প্রবন্ধ - পারমিতা চ্যাটার্জ্জী


















প্রবন্ধঃ

রবীন্দ্রযুগে নারীর অগ্রগতি
পারমিতা চ্যাটার্জ্জী



অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার নারী সমাজ অনেক পেছনে ছিল।তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার প্রথম দিশারী বিদ্যাসাগর মহাশয়। স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া তিনি আইনের মাধ্যমে বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রোধকরেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের বহু বিদ্রুপ সহ্য করেও তিনি তাঁর কাজে অচল ছিলেন।বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। আজকের নারী যে জায়গায় আছে তার জন্য বিদ্যাসাগর চিরস্মরণীয় ।

পরবর্তীকালে স্ত্রীশিক্ষাকে রক্ষা ও নারীপ্রগতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের অবদান অসীম।বহুবিবাহ নামক নারকীয় প্রথা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সময় বহু হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হন।

ঠাকুরবাড়ি এবং ব্রাহ্মসমাজের মহিলারানারীমুক্তি ও নারী প্রগতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

ঠাকুর বাড়ীর মেয়ে বধূদের যে দু-তিনটি উজ্জ্বল নাম আছে তার মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী।তিনি নারী কল্যাণমূলক কাজ আরম্ভ করেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত সখী সমিতির মধ্য দিয়ে।বিধবাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবী রাখে।অসহায় বিধবাদের যন্ত্রণা, তাদের মর্মবেদনা তিনি তার বহু নাটকে ফুটিয়ে তোলেন। স্বর্ণকুমারীর জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি ছিল “কাহাকে”,এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিতা আধুনিকা নারীদের অধিকার বোধ বিশ্লেষণ করেন। তিনি কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। তাছাড়া সংস্কারের কাজের জন্য তিনি এই কাব্য ও উপন্যাসের জগত ছেড়ে মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ লেখার কাজে।তিনি দীর্ঘদিন ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য হাতের কাজ শেখানোর চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।



এর পরে যার নাম আসে তিনি হলেন মহর্ষির মধ্যম পুত্র সতেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি বাংলার নারী জাগরণের অন্যতমা ছিলেন;বাঙালী মেয়েদের আধুনিক শাড়ী পড়ার ধরণতিনি আবিষ্কার করেন।তিনি তখনকার দিনে এমন একজন ভারতীয় রমণী,যিনি স্বামীর সাথে বিলেত যান এবং ভারতের বহু শহর ভ্রমন করেন । সঙ্গীত, কাব্য অভিনয়,সব কিছুতেই তার অদম্য উৎসাহ ছিল।ভারতী পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখেন । এছাড়া ছোটদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।তাঁর রচিত ছোটদের সাত ভাই চম্পা ও তাক ডুমা ডুম খ্যাতি অর্জন করে।



রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নীপময়ীর নাম এ বিষয়ে উল্লেখ করার বিশেষ প্রয়োজন । তাঁর ছবি আঁকার অসাধারণ প্রতিভা পরবর্তী কালে তাঁর সন্তানদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। পুণ্য পত্রিকায় তাঁর আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়।

স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সরলাদেবীর নাম খুবই উল্লেখযোগ্য । তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন । রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের স্বরলিপি তিনি করে দেন। “বন্দেমাতরম” সঙ্গীতে সুর তিনি দেন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি স্বক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ “জীবনের ঝরা পাতা” থেকে তাঁর এবং ঠাকুরবাড়ী সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।



জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবীর নাম অত্যন্ত সুপরিচিত । রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের এবং স্নেহভাজন ছিলেন । রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচুর স্বরলিপি তিনি রচনা করেন।



সবশেষে আসা যাক রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে।ক্ষিতিমোহন সেনের রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন বইটিতে রবীন্দ্রনাথের মতে,নারীর সাধনায় নারী সমন্ধে কবির মনোভাব সুন্দর ভাবে আলোকিত হয়েছে। 

মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে গুজরাটে সাহিত্য সভায় যোগ দেবার জন্য গুরুদেব গুজরাট যাত্রা করেছিলেন। সন্মেলন শেষে গুজরাটের মহিলাদের আমন্ত্রণে কবি সেখানকার বণিতা আশ্রমের একটি প্রতিষ্ঠানে যান।সেখানে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন,প্রত্যেক নারীর মধ্যে সুপ্ত আছেন গৌরী,যিনি তপস্যায় শিবকে জাগ্রত করে দৈত্যকুলের হাত থেকে স্বর্গকে উদ্ধার করেন।নারী যেন নিজের আত্মমর্যাদা ভুলে কখনই অন্ধের মতো পুরুষকে অনুকরণ না করেন। এই কথাই কবিগুরু তাঁর বিশ্বলক্ষ্মী কবিতায় বলেছিলেনঃ ‘ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হল ত্যাগের হোমাগ্নিতে’...



বরোদায় একটি সন্মেলনে তিনি নারী দুটি রূপ বর্ণনাকরেছিলেন একজন সৌন্দর্যের প্রতিমা আর একরূপ তপস্বিনীর। বলাকা কাব্যে এই দুটি রূপ সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে 

“কোন ক্ষণে

সৃজনের সমুদ্র মন্থনে

উঠেছিল দুই নারী

অতলের শয্যাতল ছাড়ি

একজনা উর্বশী,সুন্দরী,

বিশ্বের কামনা রাজ্যে রাণী,

স্বর্গের ঈশ্বরী।_______

আরজন ফিরিয়া আনে 

অশ্রুর শিশির স্নানে স্নিগ্ধ বাসনায়”।



মহুয়ায় সবলা নামক কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার

কেন নাহি দিবে অধিকার 

হে বিধাতা?



রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মেয়ে,গৃহবধূদের মর্মবেদনা গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন । এই উপলব্ধি আমরা পাই তাঁর ‘সাধারণ মেয়ে’ আর ‘মুক্তি’ নামক কবিতার মধ্যে দিয়ে। গৃহবধূদের জীবন যে শুধু রাঁধা আর খাওয়ার মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত, এর বাইরে তাদের চিন্তা করার কোনো অবকাশ ছিলনা,তা কবি মুক্তি কবিতায় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।





তাই রবীন্দ্রযুগে মহিলা সমিতি ও নানারকম হাতের কাজ, ছোট পত্রিকা যেখানে মহিলারা তাদের কথা লিখতে পারেন,এইসব সূচনা হয়। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক,এই অগ্রগতিতে ব্রাহ্মসমাজ যতো দ্রুত এগিয়ে ছিলেন, হিন্দুসমাজের এই জায়গায় আসতে অনেক সময় লেগেছিল।


0 মতামত:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন