তু ছিল নারীর স্বেচ্ছা-নির্বাচন। দুষ্মন্ত-শকুন্তলা লাভ ম্যারেজের আরেক উদাহরণ ! জন্ম ভিত্তিক জাত-পাত, নারীদের সমস্ত স্বাধীনতাহরণ এবং অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ নামক প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বিবাহ প্রথা সব ই চালু হয় ওই বদমায়েস মনুর সময় কালে আর কিছু অর্থ লোলুপ পুরোহিত এবং ধান্দাবাজেরা সেটাকেই হিন্দুদের সনাতন ধর্ম বলে চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ এতে তাদের দু’পয়সা অর্থাগম হচ্ছে !!

যাঁরা সমকামীতাকে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বলে চেঁচাচ্ছিলেন, তাঁদের জ্ঞ্যাতার্থে জানাই যে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ও কিন্তু প্রকৃতি বিরুদ্ধ। তাবৎ প্রাণী কুলে আর কোথাও কিন্তু জন্মদাতারা সন্তানের যৌনসঙ্গী নির্বাচন করে দেন না ! 

পরিশেষে বলি, দূরদ্রষ্টা রবি কবির কথা। ১৯১৪ সালে রচিত স্ত্রীর পত্র এ দেখি, এক বিবাহিতা মহিলা পতিগৃহ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন কারণ তিনি নিজেকে অসুখী মনে করছেন ! তিনি কিন্তু লাভ ম্যারেজ করেন নি!!



অনুবাদ কবিতা - ইন্দ্রানী সরকার



অনুবাদ কবিতাঃ


I have loved flowers that fade
by Robert Bridges



I have loved flowers that fade,
Within whose magic tents
Rich hues have marriage made
With sweet unmemoried scents:
A honeymoon delight,
A joy of love at sight,
That ages in an hour
My song be like a flower!


I have loved airs that die
Before their charm is writ
Along a liquid sky
Trembling to welcome it.
Notes, that with pulse of fire
Proclaim the spirit's desire,
Then die, and are nowhere
My song be like an air!


Die, song, die like a breath,
And wither as a bloom;
Fear not a flowery death,
Dread not an airy tomb!
Fly with delight, fly hence!
'T was thin love's tender sense
To feast; now on thy bier
Beauty shall shed a tear.



আমি বিবর্ণ ফুলই ভালোবাসি 
রবার্ট ব্রিজেস
অনুবাদ – ইন্দ্রানী সরকার 


আমি বিবর্ণ ফুলগুলিকেই ভালবেসেছি
সেইসব ফুল যাদের জাদুকরী তাঁবুতে 
সুমিষ্ট গন্ধের স্মৃতি এখনো বিদ্যমান ।
সেইসব ফুল যা দেখা মাত্রই 
মধুচন্দ্রিমা আনন্দে ভরে ওঠে,
ভালোবাসার খুশি উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে ।
কিন্তু কিছুক্ষনেই সেইসব ফুল
বিবর্ণ হয় যেমন আমার গান হয়ে যায় ।


সেইসব বাতাস যারা আকাশে বৃষ্টির ফোঁটা 
হবার আগেই নিঃশেষ হয়ে যায় 
আমি তাদেরই ভালোবেসেছি ।
সেই সমস্ত বর্ণমালা যারা আগুনে 
জ্বলে উঠে মনের বাসনা প্রকাশ করে 
ও অবশেষে তারা মৃত ও বিলুপ্ত হয় 
আমার গানও ওই বাতাসের মত ।


আমার গান তুমি এক নিঃশ্বাসের মতই 
নিঃশেষ হয়ে যাও যেমন ফোটা ফুল বিনষ্ট হয়;
পুষ্পশয্যায় মৃত্যুর কথা ভুলেও ভেব না,
অনুকুল বাতাসে ভরা সমাধি আশায় থেকো না !
খুশিতে উড়ে বেড়াও যেখানে সেখানে,
যে নরম ভালোবাসা তুমি অনুভব করতে 
এখন তা শব-বহনকারী একটি আধার, 
যেখানে সৌন্দয্যের মৃত্যু হয় ।

কবিতা - শিবলী শাহেদ (বাংলাদেশ)



কবিতাঃ 

খুন
শিবলী শাহেদ (বাংলাদেশ)


এইমাত্র কফিনের ডালা বন্ধ করলাম। 
তোমার আত্মার শান্তি হোক। 
ঘর উষ্ণতা হারিয়েছে কফিনে তাই
অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাই 
কালো পর্দায় দু' একটা বেড়ালের চোখ...

কাঁপা-কাঁপা হাতে তবু চিন্তা নেই
বাণ্ডিলটা ঠিকঠাক গুঁজে দিয়েছি
হ্যাটের ভেতর।
দূরে কোথাও সাইরেন বাজছে
রক্তকণিকায় ঘোর
সন্ত্রস্ত শীতের শিশির
পুলিশ আসছে বোধহয়..... 

কবিতা - বিদিশা সরকার



কবিতাঃ

আত্মনেপদী গদ্য 
বিদিশা সরকার 


তুমি ঠিক করতে পারোনা আমার দিক্‌বদল, আমার প্রমোদতরী । সিদ্ধান্ত এবং চরিতার্থতা নিয়মিত ও পর্যাপ্ত হলে স্বভাবতই আমি অনাহারের পুষ্টি দাবী করবনা তোমাদের কাছে। পাখি সম্বন্ধীয় বহু রচনা, আকাশ সম্পর্কিত কিছু ভ্রম থেকে আমার ঋতু জ্ঞান দো-ফসলি। দুঃসময়ের সঞ্চয়ের নিরিখে আমার সম্ভার থেকে তোমাকেও দিতে পারি আমার রাত্রির পুরোভাগ। এও তো অভ্যাসিত একটা পন্থা । মৃত্যুর ভয়াবহতা আমাকে ভাবায়নি কখনও, কিন্তু আততায়ীর বদান্যতায় সতর্ক হয়েছি। 
অন্ধকারের একটা নিজস্ব ভাষা আছে । ধ্বনিগুলো রূপান্তরিত হয় শব্দে। অতি সতর্ক থাকলে কিছুটা অনুভব গ্রাহ্য । সেইসব বিপজ্জনক শব্দগুলো আত্মহননের সুপরিকল্পিত মেধা। বেঁচে থাকার নিজস্বতায় এর গ্রহণযোগ্যতায় সন্দেহ নেই । যদিও আমি কতটা গ্রহণযোগ্য সে বিষয়ে নিশ্চিত নই ।





তুমি কতটা সমসাময়িক, তুমি কতটা প্রাসঙ্গিক -- সেটা তো তার্কিকের এক্তিয়ারে। মঞ্চ সম্পর্কে যে ভীতি ---- সেটাই যে তোমার কাছে পৌঁছানোর অন্তরায়। দূরত্বের প্রয়োজনে দূরবীন!সম্পর্কের প্রয়োজনে মধুশালা! অবক্ষয় চোখের সামনে দরদাম করে! বিস্ময়বোধক চিহ্নটা তাই বহু ব্যবহৃত। 
বুদ্ধিজীবীর হাসি রাজনৈতিক। কান্নাও। আর তার ভিতরের মানুষটা? অবশ্যই অন্ধকার। আমি সেইসব অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলি। কখন যে আমিও নাট্যকর্মী হয়ে যাই! ডায়াসের হাততালি আমার কান্নাকে বাহবা দেয় । আমি আরও উন্নতমানের কান্না রপ্ত করি।

কবিতা - ঋত্বিক দাশশর্মা





কবিতাঃ

অলিক সুখ 
ঋত্বিক দাশশর্মা


পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে বিচিত্র রংয়ে আঁকা নারী দেখার আশায়, 
সেখানে সাদা-কালো ধূসর রংয়ের কষ্টের হাহাকার ছাড়া চোখে পড়ে না কিছুই।
একটি একটি করে সমস্ত পৃষ্ঠায় খুঁজতে থাকি জলরংয়ে আঁকা নারী
কখনো সমস্ত ইন্দ্রিয় তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে ... অমানুষের মত ওরা বলে,
ওগো আমার কল্পিত নারী, আমার অধিকারের বশে 
একবার এসো এই সর্বনাশের দেশে ... 
আমি রেখেছি যেখানে আবেগের দুফোঁটা অশ্রুজল, 
বিপুল সুখের ক্ষুধা নিয়ে আছড়ে পরে ওদের রং তুলি জল 
অবাধ্য জড়ানো নির্বাক নারী তাকায় অবুঝ বসন্তের দিনে ...
ওরা কেউ অধিকার ছাড়তে রাজি নয় প্রথম ইন্দ্রিয় বিনে ।