ধারাবাহিক - স্বপন দেব






ধারাবাহিকঃ


শালগ্রাম শিলার জন্মরহস্য ও তার দেবত্বে উত্তরণের ইতিহাস ( ২য় পর্ব )
স্বপন দেব






যুগযুগান্ত ধরে এই কালীগণ্ডকী নদী গণ্ডক পর্বত থেকে শালগ্রাম শিলা বয়ে আনছে আর তারপর বিহারের চম্পারণ জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে পাটনার কাছে শোনপুরে এসে মিশেছে ভারতের সব থেকে পবিত্র নদী গঙ্গায়। আবার ফিরে আসি জীবাশ্ম প্রসঙ্গে। প্যালিয়োজয়িক কল্পের শুরুতে, মানে আজ থেকে প্রায় ৬০/৬৫ কোটি বছর আগে মলাস্কা পর্বের আদি প্রাণী সেফলোপডের আবির্ভাব। তারপর বিবর্তনের ধারা বেয়ে ২৩/২৫ কোটি বছর আগে এল এই অ্যামোনয়ডিয়া এবং তারই এক জ্ঞাতি ভাই অ্যামোনাইট গোষ্ঠীর এবং জুরাসিক থেকে ক্রিটেশিয়াস, মানে ৮ থেকে ১৫ কোটি বছর আগে এই অ্যামোনাইটের এত আধিক্য ছিল যে এই সময়কালকে বলা হয় অ্যামোনাইট যুগ। এই অ্যামোনাইট বিবর্তিত হয় বহু গণে। যার মধ্যে একটি হোল ‘পেরিসস্ফিংটিস ‘ এই পেরিস্ফিংটিস থেকে প্যারাবলিসোরাঁস, ভিরগাটোস্ফিংটিস আর অলাকোস্ফিংটিস,এই তিন উপগণ আর তাদের থেকে যেসব প্রজাতি জন্ম নিল, প্রধানতঃ তাদের জীবাশ্ম সম্বলিত শিলাকেই হিন্দুশাস্ত্রে পরম পবিত্র—সাক্ষাৎ নারায়ণ জ্ঞানে, শালগ্রাম শিলা রূপে পুজো করা হয়ে থাকে। এই জীবদেহের সিউচার রেখার অলংকরণকে বিষ্ণুলক্ষণ বা ‘বনমালা’ বলা হয়। আর জানিনা, এই প্রাণীদেহের সাইফাঙ্কল টিউবই কি নারায়ণের ‘ পৈতে চিহ্ন ? প্রাণীদেহের পিঠের দিকে খোলকের ঠিক নিচেই এর অবস্থান, ক্রমশ কুণ্ডলী পাকিয়ে চলে গেছে প্রোটোকঞ্চ অবধি, ঠিক যেমনটি থাকে চিংড়ি মাছের পিঠের দিকে খোলকের নীচের শিরাটা। এটাকে বলা হয় সাইফাঙ্কল টিউব। এর সাহায্যেই বাতাস নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রাণীরা জলের মধ্যে ওঠানামা করত; আর একই পদ্ধতিতে আজকের দিনের সাবমেরিনগুলোও জলে ডোবা ভাসা করে। মার খাবার ভয়ে যে কথাটা এতক্ষণ বলিনি, সেটা হল এরা কিন্তু আদতে কৃমি জাতীয় প্রাণী! জানি, সবাই কথাটা শুনেই ক্ষেপে গেলে। কি! আমরা একটা কৃমির জীবাশ্ম কে নারায়ণ জ্ঞানে পূজো করি? মার না খাবার ঢাল টা আমি আগেই তৈরি রেখেছি! ভেবোনা এতক্ষণ ধরে যে তথ্যের কচকচানি শুনিয়ে তোমাদের মাথা ধরিয়ে দিলাম সেটা আধুনিক বিজ্ঞানের ফসল। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকার রা এত অর্বাচীন ছিলেননা। তাদের শিলাচর্চা বা জীবাশ্ম সম্পর্কে জ্ঞান কিছু কম ছিলনা। সেকালের শাস্ত্রীয় শিলা বিজ্ঞানীরাও জানতেন শালগ্রাম শিলা—‘বজ্রকীট’ (এক ধরণের কৃমি জাতীয় প্রাণী)-এর দেহাবশেষের প্রস্তরীভূত রূপ—ফসিল। পুরাণে শাপগ্রস্ত নারায়ণের উক্তি—অহঞ্চ শৈলরূপী চ গণ্ডকীতীর সন্নিধৌ। অধিষ্ঠানং করিষ্যামি ভারতে তব শাপতঃ ।। বজ্রকীটাশ্চ কৃময়ো বজ্রদংষ্ট্রাশ্চ তত্র বৈ। মচ্ছিলাকুহরে চক্রং করিষ্যন্তি মদীয়কম।। ...গণ্ডক্যাশ্চোত্তরে তীরে গিরিরাজস্য দক্ষিণে......( ব্রহ্মপুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড )। যাক, শাপগ্রস্ত নারায়ণের কৃপায় এবারের মত গণ-ধোলাই থেকে বেঁচে গেলাম! আমি পরম বিস্ময়ে প্রাচীন শাস্ত্রকারদের বিজ্ঞান, শিলাচর্চা আর ভৌগোলিক জ্ঞান দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম! কিন্তু মজা হল এই, যে প্রজাতির কীট এর জীবাশ্ম কে শালগ্রাম শিলা বলা হয়, তার অন্তত দশ হাজার রকম ভেদাভেদ আছে। তাদের অধিকাংশই ত্যাজ্য শিলা। ত্যাজ্য শিলা পূজা করলে কি কি অমঙ্গল হতে পারে তারো আনুপূর্বিক বিবরণ দেওয়া আছে। সুতরাং, সাধু সাবধান! পথেঘাটে গজিয়ে ওঠা মন্দিরে শালগ্রাম শিলা দেখলেই কপালে হাত দেওয়া বন্ধ করুন। চিরতুষারাবৃত হিমালয় থেকে বয়ে আসা গণ্ডকী নদী ছাড়াও, নর্মদা তীরে এবং কচ্ছের কোন কোন জায়গায় শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়। কিন্তু, সেগুলি সব ই ত্যাজ্য শিলা। এই দশ হাজার রকম শালগ্রাম শিলার মধ্যে কেবল মাত্র একান্নটি পূজ্য,আর সবই ত্যাজ্য শিলা। কোনটা পূজ্য আর কোনটা ত্যাজ্য তার বিশদ বিবরণ দিয়ে আর আপনাদের মাথা ধরাতে চাইনা। শুধু এ টুকু বলে রাখি যে প্রকৃত পূজ্য শিলার আকার একটা আমলকী বা হরতুকির চেয়ে ছোট হবেনা এবং একটা বেলের থেকে বড় হবেনা। এ ছাড়া, একচক্র, দ্বিচক্র করে দ্বাদশ চক্র এবং বহুচক্র সব মিলিয়ে ওই ৫১ রকম শিলাই পূজ্য। আর সবই ত্যাজ্য। কিন্তু আমার মনে আর একটা প্রশ্ন রয়ে গেল। সেটা হল ৫০ নয়, ৫২ নয় শুধু একান্ন কেন? হিন্দু শাস্ত্রে এই একান্ন সংখ্যাটি কিন্তু খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পূজ্য শালগ্রাম শিলার সংখ্যা একান্ন, সতীর পীঠস্থান একান্ন, মা কালীর গলায় যে মুণ্ডমালা ঝোলে তার সংখ্যাও একান্ন ( যদিও খরচা বাঁচাতে এখন কুমোরেরা ১০/১২ টির বেশী দেয়না ) কিন্তু শাস্ত্রমতে সংখ্যাটা একান্ন। সর্বোপরি আমাদের সংস্কৃত ভাষা যাকে দেবভাষা বলা হয়, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে তার সংখ্যাও কিন্তু একান্ন! এই একান্ন রহস্যের কিনারা তোমরা করতে পারো কিনা দেখো। কিন্তু, আমাকে আবার শালগ্রাম শিলা নিয়ে আসতেই হবে তোমাদের কাছে। কারণ এতোক্ষণ, আমরা শালগ্রাম শিলার জন্ম-রহস্য জানলাম। এবার জানবো তার দেবত্ত্বে উত্তরণের ইতিহাস। আর এই দেবত্বে উত্তরণের ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের জানতে হবে কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনী। শালগ্রাম শিলা নিয়ে বহু পৌরাণিক কাহিনী আছে। স্থানাভাবে তার সব কটা দেওয়া যাবেনা। কিন্তু, বিশেষ ভাবে যেগুলি উল্লেখযোগ্য তার কয়েকটি তো বলতেই হবে। সেই পৌরাণিক কাহিনী বলার জন্যে আর একটি পর্ব আমাকে দিতে হবে। কিন্তু আজকের গল্পটা এখানেই শেষ করে দিচ্ছিনা। কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলে না নিলে, লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথমত, শালগ্রাম কথাটা সম্ভবত বাংলা বা সংস্কৃত শব্দ নয়। অভিধান বা শব্দকোষে এর কোন ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দেখিনি। সম্ভবত, নেপালের কোন ভাষা থেকে কথাটার উদ্ভব, তারপর কালের প্রভাবে আপন হয়ে গেছে ! দ্বিতীয়ত, এদেশে পাহাড়ের নাম গণ্ডক, নদীর নাম গণ্ডক। এই গণ্ডক কথাটা খুব সম্ভব মধ্যভারতের গোণ্ড উপজাতি থেকেই এসেছে বলে মনে হয়। কারণ নেপালের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি মহাভারতের কিরাত সম্প্রদায় ই হল নেপালের আদি অধিবাসী। খুবসম্ভব এরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী গোণ্ড দের এক শাখা-উপজাতি। গণ্ডক কথাটা সারা নেপালেই বহুল ব্যবহৃত। আর ভূ-বিজ্ঞানে গোণ্ড জাতির নাম থেকেই গণ্ডোয়ানা আন্তর্জাতিক ভাবেই বিখ্যাত। আর একটি কথা আমাকে বিস্মিত করেছিলো। যে বাঙ্গালীর পায়ের তলায় সর্ষে আছে, যারা হিল্লি-দিল্লি, কেদার, অমরনাথ কোন তীর্থই বাদ দেন না, সেই বাঙ্গালীরা শুধু নয়, ভারতবর্ষের কোটি কোটি হিন্দু,শালগ্রাম শিলা যাঁদের কাছে পরমপূজ্য, তাঁরা এর উৎসস্থল মুক্তিনাথে বা মুক্তিনাথ মন্দিরে যান না কেন ? সত্যি বলতে কি, বাঙ্গালীর নেপাল ভ্রমণ মানে ঐ কাঠমাণ্ডু বা বড়োজোর পোখরা অবধি । কিন্তু কেন ? মুক্তিনাথ দর্শনে যারা যান তাদের ৯৯ শতাংশই বিদেশী। পাশ্চাত্যবাসীদের আগ্রহে শালগ্রাম শিলার চাহিদা ইদানীং খুব বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা জমে উঠেছে কিন্তু নেমে গেছে ধর্মীয় মূল্য। অর্থের জোরে শিলা ওরা কেনে প্রাচীনতার প্রতীক হিসেবে। কিউরিও হিসেবে শোভা পায় বিত্তশালী বিদেশীদের ড্রইং রুম এ। পুরাণে আছে, হিমালয়ের দক্ষিণে গণ্ডকীর উত্তরে দশ যোজন বিস্তৃত অঞ্চল – হরিক্ষেত্র। ভগবান বিষ্ণু এখানে অবস্থান করছেন শালগ্রাম শিলা রূপে। মহাভারতেও পাই এই মহাতীর্থের উল্লেখ। ভীষ্মের তীর্থ পরিক্রমার সময়ে মহর্ষি পুলস্ত্য মুনি তাঁকে গণ্ডকী ও শালগ্রাম তীর্থ দর্শনের উপদেশ দিয়েছিলেন। অথচ আশ্চর্যের কথা—অধিকাংশ হিন্দুদের কাছে এই হরিক্ষেত্র আজও অপরিচিত। কেন এমন হল ? দূরের দুর্গম তীর্থ বললে কিছুতেই মানবোনা। হিমালয়ের মানস-পুত্র উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বই এ পড়েছি, ১৯৮২ সালে উনি প্রথমবার কেদারবদ্রী যান। ঋষিকেশ থেকে হাঁটা শুরু করে কেদার দেখে এক চক্কর ঘুরে আসতে তখনকার দিনে লাগতো পাক্কা তিন মাস। এ ছাড়া, অমরনাথ বা কৈলাস-মানসের দূরত্ব এবং দুর্গমতা অনেক বেশি। কিন্তু শালগ্রাম শিলা তীর্থের কথা শুনলে এমন অবাক চোখে সবাই তাকান কেন ?কেন আজ ও মুক্তিনাথ মুক্তিকামী হিন্দুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি ? আমার মনে হয়, এর পিছনে একটা ঐতিহাসিক ধর্মীয় কারণ আছে। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠ সংগঠক ছিলেন শঙ্করাচার্য। তিনি বৌদ্ধ প্রভাবে লুপ্তপ্রায় হিন্দু তীর্থস্থানগুলি বৌদ্ধধর্মের “বজ্রযানি”সম্প্রদায়ের প্রভাব মুক্ত করেন। এবং বৈদিক মতে সারা ভারতের হিন্দু তীর্থস্থানগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। আর কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এইসব মন্দিরে প্রচলন করেন বৈদিক পূজা পদ্ধতি। নেপালে বৈদিক ধর্ম পুনরুজ্জীবিত করে তিনি পশুপতিনাথের মন্দির সংস্কার করান। কিন্তু এরপর, অনন্য যোগশক্তিধর বৈদান্তিক সন্ন্যাসী শালগ্রাম তীর্থে না গিয়ে চলে যান বদ্রীনাথের পথে। বোধহয় এই কারণেই,শালগ্রাম তীর্থে মুক্তিনাথ মন্দিরে বৈদিক পূজা পদ্ধতির প্রভাব দেখা যায়না। আর সেই কারণেই সম্ভবত অন্যান্য তীর্থস্থানগুলি হিন্দু মানসে যে পবিত্রতা পেয়েছে মুক্তিনাথের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। লেখাটা সত্যিই বড় দীর্ঘ হয়ে গেল ! তাই এবারের মত এখানেই বিরতি। পরের কিস্তি পাঠাবো ইউ এস এ থেকে।



(চলবে)


1 মতামত: