ছোটগল্প - নারায়ণ রায়













ছোটগল্পঃ

পরাণের দাম
নারায়ণ রায়


ভোর পাঁচটা বাজে, অন্য দিনের মত পঞ্চা দোকান খুলে ঝাঁট দিয়ে, উনুন জ্বেলে উনুনের উপর তিনদিকে তিনটে জলভর্তি কেটলি চাপিয়ে মিনিট দুই জিরিয়ে নিল। এবার বিস্কুট, পাউরুটি আর ডিমের জায়গা গুলো ঠিক ঠিক জায়গায় সাজিয়ে নিল। এরপর আর একবার হাত ধুয়ে ধূপ জ্বেলে দোকানে বসেই হাতটা আরতি করার মত কয়েকবার ঘুরিয়ে নিয়ে ছোট্ট লক্ষ্মী মূর্তিটার নীচে গুঁজে দিয়ে প্রায় মিনিট খানেক হাত জোড় করে চোখ বুজে বসে থাকলো। আস্তে আস্তে দিনের আলো পরিষ্কার হচ্ছে, এদিকে জলও ফুটতে শুরু করেছে।

সকাল বেলার পরিচিত দৈনিক খরিদ্দাররা একে একে আসতে শুরু করেছে। এলাকার প্রতিটি খদ্দেরের নাড়ী নক্ষত্র পঞ্চার মুখস্থ, যেমন ঐ যে ছোটখাটো চেহারার লুঙ্গি পরা ছেলেটা? ওর নাম হরেন, ও এক কাপ চা আর একটা টোস্ট বিস্কুট খাবে তারপর এক প্যাকেট এরোপ্লেন ছাপ বিড়ি নিয়ে একটি বিড়ি ধরিয়ে চলে যাবে ঐ বহুতল নির্মানের সাইটে। ওখানে হরেন কাঠমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করে। হরেনের চা শেষ হওয়ার আগেই নিয়ামৎ এসে হাজির।

“কি রে নিয়ামৎ ? তুই আজ এত তাড়াতাড়ি ?” পঞ্চার প্রশ্নের উত্তরে নিয়ামৎ বলে, “ভুলে গেলে পঞ্চাকাকা, আজ শনিবার নারকেলডাঙ্গার খাসির হাট” এ কথা বলে পঞ্চার দোকানের বাঁদিকের চেরাই বাঁশের তৈরী বেঞ্চিটাতে দুটো পা তুলে আরাম করে বসতেই পঞ্চা একটা কেক ধরিয়ে দিল হাতে, কেকটায় যখন শেষ কামড় দেবে তখনই হাতে চায়ের গ্লাসটা এগিয়ে দেবে, আর চা টা শেষ করেই নিয়ামতও আট টাকা মিটিয়ে দিয়ে শহরের দিকে দৌড় লাগাবে, নিয়ামৎ ধুমপান করে না। কিন্তু আজ আর চা খেয়েই উঠে যাওয়া হ’ল না।

ঠিক সেই সময়ে ঝড়ের বেগে রতন চলে এল। এখানে রতনই একমাত্র লোক যে ওই বহুতল নির্মানের কোম্পানিতে সরাসরি মাস মাইনের চাকরী করে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ রতন ছোটখাটো রং মিস্ত্রির ঠিকাদার হিসেবে জীবন শুরু করে নিজ যোগ্যতায় এখন ঐ কোম্পানীর সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। তবে এখনও মিস্ত্রিদের সঙ্গে ভারায় উঠে নিজে হাতেও কাজ করে। পৃথিবীতে সর্বত্রই এমন কিছু লোক থাকে তারা যেখানেই যায় মুহূর্তেই সবার নজর কেড়ে নেয়, ইংরাজীতে যাকে বলে ‘Steals the show’। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান, বছর পঁয়ত্রিশ বয়সের রতন এই পাঁচ বছর হ’ল বিয়ে হয়েছে, বছর তিনেকের একটা ফুটফুটে মেয়েও আছে। সব সময় ফুর্তিতে থাকা সেই রতন সাইকেলটা একটা খুটিতে ঠেস দিয়ে রেখেই ঝড়ের বেগে চিৎকার শুরু করল, “কি গো পঞ্চাদা তাড়াতাড়ি একটা ডাবল ডিমের টোষ্ট বানাও তো!” বলে নিজেই বয়েম থেকে একটা পাউরুটি বের করে চাকু দিয়ে দু ফালা করে রুটির মধ্যে চাকুটা গুঁজে দিয়ে উনুন থেকে একটা কেটলি সরিয়ে রুটিটা সেঁকতে শুরু করে দিল। তারপর নিয়ামতের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,“আরে নিয়ামৎ ভাই যে ? তা আজ এত তাড়াতাড়ি ? ও আজ শনিবার, হুমমম তাইতো বলি আমাদের নিয়ামৎ ভাই একবার ছাগলের গলায় চাকু বোলায় আর একবার আমাদের পকেটে চাকু বোলায় আর দেখতে দেখতে নিয়ামতের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে” এই বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো। নিয়ামৎ বলল, “দুনিয়াটা অত সহজ না, এ তোমার ঐ ফ্ল্যাট বাড়ির রং-এর কাজ নয় যে, কোন রকমে দু পোঁচ মেরে দিয়েই দশ হাজার টাকার বিল করে দিলাম, আর লোক ঢোকার আগেই রং উঠে গেল।” হা হা হা করে উচ্চ স্বরে হেসে রতন নিয়ামতকে বলল, “তুই চারশো পঞ্চাশ টাকা কেজি তে তো মাংস বিক্রি করিস, মানে কুড়ি কেজি মাংসের একটা খাসির দাম নয় হাজার টাকা ? তা তোর নিজের পরাণের দাম কত ?” বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠলো রতন, আবার জিগ্যেস করে, “তা তুই খাসি কত করে কেজি কিনিস ?”

এবার নিয়ামতের হাসির পালা, রতনকে তুচ্ছ করে হাসতে হাসতে বলল, “কথায় বলে না যে, যার কাজ তারেই সাজে অন্য লোকে লাঠি বাজে, তোমার ঐ দেওয়ালের রং নিয়েই তুমি থাকো… আরে বাবা জ্যান্ত খাসি ওজনে বিক্রি হয়না। আমরা থামকো কিনি, তাই অনেক সময় লসও হয়।” হরেন এতক্ষণ কোন কথা না বলে ফুক ফুক করে বিড়িতে সুখ টান দিয়ে যাচ্ছিল, সে এতক্ষণে একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, “এটা তুমি জব্বর বলেছো রতনদা, নিয়ামতের একটা খাসির পরাণের দাম নয় হাজার টাকা হলে নিয়ামতের নিজের পরাণের দাম কত ?...” বলেই হরেন আবার তার সুখটানে নজর দিল। একে একে খগেন, গনশা, আকিব সবাই হাজির। তারাও যে যার মত আলোচনায় অংশ নিচ্ছিল। যাই হোক আলোচনা ভালই এগোচ্ছিল, তবে ঘড়ি ধরে যার যার কাজে বেরিয়ে যেতে হবে… তাই সাইকেলে উঠতে উঠতে রতন বলে গেল….. “ঠিক আছে নিয়ামৎ , আজ তোর একটা খাসির পরাণের দাম জানলাম নয় হাজার টাকা, কাল তোর নিজের পরাণের দাম কত হিসেব করব।”…. আস্তে আস্তে পঞ্চার দোকান একটু ফাঁকা হ’ল। এখন যারা বসে আছে তাদের তেমন কোন তাড়া নেই, ওদের উদ্দেশ্য পঞ্চার দোকানে বসে পাঁচটা গল্প করে সময় কাটানো। 

পঞ্চা কাপ ডিস গুলো পরিস্কার করে নিয়ে, আর দোকানটা একটু গুছিয়ে নিয়ে একটু আরাম করে বসল। তারপর হটাৎ কেমন যেন ভাবুক হয়ে গেল…মনের মধ্যেও কত কথা এসে একে একে ভীড় করতে শুরু করল…..আস্তে আস্তে এলাকাটার কি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল। এই এলাকাটার একটা অদ্ভুত মিশ্র চরিত্র আছে, পূব দিকের জলা ভেড়ীগুলোতে এখনও নিয়মিত মাছের চাষ হয়, সকাল বেলায় মাছ ধরা আর তার কেনাবেচা এসব নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ওই দিকটায় সারাদিন কেমন একটা আঁশটে গন্ধ। একটু দূরেই বিশাল বিশাল বহুতল নির্মিত হচ্ছে, এলাকার বেশ কিছু লোক ওখানে কাজকর্ম করে খাচ্ছে। দেখতে দেখতে কিছুদিনের মধ্যেই ঐসব এলাকায় একটা অন্য জগৎ তৈরী হবে, যেখানে পঞ্চাদের মত মানুষের প্রবেশ নিষেধ। পঞ্চার মনে পড়ে ছোটবেলায় ওর বাবা বলতো কলকাতা যাচ্ছি, ভালো করে খেয়ে দেয়ে পায়ে চটি গলিয়ে ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে ছাতা বগলে নিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পরতো। ফিরে এসে দোতলা বাস, রাস্তার ভীড়, কত বড় বড় বাড়ি এসব গল্প করত, অথচ সেই কলকাতাই এখন রাক্ষসের মত তার আসে পাশের গ্রাম গুলোকে গ্রাস করতে করতে একেবারে পঞ্চাদের গ্রামের নাকের ডগায় চলে এসেছে। তবে খালের এপারটা এখনও গ্রাম, জমির দালালরা এখনও খালের এপারটায় তেমন যাতায়াত শুরু করেনি। অনেকে বলে মাঝখানের ভেড়ীটাই তার কারণ, অতবড় ভেড়ীটাকে বোজানো নাকি আজকাল আর সম্ভব নয়, পরিবেশ দফতর এখন জনগনের চাপে একটু সজাগ হয়েছে। তাই এদিকটা এখনও পুরোপুরি গ্রাম, এলাকায় সবার ঘরে ইলেকট্রিক পর্যন্ত আসেনি, তবে অনেকেই বিদ্যুৎ চুরি করে ঘরে আলো জ্বালে, টি ভি চালায়, মোবাইলে চার্জ দেয়। এখনও বেশিরভাগ লোকের বাড়িতে হাঁস মুরগী চরে, অনেকের বাড়িতেই গরুও আছে।

তবে হ্যাঁ, এলাকার লোকেদের হাতে দুটো পয়সাও হয়েছে। গ্রামে এখন ঘরে ঘরে বাইক, সবার হাতে মোবাইল, মেয়েরা সল্ট লেকে সুপার মার্কেটে যায়, রং বে রং-এর ঘড়ি, চুড়ি, ফুলপ্যান্ট পরে। দেখতে দেখতে চেনা যায়গাটা কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। আর এত কিছু পাওয়ার মধ্যেও সর্বদা সেই ভয়টা কাজ করে, মাঝে মাঝেই দলাদলি, হানাহানি, খুনোখুনি। গ্রামের অনেক ছাপোষা ঘরের মেয়েদের সঙ্গে কলকাতার অনেক বড়লোক ছেলেদের বন্ধুত্ব হয়েছে। রাত্রের দিকে প্রায়ই দামি দামি সব গাড়ি আসে গ্রামে, গ্রামের মেয়েদেরকে তাদের বন্ধুরা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। অনেকে একেবারে রাত কাবার করে সকালে ফেরে। এই তো কদিন আগে একটা বেশ দামি গাড়িকে তেঁতুল তলায় তিন চার ঘন্টা এক যায়গায় ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে গ্রামের ছেলেদের সন্দেহ হয়। কাছে গিয়ে কালো কাঁচে চোখ লাগিয়ে দেখে পিছনের সীটে একটা মেয়ে ঘুমচ্ছে, অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোন সাড়া না পেয়ে ছেলেরা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে গাড়ির দরজা ভেঙ্গে দেখে মেয়েটি পাঁচ-ছয় ঘন্টা আগেই মারা গেছে। পরেরদিন খবরের কাগজে জানা যায় যে মেয়েটি দক্ষিণ কলকাতার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের।

টুকটাক খদ্দের সামলাতে সামলাতে আর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে একটা বেজে গেছে খেয়াল করেনি পঞ্চা। এইসময় পঞ্চা দোকান বন্ধ করে একটু বাড়ি যায়, খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চারটে পাঁচটা নাগাদ দোকান খোলে। আজও সেইরকম উনুনে জল দিয়ে ঝাঁপ নামিয়ে সবে একটা তালা লাগিয়েছে তখনই আকিব সাইকেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবরটা দিল। ‘রতন কাজ করতে করতে পাঁচ তলার ভারা থেকে একদম নীচে পড়ে গেছে। ওকে কোম্পানীর লোকেরা বাইপাশের ধারে একটা হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’ খবরটা শুনেই পঞ্চা কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন স্থবির হয়ে গেল, তারপর সম্বিৎ ফিরে পেতেই আকিবের সঙ্গে তার সাইকেলের পিছনে বসে হাসপাতালের দিকে রওনা দিল। এটা একটা বেসরকারী হাসপাতাল, বেশ পরিচ্ছন্ন, হাসপাতালের বাইরেই একটা গাছতলায় খগেন, গনশা, হরেন আরও বেশ কিছু লোক মুখ ভার করে বসে আছে। পঞ্চা আর আকিবও তাদের সঙ্গে বসে বসে পরস্পরের দিকে কেমন যেন এক অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকে। পঞ্চা জানার চেষ্টা করে ঠিক কি হয়েছিল, শরীরের কোথায় কতোটা চোট পেয়েছে এইসব, পঞ্চা এও জানলো যে ওর বাড়িতে এখনও খবর দেওয়া হয়নি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল সেই চরম সংবাদ। সবাই একসঙ্গে কেঁদে উঠল। কোম্পানীর একজন লোক ওদেরকে হাসপাতাল সীমানার বাইরে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় বসালো এবং ওদের চা বিস্কুট খাওয়ানোর ব্যবস্থা করল। কিন্তু চা খাবার ব্যাপারে কেউ তেমন উৎসাহ দেখালো না।

কিছুক্ষণ পরে কোম্পানীর এক বাবু বাইরে এসে বলে গেলেন “আপনারা আর বসে থেকে কি করবেন? আপনারা বরং আজ সবাই বাড়ি চলে যান। রতনের দেহ পেতে আরও ঘন্টা দুই লাগবে, পুলিশ ওর দেহ মর্গে নিয়ে যাবে, পোষ্টমর্টেমের পর বডি আমাদের হাতে আসতে কাল বেলা এগারোটা-বারোটা হয়ে যাবে, তখন আমরাই ওকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাবো।” এ কথা শুনে দুই-একজন চলে গেলেও বেশীরভাগ সবাই বসে রইল।

পরদিন গ্রামের কেউ কোন কাজে যায়নি, গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর গোছের ছেলে মর্গে গেছে রতনের দেহ আনতে। কারও বাড়িতে উনুন জ্বলে নি, সবাই রতনের বাড়ির অদূরে, কিন্তু একটু আড়াল রেখে গোল হয়ে ছল ছল চোখে বসে আছে। গ্রামের কিছু উৎসাহী ছেলে রতনের ছবি সমেত একটা ব্যানার টাঙ্গিয়ে দিয়েছে- “আমাদের গ্রামের গৌরব রতন কুমার দাস অমর রহে।” বাড়িতে রতনের বউ ঘন ঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছে, ওর অসুস্থ মাকে নাকি এখনও খবরটা দেয়াই হয়নি। নিয়ামৎ মাঝে মাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠছে, “কাল রতনদা যাবার সময় শেষ কথা বলেছিল আজ আমার পরাণের দাম জানতে চাইবে।” বলেই আবার কেঁদে উঠল। কান্না জিনিসটা বড়ই সংক্রামক, নিয়ামতকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে পঞ্চাও হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। কখন কাঁচের গাড়িতে শুয়ে রতন গ্রামে ফিরবে তার অপেক্ষায়। অবশেষে সেই বহু প্রতিক্ষিত গাড়িটকে আসতে দেখেই গোটা গ্রাম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। গ্রামের সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল বর্ণময় ছেলেটির নিথর দেহ আজ কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ঐ কাঁচের গাড়ির ভিতর। রতনের বউকে দুই প্রতিবেশী মহিলা ধরে ধরে নিয়ে আসছে, সে এক অসহনীয় দৃশ্য। পাশের বাড়ির এক কাকীমার কোলে থাকা তার তিন বছরের শিশু কন্যাটি এইসব দেখেশুনে কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে।

এবার যাওয়ার সময়, সঙ্গে একটা গাড়িতে কয়েকজন রতনের অফিসের লোক এসেছেন, এখনও পর্যন্ত তারাই সব খরচ-খরচা দিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামের লোকেরা কিছু ফুল আর অফুরন্ত চোখের জলে বিদায় দিল তাদের প্রিয়জনকে। প্রথমে শবযানটি, তার পিছনে কোম্পানীর গাড়িতে রতনের অফিসের লোকজন এবং সবশেষে একটি ম্যাটাডোরে গ্রামের পনের-কুড়িজন লোক। এই সময়টাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক। কাঁদতে কাঁদতে সবাই গাড়ির পিছন পিছন হাঁটছে… নিয়ামৎ উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় পড়েই গেল, তাকে তুলতে গিয়ে পঞ্চাও পড়ে গেল। ততক্ষণে শবযানটি শেষবারের মত রতনকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে আস্তে আস্তে দূর থেকে আরও দূরে চলে গেল।

পরদিন সকাল, গ্রাম আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে, তবে পঞ্চা আজও দোকান খোলেনি। নিয়ামতের মনটা আজও কেমন ছটফট করছে। থেকে থেকে কেবলই রতনের কথা মনে পড়ছে আর চোখ দুটো ছলছল করে উঠছে। দুজন সঙ্গে কিছু টাকা নিয়ে রতনের বাড়ির দিকে যাচ্চে, রতনের বউ, মা আর মেয়েটার আপাতত খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থা হয়েছে তাই জানার জন্য। ঠিক এমন সময় একটি দামি গাড়ি এসে দাঁড়ালো রতনের বাড়ির সামনে, গাড়ি থেকে দুজন ভদ্রলোক নেমে রতনের বাড়ি কোনটা জানতে চাইলো। পঞ্চা আর নিয়ামৎ ওদের দুজনকে রতনের বাড়ি নিয়ে যেতেই ওদেরকে দেখে রতনের বউ আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কান্না একটু থামতেই দুজনের মধ্যে যিনি বয়স্ক তিনি রতনের বউকে নমস্কার করে নিজের পরিচয় দিলেন রতনের অফিসের একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এবং রতনের মত একজন কাজের লোকের এইভাবে হটাৎ চলে যাওয়ায় তাঁর কোম্পানীর যে কি বিরাট ক্ষতি হ’ল তাও বললেন। আগামীকাল রতনের স্মরণে অফিসে একটি শোকসভার আয়োজন করা হয়েছে, তিনি সেই সভায় যাওয়ার জন্য রতনের স্ত্রী ও মাকে আহ্বান জানালেন। এও বললেন যে ওদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোম্পানী গাড়ী পাঠিয়ে দেবে। এটুকু বোঝা গেল যে রতনের বউ-এর তখন অত কথা শোনার মত মানসিকতা নেই, সে শুধু কেঁদেই চলেছে । ঠিক এই সময় ঐ অফিসার ভদ্রলোক পকেট থেকে একখন্ড কাগজ বের করে রতনের বউ-এর হাতের কাছে ধরে বললেন-“আসলে রতনের মত মানুষের প্রাণের দাম তো আর টাকা দিয়ে বিচার করা যায়না, তবু তার অনুপস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক আঘাতটা সামাল দেবার জন্য কোম্পানী আপনাকে এই দুলাখ টাকার চেক টা দিচ্ছে।” রতনের বউ তখনও কেঁদেই চলেছে, হাত বাড়িয়ে চেকটা নেওয়ার মত অবস্থা তার নেই, তাই তার হয়ে নিয়ামৎ চেকটা হাতে নিয়ে ডুকরে কেঁদে বলে উঠল “হায় আল্লা, এটাই বুঝি রতনদার পরাণের দাম?”


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন