ছোটগল্প - ইন্দিরা দাশ



ছোটগল্পঃ

স্বার্থত্যাগ
ইন্দিরা দাশ


ভয়ংকর অবস্থা। শ’য়ে শ’য়ে অসহায় মানুষ জলের তোড়ে ভেসে গেছে। মা-বাবা হারিয়েছে সন্তানকে, স্বামী হারালেন স্ত্রীকে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তো তাঁর পুত্র-পুত্রবধূ, স্ত্রী, নাতি নাতনি সবাইকে হারিয়ে মাথা চাপড়িয়ে শুধু কেঁদেই চলেছেন, এখনও নিজে বেঁচে আছেন বলে, তাঁর মতে বিধাতা’র এ চরম অবিচার। দেবস্থানে এমন অঘটন, উত্তরাখন্ডে প্রথমই হোল।

আমাদের হাউসিং সোসাইটিতে নানারকম লোকের বাস। তবে সদাশয় লোকের অভাব নেই। এছাড়া, ধর্মের জায়গা বলেই হোক,বা সুন্দর জায়গা বলেই হোক পরিকল্পনা করা হোল কিছু আর্থিক সাহায্য জোগাড় করার। হইচই সাতকাহন কথা চলল ঠিকই কিন্তু কাজও এগিয়ে চলল সাথে সাথে। আসন্ন শীতে পাহাড়ি এলাকার অসহায় মানুষগুলো বাস্তুহারা হয়ে কষ্ট পাবে বড়। মহিলা সদস্যরা ভার নিলেন যথেষ্ট সংখ্যায় কম্বল জোগাড় করার। ঠিক হোল হাউসিং সোসাইটিরই চারজন মেম্বার যাবেন জিনিষপত্র নিয়ে ঐ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে।

আমার ড্রাইভার রাইচরণ বুড়ো হয়েছে, নাকি বোধহয় একটু ভুল বললাম, আমি ও রাইচরণ বুড়ো হচ্ছি একই সাথে। টানা কুড়ি বছর চাকরি করার ফলে তাকে আমার বাড়ির সদস্যই গণ্য করি আজকাল আমরা। অথচ সে নিজের জায়গাটি ভোলেনা ।গাড়িতে ওঠানামার সময় দরজা খুলে দিয়ে টান হয়ে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠোকা তাঁর কাজের এক অপরিহার্য আঙ্গিক, সে দিন-দুপুরের যে কোনও সময়েই হোক, বা শরীর যতই অসুস্থ থাক। আমার ছোট ছেলেটা দুষ্টুমি একটু বেশিই করত। ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে গরমের ছুটিতে দুপুরের ক্রিকেট ছেড়ে চুপটি করে এসে গ্যারাজের কাছে বন্ধুদের নিয়ে এসে দাঁড়াত, রাইচরণকে সেলামের ফুরসত না দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়বে বলে। বেচারা চরণ হয়ত সবে একটু হেলান দিয়েছে নিদ্রাদেবীর কোলে। কিন্তু কি এক অমোঘ উপায়ে বাবুন গাড়ির কাছাকাছি যেতেই তড়াক করে ড্রাইভারের সিট থেকে উঠে এসে রাইচরণ তার বিরাট সেলামখানি ঠুকে দরজা খুলে দিত “আসো ছোটবাবু” বলে। ছোটবাবু ততক্ষণে বেজার মুখে বন্ধুদের কাছে শর্ত হেরে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে রওনা দিতো, সাধাসিধে চরণ বুঝতেই পারতনা সে বিগড়ালো কেন।

রাইচরণের পরিবার, অর্থাৎ,একটি ছেলে, একটি মেয়ে ও রুগ্না বৌটি আমারই বাসস্থান থেকে একটু দূরে ছোট একটি ফ্ল্যাটে থাকে। ভাড়াটে অবস্থায় প্রত্যেক বছর বিতাড়িত হয়ে বাড়ি বদলাতে বদলাতে যখন সে জেরবার, তখনই একদিন হাতজোড় করে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল । মেয়েটি সতের আঠারোর হয়ে উঠেছে, সব এলাকার বাসিন্দারাও সমান নয়। ছেলেমেয়ে দুজনেই স্কুলের পড়ুয়া। বিশ্বস্ত মানুষটির উৎকন্ঠা আর মনোকষ্টের কারণ বুঝে আমিই ব্যবস্থা করি আমার পড়ে থাকা ছোট ফ্ল্যাটটিতে ওদের থাকার। সেই থেকে সম্পর্কের বুনিয়াদ হোল আরও পাকা। রাইচরণ যেমন রাখীপূর্ণিমার দিনে সস্তা একটি রাখী আমার হাতে নিয়ম করে বেঁধে দেয়, তেমনি আমার ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি বেশি করলে গম্ভীর হয়ে শাসনও করে । অথচ, স্কুল থেকে ফেরার সময় তাদের ফুচকা খাওয়ার আবদারও নিঃশব্দে রাখে। মানুষটা কথা কম বলে, তাই বন্ধু কম, অন্যান্য ড্রাইভারদের সাথে গুলতানি তার প্রায় হয়ই না, সবাই একটু বোকাসোকাই ভাবে ওকে।

“চলো চরণ, আজ বেডিং স্টোরে যাবো দুপুরের খাওয়ার পর”। গোটা তিরিশেক কম্বল আমিই দান করব, আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। মানুষের মানসিকতা নানারকমের হয়, এর মধ্যেই কিছু কম্বল জমা পড়েছে যেগুলো এতটাই পাতলা যে শীত তাতে মানবে বলে কোনোমতেই আশা করা যায়না। কিছু কিছুতে তো অল্পসল্প ফুটোও দেখলাম। অথচ যারা দিচ্ছেন, তারা মোটামুটি সবাইই সচ্ছল পরিবারের মানুষ।

চেনা দোকান। দোকানী নিজেই লোক দিয়ে বেশ বড়সড় তিনটে প্যাকেট করে কম্বলগুলো গাড়িতে তুলিয়ে দিলেন। রাইচরণ ও হাত লাগাল। ছায়াসঙ্গীর মত আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, তাই বোধগম্যও তার একটু একটু হচ্ছিল যে কি হতে চলেছে।

সোসাইটির বাচ্চা ও টিনেজারদের ভার দেওয়া হয়েছিল শুকনো খাবার প্রতিটি ফ্ল্যাটের থেকে চাঁদা হিসেবে জোগাড় করতে। আর জোগাড় হোল ডঃ মিত্র আর ডঃ গুপ্ত’র থেকে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ। মাথার ওপর ছাত নেই বলে, খিদে-তেষ্টা অথবা অসুস্থতা, ভাগ্যহীন মানুষগুলোকে রেহাই তো বড় একটা দেবেনা । 

সোসাইটির ট্রেজারার দীনেশ বাবু প্রত্যেকটি আর্থিক চাঁদার হিসেব বুঝিয়ে টাকাটাও যারা যাবেন তাঁদের হাতে তুলে দিলেন নির্দিষ্ট দিনের দিন দুই আগেই।

মাসের দুই তারিখ। সমস্ত মালপত্র প্যাকেজ করা শুরু হোল দুপুরের পর থেকে। বড় বড় বাক্সে লেবেল এঁটে সমস্তই প্রায় রাত এগারটার মধ্যে তৈরি। ভোরে ভলান্টিয়ার-রা রওনা হবেন সব মালপত্র নিয়ে। 

পরদিন রবিবার। রাইচরণকে নেহাত প্রয়োজন না পড়লে সেইদিন ডাকিনা । মাঝেমাঝে নিজের গাড়িটার স্টিয়ারিং, ক্লাচ, ব্রেকগুলোর পরখও করা যায় , অভ্যাসও একেবারে খারাপ হয়না। রাইচরণকে একেবারে সোমবার সকালে আসতে বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবো, তখন পেছন থেকে কুণ্ঠিত ডাক শুনলাম “সাহেব, একটু দাঁড়াবেন?” স্বল্পবাক মানুষটির আবার কোনও প্রয়োজন হোল ভেবে তিন ধাপ চড়েও নেমে এলাম আমি, জিজ্ঞেস করলাম –“কি হোল হে, বল এইবার”। খুব কিন্তু কিন্তু ভাবে প্যান্টের পকেট থেকে একটা আধময়লা রুমাল বের করে হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। রাত হয়ে গেছে, গিন্নীর কাছ থেকে রাতের খাবার খেতে আসার তলব এসে গেছে অনেকক্ষণ, ধৈর্যচ্যুতিই ঘটল একটু। গলাটা বোধহয় একটু চড়েই গেছিল, বলেই ফেললাম-“কি ব্যাপার কি, মুখে বলতে পারনা কিছু?”আস্তে রুমালের পোঁটলাটা রাখল সে আমার হাতে, আর, মৃদু স্বরে বলে উঠল “আমি গরিব আছে, কিন্তু মানুষ আছে সাহেব। আমি অল্প কর্জ নিয়েছি, নুনভাত খেয়ে ক’দিন ঠিক বেঁচে থাকতে পারব। আর কর্পোরেশানের স্কুলে বলে কয়ে ছেলেমেয়ের এ মাসের স্কুলের মাইনে পরের মাসে দেবার ব্যবস্থা করেছি সাহেব। হুই মানুষগুলোর জন্য আমিও কিছু দিতে চাই। এটুকু পেরেছি, লিয়ে যান সাহেব”। রুমালের তিনখানা গিঁট খুলতে যে সময় লাগলো, তার মধ্যে আমার বিরক্তি উবে গিয়ে একরাশ বিস্ময় জড়ো হয়েছে মনে ততক্ষণে।

শেষমেশ গিঁট খুলে দেখি চরণ তার পুরো মাসের মাইনেটি ধরে তার মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। কি বলব, কি করব ভেবে উঠতে পারছিনা, চোখ একটু জ্বালা করে উঠলো, তাই বন্ধ রাখলাম একটু, খুলে দেখি- ততক্ষণে ধীর পায়ে রওনা দিয়েছে রাইচরণ- অস্পষ্ট তার দেহাতি গুনগুন ভাসল হাওয়ায়-“ অ্যায়সে রাম দিন হিতকারী...হো...”।


2 মতামত: