ছোটগল্প - রুমনি সেন



ছোটগল্পঃ

মন নিয়ে
রুমনি সেন



এই যে সুদেষ্ণা, তুমি সবার সঙ্গে কথা বলো, আমার সঙ্গে বলো না কেন? কি হলো, চুপ করে আছো কেন?

কি কথা বলব?

আমি জানি, তুমি আমাকে দেখে লজ্জা পাও। আসলে মনে মনে ভালোবাসো তো তাই। হি হি।

একদম বাজে কথা বলবে না।

আহা রাগ করছ কেন। আচ্ছা করো রাগ, রাগ যে তোমার মিষ্টি।

ভালো হচ্ছে না কিন্তু। 

চৈতী বলল,

এই রাগ করছিস কেন? তীর্থ তো ইয়ার্কি মারছে। এত সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন?

না এসব বাজে ইয়ার্কি করবে কেন? এমন করলে আমি কিন্তু আর কলেজে আসবো না। 

কলেজে আসবে না? অ্যাঁ অ্যাঁ আমার তাহলে কি হবে। চৈতী ওকে বারণ কর, যেন কলেজ না ছাড়ে। আমি যে ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। 

সুদেষ্ণার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। 

অসভ্য। 

চৈতী হল সুদেষ্ণার বেস্ট ফ্রেন্ড। ক্লাস ফাইভ থেকে তাদের বন্ধুত্ব। সবাই তাদের মাণিকজোড় বলে। চৈতী বলল,

তীর্থ অনেক হয়েছে। এবার যাও তো।

যথা আজ্ঞা দেবী। 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। শীতের বিকেলে ম্লান সূর্যের আলোয় সব কিছুই কেমন ম্লান হলদেটে লাগছে। সুদেষ্ণার কিছু ভালো লাগছিল না। সে ছোট্ট আয়না বের করে মুখটা দেখল, ছোট চিরুনি দিয়ে মাথার সামনেটা একটু আঁচড়ে নিল। তারপর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। 

কি রে, কোথায় যাচ্ছিস?

কোথায় আবার, বাড়ি।

সে কি রে এস বির ক্লাস করবি না? আজকে তো স্যার সাজেশন দেবে বলেছে।

নাঃ ভালো লাগছে না। 

কেন রে বাবা কি এমন দেরি হবে। ক্লাসটা কর না।

নাঃ কাল তোর থেকে সাজেশন নিয়ে নেব।

আমি পারব না। এহ, উনি থাকবেন না, আর আমি ওনাকে সাজেশন দেব। 

আমার ভালো লাগছে না। 

কেন থাক না বাবা। একসঙ্গে যাব। রাগ করছিস কেন?

রাগ করতে যাব কেন।

আমি জানি তুই রাগ করেছিস। সুদেষ্ণা প্লিজ। আমি তীর্থর হয়ে ক্ষমা চাইছি। 

তুই ক্ষমা চাইছিস কেন?

চৈতী কি বলবে ভেবে পেল না। আমতা আমতা করে বলল,

না মানে দেখ তীর্থ খুব ভালো ছেলে, ওর সম্বন্ধে ভুল ধারণা করিস না। ওর সঙ্গে মিশে দেখ, ও সত্যিই, মানে ... 

তোকে আর মানে মানে করতে হবে না। আমি চলি। কাল দেখা হবে।



ফার্স্ট ইয়ার কমার্সে নতুন ভর্তি হয়েছে তীর্থ। বয়সে সুদেষ্ণাদের থেকে কিছু বড়ই হবে। তাকে দেখলে সুদেষ্ণার মাথা নীচু হয়ে আসে, চোখের পাতা নেমে আসে। এর নামই কি প্রেম? স্বীকার করতে সুদেষ্ণার সংকোচ হয়। এমন কি অপমানবোধও হয়। ছেলেটি যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার মনের ঘরে বলপূর্বক অনুপ্রবেশ করেছে। তাকে তাড়ানো যাচ্ছে না, অস্বীকার করা যাচ্ছে না। সুদেষ্ণা শুধু এটুকুই চেষ্টা করতে পারে, তার মনের কথা যেন কেউ জানতে না পারে। তাই সে তীর্থর থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকে। তার সঙ্গে ভদ্রতা করেও কথা বলে না। কেউ যেন জানতে না পারে, হে ভগবান, তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। 

কলেজে তার থেকে দূরে দূরে থাকে, বাড়িতে সব সময় তাকেই মনে পড়ে। “কাছে এলে দূরে যাই সরে / দূরে গিয়ে কাঁদি তার তরে” এই রকম অবস্থা সুদেষ্ণার। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, তীর্থ একটা ফালতু ছেলে। কি আছে ওর? লেখাপড়ায় কি এমন? দেখতেই বা কি এমন? ওর থেকে অনেক সুন্দর ছেলে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, এইসব বলে সে নিজেকে নিবৃত্ত করার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না।অবশেষে বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর সে নিজের কাছে স্বীকার করল তীর্থকে সে ভালোবাসে। হ্যাঁ আমি ওকে ভালোবাসি, এই কথা বলে সে প্রেমের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করল। 

প্রেমে তার মন যত ভরে উঠতে লাগল, সে যেন ততই সুন্দর হতে লাগল। এটা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বন্ধুরা বলে, কি খাচ্ছিস বল, আমিও তাই খাব। একদিন তো ছোট ভাই টুটুন পর্যন্ত বলল, দিদি তোর চোখ দুটো কি সুন্দর লাগছে। একেবারে বাঘ বাঘ। সুদেষ্ণা তাকে ‘কি বললি’ বলে হাতপাখা নিয়ে তাড়া করল। কিন্তু কমপ্লিমেন্টটা মনে মনে খুবই উপভোগ করল। 

তবে তীর্থর থেকে সে দূরত্ব আগের মতই বজায় রাখল। সে তার, সহপাঠী / সহপাঠিনীদের সঙ্গে খোলা মনেই কথা বলে, মেশে কিন্তু তীর্থর সাথে নয়। কারণ আর কিছু নয়, লজ্জা, শুধুই লজ্জা। সে প্রেমের দাবী না মেনে লজ্জার দাবী মেনে নিয়েছিল। 



সেদিনের ঘটনার পর সুদেষ্ণা বন্ধুদের কাছে শুনেছে, তীর্থ না কি বলেছে সুদেষ্ণা একটা অভদ্র মেয়ে। কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না। কি ভাবে ও নিজেকে? সুদেষ্ণা কষ্ট পেল, কিন্তু বেশ স্বস্তিও পেল। যাক তাহলে বুঝতে পারে নি, আমি মিথ্যেই ভয় পেয়েছিলাম। 

কিন্তু ‘অভদ্র’ হওয়া সত্বেও তীর্থ সুদেষ্ণাকে জ্বালাতন করা থেকে বিরত থাকল না। 

যেমন, একদিন ......... 

ক্লাসের বন্ধুরা তার হাতে টাকা দিয়ে বলেছিল কাছের দোকান থেকে ছয়জনের জন্য ভেজিটেবল চপ নিয়ে আসতে। সে দোকানে গিয়ে কেন যেন ভুলে গিয়ে দশটা চপ নিয়ে এসেছিল। সবাইকে দিয়ে তীর্থর জন্য থাকল না। 

কি রে সুদেষ্ণা তীর্থকে দিলি না?

এ বাবা আমি ভেবেছি দশটা আনতে হবে।

চৈতী বলল,

ঠিক আছে, ঠিক আছে। দশটাই সবাই মিলে ভাগ করে নেব। 

সুদেষ্ণা লজ্জা পেয়ে তীর্থকে টাকাটা ফেরত দিল।

তীর্থ বলল,

আসলে সুদেষ্ণা আমার টাকা বাঁচাচ্ছে। এখনও তো বিয়ে করি নি। এখন থেকেই এত হিসেব। বিয়ের পর কি করবে কে জানে। 

সুদেষ্ণা ভয়ানক খেপে গিয়ে নিজের চপ দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে এল।

আসার সময় পিছনে চৈতীর চিৎকার শুনতে পেল,

তীর্থ, জীবনেও কি তোমার কান্ডজ্ঞান হবে না। তুমি ওকে খ্যাপালে কেন। 

বা রে আমি আবার কি করলাম। 

সুদেষ্ণা বাড়ি এসে বিছানায় আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। নিজের উপর তার ধিক্কার আসতে লাগল। কেন এমন করছে সে? নিজের কাছেও তার কোন ব্যাখ্যা নেই। শুধু কষ্ট পাওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তীর্থ তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে এটা তার সহ্যের অতীত। সে কি তীর্থকে বলবে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা কোরো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি? না না অসম্ভব, তার থেকে মৃত্যুও শ্রেয়। 



দেখতে দেখতে কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। সুদেষ্ণার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট।তাদের গ্রুপের সকলেই পাস করেছে। 

সুদেষ্ণার মনটা কি রকম ফাঁকা ফাঁকা লাগে। পড়াশুনা নেই, টেনশন নেই, ব্যস্ততা নেই। বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ নেই। 

সে এক ঘেয়েমি কাটানোর জন্য টাইপ শর্টহ্যান্ড শেখার স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। বাবার অবশ্য ইচ্ছে ছিল না। বাবার বক্তব্য এ সব করে কি হবে। ওই তো অমুকের ছেলেও টাইপ শর্টহ্যান্ড শিখে বসে আছে, চাকরি হয়েছে?

আসলে বাবা তার বিয়ের জন্য চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে, তাই এগুলো বাবার কাছে বাজে খরচ বলেই মনে হয়েছে। 

কিন্তু সুদেষ্ণা একঘেয়েমির ভার আর বইতে পারছিল না। আর তীর্থকে যখন মনে পড়ে, কষ্টে মন ভরে যায়। তার মনে হয়, সংকোচ দূরে ঠেলে দিয়ে আর এক দুইপা এগোলেই হয়ত তীর্থ তার হয়ে যেত। নিজের স্বভাবদোষে সে নিজেই বঞ্চিত হয়েছে। এ সব কষ্ট থেকে সাময়িক রেহাই পাওয়ার জন্য মনটাকে যে কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখা দরকার বলে তার মনে হয়েছিল। 

প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় টাইপ শর্টহ্যান্ড শিখতে যাওয়া, তারপর দুটো ছাত্রকে পড়িয়ে রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফেরা। আর রাতটা শুধু নিজের সঙ্গে একা হওয়া, নিজের কষ্টের মুখোমুখি হওয়া,এভাবেই কাটছিল তার দিনগুলো। 



একদিন সন্ধ্যের দিকে চৈতী এল। খুব সেজেগুজে এসেছে। 

সুদেষ্ণা বলল,

বাবা এতদিন পরে মনে পড়ল।

চৈতী ভেংচি কেটে বলল,

বাবা এতদিন পর মনে পড়ল। আমি তো তাও এলাম। তুই তো ভুলেই গেছিস। নে রেডি হয়ে নে। আমার সঙ্গে এক্ষুনি এক জায়গায় যেতে হবে। 

কোথায়?

ওটা বলা যাবে না। সারপ্রাইজ।

আগে বল নাহলে আমি যাব না। 

বলা যাবে না। ও বারণ করে দিয়েছে।

ও? ও আবার কে। অ্যাঁ?

চৈতী মিটিমিটি হাসতে লাগল। 

চল না ওর সঙ্গেই তো আলাপ করিয়ে দেব। নিজের চোখেই দেখতে পাবি। 

আচ্ছা। ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো। তা কতদিন ধরে প্রেম করছিস?

তিন বছর। 

তিইইইন বছওওওর??? নাঃ আমি তোর সঙ্গে যাব না। এই, তুই বাড়ি যা তো।

কেন ওরকম করছিস বাবা।

তোর লজ্জা করে না? তিন বছর ধরে প্রেম করছিস আর আমাকে জানাস নি।

পারি নি রে। ও বলতে বারণ করেছিল। একেবারে দিব্যি দিয়ে রেখেছিল।

দিব্যি দিয়েছিল? কে রে? শরৎচন্দ্রের ক্যারেকটার না কি?

না রে বেশ মডার্ন। গেলেই বুঝতে পারবি। চল ওই বলেছে তোকে যেমন করেই হোক ধরে নিয়ে আসতে। ও রসনার ওখানে (স্থানীয় রেস্টোর‍্যান্ট) অপেক্ষা করছে। তুই আমার স্পেশাল গেস্ট। ওখানে তোকে আমাদের বিয়ের নিমন্ত্রণ করব। প্ল্যানটা ওর ই।

তা বল তোর ভাবী স্বামী কি করে?

ওদের পারিবারিক বিজনেস আছে। 

বিয়ে কবে?

এ মাসের তেইশ তারিখে। 

বাঃ তোর লাকটা ভালো। বি এ পাস করেই বিয়ে। আর প্রেমের বিয়ে যখন দাবীদাওয়াও নিশ্চয় নেই। তোর বাবার লাকও ভালো। আমার কপালে কি আছে জানি না। টুটুন তো বলে দিদি তোর নাকের জন্য দশ হাজার এক্সট্রা দিতে হবে।

মোটেই না। তোর মত সুন্দর মেয়ে এখানে কটা আছে দেখা তো। 

দূর দূর, বাজে বকিস না। 

তবে দাবীদাওয়া কিছু নেই বলা যাবে না। ওদের বিজনেসের জন্য পঁচিশ হাজার চেয়েছে।

কি? কত? পঁচিশ হাজার???

দেখ এমন কিছু বেশী চায় নি।

তুই এখনই এই বিয়ে ক্যানসেল করে দে।

কি যে বলিস। 

ঠিকই বলছি। তোর কোন আত্মসম্মান জ্ঞান নেই? ভালোবেসে বিয়ে করছে, টাকা নেবে কেন?

আরে আমিও তো ভালোবেসে বিয়ে করছি। তাহলে ওদের ঘাড়ে বসে সারাজীবন খাব কেন? ওদের অন্ন ধ্বংস করব কেন?এ গুলো কোন যুক্তিই নয়। 

ও খরচ দিয়ে খাবি?

বড্ড বাজে বকিস। ওদের কত ভালো অবস্থা জানিস? পঁচিশ হাজার টাকা ওদের কাছে কিছুই নয়। 

তোদের কাছে?

দেখ তারা দায়িত্ব নিচ্ছে। সারাজীবন আমার দায়িত্ব নেবে। সেখানে এই টাকা কিই বা এমন। 

তোকে বোঝানো আমার সাধ্য নয়।

বোঝাতে হবে না। বকবক না করে চল আমার সঙ্গে। 

রসনার সামনেই চৈতীর প্রেমিক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে এক গাল হেসে বলল,

এসে গেছ। চলো চলো ভিতরে চলো। 

সুদেষ্ণা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এ যে তীর্থ। তাহলে তীর্থর সঙ্গেই চৈতীর প্রেম পর্ব চলছিল কলেজ লাইফে? আর সে.........



কোণের দিকের একটা টেবিলে তিন জনে বসে পড়ল। তীর্থ বলল,

কি খাবে বলো।

চৈতী বলল,

আজ সুদেষ্ণার অনারে খাওয়া হচ্ছে। ওই বলবে।

বয় এল অর্ডার নিতে। সুদেষ্ণা মেনু কার্ডে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কি খাবে। সে বলল,

আমার যা ভালো লাগে তাই অর্ডার দিলাম। তোদের ভালো না লাগলে আমাকে কিন্তু দোষ দিস না। 

তীর্থ সুদেষ্ণার দিকে অপলকে তাকিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাচ্ছিল না। চৈতী বলল,

এই তুমি আমার বন্ধুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন? আমার কিন্তু হিংসে হচ্ছে, হ্যাঁ।

তীর্থ হা হা করে হেসে উঠল,

আরে তাকিয়ে আছি ওর পরিবর্তন দেখে। এখন কত স্মার্ট হয়েছে। আগে তো আমায় দেখে লজ্জায় মাথাই তুলত না। 

সুদেষ্ণার সমস্ত লজ্জা এক মুহূর্তের মধ্যেই যেন উবে গেছে, তার প্রেমের সাথে সাথেই। এই তীর্থকেই কি সে ভালোবেসেছিল?

তীর্থ ঠিক সেই সময়টাতেই তার সামনে এসেছিল, যে সময়ে মেয়েদের কৈশোর পেরিয়ে যৌবন আসে, যে সময়ে তাদের “ফুলের বনে যার পাশেযাই তারেই লাগে ভালো” এইরকম অবস্থা হয়। যে সময়টা হল মেয়েদের জীবনে প্রেমেরই সময়। এটা প্রকৃতির ষড়যন্ত্র। প্রকৃতি এই সময়ে তাদের রূপে রঙে সাজিয়ে তোলে, তাদের হৃদয়কেও প্রেমে ভরিয়ে তোলে। তারা ভালো না বেসে থাকতে পারে না। কিন্তু না, এই তীর্থকে সে ভালোবাসে নি। সে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে নিজের অন্তরে তীর্থর যে মূর্তি গড়েছিল, সেই মূর্তিকেই তার হৃদয়ের প্রেমের বেদীতে বসিয়েছিল। সে তার অন্তরের তীর্থ, বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নেই। বাস্তবে যে তীর্থ আছে, সে তো এই, তার সামনে বসে আছে। এ তো প্রেমিক নয়, এ যে বণিক। এ তার প্রেমের যোগ্য হতে পারে না। সুদেষ্ণার এক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে ভারমুক্ত মনে হল, সে আরাম বোধ করল। 



সুদেষ্ণা বলল,

আরে না না ঠিক লজ্জা নয়। আগে কথা বলতে কেন জানি না ইচ্ছেই করত না। কিন্তু এখন তো তুমি আমার সব চেয়ে প্রিয় বান্ধবীর বর। আমার আপন জন। 

নিজের মিথ্যা কথা বলার ক্ষমতা দেখে সে নিজেই চমৎকৃত হল।

চৈতী তাকে জড়িয়ে ধরল।

ঠিক বলেছিস।

সুদেষ্ণা বলল,

তবে তোমাদের প্রেমের কথা আমাকে আগেই বলা উচিত ছিল।

তীর্থ একটা চোখ ছোট করে বলল,

বললে কি করতে? লজ্জা করতে না? কলেজে তো একেবারে লজ্জাবতী লতা সেজে থাকতে। আজ হঠাৎ এত পরিবর্তন কেন?

চৈতী চোখ পাকাল,

তীর্থ আবার শুরু করেছ?

সুদেষ্ণা বলল,

আরে দূর, তোমরা পুরুষরা চাও মেয়েরা তোমাদের দেখে লজ্জা করুক, এতে তোমাদের ইগো চরিতার্থ হয়। কিন্তু এটা তোমার ভুল ধারণা। আসলে আমি তোমায় কেন জানি না পছন্দ করতাম না। সেই জন্যই তোমার সাথে কথা বলতাম না। বুঝলে বৎস?

একসাথে এত মিথ্যা কথা সুদেষ্ণা কখনও বলে নি। সে এই সব বলে বেশ মজাই পাচ্ছিল। তীর্থকে একটু গম্ভীর দেখাল। 

এখন আর অপছন্দ করো না?

আদৌ না।

এটাও মিথ্যা কথা। প্রকৃত সত্য হল, সে এইমাত্র তীর্থকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। 

কেন?

কারণ এখন তুমি আমার প্রিয় বান্ধবীর বর। আগেই বলেছি।

ব্যস বান্ধবীর বর, এটাই কারণ?

ইয়েস।

কি জানি তোমার কথা আমার ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।

এবার চৈতী তর্কে নামল,

কেন মনে হচ্ছে না? তুমিই তো বলেছিলে সুদেষ্ণা তোমাকে পছন্দ করে না। তাই ওকে জানানোর দরকার নেই। শুধু ওকে না, কাউকেই জানাতে বারণ করেছিলে। যখন আমাদের দুই বাড়িতে সবাই জানবে, মত দেবে তখন সবাইকে জানালেই হবে। বলো নি? বাবাঃ এতদিন শুধু তোমার জোরাজুরিতে সব পেটের মধ্যে চেপে রেখেছিলাম। কি কষ্টে যে ছিলাম সুদেষ্ণাকে বলতে না পেরে। 

তীর্থ রেগে গেল,

দেখ, আমি ওভাবে বলি নি। তোমরা মেয়েরা সব কথাকে ভীষণ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারো।

চৈতী বলল,

মোটেই তা নয়। তোমার ধারণা ছিল আমাদের লাভ অ্যাফেয়ার্সে সুদেষ্ণা ভাংচি দেবে। অথচ ও সে রকম মেয়েই নয়। তোমরা দুজনেই দুজনকে ভুল বুঝেছ।

সুদেষ্ণা হা হা করে হাসল,

তবে একটা জিনিস তুমি ঠিক ধরেছিলে। আমি যদি চৈতীকে বলতাম তীর্থর সঙ্গে মিশিস না চৈতী আমার কথা শুনত। কি রে চৈতী শুনতিস না?

চৈতী জোরের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল,

একশোবার।

তীর্থ বলল,

তাহলে তো তোমার সুদেষ্ণাকেই জীবনসাথী করা উচিত ছিল। 

সুদেষ্ণা বলল,

আমরা জীবনে মরণে সাথী আছি, থাকবও। কিন্তু তোমরা শুরু করছ না কেন? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার খিদে পেয়েছে।

হ্যাঁ নিশ্চয়। শুরু করো। 

খাওয়া দাওয়া চলতে লাগল, এটা সেটা গল্প চলতে লাগল, তীর্থ নানা কথার ফাঁকে দাঁত বের করে হাসতেও লাগল। কিন্তু হাসিটা কেমন যেন চেষ্টাকৃত দেখাল, স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সব কিছু ঠিক ঠিক তেমনটা হল না যেমনটা সে আশা করেছিল। 



তীর্থ জানত সুদেষ্ণা তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসা তো বনের পশুও বুঝতে পারে, তীর্থ বুঝবে না তা কি হয়?

শুধু সুদেষ্ণাই নিজের প্রেমকে গোপন রাখতে পেরেছে ভেবে মূর্খের স্বর্গে বাস করছিল। 

তীর্থ যখন কমার্স নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিল, তখনই ঠিক করে নিয়েছিল, সহপাঠিনীদের মধ্যে থেকেই সে তার ভাবী স্ত্রী নির্বাচন করবে। তার দুই দাদাও প্রেম করেই বিয়ে করেছে। যেরকম সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ে আর তৎসহ নগদ ও যৌতুক তারা পেয়েছে, সম্বন্ধ করে বিয়ে করলে তা পেত কি না সন্দেহ। তীর্থ দাদাদের দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সে মেয়েদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রথম থেকেই বেশবাসে বেশ পারিপাট্য রাখত কলেজে আসার সময়। সব সময় তার চেষ্টা থাকত তাকে যেন আকর্ষণীয় দেখায়। অবশ্য সেভাবেই সাজসজ্জা করত যাতে সাজুনে কার্তিক বলে বদনাম না হয়। সে তার সব চেয়ে দামী পোষাক আসাক পরে কলেজে আসত, পড়াশোনার থেকে এ সবেই বেশী মন দিয়েছিল। 

তীর্থ প্রথমে সুদেষ্ণাকেই পছন্দ করেছিল। তাকে পটানোও খুব একটা কঠিন ছিল না। শুধু একদিন ফাঁকায় পেয়ে নতজানু হয়ে বলা, সুদেষ্ণা আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাহলেই সুদেষ্ণার সব প্রতিরোধ ভেঙে যেত। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখল, সুদেষ্ণার বাবা সামান্য চাকরি করে। ভাড়া বাড়িতে থাকে। তাদের পরিবারে অনেকগুলো সদস্য। শুধু দেখতে ভালো হলেই তো হবে না, সব দিক ভাবতে হবে। 

এর পর সে চৈতীর দিকে তাকাল। চৈতীও বেশ সুশ্রী। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল চৈতীরা বেশ অবস্থাপন্ন। নিজেদের দোতলা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। চৈতীরা দুই ভাইবোন। বাবা মার মৃত্যুর পর ওই বাড়ির অর্ধেক চৈতীর। তীর্থ অনেকদূর অবধি ভেবে নিয়েছিল। সে চৈতীকেই পটানোর কাজে লেগে গেল। পটাতে খুব একটা বেগ পেতে হল না। মেয়েদের পটানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। শুধু একটু লেগে থাকতে হয়। একবার যদি কোন মেয়ের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারো তুমি তাকে ভালোবাসো, সে তোমার জন্য প্রাণ দিয়ে দেবে। 

এই প্রেমের কথা সে গোপন রেখেছিল, চৈতীকেও রাখতে বলেছিল। বলেছিল তার বাড়ির লোক সহজে তাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না, এর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। যতদিন না বাড়ির লোককে বুঝিয়ে রাজী করাতে পারছে ততদিন চৈতী যেন এই সম্পর্কের কথা গোপন রাখে, কাউকে না বলে। সুদেষ্ণাকে তো নয়ই। কারণ সুদেষ্ণা তাকে পছন্দ করে না। আর অন্য সোর্স থেকে বাবা মা ব্যাপারটা জানতে পারলে হিতে বিপরীত হবে। 

কিন্তু আসল কারণ হল, সে অন্য অপশনগুলোও খোলা রাখতে চেয়েছিল। চৈতীর থেকে বেটার যদি কেউ জুটে যায় তাহলে এই সম্পর্ককে ছিঁড়ে ফেলতে সে এতটুকুও দ্বিধা করবে না। কিন্তু জুটল না। চৈতীর সঙ্গেই তার সম্পর্কটা পাকাপোক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। 

সুদেষ্ণার ভালোবাসা, লজ্জা এ সবও সে বেশ উপভোগ করত। একটা স্টেডি প্রেমিকা, আর তার লাজুক বান্ধবী, যে মনে মনে তাকে ভালোবাসে অথচ প্রচন্ড লজ্জা পায়। এ সব কিছু নিয়ে সে বেশ সুখেই ছিল। 

পড়াশোনার পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় সুদেষ্ণার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ সে চৈতীকে বলেছিল সুদেষ্ণাকে সারপ্রাইজ দিতে, সবকিছু জানাতে। বলেছিল, তোমার বন্ধুকে নিয়ে এসো একসাথে খাব, খুব মজা করব। 

কিন্তু মজাটা খুব একটা জমল না। সে অনেক কিছু আশা করেছিল, সুদেষ্ণা রেগে যাবে, কথা বলবে না। নিজের প্রেমের কথা এবার কিছুতেই আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তার চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল পড়বে, মুখ লাল হয়ে যাবে, সে না খেয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে যাবে। অনেক কিছুই আশা করেছিল তীর্থ। কিন্তু কিছুই হল না। সুদেষ্ণাকে খেপানোরও চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাতেও কোন লাভ হল না। এ যেন অন্য এক সুদেষ্ণা। 

সুদেষ্ণা খেতে খেতে গল্প করতে লাগল। তার মুখে হাসি। মন নির্ভার। ভাগ্যিস তীর্থ জানতে পারে নি সুদেষ্ণা তাকে ভালোবেসেছিল। ভাগ্যিস তীর্থর সঙ্গে তার প্রেম হয় নি। উঃ ভগবান বাঁচিয়েছে। প্রেমিক যদি তিন বছর প্রেম করার পর পঁচিশ হাজার টাকা চাইত তাহলে সে লজ্জায় সুইসাইড করত। 



খাওয়া শেষ। ওরা বেরিয়ে এল। 

চৈতী বলল,

বিয়ের দিন এক্কেবারে সকালে চলে আসবি কিন্তু। দেরি করবি না।

হ্যাঁ হ্যাঁ। তুই নিশ্চিন্ত থাক। আমি খুব সকালে চলে যাব। তীর্থ খুব ভালো লাগল। দারুণ ভালো খেলাম। আমি তাহলে আসি। তেইশ তারিখ দেখা হবে। রিকসা, এই রিকসা দাঁড়াও। 

সুদেষ্ণা বেশ খুশি খুশি হালকা মন নিয়ে রিকসায় উঠল। সে জানতে পারল না তার পিছনেই একজোড়া চোখের দৃষ্টি তার পিঠে গেঁথে আছে, যে চোখ ক্রোধে ক্ষোভে হতাশায় ধক ধক করে জ্বলছে। 



তীর্থ এই প্রথম আফসোস করতে শুরু করেছে, সুদেষ্ণা তার হাত ফসকে যাওয়ার জন্য, আর সারা জীবন আফসোস করতে থাকবে।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন