ছোটগল্প - শাশ্বতী নন্দী



ছোটগল্পঃ

ভাল দিদা
শাশ্বতী নন্দী



ভাল দিদাকে আমাদের পাড়ায় কে না চেনে ? ছোট্ট এক ফালি বারান্দার গ্রীলের খাঁজে মুখ লেপ্টে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। একটা মানুষও পাস করতে পারবে না ওঁর সামনে দিয়ে। কেউ কেউ তো শুনি অফিস কাছারি দেরি হয়ে যাচ্ছে সে ভি আচ্ছা, কিন্তু ভাল দিদার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবে না। ভাল দিদা নামটা যে কে দিয়েছিল জানি না, কিন্তু ওই নামেই বুড়ি পাড়ায় বেশ পরিচিত। 

সেদিন একটা বাচ্চা মেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল ওই পথ দিয়ে। তখনও জানত না কপালে কী দুর্ভোগ নাচছে। সর্ট কাট রাস্তা ধরে সে আপন মনে হেঁটে চলেছে। একটু অন্যমনস্ক মুখ। বোধহয় পরীক্ষা চলছে। মাথাটা সামান্য ঝোঁকানো। হয়তো মনে মনে পরীক্ষার পড়া আওড়াতে আওড়াতে চলেছে। কিন্তু যেই না ভাল দিদা ওকে দেখেছে, ব্যস্‌, মেয়েটার আপন মনে পড়া মুখস্ত একেবারে চৌপট করে ছেড়ে দিল। 

হাজার প্রশ্নের ঝাঁপিটা একেবারে উপুড় করে খুলে দিয়েছে ভাল দিদা । বলে, “কী রে কোথায় যাচ্ছিস, স্কুলে ? কতদিন পর দেখলাম, বাবা তোকে। বড্ড শুকিয়ে গেছিস। একেবারে কাঠি কাঠি চেহারা। তোর মা কী রে, একটু ভাল করে যত্ন আত্তিও করে না ? আচ্ছা, তুই একা কেন যাচ্ছিস রে ? স্কুল তো কম দূর নয়। সেই বড় রাস্তা পেরিয়ে ওদিকে। - ভাল দিদা হাত দিয়ে দূরের কোনদিক যেন দেখায়। ওদিকে আদৌ কোনো স্কুল আছে কী না কে জানে। 

মেয়েটা এবার নিজের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য উদ্যত হচ্ছে। 

ভাল দিদা মৃদু ধমক দেয়, “আরে দাঁড়া, দাঁড়া, এত হুটোপাটা করছিস কেন ? ধীরে সুস্থে হাঁট। তবে এটা কিন্তু তোর বাবা মা ঠিক করছে না। একা একা এভাবে তোকে ছেড়ে দেওয়া ... বড় হচ্ছিস। দিন কাল ভাল নয়”। 

মেয়েটা চুল ঝাঁকিয়ে বলে,“দিদা, ও দিদা, আমি ফেরার সময় তোমার সঙ্গে গল্প করব, কেমন ?

দিদার মুখ একটু কালো দেখায়। বলে, “ফেরার সময় ? সে তো অনেক দেরি। কিন্তু একী রে ! তোর চুলগুলো অমন ঝাঁটার কাঠির মতো হয়েছে কেন ? কেমন লাল, লাল। বাঙালি মেয়ে। চুল হবে ঘন কালো। নিশ্চয়ই তেল জল পড়ে না। নাহ্‌, এবার তোর মায়ের সঙ্গে দেখা হলে ভাল করে বোঝাতে হবে যে এই বয়সের মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্যের দিকে অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত। নইলে পরে ভুগতে হবে। আর শোন, ...”

মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। একেই পরীক্ষার চাপ, রাতেও ঠিকঠাক ঘুম হয় নি। আপন মনে চলেছিল লাস্ট মিনিট প্রিপারেশন করতে করতে, ব্যস্‌, এই ভাল দিদা এসে সমস্ত ভন্ডুল করে দিল। ও কান্না চেপে কোনরকমে বলে, “এবার আমায় ছেড়ে দাও। এরপর গেলে আজ আর পরীক্ষা দিতে পারব না, দিদা”।

শুনেই ভাল দিদা এত্তো বড় জিব কামড় বলে উঠলেন, “ইস্‌, তুই কী বোকা রে। আগে বলবি তো। তা হ্যাঁ রে, আজ পরীক্ষা, দইয়ের ফোঁটা দিস নি কেন ? সত্যি তোর মা-কে এবার বকুনি না দিলে হবে না একেবারেই। শুভ কাজে বের হলে সব সময় দইয়ের ফোঁটা কপালে রাখতে হয়। আজ গিয়ে মা-কে বলবি যে ...”

মেয়েটা এবার দৌঁড়তে শুরু করেছে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ বলব, বলব। আমি আসছি”।

আর আসছি। সে মেয়ে আর জীবনেও ভাল দিদার বাড়ির পথ মাড়ায় নি। এই ভাবে একে একে সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। এমনকি ছোট নাতনিটাও তাঁকে দেখলেই পালাই পালাই করে। 

ভাল দিদা তক্কে তক্কে থাকেন। কিন্তু কাউকে পান না। এবার তিনি পাকড়াও করেন ফেরিওয়ালাদের। তারা হাঁকতে হাঁকতে গেলেই ভাল দিদা পথ আটকাবেন, “কী রে তোর ঝুড়ির একটা ফলও যে দেখছি আজ সুবিধার নয়। ইস্‌ মাগো, তুই কি কাঁচকলা বিক্কিরি করছিস না কি রে ? উঁহু আজ পেয়ারাগুলোর চেহারাও তো ভাল নয়”। 

ফলওয়ালা প্রথম প্রথম ক্ষেপে কাঁই হয়ে যেত। কিন্তু ভাল দিদা দেখলেন ব্যাপারটা ঠিক ভালোর দিকে যাচ্ছে না। এরাও যদি এবার এই গলি ছেড়ে অন্য গলি দিয়ে যাতায়াত শুরু করে তো ...

তিনি এবার তাই তাঁর স্ট্র্যাটেজি পাল্টেছেন। জিনিস পত্তরের সমালোচনার দিকে মোটেই যান না বরং ওদের দেখলেই কলসি থেকে জল গড়িয়ে দেন, ঠাকুরের নকুল দানা, বাতাসা হাতে দেন। সঙ্গে চলে দেদার গল্প।

সত্যি কথা বলতে কী আমি ভাল দিদার প্রতিবেশী হয়েও কোনদিন তাঁর সঙ্গে দু দন্ড কথা বলি নি। অত সময় কোথায় আমার। একদিন শুনলাম ওদের বাড়ি থেকে বিশাল চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ আসছে। কাজের মাসিরা মোটামুটি পাড়ার গেজেট। বলে, “জানো না ওই বুড়ির বউটা ভয়ঙ্কর পাজি। বুড়ি নাতনির জন্মদিনে পায়েস বানাবে বলে কবে থেকে ছেলে বউমার কাছে গুড়ের পয়সা চাইছে, দেখো দিল তো নাই। কী ভাবে বুড়িকে বকাঝকা করছে”। 

মায়াই লাগল শুনে। কিন্তু ওই মায়াটুকু ছাড়া আর তো কিছু করার নেই। কারণ ভাল দিদার ছেলে বউমা যথেষ্ট উপযুক্ত। দুধটা, গুড়টা হাতে করে নিয়ে যদি তাঁকে দিতে যাই আর মুখোমুখি হই ওই ঝগড়ুটে বউমার সঙ্গে ! না বাবা, ওই সব খুচরো মায়া নিজের বুকেই পুরে রাখি। 

সেদিন অফিস বেরোচ্ছি খুব তাড়াহুড়ো করে এবং ভাল দিদার বারান্দার দিকে মোটেই না তাকিয়ে। কিন্তু এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ে গেল যে না তাকিয়ে পারলাম না। এক ফেরিওয়ালি এক খন্ড গুড় ভাল দিদাকে বারান্দার গ্রীল গলিয়ে দিচ্ছে। দেখে দিদার সে কী আপত্তি। বলেন, “আমার কাছে তো পয়সা নেই। কিনব কেমন করে। আর বউমা বলেছে এখন জন্মদিনে আর পায়েস খাওয়ার চল নেই। ওরা বড় দোকান থেকে কেক আনিয়ে কাটবে”।

কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা। বলে, “আমি তোমার কাছে কি পয়সা চেয়েছি নাকি যে এত কথা শোনাচ্ছ ? আর আমার মা যদি একটু গুড় চাইত আমার কাছে, আমি কি পয়সা চাইতাম তাঁর কাছে ?

ভাল দিদা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন ফেরিওয়ালির দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “তোদের জন্যই আরও অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে এই পৃথিবীতে, জানিস। কিন্তু ভারি লজ্জাও লাগে। আমি তো কোনও কাজে লাগি না কারোর। শুধু বেঁচে থেকে অন্ন ধ্বংস করছি”।



ফেরিওয়ালি এবার যে কথাটা বলল, আশা করিনি অমন কথা একজন অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মেয়ের মুখ থেকে শুনতে পাব। সে বলে, “আর কক্ষণও অমন কথা তুমি বলবে না দিদা। তোমরা হলে বুড়ো বট। তোমরা না থাকলে আমরা যে জিরোবার জন্য ছায়া পেতাম না”।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন