কৌতুক-নাটিকা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়








কৌতুক-নাটিকাঃ

শাঁখা সিঁদুরের দাম
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



বাবা । [ক্লান্ত-বিধ্বস্ত গলায়] ওঃ যা গরম পড়েছে। আর যা ট্র্যাফিক জ্যাম। অফিস করা না যমযন্ত্রণা ভোগ করা ।

মেয়ে । বাবা চা ।

বাবা । [পরিতৃপ্ত গলায়] চা এনেছিস মা ? [ চুমুক দিয়ে ] আঃ বাচলাম । দীর্ঘজীবী হ’ মা, আশীর্বাদ করি । তোর জন্যে আমার বড় চিন্তা হয় রে ।

মেয়ে । কিসের চিন্তা বাবা ?

বাবা । বাবাদের আর কিসের চিন্তা বল ? বি-এ পাস করে বিয়ে না করে বসে আছিস । চাকরি তোর ভাল লাগে না । এখন বিয়ে তো তোর একটা দিতে হবে নাকি ? বাবা যখন হয়েছি সে কর্তব্য তো করতেই হবে মা ।

মেয়ে । [অভিমানের সুরে] এ বয়েসে এত চিন্তা ভাল নয় বাবা । তাছাড়া–

বাবা । চিন্তা কি আর সাধে মা ? এই বাজারে ভাল মোবাইল পাওয়া যায়। কিন্তু ভাল বর কি পাওয়া যায় বল ? সব বর্বর । পণ নাকি আর এখন কেউ নেয় না । যৌতুক নাকি এখন একটা কৌতুক হয়ে দাঁড়িয়েছে । পণ না নেবার পণ করে এখন নগদ ছেড়ে সব গদগদ হয়ে অন্য কিছু চাইছে। ঐ ইংরেজীর প্রবাদে যাকে সব বলে “ in kind” আর কি । দয়া পরবশ হয়ে এখন সব “in kind” এর দিকে ঝুঁকছে ।

মেয়ে। বাবা,এত চিন্তা করো না, শরীর খারাপ হবে । তাছাড়া –

বাবা । ওরে কথায় বলে টাকা ফেললে নাকি বাঘের দুধ পাওয়া যায় । কিন্তু বর পাওয়া যায় কত রাত্রি শিবরাত্রি করলে কে জানে ।

মেয়ে । [হেসে] আমার বর আমি ঠিক করেছি। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো না ।

বাবা । কেমন করে মা ? এ কালে তো স্বয়ংবর-টর কিছু হয় না । তবে প্রেম হয় । চাকরির ইন্টারভিউয়ের মত অনেকগুলো প্রেম হলে তবে যদি একটা বর মেলে । তা তুই –

মেয়ে । অনেকগুলো নয় বাবা । একটা মাত্র প্রেমেই আমি কাত করেছি সৌমেনকে ।

বাবা । [বিস্ময়ে] প্রেম ? তুই ? কিন্তু তুই তো হরর ফিল্মের পোকা ছিলি মা, রোমান্টিকে তো এলার্জি ছিল ?

মেয়ে । লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট, বাবা । আমি এমনভাবে তাকিয়েছিলুম যে সৌমেন আর থাকতে পারে নি । প্রথমে রাস্তার ধারে থাকা একটা বড় নালায় আর তার পরে আমার প্রেমে পড়ে গেল । কি করি বল । পঞ্চশরে তো স্বয়ং শিবই কাবু হয়েছিল । ভাগ্যিস একটা বছর শিবরাত্রিটা করেছিলাম।

বাবা । [সোৎসাহে] ভাল ভাল । সুখের কথা । তারপর ?

মেয়ে । রেজিস্ট্রিটা করে ফেললাম বাবা । তোমার অমত নেই তো ?

বাবা । করেই যখন ফেলেছিস তখন আর মত জেনে কি হবে বল ? মত না হলে তো আর ডিভোর্স করবি না ?

মেয়ে । [আবদারের সুরে] বাবা তুমি যেন কি । তোমার কত খরচ বাঁচিয়ে দিলাম বল । কিচ্ছুটি নেবে না সৌমেন । ভীষণ আদর্শবাদী ছেলে তো ।

বাবা । [অবাক হয়ে] কিচ্ছু নেবে না ? একেবারে খালি হাতে ?

মেয়ে । আহা তা কেন । শাঁখা সিঁদুর তো তুমি দেবেই । ওর থেকে মূল্যবান আর কি আছে বল ?

বাবা । [আশ্বস্ত হয়ে] এ একটা সত্যি সুখবর মা । প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোনটা আর আমায় নিতে হল না । তোর দিদির বিয়েতে নিয়েছিলুম এখনও ঘা টা শুকোয় নি ঠিকমত । যাক আর নতুন করে খোঁচাতে হবে না, এই ঢের। বাঁচালি মা, আশীর্বাদ করি –

মেয়ে । আমি বুঝি আমার দিদির মত ? শুধু এ দাও আর ও দাও । সৌমেন খুব আদর্শবাদী ছেলে বাবা । তুমি শুধু আশীর্বাদটুকু দিও ।

বাবা । সে আর বলতে ? একেবারে প্রাণ খুলে করব মা । তুই দেখে নিস। তা শুধু শাঁখা সিঁদুরই যদি হয় তো আমি একটু ভাল কোয়ালিটিরই দোব ।

মেয়ে । হ্যাঁ শুধু শাঁখা সিঁদুরই । তবে –

বাবা । তবে ? বল মা খুলে বল । তুই আমার বড় উপকার করেছিস । আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর অকাল-হামলা বন্ধ করেছিস ।

মেয়ে । [ইতস্তত ভাবে] সিঁদুর তো আমি পরব না তুমি জান । আমার এলারজি আছে । তাছাড়া কৃত্রিম রূপচর্চা আমি বরদাস্ত করতে পারি না মোটে । আমার গায়ে জ্বালা ধরে ।

বাবা । [সামান্য হেসে] সে তো জানি মা । তুই শশা থেঁতো করে মাখিস । রসুন বেটে মাখিস । গাজর মুখে ঘষিস - মানে যা সব আমরা স্যালাডে খাই আর কি –

মেয়ে । এসব প্রাকৃতিক রূপচর্চার অঙ্গ বাবা । হাসির কথা নয় । [বাবা সামান্য গম্ভীর] কিন্তু সিঁদুর একটা কেমিক্যাল । ওটা মাথায় দেওয়া কি ঠিক বল ?

বাবা । [ঘাড় নেড়ে] তা বটে । তবে শাঁখা অতটা –

মেয়ে । অতটা খারাপ নয় ? কি বলছ বাবা ? ঠোক্কর লেগে যদি হাতে ফুটে যায় ? শুনেছি শাঁখা নাকি শাঁখ থেকে হয় আর শাঁখ –

বাবা । একটা সামুদ্রিক প্রাণী । এই তো ?

মেয়ে । বটেই তো । পচা শামুকে পা কেটে গিয়ে আমার এক বন্ধু মারা গিয়েছিল জান ? আর শাঁখ তো শামুকের জাতভাই ।

বাবা । ঠিক । তা হলে ?

মেয়ে । ফেলে তো আর দেওয়া যায় না । বাবার দেওয়া আশীর্বাদী জিনিস। বল বাবা তুমিই বল ?

বাবা । [চিন্তার সঙ্গে ঘাড় নেড়ে] হু চিন্তার কথা । ভেবে দেখিনি ।

মেয়ে । শুধু তুমি কেন । আমার মনে হয় বাংলার কোনও বাবাই ভেবে দেখে না । মেয়ের কষ্ট তো বয়েই গেল [কাঁদো কাঁদো] ।

বাবা । কাঁদে না মা কাঁদে না ।

মেয়ে । তা যাক বাবা দিলে তো নিতেই হবে । ধর্মরক্ষা বলে কথা । কিন্তু শাঁখা সিঁদুর একটা সিম্বলিক বাবা । তাই ওটাকে তো রাখতে হবে যত্ন করে তাই না ?

বাবা । ঠিক । আমার মেয়ের হাত কেটে যাবে কি কপালে ক্যান্সার হবে সেটা আর বাবা হয়ে আমি কি করে চাই বল মা ?

মেয়ে। আহা তা না হয় থাকবে । কিন্তু যত্ন করে তুলে রাখতে হবে তো? তোমার দেওয়া স্মৃতি বলে কথা । তাই একটা –

বাবা । একটা কি রে ?

মেয়ে । না বিশেষ কিছু নয় । ড্রেসিং টেবিলের বদলে আমি বরং বড় একটা আয়না দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব । একটা কাঠের বাক্সে বরং শাঁখা সিঁদুর খুব যত্ন করে রেখে দেব ।

বাবা । পাগলি মেয়ে । একটা ড্রেসিং টেবিলের আর কত দাম । ও তুই ভাবিস নি । সাজগোজও হবে আবার শাঁখা সিঁদুর ওর মধ্যে যত্ন করে রাখতে পারবি । শাঁখা সিঁদুরের সঙ্গে ও তোকে আমি ফ্রি দিয়ে দেব । আজকাল ব্যবসায়ীরা কত কি ফ্রি দিচ্ছে । পারলে টোপরের সঙ্গে বরকেও ফ্রি দিতে পারলে বেঁচে যায় । আজকালকার দিনে বিয়েতে নাকি কেউ টোপরও পরতে চায় না । টোপরের সেল নেমে যাচ্ছে হু হু করে । তা আমি মেয়েকে শাঁখা সিঁদুরের সঙ্গে একটা ড্রেসিং টেবিল ফ্রি দিতে পারব না ? ও তুই ভাবিস না ।

মেয়ে । তোমার মত বাবা থাকতে আমি ভাবব কেন বাবা ? ভালই হল ড্রেসিং টেবিলটা পেলে আমার শাঁখা সিঁদুর তার মধ্যে যত্ন করে রাখতে পারব । যত যাই বল হিন্দুদের কাছে শাঁখা সিঁদুর একটা হেরিটেজ । একটা স্ট্যাটাস সিম্বল কিনা বল ? তবে –

বাবা । [সামান্য বিরক্ত] আবার কি হল ?

মেয়ে । [সলজ্জভাবে] দুদিন পরে তো নাতি কি নাতনি কিছু হবে নাকি?

বাবা । [ভীষণ খুশি হয়ে হেসে] তা তো হবেই । আরে নাতি নাতনির মুখ দেখব বলেই না তোর বিয়ে দেওয়া ।

মেয়ে । কিন্তু সেই দুষ্টুটা তো কোনও না কোন সময় ড্রেসিং টেবিল খুলবে টেরও পাব না । শাঁখা সিঁদুর নিয়ে খেলবে । শাঁখায় হাত কাটবে । সিঁদুর মাখবে সারা মুখে –

বাবা । [শিউরে উঠে] ওরে থাম থাম ।

মেয়ে । আমি তো না হয় থামলাম, বাবা, কিন্তু সে দামালটাকে থামায় কে? তুমি আমি বা ওর বাবা কেউ তো আর চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে পারব না দস্যিটাকে । শিশু তো অবোধ, বাবা ।

বাবা । তা তুই চাবি দিয়ে রাখবি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে । চাবি দেওয়া থাকলে তো আর –

মেয়ে । সে না হয় হল । কিন্তু আমি ভাবছি চাবিটা আমি কোথায় রাখব । আঁচলে যে বাঁধব তার তো সুযোগ নেই । জিনস চুড়িদারের কি আঁচল হয়?

বাবা । [চিন্তাচ্ছন্নভাবে] তা বটে ।

মেয়ে । চাবিটা অবশ্য একটা স্টীলের আলমারিতে রাখা যায় । [একটু ভেবে] তা একটা গোদরেজের আলমারির আর দাম কত । ও আমি ম্যানেজ করে নেব । তাই বলে ভেবো না ওটা আমি তোমার কাছ থেকে চাইছি । আমিও নয়, তোমার জামাই সৌমেনও নয় । বড় আদর্শবাদীছেলে বাবা কিন্তু তোমার জামাই । তোমার মেয়ে যাকে তাকে কিন্তু বাছে নি বাবা । বর সে বটে, তবে বর্বর মোটেই নয় । শ্বশুরের ঘাড়ে রদ্দা মারার ছেলেই নয় সে ।

বাবা । [সামান্য থেমে] তা তুই ভাবিস না মা । আমি নাহয় একটা স্টীলের আলমারি দিয়েই দেব । গোদরেজের আলমারি কত আর পড়বে । কুড়ি পঁচিশের মধ্যেই –

মেয়ে । তা হলে তো ভালই হয় বাবা । কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা –

বাবা । আবার কি কথা মা ?

মেয়ে । স্টীলের আলমারি তো না হয় তুমি দিলে । তোমার উঁচু নজর তাই গোদরেজ দেবে তাও জানি । কিন্তু ভাবছি অন্য কথা –

বাবা । কি কথা ?

মেয়ে । ভাবছি অত আলমারির অত বড় লকার ফাঁকা থাকবে ?

বাবা । বোকা মেয়ে । ফাঁকা থাকবে কেন ? মায়ের গয়নাগুলো কি করতে আছে শুনি ? ওসব আর কে পরবে । ভাই টাই তো তোর কেউ নেই । নাহলে তার বৌয়ের জন্যে রেখে দিতাম । তা ও সব তো এখন তোর ।

মেয়ে । [খিলখিল করে হেসে] মায়ের গয়না ? বৌদ্ধযুগের কি মধ্যযুগের কে জানে । আমার প্রেস্টিজের কথা গুলি মারো । কিন্তু আমি ওসব পরলে তোমার প্রেস্টিজ কোথায় থাকবে বলত ? তুমি কি আর মাথা উঁচু করে চোখ তুলে হাঁটতে পারবে কোনোদিন ? [একটু থেমে] ওসব তুমি মিউজিয়ামে দান করে এস বাবা । আমি নাহয় খালি গলা আর খালি হাতেই থাকব । আমাদের মত দরিদ্র দেশে কটা লোক আর গয়না পরে বল ।

বাবা । [মন্থর গলায়] কিন্তু ওগুলো গলিয়ে –

মেয়ে । তা মিউজিয়ামের বদলে আমাকে দান করতে চাইলে কি আমি না করতে পারি বাবা ? যত যাই হোক আমি তো তোমারই মেয়ে নাকি ? কিন্তু শুধু ঐ পুরানো গয়না গলিয়ে স্যাকরা কি নতুন কিছু গড়তে রাজী হবে বল ?

বাবা । বেশ আমি নাহয় নতুন কিছু দেব ওর সঙ্গে ।

মেয়ে । সে আমি কিছু চাইছি না । তোমার জামাইও নয় । ভীষণ আদর্শবাদী ছেলে তো । তবে তুমি দিতে চাইলে আমি আপত্তি করব না । আর সৌমেনও হয়ত করবে না । শ্বশুরকে কি আর সে অপমান করতে পারে বল? তেমন ছেলে কি আমি বাছতে পারি ?

বাবা । তা – বটে ।

মেয়ে । সৌমেন খুব ভাল ছেলে বাবা । অফিস থেকে ফিরে গলদঘর্ম হবে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে হাত ব্যথা করে ফেলবে তবু কখনও বলবে না একটা ইলেক্ট্রিক ফ্যানের কথা । জানে তাতে তোমাকে খামোখা চাপ দেওয়া হবে ।

বাবা । তা একটা ফ্যান –

মেয়ে । হ্যাঁ সে প্রবলেম নাহয় সলভড । কিন্তু সব সমস্যার কি সমাধানের চাবিকাঠি তুমি বানাতে পার বাবা ? সৌমেন খুব ভাল ছেলে । অফিস থেকে ফিরে তোমার দেওয়া পাঞ্জাবী আর পাজামা পরে আমার সঙ্গে গল্প করবে খোলা আকাশের নীচে । নীলাকাশ মৃদুমন্দ বাতাস – প্রকৃতি বড় ভাল হজমের ওষুধ বাবা । ছাড় তো টিভি মিউজিক সিস্টেমের কথা । ওসব হল চোখ আর কান খারাপের যন্ত্র । তুমি কিচ্ছু ভেব না বাবা । সৌমেন অমন ছেলেই নয় । ভীষণ আদর্শবাদী বাবা । পণ না নেবার ধনুর্ভাঙা পণ করে বসে আছে একেবারে । তাছাড়া গান শুনলেই অমনি নাচতে ইচ্ছে করবে । আর তাহলে বুড়ো বয়েসে হাত-পা ভেঙ্গে – না মানে তোমার জামাইকে বুড়ো বলছি না ।তবে – তিরিশ বত্তিরিশটাই বা আর কম কি ।

বাবা । [ক্লান্ত গলায়] তা – সে – না হয় টিভি মিউজিক সিস্টেম আর যা কিছু লাগে তার ব্যবস্থা –

মেয়ে । বলতে হবে না বাবা বুঝেছি আমি । দিলে একটু ভাল ব্র্যান্ডেরই দিয়ো । বাবার বদনাম হোক এ কোন মেয়ে চায় বল ? এই তো বলে আমার বাবা । বাবা তো নয় একেবারে বাবা নম্বর ওয়ান । না, আমি বলছি না যে আমার আর কোনও বাবা –মানে তুমি তো জান না বাবা সৌমেনের বাবা নেই । সেই ছেলেবেলায় মারা গেছে । আর আমার ভালবাসায় গদগদ হবার পর তোমার প্রতি শ্রদ্ধায় । জান তো বাবাসাইকেলে করে অফিস যায়। এই গরমে – একি বাবা তুমি এত ঘামছ কেন ? এখনও তো গরম তেমন ভাল করে পড়ে নি । এসো, এসো, একটু ঘাম মুছিয়ে দিই ।

বাবা । থাক, থাক, মা । মাথার ঘাম আমার সারা জীবন ধরে পায়েই ঝরে পড়েছে । আর না হয় পড়ল কয়েক ফোঁটা । কিন্তু তোর সৌমেনের ঘামের দাম অনেক । ওটা তো ঝরতে দেওয়া যায় না ।

মেয়ে । [ম্লান গলায়] কি আর করবে বল । কপাল । সবাই কি আর হিরো হোন্ডা চাপার বরাত করেছে বল ?

বাবা । তা আমি একটা হিরো হোন্ডা–

মেয়ে । [সোৎসাহে] সে তো তুমি দেবেই । আমি জানি বাবা । আমার কষ্ট তুমি সইতে পার না । ছেলেবেলা থেকেই তো দেখছি । আর আমি তো তোমার বড় মেয়ের মত নই গো – শুধু চাই আর চাই । আমি কি অমন মেয়ে বল ?

বাবা । তা – তো বটেই । আমি বরং একটা হিরোহোন্ডা দিয়েই দেব মা।

মেয়ে । তবে বাবা ও সব কিনতে আবার সব ফিক্সড ডিপজিটগুলোখরচা করে দিয়ো না যেন । আচ্ছা চিরকাল কি আর আমরা দুজন থাকব বাবা? দুজন থেকে তিনজন কি হব না ? তিনজন থেকে চারজন হওয়াটা না হয় আটকে দেব । কি আর করা যাবে । তুমি তো আর চারচাকা দিতে পারবে না ? আর কতই বা দেবে ? দেওয়ার তো একটা সীমা আছে না কি ?

বাবা । চা–রচাকা ?

মেয়ে । তাই বলে আবার ন্যানো ফ্যানো দিয়ে বস না যেন । স্পেস বড্ড কম । আমি চেপে দেখেছি । আমার এক বন্ধুর আছে । ওর বিয়েতে ওর কিপ্টে বাবা প্রেজেন্ট করেছে । কিন্তু তোমাকে কেউ কিপ্টে বলুক সে কি আমি চাই বল ? সৌমেনও চায় না । খুব আদর্শবাদী ছেলে বাবা । আর যা পিতৃভক্ত । তোমাকে কিপ্টে বললে তাকে যদি চড় মেরে দেয় ?

বাবা । তা কি রকম চার চাকা –

মেয়ে । ও তুমি কিচ্ছু ভেব না । আমি ইন্টারনেট থেকে চয়েস করে নেব। কিন্তু তাই বা করি কি করে ছাই –

বাবা । কেন মা ? অন্তরজাল কি এখন অন্তর্জলিতে যাত্রা করেছে ? এখনও তো আছে শুনেছি । ছেলে মেয়েগুলোর মাথা খাওয়া এমন জিনিসটা চলে গেল ?

মেয়ে । [বিরক্তভাবে] কি যে ব্যাকডেটেড লোকের মত opinion দাও না বাবা । internet মাথা খায় না বরং আরও সাফা করে । সে যাক, কিন্তু বাড়িতে broadband থাকলে তবেই না internet দেখার প্রশ্ন ?

বাবা । তা সে একটা landline কি –

মেয়ে । আজকাল অবশ্য লোকে landline আর mobile দুটোই রাখছে। ওতে বড় সুবিধে বাবা । একটা গেলেও আর একটা থাকবে ।

বাবা । [স্বগতোক্তি] বুঝেছি মা । এখন দেখছি তোর দুটো বাবা থাকলেই ভাল ছিল । একটা টেঁসে গেলে আর একটা দিয়ে কাজ চলত ।

মেয়ে । কি বিড়বিড় করছ ?

বাবা । না কিছু নয় । মনে মনে একটা মন্ত্র পড়ছিলাম রে । রামকৃষ্ণ মন্ত্র – ঐ যে কি বলে, টাকা মাটি-মাটি টাকা । মানে একজন যদি টাকাকে মাটি করে তো অন্য একজনকে মাটি থেকেই টাকা খুঁজে আনতে হবে কিনা । দরকার হলে মাটি কাটতে হবে । মাটি বইতে হবে । এটা তারই মন্ত্র মা ।

মেয়ে । হ্যাঁ যা বলছিলাম বাবা । সৌমেন আবার একটু বেশী ঘামে । গরম কালে তো অফিস ছেড়ে বাড়ীতে ঢুকতেই চায় না ।

বাবা । সেকি রে অফিসে আবার ওর অন্য কোনও – মানে বান্ধবী টান্ধবী নেই তো ?

মেয়ে । [হেসে] সতীন ? কি যে বল ? তা একরকম বলতেই পার ।

বাবা । কি রকম ?

মেয়ে । ঐ যে ওর অফিসের এ-সি মেশিনটা । ওর প্রেমেই তো পাগল সৌমেন । ওকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে চায়-ই না গো । তবে তোমাকে আমি তাই বলে এ-সি টে-সি দিতে বলছি না । আমি কি তোমার অমন মেয়ে ? আর তোমার জামাইও – যা আদর্শবাদী ছেলে ? তুমি দিয়েছ শুনলেই খেপে যাবে আমার ওপর । হয়ত অভিমানে কথাই বলবে না কটা দিন । তবে –

বাবা । তবে ?

মেয়ে । তবে যদি তুমি ভালবেসে দাও তো সে কি আর না করতে পারবে বল ? তার যে নিজের বাবা নেই, তুমিই যে একমাত্র বাবা তার । তোমাকে কি দুঃখ দিতে পারে ? তা এ-সি দিলেও ফ্রিজ তুমি দেবে জানি। তুমি কি আর বঞ্চিত করবে আমাকে ? বড় মেয়েকে যখন দিয়েছ –

বাবা । তা বেশ । একটা এ-সি আর একটা ফ্রিজ –

মেয়ে । তোমার মেয়ের একটু কষ্ট হবে বটে । তবে ও জামাকাপড় আমি সব হাতেই কেচে নেব । রবিবারে সৌমেনই বা আর কি করবে । তোমার দেওয়া গাড়ী করে একটু উইক এন্ডে গেলে কাচার সময় অবশ্য আমরা কেউ পাব না । তা কি আর করা যাবে বল । বিধাতা কাকেই বা আর দিনে ছাব্বিশ আঠাশ ঘন্টা দিয়েছে । চব্বিশ ঘন্টাতেই তো দিনটা ফুড়ুৎ।

বাবা । তা একটা ওয়াশিং মেশিন না হয় –

মেয়ে । দিলে ঐ সেমি অটোমেটিকটা নয়, পুরো অটোমেটিকটাই দিয়ো বাবা। বোঝই তো আজকাল হল নিজে নিজে হয়ে যাওয়ার যুগ । এখন সব তো automatic, ম্যানুয়াল আর কোথায় কি আছে ? ময়লা জামা ফেলে দেব আর ফরসা ইস্তিরি হয়ে বেরিয়ে আসবে ।

বাবা । [বুকের বাঁ দিকটা চেপে ধরে যন্ত্রণা কাতর অভিব্যক্তি নিয়ে] এ – আর – এমন কি কথা মা । আমার জন্যে তোর কত দরদ । নিশ্চয় তুই ওজন্মে আমার ছেলে ছিলি । কত বুঝিস ।

মেয়ে । বুঝি বলেই তো টানটা আছে বাবা । নাহলে –

বাবা । পাগলি মেয়ে । বাবাকে সব খুলে বলতে হয় ।

মেয়ে । কি বলি বল তো বাবা ? আমি কি লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে পারব সৌমেনের এমন ছোট পুরোন মান্ধাতা আমলের বাড়ীটা ছেড়ে একটা হালফ্যাসানের বাড়ীর কথা ? সৌমেন বলতে দেবে ? তোমাকে তো কতবার বলেছি বাবা যে ও খুব আদর্শবাদী ছেলে ।

বাবা । তা – ওখানে যদি অসুবিধে হয় তো উঠে আয় না এখানে আমার বাড়িতে । বেশ খোলামেলা ।

মেয়ে । বাবা এ বাড়িটা বরং মিউজিয়ামকে দান করে দাও । ওদের পুরনো জিনিসের খুব কদর । মিউজিয়াম যদি নিতে না চায় তো অগত্যা আমাকেই দিয়ো । আমি আর না বলি কি করি বল ? যদি বল তো এটা বেচে – না কোনও পশ্‌ এলাকায় ভাল ফ্ল্যাট হবে বলে তো মনে হয় না ।

বাবা । [যন্ত্রণা কাতর ভাবে] এসব তো আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় নেই মা । আর তিনটে বছর আছে । ভেবেছিলুম কোনরকমে চালিয়ে দেব । কিন্তু এখন দেখছি – দেখি ভি-আর-এস টা যদি দেয় ।

মেয়ে । একার জন্যে আর চাকরি করে কি করবে বাবা ? ও আমি তোমাকে মাসে মাসে কিছু দিয়ে দেব । এই বুড়ো বয়েসে মাছ-ভাতের তো নোলা নেই তোমার,তা আমি ভাল করে জানি । আর থাকলেও শরীরের স্বার্থে তোমায় ছাড়তে হবে বাবা । আর পেটের রুগী দুধ তো তুমি ছোঁও না । আলু খেয়ো না – সুগার হতে পারে । সুগার হলে হার্ট কিডনি লিভার মায় চোখ নাক কান সব যাবে । আজকালকার ডাক্তাররা বলে বাবা । আমার মনে হয় বেগুন আর বরবটির ঝোলটাই আদর্শ । সঙ্গে একটু পেঁপেও দিতে পার । সৌমেনও তাই বলে । ভীষণ আদর্শবাদী ছেলে তা তো তুমি জানই ।

বাবা । বেশ তাই হবে আমি বরং বাড়িটার একটা খদ্দের –

মেয়ে । বেশী দেরি কর না বাবা । সৌমেন একটা ফ্ল্যাটের বুকিং করে রেখেছে তিন মাস আগে । ই-এম-আই টা আর করছি না । মাসে মাসে যত উটকো ঝামেলা । তার চেয়ে একেবারেই দাম দিয়ে দোব । বাড়ী বিক্রির টাকাটা শুধু একটু যাতে তাড়াতাড়ি হয় দেখ বাবা। আর হ্যাঁ নিজের জন্যে একটা ঘর দেখ – ছোটমোট একটা বেশী বড় নয় । আবার ঝাঁট পাট দেবার লোক রাখবে কি করে বল ? আমার পয়সা তো সব এই করতেই বেরিয়ে যাবে বাবা । আমি তো বেশি –

বাবা । তা আমি তবে একটা ঘর –

মেয়ে । আর হ্যাঁ অফিসে ভি-আর-এসের দরখাস্তটা দিতে দেরি কর না বাবা। ওখানেও আজকাল শুনেছি খুব লাইন পড়ে । আমি আর কি করব। তুমি নিজেই যা প্রমিস করেছ । সৌমেন শুনলে – না রাগ অবশ্য করবে না। যত আদর্শবাদী হোক না কেন শ্বশুরের ইচ্ছেকে অমর্যাদা করার ছেলে নয়সে । আমি তোমার বড় মেয়ের মত চাই-সর্বস্ব নয় বাবা । তোমার বিচার-বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা খুব । সৌমেনেরও তাই। খুব পিতৃভক্ত তো । রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সূর্যের দিকে মুখ করে ওঁ জবাকুসুমংসংকাশং বলার পরই বলে পিতা স্বর্গপিতা ধর্ম পিতাহি পরমংতপঃ ।

বাবা । [প্রায় চিৎকার করে] ওরে থাম থাম । এত সুখ আর আমার সইছে না । আমার কান্না পাচ্ছে । করছে বুক ধড়ফড় । এবার আমি তো স্বর্গেই চললাম মা । মেডিক্লেমের টাকায় নার্সিং হোমের খরচ না হয় চলবে । কিন্তু শ্মশানঘাটের খরচের জন্যে একটা temporary loan সৌমেনকে sanction করে নিতে বলিস মা । চিত্রগুপ্তের হাত দিয়ে আমি নাহয় পাঠিয়ে দেব ।ওখানে আমায় নিশ্চয় কিছু কাজ দেবেই দেবে ।

[নেপথ্যে এম্বুলেন্সের হুটার বাজার শব্দ]

মেয়ে । বাবা চল নার্সিং হোম । তোমাকে আমি এত সহজে মরতে দেব ভেবেছ ? আমার শাঁখা সিঁদুরের দামটা আদায় না করেই ছাড়ব ?

[ শেষ ]





[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কেবল মাত্র দুইটি চরিত্রের এই কৌতুক নাটিকাটি শ্রুতি, মঞ্চ বা অডিও ভিসুয়াল যে কোনও ভাবেই অভিনয় করা সম্ভব । কিন্তু প্রত্যেক অভিনয়ের আগে লেখক অর্থাৎ নাট্যকারের আগাম অনুমতি নেওয়া বাঞ্ছনীয় । - লেখক । ]


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন