সম্পাদকীয় - ১ম বর্ষ ৮ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়



‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে
এসেছে দারুণ মাস’
            - (সাদেকুর রহমান)



এসেছে ফাগুন; বাংলা বর্ষপঞ্জিকার শেষ ঋতু, ঋতুশ্রেষ্ঠ বসন্তের প্রথম মাস। শীতের জরাগ্রস্থতা কাটিয়ে দিকে দিকে নবপত্রালির জয়গানে আর বনানী বিস্তৃত সুবাসিত মুকুলের মদির সুবাসে মাতাল হয়ে ফুলেল আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৌ-পরাগে হলুদ হয়ে ওঠা মধুমক্ষিকার গুঞ্জরণে বাসন্তী প্রকৃতির বীণা যেন সুর-ঝংকৃত হয়ে ওঠে।

ফাল্গুন, বাংলা সনের একাদশ এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দ্বাদশ ও সমাপনী মাস, নামটি এসেছে উত্তর-পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-তে পারসি ভাষায় এ মাসের নাম ‘বহম’। নিয়মমত প্রতি চতুর্থ বৎসরে ফাল্গুন মাসের দিন সংখ্যা ৩১। সেই হিসেবে ১৪১৮ (২০১২) সাল ছিল বাংলা পঞ্জিকার অধিবর্ষ বা লীপইয়ার। খনা বলেন, যদি বর্ষে ফাগুন - শস্য হয় দ্বিগুণ।। কিন্তু pesticide আর fertilizer-এর রমরমার এ’যুগে পরিমাণটা তবে কতগুণ ? কেই বা জানে !

ভৌগলিক সীমারেখার উর্দ্ধে উঠে সমগ্র বিশ্বের বাংলাভাষা-ভাষী মানুষের কাছে এ’ মাস আরো একটি বিশেষ কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৩৫৯ সালের ৮ই ফাল্গুন (২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২) বাংলাভাষা কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। সেই থেকে ওই দিনটি বাংলাদেশে ‘শহীদ দিবস’ হিসাবে পালিত হতো।


পরবর্তী কালে, ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। সমগ্র বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের জনজাগরণের ইতিহাসে ওই দিনটি নিঃসন্দেহে একাধারে একটি মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
এই উদ্দীপিত গৌরবচেতনার রেশ নিয়ে প্রকাশিত হোল চিলেকোঠা ওয়েবজিন প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা। এই সংখ্যায় থাকছে প্রবাদ প্রতীম সঙ্গীত শিল্পী ‘বাংলার মীরাবাঈ’ যূথিকা রায়কে নিয়ে লেখা একটি মনোজ্ঞ প্রচ্ছদ নিবন্ধ, বিশেষ প্রতিবেদন, একটি মৈথিলী কবিতাসহ আরো কবিতা, রম্যরচনা, অনুবাদ ছোটগল্প, ছোটগল্প, অনুগল্প, দুইটি ধারাবাহিক, রঙ ও তুলি, ইত্যাদি। আর, চিলেকোঠা সরগরম, ছোটোদের পাতা, হাস্যকৌতুক, রান্নাঘরের মতো নিয়মিত বিভাগগুলি তো থাকছেই। আশা করি, ভালো লাগবে।

সংশয় নেই, প্রতিবারের মতই এবারও পড়বেন মন দিয়ে; নিজে পড়ুন, অন্যকে পড়ান, সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করুন। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আপনাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকাটির মানোন্নয়ণে সহায়তা করবে।

জানি, সঙ্গে আছেন, সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।।



নমস্কারান্তে,

চিলেকোঠা ওয়েবজিনের সম্পাদকমণ্ডলী

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

যূথিকা রায় : তাঁর গান ও সেই সময়
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে কলকাতার মানুষ যখন দক্ষিণ কলকাতার রামকৃষ্ণ সেবাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতাল চত্বরে হামলে পড়েছে অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য, তখনই ঐ হাসপাতালের কোন একটি ওয়ার্ডে সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘ঢুলি’ ছায়াছবির এক নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পী, ৯৩ বছরের এক বৃদ্ধা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে শায়িত ছিলেন সকলের আগ্রহের অন্তরালে ।

সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পরে তিনি মারা গেলেন ৬ই ফেব্রুয়ারি রাত্রি এগারোটায় । চলে গেলেন আধুনিক ‘মীরা বাঈ’ যূথিকা রায় । না, ‘ছায়াছবির নেপথ্য গায়িকা’ এটা কোন পরিচয়ই নয় যূথিকা রায়ের । বাঙালি যখন সবে গান শুনতে শুরু করেছে রেডিও বা কলের গানে, যূথিকা রায় সেই সময়ের সঙ্গীত শিল্পী । বলা সঙ্গত যে, বাংলা গানের যথার্থ আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানে পরিশীলিত সাঙ্গীতিক রুচি তথা আধুনিকতার নির্মাণ যাঁদের হাতে হয়েছিল তাদেরই একজন ছিলেন যূথিকা রায় ।

১৯৫০/৫২এ আট কি দশ বছর বয়সে তখনও গান শোনার কান তৈরী হয়নি । একটা চারচৌকো কাঠের বাক্স যাকে রেডিও বলা হ’ত, তাতে যখন মীরার ভজন ভেসে আসতো ‘মায়নে চাকর রাখো জী’ কিংবা ‘মেরে তো গিরিধারি গোপাল’ তখন কে মীরা বাঈ এসব জানার কথা নয় আমার । এবং বলতে লজ্জা নেই এইসব গান যিনি গাইতেন তাঁকেই ‘মীরাবাঈ’ বলে জানতাম । অনেক পরে চিতোর বেড়াতে গিয়ে গাইড যখন একটা ছোট ঘরের ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল ঐ ঘরে বসেই নাকি মীরা তাঁর গিরিধারী নাগরের ভজনা করতেন, তখন যূথিকা রায়ের কথা আর তাঁর কন্ঠস্বর সামনে ভেসে আসতো । একেই বোধহয় ‘লিজেন্ড’ হয়ে যাওয়া বলে ! কিন্তু মীরার ভজন দিয়ে শুরু হয়নি তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন, শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলা গান দিয়ে ।

যূথিকা রায়ের জন্ম ১৯২০র ১৬ই এপ্রিল হাওড়া জেলার আমতায় । ঐ একই বছরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা গানের দুই প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মান্না দে । মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন বেতারে গান গাইতে । কলকাতা বেতারের তখন নিতান্ত শৈশব কাল । মাত্র একবছর আগে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতা রেডিওর পত্তন হয়েছে ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট । ঐ বছরেই বৃটিশ ভারতে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় বোম্বাই বেতার কেন্দ্র থেকে ২৩শে জুলাই । তখনও প্রায় কারো ঘরেই রেডিও সেট পৌঁছায়নি । কানে হেডফোন লাগিয়ে বেতারের সম্প্রচারিত কথা শোনা যেতো । কিছু সম্ভ্রান্ত ঘরে রেডিও সেট ঢুকলো আরো কিছুদিন পরে । তখন বিনোদন মূলক বাংলা গান বলতে গ্রামফোন রেকর্ডে লালচাঁদ বড়াল, কৃষ্ণ ভামিনী, ইন্দুবালা, হরিমতী, কমলা ঝরিয়ার প্রেম ও ছলনামূলক ও দেহতত্বের গান, কৃষ্ণ চন্দ্র দের কীর্তনাঙ্গের গান, আর ক্বচ্চিত ‘রবিবাবুর গান’ লেবেলে দু একটি রবীন্দ্রনাথের লেখা গান । তখনও বাংলা গানের পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হয় নি । বাংলা রেকর্ডের গানের বয়সই তখন মাত্র ছাব্বিশ বছর । ১৯০২ সালে কলের গানের প্রথম রেকর্ড চালু হওয়ার পর পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হতে লেগে গিয়েছিল আরো কুড়ি পঁচিশটা বছর ।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে যূথিকা রায় প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান গাইলেন ১৯৩৪এ কাজী নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে । নজরুল তখন কাব্যভুবন থেকে চলে এসে গ্রামোফোন কোম্পানির মাস মাইনের সঙ্গীত পরিচালক । গ্রামোফোন কোম্পানির সর্বময় কর্তা । বস্তুত বাংলা গানের স্বর্নযুগের সূচনা হয়েছিল নজরুলের হাতেই । কুকুর-মার্কা এইচ এম ভি’র লেবেলে যুথিকা দুটি গান রেকর্ড করলেন প্রণব রায়ের কথা ও কমল দাশগুপ্তের সুরে, ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’ । যূথিকা রায়ের সেই প্রথম রেকর্ডের গান প্রসঙ্গে বাংলা গানের জীবন্ত তথ্যকোষ প্রয়াত বিমান মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ উদ্ধৃত করি,

“যূথিকা রায়ের নামে বাজারে রেকর্ড বেরুল - আমি ভোরের যূথিকা আর ওই বিখ্যাত সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে - যে গানটাকে এখনকার গবেষক বিশেষজ্ঞরাও অনেকে, আধুনিক বাংলা গান সরণীটির প্রথম মাইলফলক বলে চিহ্নিত করেছেন। কারুর কাছে এটা হয়ত প্রশ্নাতীত নাও হতে পারে, তবু এ গান যে ইতিহাসের উপাদান হয়ে গেছে - তাতে কিন্তু কোনরকম দ্বিমত নেই। সেই বোধহয় রেকর্ডের বাংলা গানে, প্রথম অর্কেস্ট্রা তৈরি হল।... তা, রেকর্ডখানা বাজারে বেরুল। আর মাত্র তিন মাসের মধ্যে যূথিকাদির এই রেকর্ডখানা ষাট হাজার কপি বিক্রী হয়ে গিয়ে বাজারে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিল। রাতারাতি যূথিকাদি হয়ে গেলো আর্টিস্ট, স্টার।’’ (‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে” : শীতাংশুশেখর ঘোষ, পৃ ১৫৪-৫৫)।

তিরিশের দশক বাংলা গানের সুবর্নযুগের সূচনাকাল । ১৯৩২এ শচীন দেববর্মণ প্রথম বেতার ও গ্রামফোনের গানে প্রবেশ করলেন, ১৯৩২এই বাংলা চলচ্চিত্র নির্বাক যুগ পেরিয়ে সবাক হ’ল, ১৯৩৭এ ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ ঘটালেন । শচীন দেববর্মণ ও সুরসাগর হিমাংশু দত্তের যুগলবন্দির সুরবৈচিত্রে বাংলা গান যথার্থ অর্থেই আধুনিক হয়ে উঠলো। বাংলা গানের কথায় কাব্যের লাবণ্য এল এই সময়ের গানে । এই পর্বেই যূথিকা রায় আধুনিক বাংলা গানের সুবর্ন যুগের নির্মাণে অবিসংবাদী ভূমিকা রেখে গেলেন তাঁর স্বকীয় গায়নশৈলী ও কন্ঠ মাধুর্যের গুনে । ১৪বছর বয়সে প্রথম রেকর্ডের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর গ্রামফোন কোম্পানি একের পর এক কমল দাশগুপ্তর সুরে আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড করাতে লাগলেন । সুরকার কমল দাশগুপ্তর প্রতিষ্ঠার পেছনে যূথিকা রায়েরও অবদান বড় কম ছিলনা । কারণ যূথিকা রায়ের প্রায় সব গানের সুরকার ছিলেন তিনি । যূথিকা রায়ের সংগীতজীবনের প্রায় সবটাই জুড়ে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত । নজরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন আর পরবর্তীতে শুধুই কমল দাশগুপ্ত । প্রথম রেকর্ড করেছিলেন নজরুল ইসলামের লেখা ও সুরে কিন্তু যে কোন কারণে সেই রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি । হয়তো স্বয়ং নজরুলেরই তা পছন্দ হয়নি । তিনিই তখন কমল দাশগুপ্ত কে সুর করতে বলেন । ১৯৩৯এ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন । তারপর তো বাক-শক্তিই হারালেন ।

যূথিকা রায় নজরুলের অনেকগুলি গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন । তাঁর গাওয়া নজরুলের গানের মধ্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল ‘ওরে নীল যমুনার জল’ এবং ‘তোমার কালো রূপে যাক না ডুবে সকল কালো মম, হে কৃষ্ণ প্রিয়তম’ । দুটি গানেরই সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত ।

এই সময় থেকে যূথিকা আধুনিক বাংলা গান থেকে ভক্তিমূলক – প্রধানতঃ ভজন গানে চলে এলেন । যুথিকা স্মৃতিচারণ করেছেন “এরপর প্রথমে কমল দাশগুপ্ত আমাকে একটা মীরার ভজন শেখালেন, সেই মীরার ভজন যখন দাঁড়িয়ে গেল, পপুলার হলো, ফার্স্ট যখন ‘মীরা কে প্রভু সাঁচী দাসী বানাও’ - এই গানটা বেরিয়ে পপুলার হলো, তখন ওই গ্রামোফোন কোম্পানির থেকে বলা হলো, যতগুলো মীরার ভজন আছে সব যূথিকাকে দিয়ে গাওয়ানো হবে ।

চল্লিশের দশক –বাংলা গানের ভুবন যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বেচু দত্ত প্রমুখ অনেক শিল্পী, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, মোহিনী চৌধুরী, অজয় ভট্টাচার্যর মত গানের কথাকার, দুর্গা সেন, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরীর মত সুরকার সেই সময়ের ফসল ।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পনেরো বছর বয়সে প্রথম বেতারে গান গাইলেন ১৯৩৫এ, ১৯৩৭ এ তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বেরিয়ে গেল ‘কথা কয়োনাকো, শুধু শোন’ ও ‘জানিতে যদিগো তুমি’ । বাংলা গানের ভুবনে অনেক শিল্পীর আবির্ভাব সত্বেও আধুনিক বাংলা গানের বাইরে যে অন্য ধারার গান সেখানে গায়নশৈলীর স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে রইলেন যূথিকা রায় ।

তাঁর সঙ্গীত জীবনের প্রথম পর্বের গানগুলিতে রোমান্টিকতার সঙ্গে পাওয়া যায় একটা বিষাদ বিষন্নতার ছবি, আর ভজন গানে তাঁর গায়কীতে বিভোর, তন্ময় আত্মনিবেদন । একের পর এক মীরার ভজন গাইতে গাইতে ‘আধুনিক মীরা বাঈ’এর পরিচিতি পেয়ে গেলেন যূথিকা রায় । প্রায় তাঁর সমকালেই পন্ডিত ডিভি পালুশকর কিংবা অনেক পরে অনুপ জলোটা এবং আরো অনেক শিল্পী ভারতজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন কিন্তু মীরার ভজন গানে যূথিকা রায়ের যে শ্রদ্ধার আসন তাকে স্পর্শ করতে পারেননি কেউ । এই ‘আধুনিক মীরা’ হয়ে ওঠা তাকে বিরল সম্মান এনে দিয়েছিল । সেসব কথা যুথিকা নিজেই লিখে গেছেন তার স্মৃতিচারণ মূলক বই “আজও মনে পড়ে”তে এবং নানান সাক্ষাৎকারে ।

১৯৪৭এর পনেরোই অগষ্ট । সেদিন রেডিওতে যুথিকার গানের সিটিং ছিল । ঘটনাক্রমে সেদিন লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতে প্রথম জাতীয় পতাকা তুলবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু । যুথিকার পনেরো মিনিটের রেডিও সিটিং শেষ হয়েছে, ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত । তখনই টেলিফোনে সংবাদ এলো, প্রধান মন্ত্রী নেহেরু চাইছেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পুরো সময়টা রেডিওতে যেন যুথিকা রায় গান গাইতে থাকেন । নেহেরু তখন তিনমূর্তি ভবন থেকে লালকেল্লার পথে রওনা দিয়েছেন । যূথিকা আবার বসলেন গান গাইতে । গান্ধীজীর প্রিয় রামধুন ভজন ও দেশভক্তিমূলক সহ সাত/আটটি গান গেয়েছিলেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় । যূথিকার এমনই প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল । নেহেরু নিশ্চয়ই জানতেন গান্ধীজী তাঁর দৈনিক প্রার্থনার আগে যূথিকার ভজন শুনতেন ।

১৯৪৬এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গান্ধীজী কলকাতায় এসেছিলেন সত্যাগ্রহে । মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন যূথিকাকে, তাঁর ভাষণের আগে গান গেয়েছিলেন যূথিকা রায় ।

তখন ছায়াছবিতে গান গাওয়া যে কোন শিল্পীর খুব কাঙ্খিত ছিল, শিল্পীর জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি ছিল ছায়াছবিতে গান করা । কিন্তু ছায়াছবিতে গান করা যূথিকাকে টানেনি একদম । তিনি যে তন্ময়তায় ভজন গাইতেন তেমন পরিবেশ তখনকার সিনেমায় থাকতো না বলেই মনে করতেন যূথিকা । এ ব্যাপারে তাঁর মায়ের রক্ষণশীলতাও তাঁর সিনেমায় গান না করার একটা কারণ ছিল । তবু দুটি ছায়াছবিতে তিনি নেপথ্য সঙ্গীতে ছিলেন । তখনকার প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক দেবকী কুমার বসুর হিন্দি ছবি ‘রত্নদীপ’ ছবিতে, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১তে এবং পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতপ্রধান ছবি ‘ঢুলি’, ১৯৫৪ তে । তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে আর কোন বাংলা বা হিন্দি ছায়াছবিতে তিনি গান করেননি ।

বস্তুত পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকেই তিনি অনুষ্ঠানে গান করা ছাড়া রেকর্ডের গান করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন । তাঁর প্রায় সব গানের সুরকার কমল দাশগুপ্তের সৃষ্টিশীলতাও কমে যায় । অসুস্থতার কারণে রেকর্ডে সুর করা বন্ধ করে দিলেন । যূথিকাও গানের নতুন গান রেকর্ড করা বন্ধ করে দিলেন । এই সময় শ্যামল গুপ্তর লেখা কয়েকটি গানে নিজে সুরও দিয়েছিলেন যূথিকা । আর অন্যকোন সুরকারের সুরে যূথিকাতো গানই করেনইনি । কমল দাশগুপ্ত রেকর্ডের গানে সুর করা বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্রামফোন কোম্পানী তাঁর ইচ্ছামত যে কোন ট্রেনারের সঙ্গে গান করার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু যূথিকা অন্য কোন ট্রেনারের প্রশিক্ষণে গান করায় সম্মত হননি যদিও তখনও তাঁর কন্ঠে গান ছিল আর তাঁর গানের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা ছিল । তখন তিনি রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের গানে চলে এলেন । এইসময় বাংলা ও হিন্দি ছাড়া উর্দু ও তামিল ভাষাতেও ভক্তিমূলক গান করেছিলেন তিনি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান করেননি । অবশ্য যূথিকা রায়ের সঙ্গীত জীবনের শীর্ষ সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙ্গালির কাছে এখনকার মত সর্বগ্রাসী ছিলই না বরং বলা ভালো ১৯৬১তে তাঁর শতবার্ষিকীর আগে বাঙ্গালির রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার কানই তৈরী হয়নি । অথচ মজার কথা সাত বছর বয়সে বেতারে যূথিকার প্রথম গানটিই ছিল রবীন্দ্র নাথের ‘আর রেখোনা আঁধারে, আমায় দেখতে দাও’ ।

জন্ম হাওড়া জেলার আমতা, পরিবারের আদিবাড়ি খুলনা জেলার সেনেটি গ্রাম । শৈশবশিক্ষা, গানকে ভালোবাসার শুরু সেখানেই, তারপর ১৯৩০ থেকে কলকাতায় পাকাপাকি বাস । আর গানেরতো কোন দেশ কাল হয় না । বয়সও হয়না । বিস্ময় লাগে, এই সেদিন, ২০১৩র পূজোর ঠিক আগে, ৯৩বছর বয়সে মুম্বাইতে গানের অনুষ্ঠান করলেন । সেটাই তাঁর শেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান । রেকর্ডে গান করা ছেড়ে দেবার অনেকদিন পরে বিশেষ অনুরোধে একটি সাঁইবাবার ভজন রেকর্ড করেন ১৯৭৬এ এবং এটি তাঁর শেষ রেকর্ডের গান ।

সময়ের স্রোত হয়তো আমাদের অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়, তার মধ্যে অস্বাভাবিকতাও নেই কিছুমাত্র, তবু শিল্পীর সৃষ্টি বেঁচে থাকে । যতদিন গানশোনা মানুষ ‘মীরার ভজন’ শুনতে চাইবেন, তাঁকে বোধকরি ‘আধুনিক মীরা’ যূথিকা রায়ের গানের কাছে যেতে হবে ।

বিশেষ রচনা - ঈশানী রায়চৌধুরী

ভালোবাসা | চার অক্ষর |
ঈশানী রায়চৌধুরী


চারটে অক্ষর কী অবলীলায় ব্যবহার করি ! সম্পর্কের ফাটলগুলো জোড়াতালি দিতে | অর্থহীন সংলাপের ফাঁকফোকরে গুঁজে দিই যখন তখন | দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে ! উষ্ণতা বিছিয়ে দিতে | কেমন চমত্কারভাবে সাদা পাতায় ছড়িয়ে যায় যত্ন করে এঁকে রাখা লাল টুকটুকে লাজুকলতা হৃদপিণ্ডের মুখ | পানপাতা ! জেনে গেছি , ফুল-লতা-চকোলেটে-আংটিতে একটু সাজালে গোছালে এই চারটে অক্ষর খুব সহজেই পণ্য হয়ে যায় | অবিশ্বাস্য দ্রুততায় | দামী বা সস্তা কাগজে, নীল-কালো-বেগনী কালিতে অক্লেশে লিখে যাই চারটে অক্ষর | মৌখিক উচ্চারণ… সোচ্চার বা নিরুচ্চার… কোনো পূর্ব-নির্ধারিত আবেগের শর্ত ব্যতিরেকে | গল্পে বা কবিতায়, নাটকে বা সিনেমায়… যত আলগা বুনোট রিফু করি ; যত ছেঁড়া ফাটা সংলাপ ... কী সুন্দর... সেজেগুজে তৈরী চার অক্ষরের রঙিন পোশাকে | আমরা ওই চার অক্ষর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিই আলগা করে … খুশি থাকি, খুব খুশি থাকি | রুপোর থালায় ছত্রিশ ব্যঞ্জনে খিদে মেটে না ; চার অক্ষরে কিন্তু তৃপ্তির উদ্গার ! গাছের নতুন পাতায়, বীজ থেকে অঙ্কুরের আভাসে, ফুলের পাপড়িতে ভেসে থাকা প্রথম আলোয় খুঁজে ফিরি ওই চারটে অক্ষরের জাদু ! এমনকি ধারালো ছুরির টানে যখন ফালাফালা হয়ে যায় রোজের মুখোশ আর পরণের রঙিন আলখাল্লা … তখন খুঁটে খাই চার অক্ষরের দানাপানি-সুখ | দু'টি নক্ষত্র ...কয়েক আলোকবর্ষ দূরে বা আকাশের এ অসীম নৈ:শব্দ্যের বধিরতা ...এ সব কি মেটাতে পারে ওই চারটি অক্ষর ? জানি, পারে না | তবু অস্বীকার করি, কারণ বৈচিত্র্যহীন যাপনসুখের ঝাঁ চকচকে ধাতব নীরবতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে বারবার যখন কোনো ওষ্ঠাধরের উচ্চারণে ওই চারটি অক্ষর... বিস্ময়ে, ব্যথায়, শ্বাসে ও নি:শ্বাসে .... আঁকড়ে ধরি দু'টি আঙুলে… খাদের গায়ে লেপটে থাকা পিচ্ছিল পাথর ....


আঁকড়ে ধরি, ছেড়ে দিই, আঁকড়ে ধরি........

চিলেকোঠা সরগরম

এই সংখ্যার বিষয়ঃ
"মেয়েদের অতি আধুনিক বস্ত্র-অল্পতা সাম্প্রতিক কালের নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান একটি কারণ"

(বিশেষ সূচনাঃ এই বিভাগে প্রকাশিত প্রতিটি মন্তব্য অংশগ্রহণকারীর একান্তই নিজস্ব মতামত, এ বিষয়ে চিলেকোঠা অয়েবজিন কোনোভাবে দায়ী নয়)



পক্ষেঃ

১) সুস্মিতা সিং

মাননীয় বিচারক মণ্ডলী ও সভার বিপক্ষের বন্ধুরাঃ

সভার মতে, " মেয়েদের অতি আধুনিক বস্ত্র-অল্পতা সাম্প্রতিক কালের নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান একটি কারণ " – এখানে দুটি শব্দবন্ধ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে প্রথমটি হোল ‘নারী নির্যাতন’ । নির্যাতন শব্দটিকে কাটাছেঁড়া করলে একদিকে যেমন Rape, Molestation, Eve Teasing, Physical Assault, ইত্যাদি পড়ে, অন্যদিকে মানসিক নির্যাতনটিকেও কিন্তু উপেক্ষা করা উচিত নয়। আর দ্বিতীয়টি হোল ‘অন্যতম প্রধান একটি কারণ’ – অর্থাৎ নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে খোলামেলা পোশাক পরিধানকে একমাত্র কারণ বলে মনে না করে সভা এটিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির একটি বলে মনে করছে। আমি সভার এই মতকে সম্পূর্ণ সমর্থন করি।

যে দেশের সাম্প্রতিক অতীতের একেবারে প্রথম সারির একদল কবিসাহিত্যিক কলকাতা থেকে সুদূর সাঁওতাল পরগনায় দৌড়ান, ‘মাথার প’রে দেয়নি তুলে বাস’ ও ‘মুক্তবেণী পিঠের প’রে লোটে’ বলে সুঢৌল শরীরের অধিকারিণী সাঁওতাল রমণীরা সহজলোভ্যা ভেবে এবং অবশেষে সাঁওতাল পুরুষদের তাড়া খেয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচিয়ে কোনোরকমে ফিরে আসেন নিজের ডেরায়, সেই দেশের মানুষের কোনোরকম Hypocrisy সাজে না।

যে দেশে মেয়েদের চায়ের ভাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করে ‘খাওয়া’র পর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার উপমা টানা হয়, সে দেশে Tatoo আঁকা খোলা পিঠ বা Clean n Clear বাহুমূল, অথবা মাত্র এক-চতুর্থাংশ আবৃত রোম-বিসর্জিত চিক্কণ Chicken Legs, কিম্বা Deep n Dark Cleavage আর Piercing করা গভীর উন্মুক্ত নাভিদেশ দেখলে অবশ্যই অধিকাংশ পুরুষেরই সংযমে টান পড়ে বৈকি।

সব পুরুষই তো আর নারী নির্যাতনকারী হন না; কিন্তু যাঁরা হন, তাঁদের চিত্তবিকৃতিতে নারীর খোলামেলা পোশাক নিশিতরূপে ইন্ধন জোগায়। অবশ্যই তা উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিমার্জিত মননশীলতার অভাবে, এই নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশই নেই।

আসলে যে সমস্যাটিকে চিনলে আমাদের আস্তিনে দাগ পড়তে পারে, সেটিকে না চেনার জন্য আমরা সযত্নে অন্তত একশোটা কুযুক্তি খাঁড়া করি। আবারও বলছি, সভা জানতে চায়, খোলামেলা পোশাক নারী নির্যাতনের অনেক কারণগুলির মধ্যে একটি কারণ কিনা। আমার মতে অবশ্যই এটি একটি কারণ। আগে সমস্যাটি ঠিকমতো চিহ্নিত করে স্বীকার করতে হবে। সেখানে ভাবের ঘরে চুরি করে লাভ নেই। তারপর না হয় ঠিক করা যাবে, মেয়েরা বোরখা পরবে, না ছেলেদের মানসিক চিকিৎসা ও নীতি শিক্ষার ইঞ্জেক্‌শান দেওয়া হবে!।




বিপক্ষেঃ


১) রুমনি সেন

এখানে নারী নির্যাতন বলতে নিশ্চয়ই রেপ ও মলেস্টেশন বোঝানো হচ্ছে। বস্ত্রস্বল্পতার কারণে রেপ ও মলেস্টেশন হচ্ছে এটা অযৌক্তিক কথা।

আমরা দেখি চকোলেট বা ক্যান্ডিতে মোড়ক থাকে, তা না হলে মাছি বা পিঁপড়ে ধরতে পারে। মোড়কটা থাকলে মাছি বা পিঁপড়ে ভাবে ওটা তাদের খাদ্য নয় তাই আর ধারে কাছে আসে না।

কিন্তু মানুষরা এত বোকা নয়। মেয়েরা নিজেদের আপাদমস্তক কাপড়ে মুড়ে রাখলেও তারা বোঝে পোষাকের আড়ালে একটা দেহ আছে। আর পোষাকটা এমন কোন বর্ম নয় যে তার দ্বারা অপরাধীরদের নিরস্ত বা পরাস্ত করা যাবে। বরং খুব বেশি পোষাকে আবৃত মহিলারাই আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে পারবে না, পোষাকের কারণেই। একবার একটি মেয়ে বলেছিল, জিনস পরা থাকলে আক্রমণকারীকে লাথি মারতে সুবিধে হয়।

এমন কোন পরিসংখ্যান নেই যে বিকিনি পরা মেয়েরাই বেশি রেপড হয়। স্কুল কলেজের ছাত্রী থেকে শুরু করে কর্মরতা মহিলা, সর্বস্তরেই রেপ হচ্ছে। এরা কেউ মিনিস্কার্ট পরে চলাফেরা করে না। আর যদি চলাফেরা করেও থাকে সে জন্য তাকে রেপ করার অধিকার জন্মায় না। শিশুরা (স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে) রেপিস্টদের সহজ শিকার। এমন কি গৃহপালিত পশুরাও। এদের ক্ষেত্রেও কি মিনিস্কার্ট তত্ত্ব খাটে? আসলে এই সব অপরাধের জন্য দায়ী হল পুরুষের অসুস্থ মানসিকতা, তৎসহ মদ ড্রাগ, পর্ন ভিডিও ইত্যাদিও রয়েছে আগুনে হাওয়া দিতে এবং সর্বোপরি রয়েছে দুর্বল প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা, যা অপরাধীর মনে কিছু মাত্র ভীতিসঞ্চার করে না।

সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে, তাহলেই সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে। তা না করে ভিকটিম ব্লেমিং করলে সমস্যাটা থেকেই যাবে, শুধু তাই নয়, দিন দিন বাড়তেও থাকবে।



২) অরুণ চট্টোপাধ্যায়


অলক্তরাঙ্গা পায়ে, সিন্দুর-শোভিতা ভালে, শাড়ী পরিহিতা অঞ্চলে অবগুন্ঠিতা নারী – এক কালে নারীর এই বধূরূপ ও মাতৃরূপ ছিল বাঙ্গালী তথা ভারতীয় সমাজের নারীর প্রিয় ভূষণ । সেই কালের হয়ত কথা বলছি, যখন নারীরা সংসারে আবদ্ধ ছিলেন স্বামীর বাহুডোরে, রন্ধন-কর্মে ও শিশু-পালনে । স্বামী, সংসার ও সন্তান এই তিন স-এর সু-পালিকা ছিলেন তিনি । পিতৃ-তান্ত্রিক সমাজের ধারা অনুযায়ী স্বামী-শ্বশুরের বা সমাজের তথাকথিত অভিভাবক বা সমাজপতিদের বাঁধাছকের পোশাক তাঁরা হয়ত মানিয়ে নিয়েছিলেন খানিকটা বাধ্য হয়ে ।

ইংরেজ শাসনাধীন থাকা কালে পুরুষরা কাজের সুবিধার জন্যই হোক বা অনুকরণ-প্রিয়তার জন্যই হোক ইংরেজদের পোশাক ধারণ করেছিলেন । কিন্তু অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পায় নি সে পোশাক । আজ ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। প্রত্যেকেই স্বীকৃত একজন মানুষ হিসেবে । প্রত্যেককেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে আপন আপন কর্তব্যপালনে দায়বদ্ধ । কাজের সুবিধার জন্যও মেয়েদের কিছু সুবিধাজনক পোশাক যেমন চুড়িদার, জিনস- টপ ইত্যাদি বা পুলিশ, নার্স, মিলিটারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ বিভাগীয় ইউনিফর্ম পরতে হয় ।

এটা ছাড়াও রয়েছে অভিনয়, মডেলিং ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রয়োজনানুসারে পরিচালকের পরামর্শ মত পোশাক পরিধান স্বীকৃত । এই শেষোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে অবশ্য পোশাকের মাপকাঠি বলতে বর্তমানে আছে শুধুই তার হ্রস্বতা । টি-আর-পি বা বক্স-অফিসের সাফল্যের খাতিরে এই হ্রস্বতা যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে ।

এ কথা ঠিক যে, আজ নারীদের মধ্যে পোশাক-হ্রস্বতার প্রতিযোগিতা লেগে গেছে । আর এই প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতি উপহার দিচ্ছে নানান অশালীনতাও । এমন কি বাচ্চা মেয়েদেরও ফ্যাশানের খাতিরে যেগুলো পরানো হচ্ছে সেগুলো রুচির সীমাও হয়ত অতিক্রম করে যায় । উঠতি মেয়েদের শরীরের রেখাগুলি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে পুরুষের, বিশেষভাবে উঠতি বয়সের পুরুষের কাছে । তারা নারীর সৌন্দর্যের আড়ালে উপভোগ করে যৌন-উন্মাদনা আর উত্তেজনা ।

নারীর এই অশালীন পোশাক নিন্দনীয় হতে পারে, সেটা পুরুষের চোখে জ্বালাতে পারে কামের আগুন । কিন্তু তা নারী- নির্যাতনের কারণ কেন হবে সেটা সুবোধ্য নয় । তাহলে তো এই নিগ্রহ অনেক অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা । মনে রাখতে হবে পশুরা কিন্তু কোনও পোশাকই পরে না । তবু পশুরা তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় ছাড়া কাম-পীড়িত হয় না । তবে কি মানুষের অবস্থান পশুর নীচে নেমে গেছে ? নারী-নিগ্রহ সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন বিষয় । এটি নির্ভর করে পুরুষের সামগ্রিকতার মধ্যে নয় বরং কিছু বিকৃত-কাম পুরুষের বিকৃত দৃষ্টি আর পরিণতি-বোধের অভাবের জন্যই । যৌন-আবেদনকারী পোশাকে কাম-পীড়িত হওয়া আর নারী- নির্যাতন সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন মানসিকতার বিষয় । একের সঙ্গে অন্যকে গুলিয়ে ফেলা এক ধরণের সরলীকরণ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয় । নারীর পোশাক অবশ্যই রুচিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়, তবে এই বিকৃত-কাম পুরুষগুলির মানসিকতার সু-পরামর্শ বা কাউন্সেলিং খুব জরুরী ।



৩) স্বপন দেব

“কার্যেষু দাসী, করণেষু মন্ত্রী, ভোজেষু মাতা, শয়নেষু রম্ভা, রুপেষু লক্ষ্মী, ক্ষমায়েষু ধরিত্রী, সৎ ধর্মযুক্তা, কুলধর্ম পত্নী”

যে সমাজের নীতিশাস্ত্র নারীকে দিনে দাসী আর রাতে সেবাদাসী হওয়ার বিধান দেয়, সেই সমাজে নারী নির্যাতনের দায় যে একান্তভাবেই নির্যাতিতার ওপর বর্তাবে তাতে আশ্চর্যের কোন কারণ নেই। বক্তব্য রাখার আগে আমার প্রশ্ন হল, এখানে নির্যাতন বলতে কোন নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে ? শারীরিক, মানসিক নাকি, যৌন-নির্যাতন ? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি, এখানে নির্যাতন বলতে শুধুমাত্র যৌননির্যাতন বোঝানো হচ্ছে, তাহলে সাম্প্রতিককালের কয়েকটি দৃষ্টান্তঃ- দিল্লী গণধর্ষণ, বারাসাত গণধর্ষণ, গৌহাটি গণযৌননির্যাতন, মুম্বাই জার্নালিস্ট গণধর্ষন, চেন্নাই মেডিক্যাল ছাত্রী গণধর্ষণ এর কোনোটাতেই কিন্তু চেষ্টা করেও আধুনিক বস্ত্রাল্পতা কে নারী নির্যাতনের কারণ দর্শানো যায়নি……। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি যে, স্বল্পবস্ত্র পরিহিতা নারীকে পণ্য হিসাবে দেখা হয়, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, পণ্যকেও কি তার বিনিময় মূল্য ছাড়া ভোগ করা যায় ? বাজারে আলু, পটল পেঁয়াজ, পেট্রলের দাম বাড়ে, কিন্তু নারী নামক পণ্যের কোন মূল্যবৃদ্ধি হয়না ! তাই নারীর ওপর নির্যাতন হলে, নারীকে পণ্য বানিয়ে তার আধুনিকতার ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোন সামাজিক অপরাধের জন্যই পুরুষকে দোষারোপ করা হয়না। পুরুষজাতি মহান। তারা অন্যের স্ত্রীর সাথে নিষিদ্ধ প্রেম করেও যুগে যুগে পূজিত হন মহান প্রেমিক রূপে, কলঙ্কিনী হন শুধু রাধা রা !! অপহৃত হওয়ার অপরাধে অগ্নিপরীক্ষা দেন সীতা। রাম পূজিত হন যুগশ্রেষ্ঠ স্বামী রূপে! স্ত্রীকে পণ রেখে জুয়া খেলে প্রকাশ্য রাজসভায় স্ত্রীর যৌননির্যাতনের নির্বাক সাক্ষী হয়েও ধর্মেরধ্বজা ওড়ান ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির! ভারতবর্ষের হাজার হাজার গ্রামের লক্ষ লক্ষ মহিলা প্রতিদিন, প্রতি রাতে নির্যাতিতা, ধর্ষিতা হচ্ছেন যাঁরা খবরের কাগজের হেডলাইনে আসেন না। তারা কিন্তু কেউ মিনি স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়ান না। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় নারীনির্যাতন এক চিরকালীন প্রশ্ন-চিহ্ন। নারী সব নির্যাতন......সব যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করে যাবে—পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এটাই দাবী। আধুনিক নারী যদি তার প্রতিবাদ করে, তবে নির্যাতনের অপরাধে নির্যাতনকারী নয়, নির্যাতিতার আধুনিকতাকেই দায়ী করার এই জঘন্য চক্রান্তে, আধুনিকার স্বল্প-বস্ত্রতা নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুৎসিত নগ্নতাই প্রকট হয়।



৪) অনুপম দাশশর্মা।

সকালে কাগজ খুললেই আতঙ্কে শিরশির করে শরীর। আবার দেখব নাতো তিনবছরের কোন শিশুকন্যার ধর্ষনের খবর! শুধু এইটুকুই বুঝিয়ে দেয় সমাজের নরকজাত মানুষগুলো যখন ধর্ষকামী ইচ্ছার বলিকাঠে একটি শিশুকে চড়াতেও একচুল সরে আসতে পারেনা। তাদের কাছে জঘন্য লালসাই প্রধান উৎসেচক। ওই শিশুটির ক্ষেত্রে পোষাকের কোন তাৎপর্য থাকে না। পথেঘাটে প্রবল পশ্চিমী আবহাওয়ায় নিশ্চই কিছু যৌন ক্ষুধায় সুড়সুড়ি দেয় কিন্তু নারী নির্যাতনের একমাত্র কারণ ওই আপাত উদ্দেশ্যমূলক পোষাক হতে পারে না।

কালের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সংস্কৃতির চরিত্র পালটে যায়, পালটে যায় মানুষের ভাললাগার রসদ। ক্ষুরধার আকর্ষণের সীমা লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপনের নারী শরীরের অপব্যবহারের বিপনন।

যে শিশু দীপাবলিতে তারাবাতি জ্বালায় সে ঘুরেও তাকায়না তারাবাতির প্যাকেটে অর্ধ নগ্ন নারী শরীরের ছবিটির দিকে। অথচ সুক্ষ্মভাবে পণ্যকে গণিকাবৃত্তিতে নামিয়ে এনে নারী অবমাননা করেই চলেছে দিনরাত অসাধু চরিত্ররা। শিল্পের বকলমে রিপুর তাড়না দমিত হয়, কখনও কবিতায় কখনও বিদেশী নাটকের চরিত্রায়নে।

এ সবই একটা দুষ্ট শ্রেণীকে উৎসাহিত করে নোংরা কাজে, নারীর অবমাননায়। সুতরাং কিছু অসংলগ্ন পোষাক পরিহিতা কখনই একক দায়ী হতে পারে না।

মৈথিলী কবিতা - অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

একটি অনুরোধ, কবিতাটি মৈথিলী ভাষায় লেখা, তাই সেই ছন্দেই পড়ুন।

বসন্ত – বরষণ
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়



বরষণ লাগি রে বসন্ত অঙ্গ মে
আওল শ্যামল মাতল রঙ্গ মে।

ঝনঝন ঝঞ্ঝন গুঞ্জন বিসরি
ঝমঝম নূপুর উঠইছে শিহরি
ঘনঘন গরজন পলাশ পুঞ্জে
সিঞ্চিত ভ্রমররে ফিরইছে গুঞ্জে ।

উছলিছে যমুনা কত শত ঢঙ্গ মে
আওল শ্যামল মাতল রঙ্গ মে।

শনশন দক্ষিণ পবনক অঞ্চল
উন্মাদ শাওনমে বহইছে চঞ্চল
ঘাট–বাট–তট পর ঝটিতি ঝম্পিছে
মুহুমুহু কুহু প্রাণ গরজে কম্পিছে ।

তবু হিয়া রাখনু শাওন সঙ্গ মে
আওল শ্যামল মাতল রঙ্গ মে। 

কবিতা - মৌ দাশগুপ্তা

জন্ম
মৌ দাশগুপ্তা



একদিন সব গান দুরন্ত পাখির পালকের মত উড়ে যাবে।
একদিন গল্পগুলো আবছা হতে হতে মিলিয়ে যাবে
আধফোটা চাঁদটার আলতো রূপালী আলোতে
কবিতারাও একদিন সরষে ফুলদের হাত ধরে হেঁটে চলে যাবে।

পর্ণমোচী সময়ে পাটিগণিতের মত খোলা মাঠে পড়ে থাকবে পুষ্পশর,
আদিম কানীন অরণ্যে মৃগনয়না শকুন্তলা লুকাবে বন্য সৌন্দর্য্য।
দুষ্মন্ত মনুসংহিতার মত রাতের অধ্যায় জুড়ে রাজকাহিনী লিখে যাবে
অন্ধকারে স্ত্রীর সঙ্গে, রমনীর সঙ্গে, নিখাদ পুরুষসুলভ যৌনতায় ।
অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটে যাবে মরুভূমি পেরিয়ে অলীক এক ঝর্নার দিকে ।

রাত্রির রমনীয় দেহে কামসূত্র লিখে যাবে শ্বাপদ সভ্যতা,
বারবার নারীকে ধর্ষণ করবে, নষ্ট করবে, আঘাত করবে শরীর জুড়ে,
প্রগাঢ় কুয়াশা ঘিরে ধরবে ভাঙা কুটীর, প্রাসাদ রাস্তা ও ঊপাসনাগৃহ,
ধর্ষণের শব্দে হাততালি দিয়ে আনন্দ জানাবে লোভ চকচকে মানুষগুলো !

তারপর সারারাত ধরে একটু একটু করে বিবসনা হবে তুমি,
একটু একটু করে তোমাকে নখে দাঁতে সময়ের কশাঘাতে ভাঙব,
জোনাকজ্বলা রাতের আলোয় তুমি ক্রমশ ঈশ্বরী হয়ে উঠবে ।
তখন না হয় আমাকে একটা নতুন পরিচয় দিও।

কবিতা - ইন্দ্রাণী সরকার

জীবনের সম্পদ
ইন্দ্রাণী সরকার



এক আশ্চর্য আলোকিত পথ
সামনে অপেক্ষারত,
আমি পা দুটো বাড়িয়ে দিই |
হেঁটে যাই একাকী আনমনে
এক গোলার্ধ থেকে অন্য
গোলার্ধে অমৃতের সন্ধানে |
বিগত কাল দিলনা কিছুই
শুধু একমুঠো অপমান
তুলে দিয়েছে হাতের পাতায় |
তারই মাঝে কিছু সুখ, প্রেম প্রীতি
আর কিছু মুহূর্ত প্রাপ্তিস্বরূপ

ফ্রেমে বাঁধা জীবনের সম্পদ |
সবই যেন অন্ত:সারশূন্য বিলাসিতা
তাৎক্ষণিক ভাবের প্রকাশ
মুহূর্তে মিলিয়ে যাওয়া আবেগ ||



কবিতা - সুস্মিতা বিশ্বাস

রজনীগন্ধার ডাকে যূঁইফুল
সুস্মিতা বিশ্বাস



তোমার উষ্ণতায় আমায় বাসবে কি ভালো,
কোনদিনই বুঝলেই না- ভালবাসি,
তাই বারেবার,ইচ্ছে-নদীর জলে
সুখের অনুভূতির “ঘ্রান’,
উঁচু ঝরনার স্রোতে ঝরে পড়ে আবেগের আকুতি,
তুমিই আসবে আমারই সেই চেনা মাতাল গন্ধে,
মুগ্ধ দৃষ্টির আমন্ত্রণে কাছে কাছে হৃদয়ের স্পন্দন,
অতীব প্রেমরাগ গান শোনাবে সুরনদীর অন্তরে,
রজনীগন্ধার মিষ্টি আবেগে যুঁইফুল পথে পথে,
একটানা ইমন এর সুরে মুছে যাবে বেহাগ,
কালো মেঘেরা ছড়াবে রাশি রাশি যুঁই ফুলের ধারা।

কবিতা - দেবাশিস মিত্র

আমার বসন্তে
দেবাশিস মিত্র



মনের আকাশে একমুঠো রং কে গো তুমি ছড়িয়ে দিলে...?
কৃষ্ণচূড়ার লালে লাল হয়ে কে গো তুমি আমায় মাতালে...?
দখিণা বাতাসে আবিরের গন্ধে কে গো তুমি আমায়ে ছুঁয়ে গেলে...?
পলাশের রঙে রাঙিয়ে কে গো তুমি এলে মোর স্বপনে...?
বসন্তের কোকিল হোয়ে কে গো তুমি ভালবাসার গান শোনালে...?
শুকনো পাতা ঝরার শব্দে কে গো তুমি আমায়ে আলিঙ্গন করলে...?
মধুর বসন্তে আমার সব কিছু ভরিয়ে দিয়ে কে গো তুমি আমায়ে আপনালে...?


কবিতা - সত্যজিৎ

ছুটির রোববার
সত্যজিৎ



পড়তে বসেই সকাল সকাল মনটা আমার উদাস,
কোথাও সেটা হারিয়ে গেছে নেই তো পাওয়ার আভাস ।

বইয়ের পাতায় চোখ টেকেনা খাতার পাতাও শূণ্য,
অঙ্ক গণিত ভূগোল ছেড়ে ভাবনা মনে অন্য ।

কি করি আর হয়না কিছুই ভেবেই দিশেহারা,
মনের মাঝে ছুটছে নদী আকুল পাগলপারা ।

পাশেই রাখা মুড়ি বাতাসা মন করেনা খেতে,
একনিমেষে ছুট্টে যদি খেলতে পেতাম যেতে ।

মা বলছে এখন পড়া সেই বিকেলে খেলা,
চুপটি করে পড়া শুধু দুষ্টুমি নয় মেলা ।

রোববারে-ও পড়তে হবে খেলতে যাওয়া মানা,
বাইরে যাওয়ার বন্ধ দরজা শেকল তাতে টানা ।

ভাবছি বসে জানলা ধারে মন যে কোথাও বাঁধা,
রং-পেন্সিল গল্প ছড়া লাগছে যেন ধাঁধাঁ ।

কিছুই করার নেই তো এবার উল্টে বইয়ের পাতা,
খুঁজে নিলাম আপনা হতেই কবিতার এই খাতা । 


কবিতা - রত্নদীপা দে ঘোষ

... নাম
রত্নদীপা দে ঘোষ



অপ্সরাদের ভেতরে একা যেতে সাহস হয় না । ভয় করে খুব । যদি খুব বৃষ্টি ভোরবেগুনির ছায়া নিয়ে হাজির হয়। যদি রাতের শুরুতে বিছানায় খাড়া হয়ে ওঠে মোমের মত অন্ধকার । যদি নীল শাড়ি নীল ব্লাউজ, সবুজ মানুষের দানোকথা আমার পা জড়িয়ে ধরে ... যদি আর না ছাড়াতে পারি কুলকুল নদীর খয়েরি বোঁটা ... যদি অনামিকায় মেঘ করে আসে ব্রহ্মাণ্ড । যদি পাখিরা আঁতাত করে সুনামি পালকের সাথে ...

যদি তুমি বলো তোমাদের পাড়ায় আকাশ রঙের একটা বাড়ি আছে । কামরাঙা রঙের গৃহস্থী, অনেক ঢেউ, চুড়ো করে বাঁধা চুল ... খেজুরের গহ্বরে যদি পোষা উটের ধ্বনি বাজতে থাকে, যদি একটি মেয়ে মরুভূমি সেই বাড়িতে একলা থাকে, মেয়েটির হাতে পায়ে অনেক নাচ, যদি সেই মেয়েটি আমায় ধুলোর ঘুঙুরে নাচতে বলে ...

কবিতা - কচি রেজা

কয়েক পৃষ্ঠার রাত
কচি রেজা



কত কম চুমুতে আমরা নাম রেখেছি প্রেমের
পায়ের কাছেও কালো রঙ যারা যাবে উত্তরে দক্ষিণে
জিভের বদলে আজ কথা বলছে দীর্ঘশ্বাস
চিমনিতে কালি, বালু ঘষে ধার করছি ঘুম

আমার জমে যাওয়া গলা, ক্ষুধার্ত পা
নগ্নতম ঘ্রাণ নিচ্ছে টি-শার্টের
জানি, পিতাদের মত আমাদেরও ঘন্টা কয়েকের ব্রণের গল্পে
শুধু কয়েক পৃষ্ঠার রাত…।।



কবিতা - অনুপম দাশশর্মা

অনাবৃত
অনুপম দাশশর্মা



অনেকটা পথ হাঁটার পরে জোনাকির সাথে দেখা
জিজ্ঞেস করল, বৃত্তের মুখে আবার এসেছো তো!
ভাসো এবার।

ঘুরে ফিরে যখনই করতলে চোখ পাতি
সেই একঘেয়ে আত্মসিদ্ধির ব্যঞ্জনা।

বনষ্পতি আর পাওয়া যায় না অভয়ারণ্যেও
গুঁড়ি কেটে বসে গেছে লালসার রিপুদল।
এখন আত্মজা সাথে থাকলেও
কুঁকড়ে ওঠে স্নেহমন।
পক্ষাঘাতেও চোখ খোলে না বিবেকের তাড়না।

নির্বাক নক্ষত্ররা অনেক প্রিয়জনের থেকেও বিশ্বাসী
সহমতে জোনাকিরা।

ফিরে ফিরে আসে প্রিয়ভাষিণীরা
বৃত্তাকারে, অনাবৃত অক্ষরে।

কবিতা - সৌভিক দে (শুভ)

ভালবাসার সাতকাহন
সৌভিক দে (শুভ)



তখন তুমি সবে তেরো
বালিকা বিদ্যালয়,
আমি তখন ছাত্র বারোর
মানিকতলায়।।

তখন তুমি স্কুলের পথে
মায়ের হাতে হাত,
আমি তখন বন্ধু ভিড়ে,
খুঁজি তোমার সাথ।।
তখন তুমি মেঘলা আকাশ
বজ্রের গর্জন,
আমার তখন জীবন যুদ্ধে
সবে পদার্পণ।।
তখন তুমি চাঁদের আলোয়
মিষ্টি হিমেল বাতাস,
আমি তখন তোমার কাছে
রূপালী রাতের আকাশ।।

তখন তুমি লাল সিঁদুরে
গেয়েছো কবির গান,
মোদের তখন সংসারেতে
এসেছে নুতন প্রাণ।।
তখন তোমার মৃদু হাসি
রূপাঞ্জলির সাজে,
কোথায় যেন হারিয়ে গেছি
পাখির কলরবে।।
এখন তোমার বয়স বেড়ে
হয়েছে ঊনষাট,
তবুও মোদের ভালবাসাতে
পরেনি মনের বাঁধ।।

কবিতা - শ্রীশুভ্র

অন্ত্যেষ্টি!
শ্রীশুভ্র



মালবিকা সান্যালের তাড়া আছে লাভ লোকসানের বন্দরে নোঙর ফেলার জন্য!

সদর দরজার চৌকাঠ ডিঙানো মখমল পায়ের
রিনিঝিনি নুপুর আদরে!
উন্নাসিক রাতের চাদরে!

ভোর ভোর শিশির চোখের নির্বাক বারান্দার
নাগরিক মায়াকান্নার শ্লোক!
মালবিকার ঝোঁকে!

এখানে রাজ্যপাটের অলিন্দে
চক্রব্যূহ থেকে বেনামী শিবিরে
মালবিকার অবারিত গতি!
বন্দরে রোজকার জাহাজ ভিরাতে!

তুমি বলেছিলে একদিন
ঝিলিমিলি জোনাকি আদরে

মানুষের জঙ্গল পারিজাত উদ্যান হবে!

হৃদয় জুড়োবে!

তুমি বলেছিলে পরজীবী
নগর বন্দরে, গোলটেবিল
গোপন আঁতাতে- ষড়যন্ত্রের
ট্র্যাডিশন ফুরাবে!

মালবিকা সান্যালের ভগ্নস্তুপে ধ্বংস চিহ্নের ডানায়

অবিনাশী ভালবাসা পাখি হয়ে হৃদয় উড়াবে!

কবিতা - সুমন কুমার সাহু

দিন একুশে
সুমন কুমার সাহু



দিন একুশের ভোরাই সুরে
গান ধরেছি তোমায় পেতে
সহজ সরল মনের কথা
ছন্দে বেঁধে তোমার তরে ।

তুমি তো আমার হৃদয় কোনে
স্পন্দিত হও স্বপ্ন নিয়ে
স্বপ্ন আমার ওই আকাশে
সাগর গিয়ে যেথায় মেশে ।

ভেদাভেদ হীন মহা মানব সাগর তীরে
স্বপ্ন মাখাই ভালোবেসে নতুন আলোর খোঁজে
আমার ভাষার মনে মনে অথবা চিত্কারে
শোনাই প্রিয়া শত-শতাব্দীর কবিতা তোমাকে ।।

কবিতা - দীপঙ্কর বেরা

মা
দীপঙ্কর বেরা



মনের মঞ্জিমা চায় কোলের আদর
পৃথ্বীর বুকেতে দেখি স্নেহ সমাদর,
মূর্তিখানি ঠাঁই দেয় মনের আরাম
মাগো, তোমার চরণে শান্তি সুখধাম ।

ভালোবাসা আঁচলেতে জীবনটা ভরে
আমার সমৃদ্ধ প্রাণ আশীর্বাদ করে,
জীবন বর্ণমালায় সতেজ এ’ স্নান
দুঃখ কষ্ট ব্যথা ভয় করে দেয় ম্লান ;

দয়া মায়া ও ক্ষমার প্রতিমূর্তি তুমি
আমার এ আগুয়ান কর্ম ভিত্তিভূমি ।
মমতার সযতনে চিত্ত শীতল
ছায়ার মাধুর্য মোহ আনন্দ বিহ্বল,
তোমার আলেখ্য পূজি হৃদয়ে আকুল
পরম আশ্রয়ে আমি কুড়াই বকুল ।। 


কবিতা - শমীক দাশগুপ্ত

স্বপ্ন
শমীক দাশগুপ্ত



নাহি জানি তাহার শুরু কোথা, শুধু জানি চলাচল।
সুধীর মূর্ধা মাঝে তাহার অনুদিত কোলাহল।
শাশ্বত রূপ পরিচিত লাগে ঘুমন্ত অবচেতনে।
তারে ভাবিয়াছি এক নিঝুম প্রভাতে, তারে বুঝিয়াছি সান্ধক্ষণে।
সে নাহি কয় কথা, নাহি গাহিয়াছে গান।
কখনো করে নিস্প্রাণ, কখনো করিয়াছে প্রাণোদান।
ছুটিয়াছি বহুদূর, যেথা বলাকা যায়না থামিয়া।
দেখিয়াছি দেবতা, মর্তে আসিয়াছেন নামিয়া।
জাগিয়াছে অন্তরো, অরুণে, পবনে, বর্ষণে।
ভাসিয়াছে হৃদয়ও তরী অনন্ত সন্ধানে।
বুঝিয়াছি সে যে সত্য নহে, কল্প দেশ এর ঘুমে।
তারে রাখিয়াছি গোপন মনাম্বরে, নীরবে নিঝুমে।
নিবিড় নিশিথ তারা তুমি, মোর অকারণের সখা।
তব স্পর্শে নিত্য দিবস স্বপ্নিল রঙে মাখা।



কবিতা - দেবাশিস কাঞ্জিলাল

স্বগতোক্তি
দেবাশিস কাঞ্জিলাল



বাড়িতে গোটা কয় খবর-কাগজ আসে,
সব মিথ্যে কথা পড়ে ওঠা হয় না সময় মত,
বমি আসে বলে।
তাই তারা জমে, এদিকে ওদিকে,
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে বকুনি খাওয়ায়,
আমার পালিকার !
মাঝে মাঝে তাদের বিদায়ের জন্য মরিয়া আমি,
সন্ধ্যায় কি অন্য কোন অকাল-সময়ে,
পুরোনো কাগজওয়ালা খুঁজি !

যথারীতি পাওয়া যায় না তাদের,
কেন না এ’ কথা সবাই জানে,
যাকে তুমি চাইবে মনপ্রাণ দিয়ে,
তাকে তুমি পাবে না কখনো !

সমাধান চলে এলো হাতে।
সেদিন হঠাৎ, আলাপ হল এক মানুষের সাথে,
তাঁর দোকান আছে এক, পুরোনো কাগজ, শিশিবোতল,
আরো কত সব, বাতিল জিনিষ কেনার ।
তাঁকে শুধোলুম, আপনি কি বাতিল মানুষ কেনেন ?
তিনি বললেন, এখনো অবধি কেউ বেচেনি
বাতিল মানুষ কোন, তাঁর কাছে ।

আশাভঙ্গ হল !
ভেবেছিলাম যদি আত্ম-বিক্রয় করা যায় কোন মতে,
তবে যদি কিছু দাম পাই !
সে আর হল না !

তবে পুরোনো কাগজের গতি হল,
তাঁর আমন্ত্রণে গেলাম সেই আশ্চর্য-বিপণে,
গিয়ে তো অবাক, কি নেই সেখানে !
পুরোণো কাগজ থেকে লোহা আর প্লাস্টিকের স্তূপ,
শিশি-বোতলের পাহাড়, আরো কত কি যে !

আর কিছু ?
হ্যাঁ, আরো কিছু, পুরোনো বইয়ের স্বর্ণখনি এক !
সে যে কি সম্পদ, তা বলে যাবে না বোঝান।

খুঁজে চললাম,
খুঁজে চললাম কি আছে এলডোরাডোতে !
বহু কিছু দেখা দিল,
কুমারেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি-আঁকা আর ভাস্কর্যের বই, চিত্রভূষণ।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরোগ্য-নিকেতন । শঙ্খ ঘোষের ছন্দের-বারান্দা ।
নারায়ণ চন্দ্র ঘোষের কম্পারেটিভ মেটিরিয়া মেডিকা,
অদ্ভুত কিছু বটতলার বই,
হস্তরেখা-বিচার, গাছগাছড়ায় রোগমুক্তি,
চাণক্যশ্লোক, কালিদাসের হেঁয়ালি !
আরো কত কিছু !

পুরোণো কাগজ বিনিময়ে,
বইগুলি সানন্দে দিলেন, ভদ্রলোক, আমাকে !
মহা-খুসি, দু'জনেই বেশ !
শুধু বাড়ি ফিরে বকুনি আবার,
নাকের বদলে নরুণ নিয়ে ফিরেছি বলে !

কালিদাসের হেঁয়ালি, বড়ো ভাল, কত কিছু শিখি !
অথবা সে হোমিওপ্যাথিক, মেটিরিয়া-মেডিকা,
যা’ না পেলে জানতেই যেত না পারা,
আমি এক রোগ-হিমালয়ের
চূড়ার ওপরে বসে আছি।

এইসব নিয়ে বেশ আছি,
কাঙ্গালকে শাকের ক্ষেতে
কে যেন হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
এখন শুধুই আশা নিয়ে থাকা,
কবে যে আবার, যত অবান্তর,
মিথ্যে কথা দিয়ে ভরা
বিনিময়-যোগ্য খবর-কাগজ জমা হবে !


কবিতা - আকাশ দত্ত

কর্ণ
আকাশ দত্ত



চলে যাওয়ার দিনটা কি ভীষণ ছিলো!
তোমার আমার মাঝে
মধ্যবিত্ত সভ্যতা
আতশবাজি
নিষিদ্ধ
তখনও
আঁচলটা ধরাই ছিলো মুঠিতে
অনার্য রাজার মত
উলঙ্গ অন্ধকার
বন্ধ চোখে
নরম নদীর জিভে অসহ্য সংকেত
বেজন্মা কুকুরের ডাক;
কেউ দাঁড়িয়েছিলো
পর্দার ওপারে
ঠিক
রোদ এসেছে প্রতিবিম্বে
ঠোঁটময় মেষপালকের প্রেম
ডিঙ্গিয়ে গেছে চৌকাঠ
শেষমেষ
আমার শহরে মৃত্যুমিছিল
হঠাৎই
অথচ
আজ মনে হয়
আগুনকে পোষ মানাতে গিয়ে
জ্বালিয়ে দিয়েছি ঈশ্বর
অসহায় কর্ণের মত
এই আমি!! 


রম্য রচনা - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

(সব চরিত্র কাল্পনিক)
একপাতা ঘুমের ওষুধ
অরুণ চট্টোপাধ্যায়



দেখে সন্দেহ হবার মতই চেহারাখানা । মাথার উস্কোখুস্কো চুলগুলো বেয়াড়া ভাবে মুখের এদিকে ওদিকে পড়েছে । চোখগুলো বেশ ফোলা আর লাল । জবাফুল কি করমচা এ হিসেব করার মত ধৈর্য দোকানির নেই । যা অবস্থা, কোনোরকমে তাড়ানো গেলে বাঁচা যায় এমনই মনের ভাব ।

-স্যর, একপাতা ঘুমের ওষুধ দিন না স্যর । প্লিজ ।

ঘুমের ওষুধ ? তার মানে tranquilizer ? হাইলি রেস্ট্রিক্টেড । তাও আবার এক আধটা নয়, একেবারে একপাতা । একবার কেস খেয়ে গেলে কি হবে বুঝছ ? অতএব ও রাস্তায় পা মাড়াবে কে ভাই ? মানে মানে বিদেয় হও মানে সটকে পড় ।

প্রেসক্রিপশন দেখাতে পারে নি লোকটা । সুতরাং সকলের ঘাড় ধাক্কা । দোকানীদের কেউ মিউ মিউ করে । কেউ গলাবাজি করে । কেউ চোখ পাকিয়ে বলেছে, উইদাউট প্রেসক্রিপশন তো এ ওষুধ হয় না দাদা । ডাক্তার দেখিয়েছেন তো ? প্রেসক্রিপশন দেখান ।

-যাব যাব । ওষুধ খেয়ে এ বেলা একটু ঘুমিয়ে ও বেলা যাব ডাক্তারের কাছে । আপনি দাদা না হয় অন্ততঃ একখানা দিন । মাত্র একখানা ?

মোড়ের ও মাথা থেকে এ মাথা পর্যন্ত যে কটা দোকানে ট্রাই করা হল তার সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়।

-কোথাও পেলাম না স্যর, কেউ দিল না । লোকটার কাকুতি মিনতি সাদিকের দোকানেও অব্যাহত, কত করে ঘুরে মরছি একটা দিন না কাইন্ডলি ?

সাদিক দোকানের মালিক । তার কাজ সেলসম্যানদের বিক্রি করা ওষুধগুলোর পেমেন্ট নিয়ে বিল দেওয়া । এখন বিশেষ ভিড় ছিল না দোকানে । পেমেন্টের কাজ নেই । সামনের খবরের কাগজটায় চোখ বুলোচ্ছিল আর কানে ডটপেনের পেছন দিকটা দিয়ে আরাম করে কানের খোল বার করছিল ।

কাগজ পড়বে কি । খবর আর কোথায় ? শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ । গুলি গোলা খুন রাজনীতি। ধুস জান একেবারে কয়লা হয়ে গেল । এসব যেদিন বন্ধ তো ঝড় বৃষ্টি বন্যা । আর কি যে সব বিদঘুটে খবর মাইরি । যেখানে বন্যা হবার কথা নয় সেখানে বন্যা । আর যেখানে খরা বিগত হাজার বছরে কখনও কেউ ভাবে নি সেখানে খরা ।

লোকটার কথা-বার্তা বেশ কিছুক্ষন ধরে শুনছিল সাদিক। বিশেষ মন দেয় নি । ও তার কর্মচারীরাই সামলে নেবে । তাই তাদের সঙ্গে একটু রসিকতার লোভ সামলাতে পারছিল না ।

কান খুঁটতে খুঁটতে বলল, বুঝলে কালি, এখন দেখছি রাজস্থানে বন্যা হচ্ছে । আর বঙ্গোপসাগরে নাকি যে খরা চলছে তা নাকি বিগত একশ বছরেও হয় নি । এসব যদি সত্যি হয় তো কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলোর পোয়া বার । ওদের হৈ হৈ কাটতি আর রৈ রৈ টি-আর-পি রোখে কে ? জগতটা সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে রে কালি সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে ।

-- ওই জন্যেই তো আমার ঘুমের ওষুধটা লাগবে স্যার ।

কর্মচারীদেরকিছুতেই ম্যানেজ করতে না পেরে লোকটা এতক্ষনে ছুটে এসেছে মালিকের কাছে । একেবারে দৌড়ে এসেছে যেন হাতে চাঁদ বা পরিত্রাতা পেয়েছে ।

-এমন সব ঘটছে বলেই তো আর একটু ঘুমোতে চাই স্যার । একটা পাতা না দেন একটা ট্যাবলেট অন্তত দিন ।

একজন কর্মচারীকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু গলায় বললেন, পেট গরম হয়েছে লোকটার বুঝতে পারছ না ? জেলুসিল আর হাল্কা কটা সিডেটিভ দিয়ে ছেড়ে দাও ।

-এক পাতা দিলেই ভাল হত । লোকটা তবু গাঁইগুই করে ।

-কেন এক পাতা পেলে কি করবেন ? একটা চোখ কুঁচকে প্রশ্নটা করল সাদিক ।

-কি আর করব । একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে লোকটা বলল, আরও গোটা কুড়ি বছর শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারতুম আর কি ।

- কু –ড়ি বছর ! এমন একটা হাফ পাগলকে এত কাছ থেকে পেয়ে সবাই যেমন আশ্চর্য তেমনি খুশি । সত্যি পাগলরা এমন কৌতুকের খোরাক জোগাতে পারে যা নামকরা সার্কাসের নামকরা জোকাররাও পারে না ।

কর্মচারী আর মালিকে চোখাচুখি হল যার মানে হল লোকটাকে এখন ছেড়ো না । ওকে বেশ কিছুক্ষণ খদ্দের করা যাবে ।

দোকানে ভীড় নেই । কর্মচারী ঢিমেতালে ওষুধ সার্ভ করছে । মালিক রসিয়ে আলাপ জুড়েছে । হচ্ছে রাজনীতি, রণনীতি, আবহাওয়া এই সব আলোচনা ।

-আবহাওয়া পাগলা হয়ে গেছে স্যার একেবারে just পাগলা । উস্কোখুস্কো পাগলা লোকটার ঝটতি মন্তব্য ।

মালিকের মুখে অর্থপূর্ণ গাম্ভীর্য আর চোখের কোণে ইশারা দেখে কর্মচারীরাও মুখ টিপে হাসছে । সত্যি এমন খদ্দের কি হয় বড় একটা ।

মেডিসিন সারভ করা হয়ে গেছে । জেলুসিল আর হাল্কা সিডেটিভ । দোকানের মালিকের প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী একজন কর্মচারী দিয়েছে । সাদিক এবার পেমেন্ট নিয়ে বিল লিখবে । Quantity, দাম, ব্যাচ নম্বর এসব লেখা হয়ে গেছে । এসব হাল্কা ব্যাপারে ক্রেতার নাম কেউ লেখে না । তবু সাদিকের মনে হল নামটা হলে মন্দ হয় না । “খদ্দের” যখন হয়েছে তখন একটু “নামী” খদ্দের হলে ক্ষতি কি?

-নামটা কি লিখব দাদা ?

-আমার নাম স্যার ?

হাসিটাকে বাঁকা ঠোঁটের আড়ালে আটকে রেখে সাদিক বলল, তবে কার ? আপনি তো কিনছেন ?

-আমার নাম স্যার - লোকটা ইতস্ততঃ করল, নাম - কুড়ি বছরে অনেক কিছু গুলে মেরে দিয়েছি স্যার । কিন্তু এটা তো আমার দেশও নয় মনে হচ্ছে । আচ্ছা স্যর, সারা পৃথিবীটা কি এখন একটা দেশ হয়ে গেছে ? দুনিয়া কি সত্যি একটা মুঠির মধ্যে এসে গেছে ।

কর্মচারীরা হাসছে । একজন বলল, তাই তো মনে হয় দাদা । একজন শিল্পপতি স্লোগান তুলেছে যখন । সাদিক গম্ভীর । উত্তর দেওয়াটা জরুরী মনে করল না ।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে ।

-কি মনে পড়েছে ? সাদিক কৌতূহলী । ঠেলায় পড়লে নিজের বাপের নাম অনেকেই নাকি ভুলে যায় । কিন্তু নিজের নাম ভুলে যায় এমন লোক তো এখনও দেখে নি সাদিক । কৌতূহলী হবারই কথা ।

-নাম স্যার । মনে পড়েছে মনে পড়েছে । লোকটা প্রবল উৎসাহে বলে উঠল, লিখুন রিপ ভ্যান উইংকল । শুনেছেন কখনও ?

রম্য রচনা - নারায়ণ রায়

জ্যোতিষার্ণব ঘনাইশাস্ত্রী
নারায়ণ রায়



পটাইবাবুর বাড়ির রকে আমাদের চারজনের আড্ডাটা দিনে দিনে ভালই জমে উঠেছে, তবে ইদানিং ঘনাইবাবুকে আড্ডায় সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। টানা একমাস আড্ডায় ঘনাইবাবুর অনুপস্থিতি আমাদেরকে বেশ চিন্তায় ফেলল। ব্যাপারটা কি ? জানার জন্য আমরা তিনজন অর্থাৎ আমি, পটাইবাবু এবং লাটাইবাবু, ঘনাইবাবুর বাড়ি যাওয়া মনস্থ করলাম। এতদিনের পুরানো বন্ধু, আমাদের অবশ্যই উচিত তাঁর খবরাখবর নেওয়া।

একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে আমরা হাজির হলাম । কিন্তু এ আমরা কোন ঘনাইবাবুকে দেখছি? হটাৎ ঘনাইবাবু যেন কেমন পাল্টে গেছেন, আমাদের সেই আগেকার ঘনাইবাবু কোথায় গেলেন? ঘনাইবাবুর এ কি হ’ল ?

ঘনাইবাবু আমাদের দেখেও যেন চিনতে পারলেন না। মুখে অদ্ভুত সব কথাবার্তা। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই তার উত্তরে ওনার মুখ থেকে ‘কালসর্পযোগ’, ‘রাহুর বক্র দৃষ্টি’, ‘শনির সাড়ে সাতি’ এই ধরনের অবোধ্য সব শব্দ বেরোতে লাগলো। বেশ কিছুদিন ধরে চুল দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিয়েছেন, কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। গলায় ইয়া বড় একটা রুদ্রাক্ষের মালা আর পরনে গৈরিক বসন। ঘনাইবাবু ভীষন ভাবে জ্যোতিষ চর্চা শুরু করেছেন, বাড়ির বাইরের দেওয়ালে ইয়া বড় একটা সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন- ““জ্যোতিষার্ণব ঘনাইশাস্ত্রী—সন্তানের ভবিষ্যত ? স্ত্রী কিম্বা স্বামী অন্যের প্রতি আসক্ত ? মামলায় দুঃশ্চিন্তা ? সকল সমস্যার সমাধনে—‘বাবা ঘনাই শাস্ত্রী’।””

বৈঠক খানা ঘরটিতে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে চেম্বার খুলে বসেছেন। সঙ্গে কয়েকটি পুরানো পঞ্জিকা; লগ্ন, রাশিফল ইত্যাদি বিচারের বই, একটি আতস কাঁচ আর রঙ্গীন কাঁচের মত দেখতে কয়েকটা টুকরো টুকরো পাথর। সহকারী এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন পাড়ারই ছেলে কিচলুকে। কিচলু ঘনাইবাবুর কাছ থেকে বারোশ টাকা ধার নিয়েছিলেন তিন বছর আগে, সুদে আসলে সেটি এখন বত্রিশশো টাকার মত হয়েছে। বহু তাগাদা দিয়েও তা আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঘনাইবাবু এখন ঠিক করেছেন কিচলুকে মাসে পাঁচশো টাকার বেতনের কর্মী হিসেবে রেখে মাসে মাসে তিনশো টাকা করে কেটে নেবেন।

এমন সময়ে ঘনাইবাবুর অর্ধাঙ্গিনী ঘন্টুরানী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

এ কি? ঘন্টুদেবীকে তো চেনাই যাচ্ছে না, মাত্র গত একমাসেই চেহারা অর্ধেক হয়ে গেছে। কারণ জিগ্যেস করায় জানা গেল, ঘনাইবাবুর অর্ধাঙ্গিনী দীর্ঘদিনের উচ্চ রক্তচাপের রোগী, নিয়মিত তাকে দু’বেলায় পাঁচটি- করে ট্যাবলেট গলাধঃকরন করতে হয়, কিন্তু Charity Begins at Home এই নীতি মেনে ঘনাইবাবুর নির্দেশে এক নিমেষে সেসব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে ঘনাইবাবু ঘন্টুরানীর সর্বাঙ্গে মোট সাতটি তাবিজ ও কবচ বেঁধে দিয়ে বলেছেন, “রাহু আর কেতু দুই শয়তানকেই এমন আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে দিলাম যে কেউ আর তোমার কোন ক্ষতি করতে পারে না। বেটারা নিজেরাই এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে পালাবে।”

আমরা যখন ঘনাইবাবুর এই সব কীর্তিকলাপ দর্শনে ব্যস্ত তখনই আমাদের মধ্যে উপস্থিত লাটাইবাবু সাহস সঞ্চয় করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ঘনাইবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনি এত বড় একজন জ্যোতিষ শাস্ত্রী হওয়ায় আপনার বন্ধু হিসেবে আমরা গর্বিতই”।

ঘনাইবাবু লাটাই বাবুকে জিগ্যেস করলেন, ওনার রাশি ও লগ্ন কি ? যখন জানলেন যে লাটাইবাবুর রাশি ‘কন্যা’ এবং লগ্ন ‘বৃশ্চিক’, অমনি গড়গড় করে বলে গেলেন, “আপনার রাশির অধিপতি বুধ, বর্তমান বছরটি আগের তুলনায় বেশ শুভ, আপনার আত্ম বিশ্বাস প্রবল থাকার ফলে যে কোনও অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতা আপনার থাকবে।”

একথা শ্রবণ করে লাটাইবাবু নিতান্তই কাচুমাচু মুখ করে বললেন, “কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী ? একথা যে এই ভূভারতে কেহই বিশ্বাস করবে না”।

ঘনাইবাবু বললেন, “আপনি অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু সেটি আপনার ভিতর হ’তে প্রকাশ পাচ্ছে না, আর এর জন্য চাই তিনরতি ক্যাটস্ আই কিম্বা সাত রতি গোমেদ। আর আপনার লগ্ন ‘বৃশ্চিক’ তাই লগ্নের অধিপতি মঙ্গল, এই লগ্নের জাতক-জাতিকারা সত্যবাদী ও নিষ্ঠাবান হয়ে থাকেন, অপরিসীম ইচ্ছা শক্তির বলে সব কাজেই অগ্রসর হয়ে থাকেন।”

লাটাইবাবু আবার আমতা আমতা করে ক্ষীন স্বরে প্রতিবাদ করে বলেন-“বরং ঐ জিনিসটারই আমার জীবনে সর্বাপেক্ষা অভাব, আজ যদি আমার অপরিসীম তো দূরের কথা সামান্য একটু ইচ্ছাশক্তি থাকলেও থাকতো তাহলে আজ নিশ্চয়ই আপনার মত প্রতিভাবান কেউ একটা হতাম।” সে যাই হোক আমরা খবর নিয়ে জানলাম যে ঘনাইবাবুর প্রতিদিন দুই তিন জন করে খরিদ্দার হচ্ছে এবং দৈনিক দুই-তিন শত টাকা আমদানিও হচ্ছে।

তবে সেদিন একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, দুই একটি সৌজন্যমূলক বাক্য বিনিময় ছাড়া ঘনাইবাবুর বাড়িতে পুরো সময়টাই পটাইবাবু অদ্ভুত ভাবে শুধু নিশ্চুপ ছিলেন তাই নয়, ওনার চোখ মুখের মধ্যেও একটা অবিশ্বাস আর বিরক্তি ফুটে উঠছিল। যদিও ঘনাইবাবুর বাড়ি থেকে ফেরার সময়ে রাস্তায় ব্যাপারটা পরিস্কার হ’ল।

আমরা তিনজনই বাঙালী তাই যথারীতি ফেরার সময়ে রাস্তায় নেমেই ঘনাইবাবুর নিন্দা শুরু হ’ল, আর এব্যাপারে পটাইবাবুই অগ্রনী ভূমিকা নিলেন। বললেন, “বুঝলেন রায়বাবু, জ্যোতিষী হওয়া মোটেই অতো সহজ ব্যাপার নয়, অনেক সাধ্য সাধনা এবং দীর্ঘদিনের তপস্যার দ্বারাই প্রকৃত জ্যোতিষী হওয়া যায়। ও ব্যাটা ভেকধারী জ্যোতিষী হয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, আর এই লাইনে এখন ইনকাম বেশ ভালই।”

আমি পটাইবাবুর কথায় সম্মতি জানাতেই তিনি দ্বিগুন উৎসাহিত হয়ে বললেন, “তবে হ্যাঁ প্রকৃত জ্যোতিষী জীবনে আমি একজনকেই দেখেছিলাম, তিনি হলেন বাবা কনখলানন্দ মহারাজ!” এই কথা বলে পটাইবাবু দুবার দুহাত করজোড় করে কপালে ঠেকালেন।

আমি সভয়ে জিগ্যেস করলাম, “আপনি তার দেখা কেমন করে পেলেন ?”

উত্তরে পটাইবাবু বলে চললেন, “তিনি সুদূর হিমালয়ের কনখলে গভীর জঙ্গলে বর্হিজগৎ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এক গুহার মধ্যে বসবাস করেন, আমি কৈশোরে একবার হিমালয় দর্শনে গিয়ে ঐ মহামানবের সাক্ষাৎ পাই এবং কেন জানিনা প্রথম দর্শনেই আমাকে বাবার খুব ভালো লেগে যায়।”

আমি এবং লাটাইবাবু উভয়ে বললাম, “সত্যই তো এমন মহামানবের সাক্ষাৎ কয়জন পায়? আপনি প্রকৃতই ভাগ্যবান পটাইবাবু।”

পটাইবাবু আরও বলে চলেন, “আমি বাবার কাছে কিছু না চাইতেই বাবা আমাকে বললেন, আমি তোর কপালে এক দেবজ্যোতি দেখতে পাচ্ছি, তুই একদিন এই পৃথিবীতে একটা বিরাট কিছু হ’বি। এবং আরও নির্দিষ্ঠ ভাবে বলেছিলেন বড় হয়ে আমি অবশ্যই একজন কেউকেটা হ’ব, হয় উত্তম কুমারের মত অভিনেতা কিম্বা ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের মত ডাক্তার, অথবা গোষ্ট পালের মত ফুটবল খেলোয়ার হবই হব। অত বড় একজন জ্যোতিষী তার কথা কখনো বিফলে যেতে পারে?”

আমরা আরও কৌতুহল প্রদর্শন করে পটাইবাবুর দিকে তাকাতেই পটাইবাবু এক গভীর তৃপ্তির হাসি হেসে বলে চলেন “এখন আমাকে দেখে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে বাবা কনখলানন্দ মহারাজ কতবড় জ্যোতিষী ছিলেন। বাবা নিজেও বোধ হয় জানতেন না যে তার কথা এই ভাবে মিলবে, কারণ বাবা বলেছিলেন উপরের তিনজনের মধ্যে যেকোন একজনের গুণ আমার মধ্যে বর্তাবে। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা বাবার আশীর্বাদে এবং তাঁর শ্রী- চরণের স্পর্শে উক্ত তিনজনের গুনই আমি পেয়েছি।”

পটাইবাবুর একথা শ্রবণ করে আমি যারপরনাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যখন ভাবছি, তা কিভাবে সম্ভব ? একজন মানুষ কি করে একই সঙ্গে বিধানবাবুর মত ডাক্তার, গোষ্টবাবুর মত খেলোয়ার আর উত্তমবাবুর মত অভিনেতা হবেন ? আর তাছাড়া কনখলের গভীর জঙ্গলে বসবাস করে বহির্জগত থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন থেকে তিনি বিধান রায়, উত্তম কুমার কিম্বা গোষ্ট পালের মত বাঙালীদের চিনলেন কিভাবে ? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তাঁর মুখপানে তাকাতেই তিনি ব্যাপারটি খোলসা করলেন, “আসলে আপনারা নিশ্চই পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অংক করেছেন… ব্যাপারটা সেইরূপ। একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিলেই আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি অবশ্যই উক্ত তিনজনের গুণ পেয়েছি, তবে গুণগুলিকে সামান্য একটু ঘুরিয়ে নিলেই হবে। অর্থাৎ আমি উত্তম কুমারের মত ডাক্তার, বিধান রায়ের মত ফুটবলার এবং গোষ্ট পালের মত অভিনেতা অবশ্যই হয়েছি।”

অনুবাদ ছোটগল্প - ইন্দ্রানী ঘোষ

যুবরাজ
ইন্দ্রানী ঘোষ


(অস্কার ওয়াইল্ড-এর ছোটগল্প The Young Prince অবলম্বনে)

অমাত্যরা বিদায় নিয়েছে । যুবরাজ এই মুহূর্তে একা । একটু আগে বিশাল প্রাসাদের হলঘরে চলেছে আদব কায়দার প্রশিক্ষণ । সে একটা নিঃশ্বাস ফেলল । নকশা করা কুশানে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে রইল সে । চোখে তাঁর হরিণ শাবকের চঞ্চলতা । এক ব্যথার ইতিহাসে জন্ম যুবরাজের । রাজার একমাত্র সন্তান রাজকুমারী ভালবেসেছিলেন এক অনামা শিল্পী কে । তার আঙ্গুলে ছিল জাদু, ঠোঁটে বাঁশির সুর । ভালোবাসার মূল্য দিয়ে সরে যেতে হল তাঁকে । রাজকুমারীকে বিষ দেওয়া হল । সেই ভালবাসার ফল আজকের কিশোর যুবরাজ । তার জন্মের পর এক বিশ্বস্ত প্রহরী তাকে নিয়ে চলে যায় অরণ্যের ওপারে মেষপালকের কুটীরে । বৃদ্ধ রাজা মৃত্যুর সময় সেই পরিত্যক্ত শিশুটিকে রাজা ঘোষণা করলেন । সেই কিশোর যুবরাজের আজ রাত পোহালে অভিষেক ।

রাত্রি যখন বারটা, গোলাপজলে স্নান করান হল তাঁকে । বালিশে ছড়ান হল গোলাপের পাপড়ি । ঘুমে ঢলে পড়ল যুবরাজ। যুবরাজ ছিলেন সৌন্দর্য -এর পূজারী । তাঁর সমস্ত মন জুড়ে ছিল অভিষেকের সোনার পোশাক, তাঁর মুকুটের রুবি এবং তলোয়ারে খচিত মুক্তো । সমস্ত মন জুড়ে ঐশ্বর্য্য থাকা সত্ত্বেও তাঁর মনের নিভৃত কোণ ছিল ফাঁকা এবং তাঁর নান্দনিক বোধ তাঁর বুদ্ধিমত্তার মতই ভালবাসত একাকী উপাসক কে, আর সেই কারণে সে ছিল বহুজনের মাঝে একা।

মাঝরাত্রির পর ঘুমিয়ে পড়ল যুবরাজ, স্বপ্ন এলো দু’চোখ জুড়ে । সে দেখল এক তাঁতির ঘর, ছোট শিশুরা তাঁত বুনছে । তাদের আদুল গা, পেটে খিদে ।

চোখে আগুন ঝরিয়ে তাঁর দিকে তাকাল এক তাঁতি । তাঁতি প্রশ্ন করল “তুমি কে? আমাদের প্রভুর চর?”

“কে তোমাদের প্রভু?” বলল যুবরাজ ।

“আমাদের প্রভু আমাদের যুবরাজ,” বলে তাঁতি । “তাঁর রাজপোশাক বুনতে আঙুলের রক্ত ঝরিয়ে শেষ হয়ে যাব আমরা । আমরা তাঁর দাস”।

ঘুম ভেঙে যায় যুবরাজের । ঝরোখার ওপারে মধুরঙের চাঁদ তখন ধূসর রাতের আকাশে জেগে রয়েছে ।

আবার ঘুমিয়ে পড়ে যুবরাজ । এবার সে দেখে নীল সমুদ্র । সমুদ্রে ভাসছে এক একাকী জাহাজ । জাহাজের ডেকে শায়িত এক আফগান শেখ । সামনে তাঁর স্ফটিক এর বয়াম । একদল ক্রীতদাস সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ডেকে । শেখ হুকুম দিলেন আর একটি ক্রীতদাস কে ঠেলে ফেলে দেওয়া হল সমুদ্রে । কতগুলো বোবা চোখ তাকিয়ে রইল । লোকটা ভেসে উঠল এক মুঠো মুক্তো নিয়ে, আবার চলে গেল সমুদ্র গর্ভে । এবার ফিরে এলো এক বিশাল মুক্তো নিয়ে ।

“পাওয়া গেছে যুবরাজের তলোয়ার-এর মুক্তো’ - চেঁচিয়ে উঠল আফগান শেখ । চোখ দুটো লোভে চকচক করে উঠল । মুখে রক্ত তুলে জাহাজের ডেকে ঘুরে পড়ল ক্রীতদাস। মরণ তাকে আশ্রয় দিল নিজের কোলে ।

ঘুম ভাঙল যুবরাজের । ভোর তখন তার ধুসর আঙুল বিস্তার করছে মলিন হয়ে আসা তারাদের অস্তিত্বে ।

ভোরের দিকে আবার চোখ বুজে আসে যুবরাজের এবার সে দেখতে পায় এক নদীগর্ভ । কতগুলো মানুষ উপড়ে ফেলছে বড় বড় পাথরের চাঙড় । তাদের পায়ের নিচে দলে যাচ্ছে লাল ফুল শুদ্ধু ক্যাকটাস ।

এক গুহাতে বসে তাঁদের দেখছে লোভ ও মৃত্যু । মৃত্যু জিজ্ঞেস করে লোভকে - ‘তোমার কালো চাদরের নীচে কী লুকিয়ে রেখেছ?’

‘তিনটি শস্য’ - বলে লোভ ।

‘একটা শস্য আমার চাই’ - বলে মৃত্যু ‘আমার বাগানে রোপণ করব আমি’ । ‘নাআআআ আমি দেব না’, চিৎকার করে বলে লোভ ।

‘নদীগর্ভে তোমার যে দাসেরা কাজ করছে আমি তাদের সকল কে মেরে ফেলব’ - বলে মৃত্যু ।

লাল ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় মৃত্যু সেই লোকগুলোর দিকে । মুখে আগুন ঝরিয়ে বেরিয়ে আসে ড্রাগনের দল । হিসহিসিয়ে ওঠে বিষাক্ত সাপেরা । অট্টহাস্য করে মৃত্যু ।

‘নদীগর্ভে কারা ওরা ?’ -জিজ্ঞেস করে রাজপুত্র ।

‘ওরা তোমার মুকুটের রুবি খুঁজছে’ - বলে মৃত্যু । ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘুম ভাঙে যুবরাজের । অন্তঃপুরে তখন ভোরের আলোর বন্যা ।

মেষপালকের পরিত্যক্ত পোশাক টেনে বার করে রাজপুত্র, খুঁজে বার করে তাঁর বাঁশি । এবার সে ছুটতে শুরু করে নগরীর পথ ধরে গির্জার দিকে, যেখানে ক্রুশবিদ্ধ আছেন রাজার রাজা প্রভু যীশু ।

পাত্র মিত্র আমত্যরা হায় হায় করে ওঠে । কোথায় চলেছেন যুবরাজ এই বেশে, নগ্ন পায়ে ?

‘আমি স্বপ্ন দেখেছি’ -বলে সে ।

‘এই স্বপ্ন দেখা পাগল যুবরাজ আমাদের রাজা হতে পারে না, একে মেরে ফেলা হোক’ । তলোয়ার তুলে তারা ধাওয়া করে কিশোর যুবরাজকে ।

গির্জায় পৌঁছে প্রভু যীশুর পায়ে আছড়ে পরে যুবরাজ । এক অনির্বচনীয় আলো ঘিরে ধরে তাকে । গির্জার অর্গান আপনা হতে বেজে ওঠে । পাদ্রী বলেন ‘আজ রাজার রাজা আপনার অভিষেক করলেন, যুবরাজ আপনাকে প্রণাম জানাই’ ।

মন্ত্রীদের চোখ ভিজে ওঠে । খসে পড়ে তলোয়ার । বেদী থেকে নেমে আসে নতুন রাজা । এক সমুদ্র মানুষকে দু হাতে সরিয়ে হেঁটে চলে সে । রাজার চোখের দিকে চায় না কেউ, কারণ সেই চোখ দেবদূতের চোখ । সেই মুখে দেবদূতের জ্যোতি ।

অনুবাদ ছোটগল্প - বেলাল হোসেন

টেলিফোন কল
বেলাল হোসেন



( সৌজন্যেঃ অর্নব রায়চৌধুরী )


টেলিফোনে ভুলভাল কল এলে, যদি আমার হাতে সময় থাকে, আমি তখন ফোনের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটির সঙ্গে একটু খেজুরে-গপ্পো জুড়ে দিই । ততক্ষণে সে বুঝতে পারে যে ভুল লোকের সাথে কথা বলে অযথা সময় এবং অর্থব্যয় হচ্ছে। একটি অভিজ্ঞতার কথা জানাই।

অফিসে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমার একটি জরুরী ফোন করা দরকার। ফোন নম্বরটি বার করে রিসিভার তুলে ডায়াল করে বললাম

“ফ্রেড বলছি, আমি কি রবিন কার্টারের সাথে কথা বলছি ?” ফোনটা দড়াম করে রাখবার আওয়াজ পেলাম ! যেন মনে হল গালে এক সপাট চড় খেলাম । ভাবতেই পারলামনা যে মানুষ এত রূঢ় হতে পারে ! এর পরে ডাইরেক্টরী খুঁজে রবিনের সঠিক নম্বর বার করে ডায়াল করি। ও ভুল করে শেষ দুটো নাম্বার উল্টো বলেছিল আমাকে।

রবিনের সঙ্গে কথা শেষ হতেই আবার সেই রংনাম্বার লেখা চিরকূটটা টেবিলে রাখা আছে দেখতে পাই; সঙ্গে সঙ্গে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসে আমার। আমি ঐ নম্বরে আবার ফোন করি, যেই সে বলে উঠলো “হ্যালো” , আমি তাকে বলি “ তুই একটা আস্ত ষাঁড়” , বলেই লাইন কেটে দিই। আমি আমার টেলিফোন ডিরেক্টরিতে ষাঁড় লিখে তারপর ঐ নম্বরটা লিখে রেখে দিই। কিছুদিন ছাড়া ছাড়া , যেদিন আমার খুব খরচাপাতি হয়ে যায় কিংবা একটা বাজে দিন যায়, সেদিনই ওই লোকটিকে একবার আমি ফোন করি আর হ্যালো শুনলেই বলি “ষাঁড় কোথাকার”। এরকম করে আমি বেজায় তৃপ্তি পাচ্ছিলাম।

কিছুদিন পরে টেলিফোন কোম্পানী কলার আই ডি চালু করে, যা, আমার আনন্দ পাওয়ার পথের কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। একদিন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল। আমি ষাঁড়টাকে ফোন করে মোলায়েম সুরে বলি “ আমি টেলিফোন কোম্পানী থেকে বলছি, আপনার কি কলার আই ডি দরকার?” লোকটি খুব ক্রুদ্ধস্বরে খেঁকিয়ে “না না” বলে সেরকমই দড়াম করে ফোনটা রেখে দিল । আমি বুঝলাম এই সুযোগ, তাকে আবার যথারীতি ফোন করে ষাঁড় বলামাত্রই সে চেঁচাতে শুরু করে দিল।

পড়তে থাকুন, আরও আছে।

একদিন, একটি শপিং মলের ভেতরে পার্কিং প্লেসে আমি গাড়ি নিয়ে ঢুকি , দেখি এক মহিলা তাঁর গাড়িটা বার করবার কসরত করছে; দেখে মনে হচ্ছিল এ জীবনে বোধহয় আর গাড়িটা বেরোবেনা ! শেষ পর্যন্ত গাড়িটা বেরোয়, হঠাৎই আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এক বি এম ডবল্যু সেই ফাঁকা প্লেসটাতে ঢুকে যায়, ভাবটা এমন যেন আমার কোনো অস্তিত্বই নেই! আমি নিজেকে প্রবোধ দিলাম ‘ এ ব্যাটা আরেক ষাঁড়’। দুম করে আমার চোখে পড়ে, গাড়িটার পেছনে ফোন নম্বর সহ লেখা আছে “ ফর সেল”। নম্বরটি আমি টুকে নিই।

পরেরদিন অফিসে বসে বি এম ডবল্যু , মানে দ্বিতীয় ষাঁড়কে একটা ফোন করি, তাকে বলি আপনার গাড়িটা কি আপনি বেচবেন ? আপনার নাম কি ? থাকেন কোথায় ? কখন দেখা করা যাবে” ? সে বলে “হ্যাঁ মশাই, গাড়িটা বিক্রী করবার ইচ্ছে আছে, আমার নাম রবার্ট, থাকি ১৮০, থার্টিফোর্থ স্ট্রীটে, হলুদ রং এর বাড়ি; বিকেলবেলা বাড়িতে থাকি”। কথা শেষ করতেই আমি বলি “ তুই একটা মাথামোটা ষাঁড়”।

আমি খুব খুশিতে ছিলাম; দুই ষাঁড়কে নিয়ে আমার দিন খুব ভালোই কাটছিল। শেষ মেষ ভাবলাম এর একটা গ্র্যাণ্ড ফিনালে হওয়া দরকার।

একদিন বিকেলে প্রথম ষাঁড়কে ফোন করে চটিয়ে দিয়ে ফোনটা ধরে বসে থাকি। তখন সে বলে “ তুই কি এখনো আছিস?”

আমি বলি “ইয়েস” ।

“ তোকে সামনে পেলে...”

“ কী করবি?”

“পাছায় কষে লাথি কষাব”

“চলে আয়, ঠিকানা দিচ্ছি...” এই বলে আমি তাকে দ্বিতীয় ষাঁড়ের ঠিকানাটা বলে দিই।

“ আমি আসছি, আজ তোর গুষ্টির....”

এরপর আমি দ্রুত দ্বিতীয় ষাঁড়কে ফোন করে ক্ষেপিয়ে তুলি, সে বলে,

“তোকে যেদিন পাবো সেদিন তুই শেষ..”

“আমি আসছি তোর বাড়ি, দেখি তুই কী করতে পারিস!”

এরপর আমার কয়েকটা কাজ ছিল। প্রথমে আমি পুলিশকে,তারপর দমকল , তারপর একটা নিউজ চ্যানেলকে ফোন করে বলি “ থার্টিফোর্থ স্ট্রীটের ১৮০ নম্বর বাড়িটিতে গ্যাং ওয়ার লেগেছে, শীগগির যান।“

কিছুক্ষণ পরে আমি সেখানে যাই, দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে, গাড়ির ছাদে চেপে উঠে আমি দেখি কি, পুলিশ স্কোয়াডের সামনেই দুজনে মারামারি করছে, ও বি ভ্যান এসে গেছে, মায় মাথার উপরে একটা হেলিকপ্টার ও চক্কর মারছে ! যা দেখেছি, তা ইহজীবনে আর ভুলবোনা।

অনুগল্প - সন্দীপ নস্কর

উদ্দেশ্যহীন নিশাচর...
সন্দীপ নস্কর



সারা দিনের পর রাতটুকু সম্বল, ওটুকু সম্পুর্ণ নিজের। নাঃ, পরিবারেরও নয়। কারোর ব্যক্তিগত মলিকানা-ঐ সময়টায় নেই। এমনটাই আগাগোড়া ভাবত তুহিন। আগে সকালে অফিসের তাড়া থাকত, তাই না-চাইতেও ঘুম আসত। দশটা-সাতটা-র অফিসের চাপ সারারাত জুড়ে গোল পাকাত। তাই চাকরিটাও সে ছেড়ে দিয়েছে দু’বছর হল। রোজগার কমেছে, হাতখরচ কমেছে, জীবন যাপনে দৈন্য বেড়েছে, সঙ্গে লেখাটাও বেড়েছে।

আজকাল রাত ২ টোর আগে চাইলেও ঘুম আসে না । বাবা, মা, অবিবাহিত বোন, স্ত্রী এবং পাঁচ বছরের একটা ছেলে এই হল তুহিনের সংসার। বর্তমানে সে কম্পিউটার সারানো শিখে বিভিন্ন জায়গায় ছোটো ছোটো কাজ করে কোনোমতে সংসার চালায়। চাকরি ছাড়ার পর তার এই আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন বাড়ির কেউই ঠিকঠাক মেনে নিতে পারেনি।

একমাত্র বুবুন খুব খুশি, বাবাকে একটু বেশিক্ষণ কাছে পায় তাই। আর একজন তার লেখার অন্ধ সমর্থক আছে এ বাড়িতে। সে হল তুহিনের একমাত্র বোন মিনি, তার সমস্ত লেখার প্রথম গুনমুগ্ধ পাঠিকা।

বাকি সবাইকে শোনালে এমন একটা ভাব করে, যেন কি একটা বালাই। বলতে চায়, গরিবের ঘরে এ কেমন ঘোড়া-রোগ ? কবিতা দিয়ে তো এক কেজি চালও পাওয়া যায়না, কি লাভ লিখে ?

যাই হোক কম্পিউটার নিয়ে কাজের সূত্রে তুহিনেরও একটা কম্পিউটার হয়েছে, যদিও পুরানো পেন্টিয়াম-৪ মেসিন, জুড়ে-জাড়ে বানানো, তবু মোটামুটি চলে যায়। এখন তুহিনের একটা ফেসবুক পেজ রয়েছে কবিতার, সে যা লেখে সেখানেই পোষ্ট করে। কিছু মানুষ পড়ে, ভালো-মন্দ কমেন্ট দেয় ওটুকুতেই খুশি ছিল তুহিন।
হঠাৎ একদিন ইন্টারনেটে একটা প্রকাশনীর সাথে তার যোগাযোগ হয়। তাদের নম্বরে ফোনও করে সে। প্রকাশনীর অফিস থেকে তাকে বলা হয় একদিন এসে তার পান্ডুলিপি জমা দিয়ে যেতে।

একটা গ্রীষ্ম-কালের মৃত আকাশ যেমন কালবৈশাখীর ঝড়ে আবার বেঁচে ওঠে, তেমনি ভাবে বেঁচে ওঠে তুহিনের স্বপ্ন। মনে হয় আর দেরি নেই, এবার নিজের সখ আর পেশা এক হবে, জীবনের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাও চলবে হাতে হাত ধরে।

সে সারারাত জেগে হাতে লিখে, তার পছন্দের ৭০টা কবিতার একটা পান্ডুলিপি তৈরী করে, পরের দিন সেই প্রকাশনীর অফিসে দিয়ে আসে। মনের মধ্যের চাপা উচ্ছ্বাস বোনের সাথে ভাগ করে নেয়। বোন বলে দেখিস দাদা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর কবিতার বই এবার নিশ্চয়ই ছাপা হবে।

আশায় আশায় কয়েকদিন কেটে যায় তুহিনের। দিন দশেক পর প্রকাশনীর অফিস থেকে একটা ফোন আসে। - "হ্যাঁ তুহিনবাবু,আপনার পান্ডুলিপিটা পড়লাম, খুব ভালো কবিতাগুলো। যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আমরা আগামী বইমেলায় আপনার বইটি প্রকাশ করতে চাই। "

বাকিটুকু না শুনেই তুহিন তার আনন্দ প্রকাশ করে ফেলে, বলে- "অনেক ধন্যবাদ স্যার, আপত্তি কিসের ? বলুন আমায় কি করতে হবে ?" প্রকাশক বলেন, -"না-মানে আমরা নতুন কবিদের রিস্ক, সম্পূর্নটা নিই না। প্রথম ১০০০ কপি ছাপানোর যা মূল্য, তার অর্ধেক আপনাকে দিতে হবে। মানে - ছাপাতে খরচ পড়বে প্রায় ২৬০০০/-টাকা, আপনাকে ১৩০০০/- টাকার মত দিতে হবে।"

তুহিন বলে- "নাঃ স্যার, ছেড়ে দিন। আমাদের কাছে মনে হয়, সত্যই লেখালিখিটা একটা বিলাসিতা । আমায় ক্ষমা করবেন, আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য।" ফোনটা কেটে যায়, স্বপ্ন গুলো ভেঙে যায়।
তুহিন ভাবে আর কোনোদিন লিখবেনা সে। কবিতা, গল্প, গান কিচ্ছুনা। কিন্তু পারেনা, কবি কবিতাকে ভুলতে চাইলেও কবিতা কবিকে ভুলতে দেয়না। মাথার মধ্যে আজো নিরালা ক্ষণে কবিতারা জট পাকায়, নার্ভকোষে শঙ্খ লাগিয়ে দেয়, তুহিন তাদের খুন করতে পারে না। আজো তাই নিশাচর কলম চালায়, উদ্দেশ্যবিহীন। আজো সারা দিনের পর রাতটুকু সম্বল, ওটুকু সম্পুর্ণ নিজের। নাঃ, পরিবারেরও নয়। কারোর ব্যক্তিগত মলিকানা-ঐ সময়টায় নেই।

ছোটগল্প - রুমনি সেন

প্রতিমার গল্প
রুমনি সেন



প্রতিমার তৃতীয় সন্তানটিও মেয়েই হল । অর্থাৎ নীপার জন্ম হল । পরপর দুবারই মেয়ে হওয়ায় সে প্রচন্ড হতাশায় ভুগছিল । তৃতীয়বার গর্ভবতী হওয়ার পর আবার আশায় বুক বেঁধেছিল, এবার নিশ্চয়ই ছেলে হবে । ভগবান কি এত নিষ্ঠুর হবে তার প্রতি। ঠাকুর তুমি মুখ তুলে চেও, দয়া করো, এবার যেন ছেলে হয় । সে সব সময় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে চলছিল । কিন্তু সব আশা আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দিয়ে এবারও মেয়ে হল ।

প্রতিমা প্রচন্ড ক্রোধে মেয়ের দিকে তাকাল । বিছানার এক কোণে কাঁথাকাপড় জড়ানো ছোট্ট একটা মানুষ । কম্পিত গলায় ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে চলেছে । তার একটুও মমত্ববোধ হল না, বুকে জড়িয়ে নেবার ইচ্ছে হল না, বরং তাকে বিরাট বোঝা মনে হল । ঘাড়ের উপর দুটো আছে, তার সঙ্গে এটাও যোগ হল । এখন সেবা করো, নাওয়াও, খাওয়াও পড়াশুনা করাও তারপর এক গাদা টাকা খরচ করে বিয়ে দাও । উঃ অসহ্য ।

এরপর প্রায় বারো বছর কেটে গেছে । প্রতিমার আর একটি সন্তান হয়েছে । পুত্রসন্তান । বুবুন । নীপার থেকে এক বছরের ছোট । পুত্রটি অনেক আদরে ভালোবাসায় প্রশ্রয়ে বড় হচ্ছিল আর তিনটি মেয়ে অনাদরে অবহেলায়, খানিকটা মাতৃহীনের মত বড় হতে লাগল । তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে হল নীপা । সে মার আঁচল ছাড়তে চাইত না । সব সময় মা মা করে মাকে আঁকড়ে ধরতে চাইত । মায়ের স্নেহহীনতা তার বড় দুই দিদি মেনে নিলেও সে মানতে পারে নি । সে ভেবে আকুল হত তার কি অপরাধ, মা তাকে কেন অবহেলা করে, কেন ভালোবাসে না । একদিন মা তাকে প্রচন্ড ঘৃণা ভরে বলল, এমন মা মা করে ন্যাকামি করিস না । তুই কি কচি খুকি না কি? বিয়ে দিলে এখনই বাচ্চার মা হয়ে যাবি । সেদিন নীপা সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল । লুকিয়ে, কারণ কারুর চোখে পড়ে গেলে আবার সেই ন্যাকা, কচি খুকি ইত্যাদি বিশেষণ শুনতে হবে ।

প্রতিমা দাপিয়ে সংসার করছিল । তার স্বামী কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী । স্ত্রীর সেবা যত্নে স্ত্রীর কেনা গোলাম হয়ে আছে । সংসারের ব্যাপারে স্ত্রী যেটা বলবে সেটাই শেষ কথা । তিন মেয়ে মাথায় মাথায় বড় হয়ে উঠল । তিন মেয়েই বেশ সুশ্রী । বড় মেয়ে ক্লাস টেনে উঠতেই মা বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল । ছেলে থাকে আন্দুলে । সেখানে তার একটা মুদী দোকান আছে । তাদের কোন দাবি দাওয়া নেই । প্রতিমা অবশ্য আগেই জানিয়ে রেখেছে তারা কিছু দিতে পারবে না । মেয়েদের ডেকে নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার কাউকে বলবি না ছেলের মুদীদোকান আছে । বলবি ছেলে বিজনেস করে ।

নীপা ভয়ে ভয়ে বলল, দিদির তো এখন মাত্র পনেরো বছর বয়স। এখনও তো বিয়ের বয়স হয় নি। প্রতিমা তাকে ঠাস করে এমনভাবে চড় মারল যে সে মাথা ঘুরে বসে পড়ল। হারামজাদী ! তোর মতামত আমরা জানতে চেয়েছি ? কিন্তু পরে এই কথাটাই তাদের প্রতিবেশিনী জানতে চাইল,এই বয়সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছো কেন প্রতিমাদি ? জানো না আঠেরোর আগে বিয়ে দেওয়া বেআইনী। প্রতিমা বলল, দিচ্ছি কি আর সাধে ? এরপর ফিসফিস করে প্রতিবেশিনীর কানে কানে কিছু বলল। তার দুই চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, তাই না কি ! হা কপাল! খুব ভালো করছ । তাড়াতাড়ি আপদ বিদেয় করো।

নীপা ছোট ছিল, বুঝতে পারে নি। কিন্তু বড় হয়ে, সংসারাভিজ্ঞ হয়ে বুঝতে  পেরেছিল, মা দিদির নামে কিছু অভিযোগ করেছিল ওই প্রতিবেশিনীর কাছে, এবং অভিযোগটা সম্পূর্ণ বানানো।

বড় মেয়ের বিয়ের পরের বছর মেজ মেয়ের বিয়ে হল। অবশেষে নীপার পালা এল। নীপা তখন ক্লাস টেনে পড়ে। তার জন্য একটি সুপাত্র নিয়ে এল মা। বয়স তিরিশের উপর। তার দুই জামাইবাবুও তার দিদিদের থেকে বয়সে বড়, দ্বিগুণ বড়। নীপার ক্ষেত্রেও অন্যথা হল না। ছেলে একটি জুটমিলে চাকরি করে। পাত্র যখন মেয়ে দেখতে এল, নীপার প্রাণ উড়ে গেল। রোগা ক্যাকলাসের মত চেহারা। পিঠটা ধনুকের মত বাঁকা। চোখদুটো করমচার মত লাল। নীপা পাত্রপক্ষের সামনেই হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। পাত্রপক্ষ বুঝতে পারল না (কিংবা বুঝেও না বোঝার ভাণ করল) এই কান্নার কারণ, তারা বলল, আহা এত কান্নার কি আছে? এখনই কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? কদিন দেরি আছে। আর বিয়ের পর যখন ইচ্ছে তুমি মা বাবার কাছে আসতে পারবে। দূরে তো চলে যাচ্ছ না। ইত্যাদি ইত্যাদি।

পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর নীপা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বিয়ে করব না, পড়াশুনা করব। মা হিংস্রভাবে বলল, পড়াশুনা করবি ? পড়ে উলটে দিবি তাই না ? আসলে ছেলের চেহারা দেখে পছন্দ হয় নি, তাই তো ! আমার যখন বিয়ে হয়েছিল ওনার চেহারাও রোগা ছিল। আমার সেবাযত্নে স্বাস্থ্য ফিরেছে। এত যদি ভালো চেহারার উপর লোভ, তাহলে আমাদের ঘাড় থেকে নেমে যা,ভালো চেহারাওলা ছেলে জুটিয়ে নিয়ে বিয়ে কর।
নীপা কাঁদতে থাকল। মার চোখদুটো রাগে ধকধক করতে লাগল, কি রে চুপ করে আছিস যে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওকে জানিয়ে দিচ্ছি এই পাত্র তোমার মেয়ের পছন্দ নয়।
নীপা আতংকে কাঠ হয়ে গেল। বাবা? সে তো আরো ভয়ংকর। সে বলল,না না বাবাকে বোলো না।
তাহলে তোর মত আছে?
নীপা জলভরা চোখে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, মত আছে।

শুরু হল নীপার বিবাহিত জীবন। ছোট্ট কিশোরী মেয়ে স্বামীর ঘরে এল, স্বামী
সেবা করতে এল, শুধু একটাই কারণে, বাবা মা তাকে আর বাড়িতে রাখতে চায় না। সেই কবে জন্ম দিয়েছি। তার জন্য এখনও খাইয়ে পরিয়ে রাখতে হবে এ কেমন কথা। সহ্যের একটা সীমা আছে। নীপার বাবা মা মেয়েদের পনেরো ষোলো বছর পর্যন্তই সহ্য করেছিল, তারপর আর নয়।
বিয়ের পর স্বামী তাকে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে এল। সে যে জুট মিলে কাজ করত
সেখানেই বস্তিতে একটা ঘর নিয়ে থাকতে লাগল। নীপা এমন বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত নয়। এখানে এসে নীপার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। একটা ছোট্ট ঘর। ঘরের সামনে একফালি বারান্দা তাতেই রান্না করতে হয়। বাথরুম পায়খানা সব ভাগের। জল নিয়ে বাথরুম নিয়ে রোজ ঝগড়া লড়াই। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তার বাচ্চা হবে। স্বামী তার সুখসুবিধার দিকে ফিরে তাকায় না। বাড়িতে শুধু রাত্রিবেলাটাই থাকে। সংসারের প্রয়োজনে টাকা পয়সা খরচ করে না। মদের নেশাও আছে তার। নীপার সঙ্গে সে বিশেষ ভালো ব্যবহার করে না। মাঝে মাঝে চড়-থাপ্পড়ও কষিয়ে দেয়।

জ্বালা জুড়োতে দুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে গেলেও তার মা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি তবুও রেহাই নেই। আবার জ্বালাতে আসছে। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু মুখে কিছু না বলেও এমন ব্যবহার করে যে নীপা বাপ বাপ করে বাপের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।

নীপার প্রথম সন্তানটি মৃত জন্মাল। নীপার বয়স তখন সতেরো। এর দুবছর পর দ্বিতীয় সন্তান জন্মাল। তার দুবছর পর আবারও সে গর্ভবতী হল। ইতিমধ্যে বাবা মারা গেছে। হাই-প্রেশারের রুগি ছিল, ডায়াবেটিসও ছিল। খাওয়া দাওয়ায় কোন কন্ট্রোল ছিল না। মাছ মাংস সমানে চালাতো। তার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল। বাবা কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিল। বাবার চাকরিটা ভাই বুবুন পেয়েছিল।

একদিন বুবুন এল দিদিকে বাবার বাৎসরিকের নিমন্ত্রন করতে। দিদিকে দেখে সে স্তম্ভিত। তার অমন মিষ্টি দিদির এ কি চেহারা হয়েছে। হাড়ের উপর চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই। পেটটা বিশাল। দেখে তার হৃৎকম্প হল।

সে বলল, দিদি তোর এ কি চেহারা হয়েছে?
দিদি ভাইয়ের এ হেন সহানুভূতির কথা শুনে কেঁদে ফেলল। ভাইকে অনেক দুঃখের কথাই বলল। বুবুনের মনে হল, আমি যদি মেয়ে হতাম তাহলে তো আমাকেও এই ভাবেই অন্য একটা বাড়িতে পাচার করা হত, আর আমারও এই দশা হত। তার মনে একটা অপরাধবোধ জন্মাল। সে দিদির কাছে দুদিন থেকে গেল। দিদির খুব কেয়ার নিতে লাগল। দিদি কি খাবে কি ভালোবাসে জেনে নিয়ে সেগুলো কিনে দিল। ভাগনিকেও খেলনা, জামা ইত্যাদি কিনে দিল।

দুদিন পর প্রতিমা সেখানে ছুটে এল। ছেলে একবেলার নাম করে দিদির বাড়ি গিয়ে
আর ফেরার নাম নেই। এসেই নীপাকে ধমকাতে লাগল, তুই আমার ছেলেটাকে এই বস্তির মধ্যে রেখে দিচ্ছিস ?

মা আমিও তো তোমার মেয়ে আর আমিও এই বস্তিতেই থাকি।
প্রতিমা মুখ বেঁকিয়ে বলল,তোর কথা বাদ দে। মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। এই তো তোর বাবা এতবড় অফিসার ছিল,আমি কি কষ্ট করি নি ? সেখানে তোর বর তো কারখানার শ্রমিক। তোকে তো কষ্ট করতেই হবে।

এরপর প্রতিমা তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ে না হলে ছেলেরা ঘরমুখো হয় না। তার মেয়েরা যা চিজ। কে জানে কখন ছেলেটাকে তুকতাক করে তার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। পাত্রী অর্থাৎ সোমাকে প্রতিমাই পছন্দ করল। বয়স আঠেরো উনিশ। পড়াশুনা বিশেষ করে নি। ফাইভ কি সিক্স অবধি। ওর না কি ছোটবেলায় ব্রেনে কিছু একটা অসুখ হয়েছিল, তাই ডাক্তার না কি বলেছিল বেশি পড়াশুনা যেন না করে। তাহলে ব্রেনের ক্ষতি হবে। তা না করুক। বেশি পড়াশুনাওলা মেয়েরা খুব দেমাকি হয়। গুরুজনদের মানতে চায় না। সোমা বেশ লাজুক আর নীচুস্বরে কথা বলে। আর ভাবী শাশুড়িকে প্রনাম করে তার পায়ের কাছেই বসে রইল। কিছুতেই সেখান থেকে উঠলো না। খুব ভালো লাগল প্রতিমার। এইরকম ঠান্ডা শান্ত মেয়েই তার পছন্দ। এই মেয়েকে বশে রাখা যাবে। নিজের মত করে চালানো যাবে। প্রতিমা ভেবেছিল ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে বাকি জীবনটা নির্ঝঞ্ঝাটে বেশ সুখে কাটাবে। কিন্তু তার দুঃখের দিন শুরু হল ছেলের বিয়ের পর।
এক দুপুরবেলা খাওয়ার পর সোমা সেজেগুজে এল, মা, ও বলেছে আজ সিনেমায় নিয়ে যাবে ইভনিং শো। ও অফিস থেকে বেরিয়ে হলে অপেক্ষা করবে। আমি যাচ্ছি। যাই?
প্রতিমা রেগে গেল, যাবে বলে তো ঠিক করেই রেখেছ। সব কিছু ঠিক ঠাক করে তারপর এসেছ আমার অনুমতি নিতে?
সোমা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক আছে যাও। সাবধানে যাও। তাড়াতাড়ি ফিরবে। বেশি রাত করবে না।
কেন ও তোকে বলে নি ?
কি ক্কি ক্কিইইই ! কি বললে তুমি ?
না বলছিলাম আমি তো ভেবেছিলাম ও আপনাকে জানিয়েছে।
না, তুমি আগে কি বললে আবার বলো।
কি আবার বললাম ? আমি কি করলাম, আমি তো বুঝতে পারছি না।
তুমি আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করছ, আবার বলছ কিছু বুঝতে পারছি না ?
কি বললেন? আমি তুই-তোকারি করেছি। আপনি সব সময় আমার সঙ্গে এমন করেন। কেন,আমি কি করেছি? ঠিক আছে,আপনি যখন চান না আমি যাব না। না না না আমি যাব না,যাব না,যাব না।
সোমা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে গেল। প্রতিমা বুঝল খুব শক্ত পাল্লায় পড়েছে। এবার ছেলে আসবে। তার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে, নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হবে।

বুবুন এসে তুমুল ঝগড়া শুরু করল। বিয়ের পর এই প্রথম একদিন সিনেমার প্রোগ্রাম করেছিলাম। তোমার তাও সহ্য হল না ? ভেস্তে দিলে ? তুমি কি মানুষ ?
ভেস্তে দিয়েছে তার বৌ। মা নয়। একথা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করল না প্রতিমা। লাভ নেই।

প্রতিদিন সোমা তার নতুন নতুন কৌশল চালাতে লাগল আর প্রতিমার জীবনটা নরকে পরিণত করে দিল। এর মধ্যে সোমার একটি ছেলেও হয়েছে কিন্তু স্বভাব বদলায় নি।
এক দুপুরবেলা শাশুড়ি খেতে বসেছে,সে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল। কাল্পনিক বিড়ালকে তাড়াতে লাগল, যাঃ যাঃ, খালি খাওয়া, খালি খাওয়া। গেলার গোঁসাই।

প্রতিমার খাওয়া মাথায় উঠল। প্রচন্ড ক্রোধ, কিন্তু একটা কথা বলার উপায় নেই। চিৎকার করে কেঁদে ভাসাবে। পাড়াপ্রতিবেশীকে সচকিত করে দেবে। তার পর কান্না মুলতুবী রেখে ঘুমোবে। আর বুবুন এলে বাকি কান্নাটা কাঁদবে। প্রতিমা চুপচাপ ভাতের থালা এঁটো বাসনের স্তুপে রেখে এল। সোমাও পিছন পিছন এল। মুখে মিষ্টি হাসি,এ কি খেতে পারলেন না ? এ বাবা হে হে।
সোমা তাকে অহরহ জ্বালাতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্যও সে শত্রুতা ভুলত না। হয়ত প্রতিমা খেতে বসেছে, সোমা চিৎকার করে উঠল,এই বিধবা বুড়িটাকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। সহ্য করা মুশকিল। প্রতিমা ভাতের থালা দূরে ঠেলে তাকে জিজ্ঞেস করল, সে কেন এমন কথা বলছে। ব্যস এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিল সোমা। সে এমন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল যে পাশের বাড়ির মহিলা ছুটে এল। সোমা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, সব সময় আমার সাথে এমন করেন। আমি খালি সিরিয়াল দেখতে দেখতে বলেছি এই বুড়িটাকে আমি দেখতে পারি না। তো উনি আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করেছেন। আমি এখানে থাকব না। আমি চলে যাব নয়ত মরব। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমি মরব মরব মরব।
প্রতিবেশিনী মহিলা বলল, কেন রাগ করছ প্রতিমাদি ? ওতো তোমাকে বলে নি। আমরাও তো সব সময় বলি, জন্মভূমির বুড়িটা খুব শয়তান। তুমি কেন নিজের গায়ে মেখে নিচ্ছ ? আমি তো দেখছি তোমার একটা মানসিক রোগ দাঁড়িয়ে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা সোমার মড়াকান্নার আওয়াজ শুনেই প্রতিমা বুঝতে পারল বুবুন ফিরেছে। সে ছেলের কাছে গিয়ে বলল, আমি আর তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারব না। অনেক হয়েছে।
বুবুন গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে বলল, তা তো পারবেই না। ছেলের বৌকে হিংসে করো তা কি আর জানি না। সব সময় ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো। কেন কি জন্য? ও কি ভেসে এসেছে? জানো ও ওর বাবা মায়ের কত আদরের ? তোমার মেয়েদের মত বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো নয়।
ওসব কথা ছাড়। তোর বৌ কি জিনিস তুই তা ভালো করেই জানিস। কম দিন তো ঘর করছিস না। সব জেনেশুনেও ওকে মদত করছিস। অন্য কেউ হলে হাত পা ভেঙে দিত।
হ্যাঁ, তাই তো চাও। হাত পা ভেঙে দিই আর জেলে যাই। তুমি ওকে পছন্দ করে এনেছ। আমি তো প্রেম করে বিয়ে করি নি। এখন তুমি যদি অ্যাডজাস্ট করে থাকতে না পার সেটা তোমার প্রবলেম। আমার ওকে নিয়ে কোন প্রবলেম হচ্ছে না।

প্রতিমা পৃথক হয়ে গেল। খুবই যন্ত্রণাময় নিরানন্দ জীবন। ছেলে তার জীবনের সব কিছু ছিল। এখন ভাবলেই হাসি পায়। এই ছেলে কি তারই ছেলে ? না, এ হল সোমার বর। অথচ এর জন্যই তার কত ব্যাকুলতা ছিল। ছেলে হচ্ছে না বলে মনে কত যন্ত্রণা ছিল। এখন ভাবলেই অবাক লাগে ! প্রতিমা যা পেনশন পেত তাতে ভালোভাবেই চলার কথা। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে নানা রোগ ব্যাধিতে ধরে ফেলেছিল। সুগার প্রেশার, গাঁটে ব্যথা। ডাক্তারে ওষুধেই সব টাকা পয়সা বেরিয়ে যেত। আর পৃথক হয়েও বৌয়ের বাক্যবাণের হাত থেকে মুক্তি পায় নি। সব সময়েই বিষ মাখানো কথার তীর তাকে ছুঁড়ে ছুড়ে মারত সোমা।

সেদিনটা ছিল প্রচন্ড শীত। প্রতিমার দুদিন ধরে জ্বর। সারা গায়ে ব্যথা। শুয়ে শুয়েই জলের বোতলের দিকে হাত বাড়াল। বোতল খালি, একফোঁটা জল নেই। প্রতিমা কাতরাতে লাগল। লজ্জার মাথা খেয়ে সোমাকেই ডাকাডাকি করতে লাগল,সোমা সোমা, আমাকে একটু জল দেবে মা? কোন সাড়া নেই। হতাশ হয়ে প্রতিমা নিজেই ওঠার চেষ্টা করল। সেই সময় পাশের ঘর থেকে সোমায় বিকট চিৎকার শোনা গেল,ওসব নকশাবাজি অন্য জায়গায় দেখাস। বুঝলি ? প্রতিমা চোখের জলে ভাসতে লাগল। কি করেছে সে ? কেন এই ব্যবহার ? ভাবতে ভাবতে জবাব পেয়ে গেল। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তিন মেয়ের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তা মনে পড়ে গেল। নীপা একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,
আমার সঙ্গে এমন করছ কেন ? কি করেছি আমি ?
কি বললি ? মুখে মুখে তর্ক ? এই বলে নীপাকে প্রচন্ড মার মেরেছিল। পান থেকে চুন খসলেই প্রচন্ড মার খেত মেয়েরা। সে নিজে মারত, স্বামীকেও লেলিয়ে দিত। আজ বারবার নীপার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মায়ের শরীর একটু খারাপ হলে নীপা কি রকম উদ্বিগ্ন হত। বার বার মায়ের কপালে হাত রেখে দেখত জ্বর আছে কি না।
প্রতিমা তখন বিরক্ত হত। কারণ সে মেয়েকে গায়ে পড়া বা তোষামোদকারী ছাড়া আর কিছু ভাবে নি। মেয়েদের ভালোবাসা সে চায় নি। সে চেয়েছিল স্বামী আর ছেলের ভালোবাসা।
দুদিন পর শরীরটা একটু সুস্থ হতেই প্রতিমা নীপার বাড়ি রওনা হল। আমি শেষ জীবনটা আমার মেয়ের সঙ্গেই কাটাব। মেয়ে আমাকে যেমন রাখবে তেমন থাকব। অন্তত মরার সময় মেয়ে মুখের কাছে জলটুকু তো ধরবে।

বছর খানেক হল নীপারা নতুন বাড়ি করেছে। জমি আগেই কেনা ছিল। দেড় কাঠারও কম। অনেক কষ্টে অনেক কৃচ্ছসাধন করে এই বাড়িটা করতে পেরেছে। পাঁচ ইঞ্চি গাঁথনি,অ্যাসবেস্টসের ছাদ। বাইরের দেয়ালে এখনও প্লাস্টার হয় নি। দুটো ছোট ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, সামনে এক টুকরো বারান্দা। এটুকু করতেই জিভ বেরিয়ে গেছে তাদের। ওই বস্তির ঘরে অনেকগুলো বছর কাটানোর পর এই বাড়িতে এসে নীপা নিজের জীবনটাকে অনেক সফল মনে করে। সে তার নতুন বাড়ি ঘর সব সময় ঝকঝকে করে গুছিয়ে রাখে। তার মেয়ে পড়ে ক্লাস টেনে, ছেলে এইটে। দুজনেই লেখাপড়ায় বেশ ভালো।
প্রতিমা সন্ধ্যে নাগাদ সেখানে পৌঁছল। নীপার দুই ছেলেমেয়ে তখন পড়াশুনা করছিল। একটি শুঁটকো চেহারার টাক মাথা বুড়ো মন দিয়ে টিভি দেখছে। বুড়োটা কে ? ও হরি। এতো তার জামাই। নীপা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিল। ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে এল। নাইটির উপর একটা পুরনো কার্ডিগান পরেছে। হাতা দুটো কনুই অবধি গোটানো। মাথার চুলগুলো পিছনে জড়ো করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো। তার মেয়ে এখনো কচিই আছে। বয়সের ছাপ বিশেষ পড়ে নি। আর কতই বা বয়স হবে। চৌত্রিশ, পঁয়ত্রিশ। প্রতিমার বুকটা কেমন করে উঠল। আহা, এই বয়সেও কত মেয়ে বিয়ে না করে থাকে, স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করে। আর সে মেয়েদেরকে সাত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে ছাড়ল। এখন যদি নীপা অবিবাহিত থাকত তাহলে কি ওরা এত বাড়তে পারত।
নীপা মাকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল।
তুমি ? কি মনে করে ?
তোর কাছে এলাম। চল রান্নাঘরে। তুই কাজ কর, আমি কথা বলি।
ঠিক আছে এসো।
আসলে জামাইয়ের সামনে সব কথা বলতে চায় নি বলেই মেয়ের সঙ্গে রান্নাঘরে যাওয়া।
নীপা মায়ের সব কথাই শুনল। খুব গম্ভীরভাবে। তারপর বলল,দেখো মা, তুমি তো তোমার কোন ব্যাপারে মেয়েদের উপর নির্ভর করো নি। মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়ায় তাও চাও নি। বাচ্চা বয়সে সবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ। আমার যখন বিয়ে দিয়েছ তখন আমার বয়স পনেরো। তোমার জামাইয়ের বয়স তখন তিরিশের বেশি। জুটমিলের শ্রমিক, সামান্য মাইনে। মদের নেশা ছিল, অন্য দোষও ছিল। আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত না। মারধোরও করত। সব সহ্য করে থেকেছি। কোথায় যাব। একদিনের জন্য তোমার কাছে গেলেও তুমি বিরক্ত হতে। আমি তাই সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে স্বামীর ঘর করতাম। এখন তোমার জামাইয়ের মাইনে আগের চেয়ে বেড়েছে। মদের নেশাও অসুখ বিসুখের কারণে ছেড়েছে। আর এখন ও অনেক বদলে গেছে। আমার গায়ে আর হাত তোলে না। আমিও ওই স্বামীর সঙ্গেই মানিয়ে গুছিয়ে আছি। তুমি আর আমার সংসারে অশান্তি করতে এসো না।
জামাই সম্ভবত আড়াল থেকে সবই শুনেছে। সে চেঁচাতে লাগল, তখন থেকে এক কাপ চায়ের জন্য বলছি। শুনতে পাচ্ছ না? শুনবে কি করে, গপ্পের ঝুলি খুলে বসেছ যে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এই যে দিচ্ছি।
জামাই স্বগতোক্তি করতে লাগল, যতসব আপদ আমার ঘাড়ে এসে চাপে।
প্রতিমা এরপর বেশিক্ষণ মেয়ের বাড়ি থাকে নি। ফিরে এসেছে।

এর কয়েক মাস পরই তার মৃত্যু হয়। শাশুড়ির মৃত্যুর পর সোমা ভয়ানক কাঁদল।
প্রতিদিন মা মা করে কাঁদতে লাগল। শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত তার কান্না চলল।
দেখে লোকের তাক লেগে গেল। শাশুড়ি তো বৌকে কম জ্বালাত না। কিন্তু দেখো ওই শাশুড়ির জন্যই কেমন কেঁদে ভাসাচ্ছে। লাল পাড় সাদা শাড়ি, রুক্ষ চুল।
কান্নায় চোখদুটি ফোলা। সোমা বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল তার এলাকায়।

শ্রাদ্ধশান্তি সব শেষ। সোমার মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। আপদ গেছে। শাশুড়ির গয়না গাটি সব আগেই হাতিয়েছে। তিন মেয়ে অনেক আশা করে এসে খালি হাতে ফিরে গেছে। এবার সব কিছু নতুন করে গোছগাছ করতে হবে। শাশুড়ির ঘরটা সে ছেলের পড়ার ঘর করবে। আর ডাইনিং স্পেসে টিভি রাখবে। আগে টিভি ছিল তাদের শোয়ার ঘরে। ডাইনিং স্পেসে ছেলে পড়ত। সে রান্না করতে করতে টিভি দেখতে পারত না। এখন আর সেই সমস্যা নেই। আঃ, সন্ধ্যে বেলার সিরিয়ালগুলো এখন মনের সুখে দেখা যাবে। শাশুড়ির অনেক দামী দামী শাড়ি আছে, পুরনো দিনের। ওসব শাড়ি এখন আর পাওয়াই যায় না। সেগুলো নিয়ে পছন্দমত জারদৌসি কাজ করিয়ে নেবে। বড়দার মেয়ের বিয়ে যখন হবে তখন পরলে যা লাগবে না। উঃ দারুণ হবে। আর শাশুড়ির পুরনো দিনের খাট আলমারি বিক্রি করে হাল ফ্যাশনের কি কি আসবাবপত্র কিনবে সে বিষয়েও নানা পরিকল্পনা করতে লাগল।

কিন্তু সে জানতে পারল না, একজন আছেন। তিনি সোমাকে নিয়ে কিছু ভিন্ন পরিকল্পনা করেছেন। সেগুলো তিনি আসন্ন ভবিষ্যতে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করবেন। যেমন প্রতিমার ক্ষেত্রে করেছেন।