জানো কি? - অলোক চৌধুরী



জানো কি?


লাগে টাকা দেবে গৌরীসেন
অলোক চৌধুরী

‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। কে এই গৌরী সেন ? কেনই বা তার নামে এই প্রবাদ ?

কেহ ধনী ব্যক্তির সাহায্যের উপর নির্ভর করিয়া যথেচ্ছ অর্থ ব্যয় করিলে তাহার সম্বন্ধে এই প্রবাদ প্রযোজ্য হয়। আনুমানিক তিনশত বৎসর পূর্বে হুগলীর বালি নামক গ্রামে এক সুবর্ণ বণিক পরিবারে গৌরীকান্ত সেন জন্মগ্রহণ করেন। তাহার পিতার নাম ছিল হরেকৃষ্ণ মুরলিধর সেন। পিতার আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না থাকায় যৌবনে গৌরী সেন সামান্য পুঁজি লইয়া ব্যবসা শুরু করেন। তাহার ব্যবসায় বুদ্ধি ও সততা তাহার বাণিজ্যের পথ সুগম করে।

ব্যবসার সুবিধার্থে পরে তিনি কলকাতার বড়বাজারে বসবাস করিতে আরম্ভ করেন। তখনকার বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের সহিত অংশীদার হইয়া আমদানী-রপ্তানীর ব্যবসা শুরু করেন।

হুগলী ও কলকাতার নানা স্থান হইতে পণ্য সংগ্রহ করিয়া তিনি মেদিনীপুরে চালান দিতেন। মেদিনীপুরে ভৈরবচন্দ্র দত্ত নামক এক ভদ্রলোক তাঁহার এজেন্ট ছিলেন। তিনি সাধারণতঃ নানাবিধ শষ্য, ফলমূল, তৈজসপত্র, নানাবিধ ধাতু এবং গ্রামীণ শিল্প প্রভৃতি চালান দিতেন।

কথিত আছে, একবার তিনি সাতখানি নৌকা বোঝাই করিয়া রাংধাতু মেদিনীপুরে চালান দেন। ভৈরবচন্দ্র চালান পত্রের সহিত মাল মিলাইতে গিয়া দেখেন, সাতটি নৌকাতেই রাং-এর পরিবর্তে রূপা রহিয়াছে। সাধুতায় ভৈরবচন্দ্রও কম ছিলেন না। তিনিও ভুল মাল আসিয়াছে মনে করিয়া তৎক্ষণাৎ সমস্ত মাল ফেরত পাঠাইয়া দেন।

এদিকে নৌকা ফিরিবার পূর্বে গৌরী সেন স্বপ্ন দেখিলেন, মহাদেবের কৃপায় নৌকার সমস্ত রাং রূপায় পরিণত হইয়াছে। নৌকা ফিরিয়া আসিলে স্বপ্নবৃত্তান্ত আশ্চর্য্যরূপে ফলিতে দেখিয়া বড়ই বিস্মিত হইলেন। তারপর ঐসব রূপা বিক্রয় করিয়া প্রভূত বিত্তশালী হইলেন। মহাদেবের প্রত্যাদেশ অনুসারে নিজগৃহে শিবমন্দির নির্মাণ করিয়া শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং নিত্যপূজার বন্দোবস্ত করিলেন।

প্রচুর সম্পদের অধিকারী হইয়াও গৌরী সেন বিন্দুমাত্র অহংকারী ছিলেন না। তাহার আচরণ সর্বদাই বিনম্র ছিল। নানারূপ দানধ্যান করিয়া তিনি তার সম্পদের সদব্যবহার করিতেন। সেকালে ঋণের দায়ে যাহারা কারারুদ্ধ হইত, তাহাদের নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা ছিল না। যতদিন না ঋণ পরিশোধ হইত ততদিন তাহাকে কারারূদ্ধ থাকিতে হইত। ঋণ পরিশোধ করিতে না পারায় বহু হতভাগ্যের কারাগারেই জীবনাবসান হইত। গৌরী সেন (গৌরীকান্ত সেন) এইসব হতভাগ্যের ভরসা ছিলেন। জাতিধর্মনির্বিশেষে ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিকে তিনি তার দায় হইতে মুক্ত করিতেন। অনেক অসাধু ব্যক্তিও মিথ্যা দায় জানাইয়া তাঁহার নিকট হইতে অর্থ সাহায্য লইতেন। তাঁহার মুক্তহস্তে সাহায্যের সুযোগ পাইয়া বহু ব্যক্তি বিচার বিবেচনা না করিয়া সাধ্যাতীত ব্যায় করিত। তাহাদের ভরসা ছিল গৌরী সেনের কাছে হাত পাতিলেই অর্থের সুরাহা হইয়া যাইবে। এইরূপ আচরণ হইতেই “লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন” এই প্রবাদ সৃষ্ট হইয়াছে।

উত্তর কলকাতার আহারীটোলায় এখনও গৌরী সেনের বৃহৎ অট্টালিকা বর্তমান আছে। আমার বাড়ির অনতিদূরে একটি গঙ্গার ঘাট গৌরী সেনের টাকায় নির্মিত বলিয়া কথিত আছে। কিন্তু প্রামাণ্য কিছু পাই নাই বলিয়া তাহার ছবি দিতে ভরসা পাইলাম না। 



তথ্যসূত্রঃ

(১) সুবোধচন্দ্র মিত্র সংকলিত ‘সরল বাংলা অভিধান
(২) প্রসঙ্গ উত্তরপাড়া


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন